বিশিষ্ট ছড়াকবি জগলুল হায়দারের জন্ম ১৯৬৫ সালের ৮ অক্টোবর। ‘নতুন স্লোগান’, ‘ছাগলশুমারি, ‘জার্নি’র মতো অসংখ্য পাঠকনন্দিত ছড়া লিখে তিনি পৌঁছে গেছেন ছড়াকারদের খ্যাতির শীর্ষে। দেশের জাতীয় দৈনিক ও অনলাইনগুলো সমৃদ্ধ হয় তার শিশুতোষ, সমসাময়িক, রম্য ও সিরিয়াস ছড়ায়। এছাড়া তিনি নিয়মিত লিখে চলেছেন কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ও সমকালীন বিষয়ের কলাম বয়ান।
জগলুল হায়দার বাংলাদেশ বেতার ও বাংলাদেশ টেলিভিশনের তালিকাভুক্ত গীতিকার। লিখেছেন অসংখ্য গান। তার কথা ও সুরে মনির খানের গাওয়া ‘লক্ষ টাকায় খাট কেনা যায়-ঘুম কেনা যায় যায় কি বলো?’ শ্রোতা-বোদ্ধামহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এছাড়া, রোহিঙ্গা গণহত্যা নিয়ে তার কথা ও সুরে দ্রোহের গান ‘অ্যাগেইন স্টপ জেনোসাইড’ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে। জগলুল হায়দারের লেখা পথনাটক ‘নাড়াই’-এর এ পর্যন্ত ৮৫টি প্রদর্শনী হয়েছে। পেশায় প্রকৌশলী, এই ছড়াকবির বাবা মুক্তিযোদ্ধা প্রকৌশলী জি কে এম আবদুল লতিফ, মা জাহানারা বেগম। স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে তার সংসার।
জগলুল হায়দারের ছড়াসমগ্র ছাড়াও প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। উল্লেখযোগ্য বইগুলো হলো- চুম্বক (অণুকাব্য), বাংলার মুখ বাংলার মিথ (ছড়া), টুইন টাওয়ার রুইন টাওয়ার (ছড়া), সুফিয়ানা, পলিটিকা, আন্তনেটের ডটকম (ছড়া), স্বাধীনতার কাব্যইতিহাস(ছড়া), সে কালের গল্প এ কালের ছড়া (গল্প ও ছড়া), অদ্ভুত বদ ভূত (ছড়া), মিট্টি মেধার কার্টুন ছড়া (ছড়া), ফাংকোলো (ছড়া), প্রিপেইড ভালোবাসা (অণুকাব্য), তা রা রা তা রা রা তারারে (কাব্যছড়া), পল্টনে পটকা (লিমেরিক), ভালোবাসার পয়জন (অণুকাব্য), রাজনীতি ভাঁজনীতি (ছড়া), স্বপ্ন সমান আকাশ আমার (কাব্যছড়া), জলটুপ শ্রাবণে (ছড়া), ভাবতে ভাবতে একটা ছেলে (কাব্যছড়া), উড়তে উড়তে একটা ঘুড়ি (কাব্যছড়া), অনার করলে অনার পাবি (ছড়া), পাওয়ার প্লে (উত্তর-আধুনিক ছড়া), বাংলাদেশের প্রেমের ছড়া (সম্পাদনা), বাংলাদেশের ভ্যালেনটাইন ছড়া (সম্পাদনা), ভালোবাসার একশ লিরিক ও বিকেল খেকো টাওয়ার।
সাহিত্যে অবদানের জন্য পেয়েছেন তিনি রেবতী বর্মণ সম্মাননা স্মারক, ফুটতে দাও ফুল সাহিত্য সম্মাননা, শ্রীপুর সাহিত্য পুরস্কার, শহীদ সৈয়দ নজরুল সাহিত্য পদক, পদক্ষেপ সাহিত্য পুরস্কার, লেখারেখা পুরস্কার, সাহস সম্মাননা স্মারক, স্বপ্নসিঁড়ি সাহিত্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। আজ ৮ অক্টোবার এই ছড়াকবির জন্মদিন উপলক্ষে তার মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ শিশুসাহিত্যিক-সাংবাদিক আবিদ আজম।
আবিদ আজম: জন্মদিনে শৈশবের কথা খুব মনে হয়?
জগলুল হায়দার: এইটা আগে তেমন কইরা ভাবি নাই। তয় এখন জন্মদিন আসলে মনে হয়, বয়স আরও একবছর কমলো। আসলে জন্মদিন আর দুই-দশটা দিনের মতোই। আমার আব্বা ঘটা কইরা জন্মদিন পালন করতে দিতেন না। আম্মা অবশ্য বাসায় ভালোমন্দ খাবার রানতেন। বিয়ের পর আমার স্ত্রীও প্রতি জন্মদিনে তাই করেন। এখন জন্মদিনে শৈশবের কথা খুব মনে হয়।
আবিদ আজম: ছড়া লিখে মানুষের ভালোবাসা কেমন পেয়েছেন?
জগলুল হায়দার: আমি আসলে কিছু হওয়ার জন্য ছড়া লিখি নাই। এমনকি শুরুতে আমি ছড়াকার হমু, এই রকম কুনো ধারণাও ছিল না। তয় যখন লিখছি, চাইছি সত্য কথাটা লিখতে। মানুষ সময় আর সমাজের মন পড়ার একটা ক্ষমতা আল্লাহ বেশ ভালোই দিছেন আমারে। সেইটা ছড়া লেখায় কাজে দিছে। মানুষের সেই প্রত্যাশা আর সময়ের সেই ডাক আমার ছড়ায় কিছুটা হইলেও হয় তো উইঠা আসছে। তাতেই মানুষও উজাড় কইরা তাদের ভালোবাসা দিছে। আর তাদের সেই ভালোবাসাই হয়তো অনেকের চোখে তারকাখ্যাতি বইলা প্রতিভাত হইছে।
আবিদ আজম: আপনি নিজেকে প্রকাশের জন্য সাহিত্যের কোন মাধ্যমকে গুরুত্ব মনে করেছেন?
জগলুল হায়দার: আমার ভাইবোনরা বলে আমি খানিক সহজ সরল। যা বলতে চাই সহজ কইরা বলতে চাই। আমি রবীন্দ্রনাথের ‘সহজ কথা বলতে আমায় কহ যে/ সহজ কথা যায় না বলা সহজে’ এর মিথ ভাঙতে চাইতাম। আর এই ক্ষেত্রে ছড়াকে আমার সঙ্গত হাতিয়ার মনে হইছে। খালি সহজ কথা না বরং আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক অনেক কঠিন ইস্যুকেও ছড়ায় আমি সহজভাবে ডিল করছি। এমনকি বিজ্ঞান ও সভ্যতার দ্বন্দ্বের মতো জটিল বিষয়গুলাকে সাধারণের কাছে সহজবোধ্য কইরা উপস্থাপন করতে চাইছি। আর এই ক্ষেত্রে অনাবশ্যক বাঁক বিভঙ্গহীন ছড়াকেই আমার প্রার্থিত পথ মনে হইছে।
আবিদ আজম: লেখালেখির ক্ষেত্রে পরিবার থেকে উৎসাহ বা সহযোগিতা কেমন পেয়েছেন?
জগলুল হায়দার: খালি ছড়ায় নয়, সব ক্ষেত্রেই আমার প্রেরণা আমার জন্মদাতা পিতা। বাবার কাছ থিকা উত্তরাধিকার সূত্রে দুইটা জিনিস ভালোই পাইছি। এর একটা সাহস আরেকটা জ্ঞানপিপাসা। আব্বা প্রচণ্ড সাহসিকতা নিয়া পাক সরকারের চাকরির মুখে লাথি মারছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিছিলেন। তার এবং তার বাবা যিনি ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বুক চিতায়া দাঁড়াইয়া আমগো গ্রামে প্রথম স্কুল প্রতিষ্ঠা করছিলেন, তাঁরাই আমার মূল প্রেরণা। সাহিত্যে আমি ‘আর্ট ফর মেন সেক’ তথা ‘মানুষের জন্য শিল্প’ নীতিকে প্রাধান্য দেই। নিছক কলাকৈবল্যবাদ আমার আদর্শ নয়। ব্যক্তি দর্শনের ক্ষেত্রে আমার বুঝ খুব সহজ। ব্যক্তি জীবনে মহানবীর জীবন ও আদর্শকে অনুসরণীয় মানি। আমি প্রাচ্য জাগরণের পক্ষের মানুষ। এইক্ষেত্রে বামচিন্তা দর্শনের প্রতি ঝোঁক থাকার পরও আমার আব্বা যেমন শেষমেশ প্যান-ইসলামিক ছিলেন, আমিও এডওয়ার্ড সাইদ এমনকি চমস্কিতাড়িত হয়েও অনেকটা তাই।
আবিদ আজম: আপনার প্রিয় লেখক কে কে?
জগলুল হায়দার: প্রিয় লেখক অনেক। তয় তাদের মধ্যে কবি নজরুল বিশেষ। আবার রুমির প্রতি ব্যাপক আকর্ষণ আমার। দেশে কবি আসাদ চৌধুরী। ছড়ায় সুকুমার রায়, সুনির্মল বসু, অন্নদা শংকর রায়, সুকুমার বড়ুয়াসহ আরও অনেকেই।
আবিদ আজম: এবার একটু ভিন্ন কথা জিগাই, লেখালেখি কেন করেন?
জগলুল হায়দার: লেখালেখি ক্যান করি, এইটা নিয়া সেইভাবে ভাবি না। তয় লেখালেখি ভাল্লাগে। লেখাটাই সহজে আসে আমার। লেইখা মজা পাই। মানুষ বিনোদিত হয়। এইসব কারণেই হয় তো লেখালেখি করি।
আবিদ আজম:আমাদের সাহিত্য কি কল্যাণমুখী? আপনার অভিমত কী?
জগলুল হায়দার: বিপ্লব অনেক বড় জিনিস। সাহিত্যের মাধ্যমে সুন্দরের বিপ্লব। এইটা হয় তো কিছুটা হইতেছে। কল্যাণমুখী সাহিত্য একবারে হারায়া যাইতেছে না। তয় বাণিজ্যিক সাহিত্য প্রবল হয়ে উঠতেছে। এতে কল্যাণমুখী সাহিত্য খানিকটা আড়াল হইতেছে বৈ কি! আর গণমুখী সাহিত্য যদি বলো; আমি একটা কঠিন কথা বলব, বাংলাদেশে সেই অর্থে গণমুখী সাহিত্য নাই। এইটা আমার ব্যক্তিগত অপিনিয়ন, যে দেশের সাহিত্য প্রায় আমদানিকৃত ভাষায় রচিত। যে দেশের সাহিত্যে গণমানুষের জবানকে অপাঙ্ক্তেয় ভাবা হয়, সেই দেশে গণমুখী সাহিত্য কিভাবে সম্ভব? এইটা আমারে খুব ভাবাইছে। আর এই ভাবনা থিকাই সারা বাংলাদেশের মানুষের বোধগম্য একটা ভাষায় (আঞ্চলিক নয়) সাহিত্যে গত দুই দশক ধইরা লড়াই করতেছি। এই লড়াইয়ে অগ্রসর চিন্তার আরও বেশকিছু সাহিত্যিক আছেন। যেদিন এই লড়াই কামিয়াব হইব, সেইদিনই বাংলাদেশে সত্যিকারের গণমুখী সাহিত্য রচনার পথ খুলব।
আবিদ আজম: জাতীয় জীবনে লেখককের অঙ্গীকার সম্পর্কে….
জগলুল হায়দার: কোনো কোনো লেখক-কবি-ছড়াকারেরও কিছু চ্যুতি আছে। তারপরও এইটা সত্য, জাতির প্রতি তাদের অঙ্গীকারের ব্যাপারটা হয় তো পুরাপুরি ভোলেন না তারা। তয় এই ক্ষেত্রে কারও কারও বুঝে ঘাপলা আছে। ফলে ইচ্ছা সত্ত্বেও অনেকে সেইভাবে তা পালন করতে পারতেছেন না। আবার কেউ কেউ পারতেছেন।
আবিদ আজম: লেখালেখি নিয়ে আপনার ভবিষ্যৎ কোনো পরিকল্পনা…
জগলুল হায়দার: আমি আসলে সেইভাবে পরিকল্পনা কইরা লেখি না। তয় জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লেইখা যাইতে চাই। বিখ্যাত গণসংগীত শিল্পী মরহুম আব্দুল লতিফের একটা গান আমার প্রাণে খুব বাজে। ৫২-র মহান ভাষা আন্দোলনে বাঙালির আত্মত্যাগের মুহূর্তে গাওয়া সেই গানে তিনি বলছিলেন—‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়/ কইতো যাহা আমার দাদায়/ কইছে যাহা আমার বাবায়/ এখন কও দেখি ভাই/ মোর মুখে কি অন্য ভাষায় শোভা পায়?’ কী সহজ কথা, কী সহি বুঝ! আমগো বাপদাদার জবানই তো আমগো ভাষা। খালি টঙের দোকানের আড্ডায় নয় বরং সাহিত্যেও চাই আমগো ভাষার অধিষ্ঠান।
আবিদ আজম: এতক্ষণ সময় দেওয়ার আপনাকে ধন্যবাদ।
জগলুল হায়দার: তোমাকেও।