মেহেদি আর হাসনাত রাতের খাবারের পর ফটকের বাইরে গিয়ে সিগারেট টেনে কিছুক্ষণ এদিকওদিক করে ফিরে আসার ব্যাপারটা এখন নৈমিত্তিক। আজও অনেকটা পথে হেঁটে শুষ্ক কণ্ঠে দুজনেই এসে ঢুকেছিল অতিথিশালায়। টেবিলের কাছে মেহেদি আগে পৌঁছে গিয়ে পাত্রে ঢালল জল। এগিয়ে দিলো হাসনাতের দিকে। হাসনাত এতোটা আশা করে নি। বিনয়বশত অসম্মতি জানালেও শেষমেষ তাকেই নিতে হলো। মেহেদিও জল পান শেষে বেরোবার উপক্রম করছে, এমন সময় বিছানার পাশের ছোট্ট টুলের ওপর রাখা একটা খাটো মোটা সবুজ বই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলো। চামড়ার সবুজ মলাটের ওপর সোনালী লতার কারুকাজ। আগ্রহী হয়ে এগিয়ে গেল কাছে। দেখল সোনালী লতা থেকে একটা নাম অজানা স্বর্গীয় ফুল উবু হয়ে বেরিয়ে পৃথিবীর হাওয়ায় সুবাস ছড়াতে চাইছে। নকশার মধ্যখানে ফাঁকা স্থান, সেখানে আরবি বর্ণমালার তীর ধনুক তরবারি দিয়ে লেখা আল কোরানুল কারিম। বইটার আকার এমন যেন হাতের এক বিঘতের ভেতর পুরোটা এঁটে যাবে।
পাশেই একটা খোলা ঝোলার ওপর ঝুঁকে আছে হাসনাত। ভাঁজে ভাঁজে বেনর করে আনছে কাপড়চোপড় সব। বইটা বোধয় তাবৎ পরিধেয়সমগ্রের একেবারে ওপরে কোথাও ছিল। অবশেষে পছন্দমতো একপ্রস্থ কাপড় আলাদা করে বাহুতে তুলে বিছানার ওপর আগেই রেখে দেওয়া পরিষ্কার সাদা তোয়ালেটা কাঁধে ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। মেহেদিকে তখনো লক্ষ করে ওঠেনি। ওভাবেই ঘুরে দাঁড়ালে স্নানঘরে ঢোকার মুখের বেসিনে জলছিটে পড়া আয়নায় পেছনের মানুষটির বিম্ব দেখে সে থেমে গেল। ততক্ষণে মেহেদিও বলে উঠেছে, কোরান শরিফ? কী সুন্দর! পড়ো তুমি?
হাসনাত হেসে কাঁধ দুটোয় একবার ঢেউ খেলিয়ে ঘুরে দাঁড়াল। বলল, বাসায় পড়তাম না। তবে এখন পড়ছি। হয়েছে কি; বলে খানিক বিরতি; বুঝি মনের ভেতর গুছিয়ে নিচ্ছে সঠিক এবং নিরাপদ শব্দনিচয়। যখন ব্যাগ গোছাচ্ছিলাম, তখন যেটা হলো, আম্মা এটা দিয়ে দিলেন ভেতরে। ছোটবেলায় যখন অতি ধর্মভীরু ছিলাম, আর টোপ পরা কোনো মানুষ দেখলেই আল্লা মনে হতো, তখন নাকি এই কোরান শরিফটা আমার প্রিয় ছিল খুব। সারাক্ষণ শুধু উল্টে পাল্টে দেখতাম। এটা আবার আমার নানার আনা আরব দেশ থেকে। আমার শৈশবে তিনি ভারতের বম্বে হয়ে জাহাজে চড়ে মক্কায় গিয়েছিলেন। আসার সময় আমার জন্য একটা লাল মাদুর, আর মায়ের জন্য এই কোরান শরিফটা এনেছিলেন। তো, বড় হওয়ার পর, আরো নানাবিধ বইপত্রের সঙ্গে পরিচয় ঘটায়, অজেয় কিছু মানুষের অসামান্য মেধার সংসর্গে আসায়; অবশ্যই বইয়ের মধ্য দিয়ে; যা হলো, আগের ওই অন্ধভক্তিটা গেল উবে। আর কোথাও ঘাটতি তৈরি হয়েছে টের পেয়েই আব্বা আম্মাও খুব ভয় পেয়ে গেলেন। স্বাভাবিক। আজীবন যে ধর্মীয় আদর্শে বড় হয়েছেন, বড় করেছেন; তো খুব চটলেনও। বলতে পারেন ওই ভয় আর চটে ওঠার কাঁটা গাছের সুন্দর একটা ফুল এটা, যেটা ফুটল। আম্মা ব্যাগে দিয়ে দিলেন, যেন পড়ি। তো ওটাই বলছিলাম; ভেতরের অনেকানেক ভাষ্য পরে আর আমাকে সন্তুষ্ট করতে পারে নি। এবং চারপাশের শেখানো নীতি রীতি অনুযায়ী বিনা প্রশ্নে জোর করে সন্তুষ্ট হতেও আমি পারিনি। তবু যখন পড়ি, এর শব্দের ঝঙ্কার আমার ভালো লাগে অস্বীকারের কোনো উপায় নেই। এই যে দেখি, বর্তমান সনাতন ধর্মাবলম্বিরা আজ দুটো মহাকাব্য রামায়ন আর মহাভারতকে রীতিমতো নিজেদের ধর্মগ্রন্থ করে তুলেছে। মুসলমানদের উচিৎ কোরানের ব্যাপারে উল্টোটা করা, অর্থাৎ কোরানকে কাব্য জ্ঞান করা; যদিও কোরানের ভেতরেই নিষেধ রয়েছে; আর এখানেই ব্যাপারটা আলোচ্য। কিন্তু তারপরও একান্তই আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে, এটাকে যদি লোকের মধ্যে সাহিত্যকৃতি হিসেবে দাঁড়িয়ে যেত এবং এখানে আসা সমস্ত বিবরণ ভাষ্যকে মানুষ যদি আক্ষরিকভাবে না নিয়ে রূপক হিসেবে নিতে পারতো, তা হলে সবকিছু অন্যরকম হতো। অনেক অন্যরকম হতো। বলতে, অনেক ভালো হতো। কারণ প্রেরণার জায়গাটাই যেত বদলে! তবে, এখনো রূপক হিসেবে নেয় বটে অনেকে, যেটুকু নিলে সুবিধা, যেটুকু নিলে ভেজাল টিকিয়ে রাখা যায়, ওইটুকুই শুধু নেয়। ওটা আরো কষ্টের।
চোখ দুটো বড় বড় করে দু হাত আত্মসমর্পণের মতো পরে তুলে দাঁতে দাঁত কেটে বিচিত্র ভঙ্গিতে হেসে উঠে হাসনাত বলল, সবসময়, সবসময় এক কথা বলতে গিয়ে চার কথা। মানে, নিজেই বিরক্ত। তো, এটা আপানার ভালো লেগেছে ভাই? আঙুল দিয়ে মেহেদির রাখা কোরানটা দেখিয়ে বলল। কণ্ঠে চাপল্য।
কথাগুলো মেহেদি ভালোভাবে নিচ্ছিল এমনটা কিন্তু মুখ দেখে তার ভাবা গেল না। বরং শেষদিকে কানদুটো খানিকটা লাল, আর চোখে একটা ছটফটে ভাব ফুটে উঠেছিল কর্তার। যেন শিগগির মুক্তি চায়। হাসনাতের কথা থামতেই সে হাসলো। বলতে, কানির্মিত হাসি। এতোক্ষণে বলা কথাগুলোর কোনোটির প্রত্যুত্তর না করে হাতের কোরানটাকে দেখিয়ে কেবল বলল, হ্যাঁ বেশ ভালো লেগেছে। আমারো আছে একটা। তবে ওটা আমার মা আমাকে দেয় নি। আমি নিজেই এনেছিলাম। শেষ কথাটার ওপর জোর খাটাল মেহেদি, যেন হাসনাতের কাছে ধর্ম বিষয়ে তার মনগত স্থানটি কিছুটা হলেও পরিষ্কার হয়ে যায়। আগের কথার খেই ধরেই আরো বলে গেল, ওটা অবশ্য তোমার এটার মতো এতো সুন্দর নয়। তবে পড়ে আরাম। এখানে তো বোধয় বর্ণমালা প্রায় চোখেই পড়বে না, এমন ছোট।
হাসনাত মাথা ওপরনিচ দোলালো দ্রুত। হ্যাঁ হ্যাঁ, বেশ ছোট। এক পায়ের বুড়ো আঙুলের নখে অপর পায়ের পাতা চুলকে বলে উঠল। তবে সব মিলিয়ে এটা আসলেই খুব সুন্দর। আপনি যদি পড়তে চান, নিতে পারেন কিন্তু।
না না, ঠিকাছে। বলে একবার হেসে আবার টুলের ওপর বইটা রেখে সোজা হয়ে দাঁড়াল মেহেদি। অনেক ধন্যবাদ হাসনাত, অন্তত বলার জন্য। কখনো ইচ্ছে হলে নেব। ঠিকাছে, তুমি গোসলে যাচ্ছিলে যাও। আমিও; হাতের পাতায় নিজ ঘর নির্দেশ করে; ঘরে ফিরে যাই। খানিক বিশ্রাম। এরপর একটা কিছু পড়তে পড়ে ঘুম।
ঠিক এ সময়ে ঘরে এলো জসিম। ওদের দিকে তাকিয়ে বলল, কী, কী নিয়ে কথা বলছ তোমরা?
হাসনাত কিছু না বলে হাসলো দেখে মেহেদি মুখ ঘুরিয়ে জসিমের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলো প্রশ্নের। এই আরকি। হাসনাত একটা কোরান শরিফ এনেছে। বেশ সুন্দর। দেখে বেশ ভালো লাগল আমার।
কি? ওকে কোরান শরিফ আনতে দেখে তোমার ভালো লেগেছে? জসিমের কণ্ঠে কৌতুক। একদিনো তো পড়তে শুনলাম না। দেখলামও না।
না জসিম ভাই, আপনি যা বুঝেছেন আমি আসলে ঠিক তা বলি নি। মেহেদির সাবধানী প্রত্যুত্তর। আমি বলেছি, কোরান শরিফটা এতো সুন্দর যে দেখে আমার বেশ ভালো লেগেছে।
জসিম জল পানের পর পাত্রটা নামিয়ে রেখে ভেজা ঠোঁটে বলল, ওই হলো তো। তার মানে ও যে পড়ার জন্য কোরান এনে পড়ছে টড়ছে না, লোক দেখিয়ে বেড়াচ্ছে, এটায় তোমার কোনো আপত্তি নেই! নয়ত আমার কথা নিলে না কেন। আমি বুঝতে পেরেছি আগেই তুমি কী বলেছ। কী মনে করো তুমি।
মেহেদি আর হাসনাত দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসলো। জসিম এখানে হাসার কোনো অর্থ করতে না পেরে চটে উঠল। নতুন ছেলেটার এমন স্পর্ধায় অবাক হয়ে গেল সে তৎক্ষণাৎ। একইসঙ্গে মেহেদিও যেন উসকে দিলো ব্যাপারটা। জসিমের আর সহ্য হলো না। একবার মেহেদির দিকে তাকিয়ে, তাকালো হাসনাতের দিকে। বলল, বেড়ালটা শুরুতেই মারা হয় নি এর বেলায়। আর ফলও পাওয়া যাচ্ছে হাতে নাতে। মুখে কপট স্মিত হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করল এরপর, তা, হাসির কী বলেছি আমি শুনি?
এ পর্যায়ে মেহেদি পরিবেশটাকে আরো ঘোরালো করে তুলল এই বলে, ঠিকাছে হাসনাত, আপনি গোসলে যান। জসিম ভাই, ঘরে যাচ্ছি আমি।
হাসনাত চট করে ঢুকে গেল স্নানঘরে। আর মুখ নামিয়ে জসিমকে অতিক্রম করার সময় মেহেদি শুনতে পেল, তুমি একটা নতুন ছেলের সামনে আমার সঙ্গে এমন করলে কেন? কেন বলো আমাকে। এতো বড় হয়েছ, তোমার তো বোঝা উচিৎ এসব। এই ছেলে এখন আর আমাকে মানবে?
ফিরে দাঁড়াল মেহেদি। জসিম ভাই, সবসময় আপনি এতো অদ্ভুত সব বিষয়ে ভাবনা করেন কী বলবো। কী বললাম, কী করলাম আপনার সঙ্গে? মেহেদির কণ্ঠে খানিকটা সংকোচ মেশানো অসহিষ্ণুতা। আমরা দেখুন, দুজনেই ভেবেছিলাম আপনি কথাটা মজা করে বলেছেন। অথচ পরে আপনার মুড দেখেই না টের পাওয়া গেল! আর সবসময় এতো ব্যতিব্যস্ত করে রাখেন আপনি যে নিজের আচরণের ওপরই নিয়ন্ত্রণ থাকে না, সত্যি। বলে মেহেদি পরিবেশ হালকা করার জন্য খানিক হাসলো। যোগ করল শেষে, আর আপনি এভাবে বরং ছেলেটাকে ভয় পাইয়ে দিলেন আজ। যদি কোনো ক্ষতি হয় তো এতে হয়েছে। আর কিছুতে না।
আমি এখানে মজা করে কিছু বলি নি। মুখটা মেহেদির আরো কাছে নিয়ে এসে বলল জসিম। তোমাদের মতো কোরান হাদিস নিয়ে কথায় কথায় মজা করি না। এসব বেয়াদবি হবে না আমাকে দিয়ে। শিখি নি আমি।
আপনি বিনা কারণে আমাকে এভাবে অপমান করে কথা বলছেন জসিম ভাই। মেহেদির প্রতিবাক্য। এ বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমি কোনো আলাপে যেতে চাই না। আর আপনাকে মানার কথা বলছেন তো? সলিল বুঝি আপনাকে খুব মানে? তার বেলায় তো বেড়াল মারা চেষ্টায় আপনার কোনো কমতি ছিল না। সলিলও মানে না আপনাকে। আপনার সারাক্ষণ চটে থাকা স্বভাবটার জন্য দূরে দূরে থাকে। শ্রদ্ধা আপনি হারিয়েছেন তার কাছে আরো আগেই। ওর মান্যতা আপনি আদায় করতে পারেন নি।
আর তোমাদের? তোমাদের কাছে শ্রদ্ধা হারাইনি? জসিমের কণ্ঠে আহত সাপের স্বর।
আমার আর পল্লবের সঙ্গে আপনার যখন পরিচয় তখন আপনি এমন ছিলেন না জসিম ভাই, মনে করে দেখুন। আপনার এই অদ্ভুত মনমানসিকতার উদ্ভব ঘটেছে ঠিক কখন, কিসের পর, এসব আপনার নিজেরই ভেবে বের করার বিষয়। এইসব আত্মউদঘাটনের ভেতর দিয়ে নিজেকে যেতে হয় জসিম ভাই। ধর্মগ্রন্থ পড়ে সব শেখা যায় না। নিজেকে পড়তে হয়, মানুষকে পড়তে হয়। মানুষ ভজতে হয়, তাহলে সোনার মানুষ হওয়া যায়। আপনি লালনের অঞ্চলের লোক জসিম ভাই। এসব আপনার অজানা থাকার কথা না।
ওসব নষ্ট বাউল ফকিরদের হিন্দুয়ানির কথা আমাকে শুনিয়ো না তুমি। হ্যাঁ, আমি ওদের দেশের মানুষ। ওদের সঙ্গেই বলতে গেলে আমার বেড়ে ওঠার সময় কেটেছে। সুতরাং ওদের ব্যাপারে তোমার চেয়ে আমার ভালো জানাশোনা আছে।
মেহেদি চলে যেতে যেতে বলল, কোনো দরকার ছিল না জসিম ভাই।
জসিম এ কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মেহেদির গমনপথের দিকে তাকিয়ে গাঁটের মতো দাঁড়িয়ে থাকল। এরপর তাকাল স্নানঘরের দিকে। কোনো জলপতনের শব্দ নেই কেন? ছোকরা নিশ্চয়ই সব শুনেছে এতোক্ষণ।
পরদিন সকাল পেরিয়ে দুপুর। কারখানা আজ বন্ধ। কিন্তু সকাল থেকেই ব্যস্ত সবাই। রবিকে দেখা গেল মহাব্যস্ত রূপে। চতুর্থ শ্রেণির আরো কর্মচারী যারা আছে, তারা কেউ প্রতিদিনের মতো অপরিচ্ছন্ন হয়ে থাকে নি। বেজায় ফিটফাট। এই ফিট অবস্থাটি বজায় রেখে দৌড় ঝাঁপে ওদের অসুবিধা কম নয়। তবু মুখে লাজুক হাসি ধরে রেখে তারা যতোটা পারা যায় প্রশমিত করতে চাইছে ক্ষতি। শার্টের গোঁজ খুলে যাবে বলে অনেককে দেখা গেল কুঁজো হয়ে কিছু তুলতে ভয় করছে। কাজ সামলে আবার গোঁজ সামলে নিয়ে ভুগছে সন্দেহে; বুঝি আগের মতো হয়নি। সাবধানে আলগে ধরে আনা নেওয়া চলছে তরলবহ পাত্রের, কিছু যেন ছলকে বা ছিটকে না পড়ে। আঁচড়ানো চুলের পাট যেন নষ্ট না হয়, মাথা সোজা করে চলছে সেই আনুপাতিক পরিচর্যা, থেকে থেকে।
অতিথিশালার পেছনে ঢং ঢাং শব্দে বিরাট সব ডেকচি আর ঢাকনি নিয়ে শব্দ তুলছে রাঁধুনেরা। দুটো তেলচিটে বাঁশের মধ্যখানে সমান্তরাল পাটের রশি বেঁধে আনা নেওয়া চলছে বড় বড় হাড়িকুড়ির। ভেতরে উপুড় লাল গোলাপি যতো মাংস, দুধসাদা সুগন্ধী চাল, ছোটোমুখো ঢাউস পাত্রের ডবডবানো তেল আর বড় বড় ঘিয়ের কৌটা। রান্না যারা করছে, কারো স্বাস্থ্যই বিশেষ ভালো নয়। কজন আছে তাদের ভয়ানক রোগা বলা চলে। লাল ইট সাজিয়ে কয়লা ঢেলে তৈরি চুলা। তার ওপর সশব্দে বুদবুদ তুলছে মশলাদার মাংস। বৃদ্ধ এক লোক শাবলের মতো আকারের এক খুন্তি দিয়ে মাংস নেড়ে দিচ্ছে; চেয়ালটা তার চুপসে ভেতরে চলে গেছে। লিকলিকে লম্বা দুটো হাত। ঘাড় বাহু উদর উরুর পেশিতে দারিদ্র্যের সাক্ষ্য স্পষ্ট। সেই সাক্ষ্য তার ছেঁড়া মলিন পোশাকেও। পাশেই পাকা পাটাতনের ওপর কোণভাঙা পাটি বিছিয়ে তাতে আসন পেতেছে পঞ্চাশোর্ধ স্থূলকায়া এক নারী। খোঁপার ওপর ঘোমটা তোলা। কোণে সুপারির গুঁড়া জমে থাকা পানখাওয়া লাল ঠোঁট থেকে কথার ঝরণা নামছে অবিরাম। তার জগৎসারাৎসারিক কথায় সাড়া দিচ্ছে না রাঁধুনেদের কেউ। মাথায় লাল গামছা বাঁধা মাঝবয়েসী এক লোক খানিক বাদে বিরক্ত মুখে সুগন্ধী চাল ফোটা ডেকচিটা তুলে তুলে দেখছে। লাল মাংস যখন শেষে পথে তখন পোলাও হয়ে এলো। ওই চুলা খালি হতেই এবার তাতে গোলাপি মাংস উঠল। আর লাল মাংসটা হয়ে যেতেই ওই খালি চুলায় চাপানো এক পোড়ো কালো কড়াই। কড়াইয়ের ধোঁয়া ওঠা তেলে ছাড়া হলো গরম মশলা। মুহূর্তে জায়গাটার বাতাস এতো ভারি হয়ে উঠল যে শ্বাস নেওয়াও হয়ে উঠল দায়। মুখ ঘুরিয়ে কমবেশি কাশতে শুরু করল সবাই। কাশির পর্যাপ্ত স্বাধীনতার জন্য কেউ কেউ বেশ খানিকটা সরে পূর্ব দিকে সীমানা দেয়ালটার কাছে চলে গেল। আর পাতা পাটির ওপর বসে থাকা মুখর নারীর কথায় পড়ল ছেদ। সেটা ক্ষণিকের যদিও। পরমুহূর্তে চেঁচিয়ে উঠল এই বলে, তোরা সবসময় আদকা এই কাজ করিস, ঝাঁঝ খাওয়াস আমাকে, জানিস যে সয় না, ছোট লোকগুলো। ইচ্ছা করে করিস, সব ইচ্ছা করে করিস। বলতে না বলতেই নাক কুঁচকে ঠোঁট দুটো গোলাটে করে যেন বাতাসে খাবি খেতে থাকল, এভাবে কাটল ক’মুহূর্ত। এরপর বিকট শব্দে হাঁচি। শেষ মুহূর্তে মুখ ঘুরিয়ে নেওয়ায় শ্লেষ্মার শত সহস্র বিন্দুর দাপুটে আক্রমণ থেকে অল্পের জন্য রেহাই পেল সালাদের জন্য কেটে রাখা শসা, গাজর আর পেঁয়াজ মরিচ; সামনে যতটুকু যা অবশিষ্ট ছিল। এক হাতের চেটো এরপর ঠোঁটের ওপর একবার বুলিয়ে এনে মুছে ফেলল শাড়িতে আঁকা গোলাপ ফুলের ওপর, উরুর কাছটায়। আবার মুখ খুলল কথা বলতে। কিন্তু থেমে যেতে হলো, আপাতত রসদ নেই। হাতের কাজ তার শেষ হয়েছে। হাতের কাজ আর মুখের বলা, এ দুটোই তার পরস্পরনির্ভরশীল। একটা ঘাটতি তো অপরটায় ছেদ। রাঁধুনেরা সবাই ফের এলো একে একে। জ্বাল দেওয়া ঝাঁঝমশলায় তেলের সাগরে হাবুডুবু খেয়ে বুড়বুড়ি তুলতে থাকল মোরগপাখির ছিন্নাংশ। আর অভাবি, নারোচ মানুষগুলো গরমের সঙ্গে আপস করে গলতে গলতে সিজলের ভেতর মেহনত করে চললো লাগাতার। মাঝে মাঝে দীর্ণ ছিন্ন শার্টের বোতাম খুলে ঢেউ তুলে ভেতরে হাওয়া খেলাতে থাকল ওরা। বড় ছোট নানা রকমের, রঙের ট্রান্সফর্মার আঁকা শক্তিমতির একটা মোটা বিজ্ঞাপনী কাগজ মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে বাতাস করতে থাকল ওই ঘর্মাক্ত নারী। হাত সচল রেখেই তৃষ্ণার্ত কবুতরের মতো মুখটা করতে থাকল কেবল এদিক ওদিক।
প্রকৌশলীরাও যার যার সেরা পোশাকটা পরেছে আজ। সাজসজ্জা নিয়ে তারাও কম ভাবিত নয়। তবে সেসব পর্যাপ্ত আড়াল নিয়ে চলল। মেহেদি প্রথমে ফতুয়া পরে বেরিয়েছিল। পরে হাসনাতকে মিহিন সবুজ পাঞ্জাবি পরতে দেখে খানিকটা প্রভাবিত হয়ে আরো কিছুক্ষণ ক্ষেপণ করে সময়, ঢুকল গিয়ে ঘরে। এরপর অজস্র ভাঁজসমেত চকচকে নীল পাঞ্জাবি পরে বেরিয়ে খুশি মনে যোগ দিলো অনুজের সঙ্গে। জসিম আর সৌরভ দুজনেই পরেছে ঢাকা থেকে বানিয়ে আনা দামি শার্ট, আর ইস্ত্রি করে করে চকচকে করে তোলা মসৃণ ভয়েল কাপড়ের প্যান্ট। সলিলকেও দেখা গেল সাদা পাঞ্জাবি পরে ছোট ফটকটা দিয়ে মাথা নিচু করে ঢুকছে। পেছনে পল্লব। পল্লবের পরনে নিত্য পরার নীল শার্ট, সবার কাছে চেনা। বিশেষ দিনকে পোশাকে স্বীকৃতি দিতে পল্লব কখনই রাজি নয়। ফটক দিয়ে ঢোকার পর অতিথিশালার রসুইঘর থেকে তাকে দেখতে পেল রবি। ফাঁক করে এসে লাজুক হেসে জিজ্ঞেস করল তাকে, স্যার আপনি শার্ট ভেতরে ঢোকাবেন করবেন না? পল্লব সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে রবির থুতনি ধরে আদরে নেড়ে দিয়ে পাল্টা বলল, আরে রবি, তোকে তো দারুণ লাগছে রে! লাল শার্ট, নীল জিন্স, একদম ঠাকুর বাড়ির বড়সাহেব প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর, রবি বাবুর বড় দাদা। সাবাশ! তোর ঈদের জামা বুঝি? রবি খুশি হয়ে ওপর নিচ মাথা দুলিয়ে দ্রুত আড়াল হয়ে গেল।
এসময় সলিল তার কাছে এসে ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, দ্বারকানাথ ঠাকুর কি এমন লাল শার্ট নীল জিন্স পরতেন? পল্লব বললো, বিন্দুমাত্র ধারণা নেই আমার!
একে একে তারেক, টিয়া, লাবু, মহাদেবসহ আরো যতো দ্বিতীয় ধারার প্রকৌশলী আছে, ভাঁড়াররক্ষী মকবুলসহ আরো যতো দপ্তরসহকারী আছে, সবাই একে একে চলে এলো।
সৌরভ ক্ষণে ক্ষণে দলছুট হয়ে মুঠোফোনে কথা বলছিল কারও সঙ্গে। কথা শেষ হতে সবার কাছে এসে মাথা দুলিয়ে জানিয়ে দিচ্ছিল, কত দূরে এখনো অতিথিরা। একসময় কানের পাশ থেকে ফোন নামিয়ে তৎপর হয়ে উঠল সৌরভ। এদিক ওদিক গিয়ে তদারক করতে থাকল দ্রুত, আর ঘন ঘন তাকাতে থাকল মুঠোফোনের দিকে। তার শরীরী ভাষা দেখে সবাই বুঝে গেল রাজধানীর কর্তাব্যক্তিরা বলতে গেলে চলেই এসেছেন।
বেশিক্ষণ আর অপেক্ষা করতে হলো না। কারখানার বিশাল নীল ফটকের সামনে খানিক বাদেই তিনটি চারটি দামি গাড়ি এসে থামল, আর একটা সাধারণ টেপ খাওয়া মাইক্রোবাস। সবার সামনের জিপটা জোরে হর্ন দিতেই দ্বাররক্ষী আলমগীর হুড়োতাড়া করে বড় ফটকের ছিটকিনি খুলে দিয়ে ভেতরে দিকে পাল্লা টেনে নিয়ে গেল একেবারে শেষাব্দি। কারখানার ভেতরে প্রবেশ করল গাড়িগুলো সব। ভেতরের সবাই তখন টানটান ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে। হাসনাত তার মাথাটা হেলিয়ে মেহেদির কানের কাছে নিয়ে বলল, ভাই, আপনার পাঞ্জাবির দলাই মলাই ভাব কেটে যাবে বলেছিলেন। কাটলো আর কই। তার আগেই তো সবাই চলে এলো।
আরে বাদ দও! মেহেদির ভাষ্য এলো ত্বরিৎ। শোনো, সদর দপ্তরের লোকজন আর তোমার বন্ধু ওই বিপণন প্রকৌশলীরা এমনিতেই কারখানার কামলা বলে ডাকে আমাদের, পাত্তা দিতে চায় না।
আলো আর ছবি ঠিকরে ফিরিয়ে দেওয়া গাড়িগুলোর দরজা খুলে একে একে বেরিয়ে এলো তিন পরিচালকসহ পর্ষদের কর্তা আরো দুই ব্যবস্থাপক। সঙ্গে ধারাল চার ঊর্ধ্বতন বিপণন প্রকৌশলী। সম্ভাষণ জানানো হলো তাদের। পেছনের মাইক্রোবাসের দরজা সশব্দে সরিয়ে ঝটপট নেমে এলো তরুণ বিপণন প্রকৌশলী থেকে শুরু করে প্রশাসন আর কোষাগারের কর্তারা। এদের প্রতি সম্ভাষণ আরো মৃদু। সবশেষে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা। চাপাচাপি করে এরা সবার পেছনে বসে ছিল। কোনো সম্ভাষণই জুটলো না এদের লটে। সমপদীরাও থাকল দূরে দূরে।
ঊর্ধ্বতন বিপণন প্রকৌশলীদের জমক দেখে কারখানার কর্মচারীদের মাথা ঘুরে গেল। তাদের সবার মুখে অভিজাত গাম্ভীর্য, চোখ পড়তেই দূরে ঠেলে, কিন্তু সম্ভ্রম জাগায়। দামি পরিধেয় জাগায় সমীহ। ওসব রাজধানীর অভিজাত পোশাক নির্মাতাদের হাতে শরীরের মাপ নিয়ে তৈরি। চোখে রোদচশমা, কালো কিংবা রুপালি। পায়ের জুতোর গল্প আলাদা করে করা চলে। কারো কালো জুতো আয়নাতুল্য, দিব্যি মুখ দেখা চলে। কারো জুতো বাংলার রুপালি পর্দার হিলহিলে খলনায়কদের মতো সাদা, দেখে ভয় জাগে। জবরদস্ত কোনো প্রাণির ছাল ছাড়িয়ে বানানো অভিজাত জুতোর ফিতে নেই, আছে বেল্ট। রুপালি বকলসে সূর্য কথা বলে। গটগটানো হণ্টন। কারখানার প্রকৌশলীদের ওরা দেখেও দেখল না।
নবীন বিপণন প্রকৌশলী যারা, একরকম ছুটে হাসনাতের কাছে এলো। সেও সবাইকে জড়িয়ে ধরে, হাত পা নেড়ে গল্প পেড়ে হেসে কেঁদে অস্থির। প্রশাসন, কোষাগার আর ক্রয় বিক্রয় বিভাগের কর্তারা পরিচালকদের চারপাশ ঘিরে বিনীতভাবে দাঁড়িয়ে থাকল। কথা না বলে আগে শুনতে চাইলো বড় কর্তারা কী নিয়ে কথা প্রথমে তোলেন।
ভাবছিলাম বৃষ্টিই না পেয়ে বসে, বলল পরিচালকদেরও যে মাথা, সে। বলিষ্ঠ তার শরীর। বুক টান দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে বয়স যা লেখা, মুখের গড়নে লেখা তার তিনগুণ। দামি স্যুট তার পরনে। ঝিকিয়ে ওঠা টাকের শেষ মাথায় যেটুকু চুল সেটুকুও বেশ পরিপাটি করে আঁচড়ে রাখা। ছাঁটটুকু পরিষ্কার। কোটের ভেতরের বুকপকেট থেকে সিগারেট রাখার রুপালি ধাতব বাকশো বের করে সৌরভের দিকে ফিরে বললো, ধরাতে পারি তো আপনার কারখানায়?
সৌরভ এক মুহূর্ত দ্বিধাবিভক্ত হয়ে থাকল। এ যে ভীষণ পরীক্ষা। কর্তা যে ঠিক কোন উত্তরটা চায় তা বোঝা মুশকিল। শেষে নড়ে উঠল সহাস্য। স্যার শুধু কৌতুক করেন। একশবার!
হঠাৎ করেই রোদ পড়ে গিয়ে চারপাশ ছায়ায় ঢেকে গেল। আর বাতাসও যেন শীতল হয়ে এলো একস্তর। পরিচালকদের অপর একজন বলল, এই তো, আমরা সঙ্গে করে বৃষ্টি নিয়ে এসেছি। আমাদের পেছনে পেছন বৃষ্টি চলছিল। এখানে তো গতিক দেখে মনে হচ্ছে ঝড় হতে পারে। প্রস্তুতি সব নেওয়া হয়েছে তো? কাজ টাজ?
একদম, স্যার। বিগলিত হয়ে বলল সৌরভ। সব শেষ! এই রান্না বান্না, গোছগাছ, সাফসুতরো।
ক্রয়বিভাগের এক কর্তা এসময় মাপা স্বরে বলল, দারুণ লাগছে। আমি বলবো গোটা বাংলায় এমন টিপটপ ফ্যাক্টরি আর একটাও নেই।
আশপাশের সবাই নিঃশব্দে হেসে ওপরনিচ মাথা দোলালো তার কথায়। তৃতীয় পরিচালক মুখ খুলল এরপর প্রথমবারের মতো। বয়সে তার প্রথম জনার মতোই। বলল, তো জনাব চেয়ারম্যান, চলো এগোনো যাক! এগোনোর অনুমতি দাও!
প্রথমজন হেসে দুহাত ঝেড়ে সামনে বাড়ল। আরে চলো চলো! কোথায় হবে মিটিং?
দপ্তরঘরে স্যার, সৌরভের চটপটে জবাব।
তাই? সবার জায়গা হবে?
হবে স্যার আশা করি। হিসেব করেই চেয়ার পেতেছি তো স্যার, হয়ে যাবে।
পরিচালক, প্রথম সারির প্রকৌশলী, প্রশাসন আর কোষাগারের পূর্বনির্ধারিত কর্তারা চলে গেল দপ্তরঘরে। বাকিরা কারখানার বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ল। ছোট ছোট দল পাকানো হলো। দিব্যি আলাপ চলতে থাকল তার ভেতর। কেউ সিগারেট ধরালো। কেউ ধোঁয়া থেকে বাঁচতে নাকমুখ কুঁচকে হলো কপট দলছুট। বিরাট বিপুল যন্ত্রপাতিগুলো সভয়ে ধরে দেখতে থাকল কেউ কেউ। কেউ আবার এই করতে গিয়ে হাতে তেলচিটে কালি লাগিয়ে কোথায় মোছা যায় তাই খুঁজতে লেগে গেল। ওদিকে আলাপিদের ভেতর চলল থাকল কণ্ঠের কৌতুকময় ওঠানামা। একটা উপদলে রসিকতার শ্লেষ্মায় পা পিছলে একে অপরের ওপর গড়িয়ে পড়তে থাকল প্রগলভ কর্তা কর্মীরা। মুখে বিব্রত হাসি নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকল এক তরুণী। পরনের পোশাকের মূল্য জ্ঞান করা কঠিন, তবে পরিমিত রুচির স্বাক্ষর তাতে আছে। কথাবর্তাতেও সুশিক্ষার স্পষ্ট ছাপ। এর আগে থেকে থেকে একটা দুটো কথা যখনই বা বলছিল, চুপ করে শুনছিল সবাই।
আমি কি ভুল কিছু বলেছি? তরুণীর কণ্ঠে অনুযোগ। ফ্যাক্টরির হৃৎপি- হলো এখানকার প্রকৌশলীরা। আর গোটা প্রতিষ্ঠানের প্রাণ হলো বিপণন প্রকৌশলী। আর আমি আপনি আমরা হলাম অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যা আছে। এ কথায় কৌতুক করার কিছু নেই। একটা গোটা ব্যবস্থা সবসময় সবার ওপর নির্ভরশীল থাকে, শরীর যেমন। কী ভাই। তবে শরীরের হাত পা কাটা পড়লে সে তখনই মারা পড়ে না। মারা পড়া বলতে আমরা যদি প্রাণ চলে যাওয়াকে বুঝি। মাথাটা কাটা পড়লে, হৃদপি-টা থেমে গেলে শরীর মারা পড়ে। কিন্ত বাকিসবও দেহের পূর্ণাঙ্গতার জন্য খুবই জরুরি।
তরুণী এই পর্যন্ত বলে আরো কিছু বলার মতো কথা খুঁজতে থাকল। আর ওদিকে চাপা হাসিটা আবারো ফেনিয়ে উঠতে থাকল অন্যদর মধ্যে। ক্রয় বিভাগের একজন বলল, ম্যাডাম, বরাবরই ইঞ্জনিয়ারদের ওপর আপনার পক্ষপাত। কারণটা কি বলবেন?
এ কথায় সবাই একসঙ্গে হেসে উঠল আবার। অপর একজন বলল, এখানে আমাদের অন্তত একটা দুটো হলেও সুখ্যাতি করুন না ম্যাডাম, মনের দুঃখ মেটাই। এখানে তো প্রাণ, আত্মা, হৃৎপি- কেউই এখন উপস্থিত নেই। সবাই ওপরওয়ালার কাছে। এখন আমাদের কথা কিছু বলুন!
লঘু কথার নদে হেসে হেসে সাঁতার কেটে চলল সবাই। সময় গড়াতে থাকল। ওপরে দপ্তরে চলতে থাকল ঘোরালো বৈঠক। এদিকে রাঁধুনেরা সব গুছিয়ে নিয়ে খাবার আপ্যায়ন শুরু করার অপেক্ষায় এক জায়গায় জড়ো হয়ে গল্প জুড়ে দিয়েছে। সংখ্যায় ওরা জনা দশেক। থেকে থেকে ছোট ছোট দলগুলোর ওপর চোখ বোলাচ্ছে ওরা। ফিরে ফিরে দেখছে সুবেশি যতো কর্তা আর সুদর্শনা তরুণীটিকে। কারো চোখে প্রশংসা। চুল থেকে নখাদি দেথে নিচ্ছে সব। কারো চোখে স্পষ্ট বিরাগ। আগুন আছড়ে পড়ছে শরীরের এখানে ওখানে।
এসময় বাইরে নক শুনে উঠে দাঁড়িয়ে রুপালি হাতঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে, ঘেমে নাক ধরে নেমে আসা চশমাটা আরো খানিকটা ওপরে তুলে পকেট গেটটা খুলে দিলো আলমগীর। একজন দুজন করে আসতে শুরু করেছে শ্রমিকরা। বাতাসে খাবারের গন্ধ পেয়ে কানাকানি।
কিছুক্ষণ বাদে ফটক গলে ভেতরে এসে ঢুকলো বিভিন্ন গড়নের জনা পাঁচেক লোক। এর আগে পাচকদের কাছে টেপগলা কালিতলা হাড়িকুড়ি পৌঁছে দেওয়ার কালে কারখানার উত্তর পাশের ওই টানা করিডোর ঘেঁষে ওরা স্তূপ করে রেখে গিয়েছিল কাঠের টেবিলের দশটা ডিম্বাকৃতির পাটাতন, টেবিল পাতার ধাতব কাঠামো, আর প্লাস্টিকের লাল সবুজ একশ চেয়ার। পাটাতনগুলোর পাশেই দাঁড় করিয়ে রাখা ওই কাঠামোগুলো। তাদের পেছনে একটার খাঁজে আরেকটাকে বসিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে লাল সবুজ চেয়ারের উঁচু উঁচু চারটি টিলা। পাঁচজনা এসে ঝুঁকে লাগালো পাকা হাত। একে একে সবই স্তূপ দশা থেকে মুক্তি পেল। পাতা হয়ে গেল সব পরিপাটি। সব শেষে সাদা থান কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হলো মলিন টেবিলগুলো। সাজিয়ে রাখার পর দেখা গেল কিছু চেয়ার ভাঙা পড়েছে। দেখে কথায় কথায় একে অপরকে দুষতে দুষতে বাড়তি চেয়ারের স্তূপ থেকে আরো চেয়ার নামিয়ে নিয়ে বদলে দিলো।
এরইমধ্যে শেষ হলো বৈঠক। দপ্তরঘর থেকে পায়ে পায়ে নেমে এলো সবাই। শুরু হলো ভোজ। কুটুম্বিতার ভার পড়েছে কারখানার প্রকৌশলীদের ওপর। তারা প্রসন্ন মুখে বেড়ে দিতে থাকল খাবার, এক টেবিল থেকে আরেক টেবিলে যেতে থাকল, যেন ভীষণ ব্যস্ত। কাউকে পরিবেশন করে ধন্যবাদ পেল ঢের, কেউ আবার ধন্যবাদ দেওয়া দূরে থাক, তাদের দিকে ফিরেও তাকালো না। শুধু ঝোলটা বেশি পড়ে গেলে হাত তুলে থামতে বলল। অথবা সালাদ প্রয়োজন হলে আঙুল তুলে দেখাল দূরের বোলটা।
পাচক দল আর সাজসজ্জার লোকেরাও এক কোণে বসে খেলো। একবার শেষ হতেই আরেকবার চেয়ে নিয়ে প্রাণ ভরে খেতে থাকলো শ্রমিকরা। শূন্য পেটের দাবি মিটেছে অনেক আগেই। শূন্য প্রাণের দাবি মেটাতে গিয়ে ঘর্মাক্ত। পরিচালকদের খাওয়ার পাট চুকে গেছে, কিন্তুওসব টেবিলে খাবারের আনা নেওয়া চলছে দেদার। দেখে নিজেদের ভেতর একবার কথা বলে তিন পরিচালক এগোলো টেবিলগুলোর দিকে।
এই, তোমাদের খাওয়া হচ্ছে তো ঠিকমতো? একদিকে ঘাড় হেলিয়ে বলল ইউসুফ, পরিচালকদের ভেতর জ্যেষ্ঠ জন, পতিতকেশ। হাতে অভয়মুদ্রা, সহাস্য। পেছনে চোখে একই প্রশ্ন ধরে রেখে সহাস্য দাঁড়িয়ে মামুন, কনিষ্ঠ, পক্বকেশ। কনিষ্ঠতম মারুফ, পক্বকেশ সেও, অগ্রজ দুজনকে ছাড়িয়ে আরো খানিকটা এগোল।
শ্রমিকদের খাওয়া গেল থেমে। সঙ্কোচে গুটিয়ে গেল সবাই একরকম। শরীরের মতো গুটিয়ে গেছে কণ্ঠনালীও বুঝি। কারো গলা দিয়ে উত্তরের কোনো স্বর বেরোল না বেশ খানিকটা সময়। মারুফ প্রথম টেবিলের কাছে গিয়ে বয়েসী একজনার পিঠে হাত রেখে বলল, কী জসিম? খাচ্ছো তো ঠিকমতো?
এবার যোগাযোগ স্থাপনের শেষ ফাঁকটুকু বুঝি হলো বন্ধ। মুখ নড়ল ওদের। জসিম বলল, জি স্যার। খাচ্ছি। মুখ তার তৃপ্তির হাসিতে ভরে গেছে। সবার সামনে সে আলাদাভাবে সম্মানিত হয়েছে।
আরো ক’জনের নাম উঠল এরপর। কী আসাদ? নরেন? মিহির?
জি স্যার, খাচ্ছি। খুব ভালো লাগছে।
খুব মজা হয়েছে স্যার।
জি স্যার, খুব মজা হয়েছে।
খাচ্ছি স্যার ঠিক মতোই, অনেক স্বাদ।
এরপর উত্তরের মহড়া চলতে থাকল। কারো দিকে তাকালেই সেও বলে উঠতে থাকল।
স্যার, আপনারা ঠিকমতো; কমবয়েসী একজন বাক্যটা শুরু করেও শেষ করতে পারল না সঙ্কোচে। ক’মুহূর্তের নীরবতা ঝুলে থাকল বাতাসে। উভয়পক্ষেই অপেক্ষা। অবশেষে মামুন খানিকটা সামনে ঝুঁকে অসমাপ্ত প্রশ্নকর্তার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ, আমরাও খেয়েছি সবাই। ঠিকমতোই।
জড়তার বরফ গেছে গেলে। পরিচালকেরা ঘুরে দাঁড়ালে আবার ফিরে এলো আগের পরিবেশ। খেতে শুরু করল সবাই, সানুরাগ, সশব্দ।
সলিল মেহেদিকে কাছে ডেকে বলল, ওই মেয়েটা আপনার দিকে তাকাচ্ছে থেকে থেকে।
শুনে মেহেদির মুখ লাল হয়ে উঠল। বলেছে! বলে উঠল তখনই। আপনার দিকে তাকাচ্ছে। সেই কখন থেকে দেখছি।
ওই মেয়ে তাকাচ্ছে কি নাতাকাচ্ছে তার চেয়ে বড় কথা তোমরা নিয়ম করেই তাকাচ্ছ ওর দিকে, বলে উঠল পল্লব। ঠোঁটে কৌতুক। ওর চোখ কোনদিকে যায় না যায় সেদিকে পর্যন্ত চোখ। ছিহ। তোমরা না বিবাহিত পুরুষ? ছি ছি। আমি এখনো বিয়ে করিনি। এসব তো বরং আমার বলার কথা!
ব্যাস, তিন জনের কথাতেই একটা বিষয় বেশ প্রমাণিত, বলল সলিল।
কী?
কী সেটা?
লয়েড সাহেব কবরে শুয়ে হাসছেন।
মানে কী?
মানে হলো, মেয়েটা হয়ত সচেতনভাবে আমাদের দিকে একবারো তাকিয়েছে কি তাকায়নি, সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিতও নই। কিন্তু এটা নিশ্চিত যে ওই একটি মেয়ের প্রতি আমরা খুব উৎসুক, তার দিকে আমরা সবাই ভীষণ আগ্রহে তাকিয়ে আছি। বাড়ি থেকে দূরে, শহর সমাজ থেকে দূরে এই আমাদের চোখে কিন্তু এমন শহুরে সুবেশী মেয়ে পড়েনি অনেক’দিন। তাই ভেতরে ভেতরে আমাদের মন একটু সামাজিকতার জন্য, স্বাভাবিকতার জন্য, সুন্দরের পূজাটা দেওয়ার জন্য কেমন অস্থির হয়ে ছিল। বলল সলিল।
হয়েছে! হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিলো পল্লব। তুললে লয়েডের কথা। ব্যাখ্যা করলে পুরন্দর ঠাকুরের মতো। আর মেয়েদের কাছে যাও না বলছ অনেক’দিন। মেয়েদের মাত করার মতো ক্ষমতা তো কথায় একেবারে অটুট!
পল্লবের কথার সুরটাই ধরল মেহেদি। মানে একদম! আমিও তাই বলি। যাক, এখন যা বলেছ, কথা কিন্তু সত্য। অস্বীকারের উপায় নেই। শুধু চেয়ারম্যান যে কী চায়, তাই বুঝতে পারলাম না। আর কত খাটব! আমি যদ্দূর জানি; হাসনাতও বলল; বিপণন প্রকৌশলীরাও প্রাণান্ত করছে! তাহলে লোক না বাড়িয়ে এই দিয়েই তিনি কী আশা করছেন, পরিষ্কার না আমার কাছে। মাথায় ঢুকছে না। তবে মনে হলো প্রতিষ্ঠানের ভেতরকার কথা তিনি কমই জানেন। কমবয়েসীজন তার ভেতর পোকা ঢুকিয়েছে।
সলিল চুপ করে থাকল। পল্লব বলল, চলো বাইরে। সিগারেটের জন্য বুক হাহাকার করছে। এসব আলাপ এখানে নয়।
সন্ধ্যায় দুপুরের পাচক দলের দুজন এলো ফটকে। হাড়ি বহন করার বাঁশ দুটো ফেলে গেছে ওরা ভুল করে। দরজা খুলে দেওয়া হলো। ভেতরে ঢুকল ওরা। দুজনেই বয়েসে তরুণ। চোখে মুখে একটা অপরাধী, সঙ্কুচিত হাবভাব। একে অপরের দিকে তাকিয়ে কেমন কুণ্ঠাভরে ক্রমে অতিথিশালার পেছনে হারিয়ে গেল। প্রহরী রোস্তমের পালা তখন চলছে। অপর সান্ধ্য প্রহরী কাশেম গেছে বিয়োগঘরে। সুতরাং ফাঁকা ফটক রেখে সরতে পারল না রোস্তম। খানিক বাদেই মধ্যখানে দড়ির যোগ এমন দুটো তেলতেলে বাঁশের দণ্ড ওরা বয়ে নিয়ে এলো। রোস্তমকে লম্বা সালাম ঠুকে প্রসন্ন করে দিয়ে অন্ধকারে গেল হারিয়ে।
চলবে…
কারখানার বাঁশি: পর্ব-২০॥ হামিম কামাল