ফারুক আহমদের জন্ম ১৯৬৪ সালের ২২ জানুয়ারি, সিলেটের গোলাপগঞ্জ থানার গোয়াসপুর গ্রামে। রেডিও বাংলাদেশের গীতিকার ও নাট্যকার। রয়েছে সাহিত্য, সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা নিয়ে ডজনখানেক গ্রন্থ। ১৯৮৯ সাল থেকে লন্ডনে বসবাস করছেন। প্রবাসে সাহিত্যচর্চা ও বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তাসূত্রের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি।
চিন্তাসূত্র: দেশ থেকে অনেক দূরে আছেন। কত বছর ধরে আছেন প্রবাসে? কেমন লাগছে প্রবাসজীবন?
ফারুক আহমদ: বিলাতে আছি আজ প্রায় তিন দশকের কাছাকাছি। আপনার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে, ‘প্রবাস’ শব্দের একটি ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। যেমন, আমাদের পূর্বপুরুষের কাছে বাংলাদেশের বাইরের যেকোনো দেশই ছিল প্রবাস। তারা বিশেষ করে ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশে ছিলেন ‘সজান’ বা কর্মসূত্রে আসা মানুষ। একটা নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করে রুজি-রোজগার করে আবার দেশে ফিরে যেতেন, আবার আসতেন। কিন্তু কোনো দিনই তারা এ দেশগুলোকে ভুলেও নিজের দেশ মনে করেননি, করার কারণও ছিল না। এই ঐতিহ্য চলছিল ঊনিশ শ সত্তরের দশক পর্যন্ত।
কিন্তু আমরা সে ধরনের প্রবাসী নয় বা প্রবাসীজীবন যাপন করছি না। মোঘলরা যেমন ভারতে গিয়ে দেশটাকে আপন করে নিয়েছিল, অপ্রিয় হলেও সত্য যে, এখন আমরাও অনেকটা সেভাবেই বিলাতকে দেশ ভাবতে শুরু করেছি। আমাদের সন্তানদের কাছে তো এটা স্বদেশের মতো। বাংলাদেশ তাদের পূর্বপুরুষের দেশ। বাংলাদেশে তারা যায় বেড়াতে। এই সত্যকে মেনে নিয়ে আমিও বলতে চাই, আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের মতো বিলাতপ্রবাসী নই, বিলাতবাসী। ঠিক একইভাবে আমাদের উত্তরসূরিদের সংজ্ঞাও পরিবর্তিত হচ্ছে। তারা বাঙালি হলেও আমাদের মতো বাঙালি নয়, তারা—বাঙালি-ব্রিটিশ অথবা ব্রিটিশ-বাঙালি। কেমন লাগছে এর জবাবে বলব—‘আমি এক যাযাবর/ পরকে আপন করেছি আমি/ আপন করেছি পর’। সুতরাং ভালো লাগার চাইতে অন্তর পোড়ার মাত্রাটাই বেশি।
চিন্তাসূত্র: কর্মব্যস্ততার ফাঁকে লেখালেখির সুযোগ পান কেমন?
ফারুক আহমদ: আমার কাছে জীবনের আরেক নামই কর্ম। কার্মহীন জীবন তো জীনব নয়, জড়। সেই বাল্যকাল থেকেই আমি কাজ করতে পছন্দ করি। সেজন্য কর্মব্যস্ততার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করেই সুযোগটা বের করে নিতে চেষ্টা করি এবং নেই।
চিন্তাসূত্র: দূরপ্রবাসে বসে দেশকে কেমন অনুভব করেন? হঠাৎ করেই দেশে ফেরার জন্য প্রাণ কেঁদে ওঠে কখনো? দেশের কথা মনে পড়লে কী করেন?
ফারুক আহমদ: জন্মভূমি ভুলে থাকা কি কোনো মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব? গত প্রায় তিন দশকের মধ্যে হয়তো এমন কোনো দিন ছিল না যেদিন দেশের কথা মনে না আসেনি। এছাড়া, আমাদের মতো নবিস লেখকদের লেখার মূল চালিকাশক্তিই তো মা, মাটি আর মানুষ। তাই কোনো না কোনোভাবে প্রতিদিনই দেশ মাতৃকার কথা এসেই যায়। আর এখন তো ফেসবুক, টুইটার, ওয়াটসআপের মাধ্যমে প্রতিমুহূর্তেই বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আলাপ হচ্ছে। দেশের কথা মনে হলে অবশ্যই প্রাণ কেঁদে ওঠে। তখন প্রাণ খুলে বেসুরো কণ্ঠে কবিতা আবৃত্তি কার, গুনগুনিয়ে নিজের মতো করে গান গাই, তবে বেশির ভাগ সময়ই গানে প্রাণ জুড়াই।
চিন্তাসূত্র: প্রবাসে সাহিত্য চর্চায় কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি পড়েছেন?
ফারুক আহমদ: আমার লেখালেখির ক্ষেত্র হচ্ছে মননশীল সাহিত্য। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বলা যায়, এখানকার জীবন আমার লেখালেখির জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। যে সব বই বাংলাদেশে থাকার সময় আমার পক্ষে কেনা বা পড়া সম্ভব ছিল না, অথবা যে সব দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া ছিল প্রায় অসম্ভব, এখন ব্রিটিশ লাইব্রেরি, সোয়াস লাইব্রেরি ইত্যাদির বদৌলতে তা আমি পড়তে পারি। রূপসী বাংলা, সঙ্গীতা, গ্রন্থনীড় ইত্যাদি বুক শপগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশ ও ভারত থেকে প্রকাশিত গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো অতি সহজে সংগ্রহ করতে পেরেছি। তৃতীয়ত আমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান যে, এখানকার কয়েকজন প্রবীণ মারা যাওয়ার আগে তাদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ আমাকে দিয়ে গেছেন। তার ওপর রয়েছে আমার বন্ধুবান্ধবদের ব্যক্তিগত লাইব্রেরি। এ তো গেল একটি দিক। অন্যদিকে আমার স্ত্রী বিলাতে লেখাপড়া করে বড় হলেও সুখের কথা যে জিসিএসসি পর্যন্ত বাংলা পড়েছেন। আমার দ্বিতীয় বইটি তারই টাইপ করা। এদেশে আসার আগে আমি বাংলা টাইপ করা, কম্পিউটার চালানো ইত্যাদি জানতাম না। এখানে আসার পরে তার হাত ধরেই এগুলো শিখেছি। সেজন্য এখন পর্যন্ত আমার সাহিত্যচর্চায় বড় ধরনের কোনো প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়নি বা হচ্ছে না।
চিন্তাসূত্র: সামনে বিজয় দিবস। এ সময় আপনি দেশের বাইরে। বিজয় দিবসসহ জাতীয় দিবসগুলোর সময় বিদেশের মাটিতে বসে দেশকে কিভাবে উপলব্ধি-ধারণ করেন। দিবসগুলো পালন করবেন কিভাবে?
ফারুক আহমদ: আমি মুক্তিযুদ্ধে বিলাতবাসী বাঙালির অবদান নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছি। সেজন্য শুধু বিজয় দিবস নয়, যেকোনো জাতীয় দিবসের সময় তুলনামূলকভাবে একটু বেশি ব্যস্ত থাকি। তখন এখানকার পত্রপত্রিকার কাছ থেকে লেখা দেওয়ার তাগাদা আসে। টেলিভিশনগুলোর প্রতিনিধিরা আসেন অভিমত, সাক্ষাৎকার, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক ছবি, লিফলেট ইত্যাদির স্থিরচিত্র সংগ্রহের জন্য। দেশের মতো, এখানকার বিভিন্ন সংগঠন অনেক আগে থেকেই দিবসগুলো পালনের প্রস্তুতি নিয়ে থাকে এবং সে অনুষ্ঠানগুলোয় যাওয়ার জন্য অনুরোধ আসে। তখন মনে হয়, বিদেশে নয়, দেশেই আছি।
চিন্তাসূত্র: আগামী বইমেলায় আপনার কোনো বই আসবে?
ফারুক আহমদ: দুটো বই আসার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমটি ‘বিলাতে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি চর্চা’। এটি প্রকাশ করছে বাংলা একাডেমি, ঢাকা। দ্বিতীয় বইটি হচ্ছে ২০০২ সালে প্রকাশিত ‘বিলাতে বাংলা সংবাদপত্র ও সাংবাদিকতা’ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ। প্রকাশ করছে ইত্যাদি গ্রন্থ প্রকাশ, ঢাকা।
চিন্তাসূত্র: দেশের সাহিত্যচর্চার নিয়মিত খোঁজ পান? কিভাবে দেখছেন এ সময়ের সাহিত্যচর্চা?
ফারুক আহমদ: ইতঃপূর্বে দেশের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে জানার মাধ্যম ছিল বাংলা সংবাদপত্র। কিন্তু ২০১৪ সালে এখানকার বুকশপগুলো একে একে বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর থেকে আগের মতো নিয়মিত খোঁজ পাচ্ছি না। এক্ষেত্রে আমার ধারণা—তা সঠিক নাও হতে পারে। আগের চেয়ে, কথাসাহিত্য ও মননশীল সাহিত্যের চর্চা তুলনামূলকভাবে কম হচ্ছে। তবে যারা করছেন, তারা ভালোই করছেন।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যকে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে দিতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?
ফারুক আহমদ: এর একমাত্র পথ হচ্ছে অনুবাদ। এ কাজের জন্য বাংলা একাডেমির মতো আরেকটি প্রতিষ্ঠান, ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্টটিটিউট’ রয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানটি এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্টটিটিউট’-এর কাজটা কী? অর্থাৎ প্রতিষ্ঠানটি কী কাজ করছে, তা আমরা জানি না।
এখানে অপ্রাসঙ্গিক হলেও বলতে চাই, আমরা, বাংলা ভাষার সাহিত্য আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে কাঙ্ক্ষিতভাবে ছড়িয়ে দিতে না পারলেও বাঙালি-ব্রিটিশ, বাঙালি-আমেরিকান ও অস্ট্রেলিয়ানদের সাহিত্যকর্ম সে শূন্য স্থানটি পূরণ করছে বলেই আমার বিশ্বাস। এর ইতিহাস দীর্ঘ। আমি নীরোদ সি চৌধুরী, তপন রায় চৌধুরী, অমর্ত্য সেন, কেতকী কুশারি ডাইসন, গোলাম মুরশিদ, হিরন্ময় ভট্টাচার্য, আব্দুল গাফফার চৌধুরী প্রমুখ প্রবীণ বাঙালির কথা বাদ দিয়ে একেবারে সাম্প্রতিক যে উদাহরণগুলো দেওয়া যায়, সে তালিকার প্রথম নামটি হচ্ছে মনিকা আলী। বিশ শতকের শেষ দশক থেকে যে বাঙালি-ব্রিটিশরা ইংরেজি সাহিত্য করছেন, তাদের মধ্যে মনিকা আলী সবচে আলোচিত ও প্রশংসিত একটি নাম (এবং পূর্ব লন্ডনের সিলেটি বাঙালি সমাজের একটি অংশের কাছে সমালোচিত)। বাঙালি বাবা ও ইংরেজ মায়ের সন্তান মনিকা আলীর জন্ম বাংলাদেশে, বেড়ে ওঠা ইংল্যান্ডের বল্টনে এবং লেখাপড়া অক্সফোর্ডে। ২০০৩ সালে তার ‘ব্রিক লেইন’ উপন্যাসের পাণ্ডুলিপির ওপর ভিত্তি করে ইংরেজি সাহিত্যপত্রিকা গ্রান্টা তাকে ব্রিটেনের শ্রেষ্ঠ তরুণ ঔপন্যাসিক মনোনীত করে। ২০০৩ সালে প্রকাশিত হলে, উপন্যাসটি বিলাতে ‘ম্যান বুকার’ ও ‘হুইটব্রেড’ এবং আমেরিকার ‘ন্যাশনাল ক্রিটিক সার্কেল’ পুরস্কারের জন্য বাছাই-তালিকায় যায়। ২০০৭ সালে উপন্যাসটিকে নিয়ে নির্মিত হয়, ব্রিক লেইন চলচ্চিত্র। মনিকা আলী লিখিত অন্য বইগুলোর মধ্যে আছে—অ্যালেন্তেজো ব্লু (২০০৬), ইন দ্য কিচেন (২০০৯) ও আনটোল্ড স্টোরি (২০১১)।
তারপরই আসে জিয়া হায়দার রহমানের নাম। জিয়া ১৯৭১ সালের পরে, মাতাপিতার সঙ্গে লন্ডনে আসেন। অক্সফোর্ড, ক্যাম্ব্রিজ ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে, জিয়া প্রথমে ছিলেন একজন বিনিয়োগ ব্যাংকার হন; এরপর করপোরেট আইনজীবী, আরও পরে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার-বিষয়ক আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন। ২০১৪ সালে তার প্রথম উপন্যাস ইন দ্য লাইট অব হোয়াট উই নো প্রকাশিত হয়। উপন্যাসটি এখন পর্যন্ত ডাচ, হিব্রু, স্প্যানিশ, ফ্রেঞ্চ, জার্মান, বাংলা, পর্তুগিজসহ বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। এই উপন্যাসটির জন্য তিনি ২০১৫ সালে যুক্তরাজ্যের সবচে পুরনো ব্রিটিশ সাহিত্য পুরস্কার ‘জেমস টেইট ব্ল্যাক প্রাইজ’ লাভ করেন। অন্যদের মধ্যে আছেন, আইরিন জোবাইদা খান, মঞ্জু ইসলাম (সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম), তাহমিমা আনাম, সঞ্চিতা ইসলাম, মোহাম্মদ মাহবুব হোসেন (ইড হাসান), ফয়সল ইসলাম, রাবিনা খান, কেয়া আব্দুল্লাহ, শেলি সিলাস, রেখা ওয়াহিদ, শাহিদা রহমান প্রমুখ। বর্তমানে কানাডাবাসী কথাশিল্পী নিয়ামত ইমাম, তার বিখ্যাত উপন্যাস দ্য ব্লাক কোট লন্ডনে বসে লিখিছিলেন। উপন্যাসটি পেঙ্গুইন ২০১৩ সালে ভারতে এবং ২০১৫ সালে লন্ডনে প্রকাশ করে। এভাবে ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায় আরও অনেক বাঙালি আছেন যারা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের নামটাকে ধারণ করছেন, অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আপনার প্রত্যাশার কথা জানতে চাই।
ফারুক আহমদ: বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ অবশ্যই সম্ভাবনাময়। যে দেশে এখন প্রায় সতের থেকে আটারো কোটি বাঙালির বসবাস, সে দেশে বাংলা সাহিত্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করার কোনো কারণ নেই। যুগে যুগে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ কিংবা জীবনানন্দের মতো লেখক না জন্মালেও শামসুর রহমান, আল মাহমুদ, হুমায়ুন আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, হুমায়ুন আহমদের মতো লেখক তো আমরা পেযেছি। এখনো আমাদের হাসান আজিজুল হক, হেলাল হাফিজ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, প্রশান্ত মৃধা, ইমদাদুল হক মিলন প্রমুখ তো রয়েছেন।