(পর্ব-৩০)
ধানমন্ডির গোলাম রব্বানীর বাড়ি। তিনি সরকারের ক্ষমতাধর সচিব-নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের। মার্জিত স্বভাবের মানুষ। কিন্তু স্ত্রী আসমা রব্বানীর দেমাকমাখা ঢেউয়ে ছত্রখান হয়ে যান। টাল সামলাতে না পেরে অনেক সময়ে কূপোকাত হয়ে পড়েন। কিন্তু আদরের মেয়ে মিলি মাহজাবীন এমন একটা কাজ করবে, কখনো বুঝতেই পারেননি।
বাসার মধ্যে হুলস্থুল ঘটনা। আসমা রব্বানী এগারো দিন পরে হাসপাতাল থেকে বাসায় এসেছেন। মিলি বাসা ছেড়ে চলে গেছে বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারিয়ে মেঝের ওপর লুটিয়ে পড়েছিলেন। পরিচিত হাসপাতালে ফোন করে মিলির ছোট ভাই কায়েস রব্বানী। ফোন পেয়ে অ্যাম্বুলেন্স চলে এলে সবাই ধরে তুলে দেয় আসমা রব্বানীকে। সেই থেকে হাসপাতালে টানা দশ দিন। দশ দিন পরে গোলাম রব্বানী হাসপাতালে যান। দশ দিনের মধ্যে তিনি একবারও স্ত্রীর খবর নেননি। ফোন করলে বা সামনে গেলে স্থান কাল পাত্র মনে না রেখেই চিৎকার চেঁচামেচি করবে। পুত্র কায়েস আর ডাক্তার বন্ধু আমীরুল ইসলামের সঙ্গে সব যোগাযোগ রেখে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। টাকা পয়সা পাঠাচ্ছেন। আসমা রব্বানী মেয়ে হারানোর ধকল অনেকটা কাটিয়ে উঠেছেন। কিন্তু বাসায় আসতে চাইছেন না। বারবার মনের মধ্যে নিজের ব্যর্থতার একটা চিত্র দেখছেন তিনি, এত কড়া শাসনের মধ্যে রেখেও নিজের মেয়েটাকে চিনতে পারলাম না?
যাবি যা, জানিয়ে যা। কোথায় কার সঙ্গে গেছে মেয়ে? বোনের ছেলে ক্যাম্পাসে যে ছেলেটার সঙ্গে ঘুরতে দেখেছে, সেই ছেলের সঙ্গেই কি গেছে? আত্মীয় স্বজন বন্ধু প্রতিবেশী কারও কাছে আর সন্মান রাখলো না মেয়েটা। বেদনায়-মর্মবেদনায় আসমা রব্বানী শোকে মুহ্যমান। হাসপাতালের কেবিনে বসেই ঝগড়া করেছে গোলাম রব্বানীর সঙ্গে কয়েক বার টেলিফোনে। বিষয় একটাই, মেয়েটা এমন করলো কেন? কী অভাব রেখেছিলাম? আর যাবেই যদি, অন্তত একটা ঠিকানা রেখে গেলেই পারতো। সন্তান জন্ম না দিলে এক ঝামেলা, আর সন্তান থাকলে হয় শতেক ঝামেলা।
গোলাম রব্বানী প্রথম দিন চার দিন মিলির এভাবে চলে যাওয়াকে মানতেই পারছিলেন না, বিশ্বাসই করতে কেমন লাগতো। আরে, আমার মেয়ে বাসা ছেড়ে আমাকে না জানিয়ে কোথায় কোন ছেলের কাছে যাবে? কেন যাবে? আমি মিলিকে, হ্যাঁ ঝামেলা পাকিয়েছে মিলির মা আসমা রব্বানী।
আসমা রব্বানীর বড় বোনের ছেলে ফয়জুর খানকে বিয়ে করার জন্য পছন্দ করে না মিলি। মেয়েটির কোনো দোষ দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। কারণ মিলি অপছন্দের ঘটনা তো জানিয়েছে গোলাম রববানীকে। মাসখানেক গাড়িতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দেওয়ার সময়ে বলেছে মিলি, আব্বা তোমার সঙ্গে আমার জরুরি আলাপ আছে।
-বল।
-গাড়ি থেকে নেমে বলবো।
-গাড়ি থেকে নামতে হবে কেন?
মিলি আড়চোখে ড্রাইভারকে দেখায়। গোলাম রব্বানী বুঝতে পারছে ড্রাইভারের সামনে বলতে চায় না মেয়ে। একটু চিন্তার মধ্যে পড়ে গেলেন তিনি। বিয়ের ব্যাপারে ফাইনাল কথাবার্তা হচ্ছে দুই পারিবারের মধ্যে। এই সময়ে মেয়ের কী ধরনের কথা থাকতে পারে? কিন্ত যে কথাই থাক, জানা দরকার। তিনি ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, এগারোটার দিকে একটা গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক আছে, তবু তোমার সঙ্গে বসবো।
ঘাড় নাড়ে মিলি, ঠিক আছে।
গাড়ি বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছানোর পর মেয়ের সঙ্গে নেমে বিখ্যাত বটতলায় গোল বেদীর ওপর বসে গোলাম রব্বানী। মিলিও বসে পাশে। মেয়েটাকে অনেক সময়ে চিনতে পারেন না গোলাম রব্বানী। নিজের ওরসজাত কন্যা, একটা ঘরে থাকে, শৈশব থেকে আদরে মমতায় স্নেহে ভালোবাসায় গড়ে ওঠার পরও অনেক পার্থক্য, অনেক নিঃশব্দ দূরত্ব থেকে যায় বা তৈরি হয়, একে অন্যের মনে বিচিত্র রুচি আর ভাবনা সৃষ্টির মিথস্ক্রিয়ায়।
মীরার প্রশ্নে সামান্য হাসেন গোলাম রব্বানী, মা, তোমার আপু যে ছেলেকে বিয়ে করেছে, সেই ছেলে শহরে মানে ঢাকায় থাকে না। বিয়ে করেছে গ্রামের একটা ছেলেকে। সেই গ্রামেই আছে তোমার আপু।
সচিবালয়ের বৈঠকের চাঞ্চল্য বুঝতে না দিয়ে মেয়েকে বলে, বল মা কী বলবি।
-আব্বা, তুমি বিয়েটা বন্ধ করো।
অনেকটা অনুমান করেছিলেন গোলাম রব্বানী, মিলি এই ধরনের অনুরোধই করবে। সুন্দর কোমল আদ্রতায় ভরা মুখের মেয়েটার মুখটা কেমন মলিন। বুকের মধ্যে একটা হাহাকার অনুভব করেন পিতা গোলাম রব্বানী। কিন্তু স্ত্রী আসমা রব্বানীর মর্ষকামী চরিত্রের কারণে পিতা বা স্বামী হিসেবে দায় পালন করতে পারেন না সংসারে। মেয়েও বলতে পারছে না মায়ের কাছে নিজের সংশয় বা অপছন্দ। তাই পিতাকে অবলম্বন করেছে।
-কেন মা? ছেলেটা বিদেশ থেকে পড়াশুনা করে এসেছে। তোমার বড় খালার ছেলে। তোমার মা তো…
-আব্বা, মা যদি সিদ্ধান্তে অটল থাকে, বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটবে, মনে রেখো।
-তুমি আত্মহত্যা করবে?
-না, আত্মহত্যা করবো কেন? আমি আত্মহত্যা করবো না আব্বা। কিন্তু আমি এমন একটা কিছু করবো, যা ভাবতেই পারছো না। আমার স্বাভাবিক ইচ্ছের পথ আটকে দিলে, আমি বিকল্প পথ বেছে নেবো।
-মারে, আমার মান সন্মানটা দেখবি না?
হাসে মিলি, ভালো বলেছো আব্বা। আমি তোমার সন্মান দেখবো কিন্তু আমার জীবন আমার ভবিষৎ তোমার কাছে কিছু না?
-তোমার জীবনটাই আমার কাছে অনেক বড় ঘটনা।
-তাই যদি হয়, মিসেস আসমা রব্বানীকে থামাও। আমাকে বিয়ে দাও, মানুষ হয়ে জন্মেছি, প্রচলিত প্রথায় জীবনে বিয়ে তো করবোই কিন্তু ফয়জুর খানকে না।
-কেন মা? কী অপরাধ ওর?
-আমি ওকে ঘৃণা করি।
মেয়ের কঠিন মুখের দিকে তাকিয়ে ভেতরে ভেতরে চমকে ওঠে গোলাম রব্বানী। মনে মনে বলে, যেকেনোভাবেই হোক, আমি এই বিয়ে ঠেকাবো। কিন্তু আসমা রব্বানীর সামনে দাঁড়ালে কেমন যেন মিইয়ে আসেন গোলাম রববানী। এই ধরনের চরিত্রকেই কি স্ত্রৈণ বলে? মেয়েকে সর্বনাশের মূলে আমিও, মিলি তো আমাকে বলেছিল কিন্তু আমি তো কিছুই করতে পারলাম না। আবার আসমা রব্বানীর রোষ কষায়িত মুখ, কর্কশ ভাষ্য-জেদ আমাকে বার বার পর্যুদস্ত করছে।
সন্ধ্যায় অফিস থেকে বাসায় আসার পর ছোট মেয়ে মুমু একটা চিঠি এগিয়ে দেয়। চিঠিটা হাতে নিয়ে মিলির হাতের লেখা দেখে, প্রথম নিঃশ্বাসটা নেয়, বেঁচে আছে মিলি! তিনি দ্রুত নিজের রুমে ঢুকে চিঠিটা নিয়ে বসলেন বিছনার ওপর। বসার আগে বন্ধ করে দিলেন দরজা। জানেন না তো মেয়ে কী লিখেছে চিঠিতে।
খামটা খুলে চিঠিটা পড়তে শুরু করলেন।
আব্বা,
আমি তোমাকে জানিয়েছিলাম, আমাকে মায়ের বোনের ছেলে ফয়জুরের সঙ্গে বিয়ে দিলে আমি বিকল্প জীবনে পাড়ি দেবো। সেটাই দিয়েছি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের ছেলে আহমেদ তমাল শিমুলের সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল। ছেলেটা আমাকে খুব পছন্দও করে। খুব সহজ সরল ছেলে। শেষ পর্যন্ত তমালকে বিয়ে করেছি। এখন আছি ওদের বাড়িতে।
ওর বাবা শামসুদ্দিন কৃষিকাজ করেন। খুবই ভালো মানুষ। আমাকে মেয়ের স্নেহে গ্রহণ করেছেন। আমার শাশুড়িও অসম্ভব ভালো। ননদ, দেবর মিলে বাড়িটা সব সময়ে জমজমাট থাকে। গ্রামের জীবনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার খুব ভালো লাগছে, উপভোগ করছি আমি আব্বা। নগরের বাইরে এমন মায়াঘ্রাণের অসাধারণ জীবনের পালা আছে, শিমুলের সঙ্গে বিয়ে না হলে, ওদের গ্রাম উজানগাঁও না এলে বুঝতে বা জানতে পারতাম না। আমি দারুণ উপভোগ করছি।
আমি আমার জীবন বেছে নিয়েছি। পিতা ও মাতা হিসেবে তোমাদের কাছে অসীম কৃতজ্ঞতা, আমাকে পৃথিবীতে এনেছ, স্নেহে মমতায় গড়ে তুলেছ। আমি যেখানে, যেভাবেই থাকি না কেন, চিরকাল তোমাদের মনে রাখবো। মাকে আমার ভালোবাসা জানিও।
ঢাকায় এলে, অনুমতি দিলে আমরা, মানে আমি আর শিমুল দেখা করবো।
তোমার মেয়ে মিলি।
ঠিকানা: শামসুদ্দিন। গ্রাম ও ডাক: উজানগাঁও। থানা: ভানডারিয়া। জেলা: পিরোজপুর।
চিঠিটা পড়ে কয়েক মিনিট ঝিম মেরে বসে থাকেন গোলাম রব্বানী। শেষ পর্যন্ত মায়ের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মিলি এমন সর্বনাশ করলো নিজের? জীবনটা বিলিয়ে দিলো শুকনো জমিনে? যে জমিনে কোনোদিন ফসল হবে না; বুঝতে পারলো না মিলি, কী ক্ষতি করতে যাচ্ছে নিজের? কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারছেন না গোলাম রব্বানী। রুমের মধ্যে পায়চারী করতে করতে ভাবলেন, চিঠির বিষয়টা আসমাকে জানানো দরকার। জানালে, মিলি বেঁচে আছে জেনে হয়তো শান্ত হতে পারে। গোলাম রব্বানী এতদিনে, বিবাহিত জীবনের প্রায় ত্রিশ বছর পার হয়ে আসার পরও বুঝতে পারছে না স্ত্রী আসমাকে। আসমা অনেকটা রোদ মেঘ বৃষ্টির মতো; অনিয়ন্ত্রিত। বিয়ের পর থেকে এই ভালো, ভালো-এত ভালো যে, অনেক সময় চমকে যেতে হয়। আবার ইচ্ছের বিপরীতে গোলাম রব্বানী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তুলকালাম বাধিয়ে বসে। বাসা থেকে মিলির পালিয়ে কোথাকার কোন শিমুলকে বিয়ে করা…সব কিছুর পিছনে দায়ী আসমার খামখেয়ালিপনা আর সব আমার ইচ্ছেয় হবে; এখন কোথায় গেলো জেদের রসায়ন? বাস্তবতা হচ্ছে সংসারের এবং আমার নিজের জীবনের জন্যও মিলির এই বিয়েটা কালো দাগ; এই দাগ কি কখনো মুছে ফেলা যাবে?
মিলি একবার যখন বাসা ছাড়তে পেরেছে ওকে আর ফেরানো যাবে না, বুঝতে পারেন গোলাম রব্বানী। ছেলে মেয়ে–সময়ের আচঁড় কেটে বড় হয়ে গেলে ওদেরও মতের গুরুত্ব দেওয়া উচিত, একদমই বুঝতে চায় না আসমা। সব সময়ে সরকারি কর্মকর্তার স্ত্রীর দাপট দেখিয়ে চললে কি হয়? সেই দাপট বাইরের মানুষের ওপর দেখাতে দেখাতে নিজের স্ত্রী-ছেলে-মেয়েদের ওপর প্রয়োগ করলে চলবে কেন?
গোলাম রব্বানী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে রুম থেকে বের হলেন। যাবেন স্ত্রী আসমার কাছে, হাসপাতালে। অনেক দিন আজ দুপুরে আসমা ফোন করেছিল। বোঝা যাচ্ছিল, মিলিকে হারিয়ে ভেঙে পড়েছে। ড্রয়িংরুমে এসে তিনি ছোট মেয়ে মীরা আর ছেলে কায়েশকে ডাকলেন। অনেক দিন পরে তিনি ছেলেমেয়ে দুটোকে কাছে পেলেন। দুজনার চোখ মুখ বিষণ্ন। মীরার মুখ শুকিয়ে আমসি। জানেন, দুই বোনের মধ্যে খুব খুনসুটি চলতো। আর কায়েশ মিলি আপা ছাড়া কিছুই বোঝে না। মীরার মাথায় হাত রাখতেই হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ে বাপকে জড়িয়ে। তিনিও মেয়েকে জড়িয়ে ধরেন আর পাশে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে কাঁদছে কায়েশ।
কান্না থামলে মীরা জানতে চায়, আব্বু চিঠিতে আপু কী লিখেছে? কোথায় আছে?
মিলি বিয়ে করেছে, খুব স্বাভাবিকভাবে বলেন গোলাম রব্বানী। তিনি জানেন, নিজে যতটা স্বাভাবিক থাকবেন, ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ওর তেমনই প্রভাব পড়বে।
-কাকে বিয়ে করেছে আপু? প্রশ্ন কায়েশের।
-ওর বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ছেলেকে।
-বাসা কোথায় সেই ছেলের?
মীরার প্রশ্নে সামান্য হাসেন গোলাম রব্বানী, মা, তোমার আপু যে ছেলেকে বিয়ে করেছে, সেই ছেলে শহরে মানে ঢাকায় থাকে না। বিয়ে করেছে গ্রামের একটা ছেলেকে। সেই গ্রামেই আছে তোমার আপু।
-কোথায় গ্রাম? জানতে চায় কায়েশ।
-পিরোজপুর নতুন জেলা। আসলে জায়গাটা বরিশালের ভেতরে, সাগরের দিকে। আমি চাকরি জীবনের শুরুতে পিরোজপুরে মাস ছয়েক ছিলাম ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে। শহরটা ভালোই, ছিমছাম কিন্তু গ্রামের দিকে আমার যাওয়া হয়নি।
-মা? মাকে বলবে না?
মাথা নাড়ান গোলাম রব্বানী, হ্যাঁ। এখন হাসপাতালে যাচ্ছি তোমার মাকে জানাতে। দুপুরে কথা হয়েছিল, তোমাদের মাকে স্বাভাবিকই মনে হয়েছে। দেখি, বাসায় নিয়ে আসা যায় কি না! তোমরা থাকো বাসায়। ঠিক আছে?
ঘাড় নাড়ে মীরা, আচ্ছা।
জগতের সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও ধ্বংসের একটা শক্তি থাকে। সেই শক্তিটা পেয়েছি তোমার কাছ থেকে। তুমি ভালো থেকো।
গোলাম রব্বানী সামনে দু পা দিয়ে আবার ছেলে ও মেয়ের মুখোমুখি দাঁড়ান, আমি জানি আমরা একটা খারাপ সময় পার করছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মানুষ হলেই, সংসার থাকলেই বিচিত্র সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। এই ধরনের পরিস্থিতিতে মানুষ-পাড়া প্রতিবেশী-আত্মীয় স্বজন; নানা ধরনের প্রশ্ন করবে। কেউ কেউ হাসবে, উপহাস করবে, বিশ্রী বাজে মন্তব্য করবে; করছেও ইতোমধ্যে, সবকিছু ঠাণ্ডা মাথায় ট্যাকেল করবে। মাথা গরম করবে না। আর হ্যাঁ আমাদের এই দুর্যোগের মধ্যে বোঝা যাবে বা আমরা চিন নিতে পারবো কে আমাদের বন্ধু, কে আমাদের শত্রু! আমি কী বলতে চাইছি, নিশ্চয়ই তোমারা বুঝতে পেরেছ।
-জি আব্বু, বুঝতে পেরেছি। জানায় কায়েশ।
-ওকে, বের হয়ে যান গোলাম রব্বানী।
কায়েশ আর মীরা সোফায় বসে মুখোমুখি। কায়েশ বয়েসের তুলনায় স্বাস্থ্যবান। মাথায় প্রচুর কালো চুল। সেই তুলনায় মীরার চুল কম। প্রায়ই বলে কায়েশকে, তোর কিছু চুল আমাকে দে।
হাসে কায়েশ, পারলে নিয়ে যা।
মীরা পাশে দাঁড়িয়ে ভাইয়ের ঘনকালো চুলে বিনুনি করে। আরামে চোখ বুঝে থাকে কায়েশ। কিন্তু মিলি মাহজাবীন বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার পর ভাইবোনের সেই খুনসুঁটি আর হয়নি। বড় খালার ছোট মেয়ে মেরিনা কয়েকদিন আগে ফোনে আজেবাজে অনেক মন্তব্য করেছে মীরার কাছে। মীরা বুদ্ধি করে রেকর্ড করেছে মোবাইলে।
মেরিনার প্রথম বাক্য ছিল, যা হয়েছে ভালেই হয়েছেরে।
-মানে? বুঝে উঠতে পারেনি মীরা। কী বলতে চাস আপু? মেরিনা বছর খানেকের বড় মীরার। দুজন দুজনকে তুই তোকারিই করে ডাকে, ভাবও খুব। কিন্তু গোটা ব্যাপারটা থমকে যায় মিলির কারণে। যখন বড় খালারা জেনে গেছে, মিলি মাহজাবীন বাসা ছেড়েছে, সেই দিন থেকে কোনো যোগাযোগই রাখে না ওরা। সেই না রাখা যোগাযোগের মধ্যে হুল ফোটাতে ফোন করেছে মেরিনা তাবাসসুম।
-বুঝলি না তুই?
না, বুঝতে পারিনি আপু।
-শোন, আমার ভাইয়া ফয়জুরের সঙ্গে তোর বোনের বিয়ের পর যদি তোর বোন বেগে যেতো, কী বদনামটাই না হতো ভাইয়ার আর আমাদের। বিয়ের আগে আগে বেগেছে, মিলি আপুকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। আমাদের মান সন্মান ইজ্জত রক্ষা করেছে। আমি ভাবছি কী জানিস?
নিঃশব্দ মীরা।
কেয়ার করে না মেরিনা তাবাসসুম, তোর বোনের সঙ্গে মানে মিলি আপার সঙ্গে যদি আমার কোনো দিন দেখা হয়, আমি আপাকে একটা ক্রেস্ট দেবো। কেন দেবো ক্রেস্ট? প্রশ্ন কর আমাকে। ও প্রশ্ন করবি না, তাহলে আমিই বলি, আমাদের পরিবারের ইজ্জতটা বাঁচিয়ে দিয়েছে, বিয়ের আগে পালিয়ে গিয়ে। অনেক বড় উপকার করেছেন তিনি।
-তুমি আর কিছু বলবে আপু? কঠিন গলায় প্রশ্ন করে মীরা।
-না, আর কী বলার আছে? আর একটা বিষয়, তোর মা মানে আমার খালাকে হাসপাতালে যাওয়ার নাটক করতে না করিস। এটা কি বিশ্রী ঘটনা, একটা কিছু হলেই জ্ঞান হারিয়ে হাসপাতালে যাওয়া। মানুষেররা হাসে তোদের বাসার ঘটনায়। অনেক হাসিয়েছিস, আর হাসির চেষ্টা করিস না। বাই। লাইন কেটে দেয় মেরিনা তাবাসসুম।
অনেকক্ষণ নিজের রুমে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল মীরা মাহজাবীন। ইন্টারমিডিয়েড সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে ও। সংসারের সুখ-দুঃখ, ভালো-মন্দ ভালোই বোঝে। আর সংসারের এই বিদঘুটে টালমাটাল সময়ে মা হাসপাতালে, বাবা অফিসে; সংসারটা তো আগলে রেখেছে মীরাই।
দরজায় এসে দাঁড়ায় কায়েশ। তাকায় মীরা। মীরার স্তব্ধ মুখ দেখে ঢোকে রুমে, বসে পাশে, কী হয়েছে রে?
-কিছু না, গলাটা কেঁপে যায়।
হাত ধরে মীরার, বল আমাকে? কেউ তোকে কিছু বলেছে?
-শোন, মীরা হাতের মোবাইলে রেকর্ড করা মেরিনা তাবাসসুমের বক্তব্য ছেড়ে দেয়। সবটাই শোনে কায়েশ। কয়েক মুহূর্ত স্থির থেকে আবার হাত ধরে মীরার, শোন বিপদে পড়লে প্রিয় মানুষেরাই তো পাল্টে যায়। তুই এসব নিয়ে কিচ্ছু ভাবিস না। সময় আসুক। নিশ্চয়ই আমাদের জন্য প্রতিশোধের সময় আসবে। তোর মোবাইল থেকে ওটা আমার মোবাইলে ম্যাসেস করে পাঠা। আর শোন, মা-আব্বুকে এখন বলার বা শোনানোর দরকার নেই। সময় এলে আমিই বলবো।
ঘাড় নাড়ে মীরা, আচ্ছা।
-এখন এককাপ চা দে আমাকে।
-দিচ্ছি, বিছনা থেকে নেমে যায় মীরা। তাকিয়ে থাকে কায়েশ বোনটার দিকে, মিলি আপু, তুমি দেখে যাও চব্বিশঘণ্টা ছটফট করা আমাদের মীরা কতটা দায়িত্বশীল আর সংসারী হয়েছে, তুমিই নেপথ্যে থেকে ওকে আমাকে এই শক্তিটা দিয়েছ। জগতের সব কিছু ধ্বংস হয়ে গেলেও ধ্বংসের একটা শক্তি থাকে। সেই শক্তিটা পেয়েছি তোমার কাছ থেকে। তুমি ভালো থেকো।
চলবে…