রওশন হাসান—কবি ও অনুবাদক। বর্তমানে নিউইয়র্কের একটি ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানিতে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা বারো। সম্প্রতি প্রবাসে সাহিত্যচর্চা নিয়ে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন এই সাহিত্যিক।
চিন্তাসূত্র: দেশ থেকে অনেক দূরে আছেন। কত বছর ধরে আছেন প্রবাসে? কেমন লাগছে প্রবাসজীবন?
রওশন হাসান: দেশ থেকে দূরে আছি তা বলব না, তবে স্থায়ীভাবে বসবাস করছি না, তা বলা যাবে। প্রায় একযুগ দেশ থেকে দূরে। ফ্যামিলিতে দুই ভাই-বোন ছাড়া সবাই দেশে বাস করছেন। বাবা অবসরপ্রাপ্ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বাবা ও ভাই-বোনদের দেখতে দেশে যাওয়া হয়। প্রবাস জীবন সংগ্রামী জীবন। হাউসহোল্ড থেকে শুরু করে বাইরের সব ধরনের কাজই নিজেকে সামলে নিতে হয়। দেশকে মিস করি যেখানেই বাস করিনা কেন। বাংলাদেশ প্রাণের গভীরে সর্বদাই গ্রথিত। দেশের খাবার থেকে শুরু করে বিশেষ করে পছন্দের বাংলা বই, লেখক, কবি, বিশ্বসাহিত্যকেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরি, ইউনিভার্সিটি চত্বর, আরও অনেককিছু মনে পড়ে। তবে দেশের নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থার শোচনীয় অবস্থা ভাবিয়ে তোলে। দেশে অবস্থানরত পরিবারের জন্য প্রায়ই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। প্রবাসে এখন দেশের সব পণ্যই পাওয়া যায়। সাহিত্য আসরগুলোয় অংশগ্রহণ করে নতুন কবি, লেখকের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। একটি মিথস্ক্রিয়া তৈরি হয়। এসব আয়োজন লেখার অনুপ্রেরণা যোগাতে সহায়ক। বাংলাদেশ থেকে আগত লেখক, গবেষক, প্রকাশক, সাংবাদিক প্রায়ই উত্তর আমেরিকায় আসছেন। প্রতিবছর মুক্তধারা আয়োজিত বইমেলা হয়। বইমেলার সুবাদেও দেশের প্রখ্যাত মানুষদের সঙ্গে দেখা করার একটি ক্ষেত্র তৈরি হয়।
চিন্তাসূত্র: কর্মব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখির সুযোগ পান কেমন?
রওশন হাসান: কর্মব্যস্ততা জীবনের অংশ। ইচ্ছাশক্তি আপনাআপনিই তৈরি হয়। সহজাত বিষয়গুলো থেকে দূরে থাকার অর্থ নিজেকে আড়াল করা, সেটা সম্ভব নয়। তবে মাঝে মাঝে সময় বের করা কঠিন হয়ে পড়ে। এরমধ্য থেকেই সাহিত্যের মাঝে বিচরণ করছি, হৃদয়ের জানালায় যেতে সময়ের অভাববোধের কথা কখনো অনুভব করিনি।
চিন্তাসূত্র: দূরপ্রবাসে বসে দেশকে কেমন অনুভব করেন? হঠাৎ করেই দেশে ফেরার জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে কখনো? দেশের কথা মনে পড়লে কী করেন?
রওশন হাসান: জন্মগতভাবে দেশ আমার নিজস্ব পরিচয়। যে দেশেই থাকি না কেন আমি বাঙালি। বলতে পারি—Global in thought, Bangladeshi in heart. এটিই নীতিবোধ মনে করি। কবি, লেখক যেখানেই থাকেন না কেন, পারিপার্শ্বিক একটি প্রভাব লেখায় পড়ে। একটি আবহ তৈরি হয়। বাংলাদেশ ও প্রবাস দুটো আবহ মিলে নতুন সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। এটি বাংলাদেশে অবস্থান করেও হতে পারে। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, নিরাপত্তা ব্যবস্থা, যানজট এসব গুরতর সমস্যার কথা ভেবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই। দেশের উন্নতি কামনা করি। দেশে ফেরার জন্য তেমন তাগিদ অনুভব করি না প্রবাসে পরিবারের স্থায়িভাবে বসবাসের কারণে। তবে দেশের সঙ্গে সবসময় যোগাযোগ রয়েছে। মাঝে মাঝে আবেগতাড়িত হই। সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে বাংলা ভাষা ও ঐতিহ্যকে লালন করার মাধ্যমে দেশের প্রতি আত্মসংযোগ অনুভব করি। জন্মভুমির প্রতি দায়বদ্ধতা তো থাকবেই।
চিন্তাসূত্র: প্রবাসে সাহিত্যচর্চায় কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি পড়েছেন?
রওশন হাসান: যেকোনো নতুন সৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্ন ও প্রতিকূলতা তো থাকবেই। সমতা নিয়ন্ত্রণ করেই চলতে হবে, জীবনের কোনো পথই কণ্টকমুক্ত নয়। তবে প্রতিভা ও সাধনার জয় সর্বত্রই হয়। প্রতিকূলতার মাঝে থেকেও সৃষ্টিশীল কাজ এগিয়ে যায়।
চিন্তাসূত্র: সামনে বিজয় দিবস। এ সময় আপনি দেশের বাইরে। বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোর সময় বিদেশের মাটিতে বসে দেশকে কিভাবে উপলব্ধি-ধারণ করেন? দিবসগুলো পালন করেন কিভাবে?
রওশন হাসান: দেশের বাইরে থেকে বিজয় দিবসে কোনো আক্ষেপ হয় না, কারণ হচ্ছে বর্তমানে প্রবাসে বহু বাঙালি বসবাস করছেন। তারা একাধিক কমিউনিটি-অ্যাসোসিয়েসন পরিচালনা করছেন। বিজয় দিবসকে স্মরণ করে নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। নিউইয়র্কস্থ জাতিসংঘ এ উপলক্ষে বিশেষ কার্যক্রম হাতে নিয়ে থাকে। বাঙালিরা ভিনদেশিদের সঙ্গে মহা উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দিনটি উদযাপন করে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সমবেত হয়ে দিনটিকে, দেশকে বিশেষভাবে উপলব্ধি করি।
চিন্তাসূত্র: আগামী বইমেলায় আপনার কোনো বই আসবে?
রওশন হাসান: আগামী বইমেলায় দুটো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করার ইচ্ছে ছিল। আপাতত একশ কবিতা সংবলিত একটি কবিতার বই প্রকাশিত হচ্ছে সূচীপত্র থেকে। বইমেলার পরে আরও দুটো কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হবে আশা করছি।
চিন্তাসূত্র: দেশের সাহিত্যচর্চার নিয়মিত খোঁজ পান? কিভাবে দেখছেন এ সময়ের সাহিত্যচর্চা?
রওশন হাসান: ওয়েব পোর্টাল, সাহিত্যপাতা, ম্যাগাজি্ন, ওয়েবসাইট, ফেসবুক, ব্লগ—ইত্যাদির মাধ্যমে দেশের সাহিত্যচর্চার খবর নিয়মিত পাই। মুঠোফোন তো আছেই। সম্প্রতি অনেক নতুন লেখকের আবির্ভাব লক্ষ করছি। মানদণ্ডের বিচারক মননশীলতার অধিকারী পাঠক, লেখক ও বোদ্ধাজন। মানসম্মত লেখা টিকে থাকে, থাকবে, অন্যগুলো ঝরে পড়বে। তবে আশার কথা বাংলা সাহিত্য নিয়ে লেখালেখির পরিমাণ দেশে-বিদেশে উভয় স্থানেই বাড়ছে। দেশের সাহিত্য সম্পর্কে বলতে চাই, দেশের পত্রিকা বা ওয়েবের সাহিত্য পাতায় দেশে অবস্থানরত লেখকরা প্রাধান্য পেয়ে থাকেন। প্রবাসী লেখকদের ভালো লেখাও প্রাধান্য পাওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। প্রকাশকদের অধিক ক্রিয়াশীল, পেশাদার হতে হবে। শুধু ব্যবসায়িক লাভের কথা মাথায় না রেখে বইয়ের অতিরিক্ত কপি প্রিন্ট করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরি, বইয়ের দোকান, পাঠকের কাছে পৌঁছে দিতে আরও দায়িত্বশীল হতে হবে।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
রওশন হাসান: আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করতে হলে অন্য ভাষার চর্চা করতে হবে। বাংলার কৃষ্টি, ইতিহাসকে বিশ্ববাজারে পৌঁছে দিতে হলে ইংরেজিতে লেখা ও বাংলা থেকে ইংরেজিতে অনুবাদের সংখ্যা বাড়াতে হবে। মেইনস্ট্রিম সাহিত্য প্রতিষ্ঠান, লাইব্রেরিগুলোতে বাংলা ভাষার বইয়ের শাখা তৈরি করে সমসাময়িক, নতুন, পুরনো বইয়ের যোগান দেওয়া যেতে পারে। অনলাইনে বাংলা বইয়ের সহজলভ্যতা ও বিভিন্ন দেশে বাংলা বইয়ের দোকানের সংখ্যা বাড়াতে হবে। অনুমোদনসাপেক্ষে বিভিন্ন দেশে শুধু বাংলা বইয়ের স্বতন্ত্র একটি লাইব্রেরি খোলার কথা ভেবে দেখা যেতে পারে। বাংলা একাডেমি ও বাংলাদেশের অন্যান্য সাহিত্য প্রতিষ্ঠান, প্রকাশকরা এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করতে পারে।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন গল্প-উপন্যাস, প্রবন্ধ ও কবিতার মধ্যে কোন শাখাকে আপনার ঋদ্ধ মনে হয়?
রওশন হাসান: সাহিত্যের প্রতিটি শাখাই গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। কোনোটিকেই বেশি অথবা কম গুরুত্বপূর্ণ ভাবা ঠিক নয়। তবে কবিতার পাঠক সবসময়ই কম এটার কারণ হিসেবে বলা যায়, কবিতা বোঝার মতো বোদ্ধা পাঠকের অভাব। মৌলিক কবিতা লেখার প্রয়াস আমাকে বেশি উদ্দীপনা যোগায়। কোনো সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়ে বিষয়ভিত্তিক অনুচ্ছেদ, প্রবন্ধ লিখতেও স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। সমকালীন কবি আবু হাসান শাহরিয়ার, রহমান হেনরির কবিতাকে শক্তিশালী কবিতা বলে মনে করি। এঁদের কবিতায় নিজস্ব বৈশিষ্ট্য রয়েছে, newness, novelty রয়েছে।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার প্রত্যাশার কথা জানতে চাই।
রওশন হাসান: দশক গুনে গুনে কবি-সাহিত্যিকের মূল্যায়ন সর্বকালেই হয়ে এসেছে। উত্তরাধুনিক যুগেও লেখক তৈরি হচ্ছে। তবে উচ্চমানের লেখা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। প্রকাশনার গুণগত মান কমে যাচ্ছে। তাই বড় লেখক তৈরি হচ্ছে না। প্রতিভার সঠিক মুল্যায়ন হতে হবে, প্রীতিদুষ্টতাকে বর্জন করে প্রকৃত লেখককে স্বীকৃতি দিতে হবে। তবেই ভালো উপন্যাস, কবিতার বই আশাতীতভাবে বেড়ে যাবে। এতে এ প্রজন্মের পাঠক উপকৃত হবে নিঃসন্দেহে।