কথারা যখন কবিতা হয়ে ওঠার প্রয়াস পায়, কবিতারথের রশিটি তখন আর থমকে থাকে না—তাকে টেনে নিয়ে যেতেই হয়। অর্থাৎ এভাবেই শিল্পের পথে, কবিতার পথচলা। কবি জুননু রাইনেরও কবিতার পথচলাটা সেভাবেই। তবে দেড় যুগেরও অধিক সময় ধরে এ পথের পথিক হলেও তার প্রথম কবিতার বই ‘এয়া’ প্রকাশিত হলো সম্প্রতি।
‘এয়া’—একটি পৌরাণিক চরিত্র। খ্রিস্টপূর্ব আড়াই হাজার অব্দের বেবিলনীয় সভ্যতার সময়ে এবং গ্রিক পুরাণে ‘এয়া’র অবস্থান সুচিহ্নিত। এয়া জ্ঞানের দেবী—তার বাস জলের গভীর স্তরে। সেখান থেকে মানুষের জন্য সুপেয় জল সরবরাহ করেন এই দেবী। আজকের এই বিশুদ্ধ জল-সংকটের যুগে ‘এয়া’র অস্তিত্ব তাই অত্যুজ্জ্বল। ‘এয়া’ তাই মঙ্গল ও কল্যাণের দেবী।
কবি জুননু রাইনের কবিতার বইয়ের ‘এয়া’ নামকরণটি তাই প্রাসঙ্গিক ও সমকালীন নানা সংকট-ভাবনার অনুষঙ্গে যথার্থই যৌক্তিক।
শিল্পচর্চায় অবলম্বিত একটি প্রধান অনুষঙ্গ জীবনভূমি। এই ভূমিরও রয়েছে নানারকম ইতিবাচক-নেতিবাচক অভিঘাত। এই ভূমিকর্ষণ ও লালনের দায় যে সবাই সফলতার সঙ্গে পালন করতে পারেন, তা নয়। জীবন তাই কারও কাছে একটি সংগ্রামের ক্ষেত্র—কখনো কখনো সুতীব্র যন্ত্রণারও। জুননু রাইন এই জীবনেরই অধিবাসী। এই জীবন তাকেও দিয়েছে কিছু দায়িত্ব। এই দায় পালন করতে গিয়ে জীবনের কর্ষিত ভূমিতে তিনি দেখেন—জীবন আলোকসজ্জিত সুউচ্চ অট্টালিকার নয়, জীবনে অনেক ওপরে উঠতে হলে অনেক নিচে তার ফল-ফসলহীন অনাকর্ষিত যন্ত্রণাক্লেদাক্ত কাঠিন্যের আঘাত সহ্য করতে হয়:
জীবন অনেক বড় হতে হয়
সুউচ্চ টাওয়ার, পাহাড়, গাছের মতো নয়
বড় হতে হয় ঘাসের মতো
দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয় পদপিষ্টতা সহ্য করে।
…
থেঁতলে যেতে যেতে চ্যাপ্টা হতে হতে
নিজের রক্ত পান করতে করতে
বিস্তৃত হতে হয় ধৈর্য সহ্যে…
(জীবন)
জুননু রাইনের জীবন দেখাটা এ রকমই—সরল কয়েকটি বাক্যে তিনি বলে ফেলেন অনেক কঠিন সত্যটি। অথচ এই কবি হাসির মতো জীবন ভালোবাসেন, কখনো কখনো অশ্রুর মতোও জীবনের অর্থ বোঝার চেষ্টা করেন।
শুধু অজ নয়—সব সময়ই সমকালীনতা ও সময়ের সংকট অনিবার্যভাবেই শিল্প-চর্চায় সহায়ক হওয়ার অবকাশ পেয়েছে। জুননু রাইন দেখেন—তার আকাশ পাখিহীন হয়ে পড়েছে, কিশোরবেলার ভরা নদীটি এখন স্মৃতির হাহাকারে ডোবা শুকানো নদী, যে হাঁসগুলো গরুগুলো সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে তাদের চোখে রক্ষিত হবে ভালোবাসার নদী জল আর স্নেহের চর। এভাবেই জুননু রাইনের ভেতরের আহত পাখিটা জীবনের মুক্ত আকাশে ওড়ার প্রয়াস পেয়েছে।
‘এয়া’র বেশ কিছু কবিতায় মৃত্যুচেতনা অনেকটা স্থান দখল করে নিয়েছে। মৃত্যু স্বাভাবিক-অনিবার্য জেনেও এর অস্তিত্ব ও উপস্থিতি আমাদের কাছে স্বস্তিদায়ক নয়। একাকিত্বে নিঃসঙ্গতায় মৃত্যুর কালো থাবা তার জানান দিয়ে যায় আরও বেশি স্পষ্ট করে।
জুননু রাইন তাই দেখেন:
আমি এমনই—
আমি আমার ছায়ার পেছনে হাঁটি
হাঁটতে হাঁটতে জীবনের পায়ে পায়ে
দেখি বিস্ময়ে বিস্মিত আমাকে
আমাকে দেখি, স্পষ্ট মৃত্যুর প্রতিবেশী
দেখি নদীর পাড়ভাঙা রাতের
স্যাঁতসেঁতে জোছনার শীতল তুষারে
ঢেকে দেয়া অপমৃত্যুর ক্লান্তি।
(যখন আমি আমার নিঃসঙ্গতার)
‘এয়া’ শিরোনামে ছত্রিশটি কবিতা গ্রন্থভুক্ত হয়েছে—যেগুলোয় হৃদয়ের নিঃশব্দ রক্তপাতের গল্প বর্ণিত হয়েছে শব্দে ধ্বনিতে।
কিছু কবিতার আছে অভিব্যক্তি—
অনুভূতি-অবলোকনের চমৎকার উচ্চারণ—
মনে হল তাই ঘুঘু ডাকা প্রচণ্ড দুপুরকে সন্ধ্যায় নামালাম
আমার আহতের ছবি এঁকে নিজেকে দেখালাম,
তোমার চোখের বীজ বুনতে
টবের কয়েকটি সবুজ পাতায় ঝরে পড়লাম,
চাঁদের কার্নিশে মেঘাচ্ছন্ন কিশোরের-ছেঁড়া ঘুড়িতে ঝুলে পড়লাম।
(এয়া-২১)
এয়া-২৩ কবিতাটিতে আশাবাদী মন স্বপ দেখার প্রয়াস খুঁজে পেয়েছে। যে স্বপ্ন জীবন ধারণের জন্য, জীবন পরিচালনার জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। স্বপ্ন না থাকলে জীবন সম্ভাবনাময় হয়ে ওঠে না। জুননু রাইনও তা বিশ্বাস করেন। বেশ কিছু কবিতায় উঠে এসেছে সে অভিব্যক্তি। কবি তাই একটি পুরো বিকেল রেখে দেন তার কাঙ্ক্ষিতার জন্য, শহরের বিকেলে ঘুমিয়ে থাকা পাখিদের সঞ্চিত গান উপহার হিসেবে দিতে চান তাকে। প্রেমবোধের স্নিগ্ধতা এভাবেই অভিব্যক্ত হয়েছে ‘এয়া’ কাব্যগ্রন্থে।
জীবন সঞ্চরমাণ—থেমে থাকার জন্য নয়। নয় শুধু আশা ভঙ্গের বেদনা সঞ্চয় করার জন্য। সফলতাই সবার কাম্য। জুননু রাইনও তার ব্যতিক্রম নন। তার কবিতায় তাই অনিবার্যভাবেই উঠে এসেছে সেই প্রসঙ্গ:
তখন তুমি যদি জোছনায় মুখ ধুতে চাও—
রাতের শরীর বেয়ে আমার হাসির রক্ত নেমে পড়বে তোমার আঁজলায়,
অপলক চোখের সমুদ্র চেয়ে থাকবে জীবনের অপেক্ষায়।
(এয়া-১১)এয়া
কবি: জুননু রাইন
প্রচ্ছদ: দেওয়ান আতিকুর রহমান
প্রকাশক: ঐতিহ্য
মূল্য: ১২০ টাকা