পর্ব-২ ॥ ব্রাত্য বসুর নাটক: বিকেলে ভোরের সর্ষেফুল
‘বোমা’র পরে ব্রাত্য বসুর যে নাটকটি দেখেছি, সেটি ‘বিকেলে ভোরের সর্ষেফুল’। এই নাটকেও চমক আছে। তবে, এ নাটকে চমকের চেয়ে দুঃসাহসটাই বড়। এর অভিনেতা-অভিনেত্রী সবাই আমার অপরিচিত, তাই কারও নাম জানি না। প্রধান দুটি চরিত্র অনিরুদ্ধ আর কোয়েলের ভূমিকায় যারা অভিনয় করেছেন, তারা চমৎকৃত করেছেন দর্শকদের। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির এই যুগে অনিরুদ্ধ একটি আইটি কোম্পানির ব্যস্ততম কর্মকর্তা। তিনি সময়ের দৌড়ে এত বেশি ব্যস্ত যে নিজে স্বীকার করেন, স্ত্রীর সঙ্গে তার শারীরিক সম্পর্ক কিঞ্চিৎ-কদাচিত হয়ে থাকে।
একমাত্র কন্যা টিনএজে পৌঁছেছে। সময় এখন তার। প্রযুক্তি যখন অনিরুদ্ধের জীবনকে নিংড়ে সব রস শুষে নিয়েছে, তখন করুণাধারার মতো এসে উপস্থিত হয় কোয়েল। এই কোয়েল কিন্তু অনিরুদ্ধের বন্ধুর সন্তান। বন্ধুর স্ত্রীর মৃত্যুর পরে এই মেয়েকে মুম্বাইতে রেখে লেখাপড়া করানো হয়। লেখাপড়া শেষ করে কোয়েল কলকাতায় ফিরে আসে, কিন্তু বাবা ও সৎমায়ের সঙ্গে থাকতে তার ভালো লাগে না। কোয়েলের বাবা অনিরুদ্ধের কাছে এসে কন্যার জন্য একটি চাকরি চেয়ে আবেদন করেন। কোয়েল যখন তার পিতার কথামতো পিতার বন্ধু অনিরুদ্ধের অফিসে দেখা করতে আসে, তখনই সে তার উগ্র পোশাক এবং অত্যুগ্র আচরণে অফিসের সবাইকে বিরক্ত করে তোলে। মারামারির পর্যায়ে চলে যায় সে।
অনিরুদ্ধ তার অফিসের সবাইকে বুঝিয়ে কোয়েলকে সহ্য করতে চেষ্টা করে, তখনই কোয়েল পিতৃবন্ধু অনিরুদ্ধকে ভালোবেসে ফেলে। এই অসম প্রেমের নানাবিধ জটিলতার গল্প এই নাটক। এ ধরনের কাহিনিতে প্রবেশ করার আগে কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি থাকলে ভালো। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বসন্ত রাগ’ ও শামসুর রাহমানের ‘এলো সে অবেলায়’ উপন্যাস দুটি আগেই পড়া ছিল। অসম বয়সীদের প্রেমের গল্প আগে জানা ছিল, তারপরেও এই নাটকটি দেখে কেঁপে না উঠে উপায় নেই। গা শিউরেওঠা সংলাপ আছে কোয়েলের মুখে। কলকাতা আর মুম্বাই এই দুই শহরের একটি শ্রেণীর সাংস্কৃতিক ব্যবধানটাই বোধহয় নাট্যকার মুখ্য করে তুলেছেন। এ নাটকে চরিত্রের সঙ্গে সমাজের দ্বন্দ্বটা খুবই প্রকট। কারণ, একে তো পরকীয়া সম্পর্ক, তার ওপর বন্ধুর কন্যা ও নিজের মেয়ের বন্ধুর সঙ্গে প্রেম, সমাজ মেনে নেবে কেন?
অনিরুদ্ধ কিন্তু কোয়েলের প্রেমে পড়তে চায়নি, সে কোয়েলকে চাকরি দিতে গিয়ে, মাতৃহারা সন্তানের মতো স্নেহসুধা ঢালতে গিয়ে কোয়েলের উগ্রতার আগুনে পুড়ে নিঃশক্তি হয়ে পড়ে। পরিণতিতে সে নাটকের চূড়ান্ত ক্লাইমেক্সে গিয়ে বন্ধুর দ্বিতীয় স্ত্রী এবং বন্ধুর কাছে ধরা পড়ে যায়। এখানেই তার পতন হয়। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে নাটকটিকে আধুনিক ট্র্যাজেডি বলা যায়, যেখানে প্রধান চরিত্রের অভাবনীয় পতন ঘটে। অনিরুদ্ধের স্ত্রী, কন্যা, বন্ধু ও বন্ধুর স্ত্রী কারো কাছেই মুখ দেখানোর অবস্থা থাকে না।
ব্রাত্য বসু এ নাটকেও উতরে গেছেন। নাটকটি দেখার পরে মনে হয়, না দেখলে বুঝি জীবনকে নতুন করে দেখা হতো না।
কোয়েলের প্রেম অসামাজিক হলেও, অসম হলেও অনিরুদ্ধের জীবনে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে যায়। আত্মোপলব্ধি জাগিয়ে দিয়ে যায়। অনিরুদ্ধ সমকালীন প্রযুক্তির বিশ্বে বেঁচে থাকার জন্য প্রযুক্তির অংশ হয়ে মানবিক বোধ হারিয়ে ফেলেছিল, মানুষ থেকে রোবট হয়ে গিয়েছিল। তাকে সচেতন করে দিয়ে গেছে কোয়েল। তাকে আবার মানুষ হিসেবে আত্মপরিচয় সৃষ্টি করার সুযোগ দিয়ে গেছে। রোবটিক জীবন থেকে মানবিক বোধ জাগিয়ে দিয়ে গেছে। সফটওয়ার আর হার্ডওয়ারের মধ্যে রক্তবাহী সচল ধমনী সৃষ্টি করে দিয়ে গেছে। এভাবে প্রযুক্তির ঘূর্ণনে কত জীবন মানুষের জগতের বাইরে ছিটকে গেছে। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের সুযোগ করে দিয়ে গেছে কোয়েল। কিন্তু অনিরুদ্ধের যে সমাজে আর মাথা তুলে দাঁড়ানোর শক্তি রইলো্ না! একটা প্রশ্ন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে নাটকের শেষে, অনিরুদ্ধ এখন কোথায় যাবে? আমরা তা জানি না।
নাটকটিতে অনিরুদ্ধকে রবীন্দ্রনাথের ‘চোখের বালি’ উপন্যাসের মহেন্দ্রের সঙ্গে তুলনা করলে কোয়েলকে ধরে নিতে হয় বিনোদিনী। আর অনিরুদ্ধের স্ত্রীকে সহজেই মহেন্দ্রের স্ত্রী আশার সঙ্গে তুলনা করতে পারি। আশার সরলতা এখানে অনিরুদ্ধের স্ত্রীর মধ্যেও সুলভ। কিন্তু মাঝখানে প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অনিরুদ্ধের কন্যা সন্তানটি। নানাবিধ দ্বন্দ্বের ভেতর দিয়ে অনেক প্রশ্ন এ নাটকে উঠে দাঁড়ায়। সে সব প্রশ্নের উত্তর সমকালীন এই প্রযুক্তনির্ভর জীবনের কাছে ইলেকট্রনিক বর্জ্যের মতোই বাহুল্য হয়ে থাকবে, উত্তর পাওয়া যাবে না। উত্তর অনুসন্ধান করেত গেলে জীবনের অন্য অনেক দিক ডি-অ্যাকটিভ হয়ে যেতে পারে।
নাটকটির মঞ্চসজ্জা ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মুখসজ্জা যথাযোগ্য এবং মানানসই হয়েছে। কলকাতার নাটকে সাধারণত ইউরোপের নাটকের মতো মঞ্চব্যবস্থাপনায় আসবাবের আধিক্য দেখা যায়। অধিক উপকরণ দিয়ে মঞ্চসাজিয়ে নাটককে বাস্তবায়িত করা হয়। কিন্তু এই নাটকে অনিরুদ্ধের অফিসের দৃশ্য যেভাবে মঞ্চায়িত করা হয়েছে, তাতে অদৃশ্য কম্পিউটার, কি-বোর্ড শুধু অভিনয়ের দক্ষতায়, অঙ্গভঙ্গির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এটি তাদের অসাধারণ অভিনয় গুণের পরিচায়ক।
নাটকের নামটি নিয়ে প্রথমে ভেবেছিলাম এর গল্পটি বুঝি সমরেশ বসুর ‘বিকেলে ভোরের ফুল’ উপন্যাসের মতো হবে, কিন্তু ফুলের জায়গায় সর্ষেফুল নতুন অর্থ নিয়ে আসে। বিশেষ্য পদ থেকে আমরা বাগধারায় পৌঁছে যাই। চোখে যখন সর্ষেফুল দেখি, তখন যেমন নিকট পরিবেশ ও প্রতিবেশের কথা ভুলে যাই, তেমনি যৌবনের উপান্তে পৌঁছে অনিরুদ্ধ কি কোয়েলকে সর্ষেফুল রূপেই দেখেছেন? ভুলে গিয়েছেন অফিসের সম্মানিত পদমর্যাদার কথা, সহকর্মীদের কথা, স্ত্রী ও কন্যার কথা, বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর কথা? অনেক জীবন্ত প্রশ্নের মতো এটিও একটি। ব্রাত্য বসু এ নাটকেও উতরে গেছেন। নাটকটি দেখার পরে মনে হয়, না দেখলে বুঝি জীবনকে নতুন করে দেখা হতো না।
চলবে…
দূরের দর্শক-১॥ কাজী মহম্মদ আশরাফ