পর্ব: ১৭
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কফি হাউসের নাম। একাত্তরে বাংলাদেশের লেখক, কবি-সাহিত্যিকদের যোগাযোগের কেন্দ্রস্থল হয়ে উঠেছিল কলকাতার কলেজ স্ট্রিটের বিখ্যাত কফি হাউস। সেই সময়ের একটা নিখুঁত চিত্র এঁকেছেন সাংবাদিক মানস ভাণ্ডারী। ‘কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস’ গ্রন্থে তিনি জানাচ্ছেন, ‘‘পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় (১৯৭১) এই কফি হাউস শুধু সরগরমই ছিল না, সক্রিয়ভাবে নানান ক্রিয়াকাণ্ডের আঁতুড়ঘরও ছিল।
দেবব্রত মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘তারপর কফি হাউস ক্রমে মুক্তিযুদ্ধের শিবির হয়ে উঠলো। ওপার থেকে একে একে অনেক ছেলে এসে পৌঁছালো। বন্ধু ইসমাইল মোহাম্মদ, কবি সিকান্দার আবু জাফর, আল মাহমুদ, আহমদ ছফা, বেলাল তো ছিল অনেকদিন থেকেই। কফি হাউস থেকে আমরা সংগ্রহ করলাম ওপারে পাঠাবার জন্য আহতদের চিকিৎসার ওষুধ ও যন্ত্রপাতি। গোপনে বোমা ও বন্দুক পর্যন্ত সংগ্রহ করতাম ওখানে পাঠাবার জন্য। কফি হাউসে বসে জহির রায়হান পরিকল্পনা করেন তাঁর বাংলাদেশের ওপরে ডকুমেন্টারি ও কাহিনিচিত্র। বেচারি সদ্যমুক্ত বাংলাদেশে ভাইকে খুঁতে গিয়ে রাজাকারদের হাতে প্রাণ হারান। কফি হাউসের আড্ডাতেই সিকান্দার্ আবু জাফর, আহমদ ছফা, আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ রচনা করেছেন তাঁদের কত কবিতা—অনুপ্রাণিতও হয়েছেন অনেকে। ছোট গল্প ও উপন্যাস রচনায় উৎসাহিত হন শওকত ওসমান…বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে কফি হাউসের অবদান কম নয়।’
আহমদ ছফা তাঁর একটি রচনায় লিখেছেন ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের কথা। তখন তিনি কলকাতায় এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি দেশে ফেরেন। ওই দিন সকাল ১০টায় তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিংয়ের দিকে যাচ্ছেন। সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে পাকিস্তান যুদ্ধের পরিণাম সম্পর্কে। প্রায় সবারই বক্তব্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ শুধু সময়ের অপেক্ষামাত্র। যাই হোক, আহমদ ছফা এগিয়ে চলেছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক দিলীপ চক্রবর্তীর দফতরে যাওয়া তাঁর লক্ষ্য।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক সমিতির নেতা ছিলেন শ্রী চক্রবর্তী। ছফা সেদিনের ঘটনা লিখেছেন, ‘বেলা ১০টা কী সাড়ে ১০টা কিংবা ১১টাও হতে পারে, হঠাৎ প্রেসিডেন্সি কলেজের মোড়ে অজস্র পটকা ফাটোনো শব্দ শোনা গেলো। এই প্রচণ্ড শব্দে দ্বারভাঙ্গা ভবনে একটা আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লো। কেউ কেউ বললেন, নকশালরা একজোট হয়ে রাস্তায় বোমাবাজি করছে। কিন্তু সেটা নকশালদের বোমাবাজি ছিল না। ঢাকার প্রত্যাশিত সংবাদে আনন্দপ্রকাশের সেটা বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃত সংবাদে তারপর দ্বারভাঙ্গা ভবনে আনন্দের হিন্দোল।’
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে এই কফি হাউসের আড্ডাধারীদের অনেকেরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তাঁদের আন্দোলন বিষয়ে দেবব্রত মুখোপাধ্যায় আঁকেন তাঁর বিখ্যাত প্রাচীর চিত্রমালা। বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাদের বীভৎস অত্যাচারের ছবি সংবলিত বিখ্যাত অ্যালবামটি সম্পাদনা করেছিলেন শিল্পী ও সাংবাদিক শিপ্রা আদিত্য। শিপ্রাই প্রথম ভারতীয় নারী যিনি সরেজমিন সংবাদ সংগ্রহে ওই সময় বাংলাদেশে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার এই অ্যালবাম এবং দেবব্রতবাবুর প্রাচীর চিত্রমালা সারাবিশ্বে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেছিল। শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদনা করেছিলেন ‘একুশের রক্তে’, ‘সাংবাদিকদের চোখে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ’ এবং ‘বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গল্প’ শীর্ষক গ্রন্থ।
শুটিং-ফুটিং না থাকলেও প্রায় রোজই সকালের দিকে নিজেই গাড়ি চালিয়ে কফি হাউসে আসতেন নিছক আড্ডা মারতে, সেই সুদূর দক্ষিণ কলকাতা থেকে। সৌমিত্র তখন শুধু সিনেমার নটই নন— শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্য-বিষয়ক মাসিক ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদকদ্বয়ের একজনও।
বাংলাদেশের কবি আবু বকর সিদ্দিক লিখেছেন, ‘কফি হাউসের সেই রমরমা আড্ডা আজও আছে কিনা জানিনে। টেবিলে চাক বাঁধা গুঞ্জন ও হল্লা। ঝলমলে বিদ্যুতের আলো। ট্রে-তে পট সাজিয়ে বেয়ারাদের ছুটোছুটি। সিগারেটের ধোঁয়ায় পাকানো রিং। চশমার ফ্রেমে পিচ্ছিল জেল্লা। মুখর যৌবন ও ইন্টেলেকচুয়াল দীপ্তি…।’
কফি হাউসের আড্ডায় শামিল হন নানা শ্রেণী-পেশার মানুষ। তবে তাদের মধ্যে লেখকদের আড্ডার গুরুত্বই আলাদা। কারণ, তাদের আড্ডা কেবল আড্ডায় ফুড়িয়ে যায় না। বরং এই আড্ডার বিচিত্র কাহিনি তারা কবিতা, গল্প আর উপন্যাসে চিত্রায়িত করেন, যা বইয়ের পাতায় পাতায় সজীব হয়ে থাকে। গানের ছন্দে শিল্পীর কণ্ঠে কফি হাউসের মাহাত্ম বেঁচে থাকে যুগ যুগ। মানস ভাণ্ডারী আরও লিখেছেন, কফি হাউসে বিভিন্ন সময়ে সাহিত্য-সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট বহু মানুষের উপস্থিতি ঘটেছে। তাঁদের আড্ডা, আলোচনা, পরিকল্পনা ও সৃজনে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে এই সীমায়িত চার দেয়াল-মধ্যস্থিত অসীম ভূখণ্ডটি। এখানে এসেছেন অমর্ত্য সেন, সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার, নির্মল আচার্য, হরিসাধন দাশগুপ্ত, কুমার প্রসাদ, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, দীপেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায়, মণীন্দ্র রায়, নারায়ণ স্যানাল, সমরেশ মজুমদার, ঋত্মিক ঘটক, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, মৃণাল সেন, গৌরকিশোর ঘোষ, বিমল মিত্র, সমরেশ বসু, শংকর, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, তুষার রায়, অপর্ণা সেন প্রমুখ আমাদের গৌরব-ব্যক্তিত্বের দল।
কফি হাউস এক সময় যেন প্রেসিডেন্সি কলেজের কমন–রুম হয়ে উঠেছিল। কখনও আবার সেটি যেন, ‘এক্ষণ’ পত্রিকার অফিস। আবার কখনও বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের শিবির।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পর্কে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক লেখায় কফি হাউসের একটি ছবি পাওয়া যায়। সুনীল লিখেছেন, …কৃত্তিবাস পত্রিকার সূত্রেই শক্তির সঙ্গে প্রথম যোগাযোগ। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের উদীয়মান কবি এবং গল্পকারদের আলাদা আলাদা টেবিল। এক-একটা টেবিল আবার এক-একটি লিটল ম্যাগাজিনের কার্যালয়ও বটে। শক্তি তখন বসতো গদ্য লেখকদের টেবিলে, স্ফুলিঙ্গ সমাদ্দার এই ছদ্মনামে টুকিটাকি গদ্য লিখে ‘কুয়োতলা’ নামে একটি উপন্যাসও মকসো করেছে। কবিতার ধারেকাছে নেই। ক্রমশ দেখা গেলো, কবিরাই দলে ভারী, তাদের উদ্দীপনা বেশি। একদিন গুটি গুটি পায়ে শক্তি এসে বসলো আমাদের টেবিলে। গাল ভর্তি দাড়ি, সিগারেটের বদলে বিড়ি খায়, সেটাই ছিল শৌখিনতা। …অচিরে বোঝা গেলো, শক্তি বাংলা কবিতার সিংহাসন দখল করতে এসেছে।’
ষাটের প্রথম দিকে শক্তি চট্টোপাধ্যায় এখানে বসে ‘হাংরি জেনারেশন’ করেছেন। সাহিত্য ও সংস্কৃতির সেই তুমুল বিতর্কমূলক আন্দোলনে যুক্ত ছিলেন মলয় রায় চৌধুরী, সমীর রায় চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, দেবী রায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ একঝাঁক শক্তিমান কবি ও লেখক। পরে অবশ্য শক্তি চট্টোপাধ্যায় এই আন্দোলন থেকে সরে এসেছিলেন। তাঁদের আদর্শ ছিলেন অ্যালেন গিনসবার্গ। আমেরিকায় তখন বিট জেনারেশনের তুমুল হইচই।’
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার রচিত এবং সুপর্ণকান্তি ঘোষের সুরে মান্না দে’র গাওয়া ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা…’ তো আজও আমাদের সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে যায়।’’
কবি বেলাল চৌধুরীর ‘কলকাতায় একাত্তর’ নিবন্ধেও কফি হাউসের সরস বর্ণনা আছে। তিনি লিখেছেন, ‘‘আমাদের প্রধান আড্ডা বই আর লেখাপড়ার পাড়া কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে নতুন নতুন ছেলেমেয়েদের আনাগোনা দেখলেই বোঝা যেত নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরু হয়েছে। নতুন ছেলেমেয়েদের জন্য সকালের দিকে কফি হাউসের প্রধান আকর্ষণ ছিল সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। শুটিং-ফুটিং না থাকলেও প্রায় রোজই সকালের দিকে নিজেই গাড়ি চালিয়ে কফি হাউসে আসতেন নিছক আড্ডা মারতে, সেই সুদূর দক্ষিণ কলকাতা থেকে। সৌমিত্র তখন শুধু সিনেমার নটই নন— শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্য-বিষয়ক মাসিক ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদকদ্বয়ের একজনও।
…এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন ওই একাত্তর সালের মার্চের শেষ দিকে দেখা গেলো কফি হাউসে অন্য এক ধরনের কলকাকলি, ভীতসন্ত্রস্ত নতুন নতুন মুখের ভিড়। মুখের ভাষা থেকে সবকিছুতেই একটা স্বাতন্ত্র্যের ছাপ। এমনিতেই ঘটিদের চলতি বুলিতে রয়েছে ‘বাঙালি মনুষ্য নয়’ জাতীয় একটা শব্দবন্ধ। তার মধ্যে আবার ১৯৪৭ সালের পর একি নতুন উৎপাত। বিকালের মধ্যেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে এলো। পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। নবাগতদের মধ্যে বেশিরভাগই আনকোরা তরুণ। তাদের ভীতি-বিহ্বল মুখ থেকে যেন কথা সরছিল না। মূল ঘটনা ঘটেছে ঢাকায় কিন্তু তার ধাক্কা এসে লেগেছে বাংলাদেশের ছাপান্ন হাজার বর্গমাইলের শেষ সীমানা অবধি। সেটা দেখে এ নৃশংসতার তীব্রতা এবং জের যে কত শক্তিশালী তা যেন ওই কফি হাউসে দাঁড়িয়েও টের পাচ্ছিলাম।’’ (আমার কলকাতা: বেলাল চৌধুরী)
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেন লিখেছেন, ‘‘রমেশ গাড়িটি প্রধান সড়কে রেখে আমাদের একটি ছোট নিয়ন সাইন বোর্ডে ‘কফি হাউস’ লেখা একটি তিন তলা দালান দেখিয়ে বললেন, ‘এটাই কফি হাউস’। আমরা তিন জন ভেতরে প্রবেশ করলাম। একটি বড়সড় হলঘর। প্রচুর টেবিল পাতা। প্রত্যেক টেবিলে পাঁচ থেকে ছয়টি চেয়ার পাতা। …ওপরে চারপাশে টানা বেলকনি। সেখানে প্রচুর লোক। সামনের দেয়ালে রবীন্দ্রনাথের যুবা বয়সের বেশ বড়সড় একটি বহু পুরনো পেইন্টিং শোভা পাচ্ছে। ছবিটিই এই কফি হাউসের মাহাত্ম্যকে ফুটিয়ে তুলেছে।… আমার চোখ পড়লো আরেকটি ছবির ওপরে। পুরনো ছবি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোসের। দু’পাশের দু’টো ছবির সঙ্গে এ কফি হাউসের ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে।’’ (বাংলা বিহার প্রান্তরে: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. এম. সাখাওয়াত হোসেন)
এর একটু পরেই স্ট্রোক করলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ডায়ামন্ড হারবার রোডের ক্যালকাটা হাসপাতালে নেওয়া হলো। রাত পৌনে ৩টার দিকে মারা যান। ভৃত্য বনমালীর হাতে তৈরি এককাপ চা খেয়ে সকালে লিখতে বসতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
অন্যের টাকায় মদ খাওয়ার খ্যাতি আছে কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের। মদ খেয়ে কফি হাউসে তাঁর মাতলামির অনেক ঘটনা আছে, যা আজো আলোচনার খোরাক জোগায় তাঁর বন্ধুবান্ধব এবং অনুসারীদের। মাতাল অবস্থায় কবি বন্ধুদের পাছায় লাথি মেরে বলতেন, ‘শালা নিশিকুটুম্ব। মার্কিন সাহিত্য চুরি করে লিখিস। প্রেম, ঘৃণা, খিদের কী জানিস তুই? যা, চৌর্যবৃত্তির জন্য তোকে আকাদেমি দিলুম।’ একবার ঢাকার আবদুল্লাহ আবু সায়ীদকে শক্তি বললেন, ‘দ্যাখো, তুমি হলে গিয়ে আমাদের অতিথি, গেস্ট। তোমাকে আমাদের বলা উচিত নয়। কিন্তু তোমাদের তো দেখছি হাত ঝাড়লেই টাকা ঝরে। তোমাদের ঢাকার লোকদের ব্যাপার-স্যাপারই আলাদা’, এই বলে সেদিন সায়ীদের পকেট খসিয়ে মদ খেয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। এ নিয়ে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের মন্তব্য, ‘চিরকাল পশ্চিমবঙ্গের ঘটিদের তুলনায় আমাদের বাঙালদের মেজাজ অনেক খোলা আর দিলদরিয়া।’
যে কফি হাউসকে নিয়ে এত আলোচনা এত হল্লা, সেই কফি হাউসের রয়েছে দীর্ঘ ঐতিহ্য ও ইতিহাস। সেই ইতিহাসের একটুখানি তুলে ধরছি—কলেজ স্ট্রিটের যে ভবনে কফি হাউস অবস্থিত, সেই ভবনটির নাম অ্যালবার্ট হল। তারও আগে এই বাড়িটির মালিক ছিলেন রামকমল সেন। কী করে সেটি অ্যালবার্ট হল নামকরণ হলো, সে ভিন্ন এক ইতিহাস, সে দিকে যাচ্ছি না। তবে এই অ্যালবার্ট ছিলেন রাণী ভিক্টোরিয়র স্বামী।
১৯৪৪ সালে কলেজ স্ট্রিটে কফি হাউসের যাত্রা শূরু। তারও কিছু আগে ১৯৩৬ সালে Coffe Cess কমিটি ভারতে কফি তৈরি শুরু করে। তারা প্রথম কফি হাউস চালু করে মুম্বাই শহরে। এর কিছুকালের মধ্যই ১৯৪০ সালে ব্রিটিশ-ভারতে পঞ্চাশটিরও বেশি কফি হাউস গড়ে ওঠে বিভিন্ন শহরে। কিন্তু ১৯৫০ সালে এসে এগুলোকে বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা এ কে গেপালনের উদ্যোগে বাঙ্গালোরে ১৯৭৫ সালে একটি কো-অপারেটিভ সোসাইটি গঠিত হয়। কফি হাউসগুলোকে পরিচালনার জন্য বর্তমানে সারা ভারতে ১৩টি কো-অপারেটিভ সোসাইটি রয়েছে। প্রত্যেক কো-অপারেটিভ সোসাইটি স্বতন্ত্র। নির্বাচিত ম্যানেজিং কমিটি এই সোসাইটি পরিচালনা করে।
সুদূর অতীতে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি নিজেদের ব্যবহারের জন্য লালবাজার এবং বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটে কয়েকটি কফি হাউস তৈরি করেছিল। সেগুলো কোনোভাবেই জনসাধারণের জন্য ছিল না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার দুই-তিন বছর পর ইন্ডিয়ান কফি মার্কেটিং এক্সপ্যানশন বোর্ড কলকাতায় ‘চৌরঙ্গী কফি হাউস’ খোলে। ব্যবসায়িক সাফল্য ও জনপ্রিয়তায় উৎসাহী হয়ে বোর্ড দু-এক বছরের মধ্যে কলেজ স্ট্রিটে অ্যালবার্ট হলে তাদের দ্বিতীয় কফি হাউসের সূচনা করে। ১৯৪৪ সালে কেন্দ্রীয় সরকার এর নামকরণ করে ‘কফি হাউস’।’’
কফির বিকল্প চা নিয়ে অল্প কিছু কথা। পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে চীন ছাড়া পৃথিবীর কোথাও চায়ের প্রচলন ছিল না। ১৬১০ সালে ওলন্দাজ বণিকরা সর্ব প্রথম চীন থেকে চা আমদানি শুরু করেন। চীনই তখন চায়ের একমাত্র জোগানদার। তাই ইউরোপে সব চা আসতো চীন থেকে। চীন-জাপান যুদ্ধের ফলে চীনের সঙ্গে ইউরোপের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। ফলে চায়ের ব্যাপক মূল্য বৃদ্ধি ঘটে। ইউরোপের মানুষ ততদিনে চায়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু চীন থেকে চা আমদানি করা যাচ্ছে না। এ অবস্থায় বিকল্প পথের সন্ধান করা শুরু হয়।
ভারতবর্ষ তখন ইংরেজদের দখলে। অনেক সলাপরামর্শের পর ১৮৩৫ সালে বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি রয়েল কমিশন গঠন করা হয়। এই কমিশনের দায়িত্ব হচ্ছে ভারতবর্ষে চা উৎপাদন করা যায় কিনা, তা অনুসন্ধান করে দেখা। এই কমিশন কাজ শুরু করার আগেই খবর পাওয়া গেলো যে, ভারতবর্ষে চা গাছের সন্ধান মিলেছে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক সাহেবের বাবুর্চি মো. ওয়ারিয়া সিলেরচর অথবা করিমগঞ্জের এক টিলায় চায়ের গাছ দেখেছেন। বাবুর্চির বাড়ি ছিল জকিগঞ্জে। তিনি তাঁর খুঁজে পাওয়া গাছের কিছু পাতা নিয়ে তাঁর সাহেবকে দেন। এই পাতা পরীক্ষা করে ইংরেজরা স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে, ভারতবর্ষে চায়ের আবাদ সম্ভব এবং বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে লাভজনক হবে। ১৮৩৫ সালে চীন দেশের সীমানার বাইরে সর্বপ্রথম চা উৎপাদনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে ১৮৫৪ সালে পরীক্ষামূলকভাবে সিলেট শহরের অদূরে মালনীছড়া চা বাগানের পত্তন করা হয়। এরপর ভারতবর্ষে বিশেষ করে আসামের ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় সিলেট ও কাছাড় জেলায় চায়ের উৎপাদন দিনকে দিন বাড়তে থাকে। সংক্ষেপে এই হচ্ছে ভারত তথা বাংলাদেশে চা উৎপাদনের আদি পর্ব। (সুরমা উপত্যকার চা শ্রমিক আন্দোলন: অতীত ও বর্তমান: ইসহাক কাজল)
চা নিয়ে যেমন অনেক কাহিনি রচিত হয়েছে, তেমনই আছে অনেক মজার মজার ঘটনাও। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িয়ে আছে চা। কীভাবে? গল্পকার ব্যারিস্টার সাইফুর রহমান এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন এভাবে—‘১৭৭০ সালে ব্রিটিশ সরকার ব্রিটেন থেকে চায়ের ওপর আরোপিত শুল্ক প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু তাদের ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র আমেরিকাতে কিন্তু চায়ের ওপর শুল্ক ঠিকই বহাল থাকে। যেহেতু ব্রিটিশ পার্লামেন্টে আমেরিকার কোনো সংসদ সদস্য থাকার সুযোগ ছিল না, তাই তারা পার্লামেন্টে এ বিষয়ে কোনো প্রতিবাদও করতে পারলেন না। বরং তারা প্রতিবাদ করলেন অন্য একটি উপায়ে। ১৬ ডিসেম্বর সালটি ১৭৭০, বোস্টন নৌবন্দরে চা বোঝাই তিনটি জাহাজ থেকে আমেরিকার মুক্তিকামী মানুষ সমস্ত চায়ের পেটি ছুড়ে ফেলে দিলেন সাগরে। আর এর মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে গেলো আমেরিকার স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রাম।’
ঘটনাটি ১৬৬২ সালের মে মাসের। পর্তুগালের রাজকুমারী ক্যাথেরিন ব্রাগেঞ্জা ইংল্যান্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের রানি হতে যাচ্ছেন। বিয়ে উপলক্ষে এরইমধ্যে উভয় পক্ষের চুক্তি হয়েছে। চুক্তির শর্তানুযায়ী, রাজকুমারীর বাবা যৌতুক হিসেবে পর্তুগিজদের অধীনে থাকা ভারতের বোম্বাই সংলগ্ন দ্বীপগুলো পাঁচশো পাউণ্ডের বিনিময়ে ইংল্যাণ্ডের রাজাকে দিয়ে দেন। ক্যাথেরিনের আগমন উপলক্ষে রাজ প্রাসাদে জমকালো উৎসবের আয়োজন সম্পন্ন। রাজা বেজায় খুশি। শুভেচ্ছা জানানোর পর চার্লস ভবিষ্যৎ রানির কাছে জানতে চাইলেন, যাত্রাপথের ক্লান্তি দূর করতে তার কী ধরনের পানীয় পছন্দ। ক্যাথেরিনের জবাব— ‘এক পেয়ালা চা-ই যথেষ্ট।’ চার্লস হতভম্ব হয়ে গেলেন! কারণ, চায়ের কথা এর আগে শুনেছেন কিনা তাও ঠিক মনে পড়ছে না। তিনি বললেন, ‘দুঃখিত, এখানে চায়ের প্রচলন নেই। বরং একগ্লাস বিয়ার হলে আপনার মন্দ হবে না।’
নারীবাদের জননী হিসেবে খ্যাত সিমন দ্য বোভোয়ার দিনের শুরুতে, মাঝে এবং কাজের শেষে চা পান করতেন। চায়ের নেশা ছিল রাশান সাহিত্যিক ফিওদর দস্তয়ভস্কিরও। তিনি বলেছেন, ‘পৃথিবী গোল্লায় যাক, আগে আমি এককাপ চা চাই।’ আবার ব্রিটিশ লেখক সি এস লুইস চা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘বড় এক পেয়ালা চা অথবা বড় একটি বই ছাড়া আমার চলবেই না।’
বুদ্ধদেব বসু ১৯৭৪ সালের ১৮ মার্চ সন্ধ্যায় এক পেয়ালা চা পান করেন। এর একটু পরেই স্ট্রোক করলেন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে ডায়ামন্ড হারবার রোডের ক্যালকাটা হাসপাতালে নেওয়া হলো। রাত পৌনে ৩টার দিকে মারা যান। ভৃত্য বনমালীর হাতে তৈরি এককাপ চা খেয়ে সকালে লিখতে বসতেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই বনমালীকে নিয়েই কবি রচনা করেন ‘পুরাতন ভৃত্য’ নামে কবিতা।
চলবে…