রকিবুল হাসান। কবি, কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক ও গবেষক। তিনি ১৯৬৮ সালের ৩১ মে কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মোহা. উকিল উদ্দিন শেখ। মাতা পরীজান নেছা। পেশায় শিক্ষক। নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা সাহিত্য, সংস্কৃতি ও গবেষণা অনুষদের ডিন ও বাংলা বিভাগের প্রধান। তিনি এর আগে সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান ও উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের কো-অর্ডিনেটর ছিলেন। তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ (অনার্স), এমএ ও পিএইচডি করেছেন।
প্রকাশিত গ্রন্থ:
গবেষণা-গ্রন্থ: সাহিত্যের নন্দনচর্যা, পঞ্চাশের সাহিত্যে জনপ্রিয় যুবরাজ, ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার ও ফোকলোর, বাংলা জনপ্রিয় উপন্যাসের ধারা: মীর মশাররফ হোসেন থেকে আকবর হোসেন, বিপ্লবী বাঘা যতীন, আকবর হোসেনের কথাসাহিত্য: রূপলোক ও শিল্পসিদ্ধি, কয়ায় রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন ও প্রাজ্ঞজন।
প্রবন্ধ গ্রন্থ: গড়াই নদীর পাড়, পথে যেতে যেতে, পথের কথা, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, প্রবন্ধ প্রমূর্ত: ভিতর বাহির, রবীন্দ্রনাথ ও বাঘা যতীন।
উপন্যাস: জীবন দিয়ে ভালোবাসি, এ কী তৃষ্ণা এ কী দাহ, নবীরন, ভাঙন, ছায়াবন্দি, অহনাবউ।
গল্পগ্রন্থ: মেয়েটির চোখে শিশির জমেছিল, প্রেমের বেলা নেই।
কাব্যগ্রন্থ: অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে, এক ধরনের অহংকার, দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত, দেবতীদেউল, রহস্যস্বাক্ষর, রকিবুল হাসানের প্রেমের কবিতা, ব্যর্থ ভয়ঙ্কর দৌড়ের কাছে, স্বদেশলক্ষ্মীর তিমিররাত্রি, (যৌথ), ধুলোমাটির ঘ্রাণ।
সাক্ষাৎকারভিত্তিক গ্রন্থ: ইন্টারভিউ।
সম্পাদিত গ্রন্থ: বিমূঢ় বিস্ময় জীবনানন্দ দাশ (যৌথ) সহ ১৩টি।
সম্পাদিত পত্রিকা: সাপ্তাহিক অর্থবিত্ত ২২ বছর ধরে সম্পাদনা করছেন। পিআররিভিউ জার্নাল ‘গবেষণা সাময়িকী (১-৪) সংখ্যা সম্পাদনা করেছেন। এনইউবি বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি গবেষণা পত্রিকার সম্পাদক। সাহিত্যের অনিয়মিত কাগজ গৈরিক, একক, কলরব ও সংগতির সম্পাদক।
পুরস্কার:
বাংলাদেশ রাইটার্স ক্লাব সাহিত্য সম্মাননা ২০২০। শ্রীপুর সাহিত্য পুরস্কার ২০১৯, শ্রীপুর, গাজীপুর। কবি ওমর আলী স্বর্ণপদক ২০১৮, পাবনা। লালন সাঁই পুরস্কার-২০১৫, লালন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী, ঢাকা। বাংলা সাহিত্য পদক-২০০৬, পাবনা। স্যার সলিমুল্লাহ পদক-২০০৬, ঢাকা। দ্য সান সম্মাননা-২০১০, ঢাকা। চাইল্ড হেভেন সম্মাননা-২০১০, কুষ্টিয়া। ইতিহাস-ঐতিহ্য সংরক্ষণ পরিষদ সম্মাননা-২০১১, কুমারখালী, কুষ্টিয়া। সিটি স্কুল সম্মাননা-২০১৫, ঢাকা।
মূল্যায়ন
১.
‘নতুন কালে কি সত্যি নতুন মানুষ দেখা যায়? এত নতুন যে তাকে আর চিনতেই পারা যায় না? মানুষ কি বদলে যাচ্ছে? বদলে কি যায়? যে যুবক যুবতীদের পরিবর্তনের রকমারি পোশাকে দেখতে পাই সেই পোশাক সরালেই তো দেখা যায় চিরকালের সেই যুবক যুবতী। রকিবের উপন্যাস পড়তে গিয়ে এই কথাগুলিই আবার মনে এল। দু’জোড়া যুবক যুবতীর গল্প এখানে। প্রথা তারা এতদূর ভাঙতে পারে যে হঠাৎ মনে হয় একালের যুবক যুবতী খুব বদলে গেছে। স্ত্রীর সঙ্গে বনিবনা না হলে প্রেমসহ বা প্রেমবিনাই ভিন্ন নারীর সঙ্গে সম্পর্ক যেমন স্থাপিত হয় তেমনই আবার বিয়ে সামাজিক পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই প্রেমিকার গর্ভে সন্তান চলে আসে। মনে হয় সময় বদলেছে, মূল্যবোধ বদলেছে। প্রথা ভাঙা চলছে কিন্তু একটু ভেতরে ঢুকেই বুঝতে পারি একই চিরন্ততা এ কালের তরুণ-তরুণীদের মধ্যেও নির্বাধ বয়ে যাচ্ছে।
রকিবুল হাসানের এই উপন্যাস যেমন বর্তমানের সমাজকে চেনায়, রাষ্ট্রকে চেনায় তেমনই নতুন মানুষকেও চেনায়।
(ভাঙন: হাসান আজিজুল হক)২.
রকিবুল জীবনকে খাঁটিভাবে দেখেছেন। তাঁর প্রতিটি কবিতা সম্পূর্ণ ও আমেজময়।গোট কবিতা একটি প্রচ্ছন্ন কাহিনী তুলে ধরে। সমাজের নারী হত্যা, ভালোবাসার ব্যর্থতা ও হাহুতাশ রকিবুল হাসানের কবিতার উপজীব্য বিষয়। তিনি নিসর্গকে দেখেছেন এবং তাঁর কল্পনা শক্তি প্রখর। তাঁর কবিতা কোমলভাবে আমাদের মনকে নাড়া দেয়।… রকিবুল হাসানের মতো আমাদের আরেকজন কবির কথা মনে পড়ছে, তিনি আবুল হাসান। রকিবুল হাসানও তাঁর মতো মিষ্টি কবিতা লেখেন। তাঁর কবিতার বাক চাতুর্য মুগ্ধ করে।
(অনিয়ম চুম্বনের সিঁড়ি ধরে: ওমর আলী)৩.
এ উপন্যাসে (অগ্নিকা আঁধার) অনেক চরিত্রের সমাহার ঘটেছে। তবে কোনো একটি চরিত্রকে উপন্যাসের কেন্দ্রীয় নায়ক বলে মেনে নেওয়ার সুযোগ নেই। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত গভীর মনোনিবেশের সঙ্গে পাঠ করলে বোঝা যাবে, এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র বিপ্লবী বাঘা যতীন অর্থাৎ বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়। এই নাম একটি বিপ্লবের নাম। বাঘা যতীন দেশের স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই করে গেছেন, তেমনি উপন্যাসে বর্ণিত বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় নানা প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করে সুস্থ একটি উচ্চশিক্ষাঙ্গন সগৌরবে দাঁড় করাতে চেষ্টা করেছেন। সেই আলোটা ঠিকই ছড়িয়ে পড়তে দেখি।
(অগ্নিকা আঁধার: সফল আন্দোলনের চিত্র ॥ সেলিনা হোসেন)৪.
রকিবুল হাসানের ‘পথের কথা’ গ্রন্থের প্রত্যেকটি লেখা যদি চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ করা যায়Ñতাহলেও দেখা যাবে এই গ্রন্থটি লেখকের এক ভিন্নমাত্রিক সৃষ্টি। বাংলা সাহিত্যে এই গ্রন্থটিকে এক ভিন্নমাত্রিক অনন্য সংযোজন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।
(পথের কথা: ভিন্ন আঙ্গিকের একটি রচনা।। আবুল আহসান চৌধুরী)৫. ‘দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত’-নামটি আকর্ষণীয় এবং ত্বারিৎ বেড়ে চেতনায় একটি দোলা দেয়। রাত দুঃখময়ী এবং শ্যামবর্ণ। আমরা নিকষ কালো, তমিস্রঘন, রজনী শাওনঘন, ঘোর যামিনী, মাধবী রাত, নীল হাওয়ার রাত, আঁধারিয়া রাতি প্রভৃতি বিশেষণ ও রূপকে রাতকে কবিতায় সরব হতে দেখি, রকিবুল হাসান শ্যামবর্ণ রাতের প্রসিদ্ধি ব্যবহার করেছেন। শ্যামের দেহ কালো। দুঃখের রূপ মলিন। ধূসরিমার সঙ্গে যেন দুঃখের মিতালি। বর্তমান কাব্যের কিছু কবিতার নামও চমকে দেয়ার মতো। ভুলবৃষ্টি, ঘাসফড়িং, জোনাকিসন্ধ্যা, একছাদ পৃথিবী, ভাঙাচাঁদ,, মেঘবালিকা এই রূপমণ্ডিত নামগুলো কবিতায় নতুন খোরাক জোগায়। কাজেই আমাদেও স্বীকার করতেই হয় সুষম ও নির্বাচিত শব্দের ব্যবহাওে রকিবুল হাসান সুদক্ষ।..রকিবুল শব্দ সচেতন। শধশর সংযোজনে পারঙ্গম। তাই কবিতার আকৃতি ও প্রকৃতিগত পরিসরেও তাঁকে বৈচিত্র্য সাধনে বাস্তবে দেখি। প্রচলিত কবিতার দেহ থেকে ভিন্নমাত্রার কাব্যদেহ নির্মাণে তাঁর মনোবল লক্ষণীয়।
(দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত: পরিগঠন ও পরিচর্যা : অনীক মাহমুদ)৬.
কবিতায় আধুনিক কবিতার যে বৈশিষ্ট্য; দুর্বোধ্যতা, তা যত দূও সম্ভব কবি এড়িয়ে চলেছেন। কবিতায় মন্সিয়ানা দেখাতে গিয়ে একালের অনেক কবি নান কৌশল অবলম্বন কওে কবিতার ভেতর-বাইওে লতা-জটিল অরণ্যানি ও দুর্জ্ঞেয় রহস্যময়তদার জাল বিস্তার করেন। আমাদেও কবি সে-দলের কেউ নন। তাঁর কবিতা সহজেই বোঝা যায়; কি ভাষায়, কি বক্তব্যে। শব্দপ্রয়োগে তিনি কুশলী শিল্পী। কবিতার ক্যানভাস ও অন্তঃপ্রকৃতি বিবেচনায় এনে তিনি যথাযথ শব্দ প্রয়োগ করেন। পূর্বসূরির দরোজায় হানা দিয়ে এ কালের কবিদের যথেচ্ছা শব্দ, চিত্রকল্প ইত্যাদি অন্ধ অনুকরণের মাধ্যমে গ্রহণ করার যে সিদ্ধ নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে; কবি সে পথ পরিহার করে নিজস্ব শব্দ ও বাণীবিন্যাসের মাধ্যমে তাঁর কথামালা সাজিয়েছেন।
(দুঃখময়ী শ্যামবর্ণ রাত: কবিতার ভুঁইচাপা আঙিনায় নাড়িছেঁড়া টান: অমৃতলাল বালা)৬.
রকিবুল আঘাত করতে চেয়েছেন পাঠকের চৈতন্যেও মর্মমূলে। সৃষ্টি করতে চেয়েছেন এক গভীর স্থায়ী আবেদন। রচনা করতে চেয়েছেন এক নিবিড় এমপ্যাথি; সেই বিষয়গুলো নিয়ে যেগুলো আমাদেও সামাজিক, রাজনৈতিক সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পরম্পরার সাথে মিশে আছে। আর এই আঘাত হানতে গিয়ে অস্ত্রতে কখনৈা করতে হয়েছে শাণিত, কখনো ভোতা, কখরেনা বক্র। সেদিক থেকে রকিবের মিশ্র বয়ানশৈলী সঙ্গত ও সার্থক।
(রবীন্দ্রনাথ, বাঘা যতীন এবং প্রাজ্ঞজন: একটি উত্তর-ঔপনিবেশিক আলোচনা: রাশিদ আসকারী)