—পান্তা খাছি।
—কী দিয়ে খেয়েছ খুশি?
—আললেই খাছি নবণ দিয়া, ছালুন আবার কুন্টি পামো?
—তোমার বোন কী খেয়েছে?
—আপা কিচু খায়নি, মিচ্চিয়ানা পান্তা আছল, হামি শুধু খাছি। আপাক খাবার কছনু, আপা কলো তুই ছোটো মানুষ, তুই খেয়ে নে।
ঢাকা থেকে আসার পর খুশবুর সঙ্গে এখনো তোহার দেখা হয়নি। তোহার মন-মেজাজ একদম ভালো নেই, তারপরও খুশির সঙ্গে ফুরফুরে মেজাজে কথা বলে। আসলে প্রেমিকার বাড়ির কুকুরকে দেখলেও চুমু খেতে ইচ্ছে করে, ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। আর খুশি তো খুশবুর নিজের ছোট বোন।
তোহার ভেতরে হাজার হাজার পাহাড়ি অজগর একসঙ্গে ফুঁসছে। চাকরির ভাইভা দিতে দিতে অনেকটা সে ক্লান্ত, ওর কাছে মনে হচ্ছে, চাকরি দেওয়ার নামে সার্কাস চলছে দেশে।
একটা চাকরির ভাইভায় যাওয়ার আগে অনেক ধাপ পার করতে হয়। প্রথমে প্রিলি পরীক্ষা, তারপর লিখিত পরীক্ষা, সবশেষে ভাইভা। ভাইভায় ভালো করতে পারলেই চাকরি। নতুবা না। মামা বা খালু থাকলে ভিন্ন কথা, তাদের তো কোনো ধাপই উৎরাতে হয় না!
তোহা লিখিত পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নম্বর তোলে, কিন্তু ভাইভায় ভালো করতে পারে না। তোহা যে খারাপ ছাত্র, তা না। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। এছাড়া লিখিত পরীক্ষায় তো ভালো করেই। সমস্যা হয় ভাইভায় গিয়ে। সে চটজলদি উত্তর দিতে পারে না। বিশেষ করে, নাম মনে রাখতে পারে না। লাস্ট ভাইভায় তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল যে, নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর কে? সে বলতে পারেনি, আসলে সে জানতো, কিন্তু নাম মনে করতে পারছিল না। যেইমাত্র সে ভাইভা রুমের বাইরে পা দিয়েছে, তার মনে পড়লো—অমর্ত্য সেনের নাম।
সড়ক দুর্ঘটনায় একসঙ্গে ওর মা-বাবা দুজনই মারা যান, এরপর থেকে ওর এ অবস্থা। তোহা সিদ্ধান্ত নিয়েছে—সে আর চাকরি করবে না। এরপরই সে ঢাকা ছেড়ে এসেছে।
খুশবুও মাস্টার্স পাস করে বসে আছে। গরিবের মেয়ে। বসে থাকলে দিন যায় না। তার নিজের পেট আছে। সঙ্গে পুরো পরিবারের কথা ভাবতে হয়। বুড়ো বাপে আর কী করবে! সে শহরে গিয়ে একটা টিউশনি করায়। এই টিউশনির টাকা দিয়ে সংসার চালায়। সারাদেশের মতো এই শহরেও মেয়েরা নিরাপদ না। রাস্তা-ঘাটে-বাসে মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। দিনকে দিন তা বেড়েই চলছে। একমাস আগেও খুশবুর এক বান্ধবী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। প্রথমে পুলিশ মামলা নিতে চায়নি। পরে জল ঘোলা হলে নিয়েছে কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো বিচার হয়নি। ধর্ষক বুক ফুলিয়ে দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ পুলিশ বলছে, আসামিকে তারা খুঁজে পাচ্ছে না। তবে, শিগগির ধরা পড়বে।
খুশবুর বুক ধুঁকপুক করে সবসময়। যখন সে বাড়ি থেকে বের হয়, বুড়ো বাপ আর ছোট বোনের দিকে জুলজুল করে চেয়ে থাকে—এই তার শেষ দেখা হতে পারে—যদি ভাগ্যে খারাপি লেখা থাকে।
কিন্তু গতকালের ঘটনায় সে ঘর থেকে আর বেরোনোর সাহস পাচ্ছে না, আবার একটা মেয়ে রেইপ হয়েছে। এইটা স্বাভাবিক, অপরাধের বিচার না হলে অপরাধ বেড়ে যায়। তারা মিয়া মেয়ের চেহারা দেখে বুঝতে পারে সব। মেয়েকে বলে, মা তোর বাড়িত থেকে কুন্টিও যাওয়া লাগবিনে।
বাপের কথা শুনে খুশি বললো, হামরা তালে না খেয়ে মরমু আব্বা? আপা পড়াবের না গেলে নবণ দিয়ে পান্তাও তো জুটবিনে! হামি তো না খেয়ে থাগবের পারিনে।
তারা মিয়া মানুষের ফসলের ক্ষেতে কাজ করতো, কিন্তু এখন সে উপায়েও নেই। বন্যায় সব ডুবে গেছে। হয়তো রাত না হতেই এই থাকার বাংলাঘরটাও বানে ভেসে যাবে। পানি শোঁ শোঁ করে আসছে, পানির স্রোত দেখলে মনে হয় বিষধর সাপ শিকারি তাড়া করছে।
যে জমিতে তারা মিয়ে ঘর তুলে আছে, সে জমিটা তার নয়। এই জমির মালিক ঢাকায় থাকে। দয়া করে থাকতে দেয়নি, প্রতি পাঁচবছর অন্তর বিশ হাজার টাকা দিতে হয়। এই টাকা দিতেই হিমশিম খায় তারা মিয়া। প্রতি বছর বন্যা হয়, ঘর ভেসে যায়, নতুন করে ঘর তুলতে হয়। এতেও অনেক টাকা লাগে। বাজারে গেলে টিভিতে খবর দেখে যে, সরকার বন্যার্তদের ঘর তৈরি করে দেবে। তারা মিয়ার এতদিনের অভিজ্ঞতায় জানা হয়ে গেছে—সরকার কতদূর করতে পারে। এই যে চালের বাজার আগুন। পঞ্চাশ টাকা কেজি চাল, এই গরিব মানুষগুলোর এত দাম দিয়ে চাল কেনার সাধ্য আছে? সরকার বাহাদুর বলে, কেউ তো না খেয়ে মরছে না! সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, মাথাপিছু আয় ষোলশ মার্কিন ডলার। এসব পরিসংখ্যান এই গরিব লোকদের সঙ্গে ঠাট্টাতামাশা করা না?
রাত আর হতে দিলো না। পৃথিবীতে সন্ধ্যা নামার আগেই বন্যার পানিতে বাড়ি-ঘর ডুবে গেলো। তারা মিয়া দুই মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে স্কুল ঘরে উঠলো। স্কুলের মাঠে অনেক বানভাসি মানুষ এসে জড়ো হয়েছে। গরু-ছাগল, হাঁস-মুরগি, কুকুর-বিড়াল, মানুষ—সব একসঙ্গে গাদাগাদি হয়ে আছে। চেয়ারম্যান এখানে থাকে না, তার ষণ্ডাপাণ্ডারা এখানে থাকে। চেয়ারম্যান পরিবারের সঙ্গে শহরে থাকে। ভোটের আগে এখানে কয়েকদিনের জন্য আসে, ভোট শেষ হয়ে গেলেই আবার শহরে চলে যায়।
বাড়িটা ছিল তোহাদের, কিন্তু কায়দা করে লিখে নিয়েছে চেয়ারম্যান। তোহার বাবা ছিলেন স্কুলমাস্টার। খুব নরম মানুষ ছিলেন। চেয়ারম্যানের চাতুরি বুঝতে পারার মতো মানুষ ছিলেন না। তবে বেঁচে থাকলে হয়তো নিজের জমি উদ্ধার করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তো জানতেনই না যে, জমি তার আর নেই, চেয়ারম্যান লিখে নিয়েছে। তিনি তো নিজের ঘরবাড়ির মতো বসত করেছেন।
চেয়ারম্যান অন্য মানুষ না, তোহার নিজের চাচা। স্কুল পার হওয়ার আগেই তোহার মা বাবা মারা যান। কলেজ পাস এই বাড়ি থেকেই করেছে তোহা। এ গ্রাম থেকে সে আর খুশবুই প্রথম দুই কৃতি সন্তান, যারা সরকারি আজিজুল হক কলেজে পড়ার সুযোগ পায়। তোহা চান্স পেলেও চেয়ারম্যানের ছেলের চান্স হয় না। তখন থেকেই চেয়ারম্যানের মনে একটা ক্ষোভ জন্মে। সে ভাতিজার ভালো সহ্য করতে পারে না। কিন্তু রাগটা জাহির করে না, পুষে রাখে। চেয়ারম্যান দ্বিতীয় চোট পায় তখন, যখন তার ছেলের কোনো পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স হয় না আর তোহা চান্স পায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
তোহা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়ার খবর শুনে প্রথমে তার চাচার কাছে আসে, মা-বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো তাদের কাছে যেতো। এখন চাচা-চাচিই তার মা-বাবা, অবিভাবক।
—চাচা, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছি।
—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছ তো কী হয়েছে? চান্স পেয়ে কি বিশ্ব জয় করে ফেলেছ?
শোনো, তোমাকে একটা কথা এতদিন বলা হয়নি তুমি ছোট ছিলে বলে। এখন যথেষ্ট বড় হয়েছ। শোনো, এইটা তোমাদের বাড়ি না, তোমার বাবা আমার কাছে বেচে গেছে। তুমি তো জানই তোমার মায়ের অসুখের সময় অনেক টাকা তোমার বাবাকে খরচা করতে হয়েছে।
—কিন্তু বাবা তো বাড়ির জায়গা বিক্রি করেননি। পাথারের জমিটা শুধু বিক্রি করেছিলেন।
—তুমি আমার চেয়ে বেশি জানো? বেয়াদব ছেলে, মুরব্বিদের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয়, তাও জানো না?
—আমি তো…
—চুপ করো বেতমিজ, মুরব্বিদের মুখে মুখে কথা বলো! শোনো, তুমি আর এই বাড়িতে থাকতে পারবে না, আমি বাড়িটা ভাড়া দিয়েছি। এক তারিখে ভাড়াটেরা উঠবে, তুমি তার আগেই যা কিছু নেওয়ার গাট্টিবোচকা বেঁধে চলে যাবে।
কী সব বাজে কথা বলছেন—তোহার চাচি এসে বলে। ছেলেটার আজ খুশির দিন, আর আপনি….ছিঃ!
তোহার উদ্দেশে চাচি বলেন, বাবা তুমি তোমার ঘরে যাও, তোমার রেজাল্টের কথা শুনে আমি বাজারে গোবিন্দর হাতে মিস্টি আনতে দিয়েছি।
তোহা চাচির পায়ে সালাম করে নিজের ঘরে ফিরে যায়। তারপর থেকে এই ঘরটাই আছে শুধু, আর কিছু নেই। বাকি সব সম্পত্তি দখল করে নিয়েছে চেয়ারম্যান।
ঘরের ভেতরে অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে। তোহা জানালা খুলে দেয়। জানালা খুলেই ওর মনে হয়—আজ আকাশটা নিচে মাটিতে নেমে এসেছে। যে দুটো চোখ দেখতে পেলো, মনে হলো ও দুটো চোখ নয়। আকাশের গায়ে দুটো তারা জ্বলছে। খুশবুকে দেখে বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠলো। ওর ওই নিষ্পাপ হরিণী চোখ থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারে না সে। কয়েক যুগ যেন তাকিয়ে থাকে। একে অন্যকে দেখলো চেয়ে চেয়ে।
তোহার ইচ্ছে করলো যে খুশবুকে নিজের ঘরে নিয়ে এসে রাখতে, কিন্তু চাচার ভয়ে সেই ইচ্ছেটা মাটি চাপা দিলো। ভয়টা নিজেকে নিয়ে নয়, ভয় খুশবুকে নিয়ে, ওর যদি কোনো ক্ষতি করে বসে! এমনিতেও খুশবুর ওপর তার চাচার ষণ্ডমার্কা ছেলের কুনজর আছে। একটু পান থেকে চুন খসে পড়লেই ওর ক্ষতি করার পাঁয়তারা করবে। অন্ধকার বাড়ছে। তোহা আর ঘরে থাকতে পারলো না, বারান্দায় গিয়ে বসে পড়লো। এই খোলা আকাশের নিচে খুশবুকে নিরাপদ মনে করলো না। তার চাচার ছেলেদের কিছুই করতে হাত কাঁপে না।
অনেক মেয়েছেলে। ক্লান্ত মানুষগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে। খুশিও ঘুমিয়ে পড়েছে বড় আপার বুকের কাছে মাথা রেখে। শুধু জেগেছিল খুশবুর চোখ দুটো আর চারদিকের অন্ধকার। তোহাকে বারান্দায় বসা দেখে ভয়টা বুক থেকে সরে গেলো, একটু সাহস পেলো চোখ বন্ধ করার, সে সাহস আর খরগোশের বাচ্চাটাকে বুকে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। তোহা গিটারে টুংটাং সুর তুলতে লাগলো, কিন্তু খুব বেশি সুবিধে করে উঠতে পারলো না। তোহার গিটারের সুরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তারাও গান করতে শুরু করেছে।
রাত শেষের দিকে। খুশবুর পায়ের কাছে ঘুমিয়ে থাকা কুকুরটা কুঁই কুঁই করে চিৎকার করে উঠলো। খুশবুর ঘুম ভেঙে যায়। চোখেমুখে ভয়, বুকটা ধ্বক ধ্বক করতে লাগলো। আশেপাশে চেয়ে দেখলো। আরও অনেকে ঘুম থেকে জেগে উঠেছে। দেখলো কিছু হয়নি, সব ঠিকঠাক আছে। তাহলে কুকুরটা চিৎকার করলো কেন? কেউ কি ওর কাছে এসেছিল? তোহার কথা মনে হলো, তোহা গিটারের তারে আঙুল রেখে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ভাবলো, ও তো ঘুমাচ্ছে, রাত তো বেশি নেই আর। হয়তো চোখ আর খুলে রাখতে পারেনি, সারা রাত আমার জন্য জেগেছিল হয়তো বেচারা। ও টের পেলো ওর হাতের ভেতরে একটা ছোট হাত আশ্রয় খুঁজছে, পরিচিত স্পর্শ, বুঝতে পারলো খুশি ভয় পেয়েছে।
আপা, হামার পাও কুত্তোর পায়ের ওপর পড়িছিল, হামি কলত পানি খাবার গেছনু, হামি আর থাগবের পারিচ্চিনে, হামাক খিদে লাগিছে।
খুশবু ছোটো বোনকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। ও জানে পেটের জ্বালা বড় জ্বালা, ওর পেটেও ইঁদুর দৌড়াচ্ছে। ও কাকে বলবে, আমাকে খেতে দাও। গতকালের দিনটা না খেয়ে গেছে, রাতেও পেটে একটা দানা পড়েনি, সরকার বাহাদুর তো উন্নত দেশের কথা বলে গর্বিত হচ্ছে, এদের জীবনের খবর তাদের কাছে আছে?
তোহার চোখের পাতার ওপর রোদ নাচা শুরু করেছে, স্কুলের মাঠে সোরগোল। ত্রাণ এসেছে মনে হচ্ছে বানভাসি মানুষদের জন্য। উঠে পড়লো, কাছে গিয়ে বুঝতে পারলো—ত্রাণ অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। সাংবাদিক আসছে, বানভাসি মানুষদের সঙ্গে কথা বলছে।
—আপনারা ত্রাণ পেয়েছেন?
—না, চাল পাছি। সাংবাদিক ভাই হেসে উঠল।
পাশে থেকে এক নারী বললো, দশ কেজি চাল পানু, মেপে দেকনু সাত কেজি। হামাগরে মুখের খাদ্য ইংকে করে চুরি করলে হামরা ক্যাংকা করে বাচমু?
তোহা জানে সবাই এই ত্রাণ পায়নি, খুশবুরা তো নিশ্চিত পায়নি, খুশবুকে বিয়ে করতে চেয়েছিল চেয়ারম্যান, তারা মিয়া রাজি হয়নি। পরে সে হাল ছেড়ে দিলে চেয়ারম্যানের ছেলে সেই হালে পানি দেয়। রাস্তাঘাটে বিরক্ত করে। নির্জন জায়গায় পেলে খপ করে হাত চেপে ধরে। গ্রামের মোড়লদের নিয়ে একবার সালিশ বসেছিল, খুশবু অভিযোগ করলে সালিশ বসানো হয়। সালিশে উল্টো খুশবুর চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলে গ্রামের মাতাব্বররা। এরপর আর খুশবু কারও কাছে মুখ খোলেনি। এমনকি আল্লাহর কাছেও না।
তোহা বাজারের দিকে গেলো। কাঁধে তার গিটারের ব্যাগ ঝুলছে। ও যখন বাজার থেকে ফিরছে, তখন কাঁধে গিটারের ব্যাগটা নেই, কিন্তু হাতে দশ কেজি চালের একটা ব্যাগ আছে। স্কুলের মাঠে গিয়ে দেখলো খুশবু নেই, পিচ্চিটাকেও দেখতে পাচ্ছে না, একটু দাঁড়াতেই তারা মিয়া হাজির হলো। মুখটা কালো, তাকানো যাচ্ছে না।
—চাচা, কী হয়েছে আপনার? এমন দেখাচ্ছে কেন?
—আর বলো না বাবা, সগলি ত্রাণ পালো, হামি শুধু পানু না।
—কে বললো আপনাকে দেয়নি? আসলে আমি আপনাদের ত্রাণ নিয়ে রেখেছিলাম। এই যে দেখেন দশ কেজি চাল, আপনি নিলে তো সাত কেজি পেতেন।
—তুমি ভালো করেছ বাবা। যারা পাছে, তারা সগলি সাত কেজি পাছে।
—আচ্ছা চাচা, আমি এখন যাই।
আসার মুখে খুশির সঙ্গে দেখা, মুখটা শুকনো শুকনো লাগছে।
—তুমি কোথায় গেছিলে?
—পানি দেখপের গেছনু। পানি আরও বাড়িচ্ছে। হামগরেক না খেয়ে মরা লাগবে।
—ধুর পাগলি, সারাজীবন পানি আটকে থাকবে নাকি!
—তোমার আপাকে যে দেখছি না?
—হামি তো বাড়িত দেখেই গেছনু, কুন্টি বেন গেলো?
—চিন্তা করো না, এসে পড়বে। হয়তো কোথাও কাজে গেছে।
বাসস্ট্যান্ডে যেতে অনেকটা পথ পায়ে হাঁটতে হয়। এই পথটা পাড়ি দিতেই বেশি বুক কাঁপে খুশবুর। রাস্তার দুই পাশে জঙ্গল। বড় বড় গাছ, লম্বা লম্বা ঘাস। ঘন ঝোপের মধ্য থেকে বুনো ফুলের গন্ধ আসে। এই পথে কোনো পাখি শব্দ করলেও ওর শরীর ভয়ে ছম ছম করে ওঠে। এই বুঝি কেউ পেছন থেকে মুখ চেপে ধরল, এই বুঝি কেউ ঝোপের মধ্যে টেনে নিয়ে গেলো!
এসব ভয় আর আশঙ্কায় খুব সাবধানে পথ চলছে।
খুশবু জানে, সে কোনো পথেই নিরাপদ না, যে বাসায় টিউশনি করাতে যাচ্ছে, সেখাও না। হরিয়াল বাবু, শহরের সব চেয়ে প্রভাবশালী নেতা। তার ছেলে হারজিত বাবুর মেয়েকে সে পড়ায়। হারজিত বাবুর ঘরে সুন্দরী বউ আছে, তবু সে খুশবুর ওপর নজর ফেলেছে।
প্রথমে চোখ দিয়ে গিলে খেতো, পরে গায়ে হাত দেওয়া শুরু করলো, কোনোদিন পেছন দিয়ে এসে বুক চেপে ধরেছে, কোনোদিন পেট খামছে ধরেছে, আবার কোনোদিন পেছন থেকে জড়িয়ে সাপটে ধরেছে। খুশবু অনেকবার টিউশনি ছেড়ে দেওয়ার কথা ভেবেছে, কিন্তু হারজিত বাবু বলেছে, আমার মেয়ের খারাপ রেজাল্ট হলে জানে মেরে ফেলবো। খুশবু অনেক অনুনয়বিনয় করে বলেছে, হারজিত বাবু, আমাকে মাফ করেন, আমি আপনার মেয়েকে আর পড়াতে পারবো না।
—তুমি কী ভাবছ? আমার মেয়েকে না পড়ালে, আমার বাসায় না আসলে তুমি আমার হাত থেকে মুক্ত হবে? আমি এই শহরের বাপ, আমি না চাইলে এই শহরের একটা গাড়ির চাকাও চলবে না। আমার প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাও, তোমার সবদিক দিয়ে ভালো হবে। শহরের একটা ফ্ল্যাট বাসা তোমার নামে লিখে দিব, সেখানে বুড়ো বাপ, ছোটো বোনকে নিয়ে দিব্যি রাজার হালে থাকতে পারবে, অভাব অনটনের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবে। তোমাকে স্ত্রীর মর্যাদা দিয়েই রাখব।
খুশবু একটা কথাও বলেনি। এরপর প্রায় একমাস হারজিত বাবু সামনে আসেনি। বাসায় যে ছিল না, তাও না, কিন্তু খুশবুর সামনে আসেনি। তাকে নানাভাবে বিরক্ত করতো, তাও করেনি। কিন্তু পরশুদিন সে আগের সবকিছু ছাড়িয়ে গেলো। পেছন থেকে এসে তাকে পাঁজাকোলা করে তার বেডরুমে নিয়ে গেলো, বিছানায় রেখে দরজা ভিজিয়ে দিলো, প্যান্টের জিপ খুলে ফেললো।
—দেখো, আমি এখন চাইলেই তোমাকে নষ্ট করতে পারি, তুমি আমাকে ঠেকাতে পারবে? পরে পুলিশের কাছে মুখ খুলবে? এই রাষ্ট্র, এই পুলিশ, আদালতের বিচারক আমার গোলাম, তুমি কিচ্ছু করতে পারবে না। তোমার বান্ধবীকে কে রেইপ করেছে? আর কেউ না জানলেও তুমি জানো। দেখলে তো, পুলিশ আমার কিচ্ছু করতে পারেনি, এই যে একমাস তোমার সামনে আসিনি, কেন জানো? শুধু তোমার বান্ধবীর পরিণতি গভীরভাবে ভাবার জন্য। একটা মেয়েকে নষ্ট করলেও যে এই রাষ্ট্র আমার কিচ্ছু করতে পারবে না, তা নিশ্চয় এই একমাসে বুঝে গেছ।
হারজিত বাবু সামনে এগুতে থাকে, খুশবুর গলা শুকিয়ে যায়, ভয়ে কাঁপতে থাকে, বলে, প্লিজ আমাকে কয়টা দিন ভাবতে সময় দিন।
খুশবুর গা ঝাঁকি দিয়ে উঠলো। বাসের অন্যান্য প্যাসেঞ্জার সবাই ওর দিকে তাকালো। একটা ছেলে বললো, আপু, আপনি ঠিক আছেন তো! খুশবু একটু লজ্জা পেয়ে গেলো। স্বগতোক্তি করলো, মানুষরা না জানি কী না কী ভাবলো!
তোহা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছে। সে আবার ঢাকা যাবে ভাবছে। সে চাকরির যাবতীয় প্রস্তুতি পড়া অধ্যয়ন করবে। ক্যাটালন কোন দেশের ভাষা? রোলিহ্লাহ্লা কোন ব্যক্তির নাম? ওয়াকা কোন দেশের রাষ্টীয় বার্তা সংস্থা? ইরাবতি কোন দেশের নদী? সব পড়ে যাবে।
তাকে একটা চাকরি জোটাতেই হবে, খুশবুকে নিয়ে সে ঘর করবে। কলেজে থাকতে খুশবু একটা ছবি এঁকেছিল, আর সেই ছবির গল্প লিখেছিল তোহা।
ছবির গল্পটা ছিল এরকম:
ছেলেটি সুন্দর, মেয়েটি আরও সুন্দর
বিশৃঙ্খল বাতাসে ওদের চুল উড়ছে
শাড়ি উড়ছে, উড়ছে শাদা পাঞ্জাবির প্রান্ত
বাতাসে ভাসছে বুনো ফুলের গন্ধ
ওরা ছুঁয়ে দিয়েছে ভালোবাসার দিগন্ত।
তোহা সেই কলেজের দিনগুলোর খুশবুর আঁকা ছবি হওয়ার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে গেলো।
বিকেল হয়ে এসেছে, বানের জলে ছড়িয়ে পড়েছে রাঙা আলো। আসর নামাজের আজানের ধ্বনিতে সে বাস্তবে ফিরে এলো। ভাবছে, যাওয়ার আগে তো একটিবার দেখা করে যেতে হয়। কিন্তু ওদের কারও সঙ্গেই কয়টা দিন ধরে দেখা হচ্ছে না। গেলো কোথায়? সে খুশবুকে দেখার জন্য ছটফট করতে লাগলো।
অনেক দিন পরের কথা।
কারও যেন পায়ের শব্দ কানে এলো। পেছনে ফিরে তাকাতেই চোখ ছানাবড়া।
—তুমি খুশি না?
—জি ভাইয়া।
—তুমি তো অনেক সুন্দর হয়ে গেছ। আবার দেখি শহরে ঢঙ্গে কথা বলছ!
—ভাইয়া, আমরা যে এখন শহরে থাকি।
—শহরে থাকো মানে?
—আপা যেখানে চাকরি করতো, সেই অফিস থেকে আপাকে ফ্ল্যাট বাসা দিয়েছে।
—ও। তা এইদিকে কোথায় গিয়েছিলে?
—খালার বাড়ি। আপুর বিয়ে তো, তাই দাওয়াত দিতে গেছিলাম। আব্বু ও আমার সাথে আছেন, ওই যে আসছেন।
তোহার চোখ দিয়ে দর দর করে পানি পড়তে লাগলো। একটু আগেই যে ছবিতে বুঁদ হয়ে ছিলো, সেই ছবির প্রতিটা দৃশ্যপট যেন ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। বুকের ভেতর ছলকে উঠলো। মনে হলো পৃথিবীসুদ্ধ সবাই লোভী, সবাই স্বার্থপর। ভারী ক্লান্ত লাগছে ওকে, পীড়নে জ্বলে যাচ্ছে শরীর, পুড়ে যাচ্ছে মন। তোহার পা টলছে, চোখের দৃষ্টি আচ্ছন্ন। এক খুশবু ছাড়া এই পৃথিবীতে তার কেউ ছিলো না। তবু তার কখনো নিজেকে একা মনে হয়নি, আজ বড্ড মায়ের কথা মনে পড়ছে, বাবার কথা মনে পড়ছে। আজ সে নিঃসঙ্গ, এতদিন পরে বিরাট এই পৃথিবীতে সে নিঃসঙ্গ।