সাহিত্যের একাধিক শাখায় সালাহ উদ্দিন মাহমুদের বিচরণ থাকলেও আমি তার কথাসাহিত্যের মুগ্ধ পাঠক। বিগত সাত-আট বছরেরও বেশি সময় ধরে আমি তার লেখার সঙ্গে পরিচিত। বলা চলে, আমি তার নিয়মিত পাঠক।
এই সময়ে যারা নিয়মিত লিখছেন, তাদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজনের লেখা আমাকে টানে। তার মধ্যে সালাহ উদ্দিন মাহমুদ অন্যতম। তিনি কবিতা লিখলেও আমি তাকে পাঠকের কাছে কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদ দীর্ঘদিন ধরে সাহিত্যচর্চা করলেও এই সময়ের লেখকদের হিসাবে তার বই বিলম্বে প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার বইসহ তার এ যাবৎ আটটি বই প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে একটি উপন্যাস, তিনটি গল্পের বই, দুটি কবিতার বই ও দুটি সম্পাদনাধর্মী। তবে গল্প-উপন্যাস দিয়ে সালাহ উদ্দিন মাহমুদ জানান দিয়েছেন, তিনি কথাসাহিত্যের অঙ্গনে পাঠকের জন্য ভিন্নমাত্রার কিছু নিয়ে এসেছেন। ইতোমধ্যে তার পাঠকগোষ্ঠী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছেন।
আমি কথাসাহিত্যিক সালাহ উদ্দিন মাহমুদের কথাসাহিত্যের বিষয়ে আমার কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। কথাসাহিত্য পঠন-পাঠনে আমার অভিমত তার বিদগ্ধ পাঠকের কারও কারও সঙ্গে মিলে যেতে পারে, আবার কেউ কেউ দ্বিমতও পোষণ করতে পারেন। আমি যখন কোনো গল্প কিংবা উপন্যাস পাঠ করি; তখন আসলে সাহিত্যমানের চেয়ে তার ভেতরের গল্প বা কাহিনি আছে কি না, সেদিকটাই বেশি খেয়াল করি। কারণ গল্প আমাকে বেশি টানে। তাই বলা চলে, আমি মূলত গল্পের জন্য লেখকে মনের গভীরে ঠাঁই নিতে চাই। লেখক হয়ে ওঠেন আমার গল্প শোনার সঙ্গী।
সালাহ উদ্দিন মাহমুদের লেখায় প্রাণসঞ্চারী গল্প যেমন পাই, তেমনই পাই সাহিত্যরসও। তার প্রথম বই ‘সার্কাসসুন্দরী’ পাঠ করেই মুগ্ধ হয়ে যাই গল্প বুননের কারিশমা দেখে। তার প্রথম গল্পগ্রন্থ ‘সার্কাসসুন্দরী’র প্রতিটি গল্পেই একজন সুদক্ষ কথাশিল্পীর ছাপ সুস্পষ্ট। গল্পে ঘটনার পরম্পরা, আবহের সাবলীল বয়ান, সেইসঙ্গে হৃদয়গ্রাহী শব্দের ব্যবহারে মুন্সিয়ানাও দেখিয়েছেন তিনি। মোট ১৩টি গল্প নিয়ে ‘সার্কাসসুন্দরী’ গল্পগ্রন্থটি মলাটবন্দি করা হয়েছে। প্রতিটি গল্পই বর্তমান সময়ের রুচিশীল পাঠককে আকৃষ্ট করবে। গল্পকার তার গল্পগুলোয় সমসাময়িক সামাজিক সমস্যা, প্রেম, বিরহ, বেকারত্ব, প্রতারণা, নতুন প্রজন্মের অবক্ষয়সহ নানা অনুষঙ্গ সুনিপুণভাবে তুলে আনার চেষ্টা করেছেন।
একটি হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যদের ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ খেতে চাওয়ার গল্প পাঠককে ভীষণভাবে আলোড়িত করবে। যারা নব্বই দশকের গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন, তারা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হবেন।
‘মাঝ রাতে কবির সঙ্গে’ শীর্ষক গল্পটিতে সালাহ উদ্দিন মাহমুদ আমাদের বর্তমান সমাজব্যবস্থা, সাহিত্যচর্চার দুর্দশার কথা বলেছেন। এ গল্পের মধ্যদিয়ে স্বপ্নলোকে রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মুঠোফোনে কথা বলেছেন। তার এই কথোপকথন পাঠককে হাসাবে, আবার গভীর ভাবনায় নিমজ্জিতও করবে। অন্যদিকে ‘সার্কাসসুন্দরী’ গল্পে এক ছন্নছাড়া যুবকের কথা প্রতিভাত হয়েছে। গ্রামে সার্কাস দেখতে গিয়ে এক যুবক সার্কাসের নায়িকার রূপ-রসে মজে যায়। তাকে নিয়ে ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর হয়ে যায়। অত্যন্ত প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি এ গল্পের প্রতিটি লাইন সাজিয়েছেন। এ থেকে কয়েকটি লাইন পাঠকের সামনে তুলে ধরার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না, ‘হ্যাঁ, সুন্দরী। আমার সুন্দরী। ওকে তো আমার চাই-ই চাই। লোক আমি বেশি সুবিধার নই—পাড়ার সকলেই তা জানে। কত মেয়ের ওড়না, শাড়ি, অন্তর্বাস এখনো আমার আলনায় দুলছে। ভাড়াটে সুন্দরীরা প্রায় রাতেই মেতে ওঠে আমার শরীর নিয়ে।’
তার ‘ক্ষত’ গল্পটি সমসাময়িক যৌনমনস্তাত্ত্বিক জটিল বিষয়ে আবর্তিত। একজন স্বামী বাসর রাতে তার নববিবাহিত স্ত্রীকে অন্য যে কারো সঙ্গে সেক্স করতে অনুমতি দেন। যা পাঠকসমাজকে নিশ্চিত ভাবিয়ে তুলবে। অথবা বিতর্কেরও জন্ম দিতে পারে। বাস্তবে এমন ঘটে কি না–জানা না থাকলেও ঘটতে পারে বিবেচনা করে গল্পটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এখন ‘বাসর রাতে বেড়াল বৃত্তান্ত’ গল্পটি সম্পর্কে আলোকপাত করতে চাই। এটি ‘অতিপ্রাকৃত’ ঘটনা অবলম্বনে রচিত। এ ধরনের গল্পে যে বৈশিষ্ট্য থাকা প্রয়োজন, তার অধিকাংশই এতে বিদ্যমান। তাই এটিকে সার্থক অতিপ্রাকৃত গল্প বলা যায়।
এছাড়া ‘মাহিনের ইচ্ছেগুলো’, ‘মিথিলা এখনো কানামাছি খেলে’ ও ‘অন্তহীন’ গল্প তিনটিকে গল্পের পরিবর্তে আত্মজীবনী মনে হয়েছে। তার আঞ্চলিক ভাষায় লিখিত ‘হাক্কা’ গল্পটি চমৎকার লেগেছে। আঞ্চলিক ভাষার কবিতা আমরা অনেক পড়েছি। কিন্তু পুরো গল্পটি আঞ্চলিক ভাষায় মনে হয় এই প্রথম পড়লাম। ভাষাটি সম্ভবত লেখকের জন্মস্থান মাদারীপুর অঞ্চলের হয়ে থাকবে।
তবে সমালোচকরা বলেছেন, ‘সার্কাসসুন্দরী সালাহ উদ্দিন মাহমুদের প্রথম গল্পের বই হলেও তার চিন্তা ও উপস্থাপন ভঙ্গির মধ্যে পরিপক্বতার ছাপ স্পষ্ট। গল্পের কাহিনী বিন্যাসের বাঁক-বদল পাঠককে চমকে দেবে। তবে গল্প নির্বাচনে দু’-একটি গল্প এই বইয়ে অন্তর্ভুক্ত না করলেও লেখক ভালো করতেন। ভাষার ক্ষেত্রে পাঠক হিসেবে একজন উদীয়মান কথাসাহিত্যিকের কাছে আরও প্রাঞ্জলতা প্রত্যাশা করি। তার নতুন গল্পে নতুন চিন্তা ও ভাষার কাব্যময়তা আমাদের মুগ্ধ করতে সমর্থ হবে।’
সালাহ উদ্দিন মাহমুদের দ্বিতীয় গল্পের বই ‘নিশিসুন্দরী’। গল্প গ্রন্থটির গল্পগুলোও বেশ হৃদয়গ্রাহী। এ বইয়ের প্রতিটি গল্পই পাঠক হৃদয় ছুঁয়ে যাবে। এ বইয়ের ‘নুরু দাদার অন্তিম প্রস্থান’ গল্পে আমাদের জীবন-মৃত্যুর অমোঘ সত্য কী সহজেই না বলেছেন! লেখকের বয়ানে শোনা এ গল্পের একটি কথা, ‘মানুষ এতো সহজেই লাশ হয়ে যায়? অথচ বেঁচে থাকার জন্য মানুষ কতো চেষ্টা, কতো পরিশ্রম করে।’ আসলে মৃত্যু কার কখন আসবে কেউ কি বলতে পারে? এতো অমোঘ বিধান। প্রত্যেক মানুষের মৃত্যু অনিবার্য। এই অনিবার্য সত্যকেই মেনে নিতে হয়।
‘হাতঘড়ি’ গল্পে বোঝা যায়, ভালোবাসা কখনো বুড়ো হয় না। সব সময়ই তা সতেজ থাকে। ভালোবাসায় ছেলেমানুষি বলতে কিছু নেই, ভালোবাসা সারাজীবন শিশুর মতোই থাকে। অথচ কতটা দূরত্ব হলে ডায়াল কল থেকে ভালোবাসার নম্বর মুছে যেতে পারে? কেননা আমরা কাছের মানুষটাকে বেশি অবহেলা করে থাকি। যে কোনো ক্ষেত্রে অবহেলা করাটা ক্ষতির কারণ হয়। হাতঘড়ি গল্পে স্ত্রী তার স্বামীকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। কিন্তু স্বামী তার স্ত্রীকে সেভাবে সময় দিচ্ছে না। যে কারণে তাদের মধ্যে ঝগড়া লেগে থাকে। স্ত্রী তার স্বামীর বাসা ছেড়ে চলে যায়। পরে স্বামী বুঝতে পারে প্রিয় মানুষটি চলে যাওয়ার বেদনা। তার সব কাজ থেমে থাকে। সুতরাং বলতে পারি, প্রত্যেকটি সম্পর্কে ভালোবাসার প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। কখনো কাউকে অবেহলা করতে নেই।
‘চৈতির রোজনামচা’ গল্পে লেখক বোঝাতে চান- জীবনের আলো যার ফুরিয়ে এসেছে, জগতের আলোতে তার কী হবে? কারণ ঘরের কথা বাতাসের আগে দৌড়ায়। আজকাল ভালোবাসার নামে ছেলেখেলা হচ্ছে। ভালোবাসার নামে শরীরের চাহিদাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। অথচ ভালোবসা হচ্ছে পবিত্র। সেই ভালোবাসাকে অপবিত্র করার কারণে ভালোবাসার মানুষটি আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়। সাথে সাথে শেষ হয়ে যায় একটি সুন্দর পরিবার। সুতরাং ভালোবাসা হোক সম্মানের, শরীরের চাহিদার জন্য নয়।
গল্পগ্রন্থের নামগল্প ‘নিশিসুন্দরী’ পড়লে মনে হবে, আজ যেটা ঘটলো- পরদিন তার ঠিক উল্টো ঘটতে পারে। দার্শনিক হিরাক্লিটাস তার পরিবর্তনবাদে বলেছেন, ‘আজকের আমি, আর কালকের আমি এক না-ও হতে পারি।’ এখানে লেখক বলেন, ‘পৃথিবীতে সবাই খেলছে, যে যেভাবে পারছে।’ কারণ ভালো-মন্দ মিলে এ জগৎ। কেউ সুযোগের অভাবে ভালো থাকে, আবার সুযোগ পেলে খারাপ হয়ে যায়। দিনে ভদ্রলোক, আর রাত হলেই তাকে চেনা যায়- তিনি কতোটা ভদ্র। মানুষ বেশি লোভ করতে গিয়ে নিজের ক্ষতিটাই করে ফেলছে। কারণ সব বিষয়ে লাভ-ক্ষতির হিসাব করতে নেই। অথচ পরদিন নিশিসুন্দরী আবার অন্যরকম আচরণ করে। অপরিচিত মানুষটাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আসলে যৌনকর্মীরা সমাজের চোখে খারাপ হলেও তারা মানুষরূপী শয়তান থেকে ভালো।
আসলে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো সালাহ উদ্দিন মাহমুদ তার নিশিসুন্দরী বইয়ে শুধু একজন গল্পকারের চোখ দিয়েই দেখেননি, একজন দার্শনিকের চোখেও দেখেছেন। প্রতিনিয়ত আমাদের জীবনে আমরা উপলব্ধি করি কিন্তু বলতে পারি না, তা সালাহ উদ্দিন মাহমুদ সুন্দরভাবে গল্পের দৃশ্য পরম্পরায় বলেছেন অনায়াসে।
লেখকের তৃতীয় গল্পের বই ‘বেদেসুন্দরী’। বইটিতেও তিনি গল্প বয়ানের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন শতভাগ। এ গল্পের বইয়ের গল্প সিংহভাগই ৯০ দশকের প্রেক্ষাপটে লেখা। গল্পের পরতে পরতে উঠে এসেছে সেই সময়ের আর্থসামাজিক অবস্থা এবং মানুষের জীবনযাপনের চিত্র। ‘বেদেসুন্দরী’ বইয়ের ‘বয়জা’ গল্পটি আমার মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছে। গল্পটিতে মাদারীপুর জেলার একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েন, সাধ ও সাধ্যের কথা চিত্রিত হয়েছে। মাদারীপুর অঞ্চলে ইলিশ মাছের ডিমকে বলা হয় বয়জা। একটি হতদরিদ্র পরিবারের সদস্যদের ডিমওয়ালা ইলিশ মাছ খেতে চাওয়ার গল্প পাঠককে ভীষণভাবে আলোড়িত করবে। যারা নব্বই দশকের গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে বেড়ে উঠেছেন, তারা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হবেন। আহা, গল্পের সমাপ্তিটা যেন চোখে জল এনে দেয়।
এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ‘সার্কাসসুন্দরী’, ‘নিশিসুন্দরী’, ‘বেদেসুন্দরী’ গল্পগ্রন্থ ও ‘মমতা’ উপন্যাসের মাধ্যমে একজন শক্তিমান তরুণ কথাসাহিত্যিকের প্রমাণ দিয়েছেন।
এ গল্পে অনেক কষ্ট-ক্লেশ করে একটি ইলিশ মাছ কেনেন বশিরদ্দি। কিন্তু মাছ কিনে আনার পর বাড়িতে এসে দেখেন মেহমান এসেছে। তাই আর মন ভরে ইলিশ ও বয়জা নিজেরা খেতে পারেন না। গল্পের শেষের কয়েকটি লাইন তুলে ধরছি—
সবাই খেতে বসলে রাবেয়া কারো প্লেটে লেজ, কারো প্লেটে কানকা, ফুলকা আর গাদার একটা মাছ ভেঙে দুই টুকরা করে দেয়। তখন ছোট ছেলেটা বলে ওঠে,
বয়জা নাই মা। বয়জা দিলা না যে?
বয়জা নাই। এক টুকরা তোর দাদির লেইগা। আর এক টুকরা তোর বাপের।
বশিরদ্দি বলে, আমার লাগবো না। অগো সবাইরে ভাইঙ্গা দাও। মায়রে এক টুকরা দাও। মায় তো আবার কাটাকুটা খাইতে পারে না।
পোলাপানগুলো একজন আরেকজনের দিকে তাকায়। বশিরদ্দি তাকায় রাবুর চোখের দিকে। রাবুর চোখে তখন টালমাটাল ঢেউ। দাদি তখন বয়জা খুটে খুটে ভাত তুলে মুখে দেয়। এ বছর আর হয়তো বয়জা খাওয়া হবে না।
বেদেসুন্দরী বইটিতে বয়জা, বেদেসুন্দরী, সমিরদ্দি পাগলা, বৈচাপাগল, নিরানন্দ শিরোনামের মোট সাতটি গল্প রয়েছে। গল্পগুলো পাঠককে সত্যিই ভাবাবে। এর চিত্রায়ন, চরিত্র নির্মাণ, সংলাপ পাঠকের চোখের সামনে জ্বলজ্বল করে উঠবে।
গল্পকার সালাহ উদ্দিন মাহমুদ এবার হাত দিলেন উপন্যাসে। লিখলেন একটি উপন্যাস। নাম ‘মমতা’। এ উপন্যাসে লেখককে পেয়েছি একজন পরিপক্ব কথাসাহিত্যিক হিসেবে। এ উপন্যাস পাঠে মনে হয়েছে, তিনি উপন্যাস লেখার জন্য গল্প লিখে এতদিন প্রস্তুতি নিয়েছেন। বিশাল ক্যানভাসে মমতা উপন্যাসে এঁকেছেন মানব জীবনের এক অনন্য আখ্যান। এ উপন্যাসে দৃশ্যপট এঁকেছেন দক্ষ শিল্পীর মত।
মমতা উপন্যাসে যে এলাকা ঘটনাস্থল হিসেবে নির্বাচন করা হয়েছে, সে এলাকার বর্ণনা পড়েই মুগ্ধ হবেন পাঠক। আড়িয়াল খাঁ নদের পাশঘেঁষে গড়ে উঠেছে ছবির মতো সুন্দর একটি গ্রাম। নাম তার শশীরচর। বর্ষায় নৌকা আর গ্রীষ্মে ভাঙা রাস্তা ধরে পায়ে হাঁটাই এ গ্রামের মানুষের একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। কৃষিনির্ভর এলাকাখ্যাত সুন্দর এই শশীরচরেই বাস করে সদ্য যৌবনের সাজে সজ্জিত এক সুশ্রী তরুণী মমতা। উড়ুউড়ু মন, দুচোখ ভরা রঙিন স্বপ্ন আর ঠোঁটের ডগায় যখন সিনেমার গান; ঠিক তখনই বিয়ের করুণ সুর বেজে ওঠে মমতার জীবনে। একই গাঁয়ের বলাই মুন্সির ছেলে জালালের সঙ্গে সাতপাকে বাঁধা পড়ে মমতা। মুহূর্তেই খান খান হয়ে যায় জীবনের সব রঙিন স্বপ্ন।
গোধূলিলগ্নে স্বামীর হাতে ধরে মমতা চলে যায় শ্বশুরালয়ে। যা ভেবেছিল ঠিক তা-ই হলো। হাতে মেহেদির রং ঝাপসা হয়ে যাওয়ার আগেই স্বামীর ঠিকানা হলো প্রবাসে। মমতার বিষণ্ন জীবনে আবারও একাকিত্বের সুর। মমতার দিন যায়, রাত কাটে চরম বিষণ্নতায়। রাতের আঁধার মারিয়ে মমতার জীবনে আচমকা আভির্ভূত হয় বাল্যপ্রেম। মালয়েশিয়া থেকে ফিরে কুয়াশার আস্তরণ ভেদ করে মধ্যরাতে রাশেদ দেখা করতে যায় মমতার কাছে, বলাই মুন্সির বাড়ি। ভালোবাসার পরম উষ্ণতা পেয়ে একেবারে গলে যায় মমতা। রাশেদকে জড়িয়ে ধরে ফুপিয়ে কেঁদে ওঠে মমতা। অতঃপর অন্ধকারকে সাক্ষী রেখে দুটি দেহ মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
রাশেদের এ আচমকা আগমন মমতার জীবনে বয়ে নিয়ে আসে চরম এক ভয়াবহ অধ্যায়। নির্মম নিয়তির প্রবল ধাক্কায় এলোমেলো হয়ে যায় মমতার জীবন। সময়ের প্রয়োজনে রাশেদও পাড়ি জমায় প্রবাসের পথে। মনের অজান্তেই মমতার দেহে সন্তর্পণে বেড়ে ওঠে আরেকটি দেহ। এ অধ্যায় মমতার জীবনকে দাঁড় করিয়ে দেয় চরম সংকটের মুখোমুখি। সমাজ-সংসার কেউ সহজভাবে মেনে নেয়নি মমতাকে, মমতার দ্বিতীয় অধ্যায়কে। কলঙ্কের দাগ গায়ে মেখে এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে মমতা। অতঃপর ডালপালা মেলতে থাকে মমতা উপন্যাসের।
মমতা উপন্যাসের বিস্তৃত কলেবরের কাহিনি পাঠকে এক মুহূর্তের জন্যও বিরক্তিতে ফেলবে না, বরং ঘটনার পরম্পরা পাঠককে নিয়ে যাবে মমতা উপন্যাসের শেষ লাইন পর্যন্ত। উপন্যাসে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন লেখক। মমতাকে বিশিষ্ট করেছে তার বয়ান। সমাজচ্যুত এক নারী হয়ে উঠেছেন পাঠকের সহমর্মিতার কেন্দ্রবিন্দু।
সবশেষে এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ ‘সার্কাসসুন্দরী’, ‘নিশিসুন্দরী’, ‘বেদেসুন্দরী’ গল্পগ্রন্থ ও ‘মমতা’ উপন্যাসের মাধ্যমে একজন শক্তিমান তরুণ কথাসাহিত্যিকের প্রমাণ দিয়েছেন। এখন পাঠকের প্রতি তার এক ধরনের দায়বদ্ধতা তৈরি হওয়া উচিত। সে দায়বদ্ধতা হচ্ছে, পাঠককে প্রতিনিয়ত নতুন লেখা উপহার দেওয়া। আশা করি লেখক তার সাহিত্যচর্চা অটুট রাখবেন। বিগত লেখার ভুলত্রুটিগুলো শুধরে নেবেন। নতুন নতুন বিষয় নিয়ে পাঠকের মাঝে হাজির হবেন।
তথ্যসূত্র
সার্কাসসুন্দরী: সময়ের মানসিক বিভ্রাট/ সানাউল্লাহ সাগর
সার্কাসসুন্দরী: কথাসাহিত্যে অনন্য সংযোজন / মিজানুর রহমান মিথুন
নিশিসুন্দরী: আমাদের জীবন দর্শন / মমিন উদ্দিন
মমতা: নারীর সর্বস্ব ত্যাগের অনন্য দৃষ্টান্ত / হারুন অর রশীদএই বিভাবের আরও লেখা: মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রবন্ধ: যুক্তির শৃঙ্খলা ও শিল্পের দায় ॥ আজিজ কাজল