একজন তরুণ লেখকের উত্থান ও এর পেছনে সম্পাদকের ভূমিকানির্ভর একটি ঠাণ্ডা মেজাজের চলচ্চিত্র জিনিয়াস। এটি মাইকেল গ্রান্ডেজ পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র। এটি নির্মাণের জন্য গ্রান্ডেজ বেছে নিয়েছেন মার্কিন কথাসাহিত্যিক টমাস উলফিকে; যার মৃত্যুতে উইলিয়াম ফকনার বলেছিলেন, আমাদের সময়ে একজন অন্যতম সেরা প্রতিভাধর ছিলেন টমাস উলফি।
নিউইয়র্কের স্ক্রিবনার’স সন্স পাবলিশিং হাউজের একজন প্রখ্যাত সম্পাদক ম্যাক্সওয়েল পারকিন্স ১৯২০ সালে একটি অদ্ভুত বই প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বইটির লেখককে তুলনা করেন আর্নেস্ট হেমিংওয়ে এবং স্কট ফিটজগেরাল্ডের সঙ্গে। টমাস উলফি একজন বিশৃঙ্খল আমুদে মানুষ, যার সঙ্গে প্রথম পরিচয়েই পারকিন্স অবাক হয়ে যায়। পারকিন্সের পরামর্শক্রমে উলফি তার প্রথম পাণ্ডুলিপিটি পরিমার্জনে হাত দেন। তার প্রথম বই ‘লুক হোমওয়ার্ড, এঞ্জেল’ প্রকাশিত হওয়ার পর সাড়া পড়ে যায় চারিদিকে। কিন্তু দ্বিতীয় বইটি সম্পাদনার সময় পারকিন্স-উলফির ভেতর বাবা-ছেলের মতো অকৃত্রিম সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। এই সম্পর্ক তাদের উভয়ের পারিবারিক জীবনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে। এছাড়া সম্পাদনা নিয়ে শুরু হয় লেখক-সম্পাদকের ভেতর দ্বন্দ্বও। এই সব মিলে চলচ্চিত্রটিতে সৃষ্টি হয়েছে লেখক-সম্পাদকের রসায়ন, যার ফলাফল দারুণ। বিশেষ করে যারা লেখালিখির সঙ্গে সম্পৃক্ত, তাদের জন্য এই চলচ্চিত্রটি দেখা জরুরি। জন লোগান চলচ্চিত্রটির চিত্রনাট্য রচনা করেছেন স্কট বার্গের Max Perkins: Editor of Genius অবলম্বনে।
কোনো লেখকের আত্মজীবনী চলচ্চিত্রাকারে প্রকাশ করা বেশ কঠিন কাজ। কেননা, একজন লেখকের জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটে যায় খাতা-কলম নিয়ে। তাই তাদের জীবনের কাহিনীতে বৈচিত্র্য চিত্রিত করা সহজ নয়। আর চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তুকে যদি লেখকের জীবন থেকে আলাদা করে শুধু লেখালিখির প্রক্রিয়া কিংবা উপাদানকে মুখ্য হিসেবে গণ্য করা হয় তবে কাজটা আরও কঠিন হয়ে যায়। আর এই কাজটিই করা হয়েছে জিনিয়াস চলচ্চিত্রে। আত্মজৈবনিক কাহিনীতে জীবনকে উহ্য করে একজন লেখক ও সম্পাদকের ভেতরের সম্পর্কের পোস্টমর্ডেম করাটা সহজ ছিল না। আবার সম্পূর্ণ ভিন্ন চরিত্রের গুণাবলি সম্পন্ন দুজন মানুষ, উলফি ও পারকিন্সের ভেতর বন্ধুত্ব জীবনবোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছে। পাঁচ হাজার পৃষ্ঠার লেখাকে সংক্ষিপ্ত আকারে আনতে গিয়ে লেখক ও সম্পাদকের ভেতর বৈরিতা সৃষ্টি হয়। আবার বইটি প্রকাশিত হওয়ার পর সফলতা পেলে টমাস উলফি দ্বিধায় পড়ে যান, আসলে কে তার প্রকাশিত লেখার মূল কারিগর? সে নিজে না কি সম্পাদক পারকিন্স? একটি বই প্রকাশে সম্পাদক ও প্রকাশনা সংস্থার ভূমিকা কী, তা চলচ্চিত্রটিতে খুব স্পষ্টভাবে তা উঠে এসেছে। একটি বই প্রকাশের আগে কী কী প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়া উচিত, তাও উঠে এসেছে চলচ্চিত্রটিতে। আপনারা একটু লক্ষ্য করলেই দেখবেন, এদেশের প্রকাশকেরা একটি বই প্রকাশের পূর্বে তেমন কোনো প্রক্রিয়াই অনুসরণ করেন না। যার ফলে অসংখ্য মানহীন সাহিত্যের ভাণ্ডার প্রতি বছর আমরা পাচ্ছি, যা কখনোই কাম্য নয়। একটি বই প্রকাশের আগে সম্পাদনার গুরুত্ব হোমিংওয়ে, ফিটজগেরাল্ডরা ঠিকই বুঝেছিলেন; উলফিও বুঝেছিলেন, কিন্তু এদেশের প্রকাশনা সংস্থাগুলো আজও বোঝেনি।
অসাধারণ অভিনয়ে চলচ্চিত্রটি মুখর করেছেন কিছু আলোচিত অভিনেতা। কলিন ফির্থ চরিত্রে ম্যাক্সওয়েল পারকিন্স চরিত্রটিকে বেশ ভালোভাবে চিত্রিত করেছেন। বলতে গেলে একজন আদর্শ সম্পাদক ও তার গুণাবলি ফুটিয়ে তুলতে তিনি সমর্থ হয়েছেন। টমাস উলফি চরিত্রে ব্রিটিশ অভিনেতা জুডে ল তার বিশৃঙ্খল, অস্থির জীবনের বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সর্বদা যেন ব্রত ছিলেন। টমাস উলফির সঙ্গিনী চরিত্রে নিকোলি কিডম্যান চরিত্রটিকে কতটুকু ফুটিয়ে তুলেছেন এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। আবার চরিত্রটির বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মেজাজের উপস্থাপন বেশ অসংযত। আসলে পরিচালক এই চরিত্রকে যতটুকু জায়গা দেওয়ার প্রয়োজন ততটুকু দিয়েছেন বলে মনে হয় না। আর্নেস্ট হোমিংওয়ের চরিত্রে ডমিনিক ওয়েস্ট ও স্কট ফিটজগেরাল্ড চরিত্রে গাই পিয়ার্সের অভিনয় বেশ হৃদয়গ্রাহী হলেও এ দু’টি চরিত্রের ব্যাপ্তি খুব অল্প সময়ের জন্য। চলচ্চিত্রটির মূল ফোকাস টমাস উলফির পরিবর্তে পারকিন্সের দিকে নিলে আরও ভালো একটি ফল পাওয়া যেতো বলে মনে হয়। কেননা, পারকিন্স সেই সম্পাদক যার নির্দেশনাতেই সৃষ্টি হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক হোমিংওয়ে ও ফিটজগেরাল্ড। আসলে চলচ্চিত্রটির মূল ফোকাস কার দিকে ছিল এটা নিয়েও বেশ ধোঁয়াশা আছে।
পরিশেষে বলা যেতে পারে, জিনিয়াস একজন লেখক ও সম্পাদকের ভেতর বিদ্যমান এক ধরনের জটিল দ্বন্দ্ব আমাদের সামনে তুলে নিয়ে এসেছে, যেটা বেশ উপভোগ্য, কিন্তু অসাধারণ একটি সিনেমা হওয়ার মতো সব উপাদান এতে নেই।