শনশনে বাতাসে তিরতির করে বয়ে যাওয়া চকচকে শুকনো বালুকা তটের মাঝখানের সরু নদীটায় পা ডোবাতেই দুর্জয় কুমারের সমস্ত শরীরটায় হিমেল ঠাণ্ডা শিহরণ খেলে গেলো।
দুর্জয়ের গ্রামে নদী আছে দীর্ঘ বক্ষ; পারে নামলেই পলি কাদা। এখানে হিমালয়ের সংস্রর্বে; গুঁড়ি গুঁড়ি পাথর আর বালি। কলকল করে পায়ের তলা থেকে সরে সরে যাওয়া জল এক হাঁটুও নয়। যেন আঠারো বছরের তরুণী। তন্বী! দুর্জয়ের গ্রামের নদী মা গঙ্গা পৌঢ়াতম্বী। দূরে ছাগল বাঁধতেছিল কালো পেঁসুটে চেহারার একটা মেয়ে। দুর্জয়ের নদীটার নাম জানার ইচ্ছে হলো। হাঁক পাড়লো, এই নদীটার নাম কী?
ছাগল বাঁধা খোটাটায় শেষ বাড়ি সমাপ্ত করে মেয়েটা ফ্যাল-ফ্যাল করে দেখতে থাকে দুর্জয়কে।
দোহারা ফর্সা কার্তিকেয় আবার হাঁক পারলো, নাম কী ? মেয়েটি বলল, কার? আমার না ছাগলের?
নদীর।
উপশয়ী…। যাতরার নোক বুঝি?—সমবেগেই জিজ্ঞেস করলো মেয়েটি ।
দুর্জয় যাত্রার ঢঙে গলা গম্ভীর করে বলে, হ্যাঁ।
ভ্যান গাড়িতে মাইক লাগিয়ে তখন চারিদিকে পাবলিসিটি পাবলিসিটি চলছে—যাত্রা…যাত্রা…যাত্রা…কলকাতার সনামধন্য মঞ্জুশ্রী অপেরার এ মরসুমের শ্রেষ্ঠ যাত্রা পালা। সিঁদুর নিয়ে হোলি খেলা।
যাত্রার প্রধান উদ্যোক্তা নূর উদ্দিনের ঘরে দুর্জয় কুমারের বেডিং পড়লো। নূর উদ্দিন বলেছিলেন, নায়িকা থাকবে তার ঘরে।
দল ম্যানেজার বলেছে, তিনি প্রাইভেটে যান; হোটেলে থাকেন। মাঠেঘাটে হাগেন মুতেন না।
পান খাওয়া লাল দাঁতগুলো বের করে নূর উদ্দিন সবিস্ময়ে বলেছে, তাই বুঝি?
দুধের সাধ ঘোলে মিটেছে নায়িকার বদলে নায়কের আতিথেয়তার সুযোগ পেয়ে। কাজের ছেলেটা বেডিং নিয়ে আগে-আগে ঘরে ঢোকে। পেছনে চোস্তা পাজামা পাঞ্জাবি দুর্জয় কুমারের মাথার চুল উল্টে আঁচড়ানো। কঞ্চির আর মাটির দাঁত মুখবের করে থাকা রসুইখানা থেকে নাক বরাবর ঘরটার দিকে উঁকি মেরে যে মেয়েটা টানটান হয়ে অপলক দৃষ্টিতে দুর্জয় কুমারকে দেখছিল, তার দিকে দুর্জয়ের চোখ পড়তেই মেয়েটা মাথার ঘোমটা বড় করে টেনে নেয়। মুখটা সে এ গ্রামে এসে প্রথম দেখেছে নদীর পারে। তবে এখন তাকে বেশ লাজুক বলে মনে হলো দুর্জয়ের।
নূর উদ্দিন মেয়েটাকে ফরমাইস করে, বাবুর জন্য ডবল ডিমের অমলেট আর চা নে আয়।
ঘরের ভেতরে-বাইরে নিকানো। তক্তপোষের ওপর বেডিং বিছিয়ে দিয়ে যায় যাত্রাদলের বেডিং ম্যানেজার।
কিছু প্রয়োজন হলে বাড়ির লোকরে কইবেন; আমারে আবার প্যান্ডেলওলার সাথে বসতি হবে।
একগাল বিনয় প্রকাশ করে নূর উদ্দিন বেরিয়ে যায়।
ডিমের অমলেট আর চা হাতে নূর জাহান এসে উপস্থিত হয় উঠোন পেরিয়ে ঘরের চৌকাঠে। দুর্জয় তখন পোশাক আশাক ছেড়ে লুঙ্গি পড়তে ব্যস্ত ছিল। দরজায় তিনটে টোকা মেরে পিছন ঘুরে দাঁড়ায় নূর জাহান। ইতস্তত দুর্জয়; হা করে নূর জাহানের দিকে চেয়ে থাকে। চুপ করে থাকতে দেখে নূর জাহান তার দিকে ঘুরে খিলখিল করে হেসে উঠে মুখে হাত চাপা দেয়। সম্বিত ফিরে পেয়ে দুর্জয় লুঙ্গির শেষ গিঁটটা সমাপ্ত করে। আব্রুর আড়াল থেকে নূর জাহান বলে, আপনার নাস্তা।
সারা রাতে এত দূরের পথ ঠেঙিয়ে এসে খিদেটা বেশ চনচনে ছিল। তাই বেশ কিছুটা তৎপর হয়ে দুর্জয় নূর জাহানের হাত থেকে চায়ের প্লেটটা নিয়ে একটা গোটা অমলেটের অর্ধেকটা মুখে পুরে নাড়তে নাড়তেই চায়ে চুমুক দেয়। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে আবার খিলখিল করে হেসে ওঠে নূর জাহান। হাসিটা কানে যেতেই নূর জাহানের দিকে ঘুরে তাকিয়ে মৃদু হাসির ভঙ্গি করে দুর্জয়।
দুর্জয়ের দশ বছরের যাত্রা জীবনে একেক সময় তার মনে হয় স্বার্থপরতা আর ব্যাভিচার অনুশীলন ছাড়া আর সে কিছুই করেনি। মাধ্যমিকে ফেল একটা ছেলে দেখতে শুনতে ভালো হিন্দি বাংলা সিনেমার গান গাইতে পারে; গ্রাম থেকে এটুকুই সম্বল করে সে এসেছিল চিৎপুর যাত্রাপাড়ায়। তারপর ভূমিহীন চাষির ছেলে হরনাথ কয়েক বছরে চিৎপুরের রঙচঙে পোস্টারে দুর্জয় কুমার হয়ে উঠেছে। পোস্টারের রঙ জীবনের রঙকেও অতিরঞ্জিত করেছে। মদ খাওয়া ধরেছে। দল মালিকদের পরের বছর ধরে রাখার টোপে কখনো বা এক নম্বর পজিশনে কাজের প্রত্যাশায় বুড়ি ছুঁড়ি কার না সায়ার দড়ি খুলেছে সে। আত্মশ্লাঘা প্রথম প্রথম ছিল। এখনো কি আছে? আসলে জীবনের দুটো রঙ একটা কালো আর একটা সাদা। কালোটার কোনো বিশ্লেষণ হয় না; সাদার স্বচ্ছতায় জীবনের কালো ছোপগুলো প্রতিফলিত হয়। মন আর মস্তিষ্কে চলে অনুশোচনা। ছোটবেলায় যাত্রার নায়ক হবে এই কথাটা ভুল করেও কখনো ভাবেনি; তবে অন্যান্য দশজনের মতো যাত্রার আসরের খবর পেলে তার উপস্থিতি থাকতো অনিবার্য। জীবন কী চায়? মানুষ কি ছাই জানে না জানবে! প্রতি মোড়ের মাথায় বৈচিত্র্যের ভিড় উস্কানি দেয় পরের মোড় অতিক্রম করতে। জীবন এগিয়ে চলে পেছায় না। পাওয়া না পাওয়া; তৃপ্ততা-অতৃপ্ততা সবই রহস্যময় হয়ে একঘেয়ে জীবনে বাঁচার রসদ যোগায়। না হলে জীবনের আর কীই বা আছে খাওয়া, ঘুমানো আর হাগু করা; আর কখনো কখনো শরীরের ডাকে শরীর মেলাতে সুন্দর পোশাকে ঢাকা দেহগুলো নগ্ন করে মরার খাটের মতো দেহটার ওপর কয়েক টুকরো দলা পাকানো মাংস পরিকল্পনা করে চেটেপুটে নিতে গিয়ে মুহূর্তের উষ্ণতায় গলে যাওয়া। খিদের পেটে খাবারের বিচার হয় না। মিটে গেলে মন বলে কি খেলি! অতৃপ্ত তা আবার খাবার নেশায় মাতিয়ে তোলে। মনের টনটনানি আছে বলেই আমরা আছি থাকবো। মনের শাসন মনের বসন। অনেকটা যাত্রা দলের বিবেকের মত। যদিও এখন দেখা যায় না; তবু নেই বলা যাবে না। মনের হড়কানো জীবনের সব কথা হবে কেন! হড়কাই তো সামান্য কড়কাই অধিক।
চায়ে শেষ চুমুক দিয়ে দুর্জয় বলে, এ গ্রামে আসা থেকে খাতির যত্নের কোনো অভাব রাখেনি তোমার আব্বা।
মেয়েটি এবার দ্বিগুণ জোরে হাসতে থাকে। দুর্জয় অসহিষ্ণু হয় হাসির কারণ বুঝতে না পেরে। বলে, তুমি বোধ হয় কথায় কথায় এমন হাসো।
মেয়েটা ঠোঁট কামড়ে বলে, বাঃ, হাসির কথা কইলে হাসব না!
দুর্জয় বিস্ময়ে বলে, হাসির কথা আবার কী বললাম!
মেয়েটার মুখ ম্লান হয়, কইলা না উনি আমার আব্বা।
দুর্জয় ফের বিস্ময়ে বলে, কেন উনি তোমার আব্বা নন?
নূর জাহান বলে, না, উনি আমার মিয়া।
বিনা মেঘে হঠাৎ বজ্রপাত হয় ।এ ঘরে বাজটা কার মাথায় পড়লো; বুঝে ওঠার আগেই বৃষ্টির সম্ভাবনায় ঘূর্ণিঝড়ের মতো নূর জাহান তার গেরস্থালীর শুকনো জিনিসপত্রসহ মাঠের ছাগলটা আনতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। দুর্জয় কুমারের চটুল বাক্যলব্ধ ঠোঁটদুটো আপনা থেকেই বাক্যহীন হয়ে পড়লো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝমঝম করে বৃষ্টি এলো। নেমে এলো অকাল অন্ধকার সকাল বেলায়। দুর্জয় ভাবছিল একটা কুপি হলে ভালো হতো। নূর জাহান কুলঙ্গির সামনে এসে দাঁড়ালো ভিজে স্নান করে। আগুন জ্বললো দুর্জয়ের মনে আর কুপিতে। কুপির ম্লান আলোয় দেখা গেল নূর জাহানের ভেজা যৌবন। দুর্জয়ের মনের আগুনে পুড়ে মনের ভেতর পেসুটে কালো মেয়েটিও উজ্জ্বল তীব্র সুন্দরী হয়ে উঠলো। ঘোমটা কখন যে অপসারিত হয়ে গিয়েছিল নূর জাহানের খেয়াল ছিল না। কুপিটা কুলঙ্গিতে তুলে রাখতে যেতেই দুর্জয়ের সঙ্গে চোখাচোখি হয়। দুর্জয়কে অপলক দৃষ্টিতে হেংলার মতো চেয়ে থাকতে দেখে নূর জাহান কিঞ্চিত লজ্জা পেয়ে ঠোঁট দিয়ে ঠোঁট কামড়ে হাসে।
দুর্জয় বলে, তুমি তো একেবারে ভিজে গেছ।
নূর জাহান লাজুক হেসে কুলঙ্গিতে কুপিটা রেখে গায়ে গামছা জড়িয়ে গামছার কোণা দিয়ে মুখ মুছতে থাকে। গামছার আড়াল ছিন্ন করে বুকের কাছটা নূর জাহানের ডানা ঝাপটানো পায়রার মতো দুলে দুলে ওঠে।
নূর জাহান বলে, মতি বিবি আমার ছাগলটা আজি ডাকিছে। সোজা খোঁটা উপড়ে পালানদের পাঁঠাটার কাছে গিয়ে হাজির। পালান বলে বিনে পয়সায় পাল খাওয়াইলি পঞ্চায়েতে মিটিং ডাকব। ভালো চাস তো মিয়ারে দুশো টেহা দিয়ে যেতে কইবি।
মুখ মোছা থামিয়ে নূর জাহান সিদে দুর্জয়ের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়, অমার মিয়ারে হালারা হিংসা করে। তুমিই কও ডাক কি আর বলে কয়ে আসে। যে আগে থাইকে জাইনা শুইনা ব্যবস্থা করুম।
দুর্জয়ের গলা ধরে আসছিল স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলে, তাইতো। এই যেমন আকাশ ডাকলো তুমি ছুটে চলে গেলে। ভিজে বাড়ি ফিরলে। সত্যি তো ভিজে যাবে এ কথা কি জানতে?
এবার আবার এক গাল না হেসে পারে না নূর জাহান, ঠাট্টা কইরতেছ! আমার চিন্তা হয় পঞ্চায়েতে গেইলে আবার মুরুব্বি বইসবে। ওই হালারা তো আর এক হারামি। সেবার কলার কাঁদি চুরি হইল। পঞ্চায়েতে জানাইতে গেলাম কইলো মিয়ারে ভালো জাতের কলা লাগাইতে কও। বিচি কলার জন্য আর মায়া কইরো না। বাড়িতে মিয়ারে আইসা কইলাম সে উল্টে আমারে ঠেঙাতে যায়। কয় চোরের কাছে গেছোস চুরির বিচার চাইতে। কলায় যে বিচি চুরির ভাগ না পাইলে জানলো কেমনে ওই হালারা।
দুর্জয় বলে, তোমার সঙ্গে তো তোমার মিয়ার বয়সের আকাশ পাতাল দূরত্ব। নূর জাহান হাতের আঙুলে গামছার খোঁট জড়াতে জড়াতে বলে, হইব না? আমি যে উনার তিন নম্বর বিবি। আমার আব্বা মাছের খুচরা কারবারি। আর ইনি পাইকারি। আড়তদার। দুজনার পিরিতের সীমা ছিল না। আমার মিয়ার দুইখান বিবি পোলাপান দিতি পাইরলো না; মিয়া গলা পর্যন্ত বাংলা খাইয়া একদিন আমারে সাদি কইরবে বললো। আব্বা তো এক পায়ে রাজি! আব্বারে কিছু টেহা ধার দে ছিল আমার এই নোকটা। আব্বা দেইখলো মাইয়ারে সাদি দিলে কর্জের টেহা শোধ দিতে হইবো না। আমি মন রাইখতে পারলে আমারে ভেজিয়ে সময় বিশেষে মিয়ারে দুইয়েও নেওয়া যাইবে ভালো। আম্মা কেঁদে ছিল। কিন্তু আব্বার ওপর কথা কইবার সাহস ছিল না। দুর্জয় একটা বিড়ি ধরিয়ে টানতে টানতে বলল, তোমার ছেলেপুলে কটা? নূর জাহানের মুখটা আবার ফ্যাকাসে হয়ে গেল, পাঁচ বছর সাদি হইয়াছে। এখনো পেট ভারী হয় নাই। হাকিম কবিরাজ কোনটায় মিয়া অভাব রাখে নাই। আল্লাহর ইচ্ছা নাই! সকালে যে নদীটা দেইখলে ওতো নামে উপশয়ী। তবু বর্ষা এইলে ওর বুক ভইরা কুল কুল কইরে জল বইয়ে চলে। আমার জেবনে কোনও স্রোত নাই। একটা বাজ কড়কড় করে আবারো পড়ে। ভয় পাই আল্লারে ডাকি! পোলা দিতি না পাইরলে মিয়া যদি আবারও তালাক লইয়া নতুন বিবি ঘরে লইয়া আসেন। বিছানা থেকে হাত বাড়িয়ে নূর জাহানের হাতটা স্পর্শ করে দুর্জয় কুমার। নূর জাহানের মনে হয় আল্লাহর মেহেরবানি তাকে ছুঁলো। স্পর্শ করা দুর্জয়ের হাতের দিক থেকে তার চোখে চোখ রাখে নূর জাহান। দুর্জয় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে, ভগবান কাউকেই সব কিছু দেন না। তাহলে ভগবানকে কেউ পুজবে না! মেঝেতে হাঁটু মুড়ে বসে নূর জাহান, তুমি তো ভারি সুন্দর কথা কও। দুর্জয় নূর জাহানের হাতটা বিছানার ওপর রেখে হাত বোলায়, আমাদের আর কথা কি। আজ এ গাঁ, তো কাল ও গাঁ। রাতের পর রাত জাগি। সকলে যাত্রা দেখতে আসে। আমরা মুখে রঙ মাখি। যাত্রা শেষে সকলে বাড়ি ফিরে যখন ঘুমায়; আমরা রং মুছি; আগামী দিনের জন্য রওনা হই। নূর জাহানের মাথার ঘোমটাটা অনেক আগেই খসে গিয়েছিল এবার সে সুযোগে ঘরে ঢুকে পড়া একটা দমকা হাওয়া তার গামছায় মোছা আধ ভেজা চুলের ভিতরে খেলা করে গেল। দুর্জয় তখন নূর জাহানের শরীর নিয়ে খেলার কথা ভাবছে। নূর জাহান ভেজা কাঁধে গাল ঘষতে ঘষতে বলল, ভারি সুখের জেবন তোমাদের! পাখির মতো এ গাঁও ও গাঁও উড়ে বেড়াও। দুর্জয় পাখি শব্দটার সঙ্গে একটা বিশেষণ যোগ করে, যাযাবর পাখি। নূর জাহান একগাল হাসে, তোমাদের দলে মাইয়া কজন? পোস্টারে নায়িকাকে দেখলাম। তোমার সাথে মানায়েছে বেশ। দুর্জয় স্ফীত কণ্ঠে বলে, কে শতরূপা? নূর জাহান কৌতূহলী হয়ে বলে, সিনামা দেইখেছি ওর।. কি লজ্জা! কি লজ্জা! ছোট ছোট নেকরা পইরে নাচে। ছেলে ছোকরারা শিটি বাজায়। খুব সুন্দরী না গো? দুর্জয় বলে, সৌন্দর্য যদি শুধু বাইরের চেহারাটা দিয়ে বিচার করতে হয় তাহলে সে কিছুটা সুন্দরী বটে। আর ভেতরে বাইরে মিলিয়ে যদি কারো সৌন্দর্যের হিসেব হয় শতরূপা-র কথা শুনলে তুমি ঘেন্না পাবে। আর যে জিনিস মানুষের বমির উৎবেগ ঘটায় তাকে কি সুন্দর বলা চলে! নূর জাহান কৌতূহলী হয়ে বলে, কেন রূপের খুব দেমাগ বুঝি? দুর্জয় বলে, গায়ের রঙটা আলুর মতো রং করা। আর ভেতরটা খাটা পায়খানার মতো দুর্গন্ধে ভরা। মদ আর পুরুষ না হলে চলে না। কোনো কোনো দিন দলের ট্যাঙ্ক বওয়া ছেলেগুলোকেই হোটেলে নিয়ে গিয়ে তোলে। প্রথম পক্ষের ছেলে নাকি দার্জিলিংয়ের হোস্টেলে থাকে; দ্বিতীয় পক্ষের বরকেও নাকি ছাড়ব ছাড়ব করছে। নূর জাহান দুর্জয়ের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বলে, কিন্তু সিনামায় যে দেখি বেটি ভালো মানুষের অভিনয় কইরে। দুর্জয় বলে, এটাই তো আমাদের গুণ। আমরা যে যা নই, তাই সাজি। নূর জাহান নির্লিপ্তভাবে বলে, তুমিও তাই। দুর্জয় দৃঢ়তার সঙ্গে বলে, আমরা সকলেই। আমি, তুমি, সকলেই। তুমি যেমন উপোসী, তবু রোজ ভান করে চলেছ যেন কত পরিতৃপ্ত তুমি। নূর উদ্দিন সাহেব নিজের কাছে নিজেই অসম্মানিত; তাই রোজ গ্রামের দশ জনের কাছে সম্মানিত হওয়ার ফন্দি-ফিকির খুঁজে চলেছেন। নূর জাহান ফুঁপিয়ে কেঁদে মুখ ঘুরিয়ে নেয় দুর্জয়ের দিক থেকে।
দুর্জয় বিছানা থেকেই নূর জাহানের কাঁধটা শক্ত করে ধরে। নূর জাহান কাঠের পুতুলের মতো তার সামনে সিদে হয়ে দাঁড়ায়। অস্ফুটভাবে বলে, মাইয়াটার এঁটো ঠোঁটে তুমি চুমা খাওনাই কোনদিন? দুর্জয় বলে, দুই চার বার মদ খেয়ে ও আমাকে ওর বিছানায় ডেকেছে। অনেকটা তোমার ওই ছাগলের মতো।
নূর জাহান চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস নেয়। সে যেন শুনেও শান্তি পায় যে, মতি বিবির মতো এমন অনেক বিবি আছে শরীরের খিদে পেলে তারা ডাকে। পুরুষ তাকে যতই না পাক বলুক, তবু সে ডাকতে পারে। নূর জাহানের নির্মেদ কোমরটাকে পেছন থেকে জাপটে ধরে দুর্জয়। গালে গলায় দুর্জয়ের গরম ছোবলের মধ্যে নূর জাহান বলে, আমি তো ডাক দিই নাই।
দুর্জয় বলে, উপোসীর ডাক শঙ্খের মতো। বুকে কান পেতে শুনে নিতে হয়।
বাইরে বর্ষণের ধারা যখন প্রবল; নূর জাহানকে আবার ভিজিয়ে দেওয়ার অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছে দেয় দুর্জয়ের জয়যাত্রা।
শেষ মুহূর্তে দুর্জয় নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে চায়। নূর জাহান তাকে আঁকড়ে ধরে, শাঁখকাটা শাঁখারি শাঁখা গইড়ে দেবে না?
হাঁপিয়ে যাওয়া দুর্জয় বলে, তাতে শাঁখ প্রাণ হারায়। তার বুকের আওয়াজ চলে গিয়ে অন্যের ফোঁকা ফুঁয়ে জীবন কাটাতে হয়। আটকে আটকে আসা গলায় নূর জাহান ফিসফিস করে বলে, খোলস হইয়াও যদি এ সংসারে পূজার কাজে আসি, পতিত জমিতে পইড়ে নষ্ট হওয়া বীজের মতো অসাড় সংসারের ত্তঁচলাকুড়ে সব শেইষ হইবার চাইতে তো ভালো। হিন্দুদের তুলসী তলায় ওই খোলসই তো জোর গলায় পৃথিবীকে জানায় গেরস্থের সাঁঝের পিদিম নেভে নাই। মিয়ার আমার বংশের প্রদীপ চাই। দরগায় চাদর চড়ানোর মানত কইরেছে।
বর্ষণ থামে মাঠঘাট সব কিছু ভিজিয়ে। তারই মধ্যে খড় বিছিয়ে প্যান্ডেল তৈরি হয় রাতের যাত্রা পালার।
পালা দেখতে বসে নূর জাহানের মনে হয় এ পালার কনসার্ট তার জীবনের পালাবদল ঘটাতে পারবে তো! নায়িকার জায়গায় বার বার সে দুর্জয়ের পাশে নিজেকে দেখলো।
পালা শেষে বটতলার অন্ধকারে আর একবার সাহসী হয়ে নূর জাহান দুর্জয়কে বলে, আমারে তোমার মইনে থাকবে তো!
দুর্জয় চারিদিকে চেয়ে বলে, কেউ দেখে ফেলবে।
নূর জাহান শাড়ির আঁচলে মুখ টিপে খিলখিল করে হাসে, দেইখলে বুঝি চাকরি চইলা যাইব? আবার কবে আইসবে?
দুর্জয় কোনো উত্তর করে না। সিদে গাড়িতে গিয়ে ওঠে। সে মতি বিবিদের ডাক বোঝে, বোঝে পাগলামি। জান্নাত থেকে নেমে আসা দুর্জয় যেন এক ফেরেশতা। আবার জান্নাতে ফিরে যাচ্ছে। গাড়ি ছাড়া অবধি নূর জাহান দাঁড়িয়ে থাকে লোকচক্ষুর অন্তরালে রাস্তার পাশের বড় ঝোপটার অন্ধকারে। গলা অবধি মদ খেয়ে বাড়ি ফিরে নূর উদ্দিনের তখন নূর জাহানকে খোঁজার সামর্থ্য নেই।
কলকাতায় এসে খোঁজ-খবর নিয়ে নূর উদ্দিন কলকাতার বিশ্বলোক অপেরাকে বুকিং করলো। দুর্জয় এ বছর সে দলের নায়ক। তবে শতরূপা রায় এ দলে নেই। আছে মিস লাভলী। পোস্টারে ক্যাপশন করেছে শ্রেষ্ঠাংশে যাত্রার গায়ক নায়ক দুর্জয় কুমার ও গ্ল্যামার কুইন মিস লাভলী! দুর্জয় নায়েক নূর উদ্দিনের বাড়িতে উঠতে রাজি না হওয়ায় স্বয়ং নূর উদ্দিন এসে উপস্থিত হলেন যাত্রার গাড়িতে। গত বছরের মতো নায়িকার সংসর্গের লোভ তার আর নেই। সে চায় এবছরও দুর্জয় তার বাড়িতে পায়ের ধুলো দিক।
কেমন আছেন?
মৃদু হাসির ভঙ্গি করে দুর্জয় কুমার বলে, ভালো। আপনি কেমন আছেন?
এক গাল হেসে নূর উদ্দিন তার পান চিবানো কালো ছোপ পড়া দাঁতের ফাঁকে লুকানো লাল পিক জিব দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, জবর খবর। একটা ফুটফুটে পাঁঠা হইয়েছে; সে হালা ভীষণ বজ্জাত কোলঘেঁষা। নূর উদ্দিন বাড়িতে ঢোকার মুখেই নূর জাহান পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে পরবের শাড়িটা পরে ছেলে কোলে দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। চেহারায় তার বেশ উন্নতি হয়েছে বলেই এক ঝলকে দুর্জয়ের মনে হলো। দুর্জয়ের কাছে এগিয়ে এসে কোলের ছেলেটাকে এগিয়ে দিয়ে বললো, আমার পোলা।
সেদিনের সেই পেসুটে মুখটার উজ্জ্বল আকাশে আজ এক ঝলক হাসির মেঘ বলাকা উড়ে যেতে দেখে দুর্জয় এবার প্রাণ থেকে প্রসন্ন হাসি হাসলো। ছেলেটাকে কোলে নিয়ে বলে, কী নাম দিয়েছেন মিয়া সাহেব?
নূর উদ্দিন বেডিং বওয়া ছেলেটাকে ঘরের বিছানা দেখিয়ে দরজা ডিঙ্গিয়ে দুর্জয়ের সামনে থামলো,-আজ্ঞে বড় সেয়ানা, তাই ওর নাম রুস্তম। এ হালা ছুপা রুস্তম। আপনি জেরায়ে নিন। গতবার যা দুর্যোগ গেছিল! যেভাবে গান গেইয়ে সম্মান রাইখলেন, তা আজেবন ভুইলব না।
দর্শকেরা আনন্দ পেলে আমরাও আনন্দ পাই।
নূর উদ্দিন তার অতি পরিচিত খেঁকখেঁকানি হাসিটি অব্যাহত রেখে বললো,
আপনার ওপর আমার প্রত্যাশার অন্ত নাই। দেইখবেন আমারে একটু।
দুর্জয় হালকা হাসির ছলে বলে, পরের বছরও প্রেসিডেন্ট থাকছেন তো?
ঠিক নাই। একেক সময় একেক পদ বোঝা বইলে মইনে হয়। ছাইড়া দেওয়ারও উপায় থাইকে না। আপনি বিশ্রাম কইরেন। আমারে আবার বেরতে হইবে।
নূর উদ্দিন চলে যেতে নূর উদ্দিনের পুরনো ঘরের নতুন ছাওয়া চালাটার দিকে দুর্জয় চেয়ে থাকে।
নূর জাহান বলে, গেলো বর্ষায় ওটা ভেঙে পইরেছিল।
দুর্জয় বাচ্চা কোলে নূর জাহানের সঙ্গে ঘরে ঢোকে। পুরনো অসার অপরিপক্বতাকে নূর জাহান দেখেছে ভেঙে যেতে। নতুন চালাটাকে মাথায় তুলে রাখতে হয়েছে পুরনো দেয়ালের এই ঘরটাকে। না হলে ঝড়ে উড়ে আসা ধুলো সুযোগ নিতো নোংরা করার; মুখ বাঁকানো বজ্র বিদ্রূপের হাসি খেলে যেত এই ঘরের ওপর। বৃষ্টি থুতু ছেটাতো।
বিছানায় বসা দুর্জয়ের কোলে নবজাতক! নূর জাহান বলে, কাইর মতো দেইখতে হইয়াছে কও?
দুর্জয় ভালো করে দেখে বলে, তোমার মতো।
নূর জাহান বলে, ধ্যাত! এমন সানা রঙ আমার কই। এ রঙ তোমার।
দুর্জয় নূর জাহানের দিকে বিস্ময়ে চেয়ে বলে, নূর উদ্দিন জানে?
নূর জাহান আঙুলে আঁচল পেঁচাতে পেঁচাতে বলে, হ্যাঁ। আমি কইয়াছি। তিনখান বিবির পরও যহন কারো গোরে মাটি দিবার কেউ না থাইকে, তহন বিবিদের চাইতে নোকে মিয়াদের হিড়িক দেয় বেশি। তুমি তার সম্মান বাঁচাইলে। আমারে কইয়াছে তোমার কাছ থাইকে আরেকখান উপহার নিতি। পাইরলে যারা তার পুরুষত্বকে সন্দেহের চোখে দেইখে তাদের চোখে নঙ্কা ঘষে দিবে। আমারে তুমি আর একটা ভিক্ষা দিবে?
নূর জাহানের দিকে চেয়ে দুর্জয় নিজের অজ্ঞাতেই উচ্চারণ করে, এ চাওয়া তো নূর উদ্দিনের!
চোখ থেকে দুই ফোটা জল গড়িয়ে পরে নূর জাহানের, উপশয়ী মানসের আবার চাওয়া পাওয়া কী! নিজের সাথে আপোষ কইরে নিতে হয়।