॥পর্ব-২॥
১৯১৭ সালেই তিনি প্রথমবারের মতো, লোকের কাছে বলা যায় এমন একটা চাকরি পান। চাকরিটি হলো সেনাবাহিনীর চাকরি। ব্রিটিশ বাহিনীর হয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেওয়ার জন্য তিনি এই চাকরিতে যোগ দেন। নজরুল জানতেন যে, ব্রিটিশ বাহিনী খিলাফতের সমর্থকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তার যে ইরাকে যুদ্ধ করতে যাওয়ার কথা ছিল এবং সেটি করতে হলে মুসলমান হয়ে তাকে যে খিলাফতের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, এ ব্যাপারেও তিনি সচেতন ছিলেন। সমগ্র ভারতের মুসলমানেরা তখন খিলাফতের হেফাজতের জন্য রাজপথে নেমেছে; নজরুল এই গণউন্মাদনায় অংশ তো নিলেনই না, বরং প্রকারান্তরে খিলাফতের উচ্ছেদের জন্য অস্ত্র ধরতে গেলেন। তবে আমাদের সৌভাগ্য যে, নজরুলকে ইরাকেও যেতে হয়নি, যুদ্ধও করতে হয়নি। তাহলে শত্রুর গোলার আঘাতে অকালে তিনি মারাও পড়তে পারতেন। প্রাত্যহিক পিটি প্যারেডের বাইরে একরকম শুয়ে বসেই তিনি তার সৈনিক জীবন পার করে দিয়েছিলেন। এ সময় তিনি এক মৌলভির কাছে ফারসি ভাষা শেখেন। ভারতবর্ষে চাকরির ক্ষেত্রে তখন ফারসি ভাষার কানাকড়িও মূল্য ছিল না, তবু ইংরেজি না শিখে তিনি ফারসি শেখেন সম্ভবত ফার্সি সাহিত্য পাঠ ও অনুবাদ করার জন্য। ক্যান্টনমেন্টে বসে তিনি আর যা যা করেন, তার একটিও যুদ্ধবিদ্যার সঙ্গে যুক্ত ছিল না, বরং ছিল উল্টো। নিয়মিত তিনি নানান বাদ্য-বাজনা সহযোগে গানের আসর বসাতেন, কবিতা লিখতেন, লিখতেন গদ্যও। নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা পাঠ করতেন। এসবের কোনোটিই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের জন্য অপেক্ষমাণ কোনো সৈনিকের কাজ হতে পারে না। সৈনিক মেসও ছাত্রদের মেসের মতো গান-বাজনা ও আকাশ কুসুম কল্পনার অলস নিবাস হয়ে উঠতে পারে, নজরুল ইসলাম সৈনিক না হলে আমাদের তাও অজানা রয়ে যেতো।
সেনাবাহিনীতে থাকা অবস্থায় তিনি যেসব কবিতা লিখেছিলেন, তার প্রায় সবই ছিল ইসলামি ধাঁচের। সৈনিক জীবন থেকে ফিরে এসে পরবর্তী একবছরও তিনি মূলত এই ধারাতেই কবিতা লিখেছেন। ‘শাতিল আরব’, ‘খেয়াপারের তরণী’, ‘কোরবানী’, ‘মোহররম’, ‘ফাতেহা-ই-দোয়াজদহম’ প্রভৃতি কবিতাগুলো এই সময়েই লেখা। মক্তবে পড়া হতদরিদ্র মাজারের খাদেম পরিবারের একটি ছেলের জন্য এ রকম ইসলামি ধারায় কবিতা লিখে নিছক মুসলমানদের মধ্যে খানিকটা বাহবা কুড়িয়ে জীবন কাটিয়ে দেওয়াই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু নজরুলের প্রতিভা ছিল এমন অসাধারণদের দলে যে, সাধারণ এসব হিসাব-নিকাশ উল্টে তিনি চলতে থাকেন সম্পূর্ণ নিজের তৈরি করা একপথে। ১৯২১ সাল অবধি যিনি মূলত ইসলামি কবিতা লিখছেন, ১৯২২ সালে এসে তিনি একপ্রকার হঠাৎ করেই লিখে ফেললেন ‘বিদ্রোহী’ কবিতা। এই কবিতার ভাষা, ছন্দ, উপস্থাপন ভঙ্গি এবং মিথ-এর ব্যবহার ছিল এককথায় অনন্য; চর্যাপদ থেকে শুরু করে প্রায় হাজার বছরের বাংলা কবিতার ইতিহাসে এমন তেজোদ্দীপ্ত ভঙ্গির কবিতা আর একটিও লেখা হয়নি। এই কবিতার আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক ছিল এর অসাম্প্রদায়িক চরিত্র। ভারতীয় ও গ্রিক পুরাণের পাশাপাশি এই কবিতায় ইসলামি ঐতিহ্যের সমান্তরাল ব্যবহার হয়েছে। এই কবিতায় যেভাবে ভগবানের বুকে পদচিহ্ন এঁকে দেওয়া কিংবা খোদার আসন আরস ছেদিয়া উঠবার ঘোষণা এসেছে, তাতে তাকে ধর্মনিরপেক্ষ বা ছিদ্রান্বেষীদের ভাষায় বলতে গেলে ধর্মদ্রোহী হিসেবে সনাক্ত করা চলে। বিশ শতকের শুরুর দিকে বাংলাদেশের কোনো ঘোষিত নাস্তিকও এতোটা বলার সাহস দেখাননি।
অথচ নজরুল ইসলামকে নাস্তিক হিসেবে শনাক্ত করা চলে না। তার অসংখ্য লেখা থেকে এবং ব্যক্তিগত আচরণ থেকে প্রমাণ দেওয়া যায় যে, সৃষ্টিকর্তায় তার বিশ্বাস ছিল। তবে সে বিশ্বাস যে আর দশজন মুসলমানের মতো ছিল না, তা একপ্রকার নিশ্চিত করে বলা যায়। নইলে বিশ শতকের ভারতবর্ষে তিনি ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন মুসলমান রয়েছে, যিনি নিঃসংকোচে ঘোষণা দিতে পারেন, তার মনের দোতারার একটি তার শ্যামের এবং আরেকটি শ্যামার? তার এই ঘোষণা নিছক একটা কথার কথা ছিল না, বস্তুত তিনি একই হাতে এত উৎকৃষ্ট শ্যামাসংগীত এবং শ্রীকৃষ্ণের ভজন লিখেছেন যে, শ্যামা কিংবা শ্যামের আজন্ম কোনো বাঙালি ভক্তও তা পারেননি। একটি গানে তিনি লিখেছেন:
শ্যামা মায়ের কোলে চড়ে জপি আমি শ্যামের নাম।
মা হলেন মোর মন্ত্রগুরু ঠাকুর হলেন রাধেশ্যাম।
পঞ্চদশ-ষোড়শ শতকের সাধক কবির-এর মধ্যে ছাড়া সমগ্র ভারতবর্ষের ভক্তিমূলক সাহিত্যে এমন অগতানুগতিক ভক্তির নজির মেলে না। এসব গান তিনি শুধু গ্রামোফোন কোম্পানির কাঁচা টাকার আকর্ষণে লিখেছিলেন, এমন নয়। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি হিন্দুধর্মের শাক্ত পদ্ধতির উপাসনা পর্যন্ত করেছেন। বিশেষত পুত্র অরিন্দম খালেদ, যাকে কবি বুলবুল নামে ডাকতেন, মাত্র সাড়ে তিন বছর বয়সে মারা যাওয়ার পর তিনি শোকে অধীর হয়ে কালীর উপাসনার মাধ্যমে শান্তি খুঁজেছিলেন। কালীর উপাসনার জন্য তিনি মুর্শিদাবাদের বরদাচরণ মজুমদারকে (১৮৮৬-১৯৪৭) গুরু হিসেবে গ্রহণও করেছিলেন। এই গৃহযোগীর কাছ থেকে নজরুল যোগ সাধনা শিখেছিলেন। গুরুর কথামতো শ্মশানে গিয়ে সাধনাও করেছিলেন। এমনকি বাড়িতে কালীর প্রতিমা স্থাপন করে তার পূজা পর্যন্ত করেছিলেন। ধর্মের এমন প্রথাবিরোধী চর্চা অবশ্য তার আগে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেব (১৮৩৬-১৮৮৬) হাতে কলমে করে দেখিয়েছিলেন। নজরুল নিজে রামকৃষ্ণের অনুরাগী ছিলেন কি না, তা জানা যায় না, কিন্তু কলকাতার শিক্ষিত হিন্দু মধ্যবিত্তের ধর্মভাবনায় তখন যেভাবে রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ স্থান করে নিচ্ছিল, তার খবর নজরুল নিশ্চয়ই জেনে থাকবেন। রামকৃষ্ণ মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়েছিলেন, খ্রিস্টীয় পদ্ধতিতে প্রার্থনাও করেছিলেন। নজরুল কি এই উদাহরণ দ্বারা প্রভাবিত হননি?
নজরুল ইসলাম যখন কালীপূজা করছেন, ভারতবর্ষের আবহাওয়া তখন ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। হিন্দুরা তাদের ধর্ম নিয়ে ঊনবিংশ শতকব্যাপী প্রবল হট্টগোল সেরে কিছুটা দুনিয়াদারির দিকে মন দিতে শুরু করেছে। অন্যদিকে মুসলমানদের মধ্যে শুরু হয়েছে ‘হিন্দুয়ানি’ ঝেড়ে ফেলা। রাজনৈতিকভাবে তাদের কাছে মুসলমানি পরিচয় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে—শিক্ষিত মুসলমানদের নাম থেকে ‘শ্রী’ অথবা ‘শ্রীমান’ বিশেষণটি উঠে যেতে শুরু করেছে, পোশাক হিসেবে মুসলমানেরা ধুতি ত্যাগ করতে শুরু করেছে, পাকিস্তান আন্দোলন জোরদার হতে শুরু করেছে। ধর্মীয় আত্মপরিচয়ের এই প্রবল ডামাডোলের মধ্যে নজরুল অংশগ্রহণ তো করলেনই না, বরং চলতে লাগলেন একেবারে উল্টোপথে। ১৯৪০ সালে লাহোরে যখন ফজলুল হক (১৮৭৩-১৯৬২) দ্বিজাতি তত্ত্ব উত্থাপন করছেন, তখন নজরুল বরদা মজুমদারকে তার যোগ সাধনার গুরু এবং তার যাবতীয় অর্জনের প্রকৃত অনুপ্রেরণা হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন। এ রকম অদ্ভূত সব কাণ্ড শুধু নজরুলের পক্ষেই ঘটানো সম্ভব ছিল।
জীবনের কয়েকটি বছর হিন্দুধর্মের শাক্ত, যোগ প্রভৃতি পদ্ধতিতে উপাসনা করলেও বাল্যকাল থেকে ইসলাম ধর্মকে নজরুল গুরুত্বের সঙ্গে অনুসরণ করেছেন। তবে সেই অনুসরণের স্টাইলও ছিল একান্তই নজরুলের নিজস্ব। যেমন, ত্রিশের দশকের শেষ দিকে যখন তিনি কালী সাধনা ও শ্যামা সংগীত রচনায় মগ্ন হয়ে আছেন, একই সময়ে তিনি কোরআনের অন্তর্নিহিত অর্থ অনুধাবনের জন্য একজন মুসলিম মরমি সুফি সাধককে অনুসরণ করছেন। ১৯৩৩ সালে কয়েকজন ইসলামি লেখকের সঙ্গে নজরুল কোরআনের আটত্রিশটি সুরা অনুবাদ করে ‘কাব্য আমপারা’ নামে প্রকাশও করেন। এই গ্রন্থটি মৌলভিদের উদ্দেশ্যে নিবেদন করে নিজেকে তিনি ইসলামের খাদেম (খাদেমুল ইসলাম) বলে উল্লেখ করেন। এছাড়া অসংখ্য কবিতায় ইসলামের প্রতি তার অনুরাগ ও আবেগ প্রকাশ পেয়েছে। যেমন:
আল্লা পরম প্রিয়তম মোর আল্লা তো দূরে নয়।
নিত্য আমারে জড়াইয়া থাকে পরম সে প্রেমময়।
আল্লাহ সম্পর্কে এখানে প্রেম ও ভক্তিময় অনুভূতিতে নজরুল নম্র; এই প্রেমময় ভাবের পাশাপাশি কিছু ধর্মীয় কবিতায় তার তেজোদ্দীপ্ত ভাবও প্রকাশ পেয়েছে। যেমন:
আমি আল্লার সৈনিক, মোর কোন বাধা-ভয় নাই।
তাঁহার তেজের তলোয়ারে সব বন্ধন কেটে যাই।
তুফান আমার জন্মের সাথী, আমি বিপ্লবী হাওয়া
‘জেহাদ’, ‘জেহাদ’, ‘বিপ্লব’, ‘বিদ্রোহ’, মোর গান গাওয়া!
বিপ্লব কিংবা বিদ্রোহের আওয়াজ এখন তরুণদের মধ্যে তেমন দেখা যায় না, তবে জেহাদি জোশের দেখা মিলছে যত্রতত্র। নজরুলের এই পংক্তিগুলোকে তারা হয়তো তাদের মনমতো ‘জেহাদের’ সাথে একদিন চালিয়ে দেবে। যাই হোক, কবিতার মতো অসংখ্য গানেও ইসলাম ধর্মের প্রতি তাঁর গভীর আবেগের প্রকাশ ঘটেছে। এরকম অনেকগুলো গান এতো জনপ্রিয় যে, নতুন করে সেগুলোর উদাহরণ দেওয়াও বাহুল্য মনে হতে পারে। বিশেষত ‘রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’—ঈদের চাঁদ দেখার পর থেকে সমগ্র বাঙালি মুসলমান এই গানের অনন্য লহরিতে যেভাবে উদ্বেলিত হয়ে ওঠে, তার তুলনা নেই। ঈদের আনন্দের যথার্থ প্রকাশের জন্য পৃথিবীর কোনো ভাষায় কি এমন অসাধারণ একটি গানও আছে? অথচ এই গানের রচয়িতা হয়েও নজরুল তার লেখক জীবনের পুরোটাই গোড়া মোল্লাদের ফতোয়ার মুখে পড়েছিলেন।
চলবে…
নজরুলের ধর্মচেতনা-১॥ দিব্যদ্যুতি সরকার