এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে রাত; ঘোরতর দুশ্চিন্তা জটিল অসুখের মতো এই সময় চড়চড় করে বাড়ে। এক একটা আস্ত রাত কোনোমতে কাবার করা নিয়ে কথা। ভোর মানেই স্বস্তি; যতক্ষণ তা না হচ্ছে, কাকের ডাক শোনা না যাচ্ছে…দাঁতাল দুশ্চিন্তা তাকে বেড় দিয়ে রাখে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে উসখুস করতে করতে মনোয়ার হাঁপিয়ে ওঠে, এ যেন আবর্জনার ভেতর সে নাকচোখ চুবিয়ে পড়ে আছে, হাত-পা বাঁধা। তিন-তিনটে জানালা, এর যেকোনো একটা একটু ফাঁক করে রাখলেই ঘরে-বাইরের হাওয়া ঢুকতে পারে; কিন্তু ভুলেও সে তা করে না, ভয় তাকে শেকলবেড়ি পরিয়ে রেখেছে।
এখন রাত মানে আতঙ্ক, অবিশ্বাস, নিয়তির হাতের পুতুল সাজা। এই যে আজন্ম পরিচিত হাত-পা, চোখ-নাক-কান জীবন, যেকোনো মুহূর্তে অতি সহজেই সবকিছু বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে, চোখের পলক পড়তে না পড়তে সবকিছু অচেনা হয়ে যেতে পারে।
এখন রাত মানে ভারি ভারি বুটের শব্দ, রাত মানে সুমসাম গ্রেফতার, অতর্কিতে বেয়নেট চার্জ। আতঙ্কিত ভূতগ্রস্ত অসংখ্য মানুষের মতো প্রাণভয়ে ভীত মনোয়ার আপন মনে রাতভর হাই হাই কোদাল চালায়। ভৌতিক মূৰ্ছার ভেতর এটেল মাটির মতো চাপ চাপ অন্ধকার সরানো, এই-ই তার একমাত্র কাজ।
টাক-দুম!
—কাছাকাছি কোথাও রাইফেলের গুলির আওয়াজ ফেটে পড়লো। অন্ধকারের ওপর পুরু একটা সর পড়েছিল, এখন তা তিরতির করে কেঁপে উঠলো; হয়তো তুচ্ছ কোনো কারণে ভয় পেয়েছে ছাউনির সৈন্যরা, শরীরকে চাঙ্গা করে নেবার জন্যে নিছক একটা ফায়ার। আজকাল তো সৈন্যরা এরকম খামোকা ফায়ার হরদমই করে থাকে। ছাউনির রাজাকাররাও হতে পারে। হয়তো তারাই এখন পাহারায়। অনেকের মতো মনোয়ারও জানে কারণে-অকারণে কিভাবে এদের হাত নিসপিস করে, এরা সবসময় হয়ে আছে খয়ে-গোখরো, একেবারে দুম করে হাতে কন্ধে পেয়েছে, গায়ে মাছি বসলেও ক্ষেপে ওঠে, জোরে বাতাস ছুটলেও এদের ইচ্ছে হল্ট বলে তা থামিয়ে দিতে মনোয়ার দেখেছে, কিছু না পেয়ে উড়ন্ত ঝিঁঝিঁ পোকার দিকে তাক করে ফটাফট গুলি ছুড়ে নিজেদের রসিকতায় এরা কিভাবে হো হো করে হাসে… মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিমান, মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিমান, হেউ!
মনোয়ারের মাথার ভেতর অনেক কিছু বিজবিজ করে। আচ্ছা, সত্যিই যদি এমন হয়, আলো-বাতাস, নদ-নদী, পাহাড়-পর্বত, গাছপালা, পোক-মাকড় সবকিছুই যদি মুক্তিবাহিনীর হয়ে কাজ করে, তখন? যে কোনোদিন তো মহামড়কও শুরু হয়ে যেতে পারে; দেখতে না দেখতে গোটা সৈন্যবাহিনী সাপাচাট, তখন? টাইফয়েড, ডিসেনট্রি, আরো বাপ, নেপোলিয়নের মতো বাহাদুরের বাচ্চারও তেরোটা বাজিয়ে তবে ছেড়েছিল।
ভেল্কিবাজি চাই, রাতারাতি সবকিছু বদলে যাক, গাছের ফুল ডালের পাখি, নদীর মাছ, সাপ ব্যাঙ ছুঁচো ইঁদুর সবাই একযোগে একটা কিছু করে ফেলুক, রাতারাতি স্বাধীন হয়ে যাক দেশটা। রক্তবৃষ্টি হোক, মাংসবৃষ্টি হোক, কালো রোদ ঝরুক, সবকিছু হয়ে যাক বিষাক্ত, রাতারাতি স্বাধীন হয়ে যাক দেশ।
রাত দুটো মনোয়ার টাইমপিসে সময় দেখে নেয় একবার।
মুক্তিবাহিনী এখন কতো দূর?
কোথায় এখন?
কী করছে এখন গেরিলারা!
না কি যাত্রাবাড়ির ব্রিজের ওপার পর্যন্তই তাদের সব কেরামতি! ব্রিজের এপারে বালবাচ্চা প্যাঁচানো মানুষজন ভরা থুকথুকে শহর পড়ে আছে, রাক্ষুসে সৈন্যরা ইচ্ছে হলেই কচকচে গলদা চিংড়ির মতো ক্যাঁচম্যাঁচ করে চিবোতে পারে শহরটাকে যেকোনো সময়, এসব নিয়ে কি তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই। সম্পাদকীয় লেখা, সিনেমা দেখা, কেনাকাটা করা, রেডিও-টেলিভিশনের অনুষ্ঠান তৈরি করা, মেয়েমানুষকে ভালোবাসা, সোনার গহনা জড়ানো তাবৎ সামাজিকতায় গা-চোবানো ব্রিজের এপারে মানুষগুলোকে সম্ভবত তারা ঘৃণা করে!
গত পরশুদিন রাতে ইলেকটিক সাপ্লায়ের একটা সাব-ষ্টেশন উড়ে গেছে, টহলদার সাটলেজ রেঞ্জার্সের জীপগাড়িতে গ্রেনেড পড়েছে, জনৈক মন্ত্রী মহোদয়ের গাড়ির ভেতর বোমা ফেটেছে, বোঝা যায় গেরিলারা হাত-পা গুটিয়ে বসে নেই, এমনকি দিন-দুপুরে সকলের নাকের ডগায় একটা পুলিশ ফাঁড়িও তছনছ করে দিয়েছে গেরিলারা। কিন্তু তেমন কোনো প্রতিক্রিয়া হয়েছে কি!
সম্ভবত না। সৈন্যরা যেন গ্রাহের মধ্যেই আনতে চায় না এসব। পিঠে রাইফেল ঝুলিয়ে গয়ংগচ্ছভাবে ঘোরাফেরা করছে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে সাগরকলা গিলছে একটু আধটু ফুটফাট বৈ তো তেমন কিছু নয়, ভাবখানা এই রকমই।
মুক্তিবাহিনী বিরাট একটা কিছু করছে না কেন, না কি তেমন ক্ষমতা তাদের নেই। ধুকে ধুকে কুকুর-বেড়ালের মতো মরতে হবে সবাইকে, শেষ পর্যন্ত তো এমনও হতে পারে!
মনোয়ার হাসফাঁস করতে থাকে, হাত-পা বেঁধে আমোদপ্ৰিয় সৈন্যরা যেন বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিয়েছে তাকে, ক্রমশ তলিয়ে যাচ্ছে, একটা বিরাট পিচ্ছিল বাইন তার গলা দিয়ে ঢুকবার জন্যে ক্রমাগত তড়পাচ্ছে।
দেশ না শ্মশান। চতুর্দিকে ধ্বংসস্তুপ আর ধ্বংসস্তুপ। যেকোনো সংসার যেকোনো বাগান ছত্ৰাখান করে দিতে পারে সৈন্যরা. ছারখার করে দিতে পারে লোকালয়। বস্তির পর বস্তি পুড়ছে। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় হটোপুটি খেলছে লকলকে আগুন। মুক্তিবাহিনী এক পা এগোয় দুপা পিছায়, একজন সৈন্যকে সুবিধেমতো পেয়ে কাবু করে পালায়, তারপর কতোগুলো নাংলা চাষার বেঘোরে প্রাণ যায়। শেষ পর্যন্ত মরে সব ভূত হয়ে যাবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না। মুক্তিবাহিনী তো কোন ছার,…মনোয়ার ভেতরে গোছায় তাঁর কথা, এখানে-ওখানে লাশের ওপরে লাশ পাহাড় হয়ে আছে, টানা-হ্যাচড়া করছে কুকুর, শকুনে ছিড়ছে, দাফন-কাফন নেই, সামান্য যে ফিরে তাকানো সাহসে কুলোয় না তা-ও এর ওপরে বসে স্বাধীনতার বাতুল চিন্তা, মনোয়ার অস্থিরতার চালে পড়ে একটু একটু করে ক্ষেপে ওঠে। এতোসব ম্যাও মুক্তিবাহিনী এক যদি সামলাতে পারতো, ধুত্তোরি’ বলে মনোয়ার ঘাড়ের নিচের বালিশকে দুমড়ে দেয়।
টাক-দুম টাক-দুম!
পরপর দুটো গুলি ফুটলো এবার খুব কাছাকাছি। গা ছমছম করে উঠলো মনোয়ারের। একপা দু’পা এগিয়ে আসছে বিপদ, যে বিপদের কোনো মা-বাপ কিংবা হাত-মাথা, নেই। একটা জীপগাড়ি কি একটা ট্রাক কি একটা ঘোড়ার ডিম ঝড়ের বেগে উড়ে গেল। দূরে কোথাও আগুন জ্বলছে, বিছানার ওপর দাঁড়িয়ে জানালার ফাঁকে চোখ লাগিয়ে মানোয়ার দ্যাখে শহরের একটা কোণ লাল হয়ে আছে, আগুনের লেলিহান শিখা হিলহিল করে আকাশের দিকে লাফিয়ে উঠছে।
দলামোচড়া হয়ে মনোয়ার বিছানার ওপর আবার শুয়ে পড়ে অজানা এক ভয়ে তার হাত-পা প্রায় অবশ হয়ে এসেছে, মাথার ভেতরে ঝিম। পেতলের বাটির চেয়ে হিম, সাপের গায়ের চেয়েও চটচটে, সারামুখে উল্কি দাগানো এক ভয় ধপ করে আছড়ে পড়েছে। মনোয়ারের শিরদাড়ার ওপর, জাপটে ধরেছে সজোরে। একদল দুর্দান্ত গরগরে সৈন্য যেন টেনে-হিচড়ে ঘর থেকে তাকে বের করে নিয়ে যাওয়ার অধীর অপেক্ষায় দরোজার ওপারে থাবা তুলে বসে আছে, খুটখাট একটু শব্দ হলেই ঝাঁপিয়ে পড়বে।
কী করা যায় এখন, প্রায় রোজই তার এরকম হয়, আধমরার মতো বিছানায় পড়ে থেকে একটার পর একটা দুঃস্বপ্ন দ্যাখে। জেগে জেগে সে চোখের সামনে ভয়াবহ দৃশ্য দ্যাখে। এই এখন যেমন মনে মনে সে তৈরি হয়ে নেয়, আর একটু পরেই একটা বিড়াল ম্যাও বলে ডেকে উঠবার ঠিক পরপরই সে হুট করে ধরা পড়ে যাবে। তখন কি কি বলতে হবে তাকে, কি কি বলা দরকার, মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে মনোয়ার : হ্যা হ্যা কালপ্রিট, স্বীকার করছি সব আমি সব, স্বীকার করবো, আমার কাছে কোন লুকোছাপা নেই, টর্চার বন্ধ করো সব স্বীকার করবো, আমি কালপ্রিট, হ্যা, দেশের বিরুদ্ধে অনেক গৰ্হিত কাজ করেছি আমি, আমি গাদ্দার, আমি কালপ্রিট, আমি ক্র্যাক ডাউনের পর…সরি স্যার, পঁচিশে মার্চের পর, তার মানে ছাব্বিশে মার্চ সকাল ন’টা কি দশটার দিকে আমরা নিজেদের বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছিলাম, পাড়াসুদ্ধ সবাই, জি হ্যা তখন কারফিউ ছিলো, মানিকনগরের দিক থেকে আমরা হাঁটা ধরেছিলাম, ধানক্ষেত, খানাখন্দ, কাদা, পানি ভেঙে সবাই নরায়ণগঞ্জের রাস্তা ধরি, দূর থেকে স্টেট ব্যাঙ্কের ছাদের লোহার টুপিওলা সৈন্যদের সরি স্যার দেশরক্ষা বাহিনীর লোকদের ঝাপসা ঝাপসা দেখা যাচ্ছিল, ভাগ করে ছাদের ওপর থেকে গোলা ছুড়ছিলো তারা খুবই নির্ভুল স্যার তাদের হাতের, টিপ বড় একটা ফসকায়নি, পাখির মতো ঝাঁকে ঝাঁকে মানুষ মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিল, পাখি মানে স্যার চিড়িয়া, আমরা আগে চিড়িয়া-ই বলতাম, হুজুর হিন্দুরা আমাদের পাখি বলতে শিখিয়েছে, আমরা এখনো স্যার চিড়িয়াখানা বলি, আমরা সবাই পড়ি কি মরি করে ছুটেছিলাম, কখনো সামনে কখনো পেছনে দুমদাম গোলা ফাটছিলো, প্রতিবারই পুকুরে ঝাঁপ দেবার মতো চড়াৎ চড়াৎ করে মাটির ওপর আছড়ে পড়ছিলাম আমরা, আমি কনফেস করছি স্যার, আমরা সবাই কামানের গোলার পাল্লার বাইরে যাবার চেষ্টা করছিলাম, গাড়োল, গাড়োল, নিজেদের কবর খুঁড়লো হতভাগার-হ্যাঁ স্যার আমার বাবার মুখ থকে ফস করে কথাটা বেরিয়ে গিয়েছিল সে সময়, হাঁটু কনুই সব ছড়ে গিয়েছিল আমার বাবার, বাবা মানে স্যার আব্বা, আম্মাজান দৌড়ুতে পারছিলো না, অনেক পেছনে পড়ে গিয়েছিল মা: আমার মাদার, মঞ্জু, আমার বোন, বহেন, আমার হাত ধরে দৌঁড়াচ্ছিল, আমি সব কনফেস করবো স্যার, আমি মুসলমান স্যার, মুসলমান কখনো মিথ্যে বলে না, স্যার, মিথ্যে হলো কুট, আমার ঈমানের জোর আছে স্যার, জিন্না সাহেব বলতেন ঈমান, একতা, শৃঙ্খলা, ঐ যে বললাম আমার হাত ধরে দৌঁড়াচ্ছিল আমার বোন মঞ্জু, সেও কালপ্রিট, সে একটি ছেলেকে ভালোবাসে, ছেলেটি পলিটিকস করে, ওর পাল্লায় পড়ে আমার বোন অনেক কুকাম করেছে। নিজের হাতে কাপড় কেটে স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্রওয়ালা পতাকা সেলাই করে ছাতে উড়িয়ে দিয়েছিল মঞ্জু, আমি মিথ্যে বলতে শিখিনি, স্যার, টর্চার বন্ধ করো, ঐ ছোকরার পাল্লায় পড়ে আমার বহেন ঐ কর্মটি করেছিল, কালো পতাকা উড়িয়েছিল আমার ছোট ভাই, জ্বি না টালটাল নয় স্যার, ওর নাম টুলটুল, টিইউএল টিইউএল, টুলটুলই কালো পতাকা উড়িয়েছিল, ওর নাম আগে করিনি কেন, ভুলেই গিয়েছিলাম স্যার, ও যে আমার ব্রাদার ভুলেই গিয়েছিলাম, জ্বি হাঁ পালানোর সময় টুলটুল আমাদের সঙ্গেই ছিলো, পাগলার ওখানে বড় রাস্তা ডিঙিয়ে আমরা নৌকো ধরে নদী পার হয়েছিলাম, কিছুটা হাঁটার পর আবার নৌকা, তখন সন্ধ্যা উতরে গেছে, প্রথমে উঠলাম কাঠপট্টিতে, কাঠপট্টি থেকে রিকশায় করে কেওয়াড়ের দিকে যাচ্ছিলাম আমরা, ঐ সময়ে সে একদিকে ভেগে যায়, টেরই পাইনি স্যার আমরা, হা স্যার রামপালের কাছাকাছি ভোজবাজির মতো গায়েব হয়ে যায় টুলটুল, ওতে আমাদের কারো কোনো হাত নেই স্যার, না স্যার এব্যাপারে ফাদার…আব্বাজন স্যার একেবারে নির্দোষ, বিশ্বাস করুন স্যার, ইয়েস স্যার খুব সম্ভব তাই স্যার, হাঁ স্যার এজেন্ট ছিলো ইণ্ডিয়ার, আগে আমাদের কিছুই জানা ছিলো না স্যার, আমার ফাদার স্যার, আব্বাজান স্যার…জিন্না সাহেবের এ্যাডমায়রার স্যার, জিন্না লিয়াকত আলী, সরদার আবদুর রব নিশতার, আমির অব কালাবাগ, ফিরোজ খান নুন, খটক ড্যান্স, চুঘতাই-এর ছবি, মালকা ইতারানুম নূরজাহান, কারনানাইলজি জানরাইলজি গান এসব বলতে অজ্ঞান আমার ফাদার, আমাদের নিজস্ব কোনো কালচার নেই স্যার, আমরা আধা-হিন্দু আধা-মুসলমান স্যার, হা স্যার এখনো গ্ৰামদেশে অনেকের খৎনা হয় না, আমি নিজেই একজন কালপ্রিট স্যার, রোজা-নামাজ করি না ঈদের নামাজও নয় স্যার, ঈদের দিন দরোজা বন্ধ করে সকাল দশটা পর্যন্ত ঘুমাই, না স্যার মুতেও পানি নিই না স্যার, আমি কনফেস করছি স্যার, আমি কালপ্রিট, টর্চার বন্ধ করো…
নিজের সঙ্গে একনাগাড়ে অনেকক্ষণ ছিটগ্রস্তের মতো বিড়বিড় করারপর এক সময় মনোয়ারের মনে হয় মুখে উল্কি দাগানো ভয় কোন ফাঁকে তার শিরদাঁড়া থেকে নেমে গেছে, সে টের পায়নি। এখন পালকের মতো হালকা হয়ে গেছে তার শরীর। ঘরের ভেতরে অন্য কেউ নেই, সবই ঠিক আছে পাশের ঘরে বাবা-মা ঘুমোচ্ছে, ঘুমোচ্ছে কি জেগে আছে, হয়তো জেগে জেগে ফিসফাশ করছে, মঞ্জুকে ডহুরীতে রেখে আসা হয়েছে: মঞ্জুর কথা হচ্ছে কি? কে জানে কতোদিন চলবে এই যমে-মানুষের টানাটানি। কি কোথায় সব ছিটকে পড়লো, সবাই আছে আবার কেউ নেই, ছাড়াছাড়ি, কোনো রকমে হিচড়ে হিচড়ে টেনে বেড়ানো, ক্লান্তি সব ক্লান্তি।
মনোয়ার একটা সিগ্রেট ধরালো। সময় দেখলো আবার। এখন রাত আড়াইট। ডহুরীর পাশের গ্রামে সৈন্যবাহিনী তুলকালাম কাণ্ড করে গেছে হস্তাখানেক আগে, লোকমুখে খবর পাঠিয়েছে মামা, নপাড়ার হাটের মানুষজন গানবোটের চলাফেরা দেখেছে, আজ পাড়াগাঁও আর নিরাপদ থাকছে না। মঞ্জু ঠিক আছে তো?
মঞ্জুর যদি কিছু একটা ঘটে যায় সর্বনাশ হয়ে যাবে। সৈন্যরা আদতে কি? আমি বাবা মা টুলটুল আর মঞ্জু এই পাঁচজনের জীবনের গ্যারান্টিও তারা দিতে পারে না,…মনোয়ারের মনে হলো এইসব, আর ঠিক এ সময় জানালার পাশে চাপা গলা শোনা গেল, দাদা, আমি টুলটল, শব্দ না করে দরোজা খোলো!”
ধড়াস করে উঠলো মনোয়ারের বুক। রাত এখন আড়াইটা, কারফিউ, সর্বনাশের কথা। লাফ দিয়ে ওঠে দাঁড়ায় মনোয়ার। পষ্ট টুলটুলের গলা, তবু দরজা খুলবে কি খুলবে না ভেবে পেলো না।
আলো জ্বালবি না, ঘর অন্ধকার রেখেই দরোজা খোল, বাইরে যেন আলো না আসে।
দাঁত চেপে ভয়ে ভয়ে দরজা খোলে মনোয়ার। আতঙ্কে আর উত্তেজনায় তার সারা গা শিরশির করে।
আর পাশ কাটিয়ে টুলটুল ঘরে ঢোকে, নিজেই খিল আটকে দেয় দরোজার।
‘তুই কোত্থেকে?’
‘সে অনেক কথা, মা-বাবা ঘুমোচ্ছে, আস্তে কথা বল, কাউকে জাগানো চলবে না, এক্ষুণি আবার কেটে পড়ব, দেয়ালেরও চোখ-কান আছে এখন…’
‘সত্যিই তুই একটা হাত চেপে ধরলো মনোয়ার, টুলটুল তোর বিশ্বাস হয় না…’
‘রেকি করতে এসেছিলাম, অন্য কিছু কাজও আছে হাতে। আর একটু হলেই এক শালা ট্রেস করে ফেলেছিল আর কি। একটু আগে গুলির আওয়াজ শুনিসনি? সময়মতো সটকাতে না পারলে শালার ভাই নিৰ্ঘাত গেথে ফেলেছিল আজ। কেমন আছিস সবাই?’
‘ভালো, এতদিন আসিসনি কেন?’
‘আসা সম্ভব ছিল না। আমাদের জীবনটা খুব একটা সুখের নয়…’
‘সে তো দেখতেই পাচ্ছি। ভূতের মতো কি বিদঘুটে চেহারাটাই না হয়েছে!’
‘আর চেহারা!’
‘আর চেহারা মানে?’
‘চেহারা নিয়ে কি ধুয়ে খাবে…’
‘তোকে চেনা যায় না। এই ক’ মাসে কি অসম্ভব রকম বেড়ে গেছে তোর বয়েস…’
‘ওসব কথা থাক। কুকুর-বেড়ালের মতো মরে তো আর কোন লাভ নেই, মরলে মানুষের মতোই মরা উচিত।’
কিছু একটা ভেবে মনোয়ার অধীর আগ্রহে ভেঙে পড়ে বলল, ‘সত্যি করে বলতো, শেষ পর্যন্ত দেশ স্বাধীন হবে?’
‘আলবৎ হবে, তবে অনেক সময় লাগবে, আরো অনেক রক্ত দিতে হবে, আরো অনেক ক্ষতির জন্যে তৈরি থাকতে হবে। হয়তো আমরা সবাই থাকবো না, কেউ কেউ থাকবো। এই যা, চুলোয় যাক এসব কথা, তুই কি করছিস এখন, লেখাটেখা?’
‘লেখা, মাথা খারাপ নাকি তোর! ‘
‘লিখছিস না কেন, অন্তত কিছু লেখ, লিখে জমিয়ে রাখ, পরে হয়তো কাজে লাগবে…-’
‘লিখতে হাত সরে না, ভয় করে। ভয়ে পুরোনো লেখা সব পুড়িয়ে ফেলেছি!”
‘তুই একটা যা-তা, ভীতুর ডিম, অন্তত কিছু নোট রাখ। তবে সাবধানে থাকা ভালো, কোনো রকম রিস্ক না নেয়াই ভালো এখন। তোর মরা চলবে না। কাউকে না কাউকে তো বাঁচতেই হবে।” একটু ভেবে টুলটুল আবার বললে, ‘আমি মরে গেলে সময়মতো খবর পাবি, তখন গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে বেড়াবি, কোথাও কেটে পড়ার চেষ্টা করবি। তুই বাবার বড় ছেলে, ওদের দেখা তোর কর্তব্য। দেখার কেউ নেই। তুই না থাকলে ওদের শেষ জীবন বড় কষ্টের হবে। কতো যত্ন করে কতো দুঃখকষ্টের মধ্যে আমাদের বড়ো করেছে।’
—মনোয়ার ক্ষেপে গিয়ে বললে, ‘তোর মুখে আমি লেকচার শুনতে চাই না, নিজে কি করছিস ভেবে দ্যাখ।’
টুলটল হেসে বললে, ‘অতো ভেবে দ্যাখার সময় নেই, যে জন্যে আসা তা বলি। এই কলমটা যত্ন করে রেখে দে। এর ভেতরে একটা সাঙ্কেতিক চিঠি আছে, বুঝতেই পারছিস গোপনীয়। কাল সকাল দশটার দিকে একটা মাঝবয়েসি দেড়েল শিশিবোতলকাগজওলা আসবে, তার কাছে দিয়ে দিবি…’
বাধা দিয়ে মনোয়ার বললে, ‘নিজের মতো আমাদেরকেও ঐ সব ঝক্কিবামেলার ভেতরে ফেলতে চাস?’
‘এত ঘাবড়াচ্ছি কেন, কিছু হবে না, এটাতো একটা সামান্য কাজ, কোনো রিস্ক নেই।’
মনোয়ার অসহায়ের মতো বললে, ‘তুই জানিস না টুলটুল, কতো তেলমুন খরচ করে এই বাড়িটা আমরা পেয়েছি। এখন মোটামুটি নিরাপদ, তুই আমাদের তাড়াবার ব্যবস্থা করছিস ভেবে দ্যাখ! তোর জন্য আমাদের ওপর কতো জুলুম হয়েছে খবর রাখিস, কতো রকমের যে জবাবদিহি করতে হয়েছে, গুলগল্প মেরে কোনো রকমে বোঝানো হয়েছে। এখন মোটামুটি নিরাপদ…’
টুলটুল কিছু একটা ভাবলো, তারপর ফিসফিস করে বললে, ‘কিন্তু এক সময় মোটেই নিরাপদ ছিল না এই বাড়ি, এ বাড়িতেও মানুষ মেরেছে কুত্তারা। লোকটা ছিল একটা সাদামাঠা ইস্কুল মাস্টার, দেশে কি হচ্ছে কি হতে যাচ্ছে তার কিছুই বুঝতো না। উঠোনে এখন যে হাস্নাহেনা গাছটা ঝামরে উঠেছে ঠিক ঐখানে মাটির ওপর লোকটার লাশ পড়েছিল দিনের পর দিন। পচেখসে একাকার, গন্ধে ত্রিসীমানায় ঘেষা যেত না এ বাড়ির শেষ পর্যন্ত লোকটা বোধহয় মাটিতেই মিশে গিয়েছিল, কেউ সৎকার করেনি ভয়ে…-’
মনোয়ারের গা ছমছম করে ওঠে এ কথায়।
একটু পরে সে বললে,’ তা হতে পারে, কিন্তু এ বাড়ি এখনও অনেক নিরাপদ। বাড়িটা যার দখলে, মানে আমরা যার কাছ থেকে ভাড়া নিয়েছি, সে এ তল্লাটের পাণ্ডা জামাতী ধেড়ে ধেড়ে রাঘব-বোয়ালের সঙ্গে ওঠাবসা আছে লোকটার…
‘তা থাকুক, ওতে আরো সুবিধে। ওই সুবিধেটুকুকে একটু কাজে লাগাতে হবে, এইটুকুই, এমন কোনো বিপদের ভয় নেই এতে। ভেবে দ্যাখ না, অকারণেও তো হাজার হাজার মানুষ মারা পড়ছে…’
‘ডাকাতের মতো কথা শিখলি কোথেকে? টুলটুল তুই যে কি হয়েছিস মা-বাবার জন্যেও কি তোর কোনো দুশ্চিন্তা থাকতে নেই?’
‘অতো চিন্তা করার সময় কোথায়? তোর ঘরে মুখে দেবার মতো টুক-টাক কিছু থাকলে বরং দে…’
‘এ ঘরে কিছুই নেই, আস্তে আস্তে মাকে ডাকি?’
‘তার দরকার নেই। মাঝরাতে আবার অনর্থক হাউমাউ শুরু করে দিতে পারে, তাতে বিপদ হবে। একটা সিগ্রেট দে। সিগ্রেট চাচ্ছি বলে কিছু মনে করিস না যেন আবার…’
চৌকির ওপর পা ঝুলিয়ে বসে চোখ কুচকে সিগ্রেট ধরায় টুলটুল। বললে,’ জানিস দাদা একটা ভারি মজার ব্যাপার ঘটেছে। আসবার সময় পড়বি তো পড় শালা এক রাজাকারের সামনে। একেবারে মুখোমুখি। শালার ব্যাটা শালা আমাকে চেনে এমন ভাব করে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। ভেতরে ভেতরে আমার ধুকপুকুনি শুরু হলেও ব্যাটা বুঝতে পারেনি। এক হাঁকড়ানি মারতেই ব্যাটা চোঁচা দৌড় দিয়ে পালালে। এক ফোঁটা যদি মনের জোর থেকে থাকে শালাদের, ঝাড়ু দিয়ে কুড়িয়ে কুড়িয়ে যত সব মিসকিনগুলোকে এনে গায়ে খাকি চাপিয়ে দিয়েছে, এরা নাকি আবার ঠ্যাকাবে, খেলাধুলা আর কি!’
মনোয়ার বলল, ‘আমার কাছে কিছু টাকা হবে, নিবি?’
‘তোর কোনো অসুবিধে হবে না?’
‘অসুবিধে আরকি, তুই রাখ…’
‘দে তাহলে, কাজেই লাগবে টাকাটা, ফেরার পথে মৌলভী ভাড়া করতে হবে। সন্দেহ হলেই ট্রেন-বাস থেকে মানুষজন নামিয়ে নেয় সৈন্যরা, সঙ্গে মৌলভী থাকলে অতো খেয়াল করে না…’
‘মা তোর জন্যে দিনরাত কাঁদে, দেখা দিয়ে যা না একবার…’
‘অসম্ভব! মাকে তো জানি, বিপদ হয়ে যাবে, তুই মাকে বোঝাস, আমি তো আর এক নই, কতো ছেলেই তো মুক্তিবাহিনীতে আছে…’
‘সব মিলে কত হবে?’
‘সে অনেক…’
‘তুই একটাকেও খতম করতে পেরেছিস এপর্যন্ত?’
‘তোর কি মনে হয়?’
‘তার মানে আড়ালে-আড়ালে নিছক ফুটফাট ছাড়া কিছুই পারিসনি। তোদের মুরোদ আমার জানা আছে। মধ্যে থেকে নিরীহ মানুষগুলোকে নিয়ে তোরা ছিনিমিনি খেলছিলি! এভাবে বিশ বছরেও তোরা কিছু করতে পারবি না।’
টুলটুল মনোয়ারের কথা গ্রাহ্য না করে বললে, ‘তোর সেই প্রোগ্রাম প্রডিউসার বন্ধু খলিলের কী খবর? দেখাটেখা হয়? খলিল সাহেবের সঙ্গে একটু মেলামেশা রাখিস!’
‘হঠাৎ আবার খলিল সাহেব কেন?’
‘রেডিও অফিসের ভেতরের খবর পাওয়া যাবে কিছুটা। আমাদের আরো অন্য চ্যানেলও আছে কয়েকটা, তবে বেশির ভাগ খবরই পরস্পরবিরোধী, আজকাল নাকি রাতে পাচিলের ভেতরে হাউণ্ড ছেড়ে রাখে। কিছু জিজ্ঞেস করার দরকার নেই গায়ে পড়ে, দেখা হলে কথার পিঠে যতটুকু ওঠে, লোকটাও তো হড়বড়ে।’
‘রেডিও অফিসে হামলা চালানোর মতো যেদিন তোদের ক্ষমতা হবে সেদিন অনেক দূর।’
টুলটুল বললে, ‘ঐ রকম মনে হয়। ব্যাপারটা এমন কিছু কঠিন না, একবার ভালোমতোন শুরু হয়ে গেলে দেখিস খেলা কেমন জমে, লেজ গুটিয়ে পাই পাই করে দৌড়েও কুল পাবে না।’
‘তা তো বটেই, যে যার নিজের খোয়াব নিয়ে বেশ আছিস তোরা, আর ওরা দিনের পর দিন একটু একটু করে পাঁচিল আরো উচু করছে, মজবুত করছে নিজেদের…’
বাঁধা দিয়ে টুলটুল বললে, ‘ঐখানেই তো রহস্য। পাঁচিল উচু করতে হচ্ছে কেন? ওরা কিছু একটা আন্দাজ নিশ্চয় করেছে। তা যাক, এখন উঠতে হয়। মাকে সান্ত্বনা দিস, আমার জন্যে শুধু শুধু যেন না কাঁদে, দোয়া করতে বলিস মাকে। তোর গলায় মাফলারটা আমাকে দে, ওটা মা’র হাতের বোনা…’
অন্ধকারেও টুলটুলের ছলছলৈ চোখজোড়া দেখতে পায় মনোয়ার। চিরকালই ও ছিলো অদ্ভুত ধরনের মা ন্যাওটা, সবসময় দাখো পেছনে পেছনে ঘুরঘুর করছে। ওর আগে-পরের দু’টি ভাই মারা যাওয়ায় মাও আঁচলে জড়িয়ে ওকে আগলে রেখেছে সবসময়।
‘এক সময় আমরা কি আনন্দেই না কাটিয়েছি, তুই আমি মঞ্জু সবাই একসঙ্গে…’ খুব দূর থেকে বললে টুলটুল, ‘এখন আমার সেসব রূপকথা মনে হয়, ওসব দিন আর ফিরে আসবে না। কি ছিলো আর কি হলো, কেউ কি ভেবেছিলাম হট করে সবকিছু এভাবে বদলে যাবে। দেরি হয়ে যাচ্ছে, আমি চলি। চৌকির নিচে যে ঝোলাটা রেখে যাচ্ছি ওটা ওখান থেকে সুবিধেমতো সরিয়ে রাখবি, ঐ ফেরিওলাটার হাতেই দিয়ে দিবি ঝোলাটা, দেখবি নিজে থেকেই ওটার কথা তুলবে লোকটা, দুটো পেল্লায় পেল্লায় রাজহাঁসের ডিম আছে কিন্তু ঝুলিতে, সব কথা গোপন রাখবি, এই যে আমি এসেছিলাম, চলি…’
মুখে চলি বললেও তখনকার তখনই ঘরের বাইরে গেল না টুলটুল, হঠাৎ তাকে কেমন যেন চঞ্চল মনে হলো, ঘাড় কাত করে বাইরের দিকে কান পাতলো সে । মনোয়ারের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বললে, ‘কয়েক জোড়া পায়ের শব্দ এগিয়ে আসছে, তেমন স্মার্ট নয়, কেমন একটু ল্যাবেন্ডিস মার্কা না? রাজাকার-ফাজাকারই হবে! দরোজা লাগিয়ে শুয়ে থাক, শব্দ না হয়—’
যেমন নিঃশব্দে ঢুকেছিল তেমনি বিড়ালের মতো পা টিপি টিপে বেরিয়ে যায় টুলটুল। জোড়া জোড়া পায়ের শব্দ শুনতে পায় মনোয়ার, দু একজন নয়, বেশ কয়েকজনের একটা খুচরো দল বাড়িটার দিকেই আসছে। টুলটুলের কথা ভেবে ছাৎ করে ওঠে মনোয়ারের বুক, কোথাও না কোথাও ঘাপটি মারতে হবে তাকে, তা না হলে একেবারে সামনে পড়ে যাবার সমূহ সম্ভাবনা ঘাপটি মারতে পেরেছে কি, বেরুলো তো এইমাত্র কিভাবে পারলো… মনোয়ার ব্যাকুল হয়ে পড়ে ভেতরে ভেতরে।
‘হ হ এ বাইতেই আইছে সিউর’…- কথাটা মনোয়ারের কানে বাজে, বলে কি! প্রথমে তার হাত-পা অসাড় হয়ে আসে। কিন্তু সামাল দিতে হবে যে করেই হোক। সে বোঝে সামাল দিতে না পারলে তছনছ হয়ে যাবে সবকিছু ঝট করে চৌকির তলা থেকে কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটাকে টেনে বের করে। ভাববার মতো খুব বেশি সময় নেই হাতে, মুহুর্তে গ্রনেড দুটোকে একজোড়া জুতোর ভেতর চালান করে দেয় মনোয়ার। রইল কেবল ঝোলাটা। একটা বিপদের কারণ হয়ে যেতে পারে এই ঝোলাট-কি ভেবে পাপোশের নিচে বিছিয়ে দেয়, তারপর সটান শুয়ে পড়ে। থরথরিয়ে কাঁপে মনোয়ারের সারা শরীর, উত্তেজনা আর অনিশ্চয়তায় তার দম বন্ধ হয়ে আসে। এর নাম বুঝিবা দশমথার বিপদ, মনোয়ার কোনো রকমে নিজেকে সামলাতে থাকে।
এক সময় টুকটুক করে দরোজার গায়ে টোকা পড়ে।
‘কোই হয় আন্দরমে, দরবাজা খুলিয়ে…’
কেউ একজন, সম্ভবত গ্রুপ লিডারই হবে, খেঁকিয়ে উঠলো, ‘আবে এই দরবাজার বাচ্চা দরবাজা, হউর বাইতে আইছ, জোর দিয়া ধাক্কাদে…’
এবারে সজোরে লাথি পড়লো, সেই সঙ্গে রাইফেলের কুঁদের দুটো বাড়ি, দরোজার পাল্লা জোড়া ভেঙে পরে আর কি।
খুট করে আলো জেলে দরোজা না খুলেই ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করে মনোয়ার, ‘কারা আপনারা, কি চাই এতো রাতে?”
‘পৈলে দরবাজ খুলিয়ে, বাদমে মালুম হোয়গা কোন হায়…’
মনোয়ার বেশ জেদের সঙ্গেই বলে, ‘না, খুলবো না, কিছু জানার থাকলে দিনের বেলা আসবেন…’ হঠাৎ দুডুম দুডুম করে দুটো ফাঁকা আওয়াজ তোলে ওদের দলের কেউ। গুলির শব্দে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে কয়েকটা প্যাচ উড়ে যায়। তবু ইচ্ছে করেই দরোজা খোলে না মনোয়ার, এক অদ্ভুতভাবে তার মাথায় রেখে চাপে।
সে বলল, ‘আপনারা কারা আগে তা না বললে এতো রাতে দরজা খোলা হবে না…’
‘হামলোগ মেলেটরী হায়…’
মনোয়ার মনে মনে হাসলো। শেষ পর্যন্ত সে দরোজ খুলে দিল। খোলার পরে যে একপাশে সরে যাবে তারও সুযোগ পেল না, তাকে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সকলে একযোগে হুড়মুড় করে ঘরে ঢুকে পড়ে; সেই ফাঁকে উঠোনের ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতরে সে পষ্ট দেখতে পায় হাস্নাহেনার ঝোপের ভেতর থেকে বেরিয়ে চোখের পলকে ছায়ার মতো সরে গেল টুলটুল।
মোট ছ’ জন রাজাকার।
‘অল্প কদ্রদুর আগে বাইরে থিকা কেউ আইছিলো?’ তেরিয়া মেজাজে জানতে চায় তাদের গ্রুপ লিডার।
‘না, কেউ তো আসেনি…’
‘কিন্তুক ইদিকেই আইছে।’
‘তাহলে অন্য কোথাও হবে…’
‘হাঁচা, কন তো?’
‘মিথ্যে বলার কি আছে এতে!’
‘বহুত কিছুই আছে, কয়জন হাঁচা কয়, হাঁচা কইলে গাদ্দারি করবো কারায়, কামরা সাচ করুম…’
‘সার্চ ওয়ারেন্ট আছে?’
‘ওসব লাগে না, পুলিশগো লাগে।’
সকলে মিলে উঁকিঝুঁকি মারতে থাকে এদিকে সেদিকে। ছোট কামরা, তেমন কিছু নেই হাতড়ানোর বা ঘাঁটাঘাঁটি করার মতো। গুলির শব্দ, ভারি ভারি জুতোর মচমচনি, কথা কাটাকাটি, একনাগাড়ে এতো কিছু চলতে থাকায় রাত মাথায় করে গোটা বাড়িটাই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল। আলো জেলে দরোজার ছিটকিনি খুলে মা-বাবাও ঘুম ঘুম চোখে এ ঘরে এসে দাঁড়িয়েছে ততোক্ষণে, মনোয়ারের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে দু’জনেই।
‘সবতে মিলা আপনেরা কয়জন থাহেন এইহানে?’
‘আমরা এই তিনজনেই মাত্র’, উত্তর দেয় বাবা, ‘ও আমার ছেলে’।
বাবাকে দেখে সকলে কেমন যেন একটু দমে যায়, বাবা-মা’র নিদ্রাতুর চোখ বোধহয় কাজে লাগছে, মনোয়ার ভাবলো।
‘তাহলে কেউ আহে নাই কইতাছেন …’
মনোয়ার লক্ষ করলো জিজ্ঞাসু চোখে আব্বা সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে। ওরা বুঝলো এর ভেতরে কোনো চালাকির জারিজুরি নেই, ফলে কিছুটা নরোম হয়ে এলো।
মনোয়ার ঝাঁঝালো গলায় বললে, ‘আগেই তো বললাম, এখানে কেউ আসেনি, কেউ এসে থাকলে তাকে বের করে নিয়ে যান— ‘
‘ছি বাবা, ওভাবে কথা বলতে নেই– সামাল দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে মা ।’
বাবা বললে, ‘এই এক দোষ তোর, খামোকা মাথা গরম করিস, ওনারা কি খুব আরামে আছেন, ওরা তো ওদের ডিউটি করবেনই!’
এরপর পাশের ঘর দেখার জন্যে সাগ্রহে আহ্বান জানায় বাবা!
‘ঠিক আছে, আর দেহন লাগবো না—’অকালে ঝাড়চ্যুত বাঁশের মতো গ্রুপ লিডার বললে, “আপনের কথায় ফেইথ আছে আমাগো…’
বাবা ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ‘না না, তা হয় না, আসুন আসুন, এতে মনে করার কিছু নেই। আমি নিজে সরকারী চাকরি করি, দায়িত্ব যে কতবড় জিনিস তা হাড়ে হাড়ে বুঝি, আমাদের সকলের উচিত সাধ্যমতো আপনাদের সব কাজে সাহায্য করা, এটাও একটা কর্তব্য।’
তেমন গায়ে মাখে না তারা, এখন আর কোনো গরজ নেই, অথচ উটটো ঝক্কি পাকাতে এদের কোনো জুড়ি নেই, মনোয়ার মনে মনে গাল দেয়, বুদ্ধির টেকি এক একটা, এনার নাকি আবার দেশরক্ষা করবেন।
হটপাট করে চলে যায় রাজাকারের দলটা।
বাবা বেজায় খুশি। বললে, ‘লোকগুলো ভালো ছিল।’
মনোয়ার বললে, ‘ভালো না ছাই, এক একটা রাস্কেল সব।’
‘রাকাজার হলেই রাস্কেল হয় না, ভালোমন্দ সকলের ভেতরেই আছে। যথেষ্ট ভদ্র ছিল ওরা।’
বাবা এক গ্লাস পানি খেলো। বললে, ‘যা হবার হয়ে গেছে, এখন শুয়ে পড়। বেশিক্ষণ আলো জ্বেলে গুলতানি মারতে দেখলে আবার সন্দেহ করে বসতে পারে।’
মা বললে, ‘কিন্তু হঠাৎ মাঝরাতে এরকম বাড়িঘরে চড়াও হবার মানেটা কি, এতদিন তো এসব কিছু হয়নি?’
বাবা বললে, ‘এতদিন হয়নি বলে যে কোনোদিন হবে না তেমন তো আর কোনো ধরাবাঁধা নিয়ম নেই, কেউ হয়তো কান ভারি করেছে। কতো কিছুই হতে পারে’।
‘তোমরা যা-ই বলো না কেন’– মা বললে, “আমার কি মনে হয় জানো, নিশ্চয়ই সেই শয়তানটা এসেছিল।’
বাবা তাচ্ছিল্যভরে বললে, ‘মেয়েমানুষের কথা যা হয়।’
মনোয়ার জানে অন্য কোনো সময় হলে স্রেফ এই কথাটুকুর ওপর কি রকম ঝড় বয়ে যেত, মা ঝেড়ে একচোট লেকচার দিয়ে ফেলতো, নিছক এই মেয়েমানুষটির বুদ্ধির দাপটে কতবার বাবা ভারাডুবি থেকে নিজেকে সামলাতে পেরেছে, কেমন করে একটা জীবন এই জঞ্জালে সংসারের আবর্তে পড়ে উঞ্ছভাজা হয়েছে, কতো ঝড়ঝাপ্টা গিয়েছে তার মাথার ওপর দিয়ে, অনর্গল বকে যেত মা। কিন্তু এই মুহুর্তে স্বপ্নের ভেতর থেকে মা’র কোনো ইচ্ছে নেই বেরুবার। মা বললে, ‘ক’দিন থেকেই ওর জন্যে আমার ভেতরটা ছটফট করছে। আগে কখনো এরকম হয়নি। কেবল মনে হচ্ছে আমার সাথে দেখা করার জন্যে শয়তানটা গা ঢাকা দিয়ে আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়াচ্ছে; সুযোগ পাচ্ছে না…’
নিজেই খুট করে আলো নিভিয়ে দেয় বাবা। এইসব আলাপে তার কোনো উৎসাহ নেই, এসব তার কাছে সখ করে গায়ে বিপদ ডেকে আনার মতো। বোঝা গেল বিরক্ত হয়েছে।
শুয়ে পড়ে মনোয়ারও। পাশের ঘর থেকে মা’র গলা শোনা যায়, ‘এই জন্যেই যেন পেটে ধরেছিলাম, নেমকহারাম এক একটা, এমন ছেলেপিলে যেন আর কারো পেটে না হয়-“
‘কী শুরু করলে মাঝরাতে, তোমার কোনো সময়-অসময় নেই—‘বাবার গলা, ঘুমাও ঘুমাও!’
তোমার আর কি, কারও জন্যে তোমার কিছু যায় আসে না, নিজে তো আর পেটে ধরেনি। আর একটু পরেই দিব্যি ভোঁস ভোঁস করে নাক ডাকতে শুরু করে দেবে। তুমি একটা পাথর…’
মনোয়ারের ভালো লাগলো না, আর্মি ক্র্যাক ডাউনের পর থেকেই সেই একই নিয়মে এই সব চলছে, অথচ এই সব অভিযোগের কোন ফায়দা নেই, এখন বড় একঘেয়ে মনে হয়।
টুলটুলের কথা ভাবতে থাকে মনোয়ার। তার ঘুম আসে না। চোখ বন্ধ করে মরার মতো পড়ে থাকে। আমাদের জীবন খুব সুখের নয়…টুলটুল বলছিলো; কথাগুলো শোনাচ্ছিল কান্নার মতো। টুলটুল জোর করে সহজ হতে চাচ্ছিল, পারছিলো না। না পারারই তো কথা। এই সেদিনের সেই এক ফোঁটা ছেলে, জীবনকে বাজি রেখে জুয়া খেলায় যতই মেতে উঠুক, নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কতটুকু সাহস সে দেখাতে পারে। মনোয়ার বুঝতে পারছিল, অন্তত মনোয়ারের তাই মনে হয়েছিল, টুলটুল হাঁপিয়ে পড়েছে এরই মধ্যে। সে যে হতোদ্যম নয়, কোন রকমেই তার কোন আশাভঙ্গ হয়নি, সর্বক্ষণ সে চেষ্টা করছিল হাবেভাবে তা প্রমাণ করতে। মনোয়ার এইসব ফাঁকি বোঝে। তার বুকের ভেতর খাঁ-খাঁ করে, বনেবাদাড়ে, বাসক আর মাদারের গন্ধের ভেতর, স্মৃতির ভেতর, আমের শুকনো মুকুলের মতো ঝুরঝুর করে ঝরে পড়ছে টুলটুল। টুলটুল যেন বিশাল নদীতে ছেড়ে দেওয়া শানবাঁধানো তিরতিরে পুকুরের একরত্তি হালকা পাতলা একটা মৌরলা মাছ।
অনেক চেষ্টা করে মনোয়ার, কিছুতেই ঘুম আসে না; এ এক যন্ত্রণা!
আমাকেও ফাঁসিয়ে গেল টুলটুল, মনে মনে হিজিবিজি কাটে মনোয়ার, দুদুটো গ্রেনেড, ভালোয় ভালোয় আপদ বিদায় হলেই হয়, একটা ধাক্কা তো সবেমাত্র গেল। তবু যাহোক সামলানো গেছে, আশ্চর্য তো! আমি একটুও ভয় পাইনি, একটুও গলা কাঁপেনি, এতো সাহস এলো কোথেকে; ভয় পাবার কথা, উল্লুকগুলোকে বোকা বানানো কি সহজ!
মেঘের রাজ্যে ভেসে বেড়াতে থাকে মনোয়ার : আচ্ছা সকালে সেই দাড়িওয়ালা শিশি বোতলের লোকটা এলে কি বলা যায় তাকে, আমাকে বিশ্বাস করতে পারো, আমি তোমাদেরই লোক, আমাকে বিশ্বাস করতে পারো, এই ধরনের কথা ফস করে যদি মুখ থেকে একবার বেরিয়ে যায়।
অস্পষ্ট একটা শোরগোল শোনা যায় মাঝে মাঝে । কিসের একটা হল্লা, কান পাতে মনোয়ার, স্পষ্ট শোনা যায় না কিছু না, বোঝার কোন উপায় নেই. হয়তো অপদার্থ রাজাকারের বাচ্চারা অকারণে কোথাও হামলা চালিয়ে দাঁত তুলছে, মনোয়ার আবার চেষ্টা করে শোনার।
অনেক দূরে, এক মাইল কি দু মাইল, কি আরো অনেক দূরে হড়াম করে একটা বোমা ফাটলো, থরথরিয়ে উঠলো, গোটা রাত্রিটাই। মেশিনগান চলছে, দু মুটো চিড়খাওয়া রাতে তুমুল অন্ধকার কাচের মতো ঝনঝন করে পড়ছে পোড়ামাটিতে। মনোয়ারের ভাবতে খুব ভালো লাগলো, রেডিও অফিসের একটা ছাত অসম্ভব ক্ষিপ্রতায় আকাশে লাফিয়ে উঠেছে—
উঠোনের ঐ হাস্নাহেনার ঝোপটা না থাকলে কি হতো আজ। ছ’জন রাজাকারের মুখোমুখি পড়ে যেতো টুলটুল আর একটু হলেই, খুব বাঁচা বেচে গেছে। ধীরে ধীরে মনোয়ারের আপন মনে হিজিবিজি কাটার ব্যাপারটা একবারে লাগামছাড়া হয়ে যায়। আচ্ছা এমনও তো হতে পারে বেয়নেটের খোঁচায় মরা সেই স্কুল মাস্টারের দেহাবশেষ থেকে ওই হামাহেন গাছটার জন্ম। কতো কিছুই তো হয় পৃথিবীতে, কটা রহস্য আর মানুষ জানে, শেষ পর্যন্ত তার গা ছমছম করে ওঠে…গাছটাই আজ প্রাণরক্ষা করেছে টুলটুলের, রাশি রাশি পাতার ঝাঁপি দিয়ে কি গভীর মমতায়-ই না ঢেকে রেখেছিল, প্রতিটি পাতায় শিরশির করছিল ব্যাকুলতা, নিঃশব্দে চারপাশে জড়ো করছিল নিবিড় আঁধার, টুলটল যেন মার কোঁচড়ে গিয়ে মুখ লুকিয়েছিল।
রহস্যময় নির্বোধ এক ভালোবাসায় বুক ভরে ওঠে মনোয়ারের, জলরাশির তুমুল কলধ্বনি, সেখানে উলুধ্বনি, সকাল হলেই বাঁশের চটি দিয়ে ঘিরে দিতে হবে গাছটা, পাতাগুলো ধুয়ে দিতে হবে। ভেতরে ভেতরে সে চলকে ওঠে, নিস্তব্ধ উঠোনের ঐ হাস্নাহেনা গাছটা যদি নিছক গাছ না হয়, যদি সেই মাস্টার হয়ে থাকে, তাহলে ঝিঁঝিঁ পোকাই বা মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিমান হবে না কেন? আলো-বাতাস-নদ-নদীপাহাড়-পর্বত-গাছপালা-পোকামাকড় সবকিছুই যদি টুলটল হয়ে এভাবে কাজ করে দেয়…
মেঘের রাজ্যে ক্রমাগত ভেসে বেড়াতে থাকে মনোয়ার, পেজ তুলোর মতো ভেসে বেড়ায়, আঁধার ফিকে হয়ে আসে, হু হু করে ছোটে তুমুল বাতাস, মেঘের রাজ্য থেকে, তন্দ্রালোক থেকে নরোম নির্ভার স্বপ্নপুঞ্জের সুনীল, এইভাবে দেখতে না দেখতে কখন কোন এক ফাঁকে সে হয়ে যায় ছোট এক ফিঙেরাজা : একটা চঞ্চল ফিঙেপাখি ঢেউয়ের পর ঢেউ কেটে উড়ছে আর টেলিগ্রাফের তারের ওপর বসছে, দুরন্ত ট্রেন ঝড়ো হাওয়ায় তার পলকহীন বিস্ময়ের ওপর কি তীব্র ছুটে যায় ঝমঝম। চরাচর এখন শান্ত চুপ। নদীর টলটলে আয়নায় ফিঙেরাজা তার নিজের চেহারা দ্যাখে, আমি আছি? জানতে চায় সে, ওহে আমি কি আছি? আছো, তুমি তো আছো, গলা শোনা যায় নদীর… এখন যাও, বড় কোলাহল করো তুমি, চুপ! ফিঙেরাজা উড়ে বেড়ায়, তার চঞ্চল ডানার নিচে মলিন অথচ নিবিড় এক একটি গ্রাম, যা বিপন্ন, বিষ্ণ, শৃঙ্খলিত। গুমরে উঠে বনাঞ্চল। কোথাও থমকে আছে বাতাস, পোড়ামাটির কটু আর ঘোলাটে গন্ধের হঠাৎ আবর্তে মৌরলার ঝাঁকের মতো ছিটকে উঠছে নিশিত পতঙ্গ। কিংবদন্তির সরু খাল, যা কখনো ধনুকের মতো, কখনো তরোয়ালের মতো, আর দীর্ঘ বনস্পতি…যা মহারাণী ভিক্টোরিয়ার সাম্রাজ্যকেও ছায়া দিয়েছে, সকলের মুখে ঐ একই কথা বিভীষিকা, একি বিভীষিকা ও কি? ধোঁয়া! ধোঁয়া কি উগ্রতেজা! যাও হে জটাজাল, হাঙ্গা করোগে বিভীষিকারে, সাতহাত নোলায় ঠানা মারোগে! ফিঙেরাজা এবার মঠবাড়ির চূড়া খোঁজে, কোথায় মঠবাড়ি, লোহার ত্রিশূল মাটিতে গড়াগড়ি খায়, ধুলোয় বুট জুতোর হার্মাদ গন্ধ, পচা গন্ধ, উরেশালা!
ওড়ার আর শেষ নেই ফিঙেরাজার: প্রথমে ধানের গোলা, তারপর মাড়াই কল, তারপর গরুর গোয়াল, বাঁশের সাঁকো। গোলায় গোলায় বুলেট ধান, মাড়াই কলে আমনমানুষ, আউশমানুষ, গোয়ালে গোয়ালে জাবরকাটা বেঢপ রাজাকার… ‘তোর বইনেরে দিবি, মঞ্জুরে দিবি, রাজাকার নিকা করবার চায়…’
ফিঙেরাজা বাঁশের সাঁকোয় দ্যাখে ঝুলন্ত মানুষ, বাঁশের সাঁকো এখন ফাঁসিকাঠ, হাই-হুম-হাম দিকচিহ্নহীন প্রান্তর অট্টহাসি করে ওঠে, কে যায় চৌকিদার? কে যায় চৌকিদার? ফাঁকা মাঠের মানুষখেকো শূন্যতা হাই তোলে এক একবার, হাই-হুম-হাম!
ফিঙেরাজা দ্যাখে চৌকিদার, কি খোঁজে চৌকিদার? হাস্নাহেনার ঝোঁপ দেখে কান এটো করে হাসে, ব্যতিব্যস্ত, দুহাতে ঝোপঝাড় সরায়, শোবার ঠাঁই করে নেয়। কে কাঁদে, চৌকিদার চিৎকার করে ওঠে, ‘কে কাঁদে ঐ শবেরগঞ্জে যুবতী নেই কেন, অ্যা?’
যুবতী নেই তো কি তোর বাপের মাথা আছে– ফিঙেরাজার কানে বাজে রসিকতা, পুঞ্জীভূত জোনাকিপোকারা মরে যায়, মানুষ নেই কেন, মানুষ । এই শব্দ গুমগুম করে বাজে, চতুর্দিকে। মানুষ নেই মানুষ নেই— চতুর্দিকে এই শব্দ, মানুষ নেই মানুষ নেই, চতুর্দিকে।
নৌকোগুলো যেমন নদীর একেবারে তলায়, চোখগুলো যেমন নৌকোর মতোই ভিজে ছলছলে, মানুষজন যেমন ওপড়ানো চোখের মতো ছড়ানোছিটানো, তেমনি সবকিছু এলোমেলো, ছত্ৰাখান, ছারখার। ফিঙেরাজা প্রান্তরের অট্টহাসি শুনতে পায়, সুমসাম আঁধারে বনবাদাড় জুড়ে খিলখোলা হাসি ভেঙে চুরমার হয়।
এক সময় ফিঙেরাজা অদৃশ্য হয়, অস্পষ্ট কোলাহল ভেসে আসছে, কোলাহল আর ভালো লাগে না মনোয়ারের।
ভোরের বাতাস হু হু বয়ে যায়, আবার ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে যায় মনোয়ার। ঘুমের ভেতর উড়ন্ত কার্পেটের মতো ধূসর ধূপখোলা মাঠ ভেসে আসে, বলখেলা করে শৈশব, শৈশবের গলায় গ্রেনেডের মাদুলি।
ভোররাতের কাছাকাছি ঘুম আসায় সকালে উঠতে পারে না মনোয়ার। দরোজা-জানালা বন্ধ রেখে ঘর অন্ধকার করে মরার মতো পড়ে থাকে। এক একবার ঘুমের ভেতরে একেবারে তলানো, এক একবার পেঁজা পেঁজা চৈতন্যের ওপর ভেসে ওঠা, এই করতে করতে বিছানা বালিশের ভরাট আলসেমিতে দলা পাকিয়ে থাকে সে।
আরো অনেক পরে সে বাবার গলা শুনতে পায়। জোরে জোরে কথা বলছে বাবা, বাজার সেরে ফিরে আসছে এইমাত্র। কি আশ্চর্য কথা, মানুষ আর মানুষ নেই। বাবা মাকে বলতে থাকে, ‘এই ডামাডোলের ভেতরও চোখের উপদ্রব, জানের খারাবিরও ভয় নেই, বলিহারি সাহস।’
মনোয়ার উঠে পড়ে।
‘কোথায় চললে?’ বাবা জিজ্ঞেস করে।
‘কই, কোথাও যাচ্ছি না তো।’
‘আমি ভাবলাম তুমিও বুঝি ঐদিকে ছুটবে পাড়াসুদ্ধ লোকের মতো। যতসব হুজুগে পাগল। খেয়েদেয়ে তো আর কারও কোনো কাজ নেই। এক চোর ছোঁড়া মরে পড়ে আছে, তাই দেখতে পাড়াসুদ্ধ লোকে একেবারে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে।’
মনোয়ার জিজ্ঞেস করলে, ‘মরে পড়ে আছে মানে, কারা মারলো?’
‘পাড়ার লোকজন নিজেরাই ধরে পিটিয়ে মেরে ফেলছে। গলির মুখে রেশনশপের পাশের ড্রেনে পড়ে আছে এখনো। রাতে পাঁচিল ডিঙোবার সময় ধরা পড়েছিল, বলাবলি করছে অনেকে। চুরি করার মতলব না থাকলে পাঁচিল ডিঙোতে যাবেই বা কেন! কেউ কেউ বলছে আবার পিটিয়ে নয়, গলায় ফাঁস দিয়ে মারা হয়েছে হতভাগাটাকে, এখনো নাকি গলায় একটা মাফলারের ফাঁস আটা, মানুষ আর মানুষ নেই!’
মনোয়ার বললে, ‘তুমি ডেডবডিটা দেখোনি?’
‘কী লাভ দেখে?’
মনোয়ারকে জামার ভেতরে মাথা গলাতে দেখে বাবা ক্ষেপে গিয়ে বললে, ‘তার মানে, তুমি যেতে চাও নাকি? কী পেয়েছ কী তোমরা? যার যা ইচ্ছে তাই করবে! কোনো দরকার নেই তোমার যাবার, ফালতু ঝামেলা বেঁধে যেতে কতক্ষণ…আমি সরকারি চাকরি করি এ কথাটা তোমাদের মাথায় একবারও আসে না কেন?’
মনোয়ারের কানে এসব কিছুই ঢোকে না; সে জানে, মাঝরাত থেকে সেও টুলটুলের মতো জড়িয়ে পড়েছে, এখন তার অনেক কাজ।