নাজিব ওয়াদুদ—একাধারে গল্পকথক, ছড়াকার, অনুবাদক ও প্রাবন্ধিক। প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর বিশেষত্ব, তিনি বিষয়কে আত্মস্থ করে নিজের মতো করে পরিবেশন করেন। অনুবাদে তাঁর মূল বৈশিষ্ট্য, তিনি মূল রচনার মেজাজ-রুচি অক্ষুণ্ন রেখেও এমনভাবে বাঙলায়ন করেন, পড়তে পড়তে পাঠকের একটুও সন্দেহ হয় না—কোনো ভিনভাষী রচনার অনুবাদ পড়ছেন। মনে হয়, মৌলিক রচনায়ই পড়ছেন। আর ছোটগল্প? স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা ছোটগল্পের ধারাবাহিক ইতিহাসে তাঁর গল্পভাষা, গল্পস্বর ও বার্তা সম্পূর্ণ নিজস্ব। তিনি জীবনকে দেখেন গভীরভাবে। কেবল দেখেই তিনি থেমে থাকেন না, গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তুলে আনেন জীবনের বিচিত্র সব ঘটনার পরম্পরা। এর সঙ্গে যুক্ত করেন তাঁর কল্পনা-স্বপ্ন-রুচিবোধ। তবে বক্তব্য প্রকাশে তিনি সংযমী। আবেগ তাঁর সুনিয়ন্ত্রিত। তার শ্রেষ্ঠগল্পগুলোর মধ্যে অন্যতম, ‘আবাদ’, ‘আরও দুটি খুন’, ‘বৃত্ত’, ‘কারভিউ’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশেষ করে ‘আবাদ’ গল্পটি বাংলাভাষার শ্রেষ্ঠ গল্পগুলোর একটি বললেও অত্যুক্তি হয় না। এছাড়া সাহিত্য সম্পাদক হিসেবেও তিনি তাঁর নিষ্ঠার স্বাক্ষর রেখেছেন। দীর্ঘদিন ধরে সম্পাদনা করে আসছেন শিল্পসাহিত্যের ছোটকাগজ ‘নন্দন’। সমকালীন বাংলা ছোটগল্পের এই অসামান্য কথাকারের মুখোমুখি হয়েছেন তরুণ কথাকার মাসউদ আহমাদ।
প্রশ্ন: গল্প লিখতে শুরু করলেন কেন?
নাজিব : সে কথা বলতে গেলে লেখালেখির শুরুর কথাই আগে বলতে হয়। ১৯৭১ সালে, মুক্তিযুদ্ধের সময়, আমরা সপরিবারে ভারতে পালিয়ে গিয়েছিলাম, চরম দুঃসহ ছিল সে শরণার্থী জীবন। তখন আমার বয়স দশের ঘরে, সেটা আমার শিশুমনে খুব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। সে সময় একটা মুক্তিযুদ্ধের গান লিখেছিলাম, মুখে মুখে সুরও দিয়েছিলাম। গানটার শুরু এ রকম— ‘ওরে ও বাঙালি রে, কেন বসে আছিস ঘরে, হাতে হাতে অস্ত্র নে রে …।’ সেটা একটা আবেগের বহিঃপ্রকাশ ছিল, তখন তো সাহিত্য কিংবা ছন্দ-মাত্রা বুঝতাম না। সে আবেগ স্বাধীনতা-পরবর্তী কালেও থেকে গিয়েছিল বেশ কিছু কাল। তখন কিছু বলতে হবে, চারপাশে যে অন্যায়-বৈষম্য তার মুখোশ উন্মোচন করতে হবে, তার বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করতে হবে, এ রকম সামাজিক-রাজনৈতিক আবেগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গ্রামের একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষে ভাষা দিবস ও শহীদদের নিয়ে একটা পদ্য লিখেছিলাম। তারপর থেকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা উপলক্ষে প্রবন্ধ ও পদ্য লিখেছি। প্রশংসিত হয়েছি, পুরস্কারও জিতেছি। সুতরাং উৎসাহ বেড়েছে। ১৯৭৪ সালে ‘বানের ক্ষতি’ নামে ষাট লাইনের এক বিশাল পদ্য লিখে ফেললাম। পাঠিয়ে দিলাম ইত্তেফাকের ‘কচিকাঁচার আসর’ পাতায়। এর গুরুত্ব এদিক থেকে যে, সম্ভবত পত্রিকায় সেটাই আমার প্রথম লেখা পাঠানো। তার কয়েকটা লাইন দাদাভাই ছেপেছিলেন। ১৯৭৪-৭৬ সালের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি মঞ্চ নাটক ও একটি উপন্যাস লিখেছিলাম। নাটকটি মঞ্চে আংশিক অভিনীত হয়েছিল। গ্রামবাসীর লাঠিবাজির কারণে তার পুরো মঞ্চায়ন সম্ভব হয়নি। ১৯৭৬ সালে রাজশাহী থেকে দৈনিক বার্তা প্রকাশিত হলো। শিশু-কিশোরদের জন্যে ‘কিশোরকুঁড়ির মেলা’ নামে সাপ্তাহিক পাতা বের হতে লাগল, একই নামে একটি সংগঠনও কাজ শুরু করল। এর সঙ্গে জড়িয়ে পড়লাম। ছড়া লেখা শিখলাম। ছড়া আগেও লিখেছি। না জেনে-বুঝে। অন্ত্যমিল থাকলেই তাকে ছড়া, পদ্য বা কবিতা মনে করতাম তখন। ১৯৭৬ সালের পরেই এর ব্যাকরণ বুঝলাম। ১৯৮০ সাল পর্যন্ত মূলত ছড়াই লিখেছি। আর দু-চারটা কিশোর গল্প।
তবে সাহিত্যচর্চা বলতে প্রকৃত অর্থে যা বোঝায় তার শুরু আশি দশকের প্রথম দিকে, যখন আমরা কয়েকজন তরুণ সাহিত্যকর্মী রবিবাসরীয় সাহিত্য সংসদ গঠন করি, আয়োজন করি নিয়মিত সাপ্তাহিক সাহিত্য সভার। সেই উপলক্ষেই গল্প লেখা শুরু। আমার প্রথম মুদ্রিত গল্প রবিবাসরীয় সাহিত্য সংসদের মুখপত্র ‘পরিলেখ’-এ প্রকাশিত হয় ১৯৮১ সালে। সেটার নাম ছিল ‘বানভাসি’। ওই বছরই রাজশাহী থেকে প্রকাশিত জাতীয় সংবাদপত্র দৈনিক বার্তায় ছাপা হয় ‘খাঁচায় একা’ গল্পটি। একই বছর ঢাকার পত্র-পত্রিকায় কয়েকটা গল্প ছাপা হয়। তারপর, ১৯৮২ থেকে ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত লেখালেখির বিরতি। হয়তো লেখার জগত থেকে সেটা চিরবিদায়ই হতে পারত। কিন্তু সে সময় (১৯৮৭ সালের মার্চে) পশ্চিমবঙ্গে বেড়াতে গিয়ে আত্মীয়তার সূত্রে পরিচয় হয় কথাশিল্পী আবুল বাশারের দু’জন বন্ধুর সঙ্গে—প্রাবন্ধিক আকরাম আলি এবং গল্পকার রকিবউদ্দীন ইউসুফ। এরা আমাকে নিয়ে গেলেন বহরমপুরে, পরিচয় হলো ‘রৌরব’ সম্পাদক শুভ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। এদের অনুপ্রেরণায় সেখানে বসে তড়িঘড়ি করে একটা গল্প লিখলাম। আমাদের দেশে তখন এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চলছিল। বলা বাহুল্য, আমি নিজেও এই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম। তো গল্পটা (শরণার্থী) লিখলাম এই স্বৈরাচারবিরোধী থিম নিয়ে। দেশে ফেরার সময় হয়ে যাওয়ায় খসড়া লেখাটাই দিয়ে এসেছিলাম। সেটা ছাপা হয়েছিল ওই বছরই ‘রৌরব’-এর শারদীয় সংখ্যায়। দেশে ফিরে ঘটনাক্রমে পরিচয় হলো তখনকার উদীয়মান কবি-প্রাবন্ধিক খুরশীদ আলম বাবুর সঙ্গে। সে গল্প লিখত না, কিন্তু জবরদস্ত গল্পপাঠক ছিল। ছায়ার মতো লেগে থেকে সে আমাকে গল্পচর্চার প্রতি নিবেদিতপ্রাণ করে তুলল। সুতরাং বলা চলে গল্পকার হিসেবে আমার উন্মেষকাল এর পর থেকেই, অর্থাৎ ১৯৮৭ সাল থেকে নব্বই দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সময়ের মধ্যে। তো মূল প্রশ্নে আসি, শুরুতে পদ্যই লিখছিলাম, কিন্তু ওতে, যা বলতে চাই, যা দেখাতে চাই, তা আঁটছিল না, নতুন মাধ্যমের প্রয়োজন অনুভূত হচ্ছিল। এ প্রসঙ্গে আরও একটু কথা বলতে হয়। ছেলেবেলা থেকেই আমার গল্প শোনার নেশা ছিল। মা, খালা, নানী থেকে শুরু করে যার কাছেই পেয়েছি নাওয়া-খাওয়া ভুলে গল্প শুনেছি। গল্পের সন্ধানে হাটে গিয়ে হকারের ওষুধ, মাজন, জড়ি-বুটি, তাবিজ-মাদুলি বিক্রির মজমায় বসেছি। শোনা গল্প নিজের মতো করে বন্ধুদের শোনানোও আমার একটা কাজে পরিণত হয়েছিল। লেখাপড়ার সুবাদে ক্লাসের বাংলা ও ইংরেজি বইতে পেয়েছি লিখিত গল্পের সন্ধান। এইভাবে শুরু গল্প শোনা থেকে গল্প বলা ও পড়া, অর্থাৎ সাহিত্যের পথে যাত্রা। মোদ্দা কথা হচ্ছে, শৈশব থেকেই, ‘গল্প’-র আকর্ষণ আমার হাড়-মজ্জার মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল।
তো হাড়-মজ্জায় গল্পের টান, আর, কিছু বলা ও দেখানোর জন্য উপযুক্ত মাধ্যমের প্রয়োজনীয়তা— এই দুটি বিষয় আমাকে গল্প লেখার পথে ঠেলে দেয়। এখন সারসংক্ষেপ করলে বোধ হয় এই রকম দাঁড়াবে যে, এই প্রকরণে আমি সবচেয়ে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি, সবচেয়ে বেশি দক্ষতা প্রদর্শন করতে পেরেছি। আর যা বলতে চাই, যা দেখাতে চাই, তা এই প্রকরণের মাধ্যমেই ভালো পেরেছি। সেটাই হয়তো কারণ যে আমি মূলত ছোটগল্প বা কথাসাহিত্যই চর্চা করে চলেছি।
প্রশ্ন: শুরুর লেখাগুলো কেমন ছিল?
নাজিব : শুরুটা কখন থেকে ধরব সেটা একটা সমস্যা। তবে প্রকৃত সাহিত্যচর্চার শুরুটাকেই ধরা উচিত হবে বলে মনে হয়। হয়তো ইতোমধ্যেই বুঝতে পেরেছেন, প্রথমদিকে আমি খুব রাজনীতিতাড়িত ছিলাম। সে কারণে সে সময় প্রধানত বাস্তববাদী ও সমাজবাদী ধারার বক্তব্যধর্মী ও ঘটনাপ্রধান গল্পই লিখেছি। ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত আমার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘কাক ও কারফিউ’-এর ‘বাঁচামরা’ গল্পটি এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ। এই গ্রন্থের অন্য গল্পগুলোতেও (কাক, কারফিউ, মেঘ ভাঙা রোদ, ভগ্নযাত্রা, বৃত্ত, অন্ধগলি, পিছুটান) এই প্রভাব কম-বেশি লক্ষ্য করা যাবে। পরে কথাশিল্পী কায়েস আহমেদ-এর একটি প্রবন্ধ পড়ার পর ‘সমাজবাদী ইউটোপিয়া’ থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। হয়তো কিছুটা পেরেছি, বা সম্পূর্ণ পারিনি। দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ (২০০৮) ‘নষ্ট কাল অথবা হৃদয়ের অসুখ’-এর কসাই, জীয়নকাঠি, আরও দু’টি খুন, নষ্ট কাল অথবা হৃদয়ের অসুখ, আবাদ, তৃতীয় গ্রন্থ (২০১০) ‘কমরেড ও কিরিচ’-এর দখল, কমরেড ও কিরিচ, নোনা প্রেম, ভালো ও মন্দ, এবং চতুর্থ গল্পগ্রন্থ (২০১১) ‘পদ্মাবতী কিংবা সুন্দরী মেয়েটির নাক বোঁচা’র শহীদ ইদু কানার বউ, নাকফুল, একজন প্রতিবন্ধী ও একটি মহাসড়কের গল্প’ তার প্রমাণ। এসব গল্পে কাহিনীর বিস্তার বা ঘটনার ঘনঘটা, কিংবা গল্পের চরিত্র বা গল্পকারের নিজস্ব কোনও সোজাসাপ্টা বক্তব্য না থাকলেও রাজনীতি, সমাজচেতনা, প্রতিবাদ-প্রতিরোধের বিষয়গুলো আকারে-ইঙ্গিতে বা সূক্ষ্মভাবে হলেও আছে। আর আঙিকচেতনার দিক থেকে শুরু গল্পগুলো প্রধানত বাংলা গল্পসাহিত্যের একেবারে মূলধারার অনুসরণে লেখা, যা প্রবহমান রবীন্দ্রনাথ, তারাশঙ্কর, বিভূতি ও মানিকের ধারাবাহিকতায়।
শুরুর গল্পগুলোর মধ্যে কাক, কারফিউ, বৃত্ত, পিছুটান পাঠক-সমালোচকদের বিশেষ প্রশংসা লাভ করেছিল।
প্রশ্ন: গল্প লেখার জন্য কি প্রস্তুতি নিয়েছেন? নিলে সেগুলো কেমন?
নাজিব : কোনো সংগঠিত বা পদ্ধতিগত বা একাডেমিক প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি, তা এতক্ষণে হয়তো পরিষ্কার হয়ে গেছে। ধরুন, বিংশ শতাব্দীর আশির দশকে আমার গল্প লেখার শুরু। কিভাবে শুরু? হঠাৎ এই সময়েই গল্প লেখা আরম্ভ করে দিলাম? কোনও প্রস্তুতিপর্ব নেই? এর দু রকম জবাবই দেওয়া চলে। আগেই বলেছি, ছেলেবেলা থেকেই গল্প শোনা ও বলার নেশা ছিল। দুঃখের কথা, পাঠ্য বইয়ের বাইরে পড়ার মতো গল্পের বই ছিল আমাদের গ্রামে প্রায় দুর্লভ। যাই হোক, আমার কৈশোর ও যৌবনের প্রারম্ভে, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যবই বা সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত গল্প-উপন্যাসগুলো আমি পড়ার সুযোগ পেয়েছিলাম। এছাড়া ছিল দস্যু বনহুর, দস্যু বাহরাম সিরিজ, কিছু পরে ফাল্গুনি মুখোপাধ্যায়, নীহাররঞ্জন গুপ্ত, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের মতো লেখকদের নিউজপ্রিন্টে ছাপা পেপারব্যাক উপন্যাস, এবং সাহিত্য পদবাচ্য বলতে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা। এই সময়ের শেষ দিকে আমাদের দেশের নামকরা লেখকদের মধ্যে মীর মশাররফ হোসেন, শওকত ওসমান, শহীদুল্লাহ কায়সার, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শাহেদ আলী, প্রমুখের কিছু কিছু লেখা পড়েছিলাম। আর পড়েছি রবীন্দ্রনাথের ‘গল্পগুচ্ছ’র অধিকাংশ গল্প।
_________________________________________________________________________________________________
আমি কখনো কখনো, আগেই, মনে মনে, গল্পের একটা কাঠামো তৈরি করে নেই, তারপর সেটাকে সামনে রেখে লিখতে বসি। লিখতে গিয়ে কখনো হয়তো কোনো বাধা ছাড়াই পূর্ব-কল্পনা থেকে টানা গল্পটা লিখে ফেললাম। কখনো বা পূর্ব-সিদ্ধান্ত বদলেও যায়, অন্য রকম হয়ে যায় গল্পটা। কখনো এমনও হয়েছে যে, কোনো ধারণাই নেই, লিখতে বসলাম, তারপর একটা সূত্র তৈরী হয়ে গেল। গল্প-উপন্যাসে গদ্যরীতি, বাকরীতি অথবা ক্রিয়াপদের ব্যবহার নিয়ে আমি খুব উদ্বিগ্ন হই না।
_________________________________________________________________________________________________
আগেই বলেছি, ১৯৮২ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত লেখালেখি, এবং সাহিত্যের পড়াশোনাও, বন্ধ ছিল। ১৯৮৮ সালে নতুন করে গল্প পড়তে ও লিখতে শুরু করি। এই সময় প্রথমে দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং পরে হাসান আজিজুল হক আমাকে পেয়ে বসেন। পরবর্তী কালে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নন্দী, সমরেশ বসু, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ এবং অমিয়ভূষণ মজুমদার আমার পছন্দের তালিকায় উঠে আসেন। এসময় বেশ কিছু বিদেশী লেখাও পড়ে ফেলি। আর কিছু সমালোচনা সাহিত্যও পড়েছি সে সময়। তো এই দ্রুত এবং স্বল্পসংখ্যক লেখা পাঠই আমার প্রস্তুতির মূল কথা বলতে গেলে। হ্যাঁ, আমার বন্ধু কবি-প্রাবন্ধিক খুরশীদ আলম বাবু তার ব্যাপক পাঠ-অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে ছোটগল্প-উপন্যাসের অনেক খুটিনাটি ভালোমন্দ চিনতে ও বুঝতে সাহায্য করেছেন।
প্রশ্ন: আপনার গল্প লেখার কৌশল বা ক্র্যাফ্ট কী?
নাজিব : আমি গ্রামের ছেলে। গ্রামকে আমি ভালভাবে চিনতাম, জানতাম। তো এই চেনা-জানা অর্থাৎ অভিজ্ঞতাকে অবলম্বন করেই আমার গল্পের ভিত্তি তৈরি হয়। কিন্তু ছোটগল্প যেহেতু একটা শিল্প, সেহেতু স্রেফ অভিজ্ঞতার বয়ান সাহিত্য সৃষ্টি করতে পারে না, অভিজ্ঞতাকে সাহিত্য করে তুলতে তাকে কল্পনা এবং শিল্পসৌকর্যে মণ্ডিত করতে হয়। সেজন্যে প্রয়োজন যথোপযুক্ত আঙ্গিক এবং ভাষা। আমি গল্প লিখেছি মূলত বাংলা কথাসাহিত্যের মূলধারাকে অনুসরণ করে, যেটা গড়ে উঠেছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাত ধরে। তবে বিশ্বসাহিত্যের প্রভাবে পরে বাংলাসাহিত্যে অনেক পরিবর্তন-বিবর্তন সাধিত হয়েছে। তার অভিঘাতও আমার রচনায় পাওয়া যাবে। আমাদের গ্রামগুলো দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, অন্তত বিগত দুই দশক ধরে। প্রাকৃতিক পরিবেশ, এবং আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি সবকিছুই বদলাচ্ছে। এই পরিবর্তন কিছুটা ইতিবাচক অবশ্যই, তবে আমার মনে হয় নেতিবাচকতার প্রভাব বেশি। আমাদের সমাজসম্পর্ক, পরিবার-পরম্পরা ভেঙে পড়ছে। আধুনিকতা ও প্রযুক্তির নামে সভ্যতার খারাপ জিনিসগুলোর বেশি বেশি অনুপ্রবেশ ঘটছে। এসব আমাদের গল্প-উপন্যাসে খুব কমই আসছে। আমি চেষ্টা করি। আমি কখনো অভিজ্ঞতার বাইরে যাই না। তবে শিল্পের প্রয়োজনেই এর সঙ্গে কল্পনা মেশাতে হয়। আমি একটি এলাকা কিংবা একজন মানুষকে চিত্রিত করি তার প্রকৃতি, তার ইতিহাস, তার ধর্ম, বিশ্বাস বা সংস্কার, তার পারিবারিক বলয়, আর্থ-সামাজিক পরিম-ল, তার সীমাবদ্ধতা, তার সম্ভাবনা, তার আনন্দ, তার বেদনা, তার নৈঃশব্দ্য, তার মুখরতা, তার মুখের ভাব ও তার ঠোঁটের বুলি, সব সমেত। গল্পে এগুলো আসে ছোটখাট বর্ণনার আঁচড়ে, একটা-দুটো শব্দ, বাক্য বা সংলাপের মধ্য দিয়ে। উপন্যাসে বিস্তৃতভাবে আসে।
আর জীবনের দুটো দিক আছে—একটা বহির্বাস্তবতা, অন্যটা অন্তর্বাস্তবতা। কিন্তু এগুলো পরস্পরবিচ্ছিন্ন বা পৃথক বিষয় নয়। বহির্বাস্তবতা অন্তর্বাস্তবতাকে যেমন প্রভাবিত করে, তেমনি এর উল্টোটাও ঘটে। আমি এ দুটোর সমন্বয়কে প্রাধান্য দিয়ে থাকি। আমার অধিকাংশ গল্পেই আমি বহির্বাস্তবতাকে সামনে রেখেছি, পাশাপাশি মনোবীক্ষণও রয়েছে। এটা করতে গিয়ে আমি সৃষ্টিপ্রক্রিয়া হিসেবে সূক্ষ্মতা, ইঙ্গিতময়তা ও সংযমের আশ্রয় নিয়েছি। আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কাছ থেকে আমি এটা শিখেছি। অন্তর্বাস্তবতাকে পরিস্ফুট করতে অনেকেই ভাষার জটিলতা সৃষ্টি করেন। ভাবখানা এমন যে পাঠক যেন বুঝতে না পারেন লেখক প্রকৃত অর্থেই কী বলতে চাচ্ছেন বা গল্পের চরিত্রগুলো কী ভাবছে। একজন মানুষ তার সময়, তার প্রকৃতি, তার বিশ্বাস, আচার-সংস্কার, তার ভালো-মন্দ, তার আদর্শবোধ ও চিন্তা-কর্মের বৈপরীত্য, তার সাফল্য-ব্যর্থতা, সবকিছু নিয়েই সত্যিকার মানুষ, পূর্ণাঙ্গ মানুষ। লেখার সময় আমি সবসময় এটা মনে রাখি, একেকটা গল্পে হয়তো একেকটা বিষয় বেশি গুরুত্ব পায়, কিন্তু কোনোটাকেই অবহেলা করা হয় না। অবশ্য এর সাফল্য নির্ভর করে এর নির্মাণকৌশলের ওপর। এটা গল্পের অন্তর্বস্তুর ব্যাপারও বটে।
আমি কখনো কখনো, আগেই, মনে মনে, গল্পের একটা কাঠামো তৈরি করে নেই, তারপর সেটাকে সামনে রেখে লিখতে বসি। লিখতে গিয়ে কখনো হয়তো কোনো বাধা ছাড়াই পূর্ব-কল্পনা থেকে টানা গল্পটা লিখে ফেললাম। কখনো বা পূর্ব-সিদ্ধান্ত বদলেও যায়, অন্য রকম হয়ে যায় গল্পটা। কখনো এমনও হয়েছে যে, কোনো ধারণাই নেই, লিখতে বসলাম, তারপর একটা সূত্র তৈরী হয়ে গেল। গল্প-উপন্যাসে গদ্যরীতি, বাকরীতি অথবা ক্রিয়াপদের ব্যবহার নিয়ে আমি খুব উদ্বিগ্ন হই না। কারণ, আমি জানি, আমার গদ্য আমার মতোই হবে। আমি যখন লেখা শুরু করি, খানিকটা লেখার পর বারবার পড়ি, একজন সাধারণ পাঠকের দৃষ্টিতে দেখি আমার নিজের কাছে লেকাটার গদ্যরীতি সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত, গতিশীল হচ্ছে কি না। তখন একটু ওলট-পালট করে দেখি। আখ্যানের বিষয়, কাল ও পটভূমি এবং চরিত্রের আর্থসামাজিক অবস্থানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গদ্য ও বাকরীতি গড়ে ওঠে। ক্রিয়াপদের ব্যবহার নির্ভর করে মূলত কালচেতনা এবং আখ্যানের সঙ্গে লেখকের সম্পর্কের ওপর। আমি ভাষা বা আঙ্গিকের জটিলতা ও দুর্বোধ্যতাকে সাধারণত এড়িয়ে চলি।
প্রশ্ন: আপনার নিজের গল্প বিষয়ে আপনার নিজের বিবেচনা কী কী?
নাজিব : নিজের লেখা সম্পর্কে নিজে মন্তব্য করা কঠিন, এবং বিব্রতকরও বটে, যদিও প্রত্যেক লেখকেরই তার নিজের কর্ম সম্পর্কে একটা ধারণা থাকেই, থাকা উচিতও, তা নাহলে তার অগ্রগমন বাধাগ্রস্ত হয়। তো বাংলা একাডেমির সাবেক পরিচালক আনিসুর রহমান তাঁর এক লেখায় আমার সম্পর্কে কিছু মন্তব্য করেছিলেন, সেখান থেকে একটু তুলে ধরা যায়— ‘…নাজিব ওয়াদুদকে কোনো বিশেষ ধারার গল্পকার হিসেবে চিহ্নিত করা মুশকিল। ঘটনা ও চরিত্র প্রধান, কৌতূহল-উদ্দীপক গল্পের মঁপাসীয় ধারাকে অস্বীকার না করে বরং তাকে আত্মসাৎ করে তিনি গল্পের মধ্যে মনন, মানুষের অন্তর্জগতের বিচিত্র রহস্য এবং তীক্ষ্ম ও নির্মোহ জীবন-জিজ্ঞাসা গেঁথে গেঁথে দেন। গল্পকে তিনি ব্যবহার করেন আত্ম-বিশ্লেষণ ও আত্ম-আবিষ্কার অর্থাৎ জীবনের অর্থ অনুসন্ধানের মাধ্যম হিসেবে। তাই দুঃখ-বঞ্চনা, ব্যর্থতা-অসাফল্য, ক্ষয়-ক্ষতি, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কোনো কিছুই জীবন-প্রবাহকে রুদ্ধ করতে পারে না। মহত্তর ও শুদ্ধতর, বৃহত্তর ও আনন্দময় জীবনের উপলব্ধিই তার লক্ষ্য। শোষণ, বঞ্চনা, দারিদ্র ও হতাশার আড়ালে আমাদের জীবনের তলদেশে ফল্গুধারার মতো অগোচরে বয়ে চলেছে যে প্রাণশক্তি ও স্ফূর্তির অশেষ স্রোতস্বিনী, নাজিব ওয়াদুদ তার গল্পে জীবনের এই অধরা, অদৃশ্য প্রাণরসের সন্ধান করেন। তার গল্পের মানুষরা তাই কেউ জীবনবিমুখ নয়। টিকে থাকার কঠিন সংগ্রামের মাঝে এই জীবনমুখিনতা ও প্রাণশক্তিই নিত্যদিন সংগ্রামের স্পৃহা ও সাহস জোগায়।
…গল্পের বয়নপ্রক্রিয়ায় নাজিব ওয়াদুদ নির্মোহ। নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও প্রতীকী ব্যঞ্জনায় প্রকৃতিকেও তিনি মানুষের মতো প্রাণবন্ত ও ভূমিকাশ্রয়ী করতে চেয়েছেন। বাক্যের গতিশীলতা, চরিত্র ও পরিবেশ উপযোগী শব্দ চয়ন, কৌতুক ও বিদ্রুপের অভিঘাত, তীক্ষ্ম ও ইঙ্গিতময় সংলাপ এবং মূল কথা-বয়নে স্থানিক শব্দ ও মেজাজ প্রয়োগ করে তিনি গল্পের ভাষাকে নিটোল ও উপভোগ্য করেন।’ [আনিসুর রহমান, ‘প্রসঙ্গ কথা’, চতুর্ভুজ: চার তরুণের গল্প, প্রথম প্রকাশ: ফেব্রুয়ারি ২০০১; ইরা প্রকাশনী, জাকারিয়া ভবন, ৩৩/২, হাটখোলা রোড, ঢাকা- ১২০৩] আমার মনে হয় তিনি আমার মূল প্রবণতাকে ঠিকই শনাক্ত করতে পেরেছেন।
প্রশ্ন: আপনার আদর্শ গল্পকার কে কে? কেন তাঁদের আদর্শ মনে করেন?
নাজিব : প্রিয় লেখক অনেকে। একেক জন একেক কারণে। যেমন কথাসাহিত্যিকদের মধ্যে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশংকর বন্দ্যোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, অমিয়ভূষণ মজুমদার, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, সমরেশ বসু, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। এঁদের একেকজনের বৈশিষ্ট্য একেক রকম। এঁরা প্রত্যেকেই পরিপূর্ণ কথাসাহিত্যিক, অর্থাৎ ছোটগল্প এবং উপন্যাস উভয় ক্ষেত্রেই সফল লেখক। এঁদের একাধিক লেখা আমার প্রিয়। এঁরা ছাড়াও আরও অনেকে আছেন যাদের কোনো কোনো লেখা আমার প্রিয়। একেকজন একেক কারণে আদর্শ। তবে গল্পকার হিসেবে গড়ে উঠতে আমাকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছেন শুরুতে হাসান আজিজুল হক, এবং পরে সমরেশ বসু ও সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। সেই দিক থেকে এঁরা আমার শিক্ষক। আর শিল্পের সংযম শিখিয়েছেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে।
প্রশ্ন: কার জন্য গল্প লেখেন? আপনি কি পাঠকের কথা মাথায় রেখে লেখেন? লিখলে কেন লেখেন? আর যদি পাঠকের কথা মনে না রেখে লেখেন তাহলে কেন পাঠককে মনে রাখেন না লেখার সময়ে?
নাজিব : পাঠকের কথা একেবারেই মনে থাকে না এমন নয়, তাদের রাগ-বিরাগ বা মনোরঞ্জন আমার উদ্দেশ্য হয় না। প্রথমত, পাঠক না পেলে, তার সংখ্যা যত কমই হোক না কেন, সে লেখার মূল্য থাকে না, সে কারণে পাঠকের কথা সম্পূর্ণ ভুলে থাকা সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, পাঠক লেখককে পেয়ে বসলেও মুশকিল।
প্রশ্ন: এখন কী লিখছেন?
নাজিব : ইদানীং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ঝামেলার কারণে লেখা হচ্ছে কম। গল্প, অনুবাদের কাজ ছিঁটেফোঁটা করছি।
প্রশ্ন: আগামীতে কী লিখবেন?
নাজিব : দুটি উপন্যাসের কাজ দ্রুত শেষ করার ইচ্ছে আছে। একটার খসড়া প্রস্তুত, সেটার যোগ-বিয়োগ সম্পন্ন করব। আর একটা উপন্যাসের কাজ কেবল শুরু করেছি, সেটাই শেষ করার ইচ্ছে আছে।