সমাজটা ছিল দারিদ্র্য, রোগ, কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোড়ামি-আক্রান্ত। সেই সমাজে তরুণদের উদ্যোগে চিকিৎসাসেবার উত্থান ঘটতে চলছে। এমন এক সময়ের কথা ‘ডাক্তার’ চলচ্চিত্রে তুলে এনেছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা ফণী মজুমদার। এটা ১৯৪০ সালের কথা। ১৯৪১ সালে অবশ্য চলচ্চিত্রটির হিন্দি সংস্করণ মুক্তি দেওয়া হয়। উপমহাদেশের চলচ্চিত্রের মধ্যে ‘ডাক্তার’ ছবিতেই প্রথম চলন্ত ট্রেনে গানের দৃশ্যধারণ করা হয়। এই ফণী মজুমদারের জন্ম বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায়। বলতে গেলে উপামহাদেশীয় চলচ্চিত্রের শুরুর দিকের একজন প্রবাদপুরুষের নাম ফনী মজুমদার। তার ‘ডাক্তার’ সিনেমাটি শুধু সিনেমা নয়; চিকিৎসাসেবা, সামাজিক কুসংস্কার, ধর্মীয় গোঁড়ামির মূলে কুঠারাঘাতেরও এক শৈল্পিক মহৌষধ। চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে শৈলজানন্দ মুখ্যোপাধ্যায়ের ‘তিন পুরুষ’ গল্প অবলম্বনে। চলচ্চিত্রটি পরিচালনার পাশাপাশি এর চিত্রনাট্যও লিখেছেন ফণী মজুমদার।
সিনেমাটির শুরুতেই দেখা যায়, অমরনাথ রায় নামে এক ছটফটে যুবক কলকাতা থেকে গান গাইতে গাইতে রায়ধামে ফিরছে। তার বাবা সীতানাথ রায় রায়ধামের অধিকারী। মা-হারা অমরনাথ রায়ধামের একমাত্র উত্তরসূরি। চিকিৎসাসেবায় তার আগ্রহ অনেক। কিন্তু দ্রুতই গল্পে নানা বাঁক নিতে শুরু করে। অমরনাথ ও তার বাবার আদর্শিক দ্বন্দ্বই মূলত পুরো সিনেমায় প্রভাব বিস্তার করে। অমরনাথের বাবা তার পরিবারের আভিজাত্য বজায় রেখেই নিজের জমিদারি চালিয়ে যেতে থাকেন। তার বাবা সীতানাথের আদর্শ সেকেলে। কিন্তু অমরনাথ ভিন্ন প্রকৃতির। চিকিৎসাসেবা তার জীবনের ব্রত হয়ে দাঁড়ায়। চিকিৎসাসেবার কাছে তার জমিদারি, পিতা-পুত্র সম্পর্ক, সবই তুচ্ছ বনে যায়। মানবতা ও সমতা তার আদর্শ। এ কারণে সে সব কিছু ছেড়েছুড়ে একটি অচেনা গ্রামে গিয়ে বসবাস করতে থাকে। সমাজে নিষিদ্ধ এক নারী মায়ার সঙ্গে বিয়ে করে সংসার করতে থাকে সে। সেখানেই গড়ে তোলে হাসপাতাল। গ্রামের হতদরিদ্রদের নানা সীমাবদ্ধতার মাঝেও চিকিৎসাসেবা দিতে থাকে। কিন্তু এখানেই শেষ নয়। সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যায় মায়া। শুরু হয় অমরনাথের নিঃসঙ্গ জীবন।
এদিকে অমরনাথের শিশুপুত্র সোমনাথকে তার বাড়ির চাকর দয়াল রায়ধামে নিয়ে যায়। অমরনাথের ছেলে হিসেবে নয়, অনাথ এক বালক হিসেবে। কিছু দিন পর, সোমনাথ বিলেত থেকে ডাক্তারি পাস করে ফিরে আসে। অমরনাথ দূর থেকে সব দেখে। সোমনাথ বিলেত থেকে ফিরে সরকারি চাকরি করতে চায়, কিন্তু অমরনাথ এটা মেনে নিতে পারে না। সে সোমনাথকে বোঝায়, তার দায়িত্ব আরও বেশি, তার উচিত, নিজস্ব গবেষণাগার তৈরি করে নতুন নতুন ওষুধ তৈরি করা। কেননা এটাই ছিল মায়ার স্বপ্ন। সোমনাথ অমরনাথের খ্রিস্টান বন্ধুর মেয়ের প্রেমে পড়ে যায়। আবারও শুরু হয় সোমনাথ ও তার দাদা সীতানাথের আদর্শিক দ্বন্দ্ব। দ্বন্দ্বের জের ধরেই সোমনাথ আত্মপরিচয় সংকটে পড়ে। কিন্তু তাদের ভেতরের প্রকৃত সম্পর্কের উন্মোচন সিনেমাটির ক্লাইম্যাক্স সৃষ্টিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে।
শিরোমণি চলচ্চিত্রটির একটি গুরুত্বপূর্ণ সুবিধাবাদী, ধর্মান্ধ চরিত্র। শিরোমণি রায়ধামের ব্রাহ্মণদের সর্দার। সে নানাভাবে জমিদারকে ফুসলাতে উস্তাদ। অন্যদিকে দয়াল চরিত্রটি অনেকটা রবীন্দ্রনাথের কেষ্টার মতোই প্রভুভক্ত।
সিনেমার গানগুলো নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, গানগুলো শুনলে মন নেচে উঠবে কিংবা শোকে শোকাচ্ছন্ন হয়ে উঠবে। পঙ্কজ মল্লিক একটি আদর্শিক সংস্কারবাদী চরিত্র অমরনাথকে সফলভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। শুধু অভিনয় নয়, সিনেমাটির মিউজিক ডিরেক্টরও ছিলেন পঙ্কজ মল্লিক। রবীন্দ্রনাথ ও অজয় ভট্টাচার্য্যের গানের মূর্ছনায় পরিপূর্ণ ‘ডাক্তার’ চলচ্চিত্রটি। দ্য নিউ থিয়েটার্সের প্রযোজনায় নির্মিত এই সিনেমাটি ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়েছে। সিনেমাটিতে দক্ষতার সঙ্গে সীতানাথ চরিত্রে অহীন্দ্র চৌধুরী, সোমনাথ চরিত্রে জ্যোতি প্রকাশ, শিরোমণি চরিত্রে ইন্দু মুখ্যোপাধ্যায়, মায়া চরিত্রে পান্না, শিবানী চরিত্রে ভারতী দেবী, দয়াল চরিত্রে অমর মল্লিক প্রমুখ অভিনয় করেছেন।
বিশেষ করে ‘ডাক্তার’ সিনেমার শেষ মুহূর্তের আদর্শিক দ্বন্দ্বের বেদনা ভুলে যাওয়ার মতো নয়। রায়বাবুও হয়তো প্রতিটি মুহূর্ত চাইতো তার ছেলে অমরনাথ ফিরে আসুক। আবার সোমনাথ তার পরিচয় ফিরে পেলেও তার বাবাকে খুঁজে পায়নি। এক অন্যরকম ট্র্যাজেডির মাধ্যমে চলচ্চিত্রটি শেষ হলেও, সোমনাথ ও খ্রিস্টান মেয়ে শিবানীর বিয়ে হওয়াটা কুসংস্কার ও ধর্মীয় গোঁড়ামির বিরুদ্ধে অমরনাথের জয় হিসেবেই উল্লেখ করা যায়। সব বিষয় বিবেচনায় একটি জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে সিনেমাটির সমাপ্তি টানা হয়েছে।
মায়ার প্রতি অমরের প্রেম ও প্রেমালাপ চলচ্চিত্রটির আরেকটি আকর্ষণীয় দিক। তাদের প্রেমের চপলতা যেকোনো দর্শককে স্পর্শ করবে। এদিকে, মায়ার মৃত্যুর পরেও শেষ অবধি মায়াকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা নারী হিসেবে। আর অমরের অমর প্রেমের সমাপ্তি যেন কোনোদিন সম্ভব নয়।
চলচ্চিত্রটি দেখে বর্তমান বাংলা চলচ্চিত্র দেখতে বসলে লজ্জা পাওয়ার কথা। আমাদের চলচ্চিত্র দিনে দিনে বাস্তবতা, সমাজজীবন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। আমরা শুধু ব্যর্থ সৈনিকের মতো সিনেমার বাণিজ্যিক দিক বিবেচনা করে চলচ্চিত্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছি। হলিউড, বলিউডের উপাদান বাংলা চলচ্চিত্রে মিশ্রিত করে জগাখিচুড়ি অবস্থার সৃষ্টি করছি। আমাদের স্বকীয়তা বিসর্জিত হচ্ছে। আমাদের চলচ্চিত্রকে এ মৃত্যুমুখ থেকে উদ্ধার করতে ফণী মজুমদার কিংবা সত্যজিতের এখন বড্ড প্রয়োজন। এ কথা মাথায় রাখতে হবে, আমাদের রোগাক্রান্ত চলচ্চিত্রের উন্নতির ওষুধ পূর্বসূরিরাই দিয়ে গেছেন।
ডক্টর ছবিটি দেখতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন:>