পূর্ব প্রকাশের পর
বাংলাদেশের চিন্তা চর্চার ইতিহাসের আগের কিস্তিতে আমরা জেনেছি, বাংলার মানুষেরা নিজের ভাষায় হোক, পরের ভাষায় হোক, গদ্যে হোক বা পদ্যে হোক, নিজের চিন্তার কথা সাহিত্যরূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।
বাঙালি মূলত আবেগপ্রবণ জাতি। আবেগটাই তার সব। এই আবেগী জাতির আবেগনির্ভর সাহিত্যের মাঝে চিন্তাশীল লোকের সংখ্যা কম। একারণে যারাই চিন্তাশীল কথাবার্তা বলেন বা লেখেন তাদের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানো হয়। সারারাত কাহিনিকাব্য বা বৈষ্ণবপ্রেমের গান শুনে সকাল বেলা একজন নেংটা পাগলের মুখে রহস্যময়, আধ্যাত্মিক একটা কথা শুনলে বিরলে দুর্লভ বাণী হিসেবে চিরকাল মনে সেটাই থাকে। এমনটাই যুগ যুগ ধরে ঘটেছে বাংলায়। একজন শিক্ষক সারাজীবন শাসনে-সোহাগে অর্থাৎ আবেগ দিয়ে শিক্ষাদান করলেও তার চাইতে একজন অতিথি শিক্ষক বা স্কুল পরিদর্শকের মুখে ভিন্ন রকম জ্ঞানের বা চিন্তার কথা শুনলে তার কথাই চিরকাল মনে থাকে। এতে বোঝা যায়, এখানে চিন্তার মূল্য ছিল এবং আছে। চর্যাপদের কবিতাগুলো চিন্তাশীল না হয়ে কাহিনিনির্ভর হলে এত আলোচনা-গবেষণা হতো না।
প্রাচীন এবং মধ্যযুগের বাংলায় চিন্তাশীল সাহিত্যের অনেকগুলো শাখা ছিল বলে জেনেছি। এর অনেকগুলো বাংলা ভাষায় লেখা হয়েছে। কিছু সাহিত্য রচিত হয়েছে ফারসি ভাষায়। এর বাইরে আছে বিপুল পরিমাণ মৌখিক সাহিত্য। এর মধ্যে ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ, প্রবচন ইত্যাদি। বাংলাসাহিত্যের সবচেয়ে প্রাচীন শাখা ছড়া, ধাঁধা, প্রবাদ ও প্রবচনের মতো লোকসাহিত্যের বিষয়গুলো। এগুলো মনে থাকে বেশি। ধাঁধা, প্রবাদ এবং প্রবচন চিন্তাশীল উপাদান রয়েছে বলেই মনে থাকে। এবং এগুলোর মূল্য মূলত চিন্তার ক্ষেত্রেই। ছড়ার ভেতর দিয়েও অনেক চিন্তা-ভাবনার প্রকাশ ঘটানো যায়। প্রচলিত ছড়াগুলো তো আছেই এছাড়া রবীন্দ্রনাথ কিংবা সুকুমার রায়ের ছড়াতেও তার পক্ষে প্রমাণ মেলে।
সুলতানি যুগে বাংলার মুসলমান শাসকরা এবং আরাকান রাজ্যের মগ শাসকরা বাংলাসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এর আগের সেন ও বর্মণ শাসকরা মুসলমান শাসকদের মতোই বহিরাগত ও অবাঙালি ছিলেন। [বাঙালি হিন্দুর বর্ণভেদ: নীহাররঞ্জন রায়। বিশ্বভারতী গ্রন্থালয়, কলিকাতা। ভাদ্র, ১৩৫২। পৃষ্ঠা-১৯] তারা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ব্যাপারে উৎসাহী ছিলেন না। বরং সংস্কৃত সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। এমনকি নদীয়ার বাঙালি ধর্মসংস্কারক, মহাপুরুষ শ্রী চৈতন্যদেবের বাণী সংস্কৃত ভাষায় সংরক্ষিত হয়। তিনি ‘শিক্ষাষ্টক’ নামে আটটি এবং পৃথকভাবে একটি শ্লোক প্রচার করেন; তা সংস্কৃতেই লেখা। তাকে নিয়ে প্রথমে কিছু গ্রন্থ বাংলা ভাষায় লেখা হলেও পরে তার বাণী, জীবনী ও তাকে নিয়ে নাটক সংস্কৃত ভাষায় লিখিত ও সংরক্ষিত হয়। [বাংলার সাহিত্য-ইতিহাস: সুকুমার সেন। সাহিত্য আকাদেমি, দিল্লি। পৃষ্ঠা- ৭৫—৭৭]
এখানকার মোঘল প্রশাসকরা বাংলাসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা বন্ধ করে দিয়ে সাম্রাজ্য বিস্তার ও সংহতির স্বার্থে ফারসি ভাষায় সাহিত্য রচনায় উৎসাহিত করেন। তখন বাংলায় বসবাসকারি, দায়িত্বরত এবং জন্মগ্রহণকারী বিদেশি, বিভাষী ও ভিনজাতির লোকেরা ফারসিতে লেখতেন। তাদের মধ্যে বাংলার সন্তানও ছিলেন। এসব রচনায় চিন্তাশীল সাহিত্যের পরিমাণ নিয়ে আগের কিস্তিতে আলোচনা হয়েছে।
______________________________________________________________________________________________________________________________________
এ সময়ের মুসলমান সাহিত্যিকদের অবস্থা ছিল ভিন্ন। তাদের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের মূল ধারার লেখকেরা সাহিত্যের প্রধান শাখাগুলো যেমন, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, অনুবাদ, ইত্যাদি পুরনো রচনার অনুকরণ করেন। তবে তত্ত্বপ্রধান সাহিত্য ইত্যাদি রচনায় নতুনত্ব চোখে পড়ে। আর দুর্বল প্রতিভার মুসলমান লেখকেরা নতুন একটা ভাষা রীতিতে সাহিত্য রচনা করে চলেছেন। যাকে বলা হয় দোভাষী পুঁথিসাহিত্য। অল্পশিক্ষিত এসব লেখক নিজেদের মতো সাধারণ মানুষের আবেগ আর অভিজাতদের আরবি-ফারসি-হিন্দি-উর্দু শব্দ ও লেখনশৈলী মিশিয়ে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টায় এমন ভাষারীতি সৃষ্টি করেন।
______________________________________________________________________________________________________________________________________
দুই.
মোঘল শাসন অবসানের পরে বা শিথিলতার সুযোগে বাংলায় নবাবি শাসন চালু হয়। এ যুগে ফারসি সাহিত্যেরই পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন নবাবরা। তবে স্থানীয় পরগণাভিত্তিক কিন্তু দিল্লির সম্রাটের কাছ থেকে ‘রাজা’, ‘মহারাজ’ উপাধিপ্রাপ্ত হিন্দু শাসক ভারতচন্দ্র, কাশিরাম দাস, গঙ্গারাম দাসের মতো কয়েকজন কবি এবং অনেক পণ্ডিতকে পৃষ্ঠপোষকতা দেন। তাঁরা মোঘল শাসনের দুর্বলতার সুযোগে স্বধর্মের পুনরুজ্জীবনে আস্থাশীল ছিলেন। তাঁদের কেউ কেউ নবাব সিরাজের বিরুদ্ধে ইংরেজদের ষড়যন্ত্রে অংশগ্রহণ করে সিরাজের পতন ও হত্যাকাণ্ডে সহায়তা করেন এবং ইংরেজদের ক্ষমতাগ্রহণ করার পথ প্রশস্ত করেন। তাঁদের কেউ-কেউ অবশ্য ইংরেজদের দড়িতেই ফাঁসিতে ঝোলেন, জমিদারি বা শাসন ক্ষমতা হারান। [ ড. অতুল সুর: আঠারো শতকের বাঙালী ]
তবে তাঁদের মতো হাতেগোনা অল্প কয়েকজন স্থানীয় শাসক বাংলাসাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। তাঁরা প্রধানত পশ্চিমবঙ্গের। এদের মধ্যে মহারাজ নন্দকুমার, রানী ভবানী, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, কৃষ্ণদেব প্রমুখ। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু কাজের নাম: ‘ধর্মমঙ্গল’ ঘনরাম চক্রবর্তী রচনা করেন বর্ধমানের রাজা কীর্তিচন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতায়। ‘অন্নদামঙ্গল’ ও ‘বিদ্যাসুন্দর’ ভারতচন্দ্র রায় রচনা করেন নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং ‘শিবায়ন’ রামেশ্বর ভট্টাচার্য রচনা করেন কর্ণগড়ের রাজা যশোমন্তের পৃষ্ঠপোষকতায়।
বাংলা সাহিত্যের মূল ধারাগুলোতে হিন্দু লেখকেরা পুরনো সাহিত্যকর্মের অনুকরণে ব্যস্ত থাকেন। যেমন, বিভিন্ন ধরনের মঙ্গলসাহিত্য, বৈষ্ণব পদাবলী, ভাগবত বা শ্রীকৃষ্ণবিষয়ক রচনা ইত্যাদি। সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদও করেন অনেকে। তবে সংস্কৃত ভাষায়ও এ সময় প্রচুর সাহিত্য রচিত হয়।
এ সময়ের মুসলমান সাহিত্যিকদের অবস্থা ছিল ভিন্ন। তাদের মধ্যে বাংলা সাহিত্যের মূল ধারার লেখকেরা সাহিত্যের প্রধান শাখাগুলো যেমন, রোমান্টিক প্রণয়োপাখ্যান, অনুবাদ, ইত্যাদি পুরনো রচনার অনুকরণ করেন। তবে তত্ত্বপ্রধান সাহিত্য ইত্যাদি রচনায় নতুনত্ব চোখে পড়ে। আর দুর্বল প্রতিভার মুসলমান লেখকেরা নতুন একটা ভাষা রীতিতে সাহিত্য রচনা করে চলেছেন। যাকে বলা হয় দোভাষী পুঁথিসাহিত্য। অল্পশিক্ষিত এসব লেখক নিজেদের মতো সাধারণ মানুষের আবেগ আর অভিজাতদের আরবি-ফারসি-হিন্দি-উর্দু শব্দ ও লেখনশৈলী মিশিয়ে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টায় এমন ভাষারীতি সৃষ্টি করেন।
আর মৌখিক সাহিত্যের মধ্যে হিন্দুরা কবিগান করতেন, বাউল গান করতেন। মুসলমানদের মধ্যেও বাউল দর্শন চর্চা ছিল। লোকসাহিত্যের অন্য শাখাগুলোও অব্যাহত ছিল।
তিন.
পলাশীর যুদ্ধের পরে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা-বিহার ও উড়িশ্যার শাসনক্ষমতা গ্রহণ করে নানারকম প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার পরে। এ সব প্রক্রিয়ার কিছুটা পূর্বপরিকল্পিত আর কিছুটা পরিস্থিতিনির্ভর। ১৭৭২ সালে দ্বৈতনীতি পরিহার করে দেওয়ানি এবং শাসনক্ষমতা নিজেদের হাতে তুলে নেয় ইস্ট ইন্ডয়া কোম্পানি। পরের বছরই রাজধানী মুরশিদাবাদ থেকে সরিয়ে কলকাতায় নিয়ে যাওয়া হয়। কলকাতা শহরটি ইংরেজদের বানানো। এখানে তারা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ বানিয়ে বণিক থেকে শাসক হওয়ার পথে অনেকদূর অগ্রসর হয়। ১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দে প্রথম ছাপাখানা বসানো হয়। বাংলা মুদ্রাক্ষর বানানোর জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন চার্লস উইলকিন্স, পঞ্চানন কর্মকার ও তার জামাতা মনোহর কর্মকার।
শ্রীরামপুরের মিশনারিতেও প্রেস বসানো হয়। সেখানে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচার কাজের জন্য বাইবেলের বাংলা অনুবাদ ছাপানোর কাজ শুরু হয়। ছাপাখানার প্রতি প্রথম দিকে বিদ্রোহ করেন দেশীয় লেখক এবং লিপিকাররা। কিন্তু প্রগতি ঠেলে রাখা যায় না। পরে প্রেসে ছাপানোর সুবিধা বুঝতে পেরে বিদ্রোহীরা প্রশমিত হন। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উল্লেখযোগ্য কোনো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ কলকাতা বা শ্রীরামপুর থেকে প্রকাশিত হয়নি।
এ সময়ের মধ্যে যে সব ধারায় সাহিত্য রচনা করেছেন বাংলার চিন্তাশীল সাহিত্যিকরা সেগুলো লক্ষ্য করলে দেখা যায় প্রধানত তিনটি ভাষায়—দোভাষীপুঁথি সহ চারটি ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়েছে। সংক্ষেপে পরিচয় দেওয়া যায়।
সংস্কৃত সাহিত্য
বাঙালি প্রাচীনকাল থেকেই সংস্কৃত সাহিত্যের চর্চা করে আসছে। সেন শাসনকালের বিখ্যাত কবি জয়দেব দাসের পরিচয়ের মাধ্যমে বাঙালির সংস্কৃত চর্চার ধারণা পওয়া যায়। আবার জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম্’ কাব্য অবলম্বনে বাঙালি কবি বড়ু চণ্ডীদাস ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ বাংলায় রচনা করেন। এসব রসপ্রধান রচনা ছাড়াও বাঙালি সংস্কৃত ভাষায় রচনা করেন দৈতন্যদেবের বাণীর টীকাভাষ্য, চৈতন্যের জীবনী, চৈতন্যদেবের জীবনীভিত্তিক নাটক ইত্যদি। এগুলোর বাইরেও বিপুল পরিমাণ চিন্তাশীল সাহিত্যও রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে স্মৃতিশাস্ত্রের গ্রন্থগুলোর প্রায় সবই চিন্তাশীল রচনা।
তবে মুসলমান শাসন অবসানের পরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে বা কোম্পানি যুগের প্রথম দিকেও অনেক গ্রন্থ রচিত হয়। সঠিকভাবে দিনক্ষণ বিচার করে অনেকগ্রন্থের নামকরণ সম্ভব নয় বলে আঠারো শতকের স্থানীয় বাঙালি জমিদার বা ভূস্বামীদের পৃষ্ঠপোষকতায় রচিত গ্রন্থগুলোর নাম করা যায়।
১. নবদ্বীপের রাম গোপাল ন্যায়ালঙ্কার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাপণ্ডিত ছিলেন। তিনি রচনা করেন, ‘আচার নির্ণয়’, ‘উদ্বাহু নির্ণয়’, ‘কালনির্ণয়’, ‘শুদ্ধিনির্ণয়’, ‘দায়নির্ণয়’, ‘বিচারনির্ণয়’, ‘তিথিনির্ণয়’, ‘সংক্রান্তিনির্ণয়’ প্রভৃতি চিন্তাশীল সাহিত্য।
২. ফরিদপুরের চন্দ্রনারায়ণ ন্যায়পঞ্চানন প্রখ্যাত নৈয়ায়িক পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ‘কুসুমাঞ্জলি’র টীকা প্রণয়ন করেন এবং ন্যায়সূত্রের বৃত্তি রচনা করেন।
৩. নদীয়ার জয়রাম ন্যায়পঞ্চানন ছিলেন রামভদ্র সার্বভৌমের শিষ্য। তিনি নয়টি চিন্তামূলক গ্রন্থ রচনা করেন। এগুলোর মধ্যে ‘ন্যায়সিদ্ধান্তমালা’, ‘তত্ত্বচিন্তামণি’, ‘গুণদিধিতিবিতি’ বিখ্যাত। তিনি ‘প্রকাশতিলক’ নামে একটি কাব্যও রচনা করেন।
৪. মহারজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাপণ্ডিতদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন শিবরাম বাচস্পতি। পাণ্ডিত্যের জন্য তাঁকে ‘ষড়দর্শনবিৎ’ উপাধি দেওয়া হয়েছিল। তিনি কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে ‘গৌতমসূত্রবিধি’ উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি মুক্তিবাদের টীকা রচনা করেন।
৫. মালদহে জন্মগ্রহণকারী শ্রীকৃষ্ণ তর্কালঙ্কার বিখ্যাত স্মৃতিশাস্ত্রবিদ। তিনি ‘জীমূতবাহনের দায় ভাগ টীকা’ এবং ‘দায়ক্রমসংগ্রহ’ নামক প্রামাণ্যগ্রন্থ রচয়িতা।
৬. নদীয়ার রাজবংশের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রীকৃষ্ণ সার্বভৌম অনেকগুলো গ্রন্থ রচনা করেন। এর মধ্যে ‘কৃষ্ণপদামৃত’, ‘পদাঙ্কদূত’, ‘মুকুন্দপদমাধুরী’ ও ‘সিদ্ধান্তচূড়ামণি’ উল্লেখযোগ্য।
৭. হুগলির পালপাড়ার হরিহরানন্দনাথ তীর্থস্বামীর চিন্তাশীল সাহিত্যে ব্যুৎপত্তি ছিল। তার ‘কুলার্ণবতন্ত্র’ ও ‘মহানির্বাণতন্ত্র’ তন্ত্রশাস্ত্রের মহাগ্রন্থ বলে বিবেচিত।
৮. এ ছাড়া ওয়ারেন হেস্টিংস বিখ্যাত পণ্ডিত জগন্নাথ তর্কপঞ্চানন, বাণেশ্বর বিদ্যালঙ্কারসহ এগারজন পণ্ডিতের সহায়তায় ‘বিবাদার্ণবসেতু’ নামে একটি হিন্দু আইনবিষয়ক গ্রন্থ রচনা করান। পরে গ্রন্থটি কোলব্রুককে দিয়ে ইংরেজি অনুবাদ করানো হয়।
বাংলা সাহিত্য
আঠারো শতকের শেষ পর্যন্ত চিন্তাশীল বাংলা সাহিত্যের অনেকগুলো ধারায় কাজ হয়েছে। এগুলোর মধ্যে ক. লিখিত তত্ত্বপ্রধান সাহিত্য, খ. মৌখিক সাহিত্য । মৌখিক সাহিত্য পরে সংকলিত হয়েছে। ড. আহমদ শরীফ মধ্যযুগের মুসলমান লেখকদের রচিত তত্ত্বপ্রধান সাহিত্যকে তিনটি ধারায় ভাগ করেছেন। ক. শাস্ত্রসংলগ্ন রচনা তথা ধর্মসাহিত্য, খ. যোগতাত্ত্বিক চর্যাগ্রন্থ তথা সূফিসাহিত্য ও গ. সওয়ালসাহিত্য। [ আহমদ শরীফ: কালিক ভাবনা: মুক্তধারা, ঢাকা। ১৯৭১: পৃষ্ঠা-১৩৯]
লিখিত চিন্তাশীল সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে:
১. জগৎনারায়ণের ‘আত্মবোধ’।
২. রামগতি সেনের ‘মায়াতিমিরচন্দ্রিকা’, ‘প্রবোধচন্দ্রোদয়’ ও ‘ যোগকল্পলতা’ বিখ্যাত তাত্ত্বিক গ্রন্থ।
৩. আলী রজা ওরফে কানু ফকির বিরচিত ‘সিরাজকুলুব’ ‘আগম ও জ্ঞানসাগর’।
৪. বালক ফকির রচনা করেন ‘ফয়দুল মুবতাদি’ ও ‘জ্ঞানচৌতিশা’।
৫. মুহম্মদ মুকিমের ‘ফয়দুল মুবতাদি’।
৬. এদের সবার আগে কাজী মুনসুর রচনা করেন ‘সির্নামা’ নামক তাত্ত্বিক গ্রন্থটি।
৭. আবদুল করিম রচনা করেন ‘হাজার মাসায়েল’।
৮. আব্দুল্লাহর ‘নসিয়তনামা’।
৯. কাজী বদিউদ্দীনের ‘সিফৎ ই ইমান’।
১০. সৈয়দ নাসিরউদ্দিনের ‘সিরাজ সবিল’।
১১. সৈয়দ নুরুদ্দীনের ‘দাকায়েকুল হাকায়েক’ ও ‘মুসার সওয়াল’।
১২. মুহম্মদ আলীর ‘হায়রাতুল ফিকাহ’।
১৩. হায়াত মাহমুদের ‘নসিয়তনামা’।
১৪. মোহসীর আলীর ‘মোকামমঞ্জিল কথা’।
১৫. শেখ জেবুর ‘আগম’।
১৬. এতিম আলমের ‘আবদুল্লাহর সওয়াল’।
১৭. সেরবাজ চৌধুরীর ‘মালিকার সওয়াল’ বা ‘ফকরনামা’।
এছাড়া প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ সাহিত্যের ধারায় লিখেছেন দুর্লভমল্লিক, আবদুস শুকুর শুকুর মাহমুদ। আফজল আলি, মুহম্মদ ফসিহ, মুহম্মদ আলি, সোলেমান, আইনুদ্দীন, আবদুল করিম খোন্দকার, সুলতান জমজমা, আকিল, এতিম সালেক, মুহম্মদ দানিশ, মুজাফ্ফর ও মুহম্মদ দানেশ। সঙ্গীততত্ত্ব নিয়ে লিখেছেন, ফাজিল, নাসির মুহম্মদ, আলিরজা, বকশ আলি, নাসির মাহমুদ, চামারু, দ্বিজ রামতনু, দ্বিজ ভবানন্দ, দ্বিজ রঘুনাথ, দ্বিজ রামগোপাল, দ্বিজ পঞ্চানন ও চম্পাগাজী প্রমুখ।
উল্লেখ্য, বাংলাসাহিত্যের ইতিহাস লেখকদের অনেকেই আঠারো শতকের মূল বাংলা ভাষার লেখকদের কাউকে কাউকে দোভাষী পুঁথির লেখক তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন। আবার দোভাষী পুঁথির লেখকদের নাম বাংলা বাংলাভাষার সাহিত্যিক হিসাবে দেখিয়েছেন। যেমন, গরীবুল্লাহ, হায়াত মাহমুদ, সৈয়দ নুরুদ্দীন, আমির হামজা প্রমুখ।
আর মৌখিক সাহিত্যের মধ্যে রয়েছে ক. বাউল সঙ্গীত, খ. রামপ্রসাদী সঙ্গীত, গ. ছড়া, ঘ. ধাঁধা, ঙ. প্রবাদ ও চ. প্রবচন ইত্যাদি।
দোভাষী পুঁথিসাহিত্য: দোভাষী পুঁথি সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। কিছু গ্রন্থ ও গ্রন্থকারের নাম এখানো উল্লেখ করা যেতে পারে। পুঁথিসাহিত্য নিয়ে অনেক কথা আছে। কেউ বলেন দোভাষী পুঁথিসাহিত্য, কেউ বলেন পুঁথিসাহিত্য, কেউ বলেন ইসলামি বাংলা সাহিত্য, কেউ বলেন বটতলার সাহিত্য আবার কেউ বলেন বটতলার পুঁথি। আসলে এই দোভাষী পুঁথিগুলো কোনো সাহিত্য প্রকরণ নয়। একটা ভাষারীতি মাত্র। সেই বৈষ্ণবযুগের ব্রজবুলির মতো একটা কৃত্রিম ভাষায় লেখামাত্র। এ ভাষারীতিতে শুধু কাব্যই রচিত হয়নি। কাব্য, কাহিনি, উপদেশমূলক তত্ত্ব, হেকিমি চিকিৎসা, গাছ-গাছড়া বা কবিরাজি চিকিৎসা, ধর্মীয় ইতিাহাস ও তত্ত্ব, স্বপ্নব্যাখ্যার খোয়াবনামা, ফালনামা, রাশিফল, তান্ত্রিক ধরনের দোয়া ও তাবিজের সাহায্যে চিকিৎসা ব্যবস্থা, দৈনন্দিন জীবনের নানা সমস্যার সহজ সমাধান, টোটকাসহ নানা ধরনের গ্রন্থ রচিত হয়েছে।
মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান জানান, “ইসলামী আহকাম-আরকান বা নিত্যকৃত্য, কোরআন-হাদিস বা তত্ত্ব গ্রন্থের অনুবাদ, সূফীতত্ত্ব বিষয়ক সাধনা-গ্রন্থ দোভাষী পুঁথিতে আমরা প্রচুর পাই। এ-পর্যায়ের অল্প কিছু গ্রন্থের নাম এখানে উল্লেখ করছি—
১. সৈয়দ নুরুদ্দীনের ‘দাকায়েকুল হাকায়েক’, মালে মোহাম্মদের ‘আহকামাল জোমা’, জোনাব আলীর ‘হকিকাতচ্ছালাত’, মোহাম্মদ ছাদেকের ‘জামালাতল ফোকরা’।
দোভাষীরীতির এই সাহিত্যচর্চা সাধারণভাবে মনে করা হয় অষ্টাদশ শতক থেকে শুরু হয়ে উনিশ শতক পর্যন্ত প্রচলন ছিল। কিন্তু বিশ শতকের মাঝামাঝি অর্থাৎ দেশবিভাগ পর্যন্ত প্রচলিত ছিল বলে জানা যায়। এ বিষয়ে ড. সুকুমার সেনের অভিজ্ঞতা নিম্নরূপ:
সুকুমার সেন দৌলত কাজীর ‘সতী ময়না’ কাব্যটি খুঁজতে কলকাতার বটতলা অঞ্চলের ‘আইজদ্দিন আহমদ এন্ড সন্স’ এর ‘গাওসিয়া লাইব্রেরিতে’ যান। সেখানে গিয়ে দেখেন ১৯৪৬ এর মহা দাঙ্গায় মুসলমানদের প্রায় সব বইয়ের দোকান পুড়ে শেষ হয়ে গেলেও ঐ দোকানটি আছে। তিনি রচনাটি লেখার সময় অনুমান করেছেন তখনো হয়তো আছে। মেছোবাজার স্ট্রিটে মুসলমানরা প্রথম প্রেস বসান। উনিশ শতকের মাঝামাঝি মুসলমান মালিকানায় ছিল দুটি প্রেস। একটির নাম ‘মহাম্মদি যন্ত্র’ অপরটি ‘রহমানি যন্ত্র’ (সুকুমার সেনের বানানে)। ‘মহাম্মদি যন্ত্রে’ ১৮৪৫-৪৬ সালে দ্বিতীয় মুদ্রণ হয়েছিল মহাম্মদ মিরনের লেখা গ্রন্থ ‘বাহার দানেশ’। রহমানি যন্ত্রে হিন্দু লেখকদের বইও ছাপা হতো— একই সময় ছাপা হয় রাধামাধব মিত্রের ‘বিধবা মনরঞ্জন’। এসব প্রেসে পুরনো যুগের মুসলমান লেখকদের হাতে লেখা সাহিত্যও যন্ত্রে ছাপা হতো এদের কল্যাণেই পুঁথিসাহিত্য দীর্ঘকাল ধরে টিকে ছিল। [সুকুমার সেন: বটতলার বই: দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন: আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা। ১৯৮১। পৃষ্ঠা- ২৭৯-২৮০]
সুকুমার সেনের বর্ণনা থেকে বোঝা যায় পূর্বে উল্লিখিত পুঁথি সাহিত্যের বিভিন্ন শাখা ও তত্ত্বমূলক গ্রন্থগুলো বিশ শতক পর্যন্ত রচিত ও প্রকাশিত হওয়ার কারণ; বটতলা অঞ্চলে প্রেস স্থাপন করা। প্রেসের কল্যাণে সেসব অঞ্চলে নিম্ন শিক্ষিত মুসলমান লেখকদের দোভাষী কাব্য এবং চিন্তাশীল নানা গ্রন্থ তখনো প্রকাশিত হয়েছে।
তবে এর শুরুটা নিয়ে নানা মত আছে। মুহম্মদ আবুদল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান মনে করেন ভারতচন্দ্রের ‘যাবনী মিশাল’ ভাষা থেকেই এ রীতির উৎপত্তি। ভারতচন্দ্রের জন্মস্থান ভুরশুট-মান্দারণের কাছাকাছি ছিলেন ইসমাইল গাজীর মাজার। সেখানে সব ধর্মের লোকজনের ভক্তি-শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ইসমাইল গাজী ‘সত্যপীর’ বলে মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে উল্লিখিত। সত্যপীর আবার হিন্দুদের কাছে ‘সত্যনারায়ণ’ ও ‘দক্ষিণ রায়’ বলে পরিচিত। ইসমাইল গাজী, বা সত্যপীর বা বড় খাঁ গাজীর পীঠস্থানকে কেন্দ্র করেই মিশ্রভাষার এসব সাহিত্যের বিকাশ ঘটে। এরই কাছাকাছি এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন পুঁথি সাহিত্যের দুই দিক পাল ফকির গরীবুল্লাহ ও সৈয়দ হামজা। তারাই প্রথম দিকের পুঁথিসাহিত্যিক। আঠারো শতকের লোক। অন্যেরা উনিশ শতকের। যেকোনো বড় সাহিত্যিকের চারপাশে থাকে অগণিত অনুকারী লেখক। ভারতচন্দ্রের মৃত্যুর পরে তারই অনুকারী এসব লেখক তার ভাষারীতির সঙ্গে নিজধর্মের বিষয়-আশয় যোগ করে এ ধারার সাহিত্য রচনা করেন। তবে মাহবুবুল আলম জানান, ১৬৮৬-৮৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে কবি কৃষ্ণরাম দাস ‘রায়মঙ্গল’ কাব্য রচনার মাধ্যমে এ-ধারার দোভাষী পুঁথির সূচনা করেন। [ মাহবুবুল আলম: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা। মে, ১৯৯৬। পৃষ্ঠা-২৮১]
দোভাষী পুঁথিসাহিত্য সম্পর্কে ভিন্নমত পোষণ করেন মুহম্মদ আবুদল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান । তারা জানান, ‘দোভাষী পুঁথিতে বাংলার সঙ্গে প্রচুর আরবী-ফারসী শব্দ ব্যবহৃত হ’ত ব’লে আমরা এই নামকরণ করেছি। এ-পুঁথির কিছু অংশ রচিত হ’য়েছিল কলকাতায়; কিন্তু অধিকাংশই গ্রামাঞ্চলে। শহরে ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের লোক বিভিন্ন প্রয়োজনে একত্র হ’ত, কেউ সৈন্যরূপে, কেউ ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যপদেশে অথবা অন্য কোনো সাময়িক উদ্দেশ্যে। এদের আনন্দ-বিনোদনের জন্য এ-প্রকার মিশ্রিত ভাষায় দোভাষী পুঁথি রচিত হওয়া বিচিত্র নয়।’ [মুহম্মদ আবদুল হাই ও সৈয়দ আলী আহসান: বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত: স্টুডেন্ট ওয়েজ, ঢাকা। পৃষ্ঠা-২৪—২৫]
ফারসি সাহিত্য:
উনিশ শতকের প্রায় মাঝামঝি পর্যন্ত রাজভাষা ফারসি ছিল বলে আঠারো শতকের সাহিত্যেও ফারসি লেখকদের উল্লেখ গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে প্রথম কিস্তিতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
চলবে…