সব জল্পনা-কল্পনা শেষে ডুবের পর্দা উঠেছে। জানা-অজানা অনেক প্রশ্নের উত্তর মিলেছে দর্শকদের। তাই দুই-চারটি কথা না বললেই নয়। মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর ‘ডুব’ নিয়ে গত একবছরের গুজব ডুব দিলো নাকি আরও প্রগাঢ় হলো তার হিসাব-নিকাশ পরে করা যাবে। প্রথমেই বলতে হচ্ছে, ‘ডুব’ চলচ্চিত্রটি সচরাচর ধারার কোনো বাংলা চলচ্চিত্র নয়। এটি ফারুকীর গবেষণার ফল। চিত্রনাট্যে, ক্যামেরায় দৃশ্যধারণে ও সংলাপে ডুব একদম ব্যতিক্রম ধারার ছবি। এই ছবিতে মাছি কিংবা বিড়ালও রক্ষা পায়নি অভিনয় করা থেকে। এ সময়ের বাংলা চলচ্চিত্রে এ রকমটি দেখা পাওয়া ভার।
ডুবের কাহিনীতে চমকপ্রদ কিছু খুঁজে পাওয়া মুশকিল। এ যেন আমাদের অতিপরিচিত একটি কাহিনীর চলচ্চিত্রায়ণ। যারা হুমায়ূন আহমেদের জীবন সম্পর্কে সিকি পরিমাণ জানেন, তারাও চলচ্চিত্রটি দেখার সময় এই লেখকের উপস্থিতি টের পাবেন। হুমায়ূনকে মন থেকে মুছে ফেলে জাভেদ হাসান চরিত্রকে কল্পনা করা অসম্ভব। কারণ, শুধু হুমায়ূন আহমেদ নয়, তার পরিবার ও পারিপার্শ্বিক চরিত্রগুলো কল্পনার ছলে গভীরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এখানে। শুধু চরিত্রের নামের পরিবর্তন কিংবা কাল্পনিক দৃশ্যপটের উপস্থিতি তাকে চলচ্চিত্রটি থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। তাই, একথা একবাক্য স্বীকার করে নেওয়া ভালো, ‘ডুব’ হুমায়ূন আহমেদের জীবনের নির্যাস; তার জীবনের ছায়া অবলম্বনে রচিত ডুবের চিত্রনাট্য।
সিনেমার শুরুতেই দেখা গেছে এক বিষাদগ্রস্ত চলচ্চিত্র পরিচালক জাভেদ হাসানের উপস্থিতি। একসময়ের টগবগে যুবক জীবন সংগ্রামে বিপর্যস্ত হয়ে উদাসীন জীবন-যাপন করতে থাকে। তার জীবনের উদাসীনতার ছাপ যখন তার পরিবার জীবনে পড়তে থাকে তখনি সূচনা হয় নানা সূক্ষ্ণ সমস্যার। তার প্রভাবে সে বিচ্ছিন্ন হতে থাকে তার জীবন থেকে, তবু কি সে পারে বিচ্ছিন্ন হতে? না, পারে না। তাই তো তার স্মৃতিবিজড়িত সংসার ছেড়ে আরেক সংসারে গেলেও সে তৃপ্ত হতে পারে না। তার প্রথম সংসারকে একসময় সে দূরে ঠেলে দিতে বাধ্য হয়। তবু দূরে ঠেলে দেওয়া হয় না। প্রথম সংসারের পরিবারের সদস্যরাও নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। তাদের জীবন সংগ্রামের মাঝেও বেঁচে থাকে জাভেদ হাসান।
দ্বিতীয় স্ত্রী নিতুকে নিয়ে জাভেদ হাসান সুখী না অসুখী, সেটি তার জীবনে প্রশ্ন হয়ে ওঠেনি। শুধু একজন উদাসীন জনপ্রিয় চলচ্চিত্রশিল্পীর জীবনের দহন মুখ্য হয়ে উঠেছে।
ডুবকে পরিমাপ করতে বাজারে প্রচলিত দাঁড়িপাল্লা ব্যবহার করলে আপনি নিরাশ হবেন। কারণ এই ছবিটি পরিমাপ করতে হবে শিল্পের সূক্ষ্ণ নিক্তি দিয়ে। ধরুন, আমাদের দেশে কোনো হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন না। কিংবা ছবিটির চরিত্রগুলোর সঙ্গে আমরা কোনোকালেই পরিচিত ছিলাম না, তাহলে আমাদের কাছে কী মনে হবে? মনে হবে চরিত্রগুলো আমাদের জন্য নতুন এক জগৎ সৃষ্টি করে দিয়েছে। এবার বিবেচনা করুন চলচ্চিত্রটিকে। কী মনে হচ্ছে? অবশ্যই এখন আপনি চলচ্চিত্রটিতে গভীর জীবনবোধ খুঁজে পাবেন। ডুবের দৃশ্যধারণের ধীরগতি ও ছোটগল্পের মতো আকারের জন্য অনেকে হা-হুতাশ করতে পারেন, এটাই স্বাভাবিক। ডুবে নিমজ্জিত হওয়ার সক্ষমতা সবার নেই।
যে বিষাদসঙ্গীত ডুবে ধ্বনিত হয়েছে, তা মসৃণ নয়, জীবনের মতোই খর্বাকার। তবে প্রশ্ন একটা থেকে যায়, সেটা হচ্ছে ডুবে ডুবেছে কে? একজন জাভেদ হাসান? একটি পরিবার? একটি জাতি? একজন সাবেরি? একজন নিতু? আসলে ডুবে কতগুলো মানুষ ডুব দিয়েছে, তাদের জীবনের বাস্তবতায়। শুধু তারা কেন, প্রতিটি মানুষের জীবনই ডুব দেয়। হয়তো কেউ স্বেচ্ছায় ডুব দেয়, কেউ দ্বৈব-ইচ্ছায়। ডুব আমাদের দিতেই হয়। সেই ডুবে কে ডুববে, কে ভাসবে, এটি কোনো প্রশ্ন নয়।
ডুবের অভিনয়শিল্পীদের কথা যদি বলতে হয়, তাহলে একথা মেনে নিতে হবে, প্রত্যেক অভিনয়শিল্পী এতে যথাযথভাবে অভিনয় করেছেন। এক্ষেত্রে জাভেদ হাসান চরিত্রে ইরফান খানের বিষাদগ্রস্ত উদাসীন ভাব এমন এক আবহ তৈরি করেছে, যা সিনেমাটির প্রতিটি দৃশ্যে প্রচ্ছন্ন হয়ে আছে। এছাড়া ইরফান খানের এক্সপ্রেশন ছিল চমৎকার। কিন্তু ইংরেজি সংলাপের আধিক্য ও হিন্দি টোনের অস্পষ্ট বাংলা স্বর অনেকের কাছে কটু লাগতে পারে। সাবেরি চরিত্রে তিশার অভিনয়, নিতু চরিত্রে পার্নো মিত্র ও কোহিনূর চরিত্রে রোকেয়া প্রাচীর অভিনয় অসাধারণ। এছাড়া অন্য চরিত্রগুলোকেও খুব যত্ন করে উপস্থাপন করা হয়েছে। পার্শ্ব চরিত্রের নিপুণ চিত্রায়ণে ফারুকী এর আগেও দক্ষতা দেখিয়েছেন।
আর শট নেওয়ার ক্ষেত্রে ফারুকীর এটা সেরা কাজ। এরকম নিখুঁত, সূক্ষ্ণ ও শৈল্পিক শটের সম্ভার তার আগের আর কোনো চলচ্চিত্রে দেখা যায়নি।
শেখ রাজিবুল ইসলামের ক্যামেরায় বিষাদময় একটি জীবনের গল্প দারুণভাবে চিত্রিত হয়েছে। আর বিশেষভাবে চিরকুটের ‘আহারে জীবন’ গানটির কথাও বলতে হবে। কারণ, গানটি যেন চলচ্চিত্রটির সঙ্গে মিশে আছে।
শেষমেশ যদি উপভোগের জায়গায় আশা যায়, তবে বলতে হবে, আপনি চলচ্চিত্রটি দেখে কোনো ভোগ্যপণ্য নিয়ে বাসায় যাচ্ছেন না, আপনি একটি অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরছেন। বৈচিত্র্যময়ী শিল্প পণ্য উপহার দেওয়ার জন্য তাই বাক্যটি থেকেই যাবে, ফারুকীর ছবি সবার জন্য নয়!