এক.
জননন্দিত অথচ অল্পপঠিত কথাসাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১) বিষাদসিন্ধু দ্বারা অধিক পরিচিত হলেও আরেকটি উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি হলো জমীদার দর্পণ (১৮৭৩) নাটক। একজন জমিদার বংশের উত্তরপুরুষ হয়ে ঘরের খবর এভাবে জনসম্মুখে প্রকাশ করেছেন শুধু সাধারণ নিপীড়িত মানুষের স্বার্থে। বাংলা সাহিত্যাকাশে এমন বিপ্লবী সমাজসংস্কারক তিনি একা নন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহসহ অনেকেই। তারা নিজেদের শিকড়ের কুসংস্কারগুলো ফুটিয়ে তুলে সমাজের আমূল পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দু সমাজের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দু সমাজের গোঁড়ামি ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন পরিবেশের তীব্র সমালোচনা করে সংস্কারধর্মী সাহিত্য রচনা করেছেন। আবুল মনসুর আহমদ ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ মুসলমান সমাজের ধর্ম ব্যবসা, মাজারপূজা, এমনকি প্রচলিত তথাকথিত রাজনীতিরও সমালোচনা করেছেন। এক্ষেত্রে আবুল মনসুর আহমদের ‘হুজুর কেবলা’ ও ‘ফুড কনফারেন্স’ গল্প দুইটি এবং সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু উপন্যাস উজ্জ্বল উদাহরণ। তাদের অনেকই আগেই মীর মশাররফ হোসেন নিজ শিকড়ের কুসংস্কার ও জমিদারদের শাসন-শোষণ, অত্যাচার, নারীলিপ্সা ইত্যাদি তুলে ধরে সমগ্র জাতিকে উদ্ধারের প্রয়াস চালিয়েছেন।
মীর মশাররফ হোসেন কাল্পনিক বিষয় নিয়ে নয়, বরং বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে নাটক লিখেছেন। তিনি জমীদার দর্পণ-এর ‘উপহার’ অংশে লিখেছেন—‘জমীদার বংশে আমার জন্ম, আত্মীয় স্বজন সকলেই জমীদার, সুতরাং জমীদারের ছবি অঙ্কিত করিতে বিশেষ আয়াশ আবশ্যক নহে।’ অর্থাৎ আরোপিত ধারণা তিনি পুস্তকাবদ্ধ করেননি, বরং বেশ সাবলীলভাবেই তার নিজের অভিজ্ঞতা উল্লেখ করেছেন এই নাটকে। এই নাটকের ঘটনা বাস্তবতার ওপর ভিত্তি করে লেখা। নাটকের ‘প্রস্তাবনা’ অংশে সূত্রধার বলেছে, ‘জমীদার দর্পণ নাটকে যে নকশাটি এঁকেছে, তার কিছুই সাজানো নয়, অবিকল ছবি তুলেছে।’ মীর মশাররফ হোসেন তার অপ্রকাশিত আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছেন, ‘জমিদার দর্পণ হাতে লিখিয়া আমার বাটীতে কুমারখালীতে কয়েকবার অভিনয় করা হয়। শেষ অভিনয় দিনে আনার মোল্লাকে (‘এই মোল্লার স্ত্রীই জমিদারের অত্যাচারে প্রাণ হারাইয়াছিল-পাদটীকা] উপস্থিত করিয়া দর্শকগণকে দেখান হইয়াছিল। সত্য ঘটনামূলক নাটক অভিনয় সময় নাট্যোল্লিখিত ব্যক্তিগণ সকলেই জীবিত।’ মীর মশাররফ হোসেন এভাবেই বাস্তবতাকে নাটকে উপস্থাপন করে শুধু জমীদারদের নয়, বরং ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধেও কণ্ঠস্বর সরব করেছেন।
আবার ইসলাম ও হিন্দু ধর্মাবলম্বী তথাকথিত ধর্মব্যবসায়ীদেরও কটাক্ষ করতে বাদ দেননি কালজয়ী অসাম্প্রদায়িক লেখক মীর মশাররফ হোসেন। একইসঙ্গে তৎকালীন সমাজবাস্তবতায় নারীদের অবস্থা এবং তাদের প্রতি অত্যাচারী জমিদারদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং যৌননির্যাতনের কথাও তুলে ধরেছেন পরম মমতায়। সামগ্রিক বিচারে জমীদার দর্পণ নাটকটি জমিদার শ্রেণির মুখোশ উন্মোচনে ও স্বরূপ নির্ণয়ে কালের দলিল হিসেবে এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর জমিদারী প্রথায় নারীদের অবস্থা উপস্থাপনের প্রমাণ হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে।
দুই.
‘জমীদার দর্পণ’-এ তিনটি নারী চরিত্র রয়েছে। তারা হলো নূরন্নেহার, আমিরণ আসীনা ও কৃষ্ণমণি। আরেক নারীর কথা উল্লেখ আছে যিনি মহারানি ভিক্টোরিয়া। নির্যাতিত প্রজা আবু মোল্লার সুন্দরী স্ত্রী নূরন্নেহার দলিত মানুষের প্রতিনিধি। আবু মোল্লা অন্যায়ের বিরুদ্ধে যতটা না সোচ্চার, নূরন্নেহারকে তার চেয়েও বেশি সোচ্চার ও সরব করে উপস্থাপন করেছেন মীর মশাররফ হোসেন। তার সম্পর্কে আবুল আহসান চৌধুরী বলেন, ‘স্বামী আবু মোল্লার তুলনায় নূরন্নেহারের চরিত্র অনেক বেশি প্রাণবন্ত ও উজ্জ্বল।’ তিনি আরও লিখেছেন, ‘সতীত্বরক্ষায় যে দৃঢ় সংকল্প, অত্যাচারী জমিদারের প্রতি তার আছে ক্ষোভ, স্বামীপ্রেম, একনিষ্ঠতা, চারিত্রিক দৃঢ়তা—সব মিলিয়ে নূরন্নেহার বিশেষ উজ্জ্বলতা নিয়ে উপস্থিত।’
সবচেয়ে শক্তিশালী নারীকণ্ঠ হিসেবে জমীদার দর্পণ নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্র হলো নূরন্নেহার। সে দেখতে সুন্দরী কিন্তু প্রজা দরিদ্র আবু মোল্লার স্ত্রী। গরিব চাষীর ঘরে সুন্দরী স্ত্রী থাকাকে ব্যঙ্গ করে হায়ওয়ান আলী বলেছে, ‘চাষার হাতে গোলাপ ফুল।’ এছাড়া আরও বলেছে, ‘পাকা আম দাঁড়কাকে খায়।’ এভাবেই জমিদার হায়ওয়ান আলীর নারীলোলুপতার প্রকাশ ঘটে। সুশ্রী নূরন্নেহারকে পেতে সে মরিয়া হয়ে ওঠে।
হায়ওয়ান শব্দের আভিধানিক অর্থ জানোয়ার। জানোয়ারের প্রায় সব পাশবিক বৈশিষ্ট্যগুলোই তার মধ্যে ফুটে উঠেছে। নাটক শুরুই হয়েছে তার নারী লিপ্সা এবং নূরন্নেহারের বলিষ্ঠ ও শক্তিশালী ভূমিকার মধ্য দিয়ে। নূরন্নেহারের নারীশক্তির প্রমাণ হায়ওয়ান আলীর উক্তির মাধ্যমে পাওয়া যায়। সে প্রথম মোসাহেবকে লক্ষ করে বলছে, ‘কিন্তু ভারি চালাক, কিছুতেই নড়ছে না।’ নূরন্নেহারকে বধ করার জন্য নানা ফন্দি আটতে থাকে। অবশেষে নিরীহ প্রজা আবু মোল্লাকে ধরে এনে কোন কারণ ছাড়াই পঞ্চাশ টাকা জরিমানা করে দেওয়া হয়। জরিমানার টাকা তার না থাকায় তার মাথায় ইটের বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়। এদিকে আবু মোল্লাকে জরিমানা করার নিহিত কারণ হিসেবে বলা যায়, আবু মোল্লার ওপর শাস্তি চলতে থাকলে বাড়িতে নূরন্নেহার একা ও দুর্বল হয়ে পড়বে। অন্তত তার স্বামীকে বাঁচানোর জন্য হলেও সে জমিদারের কুপ্রস্তাবে রাজি হয়ে যাবে। তাই, আবু মোল্লার ওপর চলতে থাকে শারীরিক নির্যাতন আর আবু মোল্লার স্ত্রীকে বশ করার নতুন প্রচেষ্টা হিসেবে কৃষ্ণমণি ভিক্ষা করার অজুহাতে আবু মোল্লার বাড়িতে যায়। ভিক্ষার চাল এনে বাইরে দিলে চুপি চুপি কৃষ্ণমণি নূরন্নেহারকে বলে, ‘আজ রাত্রে যদি তাঁর বৈঠক খানায় যেতে পার, তা হলে যত রাগ দেখছো একেবারে জল হয়ে যাবে। তুমি উল্টে আবার ডবল টাকা ঘরে আনতে পার্ব্বে।’ এমন প্রস্তাবে কড়া প্রতিবাদ করে নূরন্নেহার জানিয়ে দেয়, ‘প্রাণ থাকতে আমা হতে এমন কুকাজ হবে না—আমি বৈঠকখানায় কখনো যেতে পা’র্ব্বো না।’ কৃষ্ণমণি পীড়াপীড়ি করলে সে বলে, ‘সে কাজ আমি পার্ব্বো না, জান থাকতে তো নয়! আগে আমায় খুন করুন, তারপর যা ইচ্ছে তাই ক’র্ব্বেন।’ এই সময় নূরন্নেহার আক্ষেপ করে বলে, ‘হাকিমে এমন ক’রে অবিচারে মা’ল্লে কার কাছে দাঁড়াব? এর পর যদি হাকিমের পর হাকিম থাকতো, তবে এর বিচের হতো।’ অপকর্মে লিপ্ত করতে ব্যর্থ কৃষ্ণমণি এই মন্তব্যগুলো হাজারগুণে বর্ধিত করে জমীদারে করিৎকর্মা চাকর জামালের কাছে পৌঁছায়। এদিকে নূরন্নেহার ‘ঘৃণা ও বৈরক্তির দৃষ্টিতে’ আমিরণের নিকট চলে যায়। এভাবেই নূরন্নেহার তার শুধু সতীত্ব রক্ষা নয়, বরং একইসঙ্গে শক্তিশালী নারীকণ্ঠের পরিচয় দিয়েছে।
নূরন্নেহার গর্ভবতী হওয়া সত্ত্বেও পার পায় না হায়ওয়ান আলীর বিকৃত যৌনাকাঙ্ক্ষা থেকে। তার স্বামী আবু মোল্লাকে শাস্তি দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি বরং বিরক্তির সঙ্গে ঘোষণা দিয়েছে, ‘আমি মোল্লা চাইনে, নূরন্নেহার চাই।’ মোসাহেব হায়ওয়ানকে বলে, ‘আপনাকে উপরে হাকিম দেখাতে চায়, এতদূর বুকের পাটা।’ প্রত্যুত্তরে হায়ওয়ান জানায়, ‘এখনি তার হাকিম দেখাচ্ছি।’ তারপরেই চাকরবাকরকে হুকুম করে গর্ভবতী নূরন্নেহারকে জোরপূর্বক ধরে নিয়ে আনায়।
দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় গর্ভাঙ্কের শেষে নেপথ্যে যে দুটি কণ্ঠস্বর শোনা যায়, তার প্রথমটি নূরন্নেহারের। সে চিৎকার করতে থাকে ‘ছোট বিবি ম’লেম, আমায় নিয়ে চ’ল্লো, এইবারে গেলেম!’ এই আক্ষেপ এই আর্তনাদ শুধু নূরন্নেহারের না, বরং নির্যাতিত নীপিড়িত হাজারো বাঙালি নারীর, সকল প্রজার স্ত্রী-মা-বোনের।
দ্বিতীয় অঙ্কের তৃতীয় গর্ভাঙ্কে নুরুন্নেহার দুশ্চরিত্র হায়ওয়ান আলীর মুখোমুখি হয়। নূরন্নেহার করুণভাবে বলতে থাকে, ‘আপনি সব ক’র্ত্তে পারেন। আমি আপনার প্রজা, আমি আপনার মেয়ে, আপনি আমার বাপ। জাত্ মান রক্ষা ক’ত্তেও আপনি, প্রাণ রক্ষা ক’র্ত্তেও আপনি। আমি আপনার মেয়ে, আপনি আমার বাপ। (রোদন) আপনিই আমার জাত্ কুল রক্ষা ক’র্ব্বেন।’
যখন নূরন্নেহারকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন নেপথ্যে তার চিৎকার ও আক্ষেপ শোনা যায়। তার এই চিৎকার একজন অসহায় নারীর চিৎকার। তার কণ্ঠস্বর খুব দূর থেকে শোনা যায় না। তবে, জমিদারের অত্যাচরের বিরুদ্ধে এই চিৎকার খুব উল্লেখযোগ্য। আমিরণ নীরব হলেও নাটকের বিষয়বস্তু উপস্থাপনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।
নূরন্নেহারের দৃঢ়তা, প্রতিবাদস্পৃহা এবং অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ দেখা যায়। সে বলে, ‘পারেন বলে কি একেবারে মেরে ফেলবেন? এই কি জমীদারের বিচের, জমীদার বাপের সমান, কোথায় প্রজার ধনপ্রাণ-মান রক্ষা করবেন, ও মা তা গেলো মাটি চাপা। উল্টে দিতে ডাকাতি।’ এই প্রতিবাদের পরেও নিজের সতীত্ব রক্ষা করতে পারেনি। তবে সে নিজে চুপও থাকেনি। শরীরের কাপড় বেসামাল হলে জমিদারকে বলেছে, ‘আমার কাপড় বেসামাল হলো, কাপড় পরি, ছেড়ে দিন।’ এই ‘ছেড়ে দিন’ শব্দ দুইটি তার নিজেকে রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টারূপে ব্যবহৃত হয়েছে।
এছাড়া শক্তিশালী নারীকণ্ঠের অধিকারী নূরন্নেহার নিজের সতীত্ব হারানোর পরেও চুপ থাকেনি। শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্ব পর্যন্ত বলিষ্ঠ কণ্ঠে সে তার কথা বলেছে। সে কৃষ্ণমণির মতো নীরবে অত্যাচারীর অত্যাচার সহ্য করেনি। কিংবা আমিরণের মতো নিভৃতে শুধু জমিদারের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করেনি। বরং পুরো নাটকে একমাত্র নারীচরিত্র হিসেবে নূরন্নেহার দুই বার অত্যাচারী লম্পট জমিদারের শাস্তি কামনা করেছে। প্রথমবার কৃষ্ণমণিকে বলেছিল, ‘হাকিমে এমন ক’রে অবিচারে মা’ল্লে কার কাছে দাঁড়াব? এর পর যদি হাকিতের পর হাকিম থাকতো তবে এর বিচের হতো।’ আবার ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃত্যুর পূর্বে বলেছে, ‘খাঁ সাহেব! আপনার মনে এই ছিল? এই ক’ল্লেন? খোদায় আপনার বিচার ক’র্ব্বেন। শুনেছি, যে মহারানি সকলের ওপরে বড়, সাহেবদের ওপরেও বড়, আমরা যেমন তোমার প্রজা, তেমনি তুমিও তাঁর প্রজা! তিনি কি এর বিচার কর্ব্বেন না?’ এভাবে জীবনের অন্তিমকালে ‘খাঁ সাহেব’ উচ্চারণ করে তার নামে সৃষ্টিকর্তা ও মহারানি নিকট বিচার প্রার্থনা করায় একদিকে যেমন তার অসামর্থ্য ও অপারগতা প্রকাশ করে, তেমনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হিসেবেও প্রকাশিত হয়।
অ্যাডওয়ার্ড ডব্লিউ সাঈদ ব্যবহৃত ‘আদার’ ও ‘আস’ পরিভাষা ‘জমীদার দর্পণ’ নাটকেও প্রাসঙ্গিক। যদিও তিনি প্রাচ্য সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ধারণা এবং ঔপনিবেশিক শাসনামলের অবস্থা ও ব্যবস্থা বোঝাতে ব্যবহার করেছিলেন, তবু ক্ষমতার তারতম্য ব্যাখ্যা করতে সেটা এই নাটকে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। সাধারণত ‘আদার’ ও ‘আস’ অর্থাৎ ‘তারা’ ও ‘আমরা’ ধারণাটির আদলে ‘জমীদার দর্পণ’ নাটকে ইংরেজ শাসকশ্রেণী হলো ‘আস’ এবং এদেশের সবাই ‘আদার’। তবে, জমীদার যেহেতু শাসক শ্রেণীর, তাই ক্ষুদ্র পরিসরে তাকে ‘আস’ এবং প্রজাদের ‘আদার’ বলা যায়। যার হাতে ক্ষমতা থাকে, তখনই সে ‘আস’ হয়ে যায়। আর শাসিত সবসময়েই ‘আদার’-এর মধ্যে পড়ে। অর্থাৎ নূরন্নেহার এই ‘আদার’-এর প্রতীক। তাকে অত্যাচারী জমিদারের অত্যাচারই শুধু ভোগ করতে হয়নি, বরং সর্বশেষে নিজের জীবনটুকুও হারিয়েছে।
আবার, নূরন্নেহার দলিত জনগোষ্ঠী বিশেষভাবে দ্বৈত-দলিত নারীসমাজের প্রতিভূ। নূরন্নেহার প্রথমত একজন প্রজা, দ্বিতীয়ত প্রজার স্ত্রী। অর্থাৎ একজন সাবঅল্টার্নের অধীনস্থ। সে শুধু শাসক শোষক গোষ্ঠারই আজ্ঞাবহ না, বরং শোষিত এক প্রজারও অধিনস্থ। তবে দুই বার দলিত প্রমাণিত হওয়ার পরেও তার কণ্ঠস্বর শোনা যায়। যদিও ভারতীয় গবেষক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক লিখেছেন, দলিতরা কথা বলতে পারে না। ‘জমীদার দর্পণ’ নাটকে দলিতরা কথা বলতে পারে না। তবে তাদের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের ভাষা থেমে নেই। তাদের কণ্ঠস্বর কিছুটা সরব। তবে ইচ্ছাকৃতভাবেই হোক কিংবা ক্ষমতা থাকার কারণেই হোক, তাদের কণ্ঠস্বর এড়িয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের প্রতি সুবিচার তো করা হয়ই না, বরং নির্বিচারে অত্যাচারের পর ভিটেছাড়া করা হয়। এ বিষয়ে অরুন্ধতি রায়ের একটি মন্তব্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। তিনি লিখেছেন, ‘দলিতরাও কথা বলতে পারে। তবে তাদের কথা বলতে দেওয়া হয় না অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে তাদের এড়িয়ে যাওয়া হয়।’ ‘জমীদার দর্পণ’ নাটকে নূরন্নেহারকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে দেখা যায়, অত্যাচারী লম্পট জমিদারের বিরেুদ্ধে বিচার চাইতে দেখা যায়, কিন্তু তার পরেও তার এই আর্তনাদ, প্রতিবাদ ও কণ্ঠস্বর ইচ্ছাকৃতভাবে এড়িয়ে যাওয়া হয়। সে কণ্ঠস্বর জমিদার হায়ওয়ান আলীকে পরাস্ত করতে পারেনা। তার কণ্ঠস্বর বিচারেকের কান পর্যন্ত যেতে দেওয়া হয় না। তার এই বিচার মহারানি ভিক্টোরিয়া পর্যন্ত পৌঁছানো হয় না।
নূরন্নেহারের তুলনায় কম শক্তিশালী তবে অন্য নারীচরিত্রের তুলনায় শক্তিশালী হলো আমিরণ। নূরন্নেহারের ননদ আমিরণ, অর্থাৎ আবু মোল্লার বোন। জমিদারের চরিত্র উন্মোচনে তার ভূমিকা প্রশংসনীয়। কৃষ্ণমনী জমিদার হায়ওয়ান আলীর কুপ্রস্তাব নিয়ে নূরন্নেহারের কাছে এলে সতীসাধ্বী ও স্বামীভক্ত নূরন্নেহার তাকে ফিরিয়ে দেয়। তারপর কৃষ্ণমণির আগমনের কারণ জানতে চাইলে আমিরণকে চুপিচুপি সব বলে দেয়। তখন আমিরণ বলে, ‘ওদের মেয়ে মানুষ দেখলেই চ’ক টাটায়, জমীদার হলেই প্রায় এক খুরে মাথা মুড়নো।’ সে আরও বলে, ‘এদেশের জমীদারের অনেকের দশাই তো এই।’ এভাবেই সে জমিদারদের সম্পর্কে মন্তব্য করে। এছাড়া যখন নূরন্নেহারকে জোরপূর্বক তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন নেপথ্যে তার চিৎকার ও আক্ষেপ শোনা যায়। তার এই চিৎকার একজন অসহায় নারীর চিৎকার। তার কণ্ঠস্বর খুব দূর থেকে শোনা যায় না। তবে, জমিদারের অত্যাচরের বিরুদ্ধে এই চিৎকার খুব উল্লেখযোগ্য। আমিরণ নীরব হলেও নাটকের বিষয়বস্তু উপস্থাপনে শক্তিশালী ভূমিকা পালন করে।
নূরন্নেহারের মতো প্রতিবাদ ও আমিরণের মতো অন্যায়ের প্রতি ঘৃণা তো দূরের কথা, অন্যায়কে অন্যায় বলে স্বীকৃতি দিতেই পারেনি কৃষ্ণমণি। তার চরিত্রে চিরাচরিত কুটনি নারীর বৈশিষ্ট্য ফুটে উঠেছে। সে টাকার জন্য সব করতে পারে। নিজের আদর্শ বিকিয়ে দিতে পারে, ধর্মের নামে শপথ বলে অবলীলায় মিথ্যা বলতে পারে। নিজে নারী হওয়ার পরও আরেকজন নারীর সতীত্ব নষ্টে সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। স্বার্থান্বেষী ও সুবিধাভোগী চরিত্রের প্রকাশ ঘটেছে কৃষ্ণমণির মাধ্যমে।
তিন.
‘জমীদার দর্পণ’ নাটকে নারী সমাজের বাস্তবতা ও তাদের ক্ষমতাকে বিভিন আঙ্গিক থেকে দেখানো হয়েছে। মহারানি ভিক্টোরিয়া ‘সাহেবদেরও ওপরে বড়’। তাকে মহাশক্তিশালী নারী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে ভিক্টোরিয়াকে চরিত্র হিসেবে এই নাটকে ব্যবহার করা হয়নি বরং তার ক্ষমতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এটার মাধ্যমে মীর মশাররফ হোসেন হয়তোবা নারী ক্ষমতায়নের বিষয়টি ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কিংবা নারীরাও শুধু অত্যাচারিত না, বরং নিজেরাও ক্ষমতায় আসিন হতে পারে এবং নিজেদের অধিকার রক্ষায় বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করতে পারে।
নাটকের সক্রিয় নারীচরিত্রগুলোর মধ্যে নিপীড়িত প্রজা আবু মোল্লার সুন্দরী স্ত্রী নূরন্নেহারের ভূমিকা সবেচেয়ে উল্লেখযোগ্য। তাকে দেখানো হয়েছে অত্যাচারিত হিসেবে যে তার অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেও নিজেকে রক্ষা করতে পারেনি। এছাড়া আমিরণ নামক আরেকটি নারী চরিত্র অঙ্কিত হয়েছে স্বল্প পরিসরে যার হৃদয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ঘৃণা রয়েছে কিন্তু সাহস নেই সেটা প্রকাশ করার। অবশেষে কৃষ্ণমণির মাধ্যমে একজন ব্যক্তিত্যহীন নারীকে তুলে ধরা হয়েছে। এছাড়া কৃষ্ণমণি ও আমিরণের কণ্ঠ থেকে আরও কিছু নাম না-জানা অত্যাচারিত নারীর কথা জানা যায় যারা এই জমিদার কিংবা জমিদারদের দ্বারা সতীত্ব হারিয়েছে। এভাবেই বিভিন্ন আঙ্গিক থেকে নারী কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরেছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শক্তিমান সাহিত্যিক মীর মশাররফ হোসেন।
নারীর দুর্দশা দেখাতে গিয়ে, সত্য উন্মোচন করতে গিয়ে এবং নারী কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরতে গিয়ে পরোক্ষভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন, নারীদের নিজেদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ও কণ্ঠস্বরকে যথাযথ জায়গায় পৌঁছানোর জন্য নিজেদের নূরন্নেহারের মতো কিংবা আরও শক্তিশালী ও বলিষ্ঠভাবে প্রস্তুত করতে হবে। তবেই নূরন্নেহারের মতো আর কোনো নারীকে অত্যাচারী জমিদারের, অর্থাৎ সমাজের প্রভূদের হাতে নিজের মান-ইজ্জত কিংবা জীবন হারাতে হবে না।