॥ হারাধন কর্মকার॥
সাহিত্যপ্রেমীদের কাছে বাংলা একাডেমির পর সাহিত্য পুরস্কারগুলোর মধ্যে সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ হলো বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার ও চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। এই দুটি পুরস্কার দেশের করপোরেট পুরস্কারগুলোর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি উজ্জ্বল বলেও মনে করেন লেখক-পাঠক-সমালোচকরা। তাই বিভিন্ন মদের বারে-ক্লাবে রাতের অন্ধকারে বিক্রি হওয়া পুরস্কারের চেয়ে বেশি আগ্রহ এই দুটি পুরস্কারেই।
ইতোমধ্যেই বগুড়া লেখক চক্রের পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। চলতি নভেম্বর মাসের শেষভাগে ঘোষণা আসতে পারে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারের। তখন জানা যাবে চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত পুরস্কারজয়ীদের নাম। প্রসঙ্গত, চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি মূলত ৭ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার দিয়ে থাকে। এগুলো হলো (১) কবিতা, (২) কথাসাহিত্য, (৩) গবেষণা-প্রবন্ধ, (৪) সংগীত, (৫) সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম, (৬) শিশুসাহিত্য ও (৭) সংগঠন। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে আয়োজক সূত্রে জানা গেছে। এদিকে, এই পুরস্কার ঘিরে সাহিত্যপ্রেমীদের জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে গেছে। তাদের আলোচনায় বেশ কয়েকটি নাম ঘুরে ফিরে আসছে।
কবিতা
সাহিত্যের সবচেয়ে স্পর্শকাতর শাখা হিসেবে কবিতার আলাদা কদর সবার কাছেই আছে। তাই যেকোনো পুরস্কারের ক্ষেত্রে কবিতায় কে পেলেন, সেই আগ্রহও সবার মধ্যে একটু বেশিই থাকে। তেমনি কবিতা শাখায় কে পাচ্ছেন চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, তা নিয়েও রয়েছে ব্যাপক কৌতূলহ, উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা। আর সাহিত্যপ্রেমীরাও নিজ নিজ পছন্দের কবিদের এগিয়ে রাখছেন এই পুরস্কারের জন্য। প্রত্যেকেই তাদের পছন্দের ও প্রিয় কবির পক্ষে জোরালো যুক্তি তুলে ধরছেন। এই পছন্দের তালিকায় এগিয়ে রয়েছেন হেনরী স্বপন, ফকির ইলিয়াস, শাহেদ কায়েস ও মাসুদুল হক। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে রয়েছেন হেনরী স্বপন। ১৯৬৫ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি বরিশালে জন্মগ্রহণ করেছেন এই কবি। এ-পর্যন্ত তার ৮টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এগুলো হচ্ছে—‘কীর্তনখোলা’, ‘মাটির বুকেও রৌদ্রজ্বলে’, ‘বাল্যকাল ও মোমের শরীরে আগুন’, ‘জংধরা ধুলি’, ‘ কাস্তে শানানো মোজার্ট’, ‘ঘটনার পোড়ামাংস ‘, ‘হননের আয়ু’, ‘উড়াইলা গোপন পরশে’। সম্পাদনা করছেন ছোটকাগজ ‘জীবনানন্দ’। তার কবিতা সম্পর্কে ‘কবিতার সময় ও মনীষার দান: হেনরী স্বপন’ শীর্ষক প্রবন্ধে কবি-প্রাবন্ধিক মোহাম্মদ নূরুল হক লিখেছেন, ‘ক্রিয়াপদ ও অব্যয়হীন শব্দ গঠন ও নির্বাচন, বাক্যের বুননের কারণে তাঁর কবিতাকে দুর্বোধ্য ঠেকতে পারে। এ কারণেই সাধারণ পাঠককে খুব বেশি কবিতা পাঠে উৎসাহিত করে না। এ স্বভাব তাঁর মজ্জাগত। এ সঙ্গে জড়িয়ে আছে কবির সমাজ-মানসগঠনের ক্ষেত্রে আভিজাত্যের মোহ। হেনরী স্বপন কবিতা লিখেছেন হৃদয়ের ক্ষরণ থেকে, কিন্তু প্রকাশ করেছেন মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণে। সমাজ-রাষ্ট্র-রাজনীতি-দর্শন অনেকের কবিতারই অনুষঙ্গ হয়েছে। কিন্তু হেনরী স্বপনের কবিতায় এসব এসেছে দার্শনিক প্রত্যয় নিয়ে। এ কারণে তাঁর কবিতা ভাবালুতায় ভেসে যায়নি, হয়ে উঠেছে সময়ের কাছে মনীষার দান। যে মনীষা ব্যক্তি-সমাজ-রাষ্ট্রকে ধারণ করে বিশেষ তাৎপর্যে, বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে একটি মস্তবড় বিস্ময়সূচক চিহ্ণের মতো।’ বড় ধরনের কোনো ব্যতিক্রম না ঘটলে কবিতার গভীরতা, বিষয়ের বৈচিত্র্য ও সমকালীন সাহিত্যে তার প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় কবিতা শাখায় এবার চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার হেনরী স্বপন পেতেই পারেন।
ড. রকিবুল হাসান ও কাজী মহম্মদ আশরাফের পর আরও দুটি নাম ঘুরেফিরে আলোচিত হচ্ছে। তারা হলেন রঞ্জনাবিশ্বাস ও শহীদ ইকবাল। তবে, তারা কেন পুরস্কারের জন্য যোগ্য, সেই বিষয়ে জল্পনা-কল্পনাকারীরা স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না।
হেনরী স্বপনের পরই কবিতায় পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে যার পাল্লা ভারী তিনি ফকির ইলিয়াস। ফকির ইলিয়াস ১৯৬২ সালের ২৮ ডিসেম্বর সিলেটে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাবন্ধিক, গল্পকার, গ্রন্থসমালোচক, সাংবাদিক হিসেবেও রয়েছে তার ব্যাপক পরিচিতি। এই পর্যন্ত তার প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা আঠারোটি। উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ: ‘অবরুদ্ধ বসন্তের কোরাস’, ‘বৃত্তের ব্যবচ্ছেদ’, ‘গুহার দরিয়া থেকে ভাসে সূর্যমেঘ’, ‘ছায়াদীর্ঘ সমুদ্রের গ্রাম’,’গৃহীত গ্রাফগদ্য’, ‘অনির্বাচিত কবিতা’। প্রবন্ধগ্রন্থ: ‘সাহিত্যের শিল্পঋণ’, ‘কবিতার বিভাসূত্র’। গল্পগ্রন্থ: ‘চৈতন্যের চাষকথা’। গীতি সংকলন: ‘অনন্ত আত্মার গান’। ‘একজন সমসাময়িক কাব্য-পরিব্রাজক’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে তুষার সেনচৌধুরী লিখেছেন, ‘একটি নির্জন একান্ত উপলব্ধি-প্রতীক হয়ে ওঠে আধুনিক কবিতা। যার ব্যক্তি হৃদয়ের ভাবের দ্যোতনা, চিন্তা বা অন্তর-অনুভূতির কথাগুলো যখন একটি নির্দিষ্ট শৈল্পিকতার মধ্যদিয়ে প্রকাশিত হয় তখনই তা হয়ে ওঠে আধুনিক কবিতা। একই সাথে সমসাময়িক সূর্যের আলো আহরণের বিষয়টি তো থাকছেই। ফকির ইলিয়াস সেই কাজটি সুসম্পন্ন করেই লিখেন তার কবিতামালা।’ এর বাইরে শাহেদ কায়েস ও মাসুদুল হককে নিয়েও বেশ আগ্রহ রয়েছে পাঠক-সমালোচকের। প্রথমোক্ত দুজনকে ছাপিয়ে শেষোক্ত দুজনের যেকোনো একজনই হয়তো পেয়ে যাবেন চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার।
কথাসাহিত্য
কবিতার পর সাহিত্যের বড় আগ্রহের বিষয় কথাসাহিত্য। বিশেষত উপন্যাসের পাঠক সবচেয়ে বেশি। এরপরই ছোটগল্পের স্থান। চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি প্রবর্তিত কথাসাহিত্যে সম্ভাব্য পুরস্কারজয়ীদের নিয়েও শুরু হয়ে গেছে জল্পনা-কল্পনা। এই তালিকায় সবচেয়ে এগিয়ে রয়েছেন শিমুল মাহমুদ। তিনি একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক। প্রতিটি শাখায়ই তার রয়েছে সমান বিচরণ। তার জন্ম ৩ মে ১৯৬৭, সিরাজগঞ্জ জেলার কাজিপুর। এই লেখের গল্পগ্রন্থ: ইলিশখাড়ি ও অন্যান্য গল্প, মিথ মমি অথবা অনিবার্য মানব, হয়তো আমরা সকলেই অপরাধী, ইস্টেশনের গহনজনা, নির্বাচিত গল্প, অগ্নিপুরাণ ও অন্যান্য গল্প। উপন্যাসগুলো হলো, শীলবাড়ির চিরায়ত কাহিনী। প্রবন্ধগ্রন্থ, কবিতাশিল্পের জটিলতা, নজরুল সাহিত্যে পুরাণ প্রসঙ্গ, জীবনানন্দ দাশ: মিথ ও সমকাল, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ধারার কবিতা, মিথ-পুরাণের পরিচয়। কবিতাগ্রন্থগুলো হলো, মস্তিষ্কে দিনরাত্রি, সাদাঘোড়ার স্রোত, প্রাকৃত ঈশ্বর, জীবাতবে ন মৃত্যবে, কন্যাকমলসংহিতা, অধিবিদ্যাকে না বলুন, আবহাওয়াবিদগণ জানেন, কবিতাসংগ্রহ: সপ্তহস্ত সমুদ্রসংলাপ, স্তন্যপায়ী ক্ষেত্রউত্তম, বস্তুজৈবনিক। তার কথাসাহিত্য প্রথাগত নয়। সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী ও নিরীক্ষাপ্রবণ। ফলে চর্যাপদ তার এই ব্যতিক্রম ধারার কথাসাহিত্যের প্রতি সম্মান জানিয়ে তাকে পুরস্কৃত করতে পারে বলেও অনেকেই প্রত্যাশা করছেন।
শিমুল মাহমুদের পর যার নাম বেশ আগ্রহ নিয়ে উচ্চারিত হচ্ছে, তিনি ফারহানা রহমান। এই লেখক একাধারি কবি, অনুবাদক, চলচ্চিত্র সমালোচক, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক। তিনি প্রচুর লিখলেও ইতোমধ্যেই গল্পগ্রন্থ বের হয়েছে মাত্র একটি। নাম ‘শ্রেণীশত্রু।’ আর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলো: অপরাহ্ণের চিঠি (২০১৬), অপেরার দিনলিপি (২০১৭) ও লুকিয়ে রেখেছি গোপন হাহাকার (২০১৯), বিশ্বসেরা সিনামা কথা (চলচ্চিত্রের ওপর লেখা গদ্যের বই) ২০২০। এছাড়া, দিপাঞ্জলি (যৌথ) ২০১৭ ও মনোরথ (যৌথ) ২০১৮। তার গল্প সম্পর্কে সুমী সিকান্দার লিখেছেন, ‘ফারহানা রহমান জানেন, লেখককে রাজনীতি সচেতন হতে হয়। অবশ্য। সমাজের আচরণ তার মনে যে রেখাপাত করে, তার সঙ্গে কল্পনার সমন্বয়ে তিনি নিজের জন্য একটি বাস্তবসম্মত কল্পজগৎও তৈরি করে নেন। আর ওই জগতে আপন রুচি ও মর্জিমতো সব দৃশ্য বিন্যাসও করতে চান তিনি। কিন্তু প্রায়ই সেটি সম্ভব হয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাকে ব্যর্থ হতে হয়। তার এই সাফল্য-ব্যর্থতার চিত্রই তাকে আঁকতে হয়। এছাড়া ব্যক্তির একাকীত্ব, দ্রোহ, কাম-প্রেম, ভালোবাসা-বিদ্বেষকেও গল্পের অনুষঙ্গ করে তুলতে হয় তাকে।’ ফারহানা রহমানের গল্পের গভীরতা, ব্যাপ্তি ও বৈচিত্র বিবেচনায় সাহিত্যপ্রেমীদের ধারণা এবার চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার এই লেখকের ঝুলিতেই জমা পড়তে পারে।
কথাসাহিত্যে আরও যার সম্ভাবনা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে, তিনি ফরিদা ইয়াসমিন সুমি। এই লেখকও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী। তিনিও একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক। তবে, সব পরিচয় ছাপিয়ে তার কথাসাহিত্যিক পরিচয়ই বেশি গুরুত্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। তার কবিতা, গল্পসংকলন ও প্রবন্ধ মিলিয়ে এই পর্যন্ত প্রকাশিত গ্রন্থ-সংখ্যা ১৪। এর মধ্যে কবিতা ১০, গল্প ৩ ও স্বাস্থ্যবিষয়ক বই একটি। গল্পগ্রন্থ: পাতা ।। ফুল ।। কাঁটা (২০১৮), যে জীবন ফড়িঙের, দোয়েলের…(২০১৯), হাজার আয়নার ঘর (২০২০) এবং স্বাস্থ্যবিষয়ক বই নারীস্বাস্থ্য (২০১৯)। কাব্যগ্রন্থ: তোমায় দেবো নীলপদ্ম নেবে (২০১৬), তুমি আর আমি (২০১৭), তুমি তেমনই রবে আমারই (২০১৭), প্রজাপতি মন (২০১৭), চল ভালোবাসি (২০১৭), ভুল সময় বলে কিছু নেই (২০১৮), অসমুদ্রিত দেহে সমুদ্রিত মন (২০১৯), আমরা দুজন স্বপ্নে জেগে থাকি (২০২০), দুই বুকে দুই মীন (২০২০), বেপরোয়া রাজহাঁস (২০২০)। সাহিত্যে বিশেস অবদানের জন্য পেয়েছেন বিশাল বাংলা সাহিত্য পুরস্কার ২০১৬। সার্বিক দিক বিবেচনায় কথাসাহিত্যে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার এই লেখকও পেতে পারেন বলে অনেকেরই প্রত্যাশা রয়েছে।
গবেষণা-প্রবন্ধ
গবেষণা-প্রবন্ধ শাখা নিয়ে সাধারণ পাঠকের আগ্রহ কম হলেও লেখক সমাজে এর গুরুত্ব অপরিসীম। তাই কবিতা-কথাসাহিত্যের পরই প্রবন্ধ-গবেষণায় বিশেষ গুরুত্ব দেন তারা। পুরস্কারের ক্ষেত্রে এই শাখায় আবেগের চেয়ে প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তিক বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হয়। ফলে অন্যান্য শাখায় কোনোভাবে যথাযথ ন্যায়বিচার করা সম্ভব না হলেও প্রবন্ধ-গবেষণা শাখায় জুরিবোর্ড থেকে শুরু করে আয়োজকরা পর্যন্ত সতর্ক থাকেন। তাই এই শাখায় মনোনয়ন দেওয়ার ক্ষেত্রেও বিশেষ সতর্ক অবলম্বন করেন সংশ্লিষ্টরা। এই শাখায় চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারের সম্ভাব্য জয়ীদের মধ্যে এগিয়ে রয়েছেন ড. রকিবুল হাসান।
এই লেখক পেশায় শিক্ষক। তিনি একাধারে কবি, সমালোচক, কথাসাহিত্যিক ও গবেষক। কিন্তু তার সব পরিচয় ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে গবেষক-প্রাবন্ধিক সত্তা। তার উল্লেখযোগ্য গবেষণা-প্রবন্ধগ্রন্থ হলো, সাহিত্যের নন্দনচর্যা, পঞ্চাশের সাহিত্যে জনপ্রিয় যুবরাজ, ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার ও ফোকলোর, বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন, বিপ্লবী বাঘা যতীন, আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য: রূপলোক ও শিল্পসিদ্ধি, কয়ায় রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন ও প্রাজ্ঞজন; গড়াই নদীর পাড়, পথে যেতে যেতে, পথের কথা, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর বাহির, রবীন্দ্রনাথ ও বাঘা যতীন।
সাহিত্যে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ পেয়েছেন বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব সাহিত্য সম্মাননা ২০২০। শ্রীপুর সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯, শ্রীপুর, গাজীপুর। কবি ওমর আলী স্বর্ণপদক ২০১৮, পাবনা। লালন সাঁই পুরস্কার-২০১৫, লালন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, ঢাকা। বাংলা সাহিত্য পদক-২০০৬, পাবনা। স্যার সলিমুল্লাহ পদক-২০০৬, ঢাকা। দ্য সান সম্মাননা-২০১০, ঢাকা। চাইল্ড হেভেন সম্মাননা-২০১০, কুষ্টিয়া। ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ সম্মাননা-২০১১, কুমারখালী, কুষ্টিয়া। সিটি স্কুল সম্মাননা-২০১৫, ঢাকা।
তার সম্পর্কে ‘ভাঙন’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে হাসান আজিজুল হক বলেছেন, ‘‘নতুন কালে কি সত্যি নতুন মানুষ দেখা যায়? এত নতুন যে তাকে আর চিনতেই পারা যায় না? মানুষ কি বদলে যাচ্ছে? বদলে কি যায়? যে যুবক যুবতীদের পরিবর্তনের রকমারি পোশাকে দেখতে পাই সেই পোশাক সরালেই তো দেখা যায় চিরকালের সেই যুবক যুবতী। রকিবের উপন্যাস পড়তে গিয়ে এই কথাগুলিই আবার মনে এল। দু’জোড়া যুবক যুবতীর গল্প এখানে। প্রথা তারা এতদূর ভাঙতে পারে যে হঠাৎ মনে হয় একালের যুবক যুবতী খুব বদলে গেছে। স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হলে প্রেমসহ বা প্রেমবিনাই ভিন্ন নারীর সঙ্গে সম্পর্ক যেমন স্থাপিত হয় তেমনই আবার বিয়ে সামাজিক পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই প্রেমিকার গর্ভে সন্তান চলে আসে। মনে হয় সময় বদলেছে, মূল্যবোধ বদলেছে। প্রথা ভাঙা চলছে কিন্তু একটু ভেতরে ঢুকেই বুঝতে পারি একই চিরন্ততা এ কালের তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও নির্বাধ বয়ে যাচ্ছে। রকিবুল হাসানের এই উপন্যাস যেমন বর্তমানের সমাজকে চেনায়, রাষ্ট্রকে চেনায় তেমনই নতুন মানুষকেও চেনায়।’ সাহিত্যের নির্মোহ সমালোচকদের বিশ্বাস, বড় ধরনের কোনো অঘটনা না ঘটলে এবার প্রবন্ধ/গবেষণা শাখায় চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পাবেন এই ড. রকিবুল হাসানই।
আর ওই সিদ্ধান্ত আসতেও খুব বেশি দেরি হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। হয়তো সপ্তাখানেকের মধ্যেই ঘোষণা আসতে পারে। কারণ, চলতি মাসের শেষভাগেই পুরস্কারজয়ীদের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে নাম ঘোষণা আসতে আর খুব যে দেরি নেই, তা হলফ করেই বলা যায়।
এরপরই আলোচনায় যিনি রয়েছেন, তার নাম কাজী মহম্মদ আশরাফ। ‘সাম্প্রতিক প্রবন্ধের তিন কুশীলব’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে কথাশিল্পী ও প্রাবন্ধিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ‘কাজী মহম্মদ আশরাফের আলোচনার ধরন ঝরঝরে। বিষয়ের গভীরে ডুব দিয়ে তিনি মূল বক্তব্যকে খুঁজে আনেন আপন শক্তিতে। তিনি বিষয়ের অনেক অসঙ্গতি তুলে আনেন। সমস্যা উত্থাপন করে তার সমাধানের পথও তৈরি করে দেন। তার প্রবন্ধের তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণ করে তিনি উপসংহারের দিকে অগ্রগামী হন। ফলে তা পাঠকের কাছে তথ্যসমৃদ্ধ চমৎকার লেখা হিসেবে পরিগণিত হয়। তার প্রবন্ধ পাঠে সব প্রশ্নের উত্তর যেন সহজেই পাওয়া যায়। রসহীন এই বিষয়টিকেও তিনি অনেকটা রসালো করে তুলতে পারেন বর্ণনায় বা ভাষাভঙ্গিতে। প্রাবন্ধিক হিসেবে নিজেই কতগুলো প্রশ্ন ছুড়ে দেন পাঠকের কাছে। এরপর নিজেই তার উত্তর দিয়ে যান ধারাবাহিকভাবে।’ আর সমালোচকরা বলছেন, এবার কাজী মহম্মদ আশরাফ প্রবন্ধে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য ব্যক্তি। তাকে পুরস্কৃত করলে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমিরই সম্মান বাড়বে। ড. রকিবুল হাসান ও কাজী মহম্মদ আশরাফের পর আরও দুটি নাম ঘুরেফিরে আলোচিত হচ্ছে। তারা হলেন রঞ্জনাবিশ্বাস ও শহীদ ইকবাল। তবে, তারা কেন পুরস্কারের জন্য যোগ্য, সেই বিষয়ে জল্পনা-কল্পনাকারীরা স্পষ্ট করে কিছু বলছেন না।
সংগীত-সামগ্রিক সাহিত্যকর্ম-শিশুসাহিত্য-গঠন
এই চার শাখার মধ্যে সংগীতে যাদের নাম আসছে তারা হলেন, গীতিকার, কবি, সংগীতশিল্পী লুৎফর হাসান ও কবি, সংগীত রচয়িতা ও গবেষক তপন বাগচী। তাদের প্রত্যেকেরই স্ব-স্ব ক্ষেত্রে সুনাম ও স্বীকৃতি রয়েছে। তপন বাগচী সম্প্রতি পেয়েছেন দেশের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার ‘বগুড়া লেখক চক্র পুরস্কার’। আর লুৎফর রহমান বহুল পরিচিত সংগীত শিল্পী। ফলে এই দুই জনের যেকোনো একজন সংগীতে পুরস্কার পাবেন, তেমনটা আশা করাই যায়। সমগ্র সাহিত্যকর্মে রহমান হাবিব, দীপ্রআজাদ কাজল, রণজিৎ চন্দ্র রায় ও হাসান হাফিজের নাম আলোচনায় উঠেছে এসেছে বারবার। কিন্তু কে কেন এই পুরস্কারের জন্য যোগ্য, সে বিষয়ে স্পষ্ট করে কোনো আলোচকই কিছু প্রকাশ করেননি।
এদিকে, শিশু সাহিত্যে আশিক মুস্তাফা, হুমায়ুন কবীর ঢালী, গোলাম নবী পান্না ও ফারুক হোসেনের নাম এবং সংগঠনে শামীম আহমেদ, পীযূষকান্তি রায় চৌধুরী ও লুৎফুর রহমান খানের নাম উচ্চারিত হচ্ছে। তবে এসব শাখায় কে কেন পাওয়ার যোগ্য, সেই বিষয়ে জোরালো যুক্তি কিংবা বিশ্লেষণে এখন পর্যন্ত কাউকে আগ্রহী হতে দেখা যায়নি।
বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে, পুরস্কার নিয়ে ইতোমধ্যেই চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। তবে, ওই সব বৈঠকে পুরস্কারজয়ীদের নাম নিয়ে প্রাথমিক আলোচনা হলেও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের জন্য নীতিনির্ধারকা আরও সময় নিচ্ছেন। আর ওই সিদ্ধান্ত আসতেও খুব বেশি দেরি হবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে। হয়তো সপ্তাখানেকের মধ্যেই ঘোষণা আসতে পারে। কারণ, চলতি মাসের শেষভাগেই পুরস্কারজয়ীদের হাতে এই পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে। সেক্ষেত্রে নাম ঘোষণা আসতে আর খুব যে দেরি নেই, তা হলফ করেই বলা যায়।
উল্লেখ্য, ২০১৯ সালে চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার প্রবর্তন করা হয়। প্রথম বছর (২০১৯) চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেলেন, কবিতায় স্বপন রক্ষিত (মরণোত্তর), কথাসাহিত্যে শামস সাইদ, গবেষণা সাহিত্যে নূরুল ইসলাম ফরহাদ ও লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনায় ম. নূরে আলম পাটওয়ারী। ২০২০ সালে কবিতায় বীরেন মুখার্জী, কথাসাহিত্যে হামিদ কায়সার, সার্বিক সাহিত্যে কবি ও সম্পাদক জামসেদ ওয়াজেদ, গবেষণা সাহিত্যে জাহাঙ্গীর হোসেন, শিশুসাহিত্যে মকবুল হামিদ, সংগীতে আশিক কবির, শিক্ষায় আজমল হোসেন চৌধুরী ও বাচিকশিল্পে তানজিনা তাবাচ্ছুম।
আরও দেখুন: চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি