পর্ব-১৭ (শেষ পর্ব)
তিস্তা দর্শন
সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে উঠলাম জিপে। আবারও সেই সুষম ঢাল পেরিয়ে তিস্তা ব্রিজ পার হচ্ছিলাম। যাচ্ছিলাম শিলিগুড়ি। আবারও পথের ধারে সেই ত্রিবেণী। মোহজাগানিয়া নদী। মন বলছিলো, এই তিস্তার পাড়ে যদি বাড়ি হতো আমার, হোক সে কুঁড়েঘর।
হলফ করে বলতে পারি, ত্রিবেণীতে তিস্তা যতটা সুন্দর, ততটা আর কোথাও নয়। এখানে সে ষোড়শী। নববধূর মতো। তিস্তার সবচেয়ে আকর্ষণীয় জায়গাটা ওটাই। ত্রিবেণী ভিউ পয়েন্টের দক্ষিণে নিচের দিকটা পার হচ্ছিলাম। আগের দিন মন চাইছিল, ওই জায়গাটায় যদি যাওয়া যেতো। শিলিগুড়ি যাওয়ার পথে সেখানেই আটকে গেলো মন। গাড়ি থামাতে বললাম। সবাই নেমে গেলাম নদীর পাড়ে। নদীর একটা অসাধারণ ভিউ পাওয়া গেলো। ছবি তুলতে শুরু করলাম। প্রবল বর্ষণ হচ্ছিল কিছুদিন ধরে। পাহাড়ের গা বেয়ে আসা সেই ঘোলা পানিতে নবযৌবনা নদী। জলের ওপর ভেসে আসছিল একটা সবুজপাতাসহ বন্য ফুল। শতকূল ছুঁয়ে আসা ফুল কত মন ভাঙানিয়ার আশা জাগায় হয়তো। পাহাড়ের গা-ঘেঁষে জায়গা করতে না পেরে একেবেঁকে গেছে নদী। একেবারে ফনিল সাপের মতো। খরস্রোতা তিস্তার জল ভাটিতে তৈরি করবে সর্বনাশা ঢল।
জায়গাটি এত চমৎকার যে, ওটাকে ছেড়ে আসতে মন চাইছিল না। পাহাড় আর নদীর এমন মেলবন্ধন সবাইকে টানে। পাহাড়ি নদীগুলো সরু হয়। কিন্তু দেখতে সুখজাগানিয়া। ট্রেন্ট রিভার দেখেছিলাম যুক্তরাজ্যে গিয়ে। সেটার ধারা সোজা। আর তিস্তা হলে জনম বাঁকা। তবে দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে যথন সে চলে এসেছে ক্যামেরায় সে দৃশ্য অপরূপ মোহনীয়।
এতদিন আমাদের সঙ্গে ছিলেন পার্থ। দেখেছেন আমাদের সব স্বার্থ। আমাদের গাইড। আজ তাকে বিদায় বলতে হবে। ডাকলাম। মিল্টনকে বললাম আমাদের দুজনের ছবি তুলে দিতে। লোকটি একেবারে আমাদের একজন হয়ে উঠেছিল। আমাকে জড়িয়ে ধরে ছবি তুললো।
আরও ভাটিতে এসেছিলাম চলে। তিস্তা ধরেই যাচ্ছিলাম। চমৎকার একটা ব্রিজ পেলাম। পার্থ বললো, এটাকে বলা হয় করোনেশন ব্রিজ। ব্রিটিশ আমলে তৈরি। নির্মাণ শৈলীতেও আভিজাত্য। এক কথায় এটি বিখ্যাত একটি ব্রিজ। ডুয়ার্সের সঙ্গে শিলিগুড়ির যোগাযোগের জন্য এই ব্রিজ। দুই পাহাড়ের মাঝখানে এমন দৃষ্টিনন্দন সেতু পৃথিবীতে খুব কমই আছে। পানির স্তর থেকে এটি অনেক উঁচুতে। নির্মাণ শৈলী দৃষ্টিনন্দন। মাঝখানে ইংরেজিতে লেখা ‘করোনেশন ব্রিজ’। করোনেশন শব্দের অর্থ অভিষেক। সাধারনত কোনো রাজ্যের অভিষেক বোঝায়। ঘুম রেলস্টেশন প্রসঙ্গে বলছিলাম অষ্ট্রিয়ার সেমারিং রেল লাইনের কথা। সেখানে দুটি পাহাড়ের মধ্যে চমৎকার নির্মাণ শৈলীতে রেল ব্রিজ তৈরি করা হয়েছিল। বলা চলে সে রকম একটি সুন্দর সড়ক সেতু এই করোনেশন ব্রিজ। ১৯৩৭ সালে এটি তৈরি হয়েছিল। ২০১১ সালের ভূমিকম্পে এটি কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সরকারিভাবে এর ওপর দিয়ে ভারী যান চলাচল নিষেধ করা হয়েছিল। তাতে লাভ কী? বিকল্প সেতু না থাকায় ওর ওপর দিয়েই সব চলছিল। অবশ্য একটা বিকল্প সেতু বা দ্বিতীয় সেবক সেতুর দাবি উঠেছে অনেক দিন ধরেই। ও হ্যাঁ, ওই এলাকার নাম সেবক বা সেভক।
ডুয়ার্সে যাওয়ার জন্য করোনেশন সেতু বানানো হয়েছিলো। ডুয়ার্সটা কোথায়? বিশেষ করে বুদ্ধদেব বসুর লেখায় এই ডুয়ার্সের বর্ণনা সবচেয়ে বেশি পাওয়া যায়। ডুয়ার্সের চা বাগানে তার বেড়ে উঠো। বুঝতেই পারছেন চা বাগানের জন্য জায়গাটি বিখ্যাত।
ডুয়ার্স একটি অঞ্চলের নাম। ডুয়ার্স শব্দের অর্থ প্রবেশদ্বার। উত্তর পূর্ব ভারতের প্রবেশদ্বার বলা হয় একে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের কিছু অংশ নিয়ে এই অঞ্চল। ভারত ও ভুটানের মধ্যে সড়ক যোগাযোগ হয় ডুয়ার্স দিয়ে। এটিও পাহাড়ি এলাকা। সমভূমি ও পার্বত্য অঞ্চলের মিশেল রয়েছে ডুয়ার্সে। এর মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে জংলী নদী সংকোশ। পশ্চিবঙ্গের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার ও কোচবহিার আর আসামের ধুবড়ি, কোঁকড়াঝাড়, বরপেটা, গোয়ালপাড়া ও বঙাইগাঁও জেলার অংশ বিশেষ নিয়ে ডুয়ার্স অঞ্চল। এই অঞ্চলের নদীগুলোতে কমবেশি সারা বছরই পানি থাকে। হিমালয় থেকে জল বেয়ে নিচে নামে এসব নদী দিয়েই। তিস্তা, তোর্সা, জলঢাকা, মহানন্দা, কলজানি, বালাস এসব এলাকার নামকরা নদী। রাঙগিত হচ্ছে তিস্তার প্রধান উপনদী। তবে ডুয়ার্সের বেশিরভাগ এলাকা ঘন বনে আবৃত। গণ্ডার ও হাতির বিচরণস্থল হিসেবে ডুয়ার্স পরিচিত। এখানকার বনে বাঘ, হরিণ ও নানা রকমের বিচিত্র পাখি দেখা যায়।
ডুয়ার্সকে বলা চলে উদ্যান ও অভ্যয়ারণ্য অঞ্চল। এখানকার কয়েকটি এলাকা বেশ বিখ্যাত। যেমন গরুমারা অভ্যয়ারণ্য, বক্সা জাতীয় উদ্যান, জলদাসপাড়া অভয়ারণ্য, মহানন্দা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, কাজিরাঙা, মানস জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি। এসব জায়গা পর্যটকদের ব্যাপক আকর্ষণ করে। ডুয়ার্সের পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে সারা বছরই লোকজন বেড়াতে যায়।
করোনেশন ব্রিজের পরেই একটা জায়গায় দেখলাম বিশাল বিলের মতো। তিস্তার প্রথম সমতল দর্শন। প্রথম উপত্যকা। বেসিনের মতো জায়গা। একে সেবক বা সেভক বেসিনও বলা হয়। এখান থেকে প্রচুর পাথর আহরণ করা হয়। সেগুলো ট্রাকে করে চলে যায় বাংলাদেশে, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। পাথর নিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ। এই অঞ্চলে পাথরের সবচেয়ে বড় ব্যবসাকেন্দ্র ওটি। বাংলাদেশের বাংলাবান্ধা ও বুড়িমারি দিয়ে পাথর আসে ভারত থেকে। ওসব পাথরের চালান যায় ওই সেবক থেকেই।
সেবক পার হয়ে দেখলাম দুপাশে সমতল বন। গজারি আর শাল গাছ। আছে চা বাগানও। রাস্তা ঘেষে জামরুল গাছের সারি। রঙ্গিন ফুল ফুটে আছে। মনে হচ্ছিল আমরা ওই রাস্তা দিয়ে যাব বলে ফুলেল তোরণ সাজানো। আরও সামনে সেনাবাহিনী ঘাটি। ক্যান্টনমেন্ট। পাশেই শুকনা নদী। দুপুর নাগাদ চলে আসলাম শিলিগুড়ি।
শিলিগুড়িতে আবারও সেই হোটেল স্বস্তিকা। সত্যি! এখানকার খাবারটা অসাধারন! বাঙালি খাবারের আসল টেস্ট ওখানে পেয়েছিলাম। খাবারের স্বস্তি পেতে চাইলে স্বস্তিকার বিকল্প নেই। খাবার খাওয়ার সময় একটা চমক ছিল। সেদিন ছিল সোহাগের জন্মদিন। তাকে না জানিয়ে আমরা কেকের অর্ডার দিয়েছিলাম ফোনে। সোহাগ তো লাঞ্চের সময় কেক দেখে অবাক! আনন্দে কেঁদে ফেলার জোগাড়। বলছিল, এত মানুষের সঙ্গে জন্মদিনের কেক কাটব। ভাবিনি! এই তো জীবনের প্রাপ্তি!
লাঞ্চ শেষে টুকটুকে চড়ে গেলাম শ্যামলি কাউন্টারে। যাওয়ার পথে সিটি ট্যুরও হয়ে গেলো। ব্যাগ রেখে পার্থকে নিয়ে বের হলাম। পকেটে যতগুলো রুপি ছিল সব দিয়ে চকলেট কিনলাম। আমার সঙ্গে নূরুল, আলভি ও জনিও ছিল।
বাস চলতে শুরু করলো। স্বস্তিকার খাবার, শ্যামলির ঠাণ্ডা বাতাস, দুপাশের দেশজ প্রকৃতি। মন ভরিয়ে দিচ্ছিল। কে জানে, আবার কবে যাবো দার্জিলিং-কালিম্পং!
তার আগে পার্থ আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিলো। তার মন কিছুটা ভার। বলছিলো, গাইড হিসেবে অনেকের সঙ্গেই কাজ করি। তবে আপনাদের সঙ্গটা ছিলো অসাধারণ।
সময়টা ছিলো বসন্তের শেষ, গ্রীষ্মের শুরু। দার্জিলিং কালিম্পং আর ডুয়ার্সে প্রচুর বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির জল সব নেমে আসছিল নিচের দিকে। তিস্তা হঠাৎই ফুলে ফেঁপে উঠছিল জল কল্লোলে। দূর থেকে তিস্তার রুপোলি জল ঝিলমিল করছিল। বাসের জানলা দিয়ে দেখছিলাম।
কিছু ভিডিও দেখেছিলাম পাহাড়ি ঢলের। বনের ভেতর দিয়ে বৃষ্টির জল কিভাবে ঢালু বেয়ে ধেয়ে চলে। ওই বৃষ্টির জলে পা ভেজানো বা হেঁটে যাওয়ার ইচ্ছে আমার অনেক দিনের। সেই জল গড়িয়ে নদীতে পড়ে। আকস্মিক ঢলে ভাসিয়ে নেয় অনেক কিছু। দেখলাম চোখের নিমিষে পানি এসে ভিজিয়ে দিচ্ছিলো শুকনো বালু। অনেকে তিস্তা থেকে বালু তুলছিলেন। সেসব বালু সরানোরও সুযোগ পাচ্ছিলেন না। বালু উঁচু করে বাঁধের মতো দেওয়া ছিল দুই-এক জায়গায়। বানের জল ভাসিয়ে নিচ্ছিল সেসব।
এই তিস্তা নিয়ে বলতে গেলে দিস্তায় দিস্তায় কাগজ শেষ হয়ে যাবে। ত্রি-সেরাতা বা তিন প্রবাহ থেকে নামটি এসেছে। তিনটি প্রধান শৃঙ্গ থেকে নেমে আসা তিনটি ধারা যুক্ত হয়েছে তিস্তায়। সিকিমে এর উৎপত্তি। অবশ্যই হিমালয় থেকে। সিকিম গিয়ে দেখেছিলাম সেখানে তিস্তার ধারা অনেক ক্ষীণ। যত বঙ্গোপসাগরের দিকে গিয়েছে তত এটি প্রশস্ত হয়েছে। মূলত হিমালয়ে চিতামু হ্রদ থেকে এর সৃষ্টি। এটি ৭২০০ মিটার উচ্চতায়। সিকিম থেকে এসে দার্জিলিং এ শিভক গোলা নামে একটি পাহাড়ি এলাকায় এটি অসংখ্য প্যাঁচ খেয়েছে। সেবক এর আগ পর্যন্ত এটি বন্য নদী। ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে এর পথচলা। সেবকের করোনেশন ব্রিজ থেকে অনেকটা ভাটিতে দুয়ার সমভূমিতে প্রবেশ করেছে তিস্তা। পেরিয়ে গেছে শিলিগুড়ি, ঝলপাইগুড়ি জেলা। তারপর নীলফামারি জেলার কালিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশে। রংপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা হয়ে পড়েছে ব্রহ্মপূত্রে।
এরপর যমুনা নাম নিয়ে পাটুরিয়ায় মিলিত হয়েছে পদ্মার সঙ্গে। চাঁদপুরে মিলেছে মেঘনার সঙ্গে। নোয়াখালী আর ভোলার মাঝ দিয়ে গিয়ে পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। তিস্তার দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার। সিকিম, পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের প্রাণসঞ্চারীনি হিসেবে পরিচিত তিস্তা।
তিস্তার উৎস উত্তর সিকিমের হিমালয় পর্বতমালার ১৭৮৮৭ ফুট উচ্চতায়, মিটারে হিসেব। একটা কনফিউশন আছে, কেই বলে চিতামু হ্রদ থেকে আবার কেউ বলে সোলামো নামের একটা হৃদ তিস্তার শুরু। হতে পারে আঞ্চলিক ভাষায় ওই দুই নামেই ডাকা হয় হ্রদটিকে। হৃদটি শেসচেনের কাছে ডোংখা গিরিপথের উত্তরে অবস্থিত। দাঁত ভাঙা নামের কিছু ছোট ছোট শৃঙ্গ রয়েছে সেখানে। ওইসব থেকে নেমে আসা জলধারা সৃষ্টি করেছে তিস্তার। ছাঙ্গু বা সাঙ্গু, ইউমথাং ও ডোংকিয়া তাদের মধ্যে অন্যতম। ওই প্রধান ত্রিধারাই তিস্তার ধারাপাতের উৎস। কারো কারো মতে, করতোয়া, পুনর্ভবা ও আত্রাই; এই তিন ধারা নিয়ে তিস্তা। সিকিমের রংপো ও পশ্চিমবঙ্গের তিস্তবাজার দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা দুটি রাজ্যকে আলাদা করেছে।
ত্রিবেণী পয়েন্ট, যেখানে কালিম্পং এবং দার্জিলিংয়ের মধ্যে সীমানা নির্ধারক তিস্তা ব্রিজ; ঠিক তার কিছুটা আগে রাঙ্গিত গিয়ে মিশেছে তিস্তায়। তিস্তার পানি বন্টন নিয়ে বাংলাদেশ কিছুটা বেকায়দায়। অভিযোগ রয়েছে বাংলাদেশ তার প্রয়োজনীয় পানি পাচ্ছে না। এ নিয়ে দুদেশের মধ্যে আলোচনাও হয়েছে। তিস্তার গজব এখন গজলডোবা। বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ৬০ কিলোমিটার উত্তরে গজলডোবায় ভারত ১৯৯৮ সালে তিস্তা বাঁধ নির্মাণ করে। বাঁধে ৫৪ টি গেট রয়েছে। যেগুলো বন্ধ করে ভারত পানি নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। তিস্তার পানি মহানন্দা খালে প্রবাহিত করা হয়। যা সেচ কাজে লাগানো হয় জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং, উত্তর ও দক্ষিন দিনাজপুর, কোচ বিহার ও মালদহ জেলায়।
তিস্তার পানি নিয়ে ভারতের আরো বৃহৎ পরিকল্পনা রয়েছে। আন্তঃনদী সংযোগ এর মাধ্যমে মেচী নদীতে তিস্তার পানি ঠেলে দিয়ে কৃষিকাজে ব্যবহার করা হবে বিহার এবং মালদহ জেলায়। ফারাক্কার উজানে ফুলহার নদের সঙ্গেও সেটি যুক্ত হওয়ার কথা।
বাংলাদেশ অংশেও তিস্তা ব্যারেজ বানিয়েছে সরকার। বাংলাদেশের ফসল এবং প্রাণী জগতে তিস্তার সুস্পষ্ট প্রভাব রয়েছে। বাংলাদেশে তিস্তা নদীর রুল নাম্বার ৫২।
জানা গেলো, ১৮ শতকের শেষ পর্যন্ত তিস্তার এই ধারা গঙ্গানদীর সঙ্গে মিশতো। তখন নাকি করোতয়ার মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিলো। এখনো নাকি বুড়ি তিস্তা নামে সেই ধারাটি দৃশ্যমান। ১৭৮৭ সালে অতিবৃষ্টির কারণে ব্যাপক বন্যা হয়। সেই সময় পাহাড় থেকে নেমে আসা বিশাল জলরাশির চাপ সামলাতে না পেয়ে তিস্তা গতিপথ বদলে নেয়। সৃষ্টি হয় বর্তমান পথের। গাইবান্ধার চিলমারি বন্দরে গিয়ে এটি ব্রহ্মপূত্র নদের সঙ্গে মিলেছে। রেনেল নামে এক ভদ্রলোকের তৈরি করা একটি ঐতিহাসিক মানচিত্র রয়েছে। যা ১৭৬৪ থকে ১৭৭৭ সালে তৈরি। সেখানে দেখা যায় উত্তরবঙ্গের পুনর্ভবা, আত্রাই এবং করতোয়ার তিস্তার পানি এসে পড়তো। এই ধারাগুলো আবার মহানন্দায় পড়তো।
আবারও সেই বরুন রায়ের প্রসঙ্গে আসি। যিনি পাবনার বেড়ায় থাকেন। তার দুই বন্ধু ওহিদুজ্জামান এবং বকুল ভাইকে নিয়ে এক মধ্য রাতে গিয়েছিলাম বেড়ার পূব পাশের নদীতে। যে নদীর জল দিয়ে পাবনা সেচ প্রকল্প চলে। সেদিন ছিল চাঁদনী রাত। স্যুইচ গেটের ওপর বসে ছিলাম। চারদিক আলোকিত করে পূব আকাশে চাঁদ উঠেছিল। হালকা কুয়াশা ছিলো নদীর ওপর। দুই-একটা নৌকা চলছিল তখনো। দূরে কোনো নৌকায় আলো জ্বলছিল। কেউ কেউ মাছ ধরছিল। তখন জিজ্ঞেস করেছিলাম নদীটির নাম কী? বলেছিলেন হুরা সাগর। যেদিন অবাক হয়েছিলাম, এই নামে কোনো নদী আছে! আমি ভেবেছিলাম ওটা বড়াল নদী। যেটি বাঘাবাড়ি দিয়ে বেড়ার দিকে গিয়েছে। কথাটি বলার কারণ আছে। রেনেলের ওই মানচিত্রে হুরা সাগর দেখানো হয়েছে। যেটি জাফরগঞ্জে গিয়ে মিশেছে পদ্মার সঙ্গে। তবে আমি দেখেছি অন্যভাবে। হুরাসাগর গিয়ে মিশেছে যমুনার সঙ্গে। অনেকেই হয়তো জানেন না যমুনা সংল্গন হুরা সাগরে জেলেরা অনেক ইলিশ মাছ পান। একবার ওই তিনজনের সঙ্গেলশ ধরা দেখতে। সেবার জেলে নৌকায় রান্না করা টাটকা ইলিশ খেয়েছিলাম।
গড়ে প্রতিমাসে ২৪৩০ কিউসেক পানি প্রবাহিত হয় তিস্তা দিয়ে। নদীটির পথের ধারে অনেকগুলো গিরিখাত রয়েছে। এর তীরে পর্ণমোচী এবং লতাগুল্মের দেখা মেলে। তিস্তায় প্রচুর সাদা বালি মেলে। যা নির্মাণ কাজের কাঁচামাল হিসেবে সমাদৃত। এর পাথুরে পথে অনেক বড় বড় বোল্ডার দেখা যায়। যেকারণে রাফটিংয়ের জন্য নদীটি আদর্শ। এটি বেশ খরস্রোতা। ফলে তিস্তায় ভূমিধ্বস হয়। তিস্তার ঘুর্ণিস্রোতে অনেকের সলিল সমাধিও হয়েছে।
বেলা থাকতেই চেংরাবান্ধা বন্দরে পৌঁছালাম। ভারতীয় অংশে ব্যাগপত্র চেক করলো। চা পাতা আর চকলেট ছাড়া আমার ব্যাগে কিছু নেই। অন্যদের ব্যাগের তেমন কিছু ছিলো না। পার পেয়ে গেলাম সহজেই। বাংলাদেশ অংশেও অবশ্য চেকিং হলো। কারও ব্যাগেই আপত্তিকর কিছু ছিল না। পাসপোর্টে দুটো সিল নিয়ে বাংলাদেশে ঢুকলাম।
শ্যামলী বাস রেডি ছিল। যার যার আসনে বসে গেলাম। আসার সময় যে সিটে যিনি ছিলেন, ফেরার সময়েও তাই। খুব দ্রুতই বাস ছেড়ে দিলো। মূল রাস্তায় জ্যাম। গ্রামের ভেতর দিয়ে ঢুকলো বড় বাস। তাতে কয়েক জায়গায় সমস্যা হলো বটে। রংপুর-কুড়িগ্রাম হাইওয়েতে ওঠার পর আর কোনো ঝামেলা রইলো না। বগুড়ায় রাতের খাবার বিরতি দেওয়া হলো।
টানা ভ্রমণে বুড়িমারির পরই প্রায় সবাই বাসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রাতের খাবার খেয়ে আবারও ঘুম। সমস্যা আমার। বাসে-ট্রেনে-বিমানে কোথাও ঘুম হয় না। ভয় হয় কেবল এই বুঝি দূর্ঘটনায় পড়বো। বলা চলে ফোবিয়ায় পেয়ে বসেছে আমাকে। সবাই ঘুমায়; আমি দেখছিলাম একের পর এক শহর পার হচ্ছি। পার হচ্ছি গ্রাম, নদী, রাতের মাঠ-ফসলের ক্ষেত।
ভোরবেলা টেকনিক্যাল এসে নামলাম। ড্রাইভার ব্যাগ নিয়ে প্রাইভেট কারে তুললো। কিন্তু তুমুল বৃষ্টি। ক’দিন আগে দার্জিলিংয়ে যে বৃষ্টি হচ্ছিল, সেটি বাতাসে ভেসে ভেসে বাংলাদেশে এসে ঝরছিলো। সাগর কিংবা হিমালয়ের জল বাংলায় এসে পড়ছিল। দার্জিলিঙে বৃষ্টি কালিম্পঙে রোদ। আবার বাংলাদেশে বৃষ্টি! প্রকৃতি এমনই।
শেষ
পূর্ববর্তী পর্ব: দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-১৬॥ উদয় হাকিম