রাস্তা একেবারেই জনশূন্য তখন। মূল সড়কে মৃদু আলো থাকলেও রাস্তার দু’পাশে গাঢ় অন্ধকার। দীর্ঘক্ষণ পরপর দুই-একটা কার্গো কিংবা ট্রাক ছুটে যাচ্ছে সাঁ-সাঁ শব্দে। মাঝে মাঝে অদৃশ্য কোনো জায়গা থেকে ভেসে আসা বেশ কয়েকটা কুকুরের ঝগড়া শোনা যায়। কখনো দুই-একটা সামনেও পড়ে। বড় অদ্ভুত ওরা! মানুষ দেখলে দৌড়ে পালায় না। বরং রাস্তার ওপর এমন ভাব ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, যেন ওরাই এ পথের রাজা!
রাত তখন প্রায় ২টা। রেজা হাটছে। পরনে জিন্স, গায়ে টি-শার্ট আর পায়ে কনভার্স। গলায় ঝুলছে একটা ক্যামেরা। এলোমেলো চুলের কয়েকটা এসে পড়েছে চশমার লেন্সের ওপর। বাম হাতের দুই আঙলের মাঝে একটা জ্বলন্ত সিগারেট। সিগারেটের অর্ধেকটা ইতোমধ্যেই ধোঁয়া হয়ে বাতাসে মিশে গেছে। নির্জন রাস্তায় একা হাঁটতে গা ছমছম করে রেজা’র। তাই সঙ্গী হিসেবেই এই সিগারেটের প্যাকেটটা এনেছে।
ইদানিং তার অদ্ভুত শখ জেগেছে—রাতের ঢাকায় একা একা ঘুরে বেড়ানো। তারপর রাতের সেই অভিজ্ঞতা থেকে বিভিন্ন ফিচার লেখা।
আজ বেরিয়েছে রাত ১২টার কিছু আগে। এখন সময় রাত ২টা। গত দুই ঘণ্টা ধরে নির্জন রাজপথে একা একা ঘুরছে সে। এখনো তেমন কিছুই দেখেনি, যা মনে রাখার মতো। দেখার মধ্যে শুধু দুটি ট্রাক, তরকারি বোঝাই একটা মিনি পিকআপ, আর দুই-তিনটি কুকুর।আর কিছুই না। এখনো কোনো মানুষ চোখে পড়েনি। তবে হাঁটার পুরো সময়টা একটা কমন বস্তু দেখেছে সবখানে। রাস্তার দুই পাশে সারি সারি ‘প্রদীপের খুঁটি’। যাকে আমরা স্মার্ট বাঙালিরা ‘ল্যাম্পপোস্ট’ বলেই চিনি। অনেকেই আবার স্ট্রিট লাইটও বলি। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ ফুটপাতের অন্ধকারাচ্ছন্ন একটা জায়গায় কিছু একটা নড়ে উঠতে দেখলো রেজা! অনেকটা কৌতূহল বশতই এগিয়ে গেলো সেদিকে। কাছে গিয়ে দেখলো ফুটপাতের অন্য জায়গার তুলনায় এখানে আলো কিছুটা কম। কারণ হিসেবে খুঁজে পেলো এখানের লাইটটা জ্বলছে না।
যাই হোক, দূর থেকে আসা মৃদু আলোর রেখায় রেজা দেখতে পেলো নড়েওঠা বস্তুটা। ময়লা কাপড়ের একটা স্তূপ মনে হলো। পাশেই দুটি কুকুর, একটি শুয়ে আর একটা বসে আছে। রেজা ভাবলো একটা ছবি তুলে রাখা যায়। ক্যামেরাটা হাতে নিয়ে ঝটপট দুই-তিনটি ছবি তুলে নিলো। ক্যামেরার ফ্লাস লাইটের আলোয় আবার কেঁপে উঠলো ময়লা কাপড়ের স্তূপ। স্তূপের নিচ থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসলো একজন মানুষ। কুকুর দু’টিও ইতোমধ্যে চেঁচানো শুরু করে দিয়েছে। রেজার দিকে একবার ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আবার নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লো লোকটি। বিস্ময়ে হতবিহ্বল হয়ে মিনিট দুয়েক দাঁড়িয়ে থাকলো রেজ।
আবার হাঁটতে শুরু করলো। একটা সিগারেট ধরালো। কিছুদূর এগিয়ে বারবার ইচ্ছে করছিল পেছন ফিরে দেখতে। কিন্তু ভয়ে রেজা আর ফিরে তাকায়নি, বরং যথাসম্ভব দ্রুত হেঁটে নিরাপদে জায়গায় যেতে চাইলো। তার ভয় হচ্ছিল—এই বুঝি লোকটি উঠে এসে তাকে চেপে ধরবে।
ময়লা কাপড়ের স্তূপের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানুষের সেই ফুটপাত থেকে অনেক দুরে চলে এসেছে রেজা। শহরের একটা উদ্যানের পাশের রাস্তা ধরে হাঁটছে এখন। এ রাস্তায় অবশ্য কয়েকজন মানুষ চোখে পড়লো। একজন রিকশাঅলা যাত্রীশূন্য রিকশা নিয়ে গান গাইতে গাইতে ছুটে চলেছে। গানের ফাঁকে ফাঁকে মনের সুখে বিড়িতে লম্বা টান দিচ্ছে। কয়েকজন তরুণকে দেখা গেলো সাইক্লিং করতে। পুলিশ চেকপোসেটরও দেখা মিললো। সেখানে বসে বসে ঝিমুচ্ছে পুলিশের কয়েকজন সদস্য।
গভীর রাতে এই নির্জন রাস্তায় রেজা সবচেয়ে বেশি যে প্রাণীটিকে দেখেছে, সেটি হলো কুকুর। রাস্তার প্রায় প্রতিটি মোড়েই ওদের দখলদারিত্ব। রেজা অনুমান করতে চেষ্টা করে, দৃশ্যমান ও অদৃশ্য কত কুকুর আছে এই শহরে? অন্ধকারে প্রশ্নও ছুড়ে দেয় সে। কিন্তু উত্তর পায় না। আনমনেই সিদ্ধান্ত নেয়, সময় সুযোগ হলে একবার পুরো শহরে কুকুর শুমারি করবে।
এসব ভাবতে ভাবতে উদ্যানের পাশের রাস্তাটা ধরে অনেকদূর চলে এসেছে রেজা। একনাগাড়ে অনেকক্ষণ হাঁটার পর কিছুটা ক্লান্ত সে। মনে মনে ভাবে, খানিকটা ঝিরিয়ে নিলে মন্দ হতো না! রাস্তার পাশে উচুঁ ফুটপাতে একটা ল্যাম্পপোস্টের গোড়ায় বসলো সে। নিস্তব্ধ আঁধার রাতে মাথা উচুঁ করে দাঁড়িয়ে আছে আলোর খুঁটিগুলো। সহস্র ঘটনার সাক্ষী হয়ে থাকা একেকটা ‘কালের খুঁটি’ যেন! আঁকাবাঁকা রাজপথকে আলোকিত করে রেখেছে। দূরের রাস্তার দিকে তাকালে মনে হয় যেন আলোর সুড়ঙ্গ! এখানে বসে কয়েকটা ছবি তুললো রেজা। মৃদু বাতাস বইছে। বাতাসে ধুলোবালি নেই, দুর্গন্ধ নেই। থেমে থেমে দুই-একটা নিশাচর পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে।
একটা সিগারেট ধরালো সে। তারপরই ভাবলো, নিকোটিন কি মানুষের নিঃসঙ্গতা দূর করতে পারে? হয়তো পারে, কিংবা পারে না। আসলে এটা হলো মানুষের কল্পনাশক্তির ব্যাপার। মানুষ যেটাকে যে রকমভাবে চিন্তা করে, সেটাকে তার সে রকমই মনে হয়। তবে সিগারেটকে ভালো কিছু ভাবাটা মোটেই যৌক্তিক নয়—এসব ভেবে তবু নিকোটিন ফুঁকছে রেজা। আসলে এটাই মানুষের স্বভাব। মানুষ নিয়ম ভাঙতে পছন্দ করে। এমনকী ভাঙার জন্যেই তারা নতুন নতুন নিয়মও তৈরি করে! বড্ড অদ্ভুত স্বভাব তার।
রেজা হঠাৎ খেয়াল করলো, তার ডান পাশের ল্যাম্পপোস্টকে মাঝে রেখে ওপাশে একটা মেয়ে এসে বসেছে। মেয়েটা দেখতে মোটামুটি সুন্দর। কিন্তু ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোয় তাকে অনেক বেশি সুন্দর লাগছে। রেজা তাকালো মেয়েটার দিকে। বয়স কত হবে? ষোলো কী সতেরো! আঠারোও হতে পারে। মেয়েটাও রেজার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। হঠাৎ মেয়েটি তার ব্যাগ থেকে আয়না বের করে সাজতে শুরু করলো! ঠোঁঠে লিপস্টিক লাগালো, কপালে একটা লাল টিপ পরলো। রেজা আশ্চর্য হয়ে মেয়েটির কাণ্ড কারখানা দেখতে লাগলো। মেয়েটি তখনো তার দিকে তাকিয়ে হাসছে। রেজা এগিয়ে গেলো।
—এই কে তুমি?
—ক্যান চোখে দ্যাখেন না? আমি জলজ্যান্ত মাইয়া মানুষ।
—এত রাতে এখানে কী করছ?
—আপনে গো লাইগাই ঘুরতাছি।
—আমাগো লাইগা ঘুরতাছ মানে!
—হইছে আর ঢঙ করোন লাগবো না! আপনে এত রাইতে এইহানে ক্যান আইছেন, মাইয়া মানুষ খুঁজতে আহেন নাই?
—আশ্চর্য! আমি কেন মাইয়া মানুষ খুঁজতে আসবো?
—ও বুচ্চি! আপনে হইলেন দুধের পোলা।
—দুধের পোলা মানে!
—মানে হইলো অবুঝ। হোনেন, আমরা হইলাম খারাপ মাইয়া মানুষ। গতর বেইচ্চা খাই। আপনের মতো অনেক ভদ্রলোক আমাগো কাছে আহে। বুঝছেন?
—ছি ছি! তোমরা এই অসামাজিক কাজ কেন করো? অন্যকিছু করেও তো খেতে পারো।
—হোনেন ভাই, ওহ্ হো। আপনেরে ভাই ডাইকা ফালাইলাম! কিছু মনে কইরেন না। (বলতে থাকে মেয়েটি) সংসারের জোয়াল কান্ধে লইয়া গ্রাম থেইকা শহরে আইছি। আপনে গো এই সমাজ কিংবা সরকার আমাগোরে কোনো কাম দেয় নাই। বরং কাঁচা মাংসের গন্ধ পাইয়া আপনেগো মতো ভদ্রলোকেরা বারবার অন্ধকার ঘরে টাইন্যা নিতে চাইছে। তয় হেরা কাম না দিলে কী হইবো, ভাগ্য গরিব মাইনষের পাশে থাকে! আর হেই ভাগ্যই আমাগোরে এই অন্ধকার রাইতের কাম জোটাইয়া দিছে। এহন অন্তত দিনের বেলায় আপনেগো ভদ্র সমাজের মাইনষের লগে মিইশ্যা তিন বেলা দু’মুঠো ডাইল-ভাত খাইয়া বাঁচতে পারি!
মেয়েটি এই পর্যন্ত বলেই হঠাৎ থামলো। শাড়ির আচঁলে চোখ মুছলো। হয়তো তার চোখ ভিজে উঠেছিল কিংবা চোখে কিছু পড়েছে। রেজা এতক্ষণ মেয়েটির কথা শুনেই যাচ্ছিল।এবার মেয়েটির নাম জানতে চাইলো।
—নাম কী তোমার?
—আপনে আমার নাম জাইন্যা কী করবেন?
—তুমি না আমাকে ভাই ডেকেছ! ভাই কি বোনের নাম জানতে পারে না?
—হ পারে। আমার নাম ফুলবানু। তয় এইডা ছদ্মনাম। আসল নাম হেলেনা।
তারা যখন কথা বলছিল, ঠিক ওইসময় একটু দূরে দাঁড়িয়ে কয়েকজন লোক শিস দিয়ে উঠলো। শুনে উঠে দাঁড়ালো হেলেনা ওরফে ফুলবানু। উঠে দাঁড়ালো রেজাও। মেয়েটি বললো, জাইগা ভাই, কাস্টমার আইছে। বলেই চলতে শুরু করলো। রেজা তাকিয়ে থাকলো মেয়েটির যাওয়ার পথের দিকে। তার মনে হলো, কয়েকটি নেকড়ের সঙ্গে অনন্ত পথ ধরে হেঁটে চলেছে একটি সোনালি হরিণ!