সাফি উল্লাহ্—তরুণ গল্পকার। প্রকাশিত গল্পগ্রন্থে ‘সাত নম্বর বাস’ (২০১৬)। ‘গল্পগুলোর অর্থ নেই’ শিরোনামে দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ বইমেলা ২০১৮-তে প্রকাশের অপেক্ষায়। সম্প্রতি সাহিত্যের ওয়েবম্যাগ নিয়ে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন এই তরুণ সাহিত্যিক।
চিন্তাসূত্র: একসময় যারা দৈনিকের সাহিত্যপাতায় ঠাঁই পেতেন না অথবা যারা দৈনিকে লিখতে স্বস্তি বোধ করতেন না, তারা লিটলম্যাগ বের করতেন। সম্প্রতি লিটলম্যাগের সংখ্যা কমতে শুরু করেছে। বিপরীতে বেড়েছে অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা বা ওয়েবম্যাগ। আপনি কি মনে করেন, লিটলম্যাগের জায়গাটাই এই ওয়েবম্যাগগুলো দখল করছে?
সাফি উল্লাহ্: আধুনিক যুগ পেরিয়ে আমরা উত্তর-আধুনিক যুগে পা রেখেছি। আমাদের প্রকাশের মাধ্যমে এসেছে বিস্তর পরিবর্তন। আগে শুধু দৈনিকের সাহিত্যপাতা আর লিটলম্যাগই ছিল সাহিত্যকর্ম প্রকাশের মাধ্যম। কিন্তু জনজীবনে আধুনিকায়নের প্রভাবের ফলে ওয়েবম্যাগ, ওয়েবজিন ও ব্লগ এসেছে। এগুলোর মাধ্যমে অল্প সময়ে অনেক পাঠকের কাছে লেখা পৌঁছানো যায়। ওয়েবম্যাগের আরেকটা উল্লেখযোগ্য দিক হলো, কতজন পাঠক লেখাটি পড়লো, তা দেখা যায়। লেখক তার লেখার ওপর পাঠকের মন্তব্যও জানতে পারছেন এই ওয়েবের মাধ্যমে।
লিটলম্যাগের জায়গা ওয়েবম্যাগ কিছুটা নিশ্চয় দখল করেছে। তবে আমার মনে হয়, সময়ের দাবি হিসেবেই ওয়েবম্যাগের জন্ম। এছাড়া এখন অনলাইনে যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো লেখকের লেখা পাওয়া যায়। কিন্তু লিটলম্যাগ নিজে গিয়ে কিংবা ডাক বা কুরিয়ারের মাধ্যমে সংগ্রহ করতে হয়। এটা সময়সাপেক্ষ এবং ব্যয়বহুল। সে কারণটাও ওয়েবম্যাগের প্রভাববিস্তারের উল্লেখযোগ্য দিক বলে আমি মনে করি।
চিন্তাসূত্র: একসময় লেখাপ্রাপ্তির ওপর নির্ভর করে, পাঁচ থেকে দশ বা তারও বেশি ফর্মার লিটলম্যাগ বের হতো। এতে খরচও হতো বেশ। কিন্তু বর্তমানে ওয়েবম্যাগে সে খরচটি নেই। আপনি কি মনে করেন, অর্থব্যয়ের কারণ না থাকায় ওয়েবের দিকে ঝুঁকছেন সাহিত্যকর্মীরা?
সাফি উল্লাহ্: স্বল্প খরচ নিশ্চয় ওয়েবম্যাগের দিকে ঝুঁকে পড়ার একটি কারণ। তবে আমি এটাকে কখনোই বড় কারণ হিসেবে দেখি না। সাহিত্যচর্চার বাধা হিসেবে অর্থভাবকে দায়ী করি না। স্বল্প সময়ে অধিক পরিমাণ পাঠকের কাছে লেখা পৌঁছানোটা একটা কারণ। আরেকটি কারণ হলো, এতে নির্দিষ্ট স্পেস কিংবা পৃষ্ঠার প্রয়োজন হয় না বলে সাধারণত লেখকদের নির্দিষ্ট শব্দসীমা দেওয়া হয় না। ফলে লেখক তার প্রয়োজনীয় কথাগুলো প্রয়োজনীয় সংখ্যার মধ্যেই লিখতে পারেন। আর লিটলম্যাগে যত ভালো লেখাই তারা পেয়ে থাকুক না কেন, নির্দিষ্ট ফর্মা বা পৃষ্ঠায় ধরবে, এর চেয়ে বেশি লেখা নিতে পারে না। কিংবা ভালো বা মানসম্পন্ন লেখা না পেলেও পৃষ্ঠাপূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক লেখা নিতে হয়। ওয়েবম্যাগে এই বালাইটি নেই। মানসম্পন্ন লেখা পেলেই ছাপানো যায়। কিংবা না পেলেও কোনো শূন্যতার সৃষ্টি করে না। অবশ্য এটা মানতেই হবে, এই ওয়েব মাধ্যমে খরচ অনেক কম কিংবা স্টলে বিতরণের ঝামেলা নেই।
চিন্তাসূত্র: কারও কারও মতে, বেশিরভাগ ওয়েবে সম্পাদনা ছাড়াই লেখা প্রকাশিত হচ্ছে। এমনকী বানানও দেখা হয় না বলে অভিযোগ রয়েছে।
সাফি উল্লাহ্: বেশিরভাগ ওয়েবেই সম্পাদনা ছাড়া লেখা প্রকাশ করে, এটার সঙ্গে আমি একমত না। কারণ আমি অনেকগুলো পোর্টালের নাম বলতে পারব, যারা অত্যন্ত সচেতনভাবে সম্পাদনা এবং বানান যাচাইয়ের পরে লেখা ছাপান। তবে এটা সত্য, যেহেতু তুলনামূলক সহজ মাধ্যম এই ওয়েবম্যাগ, তাই অনেক অদক্ষ লোকও এই পোর্টাল খুলে বসছে। তাদের অনেকেই সাহিত্য বোঝে না কিংবা ভাষারীতি বোঝে না। তবে এই ভুঁইফোড় পোর্টালগুলোর জন্য মানসম্পন্ন পোর্টালগুলোকে দায়ী করার কিছু নেই। কিছু কিছু পোর্টাল রয়েছে, যেখানে লেখা বাছাই থেকে শুরু করে বানান যাচাই ও প্রকাশের জন্য একটি লেখা কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করে। এসব পোর্টালে আমি নিজে গিয়ে পছন্দের লেখাগুলো পড়ে আসি এবং নিজের লেখা দিয়েও স্বস্তি বোধ করি। নিজের অজান্তে কিছু বানান ভুল থাকলেও সেটা সম্পাদকের নজরে পড়লে সংশোধন হয়ে যাওয়ার ভরসা থাকে। এগুলোর নির্ভরযোগ্যতাও নিশ্চয় রয়েছে।
চিন্তাসূত্র: একসময় কারও পকেটে একহাজার/বারো শ টাকা থাকলেই তিনি একটি লিটলম্যাগ করার সাহস দেখাতেন। এখন পনেরো/ষোলো শ টাকা পকেটে থাকলেই কেউ কেউ ওয়েবম্যাগ করছেন, কেউ কেউ বিনেপয়সাতেই ব্লগজিন খুলছেন, লেখা সংগ্রহ করছেন। এ ধরনের ওয়েবজিন বা ব্লগজিন বের করার কারণ কী বলে মনে করেন আপনি? এটা কি নিছকই নিজের কর্তৃত্ব প্রকাশের উপায়, না কি সাহিত্যপ্রেমের জন্য?
সাফি উল্লাহ্: টাকা-পয়সার চেয়েও সাহিত্যপ্রেমে বেশি উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেকেই ওয়েবম্যাগ খুলছেন, কেউ কেউ খুলেছেন শখের বশে। তবে কিছু কিছু অপ্রয়োজনীয় ওয়েবজিনও আমার নজরে এসেছে। ওগুলোর মাধ্যমে সাহিত্যচর্চার চেয়ে কর্তৃত্বচর্চাই বেশি হয় বলে আমি মনে করি। কারণ ওরা লেখার মানের চেয়ে বেশি লেখা ছাপানোতে গুরুত্ব দেয়। এখানে একটা বিব্রতকর ও তীক্ত অথচ সত্য কথা হলো, কেউ যদি ওয়েবজিন বা ওয়েবম্যাগের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে থাকে, তাহলে লেখকসমাজে তার কদর বেড়ে যায়; অন্তত লেখা ছাপানোর জন্য। আর এই সম্পর্ক ও কর্তৃত্ব রক্ষার্থে নিম্নমানের লেখাও হরহামেশায় ছাপিয়ে দিচ্ছে সে সব সম্পাদক বা প্রকাশক। এসব ওয়েবজিনের সবগুলোই যে এমন, তাও না। কিছু ওয়েবজিন থেকে ভালো ভালো লেখাও আসছে। আবার কিছু লেখক রয়েছেন, যারা বিভিন্ন ওয়েবে লেখা দেওয়ার চেয়ে নিজের নামে খোলা ওয়েবে লিখতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন।
মূল কথা হলো, কেমন লেখা প্রকাশ করছে, তার ওপরে নির্ভর করছে সেই ওয়েবজিনের উদ্দেশ্য। প্রকাশিত লেখা পড়েই বোঝা যাবে, সেটা সাহিত্যসেবার জন্য খোলা, না কি কর্তৃত্বপ্রকাশ ও মোড়লীপনার জন্য।
চিন্তাসূত্র: আপনি কি মনে করেন, ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিন মানুষকে বইপাঠবিমুখ করে তুলছে?
সাফি উল্লাহ্: না, আমি তা মনে করি না। ওয়েবম্যাগ-ওয়েবজিন-ব্লগজিনের কারণে বরং বইয়ের দিকে মানুষের ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা দেখতে পাচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবে আমি যেটা করি, সেটা হলো—কোন লেখকের বই কেনার আগে বিভিন্ন ওয়েব পোর্টাল থেকে তার কিছু লেখা পড়ে নেই। পড়ে ফেলার পর লেখায় মুগ্ধতা কিংবা ভালোলাগা থাকলে কিংবা আমার চিন্তার জায়গা থাকলে বই কিনে পড়ি।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলো, বইবিক্রি নয়; মূলত পাঠকের কাছেই লেখা পৌঁছে দেওয়াই লেখকের উদ্দেশ্য। সেদিক থেকে ওয়েব পোর্টালগুলো লেখকের লেখা পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পালন করছে।
চিন্তাসূত্র: আপনি নিজে দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা, না লিটলম্যাগ, না এই ওয়েবম্যাগে লিখতে /পড়তে পছন্দ করেন?
সাফি উল্লাহ্: দৈনিক পত্রিকার সাহিত্যপাতা, লিটলম্যাগ ও ওয়েবম্যাগ—কমবেশি সবখানেই লিখে থাকি। তবে ইদানীং ওয়েবম্যাগেই বেশি লেখা হচ্ছে। ওয়েবম্যাগে অপেক্ষার পালা তুলনামূলক কম। এছাড়া এখন সোস্যাল মিডিয়ার যুগ, যেখানেই লেখা প্রকাশ হোক না কেন, দেখা যায় যে ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কড ইন-এ শেয়ার করে দেওয়া হয়। ফলে অনলাইন থেকেই পড়া হয়।
সম্প্রতি ওয়েবম্যাগে বেশি লেখাও হচ্ছে, আবার পড়াও হচ্ছে। যেহেতু ওয়েবম্যাগকেন্দ্রিক পড়া ও লেখা হচ্ছে, সেহেতু বলতেই পারি, ওয়েবম্যাগই আমার পছন্দ। পছন্দ শব্দটা ব্যবহার না করে বরং বলি, বেশি পছন্দ। কারণ সাহিত্যপাতা এবং লিটলম্যাগও আমার পছন্দ। তবে ওয়েবম্যাগের সঙ্গে আমার সম্পৃক্ততা একটু বেশি। বিশেষত ওয়েবম্যাগে প্রকাশিত লেখার ওপর পাঠকের মন্তব্যের কারণে এটা আমাকে বেশি টানে।
চিন্তাসূত্র: একটি লিটলম্যাগ দুই থেকে তিন শ কপি প্রকাশিত হয়, দৈনিকের সাহিত্যপাতাও সীমিত-সংখ্যক পাঠকের কাছে যায়। কিন্তু অনলাইন সাহিত্যপত্রিকা যায় লাখ লাখ ইউজারের কাছে। সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
সাফি উল্লাহ্: সাহিত্যচর্চা, প্রসার ও প্রসারের ক্ষেত্রে ওয়েবম্যাগের অবদানকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ নেই। সব লিটলম্যাগ দেশের সব এলাকায় পৌঁছায় না। আবার দৈনিক পত্রিকাগুলোর সাহিত্য পাতা পড়তে হলে অনেক পত্রিকা কিনতে হয়। সে সুযোগও সবার নেই, সব জায়গায়ও নেই। এদিক দিয়ে ওয়েবম্যাগ এগিয়ে আছে। দেশের যেকোনো জায়গা থেকে ইন্টারনেট সুবিধার মাধ্যমে ওয়েবম্যাগের লেখা পড়া যায়। শুধু পড়াই যায় না, বরং পড়ার পর সেই লেখার ওপর অভিমত দেওয়ারও সুযোগ থাকে। লেখক-পাঠকের মাঝের দূরত্ব কমে আসে।
তবে একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এখন অধিকাংশ দৈনিক পত্রিকার অনলাইন পোর্টাল এবং ই-পেপার পাওয়া যায়। ফলে সাহিত্যপাতাগুলোও সহজে পড়ে ফেলার সুযোগ রয়েছে। অনলাইন মাধ্যমে সাহিত্যকে অনেক পাঠকের নাগালে নিয়ে আসতে পেরেছে।
চিন্তাসূত্র: ওয়েবম্যাগের পরিমাণ আরও বাড়তে থাকলে একসময় কি দৈনিকের সাহিত্যপাতা গুরুত্ব হারাবে?
সাফি উল্লাহ্: মানুষ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লেখক বাড়ছে, লেখার সংখ্যা বাড়ছে, প্রকাশের মাধ্যম বাড়ছে, এমনকি পাঠকও বাড়ছে। যারা সত্যিকারের পাঠক, তারা সব মাধ্যম থেকেই সেরা লেখাগুলো বেছে পড়ে ফেলেন।
লক্ষ করলে দেখতে পাবেন, এত ওয়েবম্যাগ থাকার পরেও সাহিত্যপাতায় লেখার অভাব নেই। আবার যেদিন সাহিত্যপাতা প্রকাশিত হয়, সেদিন লেখক ও পাঠক পাড়ায় একপ্রকার উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। লেখকেরা নিজের প্রকাশিত লেখা ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পাঠকের সামনে তুলে ধরেন। পাঠকেরা পড়ে। লেখকেরাও একে অন্যের লেখা পড়েন। এই বিষয়টি ইঙ্গিত দিচ্ছে যে, ওয়েবম্যাগের পরিমাণ বেড়ে গেলেও দৈনিকের সাহিত্যপাতার আবেদন ঠিকই থাকবে।
চিন্তাসূত্র: একটি ওয়েবম্যাগকে আপনি কিভাবে দেখতে চান? অর্থাৎ একটি ওয়েবম্যাগে আপনি কী ধরনের লেখা পড়তে চান?
সাফি উল্লাহ্: ওয়েবম্যাগকে আমি বস্তুনিষ্ঠ লেখার সমাহার হিসেবে দেখতে চাই। চাই, এখানে প্রকাশক বা সম্পাদকের সঙ্গে লেখকের সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে না, বরং লেখার সাহিত্যমানের ওপর ভিত্তি করে লেখা নির্বাচন ও প্রকাশ করা হোক।
সৃজনশীল লেখা, অর্থাৎ গল্প কবিতা উপন্যাসের পাশাপাশি বিশ্বসাহিত্যের অনুবাদ, বই আলোচনা, গবেষণা প্রবন্ধ ও নিবন্ধ পড়ার আগ্রহ বেশি আমার। আমি চাইব, এগুলো ওয়েবম্যাগে থাকুক।
আর গবেষণা প্রবন্ধ ছাপা হলে নির্ভরযোগ্যতা যাচাইয়ের জন্য তথ্যসূত্র কিংবা রেফারেন্স দিলে পাঠকের সুবিধা হয়। এতে ওই বক্তব্য প্রাবন্ধিকের গবেষণালব্ধ মন্তব্য, না কি কোনো মানুষের মন্তব্য তিনি পুনর্ব্যক্ত করছেন, তা বোঝা যায়।