(পর্ব-১৮)
সাংবাদিক নির্মল সেন একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্রথমে আশ্রয় নিয়েছিলেন ত্রিপুরার আগরতলায়। এ সময় তিনি দাড়ি রেখেছিলেন, পরতেন খদ্দরের ঢিলেঢালা পাঞ্জাবি আর পাজামা (অবশ্য আমৃত্যু তিনি এ পোশাকই পরে গেছেন)। আগরতলার স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে মনে করতো— তিনি একজন খাঁটি আলেম বা মওলানা। এই মওলানা তখন সারাদিন বই পড়ে সময় কাটাতেন। নির্মল সেন তাঁর আত্মকথায় সে সময়কার একটি ঘটনা উল্লেখ করেছেন এভাবে—‘‘তখন ঢাকায় প্রতি কাপ চা ছিল দুই আনা। আগরতলায় ত্রিশ পয়সা। আমার চা খাওয়ার নেশা ছিল। কিন্তু পয়সা কোথায়। মঠ চৌমুহনীর মোড়ে দু’তিনটি চায়ের দোকান। ভাবলাম ওদের সঙ্গে ভাব করা যায় কিনা। আমি সারাদিন বই পড়ি বলে এলাকায় একটি পরিচিতি আছে। তাদের বিস্ময় যে, একজন মওলানা সারাদিন কী করে বই পড়ে। একদিন একটি রেস্টুরেন্টে ঢুকতেই একটি ছেলে বললো, ‘আপনি কি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হেড মাস্টার?’ বুঝলাম ছেলেটির বুদ্ধির দৌড় সীমাবদ্ধ। তার পরের প্রশ্ন—‘আপনাদের আল্লাহ তো আপনাদের রক্ষা করতে পারলো না। আপনাদের তো ইসলামিক রাষ্ট্র।’ আমি বললাম, তোমাদের কালীও কিছু করতে পারলো না। শুনেছি, গৌরনদী থানার বার্থি কালীবাড়ির কালীকে পাঞ্জাবিরা গুলি করেছে। তোমাদের কালী তাদের কিছুই বলেনি। ছেলেটি একটু মুষড়ে পড়লো। বললো, ‘ধর্ম নিয়ে আলোচনা ভালো নয়।’ আমি বললাম, আমি ধর্ম মানি না। ধর্ম বিশ্বাসও করি না। ছেলেটি বললো, ‘আপনাকে একটি বই পড়তে দেবো। এই বই আমার গুরু দেবের। গুরুর নাম স্বামী স্বরূপানন্দ। তিনি সাক্ষাৎ দেবতা। পৃথিবীতে কী হতে পারে বা হবে সবকিছুই নাকি তাঁর বইতে লেখা আছে।’ আমি ছেলেটির কাছ থেকে স্বরূপানন্দের রচনাবলি নিলাম। ছেলেটি খুশি হলো। সে বললো, এবার প্রতিকাপ চায়ের জন্য আপনাকে ত্রিশ পয়সা দিতে হবে না, বিশ পয়সা দিলেই চলবে।’’ (আমার জবানবন্দি: নির্মল সেন)
রবি ঠাকুরের প্রথম কবিতার বই ‘কবিকাহিনি’ প্রকাশিত হয় ১৮৭৮ সালে। বই আকারে বের হওয়ার আগে দীর্ঘ এই কবিতাটি ধারাবাহিক ছাপা হয়েছিল ‘ভারতী’ নামে একটি মাসিক পত্রিকায়, পরপর চার সংখ্যায়। এ বিষয়ে সুজিতকুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন, ‘‘১২৮৪ বঙ্গাব্দের শ্রাবণে (১৮৭৭) দ্বিজেন্দ্রনাথের সম্পাদনায় ‘ভারতী’র সূচনা। গদ্য ও পদ্যে নানা বিষয়বস্তুতে ঠাসা এ মাসিকপত্রে তখন সেই যুগের (ঊনবিংশ শতাব্দীর) প্রথা অনুযায়ী, লেখার সঙ্গে লেখকের নাম ছাপা হতো না। ‘ভারতী’র প্রথমবর্ষের পৌষ, মাঘ, ফাল্গুন ও চৈত্র—পর পর চারটি সংখ্যায় ‘কবিকাহিনি’ শীর্ষক একটি দীর্ঘ কবিতা ছাপা হয়। লেখাটি কারুর কারুর ভালো লেগেছিল। কার লেখা? কয়েকজন উৎসাহী পাঠক উক্ত লেখকের খোঁজখবর নিয়ে জানলেন, ঠাকুর পরিবারেরই ছেলে। দ্বিজেন্দ্রনাথ ও জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সবচেয়ে ছোট ভাই। নাম রবি। নেহাৎই নকি ছেলেমানুষ, ষোল বছর বয়েস বড় জোর।’’
‘কবিকাহিনি ভারতীতে প্রকাশিত হবার কিছুদিন বাদেই এক মজার ঘটনা ঘটলো। ওই কিশোর কবির এক অনুরাগী তরুণ নাম প্রবোধচন্দ্র ঘোষ, কবিকে না জানিয়েই নিজের খরচে কবিতাটি পুস্তক আকারে ছেপে কবির কাছে পাঠিয়ে দিলেন। কবি তখন গুজরাটের আমেদাবাদে মেজদা সত্যেন্দ্রনাথের কাছে। সত্যেন্দ্রনাথ তখন আমেদাবাদের সেসন জজ। নিজের লেখা ছাপা বই হাতে পেয়ে কিশোর কবি আনন্দে আত্মহারা। প্রথম বই বলে কথা।’
তারপর বছরের পর বছর কাটতে থাকে, তাদের কবিতার বই থেকে বইয়ে যেতে থাকি, আর তখন একদল বিদেশি কবি প্রবেশ করতে থাকেন আমার জগতে, সুসম্পন্ন হয় আমার জগতের বদল
এ ঘটনার বহু বছর পর রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনস্মৃতিতে লিখেছেন, ‘এই কবিকাহিনি কাব্যই আমার রচনাবলীর মধ্যে প্রথম গ্রন্থ আকারে বাহির হয়। আমি যখন মেজদাদার নিকট আমেদাবাদে ছিলাম, তখন আমার কোনো উৎসাহী বন্ধু এই বইখানা ছাপাইয়া আমার নিকট পাঠাইয়া দিয়া আমাকে বিস্মিত করিয়া দেন।’
সুজিতকুমার সেনগুপ্ত আরও বলেছেন, ‘ছাপার অক্ষরে শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর—এই নামযুক্ত সর্বপ্রথম কবিতা ‘হিন্দু-মেলার উপহার’ ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে দ্বিভাষিক অমৃতবাজারে ছাপা হয়। রবীন্দ্রনাথের এ কবিতা পাঠককে তেমন আর্ষণ করতে পারেনি। তিনি নিজেও পরবর্তীকালে, কোথাও কবিতাটির উল্লেখ করেননি।’ (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং: সুজিতকুমার সেনগুপ্ত)
প্রসঙ্গত, ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ের প্রতি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনীহা থাকলেও অন্যসব বই ও পত্রিকা ছিল তার কাছে নেশার মতো। দাদাদের আলমারি থেকে চুরি করে বাঁধানো সব পত্রিকা লুকিয়ে লুকিয়ে পড়তেন।
বই পড়া নিয়ে অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের রয়েছে দীর্ঘ রচনা। স্কুলজীবনে বইপড়া নিয়ে তাঁর স্মৃতিচারণ একটুখানি তুলে ধরছি—‘‘এক সময় একটি মোটা বাঁধানো কবিতার বই হাতে আসে, বিদ্যালয়ের পাঠাগারে পাই বইটি, নাম চয়নিকা। অনেক বছর বইটি কেউ খুলে দেখেনি, অনেক পাতা নষ্ট হয়ে গেছে, খুলে দেখি বইটি আর কারো নয়, রবীন্দ্রনাথের। আমার অষ্টম শ্রেণির কয়েকটি মাস বিভোর হয়ে থাকে ওই বইতে, সব কবিতা পড়ে উঠতে পারিনি বুঝতেও পারিনি সবকিছু। … খুব ছোটবেলায় খুব ভালো লেগেছিল নজরুল ইসলামের ‘আমি হবো সকাল বেলার পাখি’ আর ‘ভোর হলো দোর খোলো খুকুমণি ওঠো রে’। ওই কবিতায় স্বপ্ন আর সৌন্দর্য ছিল, আর ছিল মিলের মধু, তাই মন ভরে উঠেছে সহজেই।’… বিদ্যালয়ে পড়ার সময় আর কোনো কবির কথা জানিনি, যারা ছিলেন না পাঠ্যবইতে।’’
‘… তখন বুঝিনি অপেক্ষা করে আছে মহাবিস্ময়, কবিতার একটি দুরূহ সুন্দর অভাবিত জটিল জগৎ তৈরি হয়ে আছে পাঠ্যবইয়ের বাইরে—যা অবস্থিত আমার চেনা কবিতার জগত থেকে অনেক দূরে। ওই কবিদের কারো নাম ছিল না প্রবেশিকার পাঠ্যবইতে, … তারা পাঠ্যপুস্তকে কবিদের মতো ভালো মানুষ নন, তাদের কবিতা পবিত্র নয় পাঠ্যপুস্তকের কবিতার মতো।… শুনিনি জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তীর নাম, তাদের কবিতা নেই পাঠ্যপুস্তকে। তারা কি বড় কবি নন? মন বলতে থাকে তারা বড় কবি, কিন্তু কত বড় কবি? মধুসূদনের মতো বড়? রবীন্দ্রনাথের মতো বড়? রবীন্দ্রনাথের মতো বড় কবি কি আর হয়? কিন্তু সেই ষোল বছর বয়সে কে আমাকে বলে দেবে তারা কত বড় কবি?’
‘… ষোলো বছর বয়সে যখন আধুনিক কবিতার সঙ্গে পরিচয় ঘটে, তখন ওই কবিতা বুঝে ওঠার মতো কোনো শক্তিই আমার ছিল না। তাদের কবিতার বইগুলোর নামও অন্যরকম— এগুলো আর সোনার তরী, বিষের বাঁশি, সোজন বাধিয়ার ঘাট নয়। এগুলো ধূসর পাণ্ডুলিপি, বন্দীর বন্দনা, অর্কেস্ট্রা, উর্বশী ও আর্টেমিস। জীবনানন্দের ধূসর পাল্ডুলিপি কিনেছিলাম সবার আগে, পড়তে গিয়ে মনে হয় আমি এক বিস্ময়কর বিশ্বের প্রবেশ করেছি, … তারপর বছরের পর বছর কাটতে থাকে, তাদের কবিতার বই থেকে বইয়ে যেতে থাকি, আর তখন একদল বিদেশি কবি প্রবেশ করতে থাকেন আমার জগতে, সুসম্পন্ন হয় আমার জগতের বদল।’
‘‘… আমার মনে প্রশ্ন জাগে—কবিতার উৎকর্ষে কি জীবনানন্দ বা সুধীন্দ্রনাথ বা বুদ্ধদেব বসু সমতুল্য নন রবীন্দ্রনাথের, এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে উৎকৃষ্ট নন তার থেকে? সুধীন্দ্রনাথ দত্তের ‘অর্কেস্টা’ বা ‘উটপাখি’ বা ‘যযাতি’র বা জীবনানন্দ দাশের ‘অবসরের গান’ বা ‘মৃত্যুর আগে’ বা ‘বনলতা সেন’ এর সমতুল্য কোনো কবিতা আছে রবীন্দ্রনাথের? রবীন্দ্রনাথ ব্যাপক ও বিস্তৃত, তিনি রোমান্টিক ধারার শ্রেষ্ঠ কবি, কিন্তু আবেগ কল্পনা শিল্পসৌন্দর্যের অন্যান্য বহু এলাকায় আধুনিকেরা তাঁর থেকে উৎকৃষ্ট, তাঁরা কবিতাকে অপ্রাপ্তবয়স্কতার সীমার বাইরে নিয়ে গেছেন, এবং এমন জগৎ সৃষ্টি করেছেন, যার কোনো তুলনা নেই। তাঁরা সকলের কবি নন, হয়তো কখনো হয়ে উঠবেন না, কিন্তু শ্রেষ্ঠ কবি হওয়ার জন্যে সকলের কবি হওয়ার দরকার করে না।’’
সাদা কাঠের ফলকে মড়ার খুলি আঁকা, নিচে লেখা ডেঞ্জার। উলফ (গাইড) বললো, তখন এই তারের ভেতর দিয়ে হাজার বোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতো।
বাংলার বাণী পত্রিকার নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন শফিকুল আজিজ মুকুল। তিনি অনেকগুলো ভাষা জানতেন। সাংবাদিকতার বাইরে তার অদম্য নেশা ছিল বইপড়া। মুকুলের ৪৩-৪৩ নম্বর পুরানা পল্টনের বাসাটি ছিল একটি বড়সড় পাঠাগার। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়াও হিন্দি, উর্দু, ফারসি, নেপালি ও অসমিয়া ভাষার অসংখ্য দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। ভারত ও পাকিস্তানে বেড়াতে গেলে নিয়ে আসতেন কয়েক কার্টন বই। বইপড়া আর বই কেনা ছিল অকৃতদার শফিকুল আজিজ মুকুলের একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান। ২০০৬ সালে মারা যান এই নির্ভীক সাংবাদিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা।
বই পড়ার নেশা ছিল অ্যাডল্ফ হিটলারেরও। তিনি জন্মেছিলেন এক দরিদ্র পরিবারে। ছোটবেলায় মা-বাবা দুজনই মারা যাওয়ায় অবহেলায় কেটেছে তার কৈশোর। বিশেষ করে ছাত্র অবস্থায় চরম অর্থকষ্ট হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন তিনি। এই সময়ে তার শখ বলতে ছিল বই পড়া আর কদাচিৎ অপেরায় যাওয়া। বই যে কেবল পড়তেন তা-ই নয়, বই পড়ে যা উপলব্ধি করতেন ভবিষ্যৎ জীবনে তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনাও করতেন। হিটলারের মাইন ক্যাম্ফ পড়লে দেখা যায়, বইটির পাতায় পাতায় তিনি বই পড়ার বিষয়ে উল্লেখ করেছেন। মজার ব্যাপার, জার্মানির এই যুদ্ধবাজ এক নায়ক জীবনের শুরুতেই পড়েছিলেন যুদ্ধ সংক্রান্ত বই, তখন থেকেই তার মনে যুদ্ধের বিষয়ে নানান প্রশ্ন জাগতে থাকে—যা তার ভবিষ্যৎ জীবনকেও প্রভাবিত করে।
হিটলার বলেছেন, ‘বাবার বইগুলো নাড়াচাড়া করতে করতে কয়েকটা বইয়ের বিজ্ঞাপন আমার নজরে আসে। সে বইগুলো সবই মিলিটারি সংক্রান্ত। বিশেষ করে একটা বইতো আমাকে ভীষণভাবে আলোড়িত করেছিল। বইটি জনপ্রিয় ফ্র্যাংকো-জার্মান যুদ্ধের ইতিহাস ১৮৭০-৭১। দুটো পর্বে লেখা বইটি। যুদ্ধের তথ্যপঞ্জীতে ঠাসা। এই বইটি পড়তে আমি সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতাম। আর এই বইটি পড়েই কতগুলো প্রশ্ন আমার মনে জেগে ওঠে। মনের ভেতরে প্রচণ্ড আলোড়ন এনে দেয়। যুদ্ধ সংক্রান্ত যা কিছু পেতাম, সেই বয়স থেকেই তা গ্রোগ্রাসে গিলতে শুরু করি। কিন্তু যুদ্ধবিষয়ক এত বই পড়া সত্ত্বেও ফ্র্যাংকো-জার্মান বইটি আমাকে বেশি ভাবিয়ে তোলে।
হিটলারের ছাত্রত্ব কেটেছে ভিয়েনায়। সময়টা তাঁর জন্য মোটেও আনন্দের ছিল না। তিনি জানান, ‘সে বছরগুলো শুধুই দুঃস্বপ্ন বিশেষ। এমনকি সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে আজকে পর্যন্ত মনটা বিষাদে ভরে ওঠে। এই পাঁচ বছরে কখনো দৈনিক শ্রমিক অথবা তুচ্ছ ছবি এঁকে আমাকে রুটি জোগাড় করতে হয়েছে। সেই সময় একটা বই কেনা বা একবার অপেরায় যাওয়ার মানে হলো পরের কয়েকটা দিন মুখিয়ে থাকা, ক্ষুধায় ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালানো। তবু এই দিনগুলোতেই শিখেছি আমি সবচেয়ে বেশি। স্থাপত্যবিদ্যার পড়াশুনার বাইরে মাঝে মধ্যে কদাচিৎ কখনো অপেরায় যেতাম। তখনকার জীবনে বিলাসিতা বলতে ঠিক এইটুকুই। আর বই। হ্যাঁ, বই-ই ছিল ক্ষুধা ছাড়া আমার নিত্যসঙ্গী।’
‘তখন আমি খুব বই পড়তাম। এবং যা যা পড়তাম, সেই বিষয়গুলোকে চেষ্টা করতাম মনপ্রাণ দিয়ে অনুভব করতে। যেটুকু সময় ফাঁকা পেতাম পড়াশুনার মধ্যে ডুবে থাকতাম। সেই অল্প কয়েকটা বছরে বই পড়ে যে জ্ঞান আমি অর্জন করেছিলাম, বলতে দ্বিধা নেই আজও তা কাজে লাগছে। তার চেয়েও বড় কথা—জীবন সম্পর্কে স্বচ্ছ একটা দৃষ্টিভঙ্গি আর পৃথিবী সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা আমার সে সময়েই গড়ে ওঠে। যেটা ভবিষ্যৎ জীবনে আজ পর্যন্ত বদলায়নি।’
ভাবতে অবাক লাগে বই পড়ুয়া এই মানুষটি তাঁর অর্জিত জ্ঞান মানুষের কল্যাণে ব্যয় না করে ধ্বংসের কাজে ব্যবহার করেছেন। জার্মান জাতিকে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠার নেশায় উন্মাদ ছিলেন হিটলার। তাঁর বিরোধিতাকারী লাখ লাখ মানুষকে বন্দি শিবিরে নয়তো গ্যাস-চেম্বারে ঢুকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। রজিনীতিক, শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী কেউ বাদ যাননি। বর্বরতার নিদর্শন হিসেবে এই ক্যাম্পগুলো দেখার জন্য আজও মানুষ ভিড় করেন।
সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির বার্লিনে এরকম একটি ক্যাম্প ঘুরে দেখার পর লিখেছেন, ‘‘আমরা পৌঁছে গেলাম সাকসেনহাউসেন ক্যাম্পে। চারদিকে দশ ফুট উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। দেয়ালের ভেতর দিকে গোল করে প্যাঁচানো কাঁটাতারের ডবল বেষ্টনি। সাদা কাঠের ফলকে মড়ার খুলি আঁকা, নিচে লেখা ডেঞ্জার। উলফ (গাইড) বললো, তখন এই তারের ভেতর দিয়ে হাজার বোল্টের বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতো। ভেতরে ঢোকার পথে উলফ গাইড রুম থেকে ম্যাপ আর গাইড ক্যাসেট নিলো আমার জন্য। ক্যাসেট চালিয়ে হেডফোন কানে লাগিয়ে ক্যাম্পের লাল সুরকি বিছানো পথে পা রাখলাম। ‘তুমি পা রেখেছো লাখো মানুষের রক্তে ভেজা মাটিতে। লখ্য করলে এখনো তুমি রক্তের ছাপ দেখেতে পাবে, রক্তের গন্ধ পাবে। রক্তের এই দাগ কখনও মুছবে না। শহীদের রক্তের দাগ কখনও মুছে ফেলা যায় না।’ ক্যাসেটে ভারি গলায় বর্ণনা শুনছি গাইডের—১৯৩৬ থেকে ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত এই ক্যাম্পে দুই লাখ বন্দি ছিলেন। এদেরকে প্রচণ্ড নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে, একটানা নয়টি বছর।’’ (বলকান থেকে বাল্টিক: ক্রান্তিকালের মানুষ-শাহরিয়ার কবির)
অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেছেন, ‘কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মিলে যেসব বই পড়া হয়েছিল—তা আমাকে গড়ে দিয়েছিল সারা জীবনের জন্য। আজও জীবনবোধের মূলভিত্তি এগুলো।’
চলবে…