বাংলাদেশের সাহিত্যে আখ্যানশিল্প হিসেবে চিলেকোঠার সেপাই নানা কারণে উল্লেখযোগ্য। প্রথমত, এটির রচয়িতা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, একজন মননশীল কথাশিল্পী, যিনি বাংলা কথাসাহিত্যে নতুনতর আঙ্গিক ও বিষয়ভাবনার আবিষ্কারে নিয়ত সক্রিয় ছিলেন।সুতরাং আশা করা যায়, এই উপন্যাসে আমরা চিরাচরিত আখ্যানবৈশিষ্ট্যের অতিরিক্ত কিছু লাভ করব। দ্বিতীয়ত, এই উপন্যাসের বিষয় উনিশ শ ঊনসত্তরের গণআন্দোলন, যা খুব শিগগিরই (১৯৭১) স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিণতি নিয়ে আসে। তৃতীয়ত, একটি ভিন্নতর ভাষাশৈলী নির্মাণের প্রচেষ্টা রয়েছে এই রচনায়, পরবর্তী উপন্যাস খোয়াবনামায় তার উজ্জ্বলতর রূপ পরিদৃষ্ট হয়।চতুর্থত, আধুনিক আখ্যানশিল্পের মূল অভিনিবেশ ‘ব্যক্তি’, বিশেষত মধ্যবিত্ত ব্যক্তির, ভেতর-বাহিরকে খুঁড়ে-খুঁড়ে তার প্রকৃত রূপ আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন ঔপন্যাসিক তার এই নাতিদীর্ঘ রচনা-পরিসরের মধ্যে। পঞ্চমত, ব্যক্তি ও সমাজের বহিরঙ্গের রূপ ও রঙ নয় কেবল, তাদের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক এবং একইসঙ্গে সমাজের ভেতরদেশে অন্তঃসলীলা প্রস্রবণের মতো বহমান স্পন্দনকে শনাক্ত করার দুঃসাহস দেখা যায় এই উপন্যাসে আকৃত সমাজবাস্তবতার অধ্যয়নে।
দুই
একজন প্রতিভাবান কবি যেমন শুরু থেকেই সচেতনভাবে সক্রিয় থাকেন তার নিজস্ব একটি চারিত্র্য অর্থাৎ কাব্যভাষা (পোয়েটিক ডিকশন) নির্মাণের প্রচেষ্টায়, আমরা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের কথাসাহিত্য চর্চার মধ্যেও সেইরকম একটি চেতনসৃষ্ট প্রয়াস লক্ষ্য করি। সেজন্য তিনি তার গল্প-উপন্যাসে প্রধানত নিম্নবর্গের, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনযাপন ও চিন্তন-সৃজনকে অবলম্বন করলেও তার মধ্যে চারিয়ে দেন মননশীলতা, বুদ্ধিদীপ্ততা, তার চরিত্ররা চারপাশের ব্যক্তি, সমাজ, সংস্কৃতি, রাষ্ট্রকে অধ্যয়ন ও শনাক্ত করতে উদগ্রীব, এমনকি প্রায়শঃই সক্ষমও বটে।আবেগপ্রবল বাংলা কথাসাহিত্যকে তিনি যুক্তি, পৌরুষ ও দার্ঢ্যগুণে বলীয়ান করতে চেয়েছেন। তার সবকটি ছোটগল্প ও উপন্যাসেই তার প্রমাণ উপস্থিত, এবং চিলেকোঠার সেপাই তার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ।এই উপন্যাসের পাত্র-পাত্রীরা সবাই সাধারণ মানুষ; যারা বিত্তশালী এবং ক্ষমতার বলয়ের অন্তর্ভুক্ত তারাও শিক্ষা ও সামাজিক মর্যাদার বিবেচনায় অসাধারণ নয়, অভিজাত তো নয়ই, তথাপি তারা কেউই মনোগতভাবে জোলো, দ্রবণপ্রবণ মানুষ নয়, নিজ-নিজ অবস্থানে তারা প্রত্যেকেই নিজ পায়ের ওপর অর্থাৎ নিজস্ব চিন্তন-প্রক্রিয়ার ওপর আস্থাশীল। কেবল ওসমান গনি শেষ পর্যন্ত দিশেহারা হয়ে পড়ে, কিন্তু মনোগতভাবে সে-ও আবেগে গলে-পড়া, বা প্রেমে-ভক্তিতে গদগদ হওয়া, কিংবা হতাশা-গ্লানিতে ভেঙ্গে পড়ার পাত্র নয়। তার ব্যর্থতা চিন্তার দৈন্যের কারণে, বিপর্যয় শ্রেণিগত অবস্থানের দুর্বলতার জন্য, তার চৈতন্যের বিভ্রান্তি ঘটে সময় ও সুযোগ শনাক্তকরণ ও তার সদ্ব্যবহারে দূরদর্শী হতে না পারার কারণে। কিন্তু কোনওমতেই তাকে ভাব-দুর্বল বলা চলে না।
ষাটের দশকে যে প্রধান তিন সাহিত্যিক ব্যক্তিত্ব আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের খোল-নলচে পাল্টে ফেলার ব্রত নিয়ে কলমে শান দিয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস তাদের মধ্যে অন্যতম। অন্য দুজন হলেন আবদুল মান্নান সৈয়দ ও মাহমুদুল হক। এরা যতটা চেয়েছিলেন ততটা পারেননি; কিন্তু পুরোপুরি ব্যর্থও হননি। এরা কেবল যে নিজেরা অনানুল্লেখনীয় হয়েছেন তাই নয়, পরবর্তী প্রজন্মের লেখকদের তাদের পথে ব্রতী হতে উৎসাহিত করতে পেরেছেন সেটাই তাদের প্রধান সাফল্য। ইলিয়াস তাত্ত্বিক অর্থে মার্কসবাদী জীবনবীক্ষায় বিশ্বাসী, সেজন্যে বুদ্ধিবৃত্তিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে সক্রিয়ছিলেন সারাজীবন। তার সাহিত্যেও তার প্রভাব অবিসংবাদী এবং স্পষ্ট। তার দৃঢ় বিশ্বাস—
…কেউ চাক আর না-ই চাক বুর্জোয়াব্যবস্থার ধ্বংশ একেবারে অনিবার্য। বুর্জোয়া সাহিত্যের প্রধান বিষয় ব্যক্তিও আজ এতটা রুগ্ন যে তার মৃত্যু আসন্ন।
এখন নতুন সমাজব্যবস্থার জন্য মানুষের সংকল্পে শরীক হওয়া শিল্পীর প্রধান কর্তব্য। সমাজবাস্তবতা উপন্যাসের প্রেক্ষিত বলে ঔপন্যাসিক এখানে বড় দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম। মানুষকে ব্যক্তি-খোলসের ভেতর থেকে বার করে এনে তাকে প্রকৃত মানুষ করে তোলা দরকার। ব্যক্তি এখন মানুষ হয়ে উঠবে। যে-শ্রমজীবীর রক্ত ও যাদের বিনিময়ে বুর্জোয়াব্যবস্থার বিকাশ ঘটেছিল সেই সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় আজ অসন্তুষ্ট ও ক্ষুব্ধ। তাদের অসন্তোষ ও ক্ষোভ থেকে ঔপন্যাসিক নতুন করে লেখার ইন্ধন পাবেন। যদি না পান তো তাঁর লেখা ব্যর্থ হতে বাধ্য।
(উপন্যাস ও সমাজবাস্তবতা: সংস্কৃতির ভাঙা সেতু)
তিনি মনে করেন, লেখকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হলো—‘অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক লড়াই আর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক বিমানবায়নের আগ্রাসন থেকে বাঁচানোর লড়াইকে তারা মানুষের সার্বিক মুক্তির পথে সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচনা’ করবেন।আসলে সামাজিক, রাজনৈতিক, বা অর্থনৈতিক যাই বলি না কেন তার বাস্তবতার স্তর ও গ্রন্থিল বুনট স্থান-কাল-পাত্রভেদে ভিন্ন-ভিন্ন মাত্রায় উদ্ভাসিত ও চিহ্নিত হয়। সার্থক শিল্পী ও সাহিত্যিকের দায়িত্ব হলো, সৌন্দর্য সৃষ্টির পাশাপাশি অবিসংবাদীরূপে সেই বাস্তবতার স্তর ও গ্রন্থিল বুনটকে শনাক্ত করা, অধ্যয়ন করা, প্রশ্নবিদ্ধ করা, অর্থাৎ নিদেনপক্ষে পর্যালোচনা করা। তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন—
সামাজিক পরিস্থিতির নির্যাস উপলব্ধি কাম্য নিশ্চয়, কিন্তু শুধুমাত্র নির্যাসই সৃষ্টির আধেয় নয়। ওই নির্যাস কীভাবে জীবনের বিচিত্র পটে মূর্ত হয়ে উঠছে তা দেখানোয় এবং বিশ্লেষণ করাতেও সৃষ্টির উদ্যম প্রকাশ পায়। বাস্তব জীবনের নানা অনুষঙ্গ কীভাবে নান্দনিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন রূপ ও চরিত্র অর্জন করছে আর নির্বিশেষ হয়ে উঠছে বিশেষ- সেদিকে তর্জনি সঙ্কেত করে মার্ক্সীয়-লেনিনীয় সাহিত্যতত্ত্ব।
(মার্ক্সীয় সাহিত্যবীক্ষা: প্রতীচ্যের সাহিত্যতত্ত্ব)
আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে—
মানুষের প্রতিদিনকার জীবনযাপনে কোনো গভীর সত্য বা প্রশ্নের উন্মোচন সাম্প্রতিক কথাসাহিত্যে অনুপস্থিত। পাঠককে প্রচলিত মূল্যবোধ বা সমাজব্যবস্থা সম্বন্ধে কোনো জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করাতে সাম্প্রতিক কথাসাহিত্য ব্যর্থ।
(সংস্কৃতির ভাঙা সেতু: সংস্কৃতির ভাঙা সেতু)
অন্যত্র তিনি বলেন−
শ্রমজীবী মানুষের দারিদ্র্য বহু শতাব্দীর নিদারুণ শোষণের ফল। ইতিহাসের যতদূর দেখা যায়, বাংলার নিম্নবিত্তের সচ্ছল ছবি পাই না। এক হাজার বছর আগেকার বাংলা কবিতায় মানুষের নিত্যউপবাসের খবর আছে।
কিন্তু এই দারিদ্র্য দিয়েই নিম্নবিত্ত শ্রমজীবীকে সম্পূর্ণ চেনা যায় না। তাঁর জীবনযাপনে মানবিক মূল্যবোধসমূহের বিকাশ আছে এবং হাজার হাজার বছরের শোষণ তাঁর সুকুমার বৃত্তিকে উপড়ে ফেলতে পারেনি। তাই তাঁর যথার্থ পরিচয়লাভের জন্য তাঁর সংস্কৃতিকে জানা একেবারে প্রথম ও প্রধান শর্ত।
(পূর্বোক্ত)
তাঁর মতে, ‘কথাসাহিত্য ব্যক্তির মুক্তিপ্রয়াসের আর-একটি উদ্যোগ− আরও ব্যাপক, আরও সংগঠিত এবং আরও দায়িত্বশীল।’ এ মুক্তি সমাজেরও। কেননা—
কান টানলে যেমন মাথা আসে, ব্যক্তির জীবন বলতে গেলে চলে আসে সমাজ। সমাজের বাস্তব চেহারা তাঁকে তুলে ধরতে হয় এবং শুধু স্থিরচিত্র নয়, তার ভেতরকার স্পন্দনটিই বুঝতে পারা কথাসাহিত্যিকের প্রধান লক্ষ্য।
(উপন্যাস ও সমাজবাস্তবতা: সংস্কৃতির ভাঙা সেতু)
সুতরাং বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়, বা সন্দেহ করা উচিৎ নয় যে ইলিয়াসের সাহিত্যভাবনা ও সৃজনপ্রক্রিয়ার পশ্চাতে মার্কসবাদী জীবনদর্শনের রাজনৈতিক চেতনা বিশেষভাবে সক্রিয় থাকবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তার সৃজন-মননে এ বিশ্বাসও দৃঢ় ছিল যে ‘সমাজবাস্তবতা বলতে লেখকের বক্তব্য কী মতবাদের প্রয়োগ বোঝায় না।’
এটা যে কোনও সাহিত্যিকের জন্যেই সত্য যে তিনি প্রতিনিয়ত নতুনতর বিষয় খুঁজবেন, ভিন্নতর প্রকরণ আবিষ্কারেঅনবরত ক্রিয়াশীল থাকবেন; অবশ্য সব সময় পারবেন তার নিশ্চয়তা নেই একেবারেই। এটা নির্ভর করে লেখক জীবন ও জগৎকে কোন চোখে দেখছেন, কীভাবে বুঝছেন, এবং কোন প্রক্রিয়ায় তাকে উপস্থাপন করছেন তার ওপর। সেই রকম দৃষ্টি, চেতনবোধ ও সৃজনপ্রতিভা তার থাকা চাই। ‘যার সেই দৃষ্টি নেই তিনি অবিরত অবিশ্বাস ও সংশয়ের গোলকধাঁধায় ঘুরে বেড়াবেন। আবার এই বিশেষ ধরনের চোখে বিশ্বাস যাদের অস্খলিত তারাও এক ধরনের রৈখিকতা ও বৃত্তবন্দিত্বের শিকার হতে পারেন যদি অনবরত ওই দেখার প্রামাণ্যতাকে প্রশ্ন না করেন।’ (তপোধীর ভট্টাচার্য, মার্ক্সীয় সাহিত্যবীক্ষা, প্রতীচ্যের সাহিত্যতত্ত্ব)আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের শিল্পবীক্ষার দিকে তাকিয়ে এখানে ট্রটস্কির কথা স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর বিখ্যাত লিটারেচার অ্যান্ড রেভলিউশন বইতে তিনি শিল্প সৃষ্টিকে a changing and a transformation of reality in accordance with the peculiar laws of art বলে সংজ্ঞায়িত করেছেন। এখানেই আসে পরিবর্তমান বাস্তবতাকে ধারণ করার উপযোগী প্রকরণ-প্রকৌশল অর্থাৎ সৃজন-প্রক্রিয়ার কাঠামো নির্মাণের প্রশ্নটি। ইলিয়াস সাহিত্যের এই দ্বিবিধ চাহিদার কথা ভুলতে চাননি কখনও। চিলেকোঠার সেপাই এবং খোয়াবনামা তার প্রমাণ। তপোধীর ভট্টাচার্যের নিম্নোক্ত কথাগুলো তার ক্ষেত্রে উদ্ধৃতিযোগ্য:
প্রথমত, মার্ক্সীয়-লেনিনীয় বিশ্ববীক্ষা দ্বারা অনুপ্রাণিত বস্তুবাদী নন্দনতত্ত্ব প্রকরণতত্ত্বের দ্ব্যর্থহীন বিরোধিতা করে। তেমনি ভাবাদর্শগত কারণে বাস্তবতাবিরোধী শিল্পের বিমানবায়িত অপজগৎকে প্রতিরোধ ও প্রত্যাখ্যান করে। দ্বিতীয়ত, কাক্সিক্ষত আদর্শ ও লক্ষের উচ্চারণ মাত্র করে বস্তুবাদী নন্দনতত্ত্বের দায় ফুরোয় না; বাস্তববাদী শিল্পী-সাহিত্যিকের সৃষ্টিপ্রক্রিয়া যাতে লক্ষ্যচ্যুত না হয় কখনও, এইজন্যে নিরন্তর পরীক্ষা ও পুনঃপরীক্ষার মধ্য দিয়ে পদ্ধতিগত মার্গ ও কৃৎকৌশল যোগান দিয়ে যায়। তার মানে নন্দন ও ভাবাদর্শের সুষম সমন্বয় যেমন কাম্য, তেমনি পথ ও পাথেয়র সুসংহতি এবং তত্ত্বের প্রায়োগিক উপযোগিতাও খুব জরুরি।
(মার্ক্সীয় সাহিত্যবীক্ষ:, প্রতীচ্যের সাহিত্যতত্ত্ব)
মার্কসীয় তত্ত্বের গোড়ার কথা হলো− ‘নৈর্ব্যক্তিক সত্য মানুষের চিন্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা এই প্রশ্ন আসলে তাত্ত্বিক প্রশ্ন নয়। এটা খুবই প্রায়োগিক প্রশ্ন। দার্শনিকেরা তো মূলত নানাভাবে জগতের ব্যাখ্যা করেছেন; মূল কথাটা হলো− একে বদলাতে হবে।’
অর্থাৎ−
মার্কসীয় বীক্ষা অনুযায়ী, লেখক ও শিল্পীকে কেবল পীড়া সংক্রমণের প্রতি তর্জনি সঙ্কেত করে ক্ষান্ত হলে চলে না; উপরিকাঠামো বা অধিসংগঠনের স্তরে প্রতিরোধ ও পরিবর্তনের সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখার কৃৎকৌশলও সন্ধান করতে হয়।
(মার্ক্সীয় সাহিত্যবীক্ষা, প্রতীচ্যের সাহিত্যতত্ত্ব)
একথা সমাজবিবেচনা, রাজনীতি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির মতোই সাহিত্যের ক্ষেত্রেও সত্য বলে বিশ্বাস করেছেন পৃথিবীর তাবৎ মার্কসবাদীরা। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও তার ব্যতিক্রম নন। তিনি তার চিলেকোঠার সেপাই উপন্যাসে একটি বিশেষ কাল-পরিসরের (উনিশ শ ঊনসত্তর) বাংলাদেশ (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) নামক ভূখ-ের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ‘পীড়া সংক্রমণের’ বিস্তৃত চিত্র এঁকেছেন, একইসঙ্গে তার উপরিকাঠামো স্তরে এই রোগের বিরুদ্ধে ‘প্রতিরোধ ও পরিবর্তনের সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখার’ জন্য বিভিন্ন শ্রেণির ব্যক্তি ও সমাজের যে-জাগরণ ও আত্যন্তিক লড়াই তার বিজয় কামনা করেছেন। এই ধরনের কাজ করতে গিয়ে অধিকাংশ মার্কসবাদী লেখক ইউটোপিয়ার কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। তারা ভুলে যান যে ‘শ্রমজীবীর জীবনযাপন, তাঁর ভুলভাল বা ঠিকঠাক বিশ্বাস, তাঁর সংস্কার ও কুসংস্কার,তাঁর পছন্দ-অপছন্দ, তাঁর রুচি, তাঁর ভাষা ও প্রকাশ, তাঁর শক্তি ও দুর্বলতা, তাঁর ভালোবাসা ও হিংসা এসব নিয়েই তো তাঁর সংস্কৃতিচর্চা,…।’ (সংস্কৃতির ভাঙা সেতু, সংস্কৃতির ভাঙা সেতু) ‘প্রতিরোধ ও পরিবর্তনের সম্ভাবনা জাগিয়ে রাখার’ খাতিরে ইলিয়াস সমাজবাস্তবতার বস্তুনিষ্ঠতা অস্বীকার করতে চাননি। সেজন্যে চিলেকোঠার সেপাইতে হাড্ডি খিজিরের নিচুতা-ব্যর্থতা, বামপন্থী আনোয়ারের দোলাচল ও সীমাবদ্ধতা, ওসমান গনির আত্মকণ্ডুয়ন ও পলায়নপরতাকে আড়াল করার চেষ্টা দেখি না। ইলিয়াসের এই নৈর্ব্যক্তিকতা শিল্পের দাবি রক্ষায় নিবেদিত তা বলাই বাহুল্য।
এইসব করতে গিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস যে-‘কৃৎকৌশল’ আবিষ্কার করেন তা কতটা নতুন সে প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। আসলে উপন্যাসের বিষয় ও আঙিক নিয়ে তাবৎ মার্কসবাদীদের মধ্যেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব রয়েছে। এ প্রসঙ্গে প্রধান দুটি মতের কথা উল্লেখ করা যায়। লুকাচ মনে করতেন সাহিত্যিক সৃজনশীলতার উচিৎ কখনও কোনও বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিসত্তাকে নয়, বরং সমগ্র জীবনপ্রক্রিয়াকে উপস্থাপন করা। আধুনিকতাবাদী সাহিত্যাদর্শকে তিনি প্রতিক্রিয়াশীল বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে—
আধুনিকতাবাদী অন্তর্বস্তু যেহেতু প্রতিক্রিয়াশীল, আধুনিকতাবাদের আঙিকও একইভাবে গ্রহণের অযোগ্য। শ্রেণীদ্বন্দ্ব জর্জরিত সমাজে নৈর্ব্যক্তিক বস্তুবাদের বদলে উদ্বেগ (angst) আর অবসাদ ক্লিষ্ট (ennui) জগতের ছবি কেবল ফুটে উঠেছিল আধুনিকতাবাদীর চোখে। আঙ্গিকগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার যে প্লাবন বয়ে যাচ্ছিল তখন, এর কারণ, আত্মগত উপলব্ধি সম্পর্কে এক ধরনের তাচ্ছিল্য। বিকাশমান ধনতন্ত্রের অভিঘাতে যে প্রকট ব্যক্তিবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবোধ ইতিহাস ও সামাজিক প্রক্রিয়াকে বিমূর্তায়িত করে দিয়ে অর্থহীন প্রতিপন্ন করছিল— এই সবই তার পরিণাম।
(মার্ক্সীয় সাহিত্যবীক্ষা: প্রতীচ্যের সাহিত্যতত্ত্ব)
সমসাময়িক ইউরোপীয় উপন্যাস তখন ব্যক্তিকে অতি-প্রশ্রয় দিতে গিয়ে আঙিকসর্বস্বতাকে গ্রহণ করতে ব্যাপৃত হয়েছিল; লুকাচ এই প্রবণতাকে প্রত্যাখ্যান করে প্রাচীনতর বাস্তবতাবাদী দৃষ্টিকোণে ফিরে গিয়েছিলেন। ব্রেখট তার বিরোধিতা করেন। তিনি মনে করেছেন, Methods wear out, stimuli fail. New problems loom up and demand new techniques. Reality alters; to represent it, the means of representation must alter too. লুকাচ যেখানে বাস্তববাদকে একমাত্র আদর্শ আঙিক করতে চেয়েছেন, সেখানে ব্রেখট মনে করেছেন, ‘কোনো বিশেষ যুগে বিশেষ আঙ্গিক যত বড় সাহিত্যপ্রতিভার মধ্যে বিধৃত হোক না কেন, তা নির্বিচারে অনুসরণ করা ভুল।’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও ব্রেখটের মতো প্রতীতী ধারণ করতেন। তিনি লক্ষ্য করেছেন যে, ‘নতুন সমাজবাদী চেতনাকে অবলম্বন করে বিশ্লেষণের কাজ’ করেও অনেকে ‘তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে’ উঠতে পারেননি। তার কারণ, ‘উপন্যাসের পুরনো প্রকরণটি তাঁদের সমাজবাদী চেতনাপ্রকাশের জন্য মোটেই উপযুক্ত’ প্রমাণিত হয়নি। আবার এ সত্যকেও তিনি অস্বীকার করেন না যে, ‘শুধু প্রকরণগত পরিবর্তন উপন্যাসের প্রাণসঞ্চার করতে পারে না। নতুন ভাবনা থাকলেই নতুন প্রকরণ-গঠনের অধিকার পাওয়া যায়।’
চিলেকোঠার সেপাই-এইলিয়াস সর্বস্তরে মননশীলতার চাষ করেছেন, প্লট-সংগঠনকে বারবার ভেঙেছেন-গড়েছেন, স্মৃতি ও বাস্তবকে অর্থাৎ অতীত ও বর্তমানকে পরস্পরের মধ্যে ঢুকিয়ে-মিশিয়ে নিজস্ব ধরনের জাদুবাস্তবতা নির্মাণ করেছেন। এই প্রাকরণিক প্রয়াস সম্পূর্ণ নতুন না হলেও তার প্রয়োগ, সচেতন রাজনীতি, দুর্বিষহ অর্থনীতি এবং বিদ্যুৎ ও যন্ত্রদলিত জ্বলন্ত বাস্তবতারশাহরিক পরিবেশে, অনেকটাই অভিনব। ব্যক্তির চেয়ে সমাজপ্রেক্ষিত এখানে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ ব্যক্তি ও সমাজ মিলিয়ে যে-মানুষ তাকে প্রতিফলিত করাই ইলিয়াসের লক্ষ্য। সেটা তিনি অনেকটাই পেরেছেন। তার সাহিত্যিক কৃতিরএটি একটি মাত্রা বটে।
তিন.
চিলেকোঠার সেপাই লেখা হয়েছে উনসত্তরের গণ-অন্দোলনকে উপজীব্য করে। এই আন্দোলনের অনেকগুলি অভিমুখ ছিল। প্রথমত, মোটা দাগে, আপাতঃদৃষ্টিতে,এটি ছিল আওয়ামী লীগের ছয় দফা ও ছাত্রসমাজের এগার দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন। দ্বিতীয়ত, এবং প্রত্যক্ষত, আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবসহ রাজবন্দীদের মুক্তি ছিল আশু লক্ষ্য। তৃতীয়তঃ, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, অর্থাৎ একটি সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের পাকিস্তানের ক্ষমতায় আসীন হওয়া, এবং এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বলয়সীমায় পশ্চিম পাকিস্তানী রাজনীতিক, আমলা ও সেনাচক্রের প্রাধান্য খর্ব করা। তার মানে বলা চলে, এই আন্দেলনকে আওয়ামী লীগ জাতীয়তাবাদীরং দিতে সমর্থ হলেও,প্রাথমিকভাবে ও প্রধানত, আসলে এটি ছিল পেটিবুর্জোয়াদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করার দীর্ঘ লড়াইয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এই আন্দোলনের যে-বস্তুনিষ্ঠ চিত্র এঁকেছেন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতা-কর্মী-পর্যবেক্ষকদেরমুখ দিয়ে আন্দোলনের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য, গতি-প্রকৃতি সম্পর্কে যেসব কথা বলিয়েছেন তাতে একথাই প্রতীয়মান হয়। কিন্তু কেবল ‘সমাজের বাস্তব চেহারা’র ‘স্থিরচিত্র’ ধারণ করাই তার একমাত্র লক্ষ্য নয় বলে তিনি ‘তার ভেতরকার স্পন্দন’কেও অনুধাবন করতে চেয়েছেন। সে কারণেই অন্যতম প্রধান কুশীলব হিসেবে হাড্ডি খিজির, চেংটু, করমালি, আলিবক্সদের মতো সর্বহারা শ্রমিক-মজুর-বিত্তহীন চরিত্রের সৃষ্টি, বা উগ্রপন্থী সশস্ত্র বাম ও টালমাটাল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের টানাপোড়েনের ভেতর গ্রামের নিম্নবিত্ত দরিদ্র মানুষদের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াইয়ের বিবরণ প্রাসঙ্গিকতা খুঁজে পায়। এসবের মধ্য দিয়ে বেরিয়ে আসে আমজনতার হৃদয়-নিঃসৃত সেই স্পন্দনটুকু—সেটি হলো একটি বৈষম্যহীন, শোষণহীন, গণতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাক্সক্ষা। আমজনতার এই আকাক্সক্ষাই সমাজবাস্তবতার অন্তর্বস্তু, এবং এই আকাক্সক্ষার উৎসমুখ মার্কসবাদী জীবনবীক্ষা; সেকথা ইলিয়াস নিজে স্পষ্ট করে বলেন না, বরং সমাজবাস্তবতার বহিরঙ্গে বহমান উগ্র জাতীয়তাবাদের সর্বগ্রাসী প্রভাবকে তিনি যথাযোগ্য আমলে নিয়েছেন।সে কারণে আখ্যান হিসেবেচিলেকোঠার সেপাই-এর শিল্পমূল্য প্রোপাগান্ডার অভিধায় অবনমিত হওয়ার ঝুঁকি থেকে রক্ষা পায়। আর সেজন্যে, এই উপন্যাসে উপস্থাপিত বিষয় হিসেবে উনসত্তরের গণআন্দোলনের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ও গুরুত্ব পরিস্ফুট হয়েছে। আমরা জানি, এই গণআন্দোলনের যত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতাই থাক না কেন, এর ফলেই সত্তরের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে, আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে, এবং পাকিস্তানী রাজনীতিক-আমলা-সেনা চক্রের স্বৈরতন্ত্রএকটা সর্বাত্মক যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষের ওপর। শুরু হয় একাত্তরের স্বাধীনতার সশস্ত্র লড়াই। এই যুদ্ধে বুর্জোয়া, পেটিবুর্জোয়া, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত, বিত্তহীন, সর্বহারা, জাতীয়তাবাদী, বামপন্থী, সবাই অংশগ্রহণ করে। এই লড়াই কেমন হবে, এতে কার কী ভূমিকা হবে, স্বাধীনতার পর হাড্ডি খিজির, ওসমান গনি, আনোয়ার, আলাউদ্দিন, রহমতউল্লা, খয়বার গাজী, নাদু পরামানিক, চেংটু, জালাল মাস্টার, করমালি, নবেজউদ্দিন, হোসেন আলি, পচার বাপ, আলিবক্স, হোসেন ফকির, আফসার গাজী, প্রমুখ বা এদের সমগোত্রীয়দের কার ভাগ্যে কী ঘটবে তার ইঙ্গিত ওই গণআন্দোলন থেকেই পাওয়া যায়। সেজন্যে এর গুরুত্ব অপরিসীম। বিষয়-বিবেচনায় একটি বিশাল পটভূমিকে অবলম্বন করেছেন ইলিয়াস।কিন্তু ইতিহাস রচনা তার লক্ষ্য নয়, কেননা ইতিহাস তো মূলত আধিপত্যবাদী বর্গের বিজয়গাঁথা। তাদের ইচ্ছাপূরণ। ইতিহাসের কোনও বিশেষ পর্বে আধিপত্য যাদের করায়ত্ত থাকে ইতিহাস তারাই রচনা ও প্রচার করে। এই ‘আধিপত্যবাদী বর্গ তাদের শ্রেণিস্বার্থ অনুযায়ী সমাজ-সাহিত্য-সংস্কৃতির ওপর নিরঙ্কুশ প্রভাব বিস্তার করে। নিজেদের উচ্চারণকে তারা গোটা সমাজের উচ্চারণ বলে উপস্থাপিত করে এবং বৃহত্তর জনসাধারণকেও ওই সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির শরীক করে তোলে।’ (তপোধীর) ইলিয়াস একই কালপর্বে সংঘটিত রাজধানী শহর ও নিভৃত গ্রামের দুই রকম আন্দোলনকে প্রধানত পাশাপাশি, এবং কখনও মুখোমুখি ও মেশামিশি করে দেখাতে চেয়েছেনআধিপত্যবাদী বর্গ ও প্রান্তিক আমজনগোষ্ঠীর মধ্যকার চাওয়া-পাওয়া এবং আশা-আকাক্সক্ষার সূক্ষ্ম পার্থক্যসমুচয়কে। এই পার্থক্যগুলোকে স্থুলও বলা চলে। কিন্তু আধিপত্যবাদী ইতিহাসচেতনার আড়ালে পড়ে যাওয়ার কারণে প্রায়শঃই প্রান্তিকজনের ইতিহাস অগোচরে থেকে যায়। উনসত্তরের গণআন্দোলন এবং তার পরিণাম স্বাধীনতা যুদ্ধের ক্ষেত্রে সেরকমটাই ঘটেছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আমজনতার পক্ষে, কিন্তু যেহেতু তিনি একজন শিল্পী তাই ইতিহাস রচনার পথে না গিয়ে তিনি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দৈনন্দিনের আস্তিত্বিক লড়াইয়ের স্পন্দনকে তুলে আনতে কলম ধরেন। প্রচল ধারার অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক সংগ্রামেরধারণা নিয়ে এই লড়াইকে অনুধাবন করা যাবে না। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিমানবায়নের আগ্রাসন থেকে বাঁচা এবং মানুষের সার্বিক মুক্তির পথে অগ্রসর হওয়ার আকাক্সক্ষা থেকে এ লড়াইয়ের উদ্বোধন। রাজধানী শহরের রিকশাশ্রমিক হাড্ডি খিজির আর অজগ্রামবাংলার দিনমজুর ও প্রান্তিক চাষী চেংটু-করমালি-আলিবক্সরা ভিন্নভাবে লড়াই করে যদিও তাদের আকাক্সক্ষা আসলে একই, যা শহরের মধ্যবিত্ত ওসমান গনি-আনোয়ার বা গ্রামের মধ্যবিত্ত জালাল মাস্টার, আনোয়ারের মামা-চাচাদের থেকে আলাদা। কোনটি তাহলে মুক্তির পথ? ইলিয়াস খুলে বলেন না, যদিও আমজনতার প্রতি তার পক্ষপাত অস্পষ্ট থাকে না। তবে কারো কোনো ইতিহাসই তিনি রচনা করতে চান না। তিনি কেবল এইসব আন্দোলনের অন্তর্ভূত জটিল গ্রন্থিগুলিকে শনাক্ত ও উন্মোচন করতে সচেষ্ট থাকেন। ‘সাহিত্যের বাস্তবতা মানে আধিপত্যবাদী বর্গের বাস্তবতা’− এই সত্যকে ভুলে না গিয়েও তিনি তার বিপ্রতীপে দ-ায়মান হয়েছেন। ঔপন্যাসিক হিসেবে এখানেই তার সাফল্য।
চার.
চিলেকোঠার সেপাই-এর পটভূমি ঢাকা শহর, বিশেষতঃ পুরনো ঢাকা এবং বগুড়ার গ্রামাঞ্চল। দুই ধরনের ভূগোল ও প্রকৃতির সাক্ষাৎ মেলে এই উপন্যাসে। ঔপন্যাসিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসযখন যেখানকার ছবি আঁকেন তখন সেখানকার সমগ্রতার ছবিই আঁকেন। এক্ষেত্রে তিনি ভাষাকে একটি মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষার প্রতি অনুরাগ ইলিয়াসের সাহিত্যচর্চার একটি মূল প্রবণতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে শুরু থেকেই, ছোটগল্পের মাধ্যমে। এই উপন্যাসে তার বিস্তৃত রূপ পরিদৃষ্ট হয়। আমরা এখানে তিন ধরনের ভাষার সাক্ষাৎ পাই- এক, ঔপন্যাসিকের নিজস্ব প্রতিবেদনের ভাষা; এটি মূলত প্রমিত বাংলা, যার সঙ্গে আঞ্চলিক এবং মৌখিক ভাষারও মিশেল দেখতে পাওয়া যায়। দুই, ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা; তিন, বগুড়া অঞ্চলের গ্রামীণ আঞ্চলিক ভাষা। মানুষের মুখের ভাষা তার সংস্কৃতির পরিচায়ক। ঔপন্যাসিকের কৃতিত্ব এই যে তিনি ওই তিন রকম ভাষার মধ্যে দিয়েই পাত্র-পাত্রীদের জীবনচেতনা ও সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তুলেছেন, তার নিজেকে অতিরিক্ত বর্ণনা দিয়ে তা বোঝাতে হয়নি। উপন্যাসের এটাও একটা উল্লেখযোগ্য দিক। ইলিয়াসের মধ্যে একটা আকাক্সক্ষা সম্ভবতঃ সবসময় ক্রিয়াশীল ছিল যে, তিনি বাংলাদেশের বাংলা ভাষাকে নিজস্ব চারিত্র্য দেবেন, যা তথাকথিত ‘প্রমিত’ না হয়েও নিজস্ব ধরনে প্রমিত হবে। এই প্রচেষ্টা তার ছোটগল্পের ভাষাতেই প্রথম পরিলক্ষিত হয়। চিলেকোঠার সেপাই এবং খোয়াবনামায় তার প্রয়োগ অনেকখানি সার্থকতা পেয়েছে। আমরা চিলেকোঠার সেপাই-এর ভাষাশৈলী পর্যবেক্ষণ করেদেখতে পারি।
ক. ঔপন্যাসিকের নিজস্ব প্রতিবেদন
শহরের বর্ণনা :
১.
ক্যামেরার লেন্স বোধ হয় ফরিদা, রানু, রঞ্জু এমনকি ছাদের রেলিঙ পর্যন্ত শুষে নিচ্ছে। এখান থেকে রানুর প্রোফাইলটা দ্যাখা যায়। শ্যামবর্ণের গালে রোদের ঝাপটা লেগে চামড়ার ওপর পাথরের এফেক্ট দিচ্ছে! ওর ঠোঁটে রোদের চিকন একটি আভা। উত্তেজনা, লজ্জা ও খুশিতে রানুর ঠোঁটজোড়া কাঁপছে। কি রোদ! রোদ মনে হয় কাঁচের পার্টিশনের মতো ওদেরসবাইকে ওসমানের স্পর্শের বাইরে রেখে দিয়েছে।
সিঁড়ি দিয়ে ওসমান এবার তাড়াতাড়ি নামে। সত্যজিৎ রায়ের ক্যারিকেচার এই ছোকরার ক্যামেরার ক্যারদানিতে ওদের যে ভক্তি দ্যাখা যাচ্ছে তাতে ভয় হয় যে, যাবার সময় দরজা বন্ধ করার খেয়াল থাকবে না।
২.
রাস্তা চিনতে ওসমানের অসুবিধা হয়। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। রাস্তার মোড়ে চাপা প্যান্ট পরা কয়েকটা ছোকরা পোজ মেরে দাঁড়িয়ে আশেপাশের বাড়ির জানলা ও দোতলার বারান্দা সার্ভে করছে।
গ্রামাঞ্চলের বর্ণনা :
১.
ঝুলন্ত ও মাটিতে-গাঁথা ঝুড়ির মাঝে মাঝে শুকনো পাতা, হলদে ঘাসে-ঢাকা জমির কোথাও কোথাও ছোট বড়ো আকারের রোদ ও ছায়ার কারুকাজ। রোদ এখানে ঢোকার ফাঁক পেলো কোথায়?… মাথার ওপর বটশাখার বীমের ওপর ঘন বটপাতার বিস্তৃত ছাদ।…
২.
আনোয়ার শুনতে পাচ্ছে যে হোসেন আলি ফকির ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মেরে পচার বাপের মৃতদেহ ছিনিয়ে আনার সমবেত সংকল্প ঘোষণার চিৎকার বটগাছের শিশির-ভেজা পাতায় সপসপ এবং নিচের শুকনা পাতায় সরসর সাড়া তুলছে। চাঁদের অল্প আলোয় দ্যাখা যায় যে গোটা বটগাছ তার ডালপালা, পাতার বহর,ঝুড়ি. আম, শিকড় ও ছাদ নিয়ে তিরতির করে কাঁপছে। আর ঐ জীন? না, বটগাছের পুরনো বাসিন্দার কোনো সাড়া নাই, মানুষের সমবেত আওয়াজে টিকতে না পেরে সে শালা নতুন করে উড়াল দিয়েছে অন্য কোথাও।মাটিতে বসে থেকেও আনোয়ারের পা কাঁপে।…
খ. চরিত্রদের ডায়লগ
শহরের শিক্ষিত মানুষের কথা :
১.
‘তাহলে কোটি কোটি বাঙালি যে হাজার হাজার বছর ধরে এক্সপ্লয়টেড হয়ে আসছে সে কার হাতে? দেশের ভেতরেই এক্সপ্লয়টার থাকে, …ট্যাক্স বসাবার রাইট চাও? কে বসাবে?— কার ওপর?— এই দুই বাঙালি কি একই ধরনের?… বাঙালি সেনাবাহিনী হলেই বাঙালি উদ্ধার হবে? বাঙালি আর্মি তখন চেপে বসবে বাঙালির ওপরেই, বাঙালি ছাড়া আর কার ওপর দাপট দ্যাখাবার ক্ষমতা হবে তার?… তোমরা ওয়েস্ট পাকিস্তানের হাত থেকে ইম্যানসিপেশনের কথা বলছো, কিন্তু কাদের জন্যে?’
‘ইস্ট পাকিস্তানের পিপলের জন্য।’
‘না। ট্যাক্স বসাবার রাইট পিপল পায় না, পিপলের রাইট শুধু ট্যাক্স দেওয়ার। বাঙালির হাতে পাওয়ার চাও তো? মানে বাঙালিদের এক্সপ্লয়েট করার লাইসেন্স চাও?’
২.
মিটিং থেকে বেরুবার পর থেকেই আনোয়ারের মেজাজ চড়ে আছে, ‘ব্যাটারা আছে খালি নিজেদের নিয়ে। নিজেদের লিডার, নিজেদের পার্টি ছাড়া কথা নেই।’ ওসমান বলে, ‘নিজেদের কথা বলবে না কেন? পার্টিগুলো তো আর মার্জড হয়ে যায়নি।’
শহরের অশিক্ষিত মানুষের কথা
১.
‘জুম্মন? জুম্মনের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে?’
‘থাকবো না ক্যালায়?’ ওসমানকে অবাক হতে দেখে খিজির আরো অবাক হয়, ‘ডেলি ডেলি আমার কাছে আহে। জুম্মনে কয়, “মায়ে যাইতে কইছে। কিজানি কইছে।” তয় আমি গেছি পরে অর মায়ে কান্দে।’
…
এবার খিজির দমে যায়। বিড়িতে ফের কয়েকটা টান দিয়ে বলে, ‘জুম্মনরে মানুষ করবার চায়। বড়োলোকের বাড়ি কাম কইরা অর নজরখান হইছে বড়ো। খালি এক প্যাচাল পাড়ে, ল্যাহাপড়া শিখাইয়া জুম্মনরে বেরি ট্যাকসির মাহাজন বানাইবো!’
‘তোমার সঙ্গে থাকলে জুম্মন মানুষ হবে না?’
এ ব্যাপারে খিজিরের সন্দেহ আছে! ‘আমি একটা ভ্যাদাইমা মানুষ। কহন কৈ থাকি ঠিক নাই। পরের পোলারেহুদাহুদি লইয়া—।’…
গ্রামের মানুষের কথা
১.
জালাল মাস্টার বলে, ‘তুই না আমাক আসতে বললি? তোর জ্যাঠা কৈ? তাক কয়া দেখি, এখন হাল গোরু দিবো, ফসল উঠলে তুই উপযুক্ত— ।’
‘তোর গোরু কোটে?’ করমালির এই নির্লিপ্ত প্রশ্নে জালাল মাস্টার অবাক হয়, বিরক্তও হয়, ‘মানে?’
করমালি হাসে, গোরুর প্রকসি দেওয়াজনিত কারণে ক্লান্তি তার এখন কেটে গেছে। বড়ো বড়ো দাঁতে সে বিরাট হাসি ছাড়ে, ‘চাচামিয়া, গোরু এটেকার কারু নাই। তালপোঁতার ব্যামাক মানুষের এখন চারটা কর্যা পাও নাগবো, পছন্দ হলে সোগলির মাথাত জোড়া জোড়া শিঙের বন্দোবস্ত করেন।’
বেশকিছু দীর্ঘ উদ্ধৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্য ইলিয়াসের ভাষার ব্যবহার ভালো করে বুঝে নেওয়া। দেখা যাচ্ছে, ইংরেজি শব্দ ব্যবহারের প্রতি তার বিশেষ ঝোঁক রয়েছে।শিক্ষিতজনের ডায়লগে ইংলিশ শব্দের ব্যবহারের যুক্তি সহজবোধ্য, যদিও সেটাও অনেক ক্ষেত্রেই বাহুল্য মনে হয়। কিন্তু তার নিজের বর্ণনাতেও অহরহ ইংলিশ শব্দের ব্যবহার আমাদের সচকিত করে। আমরা আরও অবাক হই যখন তিনি এমনকি গ্রামীণ পটভূমির বর্ণনায়ও ইংলিশ শব্দ (বটশাখার বীমের, গোরুর প্রকসি) ব্যবহার করতে দ্বিধা করেন না। এই ভাষা যে পরিকল্পিতভাবে তৈরী তা বলাই বাহুল্য। অনেকেরই এই ভাষা পছন্দহবে না, কিন্তু তারাও স্বীকার করবেন যে, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর মধ্য দিয়ে তার নিজের একটি ভাষাশৈলী নির্মাণ করতে চেয়েছেন। তিনি মানুষের দৈনন্দিন মুখের ভাষাকে সাহিত্যিক মূল্যে উন্নীত করতে প্রয়াসী হয়েছেন।প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মুখের ভাষা ব্যবহারে তার সাবলীলতা ও অকৃত্রিমতা প্রশংসনীয়।
পাঁচ.
‘কথাসাহিত্যের সূত্রপাতই হল ব্যক্তির মুক্তিস্পৃহাকে প্রকাশ করার উদ্দেশ্যে। সামন্ত প্রতিষ্ঠানসমূহের পরোয়া না-করে সমাজের ও মানুষের, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধের চুলচেরা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ব্যক্তির বিকাশসাধনই ছিল উপন্যাসের কাজ।’
(উপন্যাস ও সমাজবাস্তবতা: সংস্কৃতির ভাঙা সেতু)
কিংবা ‘কথাসাহিত্য ব্যক্তির মুক্তিপ্রয়াসের আর-একটি উদ্যোগ—আরও ব্যাপক, আরও সংগঠিত এবং আরও দায়িত্বশীল।’ এই কথাগুলি আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের। উপন্যাস বলতে আমরা এখন যে শিল্প-প্রকরণকে বুঝি তার উদ্ভব ইউরোপে, শিল্প-বিপ্লব-পরবর্তী সমাজ-পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে, ইলিয়াস যেমন বলেছেন— ‘একটি সমাজব্যবস্থা ভেঙে যখন আরেকটি ব্যবস্থার নির্মাণ চলছে, উপন্যাস লিখিত হতে শুরু করে তখন থেকে।’ আবার তিনি এ-ও বলেন যে, ‘কথাসাহিত্যের চর্চার সূত্রপাত মানুষ যখন ব্যক্তি হয়ে উঠছে এবং আর দশজনের মধ্যে বসবাস করেও ব্যক্তি যখন নিজেকে ‘একজন’ বলে চিনতে পারছে তখন থেকে।’ আসলে শিল্প-বিপ্লবের পরে সামন্তব্যবস্থার ধ্বংশস্তূপের ভেতর থেকে যে-পুঁজিবাদী সমাজের উদ্ভব ঘটতে শুরু করে সেখানে ব্যক্তি সমাজের মধ্যে থেকেও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকে।তবে এ হলো আসলে ইউরোপের চিত্র। বাংলা ভাষায় উপন্যাসের সৃষ্টি আরো অনেক পরে, ইউরোপের অনুকরণ ও অনুসরণের সূত্রে, সমাজ বা ব্যক্তির কোনও সংকট থেকে নয়;এর সঙ্গে ঔপনিবেশিকতার একটি সম্পর্ক রয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষে বা এমনকি বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও, এদেশে ‘ব্যক্তি’র সৃষ্টি হয়নি। এদেশের কোনও মানুষ তখনও পরিবার ও সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার চিন্তাও করতো না। বরং ঔপনিবেশিক শাসন-শোষণের প্রেক্ষাপটে তার পক্ষে যুথাবদ্ধতা এড়ানো সম্ভবপর ছিলো না। তারপরেও এদেশে উপন্যাস তৈরি হয়েছে। উপন্যাস লিখতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই লেখককে ‘ব্যক্তি’র সন্ধান করতে হয়েছে। কেউ ‘ব্যক্তি’র আমদানি করেছেন ইউরোপ থেকে। আর অন্যরা যে-দেশী ‘ব্যক্তি’র কল্পনা করেছেন সে এতটাই সমাজ-লগ্ন, পর-নির্ভর, দ্বিধাগ্রস্ত, সংস্কারাচ্ছন্ন, এককথায় রুগ্ন যে প্রকৃতপক্ষে তাকে ‘ব্যক্তি’ বলা যায় না।আজ পর্যন্তও এ পরিস্থিতির খুব বেশি একটা পরিবর্তন ঘটেনি। সে কারণে বাংলা উপন্যাসে সত্যিকারের ‘ব্যক্তিচরিত্র’ দুর্লভ। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এ ব্যাপারে পুরো সচেতন ছিলেন, যদিও তিনি বিষয়টিকে দেখেছেন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত থেকে। তিনি বলেছেন, ‘…কেউ চাক আর না-ই চাক বুর্জোয়াব্যবস্থার ধ্বংশ একেবারে অনিবার্য। বুর্জোয়া সাহিত্যের প্রধান বিষয় ব্যক্তিও আজ এতটা রুগ্ন যে তার মৃত্যু আসন্ন।’ ‘ব্যক্তি’ যে বুর্জোয়াব্যবস্থার সৃষ্টি তা সত্যি, আর সেক্ষেত্রে বুর্জোয়াব্যবস্থা ধ্বংশ হলে ব্যক্তির মৃত্যু হবে তাও স্বাভাবিক। তাহলে উপন্যাস লিখিত হবে কাকে নিয়ে? তার উত্তর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস দিয়েছেন তার ‘উপন্যাস ও সমাজবাস্তবতা’ প্রবন্ধে। তিনি বলেছেন, ‘এখন নতুন সমাজব্যবস্থার জন্য মানুষের সংকল্পে শরীক হওয়া শিল্পীর প্রধান কর্তব্য। সমাজবাস্তবতা উপন্যাসের প্রেক্ষিত বলে ঔপন্যাসিক এখানে বড় দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম। মানুষকে ব্যক্তি-খোলসের ভেতর থেকে বার করে এনে তাকে প্রকৃত মানুষ করে তোলা দরকার। ব্যক্তি এখন মানুষ হয়ে উঠবে।’ সমাজকে বাদ দিয়ে কোনও ব্যক্তি পূর্ণাঙ্গ মানুষ হতে পারে না। তিনি এর আরও একটু ব্যাখ্যা দিয়েছেন এইভাবে— ‘শুরু থেকে তিনিও (কথাসাহিত্যিক) তৎপর, ব্যক্তির স্বরূপসন্ধানে। কিন্তু তাঁকে এই কাজটি করতে হয় চারপাশের প্রেক্ষিতকে গুরুত্ব দিয়ে।’ অর্থাৎ এখনকার উপন্যাসে সমাজপ্রেক্ষিত এবং ব্যক্তি ও সমাজের আন্তঃসম্পর্ক গুরুত্ব পেতে থাকবে।
চিলেকোঠার সেপাই-এ আমরা দেখি কোনও চরিত্রই সম্পূর্ণ ‘ব্যক্তি’ হিসেবে দাঁড়াতে পারে না। তারা প্রত্যেকেই হয় মনস্তাত্ত্বিকভাবে দুর্বল, দ্বিধান্বিত ও আপোসকামী, যেমন ওসমান, আনোয়ার, আলাউদ্দিন, জালাল মাস্টার, নাহয় ব্যক্তিহিংসা বা গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে ক্রোধান্বিত, যুক্তি-বুদ্ধিহীন, পক্ষপাতদুষ্ট, যেমন হাড্ডি খিজির, চেংটু, আলিবক্স। ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, নিজ-নিজ অবস্থান থেকে, এরা প্রত্যেকেই সংগ্রামী, কিন্তু শেষ পর্যন্ত একেকজন ‘চিলেকোঠার সেপাই’ ছাড়া আর কিছু নয়। ‘ব্যক্তি’র এই অবনয়ন, বা অসহায়তা, বা দুর্দৈব, বা ব্যর্থতা, যাই বলি না কেন তার কারণ নিহিত রয়েছে তার সমাজবাস্তবতার মধ্যেই। উনসত্তরের গণআন্দোলন একটি বহুমাত্রিক রাজনৈতিক ঘটনা; আবার গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের যে-লড়াই তার মধ্যে ব্যক্তিক ও সামাজিক স্বার্থই প্রধান যদিও তার সঙ্গেও রাজনীতি ওতপ্রোত জড়িত। এই দুটি ঘটনা কখনও পরস্পরের সহযোগী, আবার কখনও মুখোমুখি দাঁড়ায়। তার কারণ, একেকজনের স্বার্থ যেমন একেক রকম, তেমনই প্রত্যেকেই পরস্পরের সঙ্গে বিভিন্ন রকম সম্পর্কসূত্রে আবদ্ধ। প্রায় ক্ষেত্রেই এইসব স্বার্থ ও সম্পর্কের সমন্বয় ঘটতে পারে না। ফলে প্রত্যেককেই একেক সময় একেক ধরনের সমঝোতা করতে হয় এবং বারবার অবস্থান বদলাতে হয়। তারা কেউই যেহেতু পূর্ণাঙ্গ ‘ব্যক্তি’ নয় তাই তারা এইসব স্বার্থ, সম্পর্ক ও পরিবর্তমান অবস্থানকে অস্বীকার করতে পারে না। ইলিয়াস এইসব জটিলগ্রন্থি শনাক্ত করেছেন, এবং সেই সূত্রে ‘শুরু থেকে তিনিও তৎপর, ব্যক্তির স্বরূপসন্ধানে।’ সেজন্যেই তাদের প্রত্যেককে পৃথকভাবে চিনে নেওয়া সম্ভব হয়, যদিও চরিত্রগুলো পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তি নয়।
ওসমান গনির ‘ব্যক্তি’ হয়ে ওঠা সম্ভবপর ছিলো। কেননা, সে একাকী মানুষ। সে পরিবার থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন, সামাজিক ও রাজনৈতিক বন্ধনও ছিলো না তার। তারপরেও সে ব্যর্থ হলো কেন তার কার্যকারণসূত্র ঔপন্যাসিক বিবৃত করেন না। তার স্মৃতির ঘোর কাটে না, মাথাব্যথা-অ্যাসিডিটি যায় না, প্রেম-যৌনতাও তাকে সুস্থ পথে টানতে পারে না। সে রাজনীতির আকর্ষণ অস্বীকার করতে পারে না, কিন্তু তাতে স্বেচ্ছায় সক্রিয় অংশ নিতেও সক্ষম হয় না। ‘ওসমানের ভয় হয় মূল স্রোতধারা থেকে ছিটকে পড়ে একটি নিঃসঙ্গ জলবিন্দুর মতো সে আবার হাওয়ায় শোষিত না হয়।’ তার মানে তার সংকটকে সে বোঝে। তারপরেও সে নিরুপায়। শেষ পর্যন্ত সে উন্মাদ হয়ে গেল।তবে এই অসুস্থতাই তাকে বদ্ধ চিলেকোঠা থেকে বাইরে বেরিয়ে আসার সাহস (নাকি উন্মাদনা!) সরবরাহ করে। সে ঢাকা শহরের শূন্য পথ ভেঙে এগিয়ে চলে। কোনদিকে যাবে সে? জানা নেই। কারণ তার এই পথচলা সজ্ঞান ও সচেতন প্রয়াসের ফল নয়, যদিও উপন্যাসের ফ্ল্যাপে বলা হয়েছে— ‘সবার অগোচরে সে বেরিয়ে আসে রাস্তায়, কারফ্যুর দাপট অগ্রাহ্য করে। তার সামনে এখন অজস্র পথ। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ— সব দিক তার খোলা। ওসমান যেদিকেই তার পা বাড়ায় সেদিকেই পূর্ব বাঙলা।’তপোধীর ভট্টাচার্য ওসমানের এই উন্মাদত্বকে রূপক অর্থে গ্রহণ করে একে মুক্তিলাভের একটা প্রতীকী প্রচেষ্টা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। সে যাই হোক, ওসমান যে একজন উপনিবেশিত রুগ্ন ন্যুব্জ দিগ্ভ্রান্ত অসম্পূর্ণ ব্যক্তিমানুষ তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
আনোয়ার তাত্ত্বিকভাবে শিক্ষিত রাজনৈতিক কর্মী। কিন্তু গ্রামে গিয়ে সে পরিবার, সমাজ ও রাজনীতির নানামুখি জটিল সম্পর্কের মধ্যে পড়ে অবদমিত, হতাশ ও দিগ্ভ্রষ্ট হয়ে যায়। তার এতদিনের তাত্ত্বিক শিক্ষা ও অনুশীলন কাজ করে না। সে শহরে ফিরে আসে।গণআন্দোলনের চরম লগ্নে যে-চিলেকোঠার-বন্দিত্ব থেকে বেরিয়ে আসে ‘পাগল’ ওসমান, সেই চিলেকোঠায় নিশ্চিন্তে ঘুমায় আনোয়ার। সে গ্রামের আমজনতার সংগ্রামের পক্ষে থেকেও যেমন তাদের একজন হতে পারে না, তেমনই শহরের গণ-আন্দোলনে সক্রিয় থেকেও শেষ পর্যন্ত নিরাপদ দূরত্বকে বেছে নেয়। একজন সম্ভাবনাময় ব্যক্তির পতন ঘটে এইভাবে।
আলাউদ্দিন সত্যিকারের পেটিবুর্জোয়া চরিত্র। গণআন্দোলনের প্রধান শরীক দলের নেতা হয়েও আত্মীয়তা ও শ্রেণিস্বার্থে সে শোষক-নিপীড়কমহাজন রহমতউল্লাদের সঙ্গে সমঝোতা স্থাপন করে। ঠিক যেমন, বিপরীতক্রমে, গ্রামের গণধিকৃত নিপীড়ক আফসার গাজী ভোল পাল্টে গণআন্দোলনের পক্ষের নেতা বনে যায়। এ যেন একই মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ।
হাড্ডি খিজির এদের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল, কিন্তু তার সক্রিয়তা যতটা না রাজনৈতিক অর্থাৎ ‘আদর্শিক’, তার চেয়ে অনেক বেশি ব্যক্তিক্ষোভের ফল।মহাজন রহমতউল্লার ভোগের শিকার হয়ে তার মা মৃত্যুবরণ করেছে, তার বউকেও সে ভোগ করছে; সে নিজেও তার শোষণের শিকার। এই ক্ষোভকে সে রাজনীতির সঙ্গে মিশিয়েছে। তারপরেও সে নির্ভয়ে মিছিলে গিয়েছে, গুলি খেয়ে মরেছে। এই চরিত্রটি পাঠকের সহানুভূতি আকর্ষণ করে, কিন্তু উপন্যাসের ‘ব্যক্তি’ হয়ে উঠতে পারে না।
জালাল মাস্টার যতই সদিচ্ছাসম্পন্ন মানুষ হন না কেন, তার উদারপন্থা আপোসেরই নামান্তর হয়ে ওঠে। তাকে কাপুরুষ ভাবা অযৌক্তিক হবে না।
উগ্রপন্থী চেংটু এবং আলিবক্স চরিত্র দুটি হাড্ডি খিজিরের মতো; তাদের দুর্বলতা রাজনৈতিক শিক্ষার ও সমাজদর্শনের। আঞ্চলিকতা, তাৎক্ষণিকতা এবং আবেগের আধিক্য তাদেরকে ব্যর্থ করে দেয়।
এইসব চরিত্র যে ‘ব্যক্তি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায় না সে দোষ যেমন ওইসব চরিত্রের নয়, তেমনই ঔপন্যাসিকেরও নয়। সমাজপ্রেক্ষিতটাই এখানে নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা পালন করে। এটা এমন একটা ভয়ঙ্কর দুর্যোগের সময়, যখন সমাজ ভাঙছে, কিন্তু ব্যক্তির উত্থান ঘটছে না। ফলে ব্যক্তি ও সমাজ দুই-ই ব্যর্থ হচ্ছে। মানুষের মুক্তি হয়ে উঠছে সুদূরপরাহত। এই উপন্যাস ইঙ্গিত দিচ্ছে এইসব গণআন্দোলনের পরিণামে উনিশ শ একাত্তর সালে যে-মুক্তিযুদ্ধ হবে তাও আমজনতার মুক্তি নিশ্চিত করতে পারবে না। শোনা যায় করমালি, চেংটু ও আলিবক্সদের সামনে রেখে মুক্তিযুদ্ধ ও তারপরের ঘটনাবলী নিয়ে একটি উপন্যাস লিখতে চেয়েছিলেন আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। এই অলিখিত উপন্যাসটি লিখিত হলে পুরোপুরি বোঝা যেত ইলিয়াস ‘ব্যক্তির স্বরূপসন্ধান’ করে কী পেয়েছেন শেষ পর্যন্ত।আর সমাজপ্রেক্ষিতটাই বা কী রকম বদলেছে, কার দ্বারা, কতটুকু। সে সুযোগ আমাদের আর হবে না। কিন্তু একটি প্রশ্নের উত্তর আমাদের খোঁজার চেষ্টা করা উচিত। সেটি হলো, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস নিজে যে-সমালোচনা করেছেন— ‘…এঁদের প্রায় সবাই বুর্জোয়াব্যবস্থার সৃষ্টি ব্যক্তির রুগ্নতা, নিঃসঙ্গতা, অবক্ষয়কেই বিশ্লেষণ করেছেন এবং তাও স্যাঁতসেঁতে সহানুভূতি দিয়ে।’— তা কি তার বিরুদ্ধেও যায় না? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগে আমরা ইলিয়াসের এর পরের আরও কিছু কথা শুনে নেই:
যাঁরা নতুন সমাজবাদী চেতনাকে অবলম্বন করে বিশ্লেষণের কাজ করেছেন তাঁরা তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠতে পারেননি। এর কারণ হল, উপন্যাসের পুরনো প্রকরণটি তাঁদের সমাজবাদী চেতনাপ্রকাশের জন্য মোটেই উপযুক্ত নয়। শুধু প্রকরণগত পরিবর্তন উপন্যাসের প্রাণসঞ্চার করতে পারে না।নতুন ভাবনা থাকলেই নতুন প্রকরণ-গঠনের অধিকার পাওয়া যায়। যাঁরা নিজেদের সমাজবাদী বলে বিবেচনা করেন ও পুরনো ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ভেঙে ফেলার উদ্যোগে সক্রিয় সংকল্পে শরিক হন তাঁরা এই অধিকারটি প্রয়োগ করবেন। উপন্যাস গঠিত হবে সেইভাবে যাতে করে নতুন ভাবনাকে ঠিকমতো ধারণ করা যায়। নইলে এই সময়ের মানুষের বেদনা ও বিক্ষোভ, সংকট ও সংকল্পের তাৎপর্যপূর্ণ প্রতিবেদন দেওয়া উপন্যাসের সাধ্যেরবাইরেই থেকে যাবে।
(উপন্যাস ও সমাজবাস্তবতা: সংস্কৃতির ভাঙা সেতু)
বিভিন্ন প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকারে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস উপন্যাস সম্পর্কে যেসব পর্যবেক্ষণ ও প্রতীতী উপস্থাপন করেছেন তার ভিত্তিতে তাঁর সাহিত্যকৃতির ব্যাখ্যা পেতে গেলে সমস্যা সৃষ্টি হবে। কারণ, যা হওয়া উচিৎ বলে তিনি সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, অনেক ক্ষেত্রেই তিনি নিজেও তার বাস্তবায়ন দেখাতে পারেননি। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে তাঁর আকাক্সক্ষাকে অনুধাবন করা সম্ভব। ব্যক্তি ও সমাজ নিয়ে আর-আর সব মার্কসবাদীর মতো তাঁর মধ্যেও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিলো হয়তো। তার কারণ নিহিত রয়েছে তাঁর আকাক্সক্ষার মধ্যেই। ‘ভদ্রলোক’ কেন ‘বুর্জোয়া’-সমান হল না এই অবান্তর প্রশ্ন নিয়ে মাঝেসাঝে বড়ই কাতর হয়ে পড়েছেন’ তিনি। (শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, ভূমিকা, সংস্কৃতির ভাঙাসেতু) তাছাড়া ‘ইলিয়াসের আদর্শ ‘ব্যক্তি’ আসলে দ্বিধাবিভক্ত, দ্বৈতসত্তার : সে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়ক আবার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথিকৃৎ-ও।’অর্থাৎ এদের আকাক্সক্ষা আছে, সংগ্রাম আছে, আবার তার সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতাও আছে। কিন্তু ঔপন্যাসিক সেই সীমাবদ্ধতা ও দুর্বলতাকে ফেনিয়ে তুলতে চান না। তিনি সমাজবাদী চেতনাকে নতুন আঙিকে ফেলে ওইসব অসম্পূর্ণ ব্যক্তিমানুষকেই আবিষ্কার করতে চান। কারণ, তিনি বিশ্বাস করেন, কোনওবিশেষ কালের শিল্পকর্ম সৌকর্য লাভ করতে পারে তার উপযুক্ত সমাজপ্রেক্ষিতের ওপর দাঁড়িয়ে, এবং তার অন্তর্নিহিত সমাজচেতনার শক্তিতে; ব্যক্তির ব্যর্থতা এতে খুব বড় বাধা হতে পারে না।যথার্থ শিল্পী কালিক বৈশিষ্ট্যকে বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করেন মূলত সামাজিক বা সামষ্টিক অভিজ্ঞতায় জারিত করে, এবং তার মধ্যেই চারিয়ে দেন যুগাতিক্রমী ভবিষ্যৎমুখিতাকে। সমাজবাদীরা একেই বলেন প্রগতি। ‘চিলেকোঠার সেপাই’ অভিধাটি বিদ্রূপাত্মক; ওসমান, আলাউদ্দিন, আনোয়ার, শওকত, হাড্ডি খিজির, প্রমুখ,প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই এই অভিধাটি প্রযোজ্য। কিন্তু উপন্যাস চিলেকোঠা সেপাই যে-সমাজপ্রেক্ষিত ও চেতনাকে আকৃত করেতা একদিকে অতীতের নবমূল্যায়ন করে, অন্যদিকে ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকেও আভাসিত করে। সে কারণে এটি গণস্বপ্নের আখ্যান হয়ে উঠেছে—তার অতীত আছে, বর্তমান আছে, ভবিষ্যতও দৃশ্যমান, প্রাকরণিক কৃৎকৌশল যদিও অভিনব নয় তেমন।