কাজী নাসির মামুন—একাধারে কবি, গল্পকার ও প্রাবন্ধিক। ‘কাক তার ভোরের কোকিল’ তাঁর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থ। একালের কবিতাকে সংজ্ঞায়িত বা এর চরিত্র বিম্বিত করতে গিয়ে প্রখ্যাত সমালোচক আবু সয়ীদ আইয়ুব বলেছেন—‘এর চরিত্র অবিশ্বাসের, অনাস্থার, অমঙ্গল চেতনার, বিবমিষার, অবক্ষয়, ক্লেদ আর হতাশার। এ কবিতায় কোনো সৌন্দর্যের অনুধ্যান নেই, মহত্ত্বের প্রত্যাশা নেই। কোনো ভবিষ্যৎ নেই। নিজের কিংবা অন্য কারো প্রতি, সমাজ কিংবা দেশের প্রতি তথা মানুষের প্রতি কোনো দায়দায়িত্ব এ কবিতা স্বীকার করে না’। তাঁর এই উক্তি থেকে বোঝা যায়, আধুনিক কবিতায় সর্বগ্রাসী নাস্তিবোধ, অতলান্ত হতাশা, নিষ্ক্রমণহীন অন্ধকার এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দুর্বহ ভারগ্রস্ততা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কথাটা ঘুরিয়ে বললে এ রকম দাঁড়ায়—প্রথম মহাযুদ্ধ-উত্তর পৃথিবীর নীরন্ধ্র তমিস্রাকে ইতিহাস নির্ণীত পরিণাম এবং সভ্যতা ও মানবতার পতন মুহূর্তের মতো দুর্লঙ্ঘ্য নিয়তি বলে মেনে নিয়েই রচিত হতে হবে এ যুগের কবিতা, আশা কিংবা উত্তরণের পথ বন্ধ করে দিতে হবে। নইলে সে কবিতা কোনো ক্রমেই আধুনিক যুগোপযোগী কিংবা প্রগতিশীল সমাজ সচেতন শিল্প হবে না। কিন্তু কবি কাজী নাসির মামুন এ বক্তব্যকে স্বীকার করেন না, বরং তার দীর্ঘ সময়ের কাব্য সাধনায় তিনি কবিতাকে জীবনার্থে সৎশিল্পের নন্দনলোকে পৌঁছে দিয়েছেন।
তাঁর কবিতায় তিনি প্রশান্ত সঞ্জীবনী প্রেমের প্রতিষ্ঠা ব্যক্তি জীবনকে কেন্দ্র করে প্রত্যাশা করেছেন। কবির মিথকল্প ও লোক ঐতিহ্য সন্ধান আবিশ্ব পরিভ্রমণ শেষে, কখনো সমন্বিত রূপে, কখনো সম্পূর্ণ দেশজ লোকসংস্কৃতির অনুষঙ্গে স্পর্শ করেছে বৃহত্তর সমাজ জীবনকে-কবির দ্বান্দ্বিক ইতিহাসচেতনা জগৎজোড়া সভ্যতার সংকট ও সাধারণ মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কার্যকারণ অনুসন্ধান করতে চাইছে।
ব্যক্তিগত অনুভূতিকে তিনি সার্বজনীন করে তুলেছেন তাঁর বোধ ও শৈল্পিক চেতনায়। তাঁর কবিতায় উচ্চারিত হয়—
বিমর্ষ রাতের হুইসেলে
একটি ফিরতি ট্রেন চলে গেলে
আলস্য নির্ভর এই ভেঁপুবারান্দায়
রাতভর জেগে থেকে
আমার কেবলি মনে হয়;
আঁচলগল্পের ছায়াতলে কতোকাল
আমাদের জননীকে
. ‘মা’ বলে ডাকি না।
(বিউগল)
বিমর্ষ রাতের হুইসেলে একটি ফিরতি ট্রেন চলে যায়। আধ্যাত্ম চেতনায় কবির এই হুইসেল যেন চলে যাওয়ার বারতাকে মনে করিয়ে দেয়। ফিরতি ট্রেনের মতো আমাদের সবাইকেই একদিন চলে যেতে হবে আসল গন্তব্যে। আলস্যনির্ভর ভেঁপুবারান্দায় কবির মনে জাগে আঁচলগল্পের ছায়াতল সদৃশ জননীর কথা। যে জননীকে কতকাল ‘মা’ বলে ডাকা হয়নি।
পৃথিবীতে সবেচেয়ে ছোট এবং মধুর ডাক ‘মা’। সেই মা-কে ডাকতে না পারার আক্ষেপ ব্যক্ত করেছেন কবি। কবিতায় আমার শব্দটি ব্যবহার না করে আমাদের ব্যবহার করাতে এই ‘মা’ সর্বজনীন মা-তে পরিণত হয়েছে। এখানেই শিল্প সৃষ্টিতে কবি কাজী নাসির মামুন সার্থক স্রষ্টার পরিচয় দিয়েছেন।
আবর্তিত বেদনার শহর চাপিয়ে দিলে
মায়াউনুনের পাশে
. গ্রামীণ পিঠার ব্যর্থ ভাবালুতা
যেভাবে নিঃশেষ হয় প্রতিদিন শীতার্ত সন্ধ্যায়
বিলীন স্বপ্নের তীর হয়ে সেরকম
আমি কি পথের কালো? পিচঢাকা তোমার আত্মায়
. মর্মযন্ত্রণার ইট গাঁথি?
(নির্মাণ)
এই কবিতায় ফুটে উঠেছে কবির স্বগতোক্তিমূলক আত্মাজিজ্ঞাসা। শহরের ঘোর চক্রে বিলীন হয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ ঐতিহ্য। আবর্তিত বেদনার শহরে মায়াউনুনের পাশে সেই গ্রামীণ পিঠার স্মৃতি আজ শুধুই ব্যর্থ ভাবালুতা, যা প্রতিদিনের শীতার্ত সন্ধ্যায় নিঃশেষ হয়ে যায়। তাই পিচঢাকা শহরের আত্মায় কবি মর্মবেদনায় ইট গাঁথেন।
কবিতায় ব্যবহৃত ‘মায়াউনুন’ এবং ‘গ্রামীণ পিঠা’ শব্দ দুটি গ্রামীণ ঐতিহ্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, আবহমান বাঙালি সংস্কৃতির সুদৃঢ় মহীরুহ পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রবল ঝঞ্ঝাবাতে উনিশ শতকের শেষাবধি পর্যন্ত দারুণভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়। রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রমুখের প্রচেষ্টায় তা মেরামত প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলেও প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর ইউরোপের বৈনাশিক ঘূর্ণি হাওয়া তাকে পুণরায় খণ্ড-বিখণ্ড করে ফেলে। সেই থেকে বাঙালির জমাট-বাঁধা সংস্কৃতি চেতনার জীর্ণদশা শত বর্ষেও পুনর্গঠিত হতে পারেনি। স্মর্তব্য যে, অতীত আমাদেরকে নতুন করে কিছু দেবেনা সত্য কিন্তু তার মূল্যায়ন অপরিহার্য, কেননা সেটাই আমাদের শেকড় এবং তা আমাদের নবচেতনার উন্মেষে সহায়ক।
যদি এই বিবাহবিচ্যুত দিনে
কুণ্ঠিত যৌবন পরাজিত হয়
মেসের বাসিন্দা হই সময়ের ঘৃণিত প্রহর
চুম্বন স্পর্ধার এক আবিষ্ট সংগ্রামে
আমাকে ভেবো না ছেঁড়া পতাকার মতো
ভূলুণ্ঠিত সেবাদাস; উদ্ধত স্বপ্নের পিছু
বঞ্চিত সবুজ; লাল বর্তুলে অর্জিত অধিকার ছাড়া
. পরাস্ত রক্তের হাহাকার।
(ব্যাচেলর)
বর্তমান বিশ্বের সভ্যতার সংকট ও মানবীয় মুক্তির তথা সংকট উত্তরণের একমাত্র উপায় মার্ক্সবাদে স্থিতি। শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে বুর্জোয়া শোষকদের পতন ঘটিয়ে মেহনতি মানুষের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হলেই মানুষের দুঃখ-দুর্দশা দূর হবে- সাম্যবাদী অর্থবস্থায় বঞ্চিত নিরন্ন মানুষের সুখ শান্তি ও আত্মবিকাশের উন্মুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে।কবির কবিতা হবে প্রত্যাশিত মানবতার মুক্তির অভিসারী।
একালের উপলব্ধি নিখিল নাস্তিবোধ তথা যুগজ্বর (Fever of the age) বাহিত সমস্যা সংকট যন্ত্রণা প্রভৃতিকে তিনি সুনির্দিষ্ট কারণে মনুষ্যসৃষ্ট অপরাধ বলে মনে করেন- যা কোন অবস্থাতেই চিরস্থায়ী নয়।অতএব উত্তরণযোগ্য।এই সুদৃঢ় ধনাত্মক চেতনায়ই কবি কাজী নাসির মামুনের কাব্য সাধনার প্রধান অবলম্বন বিভাব।
এই উভয়বিধ লক্ষ্যে কবি কাজী নাসির মামুন তাঁর অসি নয় মসি চালনা করেছেন দু’হাতে, সুস্থির প্রত্যয়ে, নিশ্চিত আস্থায়।
ওই নীল গগন বিতর্কে এক যথার্থ কোকিল
ঘুমের বেদীতে চায় দুঃস্বপ্নের গুপ্ত শিরোশ্ছেদ
আমাদের বসন্ত সময় এইভাবে খান খান হয়ে গেলে
. নগরীর বিভিন্ন ক্লিনিক
যেন জন্ম নিয়ন্তার খেলাঘর; বিষাক্ত বমিতে
ভাসে; তুমি শৃঙ্খলশঙ্কিত এক নিশ্চুপ ডাক্তার।
আমাকে ডাকো না কেন
. কাকবর্বরের মতো শুষে নিতে
. তোমার অসুখ?
(সন্ধ্যাস্যাটায়ার)
এ কবিতায় একদিকে যেমন রূঢ়-বাস্তব সত্য উন্মোচিত হয়েছে অন্যদিকে তেমনি কবি দুঃসাহসিকতার সঙ্গে বিকৃত যৌনতার কলুষতা সম্পর্কে দার্শনিক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে প্রবৃত্ত হয়েছেন। নাগরিক অসভ্য-বর্বর মানুষদের সঙ্গে কোকিলের তুলনা করা হয়েছে। এই কোকিল মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে বসন্ত সময়কে খান খান করে দেয়। সেই ভয়ঙ্কর পাপের সাক্ষী থাকে হয়তো কোন ক্লিনিকের শৃঙ্খলশঙ্কিত নিশ্চুপ ডাক্তার।
যৌন নিঃসরণের মাঝে আসে প্রতিচ্ছায়া নবজাতক। এ নিঃসরণের ফলে একজন ক্ষয় হচ্ছে, ভাঙছে প্রতিনিয়ত। অপরদিকে নবরূপে নবরূপায়নে গড়ছে আর একজন। এ ধারা প্রবাহে একজনের পূর্ণ বিলোপের পথ হয় রুদ্ধ। প্রকৃতির মাঝে অনন্তকাল ধরে এ যৌনতার অনুক্রম চলে আসছে, আসবে। যৌনাচার কুৎসিত কর্মকাণ্ড বলে চিহ্নিত হলেও এ যৌনাচারইতো সৃষ্টি বিকাশের আদি কারণ। তবু অবৈধ যৌনতা কিংবা নষ্টামি কারো কাম্য নয়। নষ্টজন্মের এই আয়োজন রুখতে কবি নিজেকে ডাকতে ‘তুমি’ বিশেষণে অসহায়দের আহ্বান করেছেন। কবি কাকবর্বরের মত শুষে নিতে চান সমাজের এইসব সমূহ অসুখ।
গাছের ক্ষরণে লিখা পাখিদের স্মরণ সভায়
সজল দূষণ-ভারে ভেঙে যায় পাখ।
ফুটন্ত সংঘাতে তারপর
একটি নদীর খুন হওয়া ছাড়া
আর কোন ইতিহাস নেই।
(নদীমাতৃক)
বৃক্ষ নিধনের ফলে আমাদের পরিবেশের স্বাভাবিক ভারসাম্য ত্বরান্বিত হচ্ছে। যার ফলে নদী ভাঙ্গন, ক্ষরা, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দিচ্ছে।কবি এখানে মধুমতি নদীর বেহাল দশার দিদৃক্ষার মাধ্যমে নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদীগুলোর শোচনীয় অবস্থার কথা বর্ণনা করেছেন। যে নদী একদিন খরস্রোতা যৌবনা ছিল তা আজ বার্ধক্যে উপনীত হয়েছে, কোথাও কোথাও সরু খালে পরিণত হয়েছে। এই নদীই একদিন সোনার বাংলার গৌরবের প্রতীক ছিল। অথচ আমাদের অসচেতনতার জন্য নদী আজ শুকিয়ে নিষ্প্রাণ কাঠ হয়ে গেছে। বন উজাড় ও পরিবেশ দূষণ নদীর মৃত্যুর বড় নিয়ামক। নদীর এই ভগ্ন দশা দেখে মানবিক প্রশ্নশীল হৃদয় নিয়ত ক্ষত-বিক্ষত হয়।তাই কবির হৃদয় সংক্ষোভ ব্যক্ত করেন বিবিক্ত দার্শনিক হয়ে- গাছের ক্ষরণে একটি নদীর খুন হওয়া ছাড়া আর কোন ইতিহাস নেই।
লাল অভিলাষ এক জীবন্ত কেল্লার
অপয়া মৃত্যুর দিকে পরীবিবি ঘুমায় এখন।
এখনো শায়েস্তা খান দুঃখের বনান্তে রাখি
ঢাকার বাগান; পুষ্পসঙ্ঘরামে
আজো কেন পাখির আকাল?
(ইতিহাস)
নবাব শায়েস্তা খাঁ র কন্যার নাম পরীবিবি। এক জীবন্ত কেল্লায় সে এখন ঘুমায়। এই কেল্লা ঢাকার লালবাগ কেল্লা। মুঘল সম্রাট আওরংগজেবের পুত্র শাহজাদা আজম এর সাথে ১৬৬৮ ইং সালের ৩ মে পরিবিবির বিয়ে হয়। শাহজাদা আজম বাংলার সুবাদার থাকাকালীন সময়ে ১৬৭৮ সালে লালবাগ কেল্লার নির্মাণ কাজ শুরু করেন। ১৫ মাস কাজ করার পর তার পিতা তাঁকে মারাঠা দমনের জন্য দিল্লি ডেকে পাঠান। তারপর নির্মাণের কাজ থেমে গেলে বাংলার সুবাদার হিসেবে ১৬৮০ সালে শায়েস্তা খাঁ ঢাকায় আসেন। ১৬৮৪ সালে তাঁর কন্যা ইরান দুখত রাহমাত বানুর (পরী বিবি) মৃত্যু ঘটে ।কন্যা পরী বিবির মৃত্যুর পর শায়েস্তা খান এ দুর্গটিকে অপয়া মনে করেন এবং ১৬৮৪ খ্রিস্টাব্দে কাজ অসমাপ্ত রেখে বন্ধ করে দেন। তারপর তিনি ঢাকা ত্যাগ করে চলে যান। তারপর এটি জনপ্রিয়তা হারায়। লালবাগের কেল্লার তিনটি প্রধান স্থাপনার একটি হল পরীবিবির সমাধি । কবি এখানে পরীবিবি ও শায়েস্তা খানের ইতিহাস তুলে এনেছেন তাঁর কবিতায় শৈল্পিক বর্ণনার মাধ্যমে। কবিতায় ব্যবহৃত ‘পরীবিবি’ ও ‘শায়েস্তা খাঁ’ মিথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে।
আধুনিক কাব্যে মিথ বা পুরাণ যে ব্যঞ্জনাময় প্রভাব বিস্তার করেছে লোকসংস্কৃতির অন্যকোন উপাদান তা করেনি। অজানাকে জানার, অধরাকে ধরার, অদৃশ্যকে দেখার, অজেয়কে জয় করার, অচিন্ত্যকে চিন্তাগত করার দূর্নিবার আকাঙ্ক্ষা থেকেই মিথ(Myth) বা পুরাণ চেতনার উদ্ভব। প্রাক-সভ্যযুগে, আদিম মানুষ যখন সর্বপ্রাণবাদের (Animism) স্তর অতিক্রম করে সবেমাত্র সংহত জীবনে (Pluralism) প্রবেশ করেছে, তখন জীবন-জীবিকা, জন্ম-মৃত্যু চারপাশের প্রকৃতি তথা বস্তুবিশ্বের দুর্জ্ঞেয় রহস্য তার হৃদয়ে যে বিস্ময়াবিষ্ট কৌতূহলের জন্ম দিত-সেই অচিন রহস্য উদ্ঘাটনে তার বিশ্বাসজাত ও চিন্তাপ্রসূত প্রতীকী প্রকাশ হল পুরাণ। ইংরেজিতে এক মিথ নামে অভিহিত করা হয়। পুরাণ তাই লোকসমাজ উদ্ভাবিত এক প্রকার কল্পনালব্ধ জ্ঞান।
মূলত সৃষ্টি উৎপত্তি, প্রকৃতি, নিসর্গ, নিয়ম, ত্যাগ, বিসর্জন, দেবচরিত, বিভিন্ন মুনি-ঋষির অধিকার কাল এবং এ ধরনের শাস্ত্রকল্প বিষয়াদিই পুরাণের বিষয়। সুতরাং, ‘পুরাণ’ শব্দ দ্বারা ধর্ম, ধর্মাচার বিশেষত বৈদিক মতে সৃষ্টিতত্ত্ব, জন্ম-মৃত্যু ইত্যাদি সম্পর্কিত ধর্মীয় ধারণাই ব্যক্ত করা হয়। পৌরাণিক বিষয় দ্বারা ভূত-ভবিষ্যৎ ও বর্তমান অবস্থার পরিজ্ঞান, জ্ঞানের নির্মলতা ও বুদ্ধির প্রাখর্য জন্মে।
লোলুপ ঘাতক আজ অষ্টাদশী বাজারের বুক
. শেয়ারে শেয়ারে যার ওঠানামা।
পণ্য সমতলে নীলকণ্ঠে বিষ খেয়ে
ঘুমিয়ে থাকেন প্রেসিডেন্ট।
শ্রমের মোড়ল সেজে হাত মারে মোল্লা মন্ত্রী আর পুরোহিত।
ঘুমঘোর আরেক টোকাই-শান্তিচোর
যেন আইল্যান্ড
দরপতনের পরাভব নিয়ে রাস্তায় নির্জন;
কাক তার ভোরের কোকিল—
‘লেনিন’ ‘লেলিন’ বলে ডেকে ওঠে।
(অ-খণ্ড)
পৃথিবীর যাবৎ সুখ-সম্পদ কুক্ষিগত করে রেখেছে যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোভী-দাম্ভিক দুঃশাসক, তাদের রক্তচক্ষুর বক্রচাহনি উপেক্ষা করে সময় এসেছে বৃহত্তর মানবতার লাঞ্ছনা বঞ্চনার কার্যকারণ অনুসন্ধানের। লেলিনকে তাই তিনি আহ্বান করেন নির্ভীকভাবে সত্য প্রকাশ করতে। কারপাশে, কার দুঃশাসনে আজ নিরীহ জনসাধারণ অনাহারে অবিচারে দাঙ্গায় বৃথাই প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছে। এই মোল্লা, মন্ত্রী আর পুরোহিত কারা? যারা যুদ্ধ-মন্বন্তরে মুনাফা লোটে, জনতার আহার লুটে খায়, যাদের নির্দেশে ঘর থেকে টেনে এনে হত্যা করা হয় অপাপবিদ্ধকে।আজ জীবনের তাগিদে তাদের মুখোশ খুলে দেওয়া আবশ্যক।
অনেক ফুলের কথারেণু
আমার আয়ত্তে ছিলো; গন্ধ বিগলিত
ওইসব গল্পের তোরণ পার হয়ে
যেখানে এলাম তার নিদ্রাপাঠ এইমাত্র শেষ হলো।
জল হয়ে গড়িয়ে পড়লো
বিশ্বাসের জমাট বরফ; আর বেদনবৃষ্টির পারে পারে
বোবাদের কথার সিন্দুক বুকে নিয়ে হেঁটে গেলো
. আমাদের শীর্ষমেঘ।
(নিদ্রাপাঠ)
ফুলের রেণুর মতো অনেক জীবনের গল্প পেরিয়ে কবি পরাবাস্তবতার ভাবনায় বুঁদ হয়ে যান। তাঁর আত্মার জগত ধ্যানস্থ হয় নশ্বর জীবনের ‘নিদ্রাপাঠ’ করে। বিশ্বাসের জমাট বরফ আর বেদনাবৃষ্টির এক আকাশ বোবাকান্না বুকে নিয়ে কবি হেঁটে যান জীবনের বিষাদসঙ্কুল পথ। পরাবাস্তবতার পথে তাঁর কবিতার স্বচ্ছন্দ যাতায়াত। এই গন্তব্যে কবি একই সাথে স্রষ্টা ও দ্রষ্টার ভূমিকা পালন করেন।
পরাবাস্তববাদ (Surrealism) এর মূল বক্তব্য, কবিকে দ্রষ্টা হতে হবে, সে শুধু ভবিষ্যৎ দেখবে না, দেখবে নিজের অন্তঃকরণ, ছায়া মগ্নচৈতন্য-হৃদয় খুঁড়ে জাগাবে বেদনা, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, ললাটলিপির মতো যুক্তিহীনতা। অবচেতনমনের ক্রিয়াকলাপকে উদ্ভট ও আশ্চর্যকর সব রূপকল্প দ্বারা প্রকাশ করা। ফরাসী কবি ও সমালোচক অ্যাঁদ্রে ব্রেতো ১৯২৪ সালে সুররিয়ালিজম আন্দোলনের সূচনা করেন। এছাড়া আঁর্তুর র্যা বোকেও বলা হয় সুররিয়ালিজমের আন্দোলনের প্রধান পুরুষ। সুররিয়ালিজমের উদ্ভব ঘটেছে ডাডাইজম থেকে। ডাডাবাদীরা যেখানে চেয়েছিলেন প্রচলিত সামাজিক মূল্যবোধকে নস্যাৎ করে মানুষকে এমন একটি নান্দনিক দৃষ্টির অধিকারী করতে যার মাধ্যমে সে ভেদ করতে পারবে ভণ্ডামি ও রীতিনীতির বেড়াজাল, পৌঁছাতে পারবে বস্তুর অন্তর্নিহিত সত্যে; সেখানে পরাবাস্তববাদ আরো একধাপ এগিয়ে বলল, প্রকৃত সত্য কেবলমাত্র অবচেতনেই বিরাজ করে।পরাবাস্তববাদী শিল্পীর লক্ষ্য হল তার কৌশলের মাধ্যমে সেই সত্যকে গভীর থেকে তুলে আনা।এই অবচেতনের ধারণা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সিগমণ্ড ফ্রয়েডের ‘মনঃ সমীক্ষণ’-এ।
সৌর কল্পনার এক বিষাদকুকুর
নক্ষত্রখচিত ওই আকাশপাড়ায়
ঘেউ ঘেউ জমা রেখে ফিরে এলো;
ভাবলো, মানুষ জন্মসংক্রমণ
. গোলাপশৃঙ্খলে বেঁধে রাখে।
সুরভির অনন্য কার্তিক ফিরে এলে
তারও তো যৌবন তবে গান হয়ে যাবে।
তখন রঙ্গন চায় যদি
সুরের বাগানে কোন মাদী কুকুরেরা
ভালো কি লাগবে তার ঘেউ ঘেউ?
(সংবেদনা)
সৌর কল্পনার এক বিষাদ কুকুর কার্তিকে যৌবন প্রাপ্ত হয়ে নক্ষত্রখচিত আকাশপাড়ায় ঘেউ ঘেউ করে ফেরে। দারুণ চিত্রকল্প ও চেতনায় সমৃদ্ধ কবিতা ‘সংবেদনা’। এই কবিতায় প্রতীকী অর্থে ব্যবহৃত বিষাদকুকুরের মাধ্যমে কবি জাগতিক জীবনের জৈবিক কামনার কথা ব্যক্ত করেছেন নিপুণ শিল্পীর মত।
ফ্রয়েডীয় ধারণায় মানুষ মাত্রেই ইডিপাসিও কমপ্লেক্সের শিকার। প্রত্যেক মানুষের অবচেতন মনে ঘুমিয়ে থাকে যৌন সংক্রমণ। যা থেকে মানুষের পরিত্রাণ নেই। যৌন চেতনার কোন ক্ষয় নেই, নিবৃত্তিও নেই। বরং এর বৃদ্ধি আছে বংশগতিতে। মনের অবচেতনে সুপ্ত হয়ে থাকা অভীপ্সা যখন ঘুমের মাঝে স্নায়ুবিক মনস্কে স্মৃতির পাখনায় ডানা মেলে, আঁধার কুয়াশা পর্দা ভেদ করে ভেসে ওঠে-স্বপ্ন হয়ে।
সব আলো সিন্দুকের প্রকোষ্ঠে রেখেছি;
বহুতল গৃহের শয্যায়
. অন্ধকার গান হয়ে ফেরে।
সে-ই আজ সূর্যসঙ্গীত, বিবিধ রত্নজলাশয় জীবনের।
বঞ্চনার খিল দিয়ে আটকে রেখেছে যে-সমাদর, তাকেই
ভেবেছি প্রযত্ন সুধাগার; নীল বিপ্লবের সবুজ সঞ্চয়ে
এখন কেবলি দোল খাই, হাসি খেলি; পর্নগ্রাফির ফলিত
বিদ্যুতে তুমিই শিখিয়েছো গ্রাস হতে, বৃষ্টিবন্দনার নাম করে
ভিজে যেতে পাথরের নগ্ন আলেয়ায়।
(প্রজন্মশীৎকার-১)
কবি কাজী নাসির মামুন শুদ্ধ চেতনার একজন মানুষ। বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত মগজে মননে হৃদয়বান। তাই তাঁর লেখায় যেমন উচ্চকিত হয়ে উঠেছে প্রতিবাদ, তেমনি দৃশ্যত হয়ে উঠেছে সমাজের অন্ধকার কুৎসিত দিকগুলো। তিনি সমস্ত জাগতিক ক্ষতকে পাদপ্রদীপের আলোয় এনে মুখোশ খুলে দিতে চেয়েছেন। ‘প্রজন্মশীৎকার’ কবিতায় তাঁর মননচেতনার শুদ্ধ উন্মেষ ঘটেছে। বর্তমান বিশ্ব নপুংশক নষ্টামির অন্ধকারে ছেয়ে গেছে। সেই অন্ধকারকে কবি আলোয় এনে তুলে ধরেছেন। একজন কবির যে দায়বদ্ধতা তার প্রমাণ মেলে তাঁর এই কবিতায়। তাই কবির দায়িত্বশীলতা সম্পর্কে কিছু কথা বলতেই হয়।
আধুনিক বাংলা কবিতা ভুঁইফোড় কোনো উপদ্রব নয়। বিশ শতকের এক ক্লেদাক্ত সময়ে, সংশয়, ক্লান্তি ও নৈরাশ্যের বিরান ভূমিতে জন্ম হলেও এরও লক্ষ্য সাগরসঙ্গম। বৃহত্তম জনতার মাঝে আপনাকে উৎসর্গ করে দেওয়াই কবিতার চরম ও পরম পরিণতি। শব্দ আর নান্দনিক ঐশ্বর্য তার একমাত্র সহায়। একজন কবি তার সময়ের সার্থক প্রতিনিধি।যুগের নির্ভরযোগ্য সমাজ-বাস্তবতার চিত্র হিসেবে কবিতা আপন ঐশ্বর্যে দীপ্যমান। এদিক দিয়ে কবিতা ইতিহাসও।কিন্তু এটুকুই কবিতার সব নয়।কবিতা সমসাময়িক যুগের অগ্রবর্তী চিন্তার বাহন, যুগ জটিলতার ব্যাখ্যাতা, অন্যায়-অবিচার শোষণ-নিপীড়নের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর, মানবতার মুক্তির মিছিলে সোচ্চার স্লোগান।সমাজ-সভ্যতার সমস্ত অমানবীয় সৃষ্টি এবং সৃষ্টির ভেতরকার সমস্ত অসঙ্গতিকে ভেঙে চুরমার করে আনন্দময় নতুন বিশ্ব গড়ার সোনালি স্বপ্ন হলো কবিতা।কবিতা-সংশ্লিষ্ট মানবগোষ্ঠীর ভাব সাধনার ধারক, তার আনন্দ-বিনোদনের সঙ্গী, তার আবেগ-আকাঙ্ক্ষা ও অন্তর্গূঢ় বেদনার রূপচিত্র, তার চিন্তা-চেতনার মর্ম সহচরী।তারা বিশ্বাস করতে চায় কবিতা ‘আঁধার জীবনে আলোকের ঝিলিক ছড়ায়’।কবি সেই আলোকের Power Station. কবির কাছে, কবিতার কাছে মানুষের অশেষ প্রার্থনা কবিতা তাই আরো অনেক কিছু।
আজকের কবিতার পরিপ্রেক্ষিত পাল্টালেও কবির দায়িত্বশীলতা কিছু কমেছে বলে মনে হয় না।সঙ্গত কারণেই তাই মানুষের কাছে, জনতার কাছে কবির দায়বদ্ধতার (Commitment) প্রশ্নটিও আসে—যদিও লোক শিক্ষার দায়িত্ব কবিতার নেই।কবি যতই বলুক, ‘আমি তোমাদের আনন্দ-বেদনার, আশা-আকাঙ্ক্ষা, পাপ-পুণ্য, ধর্ম-অর্থ বা জীবন সংগ্রামের মন্ত্রদাতা গুরু কিংবা ভারবাহী পশু নই, তোমাদের কৃষ্টি-সংস্কৃতি-ইতিহাস-ঐতিহ্য-কাম-মোক্ষ বা ভাবসাধনার ফেরিওয়ালাও নই।আমি কবিতা লিখি আপন খেয়ালে- ‘স্পদানন্দ কর্ণামৃত’ আমার কবিতা’।জনতা কিন্তু তার এ বক্তব্যকে বিনয় বলেই জানে।তা না হলে রবীন্দ্রনাথের ‘সাধারণ মেয়ে’ শরৎবাবুর কাছে কেন আকুতিভরা চিঠি লিখেছিলেন- কাঁচা বয়সেই যার জীবন লেখাপড়া না জানার অজুহাতে শিক্ষিত প্রেমিকের প্রত্যাখ্যানে নিঃশেষিত হয়েছিল? পরাজিত হয়েও অন্তত গল্পে জেতার উদগ্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যে লোকচক্ষুর অন্তরালে হারিয়ে গিয়েছিল? অথবা লুইগি পিরান্ডেলো(১৮৬৭-১৯৩৬)-এর যুগান্তকারী নাটকের হতভাগ্য সেই ছয়টি চরিত্র (Six Characters in search of an Author, 1904) কেন একজন লেখকের খোঁজে বেরিয়েছিল-যিনি তাদের জীবনের দুর্ভাগ্য ও ট্র্যাজিক ব্যর্থতার কারণ ব্যাখ্যা করবেন? লক্ষণীয়, এরা কেউই তাদের সমস্যা সমাধানের জন্য মনোবিজ্ঞানী-ডাক্তার-বিচারক কিংবা প্রশাসনের কাছে যাননি, যাননি কোন পীর-ফকির আধ্যাত্মসাধকের কাছেও।এসেছেন লেখকের কাছে, শিল্পীর কাছে। ‘সবাই মোরে করেন ডাকাডাকি’- কিন্তু কেন? জীবনের দুর্জ্ঞেয় রহস্য উন্মোচনের জন্য, সংকট উত্তরণের বাণী শোনানোর জন্য।কবির দায়িত্বশীলতা ও শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই। আর কবি কাজী নাসির মামুন এখানেই কবিতার চারণভূমিতে স্বতঃসিদ্ধ, দায়িত্বশীল একজন যুগসচেতন কবি।
কবি কাজী নাসির মামুন তাঁর ‘কাক তার ভোরের কোকিল’ কাব্যগ্রন্থে সমাজের অনিরাময়যোগ্য যে ক্ষতকে তাঁর সকল উচ্চারণের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে প্রতিস্থাপিত করেছেন, তা প্রকৃত অর্থে ভালোবাসারই ক্ষত। আপেক্ষিক গুরুত্ব অনুযায়ী ঐ ভালোবাসা নিঃসরিত হয় কবিতা-নারী-দেশ-দেশের মানুষ প্রভৃতির প্রতি। তবেকবি কাজী নাসির মামুন প্রসঙ্গে যেটি প্রণিধানযোগ্য তা হল এই যে, তিনি প্রাধান্য দেন কবিতাকে, কবিতার শৈল্পিক উৎকর্ষকে। কবিতার প্রাসঙ্গিকতায়ই তাঁর কাব্যে দেশ ও দেশের মানুষ আসে। দেশের সমূহ বাস্তবতা ও মানুষের দুর্দশাও উঠে আসে তাঁর কবিতায়। ইথারের কটু ঝাঁঝের মত এই চৈতন্য ছড়ানো থাকে তাঁর কাব্যদেহের সর্বত্র। তাঁর কবিতায় ধৃত সমাজতান্ত্রিক চেতনা বা সাম্যবাদী অনুধ্যান ও নিপীড়িত মানুষের প্রতি সহানুভূতি, সমকালীন সংকট নিরসনে তীক্ষ্ণভাবে উচ্চারিত হয়েছে। এখানেই তিনি শিল্প সৃষ্টিতে অনুধ্যায়ী, ব্যতিক্রমী প্রাতিস্বিক।
তাঁর অনন্য প্রতিভার করস্পর্শে এবং শুদ্ধ চেতনা ও পরিশীলিত মনন সৌকর্যে বাংলাসাহিত্য সমৃদ্ধ হবে এই আশা রাখি।