জয়নাল আবেদীন শিবু—কবি ও ছোটকাগজকর্মী। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ নিয়ে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন এই তরুণ সাহিত্যকর্মী।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
জয়নাল আবেদীন শিবু: তথ্য আদান-প্রদানের অবাধ ও সহজলভ্যতার এই সময়ে কিছু ওয়েবম্যাগ শিল্পসংস্কৃতির চর্চায় ভালো ভূমিকা রেখে চলেছে; একে অস্বীকার করা যায় না। প্রিন্ট মিডিয়ার চেয়ে ওয়েব লেখক-পাঠক—উভয়ের জন্য সুযোগ করে দিয়েছে। ফলে ওয়েবম্যাগগুলোর আবেদন বেড়ে চলেছে। একসময় যারা দৈনিক পত্রিকাগুলোর মেজাজ মর্জি মেনে চলতে স্বস্তিবোধ করতেন না, ঠাঁই পেতেন না বা কখনো এড়িয়েও চলতেন, তারাই ‘সাহিত্য পত্রিকা’ ও ‘সাময়িকী’ বা লিটলম্যাগকেন্দ্রিক লেখালেখির চর্চা করতেন। এতে করে কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে বা যৌথ উদ্যোগে লিটলম্যাগ করেছেন, এখনো করছেন। সবসময়ই চলতি প্রবাহের বাইরে তরুণরা নিজস্ব বোধ-ভাবনা, রুচিকে বিনির্মাণের জন্য লিটলম্যাগে যুক্ত হয়ে পড়ে। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে—আংশিক সত্য হলেও লিটলম্যাগ কদরহীন হয়ে পড়েনি। ‘আঁতুড় ঘরেই মৃত্যর’ বৈশিষ্ট্য ধারণ করে বলেই কোনো কোনো লিটলম্যাগ সময়-স্রোতে বেশিদূর বাহিত হতে পারেনি। কিন্তু এখনো লিটলম্যাগের চর্চা ভালোই হচ্ছে। ওয়েবম্যাগগুলো এর স্থান দখল করে নিয়েছে বলব না, এর বদলে বলব কোনো কোনো ওয়েবম্যাগ লিটলম্যাগের মতো স্বতন্ত্র জায়গা করে নিয়েছে।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, খুব বেশি অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
জয়নাল আবেদীন শিবু: পাঁচ থেকে দশ ফর্মা কেন, বর্তমানে পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশ ফর্মারও লিটলম্যাগ বেরুচ্ছে এবং গুণগত মান নিয়েই বেরুচ্ছে। লিটলম্যাগ করতে কষ্ট ও অর্থ দুটোই দিতে হয় অনেক বেশি। এমনও সম্পাদক আছেন, যিনি মায়ের গয়না বিক্রির টাকা দিয়ে কিংবা বউ-বাচ্চার চাহিদার কোনো কোনো অংশ দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছেন নিজের সৃষ্টিসন্তান লিটলম্যাগটিকে। তবে অনেকের পক্ষেই ব্যয়ভার বহন করা সম্ভব না হওয়ায় বিমুখ হচ্ছেন লিটলম্যাগচর্চা থেকে। একটি ওয়েবম্যাগে সময়, শ্রম ও অর্থ খুবই কম লাগে। প্রকাশ ও প্রচারও একেবারে সহজ। প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গেই একসঙ্গে লাখ লাখ পাঠকের কাছেও পৌঁছে দেওয়া যায়। ওয়েবে সংযুক্ত পাঠক ও সাহিত্যকর্মীরা খুব সহজেই লেখালেখির অনেক কথাই জেনে যায়। ওয়েবম্যাগগুলো লেখকের জন্য খুবই উপযোগী। যে কারণে তারা এতে লেখালেখি এবং সম্পাদনায় আগ্রহী হয়ে উঠছেন বেশি। এই প্রবণতায় আমি অর্থকেই একমাত্র কারণ মনে করি না; ইন্টারনেটের অবাধ সুবিধার কারণে সব পণ্যপ্রাপ্তির সহজলভ্যতাকেই মুখ্য মনে করি।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবই সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
জয়নাল আবেদীন শিবু: এ অভিযোগ অনেকটাই সত্য। এখানে একটা গল্প বলি। গল্প নয়, সত্য। রবিউল হুসাইনের জবানি—একবার ব্রিটিশ রাজকবি টেড হিউজ ঢাকায় এক কবি সম্মেলনে এসেছিলেন। সম্মেলনের ফাঁকে বাংলাদেশের কবিদের সঙ্গে এক আড্ডায় বসলেন ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরিয়ানের বাসায়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন কবি সিকদার আমিনুল হক, রফিক আজাদ, বেলাল চৌধুরী, রবিউল হুসাইনসহ অনেকে। হঠাৎ হিউজকে তার আত্মদানকারী স্ত্রী সিলভিয়া প্লাথ সম্পর্কে এক বিব্রতকর প্রশ্ন করে বসেন একজন। হিউজ অপ্রস্তুত ও নিশ্চুপ হয়ে পড়েন।
আড্ডা শেষে সিকদার আমিনুল হক ও রবিউল হুসাইনের উদ্দেশে হিউজ বাংলাদেশের কবিতাচর্চা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে সিকদার বলেছিলেন—‘বিশুদ্ধ কবিতাচর্চা ছাড়া অনেক রকমের কবিতা এখানে বেশ ভালোই চর্চা হয়।’ এই ‘অনেক রকমের কবিতা’ স্রষ্টার মতো অনেক রমক ওয়েব সম্পাদকেরও কি সম্পাদনা চলছে না আপনাদের মাঝে? টেড হিউজকে বিব্রতকর প্রশ্নকারীর মতো অমেধাবী সম্পাদকদের কারণেই বানান ভুলের অভিযোগ উঠছে না, বলব কী করে?
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন ১৫/১৬ শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
জয়নাল আবেদীন শিবু: গল্পটা এ প্রশ্নেরও উত্তর নির্দেশ করে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক আর ওয়েব বলুন—ভুইফোঁড় সংগঠক, প্রতিষ্ঠান ও প্রকাশনা এখন অনেক বেড়ে গেছে। শিল্পসত্তাহীন লোকদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে এগুলো। অনেকের ওপরে এরা নিজেদের কর্তৃত্ব দেখাতেই ব্যাস্ত। এগুলো বেশিদিন টিকবে না, ভেঙে পড়বে। পানির নিচ থেকে বুদ্বুদ যেমন ওপরে উঠেই মিলিয়ে যায়, আত্মপ্রচারকামী গোষ্ঠীও এভাবে মিলিয়ে যাবে কালের গহবরে। একথা মানতেই হবে— হীনউদ্দেশ্য নিয়ে বেশি দূর এগুনো যায় না।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
জয়নাল আবেদীন শিবু: ওয়েবম্যাগ, ওয়েবজিন কেন, তথ্যপ্রবাহের সহজ অনেক মাধ্যম এখন কর্মব্যস্ত মানুষকে গিলে নিচ্ছে। কেড়ে নিচ্ছে নিদ্রা-আহার-বিহারের সময়! নেই হয়ে যাচ্ছে মানুষের চিন্তার অবসরটুকু। আমরা উন্নত যান্ত্রিক জীবনের দিকে এগুচ্ছি ক্রমশ। শিশুদের হাতে সিলেবাস বহির্ভূত জীবনশিক্ষার কোনো বই তুলে দেওয়ার পথে নেই আমরা। শিক্ষকদের হাতের ব্যাগে বাজার খরচের সওদা ছাড়া একটা বই খুঁজে পাওয়া যায় খুবই কম। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীরা নিজের ক্যারিয়ার গঠনে সেশন পাসেই ব্যস্ত; শিল্প-সাহিত্যের দুই/চারখানা পুস্তক নড়াচড়া করার সময় কই! ওপরে ওঠার সিঁড়ি হিসেবে প্রয়োজনীয় কিছু বই পড়া ছাড়া সামগ্রিক বিবেচনায় মানুষ এখন বইপাঠবিমুখ হচ্ছে। অবশ্য ওয়েবম্যাগ, ওয়েবজিনের প্রাবল্যও কিছুটা বইবিমুখ করেছে প্রজন্মকে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা, না লিটলম্যাগ, না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
জয়নাল আবেদীন শিবু: তিনটি মাধ্যই পছন্দ। তবে লিটলম্যাগ বড়ই মায়াময়। ছায়াময়।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও একটি সীমিত পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
জয়নাল আবেদীন শিবু: ওয়েবম্যাগে সাহিত্যচর্চা ও এর প্রচার-পসারকে আমি ইতিবাচক দৃষ্টিতেই দেখি। কিন্তু কেবল পরিসংখ্যান দিয়ে সব বিবেচনার পক্ষপাতী নই। এরিস্টটল গণতন্ত্রকে মূর্খের শাসন বলেছিলেন। সংখ্যাতাত্ত্বিক পদ্ধতি সর্বত্র ভালোর দিক নিরূপনের মাধ্যম হতে পারে না। অনলাইন পাঠকের এমন অনেক ব্রাউজিং-ই কেবল ওপেন আর ক্লোজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে! ফেসবুকে অনেকে ‘না পড়েই’ লাইক মারে! ধানের ভাঁড়ার যেমন চিটাহীন হয় না, লাখ লাখ ইউজারের মধ্যেও অপরিপক্বের আধিক্য থাকা অস্বাভাবিক নয়। এছাড়া বোদ্ধা পাঠকের একটা বড় অংশ যেখানে অফলাইনেই রয়ে গেছেন, যাদের হাতে চলে যাচ্ছে লিটলম্যাগের প্রকাশিত সেই দুইশ থেকে তিনশ কপি। এই কপিগুলোকে সংগ্রহে রাখার এবং সুযোগমতো কাজে লাগানোর সুবিধাকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ওয়েবম্যাগগুলোর স্থায়িত্বও অনেক কিন্তু সময়মতো পুরনো তথ্য খুঁজে বের করার ঝক্কি-ঝামেলাও কম নয়, বিশেষ করে নেট-দুর্গতির দেশে।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
জয়নাল আবেদীন শিবু: যে দৈনিকগুলো সমৃদ্ধ সাহিত্যপাতার পেছনে শ্রম, অর্থব্যয় করবে, তাদের গুরুত্ব কখনো হারাবে না, ওয়েবম্যাগ যতই বাড়ুক। এখনো তো দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি খরবেরর কাগজের সাহিত্যপাতাটি দেখি অনেক গুরুত্বহীন, বিজ্ঞাপনে ভিড়ে প্রায় শীর্ণকায়! গুরুত্ব হারানোর আশঙ্কা বাড়িয়ে দেয় দৈনিক মালিকগুলোর করপোরেট মানসিকতার ওপর।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
জয়নাল আবেদীন শিবু: বিপণিবিতানের ব্যস্ততা ঝেড়ে, লোভ-লাভের ধান্দা ছেড়ে বিজ্ঞান প্রগতির পথে, কুসংস্কারমুক্ত উদার মানবিকতার পক্ষে নিবেদিত দেখতে চাই আমার কামনার ওয়েবম্যাগটিকে। দেশ-বিদেশের সাহিত্যের তুলনামূলক আলোচনা, সমালোচনা, সাহিত্যের ভাষা, গতি-প্রকৃতি নিয়ে লেখালেখি, পাঠপ্রতিক্রিয়া, জীবনীসাহিত্যকে তুলে ধরার মধ্য দিয়ে একটি ওয়েবম্যাগ তার সমৃদ্ধ জায়গাটি তৈরি করে নিতে পারে। আমার পছন্দ তেমনই একটি ওয়েবম্যাগ।