মিলু শামস। জন্মেছেন ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর। তিনি একাধারে কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক ও কবি। প্রকাশিত কবিতাগ্রন্থ ৩টি। প্রবন্ধ ২টি। ছোট গল্প ১টি।। প্রবন্ধের জন্য পেয়েছেন এবার ‘চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার’। পুরস্কারপ্রাপ্তি ও সাহিত্যচর্চা নিয়ে চিন্তাসূত্রের পক্ষ থেকে তার মুখোমুখি হয়েছেন হারাধন কর্মকার।
চিন্তাসূত্র: প্রবন্ধে এবার পেলেন চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার। কেমন লাগছে?
মিলু শামস: ভালো লাগছে অবশ্যই। যতদূর জানি চর্যাপদ সাহিত্য একাডেমির পেছনে রয়েছেন এক ঝাঁক আপাদমস্তক সাহিত্যপ্রেমী মানুষ। যাদের বেশিরভাগই বয়সে তরুণ। বাজারি সংস্কৃতির উন্মাতাল স্রোতের মধ্যে থেকেও তারা তাদের মতো করে সাহিত্যচর্চার চেষ্টা চালাচ্ছেন। এটা ভালো লাগছে।
চিন্তাসূত্র: আপনি দীর্ঘদিন ধরে লিখছেন। লিখতে গিয়ে অনেকের লেখাই পড়েছেন। একটি সার্থক লেখার গুণাবলি কেমন হওয়া উচিত বলে মনে করেন? সার্থক প্রবন্ধ লেখার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ টেকনিক কী বলে মনে করেন?
মিলু শামস: যেকোনো সার্থক লেখার বড় গুণ হচ্ছে সহজবোধ্যতা। এমনটাই মনে হয় আমার। প্রবন্ধে তত্ত্বের উল্লেখ থাকবে, তথ্য থাকবে কিন্তু তার ভার যেন পাঠক সইতে পারেন। বক্তব্য উপস্থাপন এবং তা প্রতিষ্ঠিত করার যুক্তিগুলো লেখার ছন্দের সঙ্গে আলগোছে সমগ্র লেখায় ছড়িয়ে পড়বে। তবেই পাঠের আনন্দ উপভোগ করবেন পাঠক। একইসঙ্গে ঋদ্ধও হবেন। ভাষা ও বিষয়ের ওপর লেখকের পূর্ণ দখল থাকলে অনেক গুরুগম্ভীর বিষয়ও লঘুভাবে উপস্থাপন করা যায়। বক্তব্য বিষয়ে লেখকের নিজের ধারণা স্বচ্ছ থাকলেই কেবল তিনি সহজ করে কঠিন কথাটি বলতে পারেন। প্রবন্ধ লেখা শ্রমসাধ্য কাজ। যার প্রাথমিক শর্ত প্রচুর পড়াশোনা। আর অবশ্যই লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি থাকা। মৌলিক চিন্তা করার ক্ষমতা থাকা। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি, অর্থনীতির গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখা। কারণ বৈশ্বিক ঘটনাবলির অভিঘাতে প্রভাবিত হয় দেশীয় রাজনীতি, সমাজ, সম্পর্ক। শুধু প্রবন্ধ নয়, একটি ভালো কবিতা, গল্প বা উপন্যাস লিখতেও ঘটনার আড়ালের ঘটনা বা কার্যকারণ সম্পর্ক বোঝার অন্তর্দৃষ্টি থাকা জরুরি।
চিন্তাসূত্র: আপনি সাহিত্যের অনেক শাখায় কাজ করছেন। তাই সমকালীন কবিতা, গল্প, উপন্যাস ও প্রবন্ধ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাই।
মিলু শামস: আমার মনে হয়, সবচেয়ে ভালো কাজ হচ্ছে ছোটগল্পে। তরুণদের মধ্যে অনেক মেধাবি মুখ ইতোমধ্যে নিজেদের শক্তিশালী আগমনীর আভাস দিয়েছেন। ছোটগল্পে প্রচলিত কাঠামো ভেঙে ভিন্নভাবে গল্প বলার একটা ধারা তৈরি হচ্ছে। ঠাস বুনটে প্রথাগত প্লট নির্মাণ করে গল্প বলার চেয়ে বক্তব্য প্রধান আখ্যানের দিকে ঝোঁক এখন বেশি। পাঠকও সম্ভবত এই প্রকরণটি বেশি পছন্দ করছেন। ছোটগল্পের ভাষার কারুকাজও চোখে পড়ার মতো। এই ভাঙচুর বা সফল নিরীক্ষা সাহিত্যের জীবনীশক্তির জন্য খুব ইতিবাচক বলে মনে হয় আমার। তুলনায় উপন্যাস অনেকটাই ম্লান। প্রতিবছর বইমেলায় অজস্র উপন্যাস আসছে। কিন্তু হাতেগোনা এক-দুটোর বাইরে নজরকাড়ার মতো তেমন লেখা কি আমরা পাচ্ছি? বেশিরভাগ উপন্যাসের পাতা ওল্টালে মনে হয় এই সময়ের উপন্যাস আটকা পড়েছে মিডিওকারদের হাতে। যেখানে আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রচণ্ড অভাব। উপন্যাস বিস্তৃত ক্যানভাসের কাজ। এর জন্য প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রস্তুতি। আমার মনে হয়, এখানটায় ভীষনরকম ঘাটতি রয়েছে। প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি ছাড়াই লেখা হয়ে যাচ্ছে একের পর এক। যে জন্য উপন্যাসের পরিমাণগত বৃদ্ধির সঙ্গে গুণগত বৃদ্ধির বিশাল গ্যাপ তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ নিরীক্ষার নামে এমন সব উদ্ভট জিনিস আমদানি করছেন, যা তাদের দৈন্যকে নির্মমভাবে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
প্রবন্ধে মৌলিক কাজ হচ্ছে সবচেয়ে কম। একটি সফল প্রবন্ধের পেছনে যতটুকু শ্রম সময় এবং পড়াশোনা দরকার, অনেকেই তা দিতে চান না। বা দিতে সক্ষম নন। ফলে দায়সারা গোছের লেখাই হচ্ছে বেশি। এখানে চৌর্যবৃত্তিও চলছে অবাধে। আরেকজনের লেখা হুবহু কপি পেস্ট করে নির্বিকারভাবে চালিয়ে দিচ্ছে নিজের নামে এমন দৃষ্টান্তও আছে।
সবচেয়ে বেশি লেখা হচ্ছে কবিতা। সব কালেই হয়তো তাই হয়েছে। প্রবন্ধের তুলনায় কবিতা অনেকটাই অবগুণ্ঠিত। আড়ালের আশ্রয় নেওয়ার সুযোগ আছে। ছাপানোর জন্যও কবিতা নিরাপদ। অল্প জায়গা নেয় সুতরাং গল্প প্রবন্ধের চেয়ে দৈনিকের সাহিত্য পাতা বা লিটল ম্যাগাজিন বা অন্যান্য সাময়িকীতে কবিতা প্রকাশিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে অগ্রগণ্যে। আমার দফতরে সবচেয়ে বেশি জমা পড়ে কবিতা। প্রতিদিন অসংখ্য কবিতায় মেইলবক্স উপচেপড়ে প্রায়। বেশিরভাগ কবিতাই কবিতার মতো দেখতে হলেও তাকে আদৌ কবিতা বলা যায় কি না, তা বিশেষজ্ঞরা ভালো বলতে পারবেন। তবে আমার ক্ষুদ্র জ্ঞানে কিছু কিছু লেখা দেখে মনে হয়, এ সময়ের তরুণদের মধ্যে কাব্যচর্চার সুষ্ঠু একটি ধারা ভেতরে ভেতরে পরিপুষ্ট হচ্ছে।
বড় একটা শূন্যতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। সমাজে এখন তেমন কোনো আইডল নেই, বলিষ্ঠ আদর্শ নেই। সংগঠন নেই। গত শতকের আশির দশক পর্যন্ত পৃথিবীজুড়ে আদর্শের জন্য লড়াই ছিল। তরুণরা স্বপ্ন দেখত সমাজ পরিবর্তনের। অসম সমাজ ব্যবস্থার প্রতি প্রচণ্ড প্রতিবাদ ছিল। নব্বই দশক থেকে সে সবে ধীরে ধীরে পরিবর্তন আসতে শুরু করে। মুক্ত বাজার অর্থনীতি দ্রুত বদলে দেয় সব কিছু। বদলে যায় সম্পর্কের ধরন-মানুষের সঙ্গে মানুষের, রাষ্ট্রের সঙ্গে নাগরিকের। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ধার কমতে থাকে। সহস্রাব্দের শুরু থেকে সব ছাপিয়ে বাজার এবং পণ্যই হয়ে ওঠে একমাত্র সত্য। আদর্শহীন, প্রতিবাদহীন পণ্য সংস্কৃতির প্রকট প্রভাব পড়েছে শিল্প সাহিত্যেও। কোনো কিছুই যেন এখন স্পষ্ট করে দেখা যাচ্ছে না। একটা অদৃশ্য অস্থির প্রতিযোগিতা সর্বত্র। সবাই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। এই জীবনই প্রতিবিম্বিত হচ্ছে সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায়। সেটাই স্বাভাবিক। সাহিত্য তো এক অর্থে সময়েরও দলিল।
চিন্তাসূত্র: আপনার সমসাময়িক ও অনুজদের মধ্যে কার কার গল্প আপনাকে আকৃষ্ট করে, কার কার প্রবন্ধ-কবিতা পড়েন। কিংবা কাকে কাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন।
মিলু শামস: কার কার লেখা আকৃষ্ট করে বা কাকে কাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করি, তাদের নাম ধরে তা বলার চেয়ে এভাবে বলতে পারি, অনেকের লেখাই আকৃষ্ট করে। মুগ্ধ হয়ে পাঠ করি। আবার এও বলি, প্রচারের কৃত্রিম আলোর প্রজেকশন সরালে রাজধানীকেন্দ্রিক অনেক ‘বিখ্যাত’ কবি-সাহিত্যিকের লেখার অন্তঃসারশূন্যতা প্রকট হয়ে চোখে পড়ে। তুলনায় প্রচারের আলোহীন অনেক নবীনের লেখা প্রচণ্ড সম্ভাবনায় দ্যুতি ছড়ায়। একটি দৈনিকের সাহিত্য পাতা সম্পাদনার সঙ্গে জড়িত থাকার সুবাদে দেশের বিভিন্ন এলাকার লেখকের লেখা পাঠ করার সুযোগ এবং সৌভাগ্য আমার হয়। সে সবের মধ্যে অনেক লেখাই জ্বলজ্বল করে ওঠে।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন সমালোচনা সাহিত্যকে কোনো কোনো কবি বলছেন, অনেকটাই দুর্বল। তাদের অভিযোগ, বেশিরভাগই সমালোচকই লেখকের গুণগান আর সম্পর্কের চর্চা করেন। আপনি এ সম্পর্কে কী বলবেন?
মিলু শামস: আমার মনে হয়, সাহিত্য সমালোচনা একটি কঠিন কাজ। লেখকের চেয়ে বেশি তত্ত্বীয় পাণ্ডিত্য থাকতে হয় সমালোচকের। একইসঙ্গে প্রখর সাহিত্যবোধ। তুলনামূলক সাহিত্যে গভীর অধ্যায়ন না থাকলে সমালোচনা ঠিক বস্তুনিষ্ঠ হয়ে ওঠে না। সমালোচনা হচ্ছে সম-আলোচনা। ইতিবাচক, নেতিবাচক দু’দিকই থাকবে। সমস্যা হচ্ছে, নেতিবাচক আলোচনাটুকু অনেক লেখক নিতে চান না। ক্ষুব্ধ হন। শুনেছি, সমালোচকের সঙ্গে সম্পর্কও নষ্ট হয় এতে। আমার মনে হয়, নিজের ক্ষমতায় আস্থাবান লেখক এটা কখনই করবেন না। লেখকের সাফল্য বা সম্ভাবনার পাশাপাশি ত্রুটি বা দুর্বলতাগুলো তুলে ধরে সমালোচক লেখকের সামনে একটি দিক নির্দেশনা তুলে ধরতে পারেন। যা থেকে লেখার ব্যাপারে আরও সতর্ক, সচেতন হতে পারেন লেখক। তবে আগেই বলেছি, সমালোচককে হতে হবে বিদগ্ধ। দেশ-বিদেশের সাহিত্য পাঠে ঋদ্ধ। তেমন সমালোচকের সংখ্যাও কম। তবে একেবারে নেই তা কিন্তু নয়। তুখোড় সমালোচক আছেন। কিন্তু সমস্যা লেখকের ওই ইগো। সে জন্য হয়তো তারা সঠিক সমালোচনা করে উঠতে পারেন না। আবার এমনও দেখা যায়, একটি খুব দুর্বল লেখাকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে সমালোচক এত উঁচুতে তুলে ধরেন যে, তাতে সমালোচকের জ্ঞানের পরিধি পরিমাপ করা গেলেও লেখকের জন্য কেবল করুণাই উদ্রেক হয়। সাহিত্যের সুষ্ঠু বিকাশের জন্য বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা জরুরি।
চিন্তাসূত্র: বর্তমান ফেসবুক ও অনলাইন পোর্টালের কল্যাণে সাহিত্যচর্চা যেমন বেড়েছে; তেমন সাহিত্যের চৌর্যবৃত্তিও বেড়েছে। এর থেকে পরিত্রাণের কোনো উপায় আছে?
মিলু শামস: চৌর্যবৃত্তি ঠেকানোর তেমন কোনো উপায় আপাতত চোখে পড়ছে না। তবে অন্যের লেখা চুরি করে কি লেখক হওয়া যায়? এক সময় ধরা পড়েই। আর তখন চুরির সঞ্চয় সব এক মুহূর্তে ধসে যায়।
চিন্তাসূত্র: সাহিত্যচর্চা করতে গিয়ে কখনো কারও দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন? যাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন, তারা কারা? কিংবা সেই প্রভাবের ধরনটি কেমন হতে পারে?
মিলু শামস: প্রভাবিত হওয়ার বিষয়টা আসলে বিচিত্র। কে যে কিভাবে প্রভাব ফেলেন! জাঁ পল সার্ত্রের Roads to Freedom (রোডস টু ফ্রিডম) উপন্যাসটি এক সময় ভীষণ প্রভাবিত করেছিল আমায়। উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর পড়েছিলাম বইটি। এখনো ওই বইয়ের চরিত্রদের অনুরণন টের পাই নিজের ভেতর। তলস্তয়ের উপন্যাস বিশেষ করে বড় গল্প ‘ইভান ইলিচের মৃত্যু’ ও ‘ক্রয়টসার সোনাটা’ গল্প দুটোও ভীষণ প্রভাবিত করেছিল। ওই চরিত্ররা ভেতরে কোথাও থেকে যায়। মনন তৈরিতে কোনো না কোনোভাবে ভূমিকা রাখে। নিজের পাঠ ও অভিজ্ঞতা ও জীবনবোধের সঙ্গে মিশে গিয়ে উন্নততর সৃজনে নিমগ্ন রাখে। আন্তন চেখভ, দস্তয়েভস্কি, ইবসেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বনফুল, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের নাম এ মুহূর্তে মনে পড়ছে। যারা আমাকে আলোড়িত করেছেন, করেন। আরও কত জনের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ কত প্রভাব আছে! বিষয়গুলো এত বিমূর্ত যে, স্পষ্ট করে বলা মুশকিল।
চিন্তাসূত্র: ইদানিং পত্র-পত্রিকায় আপনার লেখা খুব বেশি চোখে পড়ে না। কী নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন? এবার আপনার কয়টি বই প্রকাশিত হচ্ছে, সেগুলো কী কী?
মিলু শামস: পেশাগত ব্যস্ততা ছাড়া তেমন বিশেষ কিছু নিয়ে ব্যস্ত নই। বই প্রকাশ নিয়ে হুড়োহুড়ি আমার কখনোই নেই। হয়তো হবে অথবা হবেনা। বইয়ের সংখ্যা বাড়ানোর লোভে পড়লে লেখার বারোটা বাজে। এটা আমার ধারণা।
চিন্তাসূত্র: বাংলা সাহিত্যের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আপনার অভিমত জানতে চাইবো। সাহিত্যচর্চার ক্ষেত্রে আমরা কি সঠিক পথে রয়েছি বলে মনে করেন?
মিলু শামস: দেখুন, প্রতিটা সময়েরই নিজস্ব স্বর থাকে। ওই সময়ের লেখকদের লেখায় তা উঠে আসবেই। অনেক আবোল তাবোল লেখার মধ্য থেকেই দু ’চারজন প্রকৃত লেখক উঠে আসেন। তারাই সময়কে প্রতিনিধিত্ব করেন। সামগ্রিক বিচারে বাংলা সাহিত্যের বর্তমান চর্চা খানিকটা ম্লান মনে হয় বিভিন্ন কারণে। তার মধ্যে অন্যতম ভাষার প্রটি অমনোযোগ। বাংলা ভাষার বিকাশে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে তেমন কোনো কাজ দৃশ্যমান নয়। বিদেশি সাহিত্যের মানসম্মত অনুবাদও কম। এখন ডিজিটাল প্রযুক্তির কারণে ঝকঝকে ছাপা, সুন্দর প্রচ্ছদের সব বই বাজারে আসছে। কিন্তু ভেতরের বিষয়বস্তু বা শৈলী দেখলে প্রায়ই হতাশ হতে হয়। সাহিত্যচর্চায় ভাষার ওপর দখল থাকা অপরিহার্য। কিন্তু খুবই পরিতাপের বিষয় যে, একাধিক উপন্যাস-গল্পের বই প্রকাশিত হয়েছে অথচ লেখকের বাক্যে ক্রিয়াপদই হয়ত ঠিক নেই। এর একটা কারণ সম্ভবত পাঠের ঘাটতি। সাহিত্যপাঠ ভাষার দক্ষতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ জন্য অন্তত নিজের ভাষার ক্ল্যাসিক সাহিত্য অবশ্যই পাঠ করা দরকার। আর ভবিষ্যতের কথা বলছেন? আমার মনে হয় আর দুয়েকটা প্রজন্ম পার হলে সাহিত্যে সত্যিকারের সুবাতাস বইবে। তবে সে জন্য প্রয়োজন রাজনীতি ও অর্থনীতিতে গুণগত পরিবর্তন। একটি বিকশিত বুর্জোয়া সমাজ আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গির সাহিত্যচর্চাকে লালন করে। আমাদের এখানে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশইতো ঠিকভাবে হয়নি।
চিন্তাসূত্র: সমকালীন সাহিত্য জগতে নাকি এক ধরনের রাজনীতি চলছে। এই রাজনীতির বলি হচ্ছেন প্রকৃত সাহিত্যিকরা। সাহিত্যের এই রাজনীতি সম্পর্কে আপনার অভিমত শুনতে চাই।
মিলু শামস: দেখুন, সাহিত্য জগতে রাজনীতি বা গোষ্ঠীপ্রীতি সব সময় ছিল। জীবনানন্দ দাশ তো ওই চক্রব্যুহ ভেঙে স্বসময়ের সাহিত্য জগতে প্রায় প্রবেশই করতে পারেননি। তাই বলে আমরা কি জীবনানন্দ দাশকে পাইনি? সজনী কান্তের ‘শনিবারের চিঠি’র চক্র ও চাবুক সত্ত্বেও একজন কাজী নজরুল ইসলাম কি বেরিয়ে আসেননি? আবার সে সময়ের তথাকথিত কোনো কোনো দাপুটে সাহিত্যিকের নাম কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। বর্তমান সময়েও এসব চর্চা আছে। ভাবসর্বস্ব কিছু লেখক কবি কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানের চেয়ার দখল করে বসে আছে, সেখানে তাদের বলয়ের বাইরের লেখকদের প্রবেশ কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত। দৈনিকের কোনো কোনো সাহিত্যপাতা সম্পর্কেও এই কথা প্রযোজ্য। সম্পাদকের নির্বাচিত বলয়ের বাইরের লেখকদের লেখা ছাপা হয় না বললেই চলে। তবে পার্থক্য হচ্ছে, আগে এই প্রাতিষ্ঠানিক চক্রের তীব্র প্রতিবাদস্বরূপ লিটল ম্যাগাজিন আন্দোলন সক্রিয় ছিল। একেকটি লিটল ম্যাগাজিন জন্ম দিয়েছে সৃজনশীল অনেক লেখক, কবি সাহিত্যিক। এখন সেটা নেই। লিটল ম্যাগাজিনের সেই প্রতিবাদী চরিত্র বিলুপ্ত হয়েছে। সুতরাং প্রতিষ্ঠান এবং গোষ্ঠীপ্রীতির দাপটে প্রকৃত সৃজনশীল লেখক কিছুটা তো কোণঠাসা হচ্ছেনই। তবে আমি মনে করি, সত্যিকারের সৃজনশীলতাকে আটকে রাখা যায় না। কোনো না কোনো সময় তা বেরিয়ে আসবেই।
চিন্তাসূত্র: চিন্তাসূত্রকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
মিলু শামস: আপনাকেও ধন্যবাদ। চমৎকার সব প্রশ্ন করার জন্য।
আরও পড়ুন: ভালো লেখার সঙ্গে বিস্ফোরণের তুলনা চলে ॥ ফারহানা রহমান