‘পারস্য পরবাসে’—হুমায়ূন কবিরের ভিন্ন আঙ্গিকের অনবদ্য একটি উপন্যাস। ইরানের ইসলামি বিপ্লব ও বিপ্লবোত্তর ইরান-ইরাক যুদ্ধকালের ধ্বংস ও মৃত্যুর বিভীষিকার পটভূমিতে এটির কাহিনী উপস্থাপন করেছেন লেখক।
ইরানি তরুণী ডাক্তার আনুশেহ সিরাজি’র সঙ্গে লেখকের পরিচয় হয় অভাবিতভাবে। প্রথম পরিচয়ের পর থেকে ঘটনাক্রমে আনুশেহ সিরাজি’র সঙ্গে তার অন্তরঙ্গতা গড়ে ওঠে। হুমায়ূন কবিরের পারস্যের প্রবাস জীবনে ডাক্তার আনুশেহ সিরাজি’র মতো তরুণীর সাহচর্য বিপদেআপদে, সুখেদুঃখে কতটা অপরিহার্য ছিল, তা তিনি তুলে ধরেছেন এই উপন্যাসে। চাহার-মহল-বখতিয়ারি হাসপাতালে আনুশেহ সিরাজি ও হুমায়ূন কবিরের পোস্টিং হয়। বাসে চাহার-মহল-বখতিয়ারিতে যাওয়ার পথে খোর্দ শহরের যাওয়ার কাইন্টারে আনুশেহ্ সিরাজি’র সঙ্গে হঠাৎ করেই হুমায়ূন কবিরের সাক্ষাৎ।
এই উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্র আনুশেহ ও মাসউদ। আনুশেহ ভালোবাসে মাসউদকে। তার পুরো নাম আগা মাসউদ কাজেমি। আনুশেহর ভাই ফারহাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, একসঙ্গে পড়ত ওরা, একসঙ্গে যুদ্ধে গিয়েছিল। ফারহাদ যুদ্ধে শহীদ হয়। আর মাসউদ সেবারে যুদ্ধে বেঁচে ফিরলেও শেষবার যুদ্ধে গিয়ে মাসউদ বেঁচে ফিরতে পারে না।
লেখকও আনুশেহকে ভালোবাসে তা পাঠক উপলব্ধি করতে পারে উপন্যাসের শেষ অধ্যায়ে মাসউদের লাশ আসার আগ মুহূর্তে লেখককে বলা আনুশেহর এই ক্ষেদোক্তি থেকে—‘আগায়ে দকতর, কী করে করলে এটা তুমি? মাত্র কয়দিনের জন্য বাইরে গেলাম আর ওই সময়ই মাসউদকে ঠেলে দিলে যুদ্ধে? আমাকে সত্যিই যদি ভালবাসতে, এ কাজটি করতে পারতে না তুমি। আগায়ে দকতর’।
আনুশেহ হুমায়ূন কবিরের সঙ্গে দেখা করতে আসে। সঙ্গে সুদর্শন এক তরুণ। আনুশেহ সেই যুবকটির পরিচয় করিয়ে দেয় তার সঙ্গে। লেখক এখানে বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে—‘তার নাম আগা মাসউদ কাজেমি। কাশানি হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ডিরেক্টর। আমার ভাই ফারহাদের সবচেয়ে কাছের বন্ধু, একসঙ্গে পড়তো তারা, এক সাথে যুদ্ধে গিয়েছিল।’
নওরোজ উপলক্ষে আনুশেহ তাকে অ্যাডওয়ার্ড ফিটজেরাল্ডের ইংরেজি অনুবাদে ওমর খৈয়ামের রুবাইয়াত উপহার দেয়। লেখক বুঝতে পারে আনুশেহ ভালোবাসে মাসউদকে, তাকে নয়।
হুমায়ূন কবিরের ব্যতিক্রমী উপন্যাস ‘পারস্য পরবাসে’টিকে মনে হয় স্মৃতিকথা। স্মৃতিকথার আঙ্গিকে লেখা এই উপন্যাসে বারবার উঠে এসেছে ডাক্তার আনুশেহ, আনুশেহের বন্ধু মাসউদের প্রসঙ্গে। এছাড়া পারস্যের প্রাকৃতিক দৃশ্য উঠে এসেছে লেখকের বর্ণনায়। পাহাড়ের পর পাহাড়। সাদা বরফে ঢাকা। কারুন নদী, ফল্গুধারার প্রস্রবণ। মাসউদ একসময় গান ধরে। আনুশেহ লেখকের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে এটা মৌলানার বিখ্যাত ফার্সি কবিতা।
লেখকের বুঝতে কষ্ট হয় না আনুশেহ সুদর্শন যুবক মাসউদকে ভালোবাসে। শেষ অধ্যায়ে লেখক বিয়োগান্তক ঘটনাগুলোকে বেদনাদীর্ণ আবহে উপস্থাপন করেছেন। লেখক আনুশেহকে না জানিয়েই ডাক্তারির চাকরিতে ইস্তফাপত্র দাখিল, মাসউদকে যুদ্ধের ফ্রন্টে যাওয়া ঠেকানোর ব্যর্থতা, যুদ্ধে মাসউদের শহীদ হওয়া—এ সবই বেদনার। আনুশেহর প্রতি তার অব্যক্ত ভালোবাসা তাকে কুরে কুরে খায়।
সেদিন রাতে ঝির ঝির করে তুষার লেখক বিছানায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে বাড়ির দুঃস্বপ্ন দেখছেন এমন সময় দ্রুত হাসপাতালে উপস্থিত হওয়ার আনুশেহর ফোন। টেলিফোনে আনুশেহ অস্ফুট স্বরে বলে—‘আগায়ে দকতর, কী করে করলে এটা তুমি? মাত্র কয়দিনের জন্য বাইরে গেলাম আর ওই সময়ই মাসউদকে ঠেলে দিলে যুদ্ধে? আমাকে সত্যিই যদি ভালোবাসতে, এ কাজটি করতে পারতে না তুমি। আগায়ে দকতর।’ লেখক সেখানে পৌঁছে দেখতে পেলেন, এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য। আনুশেহর ফোন থেকে তার বুঝতে বাকি রইলো না ওটা মাসউদের লাশ।
গার্ডরা পতাকায় ঢাকা বাক্সটা নামাতেই বাক্সের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লো মেয়েরা। মেয়েদের ভেতর একটি মেয়ে আর্তচিৎকার করে উঠলো। স্পষ্ট বোঝা গেলো আনুশেহর গলা—‘মাসউদ! মাসউদ! আগায়ে কাজেমি, কথা রাখোনি তুমি। কিভাবে ফাঁকি গেলে?’
‘পারস্য পরবাস’ উপন্যাসে লেখক হুমায়ূন কবির দেখিয়েছেন ইরানের যুদ্ধক্লান্ত নারীর চোখের জল ফেলা বেমানান। যুদ্ধে মৃত্যু আর নারীর ক্রন্দন অনিবার্যভাবে বাস্তব। তিনি এই উপন্যাসে দেখিয়েছেন যুদ্ধ, মৃত্যু-কান্নার মাঝেও প্রেম অমলিন। ইতিহাস নির্ভর এই উপন্যাসটি পাঠকের হৃদয়কে বেদনাদীর্ণ করবে। উপন্যাসটি পাঠকপ্রিয়তা লাভ করবে বলে আশা করি।
পারস্য পরবাসে
লেখক: হুমায়ূন কবির
প্রকাশক: ফরিদ আহম্মদ
সময় প্রকাশন ৩৮/২ক বাংলা বাজার,
ঢাকা
প্রচ্ছদ: ধ্রুব এষ
প্রকাশকাল একুশে বইমেলা ২০১৮
মূল্য: ৩৪০ টাকা মাত্র।