আমরা প্রতিনিয়ত নারীর মর্যাদা ও অধিকার সংরক্ষণের কথা শুনি। কারও কারও মুখে ফেনা উঠে যায় নারী অধিকারের কথা বলতে গিয়ে। কেউ শুনুক আর না শুনুক, নারী অধিকারকর্মীরা তা বলতেই থাকেন। তবে মোদ্দাকথা হচ্ছে, আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সেসব কথায় তেমন কর্ণপাত করে না। হয়তো আমরা কেউ কেউ সামাজিকতার কারণে কিংবা নিজেকে মানবতার পক্ষের মানুষ বোঝাতে নারীবাদীর ভেক ধরি। প্রকৃতপক্ষে এদেশে খুব কম মানুষই আছে, যারা নারীদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন। এমনকী অনেক উচ্চশিক্ষিত নারীও এ বিষয়ে অজ্ঞ। এতসব অজ্ঞতা-গোঁড়ামির ভিড়েও একটি চরিত্র বছরের পর বছর ধরে এদেশে নারী আন্দোলন করে যাচ্ছে। তার আন্দোলনকে খাটো করে দেখার উপায় নেই, তার অবদান অনেক বড় নারীকর্মীর চেয়েও কোনো অংশে কম নয়। আজ যদি চরিত্রটির বাস্তব অস্তিত্ব থাকতো, তাহলে হয়তো এতদিনে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়তো পুরোবিশ্বে। সেই চরিত্রটি হচ্ছে আমাদের প্রিয় কার্টুন চরিত্র—মীনা।
আমাদের বাঙালি সমাজে নারী অধিকারের বিষয়টা জনসাধারণের মস্তিষ্কের ভেতর সর্বপ্রথম কোনো ব্যক্তি নয়, বরং মীনা চরিত্রটিই ঢুকিয়ে দিয়েছে। এই অসাধারণ চরিত্রের সবচেয়ে শক্তিশালী দিক বলতে গেলে এটিই। আপনি বহু কার্টুন দেখবেন, তাতে বহু অবাক করা কাণ্ডকারখানা দেখবেন, বহু চরিত্র দেখবেন; কিন্তু মীনার মতো উদ্দেশ্যপূর্ণ চরিত্র আর খুঁজে পাবেন না।
মীনা চরিত্রটিকে বিশ্লেষণ করলে আমরা বহুগুণী মীনাকে দেখতে পাই। তবে তার সবচেয়ে প্রভাবশালী দিক হচ্ছে তার প্রতিবাদী রূপ। তার প্রতিবাদের ভাষাও ভিন্ন। সে প্রতিবাদ করতে মিছিল করেনি, সমাবেশ করেনি, বড় বড় বাণী দেয়নি; বরং সে সবসময় সমাজকে বুঝিয়ে দিয়েছে, কোনটি ঠিক, কোনটি বেঠিক। কার্টুনটির প্রতিটি পর্বেই তার এই প্রতিবাদী রূপের দেখা মেলে। মীনা প্রতিবাদ করেছে বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে, যৌতুকের বিরুদ্ধে, শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে। মীনা বার্তা দিয়েছে নারী শিক্ষার পক্ষে, নারী-পুরুষের সম-অধিকারের পক্ষে।
মীনা কার্টুনে শুধু মীনা চরিত্র নয়, পরিপার্শ্বের সব চরিত্র যেন বাস্তবতা থেকে তুলে আনা। এমন এক গ্রাম্য আবহ মীনা সিরিজে আমরা দেখতে পায়, সেটা যেন আমাদের চিরায়ত গ্রামের এক রূপ। যে গ্রামটি অজ্ঞতা, কুসংস্কারে আচ্ছন্ন; এ গ্রামের কোনো নাম হয় না, এদেশের প্রতিটি গ্রামই যেন মীনার গ্রাম। শুধু গ্রামে নয়, মীনা ধীরে ধীরে শহুরে সমাজের মাঝেও বার্তা দিতে চেয়েছে, সে বলতে চেয়েছে—শিশুশ্রম বন্ধ করুন। শিশু অধিকারের পক্ষে মীনার এই রূপ আমাদের শিশুদের মন কিংবা বড়দের মনেও তীব্র প্রভাব বিস্তার করে। আমাদের ভাবতে শেখায় বিষয়টা নিয়ে। কেননা, মীনা ভুল বলছে, এটা আপনি নারীবাদী না হলেও ভাবতে পারবেন না। চরিত্রটির গ্রহণযোগ্যতা এতটাই।
চরিত্রটি এতটা গ্রহণযোগ্য হওয়ার পেছনে কারণও আছে বটে। এটির অন্যতম প্রধান কারণ এর চিত্রনাট্য। মীনার চিত্রনাট্যে সূক্ষ্মতার সঙ্গে এমন কিছু বিষয় প্রবেশ করানো হয়েছে, যা দেখলে পুরোটাই বাস্তব মনে হবে। আপনি জানেন, হয়তো মীনার ওই গ্রাম বাস্তবে নেই, তবু আপনার কাছে মনে হবে ওই গ্রামের অস্তিত্ব আছে। আবার কিছু কিছু পর্বে মীনার কল্পনার অথবা স্বপ্নের জগৎ জনপ্রিয় মিথের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা হয়েছে। যেমন, মীনার তিনটি ইচ্ছে পর্বে, আরব্য রূপকথার দৈত্য ও কূপকে ব্যবহার করা হয়েছে সুস্বাস্থ্যের জন্য করণীয় বিষয়গুলো বোঝানোর জন্য। এছাড়া শহুরে সমাজে মীনা তার বাণী পৌঁছানোর জন্য—শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কথা জানান দিয়েছে।
এককথায় মীনা অতুলনীয় এক কার্টুন সিরিজ। যার নাট্যমূল্য বিশ্বের যেকোনো শীর্ষস্থানীয় কার্টুন সিরিজের চেয়েও অধিক। একটি নাট্যের যে সব অংশ থাকা উচিত, তার সবকিছুই এতে আছে: আরম্ভ, ব্যাপ্তি, ক্লাইমেক্স, সংকট সমাধান ও সমাপ্তি, এই পাঁচটি উপাদানের সবই মীনার প্রতিটি পর্বে উপস্থিত। এছাড়া এতে বিষয়বস্তু, সংলাপ, সময় ও ক্রিয়ার ঐক্য দেখা যায়। কোনো খাপছাড়া কিংবা এলোমেলো সংলাপ এখানে অনুপস্থিত। মীনার সংলাপে যে ভাষার ব্যবহার করা হয়েছে, তা শ্রুতিমধুর এবং সর্বজনবোধ্য। এই কারণে গ্রামের অশিক্ষিত কৃষক যেমন মীনার কথা বুঝতে পারে, তেমনি শহুরে পণ্ডিতও তা গ্রহণ করে।
এসব বাদেও মীনার সূচনা সঙ্গীতের কথা না বললেই নয়। সিরিজের প্রতিটি পর্বে শব্দ কিংবা মিউজিক সুশ্রাব্য এবং হৃদয়গ্রাহী। এনিমেশনের কাজের কথাও বলতে হয়। মীনার এনিমেশনের কাজ যে কোনো উচ্চ লেভেলের কার্টুনের মতোই। চরিত্রগুলোর মুভমেন্টে কোনো জড়তা নেই, পরিপার্শ্বের দৃশ্যও জীবন্ত।
এ তো গেলো মীনার শৈল্পিক রূপের কথা। এবার আসা যাক, মীনা কিভাবে আমাদের সমাজে প্রভাব বিস্তার লাভ করেছে? আমাদের সমাজে নারী অধিকার, শিশু অধিকার কিংবা স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মীনার গুরুত্বই বা কতটুকু? সংক্ষেপে বলতে গেলে মীনা এমন একটি কার্টুন সিরিজ, যেটি দর্শকদের শুধু বিনোদন দেয়নি, বিনোদনের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাও দিয়েছে। অনেকে বলে থাকেন, শিল্পের উদ্দেশ্য শুধু মনোরঞ্জন করা, শিক্ষা সেখানে গৌণ। কিন্তু যখন কোনো শিল্পকর্ম তার সৌন্দর্য বজায় রেখে শিক্ষাটাও দিয়ে যেতে পারে, সেগুলো মহান প্রকৃতির। মীনাও ঠিক তাই। মীনার শিক্ষার দিকগুলো উহ্য রেখেও মীনা উপভোগ্য। কিন্তু এই শিক্ষার দিকগুলোর প্রভাব অগ্রাহ্য করার সাধ্য কারও নেই। মীনা যেন এক শিক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে পুরো সিরিজে। সে আমাদের শেখাতে চেয়েছে বিভিন্ন জিনিস। এমনকী ঘরে বসে কিভাবে খাবার স্যালাইন বানাবেন তাও শিখিয়ে দিয়েছে মীনা। তার শিক্ষাগুলো আমরা একবাক্যে গ্রহণ করেছি। একসময় বাংলার ঘরে ঘরে মীনার মুখ থেকে শোনা রেসিপি অনুযায়ী আমরা খাবার স্যালাইন বানিয়ে ডাইরিয়া থেকে বেঁচেছি। সেসময় মীনা যেন আমাদের ডাক্তার আপা। এছাড়া নারীরাও যে প্রতিদিন নানা পরিশ্রমের কাজ করে সেটা বোঝাতেও ভোলেনি মীনা। নারী-পুরুষ সম-অধিকার খুব যৌক্তিকভাবে উঠে এসেছে ‘বুদ্ধিমতী মীনা’ পর্বে। এই পর্বের মাধ্যমে নারী-পুরুষ সম-অধিকারের ধারণা যখন শিশু হৃদয়ে গ্রন্থিত হয়, তখন তাদের মনে নানা কিছুর উদয় হয়। নারী শিশুরা তাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়, আবার ছেলে শিশুরা নারীদের প্রতি অবিচার না করার জন্য সচেতন হয়। শুধু তাই নয়, ‘বুদ্ধিমতী মীনা’ দেখে হয়তো কোনো অভিভাবকের দৃষ্টিভঙ্গিও পরিবর্তন হতে পারে।
এখন থেকে ২০-২৫ বছর আগে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মেয়ে শিশুদের অবস্থা ছিল করুণ। তখন গ্রামের বেশির ভাগ মেয়েকে বিদ্যালয়ে যেতে দেওয়া হতো না। সবার একটা বদ্ধমূল ধারণা ছিল, মেয়েরা ঘর-সংসার করবে; তাদের লেখাপড়ার কোনো দরকার নেই। এছাড়া অল্প বয়সেই তাদের বিয়ে দেওয়ার একটা ঝোঁক অভিভাবকদের মাঝে ছিল। মেয়েদের চেয়ে ছেলেদের ভালো ভালো খাবার, পোশাক দেওয়া হতো। কিন্তু এখন মেয়েদের নিয়ে এই নেতিবাচক ধারনার পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের পেছনে যে কার্টুন চরিত্রের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে সেটি হচ্ছে, মীনা।
মীনা কার্টুনের মূল উদ্যোক্তা ইউনিসেফ। বাংলাদেশি কার্টুনিস্ট মুস্তফা মনোয়ার মীনা চরিত্রের স্রষ্টা। মীনা কার্টুনের মাধ্যমে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, স্বাস্থ্যসম্মত পায়খানা নির্মাণ ও ব্যবহারে উৎসাহিত করা, মেয়েদের স্কুলে পাঠানো, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা, যৌতুক বন্ধ করা, নারী-পুরুষ সম-অধিকার, প্রয়োজনীয় ও সম-অধিকার পেলে মেয়েরাও অনেক কিছু হতে পারে তা বোঝানো, শহরের বাসায় কাজের মেয়েদের প্রতি সুবিচার ও তাদের প্রয়োজনীয় শিক্ষা নিশ্চিত করা, শিশুশ্রম বন্ধ করার মতো বহুমুখী বিষয়ে সচেতনতা তৈরির চেষ্টা করা হয়েছে।
মীনা এসব সচেতনতা সৃষ্টিতে অনেকটা সফল হয়েছে। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মীনার সামনে নতুন নতুন কঠিন চ্যালেঞ্জ আসছে। এখন সংঘটিত হচ্ছে নারী শিশু হত্যার মতো ভয়াবহ কাণ্ড, ব্যাপকহারে ঘটছে ধর্ষণের ঘটনা, নারীকে পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে পুরুষেরা, গৃহে গৃহে নারীকে স্ত্রীর নামে দাসী বানিয়ে চলছে নির্যাতন, কর্মক্ষেত্রে পর্যাপ্ত সুবিধা পাচ্ছে না নারী কর্মীরা, শিশুরা ডুবে আছে হতাশায়। এখন দেখার বিষয়, আট বছর বয়সী মীনা একুশ শতকের এই নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা কিভাবে করে।