পর্ব-১৬
রবীন্দ্রনাথ ও গৌরীপুর হাউজ
ট্যুর নিয়ে লেখা শেষ। তখন মধ্যরাত। জানলার পর্দা সরিয়ে বাইরে তাকালাম। শীতে জুবুথুব শহর এবং শহরতলী। দূরে আলো জ্বলছিল শহরের ঘরবাড়িতে। ঝিলমিল করছিল সে আলো। তার পাশেই ঘুমিয়ে ছিল কালো পাহাড়। হালকা কোয়াশায় ছড়াচ্ছিল মৌনতার নিশি কাব্য।
ভাবছিলাম, জীবনের অনেক সময় ঘুমিয়ে কাটালাম। এই অলস জীবন লইয়া কী করিব? তার চেয়ে কিছু জ্ঞান আহরণের চেষ্টা করি। কী করা যায়? শুনেছি কালিম্পং জায়গাটা রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিল। এখানে তিনি এসেছেন, থেকেছেন, লিখেছেন। এখানকার গৌরীপুর হাউজ খুব বিখ্যাত। ময়মনসিংহের একটি উপজেলা হচ্ছে গৌরীপুর। অনেকেই জানেন না, এই দুই গৌরীর মিল কোথায়। গৌরীপুরের জমিদার নির্মাণ করেছিলেন কালিম্পংয়ের গৌরীপুর হাউজ। আর রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় অবকাশযাপন কেন্দ্র ছিল সেটা। অনেকে একে টাগোর হাউজও বলেন। যদিও এখন সেটি পোড়ো বাড়ি।
বসে গেলাম নেটে। খুঁজে বের করে সব পড়তে শুরু করলাম।
কালিম্পং শব্দের অর্থ যে শৈলশিরায় মানুষ খেলা করে। এটি লেপচা শব্দ। লেপচা নেপালি ভাষা। তার মানে কালিম্পং অর্থ পাহাড়ের মাথায় খেলা করা। আগে সেখানে আদিবাসীদের মধ্যে গ্রীষ্মকালে ক্রীড়ানুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। বিশেষ করে ব্রিটিশ আমলে শত্রুদের (ব্রিটিশ দখলকারী) কবল থেকে দেশ রক্ষার কৌশল হিসেবে শক্তি চর্চার একটি উপায় হিসেবে ওই ক্রীড়ানুষ্ঠান হতো। কারণ তখন বলে কয়ে সরকারের বিরোধিতা করা সম্ভব ছিল না। প্রকাশ্যে শক্তির চর্চাও ছিল না। যেভাবে বাংলাদেশের চট্টগ্রামে জব্বারের বলি খেলা শুরু হয়েছিল।
ও হ্যাঁ, আরেকটি অর্থ পাওয়া গেলো। তিব্বতি ভাষায় কালিম শব্দের অর্থ রাজার মন্ত্রী। আর পং শব্দের অর্থ ক্ষমতার কেন্দ্র। তাহলে জায়গাটির নামের অর্থ বেশ রাজকীয়। ক্ষমতার কেন্দ্র যে মন্ত্রীদের হাতে। তিব্বতি ভাষায় এ রকম অর্থ হওয়ার নিশ্চয় কোনো কারণ আছে। সেটা কী?
১৮৫০ সালের আগপর্যন্ত কালিম্পং ও আশপাশের অঞ্চলগুলো শাসন করতো সিকিমের রাজা, ভুটানের রাজা। সিকিম শাসনামলে ওই অঞ্চলকে বলা হতো ডালিংকোট। ১৭০৬ সালে ভুটানের রাজা ওই এলাকা দখল করে নেয়। বলা চলে সিকিমের রাজার কাছ থেকে কেড়ে নেয়। আর তখনই ওই এলাকার নতুন নামকরণ করেন কালিম্পং। বাবা রে, কত অজানারে!
সে সময় কালিম্পং ও তিস্তা উপত্যকার ওই অঞ্চল ভুটান সংলগ্ন ছিল। একে তো পাহাড়ি এলাকা, চাষবাস ছিল কষ্টসাধ্য। রাস্তাঘাট ছিল না। যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। দুর্গম এলাকা বলে মানুষজন ছিল খুব কম। সেখানকার আদি বাসিন্দা ছিল লেপচা সম্প্রদায়। আরও ছিল ভুটিয়া ও লিম্বু উপজাতি। এ কারণে এখনো সেখানকার মানুষদের চেহারা ভুটানিদের মতোই। গত দশকে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবলার বাইচুং ভুটিয়া ওই এলাকার ছেলে।
১৭৮০ সালে গোর্খারা কালিৎম্পং আক্রমণ করে। তারা জয়ও পায়।
এখন প্রশ্ন হলো গোর্খা কারা? প্রায়ই শোনা যায় গোর্খাদের আন্দোলনের কথা। গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন শব্দ দুটো শুনে আসছিলাম ছোটবেলা থেকেই। প্রায়ই তারা অশান্ত করে রাখে ওই পাহাড়ি এলাকা। গোর্খা হচ্ছে নেপাল ও উত্তর ভারতের একটি জাতিগোষ্ঠী। অষ্টম শতাব্দির হিন্দু যোদ্ধা সন্ত গুরু গোরক্ষনাথের নাম থেকে এসেছে ওই গোর্খা। গোরক্ষনাথের শীষ্য ছিলেন বাপ্পা রাওয়াল। যদিও তার আরও দুটি নাম ছিল, যুবরাজ কালভোজ বা যুবরাজ শালিয়াধীশ। তিনি ছিলেন রাজস্থানের রাজবংশের সন্তান। ওই বাপ্পা রাওয়ালের পরবর্তী বংশধরেরা গোর্খা বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। ওই বংশই পরে নেপাল রাষ্ট্রের জন্ম দেয়। বর্তমানে নেপালের ৭৫ টি জেলার মধ্যে একটির নাম গোর্খা।
কিছুটা প্যাঁচ ছুটলো। কারণ বছর দশেক আগে থেকেই আমার নেপাল যাওয়া আসা। ওখানে গিয়ে গোর্খাদের কথা শুনি। আবার ভারতে গোর্খাদের আন্দোলনের কথা শুনি। ভুটান গিয়েও শুনেছি তাদের কথা। আবার ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে গোর্খরা কাজ করে। শুনেছি খোর্খা সৈন্যরা এমনকি সিঙ্গাপুরেও আছে। গোর্খা না হয় বুঝলাম কিন্তু গোর্খা রেজিমেন্ট (মানে সেনাবাহিনীতেও!), গোর্খা পুলিশ, গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন, ইংল্যান্ডের সঙ্গে গোর্খাদের যুদ্ধ; এসব বিষয় মাথায় ঘোট পাকাচ্ছিল।
উইকিপিডিয়ায় ঢুকলাম। ভারতের সেনাবাহিনীতে গোর্খা নামে একটি রেজিমেন্ট আছে। এই যা। রেজিমেন্ট আবার কি? রেজিমেন্ট হচ্ছে সেনাবাহিনীর একটি ইউনিট। যা একাধিক ব্যাটালিয়ন দিয়ে গঠিত। একজন কর্নেল সাধারনত এর দায়িত্বে থাকেন। আধুনিক রেজিমেন্ট একটি ব্রিগেডের মতোই। যদিও ব্রিগেডের দায়িত্বে থাকেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল। একটা রেজিমেন্টে বা একটা ব্রিগেডে কতজন সৈন্য থাকবে তা ওই রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কাঠামো বা রুলস অনুসারে নির্ধারিত হয়।
ভারতের সেনাবাহিনী ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর ব্রিগেড অব গোর্খায় তাদের সাহিসকতা ও শক্তিমত্তা ইতিহাসে খুব সুনামের সঙ্গে উচ্চারিত হয়। ব্রিটিশ শাসকেরা গোর্খাদের মার্শাল রেস বা যোদ্ধা জাতির মর্যাদা দেন। আর তাই ভারতীয় সেনাবাহিনীতে গোর্খাদের মধ্য থেকে অনেক সৈন্য নেওয়া হতো। তাদের সাহস, শক্তিমত্তা, যুদ্ধংদেহী মনোভাব, আনুগত্য, পরিশ্রমী মানসিকতার প্রসংশা করেন সবাই।
ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান ফিল্ড র্মাশাল শ্যাম মানেকেশ। ভারতের মাত্র দুজন ফিল্ড মার্শালের একজন তিনি। এটি সেনাবাহিনীর সর্বোচ্চ পদ। সাধারণত কোনো যুদ্ধে সাহিসকতার সঙ্গে জয়ের পর ওই র্যাংক দেওয়া হয়। যাহোক, ওই ভদ্রলোকের একটা মন্তব্য শুনুন। তিনি বলেছেন, যদি কোনো মানুষ বলে সে মৃত্যুকে ভয় পায় না, তাহলে হয় সে মিথ্যে বলছে নয়তো সে একজন গোর্খা। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল বিপিন রাওয়াত এবং দলবীর সিং; তারা দুজনেই গোর্খা রেজিমেন্টে ছিলেন।
গোর্খাদের ভাড়াটে সৈন্য বা মার্সেনারি সোলজারও বলা হয়। যারা কোনো রাজনৈতিক কারণ ছাড়াই কোনো রাষ্ট্র বা জাতির পক্ষে লড়ে, তাদের বলা হয় মার্সেনারি সোলজার। মানে ভাড়াটে সৈন্য। প্রধানত ভারত ও ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে সার্ভিস দিয়ে থাকে তারা। সিঙ্গাপুরের পুলিশ বাহিনীতেও গোর্খাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
এবার আসি গোর্খাদের সঙ্গে ব্রিটিশদের যুদ্ধ বিষয়ে। ঘটনার শুরু ১৮১৪ সালে। তখন ভারত শাসন করে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। কোম্পানি গভর্নর ছিলেন ডেভিড অক্টারলোনি। তার খেয়াল হলো নেপাল আক্রমণের। ২২ হাজার সৈন্য পাঠালেন আক্রমণের জন্য। নেপালিদের তখন ভারী অস্ত্রে সজ্জিত সেনাদল ছিল না। অক্টারলোনির ধারণা ছিল ব্রিটিশ সেনারা যাবে আর জামাই আদরে তাদের সব ছেড়ে দেবে নেপাল। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ২২ হাজার সৈন্যের মোকাবিলা করে মাত্র ১২ হাজার গোর্খা। ভারী অস্ত্রের বিপরীতে গোর্খাদের ছিল একটাই অস্ত্র-ছোরা। গোর্খাদের উচ্চাতাও কম, ৫ ফুট দুই থেকে চার ইঞ্চি। বাঁকানো ছোরা দিয়েই তারা বীরদর্পে দুই বছর যুদ্ধ করে। শেষ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একটি চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ শেষের ঘোষণা দেন। ইতিহাসে ওই চুক্তির নাম ট্রিয়েটি অব সুগলি। ওই যুদ্ধে গোর্খাদের সাহসিকতায় মুগ্ধ হন অক্টারলোনি। প্রস্তাব দেওয়া হয় ব্রিটিশ বাহিনীতে তাদের সার্ভিস দেওয়ার। চুক্তির এক বছরের মধ্যেই ৫ হাজার গোর্খাকে নিয়ে গঠিত হয় একটি রেজিমেন্ট (একটা রেজিমেন্টে ২ থেকে ৮ হাজার সৈন্য ছিলো)। যার নাম দেওয়া হয় কিং জর্জ ওন গোর্খা রাইফেলস। পরে অবশ্য আরও সৈন্য নিয়োগ পান।
এর আগে কালিম্পং বাংলাদেশ ছিল একই দেশে। একদেশে জামিদারি, আরেক দেশে বাংলো!
প্রথম গোর্খা রেজিমেন্ট গঠনের দুই বছরের মাথায় তাদের যুদ্ধে পাঠানো হয়। তাদের দিয়ে যুদ্ধ করানো হয় মারাঠাদের বিরুদ্ধে, ১৮১৭ সালে। এরপর ১৮২৬ সালে রাজপুতদের (রাজস্থান) সঙ্গে এবং ১৮৪৬ ও ১৮৪৮ সালে দুবার শিখদের বিরুদ্ধে তারা যুদ্ধ করে। ইস্ট ইন্ডিয়ার বিজয় ছিনিয়ে আনে তারা। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহে গোর্খারা ইংরেজদের অনুগত ছিল। এসব যুদ্ধের পর গোর্খারা বলা চলে আনুগত্যের পরীক্ষায় ভালোভাবে পাস করে। এরপর তাদের ব্রিটিশ আর্মিতে নিয়োগ দেওয়া শুরু হয়। এখন বুঝলেন তো ব্রিটিশরা কেন তাদের কদর করে!
তবে গোর্খারা আসতো নেপালের চারটি সম্প্রদায় থেকে। এগুলো হলো গুরুং, মাগার, রাইস ও লিম্বুস। গুরুং ও মাগার; এরা নেপালের মধ্যাঞ্চলে বাস করে। পরের দুটো সম্প্রদায়ের বাস পুর্বাঞ্চলে। মনে রাখবেন দার্জিলিং, কালিম্পং কিন্তু নেপালঘেঁষা। যদিও পুরো নেপাল থেকেই এখন গোর্খারা সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে আসে। তবে বেশি নিয়োগ পায় ওই চার সম্প্রদায় থেকেই। গোর্খারা হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী। পৃথিবীর একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্র কিন্তু নেপাল। যদিও সবচেয়ে বেশি হিন্দু থাকেন ইন্ডিয়াতে।
শুনলাম গোর্খাদের নিয়োগ পরীক্ষা নাকি ভিন্ন পদ্ধতির। ইংরেজি ভাষা ও গণিতে পরীক্ষা হয়। এরপর তাদের মূল পরীক্ষা হলো ডোকো চ্যালেঞ্জ। সেটা কী? কাঁধে ২৫ কেজি ওজন ডোকো বাস্কেটে নিয়ে ৪০ মিনিটে ৫ কিলোমিটার খাড়া পাহাড়ে উঠতে হয়। যাকে ডোকো ফিজিক্যাল চ্যালেঞ্জ বলা হয়। তবে গোর্খাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় হিমাচল প্রদেশের সাবাথু অঞ্চলে।
ওই যে বলছিলাম সিঙ্গাপুরের পুলিশে গোর্খারা কাজ করেন। তাদের নিয়োগ পরীক্ষাও নেপালে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট কিম জং উনের নিরাপত্তার দায়িত্ব ছিল গোর্খাদের ওপর।
এবার ডোকো বাস্কেট কাকে বলে সেটা শুনুন। ওপরের দিকটা কিছুটা ছড়ানো, নিচের দিকটা একটু চাপা।
স্থানীয়ভাবে তৈরি এমন ঝুঁড়িকই ডোকো বাস্কেট বলা হয়। বাঁশ-বেত দিয়ে এটি তৈরি করা হয়। চা পাতা তুলতে বা পাহাড়ি পথে যে কোনো জিনিস বহন করতে ওই ঝুঁড়ি ভালো কাজে দেয়। এটি পিঠে ঝোলানো থাকে। সাধারণত আদিবাসীরা এ ধরনের ঝুড়ি ব্যবহার করে।
গোর্খাদের অস্ত্র হলো কুকরি। কেউ কেউ খুকরিও বলে। এটি হলো মোটামুটি ১৮ ইঞ্চির লম্বা একটি বাঁকানো ছোরা। যুদ্ধে মানুষ হত্যা, আত্মরক্ষা এমনকি কাঠ কাটার কাজেও তারা কুকরি কাজে লাগায়। এই কুকরি দিয়েই গোর্খারা ইংরেজ সেনাদের নাস্তানুবুদ করেছিল। কুকরি নিয়ে ভয়ঙ্কর একটি কথার প্রচলন আছে। গোর্খারা একবার খাপ থেকে কুকরি বের করলে সেটাকে রক্তপান করিয়েই খাপে ঢোকানো হয়! কাউকে না পেলে এমনকি তারা নিজেদের অঙ্গ থেকে রক্ত ঝরিয়ে তবেই সেটাকে খাপবন্দি করে! আর তাই কুকরি দেখলেই অনেকের অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। যদিও এখন আর কুকরি নিয়ে অতটা ভয়ের কিছু নেই। কুকরির রক্ত পানের গল্প এখন অনেকটাই শিথিল হয়ে গেছে। তবে গোর্খা সৈনিকদের পোশাকের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এখনো কুকরি ও গোর্খা হ্যাট। ওই টুপির ডানদিকে খানিকটা বাঁকা করে পরা হয়। গোর্খারা ভয়ঙ্কর হয়, কারণ তারা বিশ্বাস করে, ‘কাথার হন্নু ভান্ডা মারনু রামরো’। অর্থাৎ কাপুরুষ হয়ে বাঁচার চেয়ে মৃত্যু শ্রেয়।
জানা গেলো, প্রথম ও দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধে গোর্খারা অসামান্য বীরত্বের পরিচয় দেন। প্রশত বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন প্রায় দুই লাখ নেপালি গোর্খা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই গোর্খা রেজিমেন্ট ছিল দশটি। ৪টি রেজিমেন্টের সেনারা বেতন পেতেন ব্রিটিশ সেনাদের সমান। আর ৬টি রেজিমেন্টের সেনারা বেতন পেতেন ভারতীয় সেনাদের সমান। পরে অবশ্য আরও কিছু সৈনিকদের নিয়ে গঠিত হয় ১১তম গোর্খা রাইফেলস।
এবার যাওয়া যাক কালিম্পং ও গোর্খা প্রসঙ্গে। ইতিহাস নিয়ে যাদের আগ্রহ বেশি তারা বিষয়টিতে আগ্রহ পাবেন। ১৭৮০ সালে গোর্খারা কালিম্পং জয় করে নেয়। ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশদের যুদ্ধ হয় ভুটানের সঙ্গে। এর পরের বছর দুই পক্ষে সিঞ্চুলার চুক্তি হয়। এর আওতায় তিস্তার পুব দিকের অংশ, যা ভুটান দখল করেছিল তা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে চলে আসে। তখন কালিম্পং ছিল একটা ছোট লোকালয়, ছোট গ্রাম। হাতেগোনা কয়েকটি পরিবার বাস করতো। এরপর ১৮৬৭ সালে এটি মহকুমার মর্যাদা পায়, জেলা ছিল দার্জিলিং। একসময় এটি ডুয়ার্স জেলায় চলে গিয়েছিল। আবার দার্জিলিংয়ে।
কালিম্পং বিখ্যাত এর আবহাওয়ার কারণে। এর শীতল মনোরম পরিবেশ সবাইকে আকর্ষণ করে। ব্রিটিশরা দার্জিলিংয়ের বিকল্প শৈল শহর গড়তে গিয়ে কালিম্পংয়ের শ্রীবৃদ্ধিতে মনোনিবেশ করেছিলেন। একসময় এটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত হয়। পশুলোম, উল, খাদ্যশস্য আমদানি রপ্তানি হতো এখানে। যে কারণে নেপাল থেকে অনেক লোক ওই অঞ্চলে চলে আসে। এতে বাণিজ্যিক প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এলাকার লোকসংখ্যা বেড়ে যায়। তিব্বত থেকে ব্যবসায়ীরা জেলেপালা পাস দিয়ে এ অঞ্চলে আসতেন। তখন তাদের যাওয়া আসার পথে কুপুপ, জুলুক, আরিতার, পেডং এসব জায়গা ছোট ছোট ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত হয়।
ব্রিটিশ মিশনারিরা এখানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন শুরু করেন। অনেক নামকরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। ধীরে ধীরে সব অঞ্চল থেকে শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়তে যেতে শুরু করেন।
১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময় কালিম্পং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অধীনে যায়। ১৯৫৯ সালে চীন তিব্বত দখল করে নিলে বহু বৌদ্ধ কালিম্পংয়ে পালিয়ে আসে। তারা ওই অঞ্চলে অসংখ্য বৌদ্ধ মঠ স্থাপন করেন। ভারত-চীন বাণিজ্যপথ হিসেবে ব্যবহৃত হতো জেলেপলা পাস। সেটি বন্ধ হয়ে গেলে কালিম্পংয়ের বাণিজ্যিক গুরুত্ব কিছুটা কমে যায়। ১৯৭৬ সালে দালাইলামা কালিৎম্পংয়ে আসেন। ও হ্যাঁ, দালাইলামা হচ্ছেন তিব্বতের ধর্মীয় নেতা। তিনি শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। কালিম্পংয়ে এসে তিনি জ্যাং ঢোক পালরি ফোডাং মঠকে পবিত্র ঘোষণা করেন।
এবার শুনুন গোর্খাল্যান্ড আন্দোলন কী? ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালে জাতিগত ভিত্তিতে আলাদা গোর্খাল্যান্ড ও কামতাপুর রাজ্যের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট ও পশ্চিবঙ্গ সরকারের মধ্যে ঝামেলা তৈরি হয়। এ নিয়ে দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলে। ৪০ দিনের বন্ধ পালিত হয়। কালিম্পং বিদ্রোহীদের দখলে চলে গিয়েছিল। সরকার সেনাবাহিনী নামিয়ে দেয়। এরপর শিলিগুড়ি ছাড়া দার্জিলিং জেলা নিয়ে স্বশাসিত সংস্থা দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল গঠিত হয়। কিছুটা শান্তি নেমে এসেছিল। পরে ২০০৭ সালে আবারও আলাদা গোর্খাল্যান্ড রাজ্যের দাবি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সেবার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। যা হোক, সবাই জানি গোর্খাল্যান্ড রাজ্য হয়নি।
নামের বিষয়ে আরও একটি বলি। ‘দ্য আনটোল্ড অ্যান্ড আননোন রিয়ালিটি অ্যাবাউট দ্য লেপচাস’ বইটি লিখেছেন কে পি তামসাং। তার মতে, কালিম্পং কথাটি এসেছে কালেনপাং শব্দ থেকে। যার অর্থ গোষ্ঠীর ছোট পাহাড়। তিনি আরেকটি কথা বলেছেন, কাউলিম নামে একটি উদ্ভিদ রয়েছে সেখানে। সেখান থেকেও আসতে পারে কালিম্পং। পাহাড়ি ওই শহরের উচ্চতা ১২৫০ মিটার। হিমালয়ের ধবল বরফে ঢাকা শৃঙ্গগুলো দেখা যায় ওখান থেকে। হিমালয়ের ফুল, টিউবার বা স্ফীতকন্দ এবং রাইজোমের ফলন হয় এখানে। বর্ষায় এখানে প্রচুর বৃষ্টি হয়। মাঝেমধ্যে ভূমিধস হয়। রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। শীত বর্ষায় কোয়াশাচ্ছন্ন থাকে।
সত্যি বলতে কী, নামের কারণে কালিম্পংকে সবাই ভালোবাসে। নামের মধ্যে যেন একটা জাদু আছে। পং শব্দটা পিং পং অনুপ্রাস তৈরি করে। ও, দেলু পার্কের কথা বলেছিলাম। যার উচ্চতা ৪৫০১ ফুট। ওখানে রাত্রিযাপনের জন্য ভালো ব্যবস্থা আছে। তবে বুক করতে হবে আগে থেকেই। ওখানে পাখির চোখে কালিম্পংয়ের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্যারাগ্লাইডিংয়ের কথাও বলেছিলাম।
এখানে আরও কিছু আকর্ষণীয় ট্যুরিস্ট স্পট আছে। যেমন গ্রাহামস হোম, মঙ্গলধাম, ম্যাকফারলেন চার্চ, হনুমান পার্ক, দুরপিনদাড়া গুম্ফা, দুরপিনদাড়া ভিউ পয়েন্ট, কালিমন্দির, দুর্গামন্দির, ফো ব্র্যাং মিউজিয়াম, পালরি, জংডং ইত্যাদি। এছাড়া আছে ধর্মোদয় বিহার, নেপালি বৌদ্ধ মন্দির। থোংসা মঠ হচ্ছে পুরনো একটি ট্যুরিস্ট স্পট। ট্যুরিস্ট প্ল্যানারগণ তাদের পরিকল্পনার মধ্যে সবসময়ই ধর্মীয় স্থাপনাগুলো রাখেন। আর আমিও যতটা পারি সেগুলো সযত্নে এড়িয়ে চলি। সবকিছুতেই ধর্মকে জড়ানোর একটা কন্টিনেন্টাল সেন্টিমেন্ট থাকেই।
শুনেছি দুরপিন দাড়াতে নিরিবিলি সময় কাটানোর ভালো জায়গা রয়েছে। নানা রঙের ফুল গাছে সাজানো লপচু গ্রামের হোম কটেজগুলোও নাকি দারুণ।
ধান ভানতে শীবের গীত গাইলাম। যে কথা বলতে গিয়ে এত কথা তা হলো, কালিম্পং জায়গাটি রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয় ছিল। বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ যখন অসুস্থ বোধ করেন, তখন ডাক্তার তাকে হাওয়া বদলের কথা বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তখন তার প্রিয় জায়গা শান্তির আবাস হিসেবে কালিম্পংকে বেছে নেন।
একজন বাংলাদেশি হিসেবে গৌরীপুর হাউজটি আমাকে খুব টানে। এটি তৈরি করেছিলেন ময়মনসিংহের গৌরীপুরের জামিদার বীরেন্দ্রকৃষ্ণ রায় চৌধুরী। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘আমার আনন্দে আজ একাকার ধ্বনি আর রঙ/ জানে কি তা এ কালিম্পঙ’। একাধিক ব্যালকনি, রেলিঙে জাফরির কাজ।
অনেক বিখ্যাত মানুষ গৌরীপুর হাউজের আতিথ্য নিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ কালিম্পং গেলে ওখানেই থাকতেন। সাদা দোতলা বাংলো বাড়ি। পাশ্চাত্য মিশ্ররীতিতে তৈরি। এখনো পাহাড়ের ওপর ঠাঁই দাঁড়িয়ে বাড়িটি। নিঃসীম শূন্যতা, অনাবিল আকাশ, প্রকৃতির নিটোল মায়া; সবই টানে প্রকৃতিপ্রেমীদের।
তবে বাড়িটি এখন জীর্নশীর্ণ। ঠিক যেন পোড়ো বাড়ি। অভিভাবক না থাকলে যা হয়। ভবনের গায়ের রঙচটা। পলেস্তারা খসে পড়ছে। দরজা-জানালা নেই বললেই চলে। কাঠগুলো খসে খসে পড়ছে। কাঁচের জানালা কিছু ভাঙা, কিছু কঙ্কালের দাঁতের মতো ভেংচি কাটছে। ফায়ার প্লেসের জায়গাটা বোঝা যায় এখনো। সংরক্ষণেরও উদ্যোগ নেই। এখন ওটা অনেকটা ভুতুরে বাড়ি। আমার ধারণা, ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর জমিদারেরা বাড়িটি নিয়ে কিছু সমস্যায় পড়েছিলেন। এর আগে কালিম্পং বাংলাদেশ ছিল একই দেশে। একদেশে জামিদারি, আরেক দেশে বাংলো!
এখন বাড়িটির অবস্থা যাই হোক না কেন এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। বাঙালির কাছে রবীন্দ্রনাথ অনেক বড় কিছু। তার স্মৃতিমাখা জায়গাটি সংরক্ষণের দাবি রাখে। ১৯৩৮ সালের ২৫ শে বৈশাখ কবির জন্মদিনে এই বাড়িতে বসেই তিনি তার জন্মদিন কবিতাটি পাঠ করেছিলেন। টেলিফোনে সেটি রিলে করছিল আকাশবাণী বেতার।
আসলে পুরো বিষয়টাই রটনা, গল্প। গল্পই মানুষকে টানে, সত্য পড়ে থাকে বামে-ডানে
এরপর ১৯৪০ সালের সেপ্টেম্বরেও কবি কালিম্পংয়ে ছিলেন। সেবার তিনি সরাসরি শান্তিনিকেতন থেকে ওখানে গিয়েছিলেন। ওই মাসের ২৬ তারিখ তিনি হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন। দার্জিলিংয়ের সিভিল সার্জন বলেছিলেন তখনই কবির অপারেশন করাতে। তিনি প্রতিমা দেবী এবং মৈত্রেয়ী দেবি অপারেশন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিছুটা সুস্থ বোধ করলে কবিকে কলকাতায় ঠাকুরবাড়িতে নেওয়া হয়।
তবে গৌরীপুর হাউজ দেখতে ভুতুরে বাড়ি হলেও মূল ভুতুরে বাড়ি হল মরগান হাউজ। এটাতে হন্টেড হাউজও বলা হয়। যদিও দুটি বাড়ি একেবারেই ভিন্ন প্যাটার্নের। গৌরীপুর হাউজ ছিল পুরো বাঙালি বাড়ির মতো। আর মরগান হাউজ একেবারে ব্রিটিশ স্টাইলে তৈরি। ব্রিটেন, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড অথবা ইউরোপে এ ধরনের বাড়ি দেখা যায়। অনেকটা ব্রিটিশ প্যালেসের স্টাইলে এটা তৈরি। দুরপিনদাড়া পাহাড়ের মাথায় প্রকৃতির মুকুট পরে দাঁড়িয়ে হাউজটি। ব্যালকটি, মিড ওয়াল, ওপরে, নিচে- সামনে, পেছনে সব জায়গায় অর্কিড। নানা জাতের শোভা গাছ, লতা-পাতায় জড়িয়ে আছে হাউজটি। সামনে প্রশস্ত বাঁধানো লন। দুপাশে পাতাবাহর। নরম স্নিগ্ধ সবুজ ঘাসের গালিচা পুরো চত্বরজুড়ে। পাখ-পাখালির কাকলি, পায়রার বাকবাকুম, ঘুঘুর ঘুঙুর পরিবেশকে করে তোলে মোহনীয়। বাড়ির উঠোন থেকেই দেখা যায় কাঞ্চনজঙ্ঘা। লুচি সবিজি দিয়ে বাড়ির লনে নাস্তা পরিবেশন করা হয় প্রতি সকালে।
এতকিছুর আড়ালে রয়েছে গা ছমছম ভাব। আগে থেকেই বুকিং থাকলে রাত কাটানো যায় ও বাড়িতে। কিন্তু সাহসীরাই কেবল থাকেন। দিনের বেলাতেও মনে হয় কোনো প্রেতাত্মা ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেকে না কি সেখানে মধ্য রাতে ভুতুরে শব্দ পান। ভূতে বিশ্বাস না করলেও মরগান হাউজের পরিবেশ দেখে গা ছমছম করে উঠবে। শিকড় বাকড় লতা গুল্ম পরিবেশকে করেছে আরও অদ্ভুতুড়ে। ব্রিটেনের গ্রামের দিকে এরকম প্যালেস বা পোড়ো বাড়ি এখনো দেখা যায়। হরর ম্যুভির শ্যুটিং হয় এরকম বাড়িতেই।
জর্জ মরগান নামে এক ব্যবসায়ী ১৯৩০ সালে এই বাড়িটি তৈরি করেছিলেন। তার ছিল পাটের ব্যবসা। ভালো লাভ করতেন। টাকা পয়সা কামাতেন দেদারসে। প্রভাব প্রতিপত্তিও ছিল বেশ। কালিম্পংয়ে তখন লোকসংখ্যা ছিল খুব কম। নিরিবিলি এমন ঠাণ্ডা মনোরম এলাকার প্রেমে পড়ে যান তিনি। বানালেন বাংলো।
স্ত্রীকে নিয়ে মাছে মধ্যেই সেখানে সময় কাটাতেন। একসময় মরগান মারা গেলেন। পরে মারা যান তার স্ত্রীও। তাদের কোনো সন্তান ছিল না। পরে এই বাড়ি চলে যায় সরকারের হাতে। ১৯৬২ সালে তখনকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরু যখন অসুস্থ হন, তখন এটিকে সরকারি রেস্ট হাউজ ঘোষণা করা হয়। ১৯৭৫ সালে বাড়িটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পর্যটন দপ্তরের আওতায় চলে যায়। এখন মরগান হাউজ একটি হোটেল হিসেবেই ব্যবহৃত হচ্ছে।
বাড়িটি নিয়ে অনেক কথা চালু আছে। স্থানীয়রা বলেন মরগানের স্ত্রী বাড়িটিকে খুব ভালোবাসতেন। এখনো তিনি মধ্যরাতে বাড়ি পরিদর্শন করতে আসেন। সাদা গাউন পরা লেডি মরগানকে নাকি পাহারাদারেরা প্রায়ই দেখেন। মরগানের বেডরুমে যারা থাকেন তাদের নাকি কপালে হাত বুলিয়ে দেন লেডি মরগান। ওই বাড়ির এক গৃহপরিচারিকা জানান, কোজাগরি পূর্ণিমায় মরগান ও তার স্ত্রী একসঙ্গে বাড়ির করিডোর, লন, ভেতরের কক্ষ পরিদর্শন করেন। তবে ভয় দেখাতে নয়, অতিথিদের যত্ন আত্তি ঠিকমতো হচ্ছে কি না; সেটা দেখতে বের হন তারা। হোটেলে যারা থাকেন তারা না কি মরগান দম্পতির পায়ের আওয়াজ পান!
শোনা যায় মরগান দম্পতি কখনো কারও ক্ষতি করেনি। কিন্তু তারপরও অনেকেই না কি ভয় পেয়ে হোটেল ছেড়ে চলে গেছেন। আবার কেউ কেউ ভুতুরে পরিবেশকে উপভোগ করতে বার বার এসেছেন। তবে আমার মতো কেউ কেউ আছেন, যারা জিন-ভূতে বিশ্বাস করে না; তারা বার বার গেছেন সত্যিই কিছু দেখা যায় কি না। তারা অবশ্য পায়নি। আসলে পুরো বিষয়টাই রটনা, গল্প। গল্পই মানুষকে টানে, সত্য পড়ে থাকে বামে-ডানে।
চলবে…
দার্জিলিঙে বৃষ্টি, কালিম্পঙে রোদ-১৫॥ উদয় হাকিম