এক.
ঘুমিয়েছি ঢের আগে। ঘুমোলে নিজের মধ্যে অন্য এক ‘আমি’ জেগে ওঠে। টের পাই, সমস্তই টের পাই। কিন্তু ঘুম ভাঙে না। ভেতরের এই অন্য আমির জেগে ওঠা, তার প্রতিটি নড়াচড়া, শ্বাস-প্রশ্বাস এমনকি দীর্ঘশ্বাস পর্যন্ত টের পাই। তবু মৃতের মতো ঘুমোই। নিজের ভেতরের এই অন্য আমিটিকে প্রচণ্ড ভয় পাই। সম্ভবত সে কারণেই ঘুমন্ত আমি মৃতের অভিনয়ে মগ্ন থাকি। এড়িয়ে চলি এই দ্বৈত আমিত্বের আশু সংঘাত।
ঘুমিয়ে গেলেই অন্য আমিটির রাজত্ব শুরু হয়। সে বোধের পৃথিবীজুড়ে চালায় শাসনের ছুরি। এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিতে চায়। ভেতরে জেগে ওঠে এক বুভূক্ষু, অতৃপ্ত, অশান্ত আমি। বিষণ্নতার বল্গাহরিণ উদ্বাহু নৃত্য চালায় আমিত্বজুড়ে। জেগে ওঠে হাজারো কথার দীপশিখা। তারা কলকল করে ওঠে, উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। কথা কয়। অনবরত কথা কয়। ‘আমাকে’ মূক, বধির করে দিয়ে বাঙ্ময় হয়ে উঠতে চায়। এই অন্য ‘আমি’ একইসঙ্গে ঘুমিয়ে রাখে, জাগিয়ে রাখে। টালমাটাল করে তোলে দ্বৈত্ব আমিত্বকে। পাগলের মতো তখন হাতড়ে মরি ‘তোমাকে’, খুঁজে ফিরি তোমার অস্তিত্ব নিজের সীমানায়, নিজেরর অস্তিত্বের আঙিনায়। কিন্তু এই ‘তুমি’ আসলে কোন তুমি, কে তুমি, সে ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে যাই পরক্ষণেই। এই অন্য ‘আমি’ সারাক্ষণ তোমার সঙ্গে খুনসুটিতে মাতে, তোমার সঙ্গে প্রেমে, প্রতিজ্ঞায়, ভালোবাসায়, ভালো লাগায় উদ্বেল হয়। তোমার সামান্য ত্রুটি-বিচ্যুতিতে সে হতাশায়, বিষণ্নতায় ডুবে যায়। আবার এই অন্য ‘আমি’ই তোমার পরিচয় ভেবে ভেবে দীর্ঘশ্বাসে ব্যাকুল, উদ্ভ্রান্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু যে আমি ঘুমিয়ে থাকি, সে আমি জানি এই ‘তুমি’, যাকে খুঁজে খুঁজে বিষণ্ন, অশান্ত, অতৃপ্ত হচ্ছে আমার অন্য ‘আমি’, সে আসলে বাস্তবের কোনো ‘তুমি’ নও, সে তুমি চিরন্তন ‘তুমি’, বিমূর্ত। সে আসলে আমারই কল্পনায় ঘুমিয়ে থাকা আমারই তৃতীয় এক সত্তা, যাকে চাইছি তোমার অবয়বে। যে তুমি ছুঁয়ে দিচ্ছ আমাকে, আদরে, ভালোবাসায় যে তুমি ভরিয়ে তুলতে চাইছ আমার শূন্য ভাঁড়ার, মেটাতে চাইছ আমার অতৃপ্তির হাহাকার, শান্ত করতে চাইছ আমার অশান্ত মন, সে তোমাতে তাই মন ভরে না। আরও চাই, আরও মহার্ঘ্য কিছু, অপার্থিব কিছু। পার্থিব এই তোমাতে তাই কিছুতেই ঘোচে না আমার ‘তুমিত্বে’র তিয়াস। তোমার বাহুডোরে থেকেও তাই কল্পনা করি অন্যবাহুডোর, তোমার কণ্ঠলগ্ন হয়ে নিমগ্ন হই অন্য ‘তুমি’র বন্দনায়। যে তুমি ভালোবেসে চুমু দাও আমার তিয়াসি ঠোঁটে, আমি তাতে ভালোবাসা খুঁজে পাই না এক তিল। আমি তাতে খুঁজে পাই বিকট কামের গন্ধ, তীব্র ঘামের উপস্থিতি। আমার ভেতরের অন্য ‘আমি’ তখন ভয়ানক যন্ত্রণায় চিৎকার করে ওঠে, তীব্র হাহাকার ছড়িয়ে দেয় আমার সমস্ত অস্তিত্বজুড়ে। সে চিৎকার, সে হাহাকার ঝনঝন করে সারাক্ষণ বেজে চলে আমার বোধের সীমানায়, অস্থির, অশান্ত, অতৃপ্ত করে তোলে আমার সমস্ত সত্তা।
আমার ভেতরের ঘুমন্ত আমি তখন অসহায় একাকিত্বে ডুবে যাই, অবসাদে তলিয়ে যাই, নিরুপায় শুনতে থাকি এই অস্থির তাণ্ডব। জেগে থাকা অন্য আমি তখন ব্যাকুল, অধীর হয়ে খুঁজে চলে তোমাকে, আমারই ভেতরে ঘুমিয়ে থাকা আমার তৃতীয় সত্তাকে। যে আমার ভেতরের সব দাবানল, সব অশান্তি, অতৃপ্তি আর হাহাকার নিভিয়ে দিবে, হয়ে উঠবে আমার প্রত্যাশার সত্যিকারের এক ‘তুমি’। কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। যে তুমি সামনে এসে দাঁড়াও আমার, একবার, বার বার, যে তুমি ছুঁয়ে দাও আমার আমিকে, সে তুমি ‘তুমি’ নও। এই তুমি ছুঁতে পারো না আমার বোধের দেয়াল, স্পর্শ করতে পারো না আমার অনুভূতির পারদ। তার আগেই পুড়ে যাও তুমি, পুড়ে যায় তোমার তুমিত্ব। তুমি মিলিয়ে যাও হাওয়ায়। আমার ভেতরে জেগে থাকা তুমিত্বের তিয়াস তাই মেটে না আর। আমার কল্পনায়, আমার বোধে, আমার আমিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা সেই তুমিকে তাই খুঁজে মরি আামি তালকানার মতো। এঁকে যাই তার অস্পষ্ট ছবি, ছন্দে, কথায়, কল্পনায়। কিন্তু বাস্তবে সে অধরা, অস্পষ্টই থাকে আমার। থাকে আমারই তৃতীয় সত্ত্বা হয়ে আমার অন্য ‘আমি’র কল্পনায় আর ঘুমন্ত এই আমি’র হাহাকারে। তবু অধরা, অস্পষ্ট এই তোমাতেই যত ভালোবাসা আমার, যত মান-অভিমান, যত প্রণতি ও নতি। তোমাকে ভেবেই কাটে আমার অষ্টপ্রহর। আমার সকাল-দুপুর-রাত। আমি তাই গুনগুনিয়ে ফিরি, ‘আমার আপনার চেয়ে আপন যে জন খুঁজি তারে আমি আপনায়।’ তোমাকে না পাই কখনো, তবু জানি তোমার চেয়ে আপনার আর কেউ নেই আমার, নেই তোমার চেয়ে প্রেমিক কেউ।
দুই.
সারাদিনের ক্লান্তিতে গা এলিয়ে দিয়েছে সূর্য। লেপ্টে আছে সিঁদুর রঙা টিপ হয়ে পশ্চিমের কপালে। আরেকটু পরেই হারিয়ে যাবে। সন্ধ্যা নামবে। আঁধার নামবে একটু একটু করে। মিলিয়ে যাওয়া এই বিকেলটুকু, এই আলোটুকু আর কি ফিরবে কাল? যে পাখি ফিরে যাচ্ছে ডানা মেলে মায়ানীড়ে, কাল কি আবার ডানা মেলে উড়বে সে এই আকাশের নীলে? এই আকাশ থাকবে, এই বিকেল থাকবে, অনন্ত সময় থাকবে তবু কি এমনই থাকবে দৃশ্যপট? না। বদলে যাবে রঙ, পাল্টে যাবে তুলির আঁচড়। কিন্তু তুলি? সেও কি পাল্টায়? তুলি পাল্টায় না, চিত্রকর একই থাকে, চিত্রপটও চির পুরাতন, তবু কেন বদলে যায় সব? কী করে পাল্টে যায় একের পর এক দৃশ্য! যে সন্ধ্যা অনন্ত হাহাকারে মিলিয়ে যাচ্ছে আজ, কালও এমনি সময়ে মিলিয়ে যাবে সে, এমনি করে ক্লান্ত, বিমর্ষ সূর্য হেলে পড়বে পশ্চিমের গায়ে, সুক্ষ্ণ কিছু পার্থক্য তবু থাকবে তাতে। কাল যে পাখিটি এমনি সময়ে ফিরেছিল নীড়ে, ব্যাকুল, অধীর হয়ে সে পাখিটি আজ হয়তো ওড়েনি আকাশে। হয়তো সে নীরবেই গুটিয়ে নিয়েছে ডানা, ভুলে গেছে ওড়ার পথ। অন্য পাখি উড়ছে আজ তার পথে। কাল হয়তো উড়বে আবার অন্য কেউ। যে আকাশ কাল ছিল হতাশা-ধূসর, সে আকাশ আজ জাফরানি রঙে রাঙা, চোখে তার আসমানি নীল। কাল হয়তো সে সাজবে অন্য কোনো রঙে, অন্য কোনো রূপে। অদৃশ্য কোনো এক চিত্রকর ফুটিয়ে তুলবে তাতে নতুন বিমুগ্ধকর বিমূর্ত কোনো চিত্র। বদলে যাবে দৃশ্যাবলি।
ফিরে যাওয়া সন্ধ্যারা আদতে আর ফেরে না কোনোদিন। সময়ের শরীরে সামান্য ঢেউ তুলে পুনরায় মিশে যায় তার বহমানতায়। যে ‘আমি’ আজ দেখছি এই সন্ধ্যার মিশে যাওয়া, সে আমি কালও কি দেখতে পাবো এই সন্ধ্যা নামা? কালকের সন্ধ্যা কি ধরা দেবে এই ‘আমার’ চোখে আজকের রূপে? না। কালকের সন্ধ্যা হবে কালকের মতো, কালকের চোখও হবে কালকেরই চোখ। এই ‘আমি’ ক্রমে মিশে যাবো কালেরই অতল হাহাকারে। কালের শরীরে সামান্য বুদ্বুদ তুলে যে আমি আজ বসে আছি এই কালের পৃষ্ঠে, সে কালই আগামীকাল হয়ে ‘আমাকে’ টেনে নেবে তার অনন্ত অশেষ গহ্বরে। তখন কোথায় থাকবো এই ‘আমি’? মহাকালের অনন্ত বহমানতায়? তার চরাচরব্যাপী হাহাকারে? মহাবিশ্বের মহাশক্তিতে মিশে যাবো আবার? মিশে যাবো তার অতলান্ত অন্ধকারে, অনিঃশেষ আলোর গর্ভদেশে? জানি না। শুধু জানি, যে সন্ধ্যা মিলিয়ে গেল এই মুহূর্তে, যে সিঁদুর রঙা টিপ মুছে গেলো পশ্চিমের আকাশ থেকে, যে পাখিটি উড়ে গেলো চোখের সামনে দিয়ে, সে সবই ছড়িয়ে দিয়ে গেলো এক অনন্ত বিষাদ, অব্যক্ত হাহাকার। সমস্বরে যেন গেয়ে উঠল তারা চিরন্তন সেই গান, আসব না! আর ফিরে আসব না!
যে চলে যায় সে আর ফিরে আসে না কোনোদিন। হারিয়ে যায় সে সময়ের বিশাল উদরে। সময় গিলে নেয় তাকে। ফিরে যে আসে, সে অন্য কেউ। অন্য সন্ধ্যা, অন্য সূর্য, অন্য পাখি, অন্য তুমি এমনকি ‘আমি’ও অন্য আমি। শুধু অপরিবর্তিত থাকে সময়, স্থির এক চিত্রকর। আর সমস্তই বহমান, নশ্বর। ‘আমি’ তবে কে?