প্রাত্যহিক সপ্রশ্ন যাপনের অভিজ্ঞতা আর হাড়ে-মজ্জায় বহমান সুপ্রাচীন পরম্পরার আশ্চর্য রোদ-ফুলের সফল মূর্তায়ন ঘটান কবি। আটপৌরে জীবনের অপ্রশস্ত ঘুলঘুলি দিয়ে যে রোদ ঢুকে পড়ে প্রতিদিন, সে রোদের শরীর ছেঁকে কবি যে চকমকি পাথরের জন্ম দেন তার প্রতিটি স্পর্শে আগুনের ফুলকির মতো জন্ম নেয় একেকটি কবিতা। কারুকার্যমণ্ডিত সেসব ফুলকির বিচিত্র ভঙ্গিমার পথ ধরে কবিতা হয়ে ওঠে বৈচিত্র্যময়। কবি বীরেন মুখার্জীর’‘জলের কারুকাজ’কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো এ ভাষ্যেরই স্মারক। এ বইয়ের কবিতায় যেমন উঠে এসেছে যাপিত জীবনের সারাৎসার, তেমনি কবিতার শরীরজুড়ে পাওয়া যায় পরম্পরার হদিসও।
‘জলের কারুকাজ’ কাব্যগ্রন্থের উৎসর্গপত্রেই কবি জানিয়ে দেন মানুষের যাপনকলার পৌনঃপুনিক ইতিহাস। দ্বিতীয় কবিতা’অনুগামী শব্দের ইশারায়’ কবি প্রথমেই কবিতার সাথে সুদীর্ঘ বচসা সেরে নেন। প্রশ্ন রাখেন, ‘শব্দে উঠে আসবে তুমি।’ কবি নিশ্চিত নন কবিতার শাব্দিক অবয়ব নিয়ে। অনেকটা দৈবের ওপর ভর করেই যেন অনুভ‚তিগামী কবি শুধু জানেন, তিনিও ‘অপ্রচল সড়কে’ হাঁটছেন। কবি কেবল অপ্রদর্শনযোগ্য এক আকুতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অজানা অন্ধকারের মুখোমুখি। অতঃপর কবি তার অভিজ্ঞতা এবং কল্পনাকে ভেঙেচুরে শূন্যতায় এসে স্থির হন। অনেকটা সিদ্ধার্থের মতোই যেন এই উপলব্ধি! এই নির্বিকার, শূন্য-দর্শনই যেন কবিকে উদ্বুদ্ধ করে ঘোষণা দিতে—‘আমাদের পুতুলদিন অনুগামী শব্দের ইশারায়/উড়ে যাচ্ছে, শুকনো পাতার মতো—নামকরণহীন।’ কবি এখানে পুতুল যাপনের কথা বলছেন। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কার ইশারায়, কিসের ইশারায় চালিত হয় এই পুতুল। এ কি দৈব, না কি রাষ্ট্র বা প্রথা!
‘আঙুলে বাজে স্বপ্নতাড়িত মেঘ’ কবিতায় আমরা পাই বৃত্তবন্দি মধ্যবিত্ত জীবনের ধারাপাত। চাক্রিক জীবনের আনন্দ-বেদনার যুগলপথে মিশে থাকে যেমন পর্যটকসুলভ নির্মোহ পারাপার তেমনি বিপুলবিস্তারি দ্বিধাকে সঙ্গী করেও টের পাওয়া যায় স্বপ্নতাড়িত মেঘের অনুরণন। বইয়ের নাম কবিতায় তিনি তুলে এনেছেন বৃত্তাবদ্ধ জীবনের বয়ান, নিহিলিস্টিক ভঙ্গিমায়। কবি একইসাথে আহ্বান করছেন যৌথায়ন ভেঙে দেয়ার জন্য, আবার ডাকছেন আত্মমগ্নতা ছেড়ে প্রেমময় পৃথিবীতে সমবেত হতে। এরপরই তিনি আত্মবিলোপের ক্ষণ বেছে নিয়ে ভাসিয়ে দিতে বলছেন নিজস্ব অভিমান। ‘ভেসে যেতে দাও বিশ্বাসের পাঠপ্ররোচনা/উড়িয়ে দাও নৈঃশব্দ্যমাখা সংগীতের কারুকাজ’—বলে তিনি প্রচল বিশ্বাস ও বোধিকে বাতিল ঘোষণা করলেও নতুন উদ্ভুত শূন্যতার মীমাংসা হাজির করেন না। বরং তিনি শেষাব্দি নিজেকে স্রোত অভিমুখী বলেই ঘোষণা করেন। যৌথায়ন ও ব্যক্তিবাদকে খারিজ করে দিলেও তিনি আদতে তৃতীয় কিছুকে কি হাজির করছেন? এখানে অন্তত তার খোঁজ মেলে না।
কবি বীরেন মুখার্জী মধ্যবিত্ত নাগরিক জীবনকে তুলে এনেছেন ফেলে আসা গ্রামীণ জীবনের প্রাকৃতিক নানা অনুষঙ্গে। আটপৌরে জীবনের প্রতিটি ভাঁজে লুকিয়ে থাকা হাজারো জিজ্ঞাসা ও তার সঞ্জাত বোধের ধারালিপি লেখার পাশপাশি তার কবিতা বিদ্যমান বাস্তবতার উপস্থাপনে হয়ে উঠেছে সমকালীনও। ছোট ছোট চিত্রকল্পের মধ্যদিয়ে কিছু ক্ষেত্রে যেমন তার কবিতা রাজনৈতিক হয়ে উঠেছে তেমনি কোথাও তিনি স্বরহীন কথকতায় বাক্সময় করে তুলেছেন বোধহীন-বোধীর ব্যঞ্জনাভাষ্য। অগম্য স্বাপ্নিক উচ্চতার দিকে তাকিয়ে প্রাত্যহিক আপাত বিচিত্র যাপনের অভিজ্ঞতাকে সম্বল করে কবি বারবার যেন সেই অমীমাংসিত প্রশ্নের উত্তরই খুঁজেছেন, যা পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় নিজেরই সামনে। মধবিত্ত জীবনের টানাপড়েন, তার চাক্রিক চারিত্র্য, স্বপ্ন ও যাপনের মাঝের দুস্তর ব্যবধান, জীবনের খেরোখাতা থেকে নৈরাশ্যের অবিরাম উদগীরণ সত্ত্বেও বেঁচে থাকা, ‘সঙ্গমে-সংস্কারে, নির্মাণে-বিনির্মাণে নিরন্তর বয়ে চলা এ সবই স্পন্দিত হয় তার কবিতায়।’ভেজা দুপুরে গঠনশৈলী ‘চন্দ্রাক্রান্ত রাত’, ‘নিয়মের শ্বাসমূল’, ’সংক্রান্তি-২’ কবিতা চারটি আটপৌরে মধ্যবিত্ত জীবনের রূপভাষ্য হিসেবে উপস্থিত। এগুলো পাঠে ব্যক্তিক জীবনের খোঁজ যেমন মেলে তেমনি মেলে নাগরিক যন্ত্রণার খতিয়ান।
_________________________________________________________________________________________________
কবি বীরেন মুখার্জী অপ্রচল সড়কে দাঁড়িয়ে কবিতার শৈলী ও আঙ্গিক নির্মাণে কতটুকু ব্যতিক্রমী তা সময়ের ওপরই ছেড়ে দিতে হয়। তবে তিনি মুহ‚র্তকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে একেকটি অনুভ‚তির তর্জমা করেছেন। যা মানুষের পৌনঃপুণিক যাপনের মতোই এক অনিঃশেষ বেদনাক্লিষ্ট কবিতার বহুপার্শ্বিক বিভাজন বলেই আমার বিশ্বাস।
_________________________________________________________________________________________________
আত্মমগ্ন অনুসন্ধানের মাঝে যতি চিহ্ন টেনে প্রতিক্রিয়াশীলতার ক্রম বিস্তৃতির এই নিথর সময়ে দাঁড়িয়ে কবি আস্তত্বের সংকটে ভোগেন অন্য অনেকের মতো। সমাজ ও রাজনৈতিক সচেতনতা তাকে বাধ্য করে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে ‘কেন ঠেলে দিতে চাও দূরে, মরুপ্রান্তরে/ রসহীন বালুর মায়া চেয়েছে কেউ কোনোদিন?’—এ প্রশ্ন পাঠককে ভাবনায় ফেলে। গহীনে টের পাওয়া যায়, না মরুময়তা কারও কাম্য নয়। ‘অসাম্যদর্শন’ শিরোনামের এই কবিতায় কবি স্পষ্টতই দেশের ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কট্টরপন্থাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। তারপর বেশকিছু চমকপ্রদ উপমা ও উৎপ্রেক্ষার মধ্যদিয়ে যাপনের শুদ্ধতাকে হাজির করে আবারও প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন—‘নির্বাসন অত্যাসন্ন জানিয়ে কেন তবে চোখ রাঙাও?’ এবার আরো সরাসরি। কবি হয়ে ওঠেন সমগ্র শুদ্ধ ও জীবনবাদী মঙ্গলময় মানুষের প্রতিনিধি। তখন শুধু প্রশ্ন না থেকে হয়ে ওঠে কারণ দর্শানো নোটিশ, যা ছুঁড়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের পক্ষ থেকে। শেষ পর্যন্ত কবি দেশ-কালে বৈচিত্র্যের প্রতিনিধি হিসেবে নিজ অবস্থিতিকে অমোঘ সত্য ঘোষণা করে সেই শ্রেণির সঙ্গে নিজের সম্পর্ক ছিন্ন করেন।
‘বৃষ্টিবাচক দৃশ্যগুলো’ শিরোনামের কবিতায় সংযোজিত হয়েছে ৪টি চতুর্দশপদী কবিতা। প্রতিটিই একেকটি স্বতন্ত্র অনুভ‚তির উৎসনামা। এর মধ্যে ‘সংযম’ কবিতাটি চিত্রকল্প ও উপস্থাপনরীতি, দুদিক থেকেই সন্ধানী পাঠককে আবিষ্ট করে। এই কবি অবারিতভাবে গ্রহণ করেছেন শব্দ, একেবারে ভিন্ন আঙ্গিকের শব্দকে সংযোগ ঘটিয়ে নির্মাণ করেছেন নতুন অর্থবাচকতা। ‘অনুভব’ কবিতায় এরকম বেশ কিছু শব্দের প্রয়োগ চোখে পড়ে। উদাহরণ দেওয়া যাক—‘ক্যানোলাশিহরিত অনুভব’, ‘সিটিস্ক্যানের শেষ দৃশ্যে তোমার সামরিক ক্লান্তি’, ‘দেখছি ই-মনিটরে, তোমার দৈনন্দিন ঘুমগুলো’। সময়ের গতির সাথে, অবধারিত যান্ত্রিক আবহের সঙ্গে এ যেন কবির নিজস্ব অভিযোজন।
আমরা মূলত সামাজিক-রাষ্ট্রিক ও প্রাকৃতিক এক সুদীর্ঘ অবস্থান্তর অবস্থার মধ্যে বিরাজ করছি। যে অবস্থা ইউরোপ পার করেছে ঊনবিংশ শতকের শেষাংশ থেকে বিংশ শতকের প্রথমাংশের ভেতরে তা এখন আমরা পার করছি। কিন্তু এর স্বরূপ এক নয়। প্রযুক্তির কল্যাণে এখন কোনো মানুষের পক্ষে একক বাস্তবতায় অবস্থান করা সম্ভব নয়। একজন কবিও সামাজিক, রাষ্ট্রিক, অর্থনৈতিক এই বাস্তবতার মাঝে বসে নিরন্তর অনুসন্ধানে আবিষ্কার করেন প্রচলিত অনুভ‚তির অপ্রচল রূপ। প্রেম, প্রকৃতি, ক্ষোভ, অভিমান, বিষাদ বা বিনাশ যত বড় বা যত ক্ষুদ্রই হোক না কেন এই অনুভ‚তি, কবি তাকে শব্দের বুনটে পরিস্ফুট করেন। কবির কলমে ধরা দিতে থাকে মুহ‚র্তের মনি-মুক্তা। এই অনুসন্ধান এক ধরনের ধারাবাহিকতা। তবে কেউ কেউ থাকেন যারা এই শান্ত প্রবাহের ধারায় বৈচিত্র্যের পাথর ছুঁড়ে আলোড়ন তুলতে সক্ষম হন। নন্দন সমুদ্রে অবগাহনের নতুন পথ নির্দেশ করতে পারেন। কবি বীরেন মুখার্জী অপ্রচল সড়কে দাঁড়িয়ে কবিতার শৈলী ও আঙ্গিক নির্মাণে কতটুকু ব্যতিক্রমী তা সময়ের ওপরই ছেড়ে দিতে হয়। তবে তিনি মুহ‚র্তকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে একেকটি অনুভ‚তির তর্জমা করেছেন। যা মানুষের পৌনঃপুণিক যাপনের মতোই এক অনিঃশেষ বেদনাক্লিষ্ট কবিতার বহুপার্শ্বিক বিভাজন বলেই আমার বিশ্বাস।
নাগরিক মধ্যবিত্ত এবং বিবদমান রাষ্ট্রিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় ব্যক্তি মানুষের বহু-বিচিত্র অনুভ‚তিগুচ্ছের কাব্যিক মূর্তায়ন পাওয়া যাবে কবিতাগুলোয়। আত্মমগ্ন কবি সময়ের যন্ত্রণাকে নিবিড়ভাবে তুলে ধরতে সচেষ্ট থেকেছেন। তার কবিতার বিদ্যমান শৈলীতে তার সহজাত বিচরণ মুগ্ধতা জাগায় বলেই বরং কবির কাছে নিরীক্ষাধর্মী আরও কবিতা প্রত্যাশা করা যেতে পারে।