মাল লাগবো স্যার? কোনটা লাগবো কোন। ইনবারসিটি, কলেজ, ইস্কুল না মক্তব?
মক্তব! শব্দটা শুনে হৃদয় যতটা মোচড় দিয়ে উঠলো তার চে বেশি জিজ্ঞাসু দৃষ্টি নিয়ে তার দিকে তাকাই। রাজধানীর বেশিরভাগ আবাসিক হোটেলেই রুম নেওয়ার পর রাতে কিংবা সকালে হউক, হোটেলবয় এসে দরজায় ঠোকা দেবেই। চোখ ওপরের দিকে তুলে, ঠোঁট বেঁকিয়ে এ রকম প্রশ্ন করবে এটা আমার কাছে নতুন কোনো বিষয় নয়। একটি জাতীয় দৈনিকের জেলা প্রতিনিধি এবং টুকটাক ব্যবসার সুবাদে প্রায়ই ঢাকায় আসাতে হয়। আর আসা-যাওয়া করতে গিয়ে এই অভিজ্ঞতা বহুদিনের। তাই হোটেল বয়দের এ রকম আচরণে মোটেও বিচলিত হই না। তবে মক্তব শব্দটা শুনে অন্তরকোঠায় বেশ ধাক্কা লাগলো। নিজে নিজে ভাবতে থাকি, খদ্দের আকৃষ্ট করতে তাদের এই এহেন পন্থা কতটা ন্যাক্কারজনক! আমাকে নীরব দেখে ছেলেটা ফাল্গুন মাসের বরই ফাটানো হাসি হেসে আবার বলে, কী স্যার, লাগবো? আমি তার হাসি মিলিয়ে যাওয়ার আগে তার কাছে জানতে চাই—মেয়েটা যে মক্তবে পড়ে তুমি জানলে কী করে? অ আচ্ছা এইডা? আগে পড়তো এখন পড়ে না। তাইলে তুমি যে বললে। সে এক বিরাট হিস্টোরি স্যার। তয় হুনেন, মেয়েটার মুখেই হুনছি হে নাকি মক্তবে পড়ত। আর ওই মক্তবের হুজুর (!) নাকি… একলা পাইয়া ভিসা লাগাই দিছে।
ছেলেটার ভেতর থেকে কথাগুলো এমনভাবে আসছিল যেন হুজুর নয় সে-ই মেয়েটার সব লুটেপুটে নিয়েছে। আর এ সবের বিবরণ আমার কাছে দিয়ে যাচ্ছে। আমি কথাগুলো শুনে রাগে ঘৃণায় ফুসে উঠছিলাম। তারপরও কোনোমতে নিজেকে সামলে তাকে কিছু বকশিম এবং মাল নেওয়ার লোভ দেখিয়ে জিজ্ঞেস করি,
আচ্ছা, মেয়েটি তোমাদের এখানে আসল কিভাবে?
সব কিছুতো স্যার বলতে পারব না। তয় হুনছি, হেই মেয়েটার সব কিছু জানাজানি হওয়ার পর, মেয়েটির পরিবারকে একঘইরা করা হয়। হের বাবায় রাস্তা দিয়া চলাফেরা করতে পারত না। রাস্তা দিয়া তাগো ঘরের কেউ বাইর হইলেই, চুকরা পুলাপাইন থাইক্কা শুরু কইরা দাঁড়িয়ালা বেডারাও কিরম আজে-বাজে কতা কইতো। হের মুখে হুনছি, তার বাপেরে নাকি গেরামের বাজারে বাজার করতে দেওয়া হইতো না। তারপরও নাকি হেরা জোঁকের মতো গেরামের মাটি কামড়াইয়া ওখানে থাকতে চাইছিলো। কিন্তু গেরামের মেম্বরের পোলার উৎপাতে গেরাম ছাড়তে না দিশ পাইছে। মেম্বারের পোলা নাকি হেরে উদান-মাদান ডিস্টার্ব করত।
হো, গেরামে থাকা যখন তাদের সম্ভব হইলো না। তখন হেরা তেজগাঁও বস্তিতে আইসা ওঠে। সেখানে খাইয়া না খাইয়া যখন তাদের দিন যাইতেছিল, হেই সময় আমগো হোটেলের বশির ভাই, তারে একটা অফিসে চাকরি দেওনের কতা কইয়া এখানে জয়েন করায়া দিছে।
তুমি তার সম্পর্কে এত কিছু জানো?
জানব না মানে! আমরা একঘরে থাকি না? আর একঘরে থাকলে একজন আরেক জনের সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে হয়। আমরা তো আর বড় লোক না যে, পোলা কোন দিকে যায়, মাইয়া কোন দিকে যায়, বউ কোন দিকে যায় হের খবর রাখতে পারব না।
বাহ, বড়োলোকেরা উদাসীন হয় সেই খবরও তুমি রাখো?
তোয়! বড়োলোকের পোলারা এদ্দুর এদ্দুর আসে (হাত দিয়ে ইশরা করে)। দাঁড়ি, মুছ ওঠার আগেই এখানে আসি মৌজ-মাস্তি কইরা যায়।
আচ্ছা তুমি না বললে তোমরা একঘরে থাকো।
হো, গেরামে থাকা যখন তাদের সম্ভব হইলো না। তখন হেরা তেজগাঁও বস্তিতে আইসা ওঠে। সেখানে খাইয়া না খাইয়া যখন তাদের দিন যাইতেছিল, হেই সময় আমগো হোটেলের বশির ভাই, তারে একটা অফিসে চাকরি দেওনের কতা কইয়া এখানে জয়েন করায়া দিছে।
মুহূর্তেই আমার ভাবনাজগতে ছেদ পরে। মেয়েটির বাবা-মা হয়তো জানেই না তার মেয়ে কোন অফিসে চাকরি করে টাকা নিয়ে যায়। আর সংসার চালায়।
তাহলে তোমাদের বশির ভাইকে তো পুলিশে দেওয়া উচিত।
কোনো লাভ নাই। এলাকার নেতা-পাতি নেতা থাইক্কা শুরু কইরা এমপি-মন্ত্রীগো লগে হের হট কানেকশন। পুলিশের কাছ থাইকা ছুইটা আসা হের এক থুরির কাজ।
ছেলেটি এতোক্ষণ কথা বলে হয়তো বিরক্ত হয়ে গেছে। তাই কথার মাঝে একটু ঝাঁঝ টেনে বলে স্যারের লগে কি এতক্ষণ বেহুদা প্যাছাল পারছি? যাইবেন না?
আমি এক রকম বোকার মতো প্রতিউত্তর করলাম কোথায়?
ক্যান মাল নিবেন না?
অ আচ্ছা মাল, হ্যাঁ হ্যাঁ চলো।
আমার ভেতরে কোনো রকম পরিবর্তন হচ্ছে বলে মনে হলো না। কিন্তু মেয়েটিকে দেখার এক অদম্য কৌতূহল আমাকে পেয়ে বসল। হয়তো নিজে সাংবাদিক বলেই মেয়েটির আসল রহস্য উদ্ঘাটনের ঝোঁক মাথায় চেপে বসে। হোটেলবয় আমাকে একটা সুদৃশ্য রুমে নিয়ে যায়। রুমটি সম্পূর্ণ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। একটি বিশাল আকৃতির এলসিডি টিভি, সুদৃশ্য ড্রেসিং টেবিল। অনেকগুলো চেয়ার এবং প্রায়টাতেই বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা বসে আছে। কেউবা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে সাজুগুজু করছে। বিশাল বক্সখাটে শুয়ে আছে আরও কিছু মেয়ে। তাদের কারও গায়ে ওড়না আছে তো বুকের একপাশে ফালানো। কারও বুক উদাম। বুকের সকল সৌকর্য উদাম করতে ওরা যে যার মতো ব্যস্ত। কেউ পরেছে জিন্সের সাথে টি-শার্ট। কেউ স্কার্টের সাথে টি-শার্ট। যেন টি-শার্ট ছিদ্র করে ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসতে চায় পাকা ডালিমগুলো। যেগুলো তার মালিকের হাত লাগা মাত্র ফেটে পড়বে। আর রসের বৃষ্টি নামবে সারাটা রুম জুড়ে। যেই বৃষ্টির পানিতে সাঁতার কাটবে জোয়ান মরদেরা। কেউ কেউ নিতম্ব নাড়িয়ে পুরুষালী ভঙিতে সিগারেটে টান দিয়ে বাহির থেকে আসা খদ্দের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছে। ভেতরে থাকা তাদের দালালের মুখে সিগারেটের ধূয়া ছুঁড়ে দিচ্ছে। আর দালালও দুষ্টামির ছলে মেয়েটির স্পর্শকাতর জায়গা চেপে দিচ্ছে। মাঝে মাঝে দুচারটা মেয়ে গুনগুনিয়ে গান ধরছে ফুলেরও বাগানে ফুটিলো ফুলরে, রসিক ভ্রমর আইলো না। ফুলের মধু খাইলো না। একজন আরেকজনের উদ্দেশে অশ্লীল মন্তব্য ছুঁড়ে দিচ্ছে।
কি রে তোর লাটিমের ব্যথা সারছে? হয় ব্যথা সারছে, কিন্তু বুড়িগঙ্গার পানি ছলাৎ ছলাৎ করতেছে। সেখানে ডুব দেওয়ার লোক পাইতেছি না। কেনো গো বান্ধবী আমি আছিনা। পেচন থেকে একটা মোটাসোটা লোক এসে মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরল। আমি ঠিকই বুঝতে পারি লোকটি হয়তো তাদের বশির ভাইয়ের মতো কোনো দালাল। হয়তো তাদের বশির ভাই।
কী হইলো স্যার, ঝিম মাইরা রইলেন যে? মাল চয়েস করেন।
অ হ্যা।
এই দেখেন স্যার, ওই মালটা।
আমি ঠিকমতো দেখতে না পেলে আমাকে তার শরীরের সাথে মিশিয়ে বলে,
আরে স্যার ওই যে লাল গেঞ্জি আর জিন্স পরা, ওরে দিবো? হে কিন্তু ইনবারসিটিতে পড়ে। এর রেইট বেশি।
আমারও কেন জানি বিশ্বাস হলো। মেয়েটার শারীরিক গড়নের সাথে শিক্ষার যে একটা যোগসাজস রয়েছে, তা মেয়েটার গোটা অবয়ব জুড়ে প্রকাশমান। আমাকে নিশ্চুপ দেখে ছেলেটি বলল…
বুঝতে পারছি আরও ডিগা মাল চান? এইটা নিশ্চিত আপনার পছন্দ হইবো। এই দেখেন, বলে একটি মেয়ে আমার ওপর এনে একরকম ছুঁড়ে মারে। এইটে পড়ে স্যার। মাত্র তিন দিন হলো আমাদের ওখানে আইছে। এক্কেরে ফেরেশ মাল স্যার। বুক দেকছেন, বুক? মালেশিয়ান মাল্টার মতো না স্যার? আর ঠোঁট! আল্লারে আল্লা, এক্কেরে কানি বকের বুকের মতো না স্যার ?
বুচ্ছি স্যার হবে না? এই দেখেন, কালো ফতোয়া পরা ওই মেয়েটা বলে সে আমাকে একটা মেয়ের দিকে ইশারা করে এবার মাত্র কলেজে গেছে। এর রেইটও পেরায় সমান।
এবারও আমি নিশ্চুপ।
বুঝতে পারছি আরও ডিগা মাল চান? এইটা নিশ্চিত আপনার পছন্দ হইবো। এই দেখেন, বলে একটি মেয়ে আমার ওপর এনে একরকম ছুঁড়ে মারে। এইটে পড়ে স্যার। মাত্র তিন দিন হলো আমাদের ওখানে আইছে। এক্কেরে ফেরেশ মাল স্যার। বুক দেকছেন, বুক? মালেশিয়ান মাল্টার মতো না স্যার? আর ঠোঁট! আল্লারে আল্লা, এক্কেরে কানি বকের বুকের মতো না স্যার ?
আমি তার এই বর্ণনায় একটু অবাক হলাম। একজন প্রস্টিটিউটের দালালের মুখে এ রকম কাব্যিক বর্ণনায় যে কারও মাথা ধরার কথা। আমি তার কথা শুনছি আর সতর্ক চোখ দুটি এদিক ওদিক নাড়াচ্ছি। আমার চোখের গতি এবার সে বুঝতে পারে। আমাকে চমকে দিয়ে সে বলে,
এই দেখেন স্যার, আপনি এতক্ষণ ধরে যারে খুঁজতেছেন
আমি মনে মনে তার বুদ্ধির প্রশংসা করি। আমি প্রথমে মেয়েটিকে না দেখলেও ছেলেটি তাকে ডেকে নিয়ে আসে।
স্যার ওর কথাই আপনারে কইছিলাম। ওর নাম পেয়ারা।
আমি শুধু একবার মেয়িটির দিকে তাকাই। তাতে আমার চিন্তার জগতে শক্ত উষ্টা খায়। মেয়েটির থেকে আমি চোখ সরাতে পারি না। তার নাম যে রকম পেয়ারা। শারীরিক গড়নও বাত্তিক পেয়ারার মতো। যেন আমাদের পাড়ার মোতালেব চাচার বাগানের সৈয়দি হফ্রি। মেয়েটির বুকের দিকে চোখ যেতেই আমার শরীরে ফসিনা বইতে শুরু করে। আমার শারীরিক উত্তেজনা মুহূর্তেই চরম আকার ধারণ করে। আমি ভুলে যাই মেয়েটির বুকে কত সাপ-বিচ্ছু ছোবল মেরেছে। তার শরীরে যে এক বিষের নদী প্রবাহিত তা যেন আমার হুঁশের বাইরে চলে যায়। কচি শশার মতো তার অঙ্গসৌষ্টব দেখে আমার ভেতরের পশুটা দাবড়াদাবড়ি শুরু করে। আর নিজের মনেই প্রশ্ন করি, তাহলে প্রতিটা মানুষই নিজের ভেতর পশু লালন করে? উত্তরও পেয়ে যাই—হ্যাঁ। এই পশুটাকে সবাই অধীনস্ত করতে পারে না। পশুর অধীন হয়ে যায়। পশু হয়ে যায়। যে রকম হয়েছে ও মেয়েটির হুজুর…
ছেলেটি পেয়ারাকে ডেকে আমার পাশে দাঁড়াতে বলে। মেয়েটিও তাই করে। আমার একেবারে গা-ছোঁয়া হয়ে দাঁড়ায়।
হুন, আমার স্যার। তার সাথে উল্টা-পাল্টা করবি না। যতক্ষণ চায় থাকবি, যেভাবে চায়…
আমি ছেলেটিকে থামিয়ে বললাম…
হয়েছে তোমাকে আর কিচ্ছু বলতে হবে না।
তারপর ছেলেটি আমাকে একটি পরিপাটি রুমে নিয়ে যায়। মেয়েটিও আমাদের ফলো করল। রুমে প্রবেশ করার পর ছেলেটি বলল, আমি যাই স্যার, আর এই অস্ত্র কটা নেন। লাগলে আরও দেওয়া যাইব। আমিও নাবালক শিশুর মতো ঘাঢ় কাত করে দিই। ঘটনার আকস্মকিতায় আমি কিছুটা অপ্রস্তুত আবার হয়তো উত্তেজনারও একটা ব্যাপার থাকতে পারে।
হুন, স্যার রে খুশি করতে পারলে ভালো বকশিস আছে কইলাম।
মেয়েটি কোনো কিছু না বলে হাতের ছোট পার্সটা খাটের ওপর ছুঁড়ে মারে, আমার দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দরজা আটকায়।
দাঁড়িয়ে রইলেন ক্যান্, আসেন।
এতক্ষণে মেয়েটি প্রায় বিবস্ত্র। এই মুহূর্তে তাকে ভোরের শিশিরে ভেজা লাউয়ের ডগার মতো কোমল আর নবজাতকের মতো নিষ্পাপ মনে হচ্ছে। কী রকম এক অদ্ভূত স্নিগ্ধতায় ছেয়ে গেছে তার চুলের রাশি। আর বাতাসে ছড়াচ্ছে সানসিল্ক মার্কা ঘ্রাণ। যার সুবাশ নিতে কতো ভ্রমর যে দালানের আশে-পাশে ঘোরাঘুরি করে তার ইয়ত্তা নেই। অথচ এই মেয়েটার নিঃশ্বাসে যে রকম আগুনের লুক্কা বেরুচ্ছে তা দিয়ে ওই মক্তবের হুজুরসহ যাবতীয় লুচ্ছা হুজুরদের জ্বালানো সম্ভব। মেয়েটি প্রায় অধর্য্য হয়ে আমাকে বলে…
মেয়েটি খাটের ওপর শুয়ে আমাকে ডাকে। আমি ধীর পায়ে তার কাছে যাই। খাটে বসি। সে আমার হাত ধরে টান দেয়। আমি এক রকম হুমড়ি খেয়ে তার ওপর পড়ি। সে বুকের ওপর থেকে ওড়না সরিয়ে নেয় এবং একপর্যায়ে তার জামা একটানে খুলে নেয়। আমাকে কোনো কিছু করতে কিংবা ঝুঝতে দেওয়ার আগেই সে তার শরীরের ওপরের অংশ উদাম করে ফেলে। সাথে সাথে ভেতর থেকে বেড়িয়ে আসে এক জোড়া কবুতর ছানা। আমি মিলির সাথে কম্পেয়ার করতে যাই। মিলি, আমার স্ত্রী। তিনটা সন্তানকে বেড়ে তুলতে গিয়ে মিলির বুক আজ চাল কুমড়ার মতো হয়ে গেছে। ঝুলে একেবারে পেট পর্যন্ত চলে এসেছে প্রায়। এ নিয়ে আমার কোনো শোক-উত্তাপ নেই। তবে তাকে নিয়ে যখন কোথাও বের হই, তখন মদনা কিসিমের কিছু পুরুষ তার বুকের দিকে তাকিয়ে থাকে। আর জিবের লালা ঝরায়। মিলিও তা উপভোগ করে। আমি একটু বিরক্তবোধ করলেও মিলির দুষ্টহাসির কাছে নাই হয়ে যাই।
এতক্ষণে মেয়েটি প্রায় বিবস্ত্র। এই মুহূর্তে তাকে ভোরের শিশিরে ভেজা লাউয়ের ডগার মতো কোমল আর নবজাতকের মতো নিষ্পাপ মনে হচ্ছে। কী রকম এক অদ্ভূত স্নিগ্ধতায় ছেয়ে গেছে তার চুলের রাশি। আর বাতাসে ছড়াচ্ছে সানসিল্ক মার্কা ঘ্রাণ। যার সুবাশ নিতে কতো ভ্রমর যে দালানের আশে-পাশে ঘোরাঘুরি করে তার ইয়ত্তা নেই। অথচ এই মেয়েটার নিঃশ্বাসে যে রকম আগুনের লুক্কা বেরুচ্ছে তা দিয়ে ওই মক্তবের হুজুরসহ যাবতীয় লুচ্ছা হুজুরদের জ্বালানো সম্ভব। মেয়েটি প্রায় অধর্য্য হয়ে আমাকে বলে…
কী হলো, তাড়াতাড়ি করেন। আমি কিন্তু বেশিক্ষণ থাকতে পারুম না।
আমি একটা জিনিস প্রত্যক্ষ করলাম। মেয়েটি এতক্ষণ যাবৎ আমার সামনে আছে অথচ একটি বারও তার মুখে হাসি দেখিনি। আমি তার কাছে একটা জিনিস জানার জন্য পারমিশান চাই।
আচ্ছা, ওই হুজুর তোমার গায়ে হাত দিয়েছিল কেন?
আপনে এখানে আসছেন কেন?
আমি তোমাকে টাকা দিয়ে চাইতেছি।
আমার ইজ্জতের দাম এই কটা টাকা?
আমি তার কথার উত্তর দিতে পারি না। শুধু বলি, তাহলে তুমি এখানে আসছ কেন?
হয়তো মক্তবের ওই হুজুরের লালসার শিকার হয়ে, নয়তো আপনাদের মতো লম্পট পুরুষদের শারীরিক ক্ষুধা মিটাইতে।
সে আমাকে লম্পট বলায় যতটা না রাগ করেছি, তার চে এতটুকু মেয়ের গোছালো কথায় বিস্মিতো হয়েছি। আসলে পরিস্থিতি তাকে এরকম কথা বলতে শিখিয়েছে। আমি তাকে আর কিছু বলতে না দিয়ে শুধু বলি, আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি এখন যাও।
আপনি রাগ করেছেন?
না
প্লিজ রাগ করবেন না। আসেন, আপনি যেভাবে চাইবেন আমি সেভাবে দেব।
বললাম তো ওসব লাগবে না। তুমি যাও। ছেলেটাকে পাঠিয়ে দিও।
আমার ভুল হয়ে গেছে। আসেন আপনি যতক্ষণ চান, আমি ততক্ষণ থাকব। প্লিজ ওর কাছে কিছু বলবেন না। তাহলে আমার এখানে কাজ করা হবে না। বাবা-মা ভাই-বোন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।
না না, ওরে কিছু বলব না। তুমি নিশ্চিন্তে যেতে পারো।
মেয়েটি চলে যায়। একটু পরে ছেলেটি আসে।
কী হলো স্যার এত তাড়াতাড়ি ছাইড়া দিলেন যে? কোনো বেয়াদবি করছে?
না না, ওসব করে নাই।
তাইলে চলেন স্যার, এইমাত্র একটা মাল উঠছে। এক্কেরে ঠাসা মাল। অবশ্য ভাবী। তয় কি অইছে, শরীর ভাঙে নাই। স্বামী বিদেশ থাকে। মাঝে-মধ্যে সুযোগ পাইলে আমাদের ওখানে আসে। বিজিট কম। ভাবী তো! এর লাইগ্যা।
আমি—কিছু লাগবে না বলে তার হাতে বকশিস স্বরূপ একশো টাকা এবং মেয়েটির পেমেন্ট ধরিয়ে কোনোমতে এখান থেকে পালিয়ে আসি। কিন্তু তাতে কী, একটি সেকেন্ডের জন্যও মেয়েটি এবং মেয়েটির যন্ত্রণাগ্রস্ত জীবনের কথা ভুলতে পারছি না।
তেরো দিন পর…
আমার স্ত্রী আমাকে ভাত খেতে ডাকে। আমি তার জবাবে বলি আসছি পেয়ারা। আমি নিজেই তখন চমকে উঠি। ভাগ্যিস আমার স্ত্রী শুনতে পায়নি। তা নাহলে কি কেলেঙ্কারিটাই না হতো! এরকম ভুল সম্প্রতি আমি প্রায়ই করছি। দেখা গেল ফলের দোকানে গিয়ে আপেল হাতে নিয়ে বলছি ভাই পেয়ারার দাম কত? দোকানি হেসে বলছে, ভাই হাতে নিলেন আপেল দাম জিগান পেয়ারার!
আমি বুঝতে পারি না পেয়ারার মধ্যে কী এমন আছে, যা আমার পে তাকে ভোলা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। অথচ তার সাথে আমার এমন কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি যা স্মৃতি হিসেবে আমার মানসপটে দোলা দিতে পারে। আর এতটুকু মেয়ের প্রতি আমার এমন ভাবনা জাগাটাও সমীচীন নয়। তারপরও কী এক আচানক টান যেনো আমাকে বারবার পেয়ারার মাঝে নিয়ে যায়। ধ্বংস করে বিবেক-বুদ্ধির চৌকাঠ। নীরবে তার প্রতি ভালোলাগা উসকে দেয়। পুরোনো দিনের ছায়ছবির মতো পেয়ারার মুখখানি যখন আমার অন্তর কোঠায় ভাসে, তখন আমাকে অস্থির করে তোলে। মাথাকাটা শিংমাছের মতো ছটফট করি। অথচ তার চোখে আমি এক অস্পষ্ট কথার ঝিলিক দেখতে পেয়েছিলাম। না বলা সেই কথাগোখরো তাকে বারবার দংশন করছে। আর বিষের যাতনায় সে নীল হচ্ছে, হলুদ হচ্ছে, কিন্তু কেউই তাকে উদ্ধার করতে আসছে না। নিজের প্রতি তাই আমার গোসসা বেড়ে যায়। কেন সেদিন মেয়েটির না বলা সব কথা ওর মুখে শুনে আসলাম না। ওর চোখের ভীরুতাই সেদিন বলেছিল সে আমাকে কিছু বলতে চায়। তার ভেতরে লুকায়িত হাবিয়া দোযখের কাহিনি। আমি মনে মনে প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, খুব শিগগিরই পেয়ারার সাথে দেখা করব। শুনে আসব তার না বলা কথা।
তিন দিন পর…
বাস শা-শা করে চলছে রাজধানী ঢাকার উদ্দেশে। আমার মন পাল্লা দিয়ে দৌড়ায় পেয়ারার সান্নিধ্যের আশায়। সেদিন তার গা ছুঁয়েছি কেবল। আজ পরখ করব তার লবণ্য। গোসল দেব তার মধুসায়রে। এসব ভাবতে গিয়ে বারবার এক্সাইটেড হচ্ছি। এই শীতেও বগলের নিচে বিন্দু বিন্দু ঘাম অনুভব করছি। হঠাৎ মনের ভেতর কে একজন বলে উঠল মিয়া সামছু, তুমি পেয়ারার শারীরিক উষ্ণতা নিতে যাইতেছ? পেয়ারার বুক তোমার ভালো লেগেছে? মক্তবের হুজুরেরও তো ভালো লেগেছিল।
আষাঢ়ের বজ্রপাতের মতো আমার ভেতরে এক ঝলক দিয়ে উঠে। সেটা পরিবর্তনের। আমার সকল কাম-তৃষ্ণা পলকেই উবে যায়। আর তার প্রতি গভীর মমতার জন্ম হয়। যেখানে সে কেবল একটি পাখাহীন মুনিয়া পাখি। আমি কেবল তাকে প্রাণভরে আদর-যত্ন করে যাই। বিন্দুমাত্র অবহেলা হতে দেই না তার অস্থিত্বের। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নেই। আমি ঢাকা যাব ঠিকই। তবে পেয়ারাকে দূর থেকে দেখে চলে আসব। ওর সামনে যাব না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওকে এই নরক থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করব। তার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে যত রকম সহযোগিতার প্রয়োজন আমি নেপথ্যে থেকে তা করে যাব।
মূলত তাদের কথাগুলো রাষ্ট্রের মাথারা আমলে নিচ্ছেন না। ধ্যুত্তরি, আমি কিসব ভাবছি। নিজের মনে নিজেই হেসে উঠি। নিজে এবার পত্রিকার পাথায় মনোনিবেশ করি।
বাস এসে একটা স্টেশনে থামলে হকারের কাছ থেকে একটি পত্রিকা কিনি। ভোরবেলা দৈনিক পত্রিকা পড়ার মঝাই আলাদা। যদিও জানি পত্রিকা খুললেই ছিনতাই, রাহাজানি, লুটপাট, খুন, ধর্ষণ, গুম এসব খবরই সর্বাগ্রে থাকবে। তখন মনে হতেপারে এসবই আমাদের দেশের প্রধান খবর। আর এই খবরগুলো যদি একটা দেশের দৈনিক পত্রিকার সিংহভাগ জুড়ে থাকে, তখন ওই দেশ বিশ্বে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ না হয়ে কি সোনার দেশ হিসেবে গণ্য হবে? দেশে এত সরকারি আমলা-কামলা, পাতিনেতা-বড়নেতা, এমপি-মন্ত্রী থাকতে দেশের সংবাদপত্র কিংবা সংবাদ মাধ্যমকে একটা নির্দিষ্ট নীতিমালায় পৌঁছানো গেল না। আমি জানি আমার মতো ছাপোষা মানুষের এই ভাবনায় জগত সংসারে কিছু যায় আসে না। দেশে এত বড়োবড়ো বুদ্ধিজীবী থাকতে কে আমলে নেবে আমার কথা? এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা টিভিতে টকশোর নামে মেধার অপচয় করে যাচ্ছেন। কাজের কাজ কিচ্ছু হচ্ছে না। মূলত তাদের কথাগুলো রাষ্ট্রের মাথারা আমলে নিচ্ছেন না। ধ্যুত্তরি, আমি কিসব ভাবছি। নিজের মনে নিজেই হেসে উঠি। নিজে এবার পত্রিকার পাথায় মনোনিবেশ করি। একটা শিরোনামে এসে আমার চোখ আটকে যায়। ‘রাজধানীর একটি আবাসিক হোটেল থেকে তরুণীর লাশ উদ্ধার।’ আমি বিস্তারিত সংবাদ পড়তে যাই। সেখানে মেয়েটির নাম এবং হোটেলের নাম দেখে আমি চমকে উঠি। বুকের ভেতর শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি ধীরে ধীরে ভারী হয়ে আসতে থাকে। মুখ দিয়ে কথা বের করতে কষ্ট হয়। এক বোবা আর্তনাদে চেয়ে যায় আমার গোটা অস্তিত্ব। চোখের সামনে ভাসতে থাকে পেয়ারার সদ্যতরুণী খেতাবপ্রাপ্ত মুখখানি। আমি ভাবতে থাকি, যে পেয়ারার সচল মুখ দেখতে আমি যাচ্ছিলাম। সেই পেয়ারর নিথর চেহারা আমি দেখব কী করে? আমি কি যাব শত বেদনায় কিষ্ট হওয়া মুখখানি দেখতে? বাসের গতি আর আমার ভেতরের হাপিত্যেশ মিলে এক অদ্ভুত আওয়াজ তৈরি করে। যেন চাকভর্তি মধুপাহারায় মগ্ন, একঝাঁক মৌমাছি স্বভাবসুলব গুঞ্জরণ করেই যাচ্ছে…