প্রাপ্তবয়স্ক একটি পাপ হাজারটি অক্টোপাস হয়ে আমার আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে। আমার স্ত্রী নীলাক্ষিকেও কোনোদিন বলা হয়নি। আজ একটি বিশেষ ঘটনা ঘটায় পুরনো ঘটনা মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো। ঘুমন্ত সাপ যেন তার লেজে মানুষের পাড়া খেয়ে ফোঁসফোঁস করে জেগে উঠলো। ভেতরটা খানিক দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে গেলো বলে মনে হলো। এমন ভাঙনের শব্দ আমি ছাড়া কারও টের পাওয়ার কথা নয়। নীলাক্ষি একবার মুখের দিকে তাকিয়ে বললো, তোমার কী খুব কষ্ট হচ্ছে? একটু জল খাবে?
মৃত্যুপথযাত্রীকে সাধারণত এমন প্রশ্ন করা হয়। কিন্তু আমি এত সহজে শ্মশানে যেতে রাজি নই। চিতা বরাবরই আমার অপছন্দের জায়গা। একজীবনে কম তো দেখলাম না। অভিজ্ঞতার একটা মূল্য আছে নিশ্চয়ই। হাতের ইশারায় নীলাক্ষিকে শান্ত রাখি, জলের প্রয়োজন নেই, কষ্টও হচ্ছে না। কিন্তু আমি ছাড়া কেউ বুঝবে না আমার কষ্টটা কোথায় আর কত বড়!
তখন আমার বয়স মাত্র বালো বছর। একটি মুখরোচক গল্প বড়দের মুখে মুখে ফিরতে লাগলো। নিড়ানোর কাজ করছিল ক্ষীতিশ ও তার বাবা শৈলেন। পাশের আল দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল ঋষিকান্ত। তার হাতে পিতলের ঘটি। পেছনে হাঁটছে ঋষিকান্তের বউ উর্মিলা। ক্ষীতিশ ডেকে জিজ্ঞেস করলো, বৌদিরে নিয়ে কো-নে যাতেছ ঋষিকান্ত দা?
-ঝাউগ্রাম যাতেছি। তোমার বৌদি মানত করচে, তাই শিবলিঙ্গের মাতায় দুধ ঢালতি যাতেছি।
-শিবলিঙ্গের মাতায় দুদ না ঢাইলে, আমার দোনের মাতায় ঢালো, কাম অয়া যাবিনি।
কথাটা বলে ক্ষীতিশ অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। উর্মিলা লজ্জায় ঘোমটা টেনে মুখটা আড়াল করে। ঋষিকান্ত কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই শৈলেন ধমক দিয়ে ছেলের হাসি থামিয়ে দেয়। শৈলেন বলে, কী কইলি তুই? দেবতা নিয়ে কেউ এমুন ঠাট্টা-তামাশা করে? আ-কতা কু-কতা কয়?
বাবার কথা কানে না তুলে ক্ষীতিশ আবার হাসতে থাকে। ঋষিকান্ত যেতে যেতে বলে, এমুন বজ্জাত ছাওয়াল জন্ম দেচো কাহা, বুজবা ঠেলা!
ক্ষীতিশ হাসতেই থাকে। সে ভাবছে দারুণ একটা কথা বলতে পেরেছে। এত মজার কথা আর পৃথিবীতে নেই। তার মনমেজাজও খুব ভালো ছিল। কেননা একসপ্তাহ পর তার বিয়ে। মনের ফূর্তি মুখে প্রকাশ করতে পেরে মনে মনে নিজেই গর্বিত।
গল্পটা ছড়িয়ে গেলো সর্বত্র। এমনকি মুসলমান পাড়ায়ও। বড়রা যখন গল্পটি করার সময় ‘ধোন’ শব্দটির ওপর জোর দেয়, তখন ভীষণ লজ্জা করে। এই বয়সটা এসব শব্দের ব্যাপারে বড়দের সামনে লজ্জা অনুভূত হওয়ার সহায়ক। অথচ আমরা, অর্থাৎ আমাদের বয়সী ছেলেরা যখন একত্রিত হই, তখন লুঙ্গি তুলে লিঙ্গের মাথার চামড়া উল্টিয়ে লিঙ্গটা ওপরের দিকে তুলে প্রস্রাব করি। পাল্লা দেই, কারটা কত ওপরে উঠলো। মুসলমান ছেলে, যাদের মুসলমানি হয়েছে, তারা কেউ কেউ বলে, তোগের তো আত দিয়ে চাইপে ফুটায়া নিতে অয়। আমাগেরটা এমনিই ফোটা।
মা-বাবাকে কোনো কোনোদিন উপোস থাকতে হতো। আমি লজিং থাকতাম বলে সে-সময় আমাকে উপোস করতে হয়নি।
আমরা কেউ কেউ বলি, তোরা তো কাটান নিচিস, ছাগলের মতো। এভাবেই আমাদের মজা করার দিন। যদিও সংসারে অভাব। সেগুলো আমরা বুঝতে চাইতাম না। বাবা আর জেঠুর কথায় কিছুটা আন্দাজ পেতাম, জিন্নাহ নামটি ঘিন্না করার মতো। তাই স্কুলে গিয়ে চাঁদ-তারা পতাকা তোলার সময় ‘পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ গানটি গাইতে গলা শুকিয়ে আসতো। বাবা আর জেঠু পালকি টানার কাজ করতো নিতাই কাহা আর পরিমল কাহাকে সঙ্গে নিয়ে। তাদের কষ্টটা আমি দেখেছি। ক্ষীতিশের লিঙ্গ বিষয়ক গল্পটি সবাই ভুলে গিয়েছিল। একটি মজাদার মুখরোচক গল্প বেশিদিন টেকে না। কিন্তু বছর দেড়েক পরে সেই গল্পের নাটক আবার ভিন্নভাবে মঞ্চস্থ হতে লাগলো। ক্ষীতিশের যে সন্তানটি জন্ম নিয়েছে, সে নাকি খোজা। নপুংসক, যাকে বলে ক্লীবলিঙ্গ। সবাই বলাবলি করলো, ক্ষীতিশ শিবলিঙ্গকে নিয়ে অপমান করেছিল, ফলে তার এই শাস্তি। কিন্তু ক্ষীতিশ সে-কথা বিশ্বাস করে না। তার মুখে আরও বিশ্রী ভাষার কথা, আমি দেবতা চুদি নে। আমার সুন্তান খুজা অইলে কী, আর যুদিষ্টির অইলে কী? আমি কোনু বিশ্যা মাগির ছাওয়ালের খাই? না পরি? তারা কতা কয়? আমারে ধর্ম শিহায়?
লোকজন চুপ হয়ে যায়। অন্তত ক্ষীতিশের সামনে এ বিষয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। সমাজে এমন দু’একটা বাজে লোক থাকে যারা সমাজকে কেয়ার করতে চায় না। ক্ষীতিশ তাদেরই একজন। পঞ্চায়েতের লোকও মুখ খোলে না তার সামনে, যদি অপমান করে, বেফাঁস কোনো কথা বলে ফেলে। বছর দেড়েক পর ক্ষীতিশের আবার একটি সন্তান হলো। সেটিও খোজা। এরপর আরেকটি সন্তান, সেটিও খোজা। পরপর তিনটি সন্তান খোজা হওয়ায় শৈলেন গালাগাল করতে লাগল ক্ষীতিশের ওপর। যে ছেলে পাপ-পুণ্য বোঝে না, সে মানুষ নয়।
ওদিকে ক্ষীতিশের বউ তপতীও বুঝাতে চেষ্টা করছে বহুদিন ধরে। যে করে হোক ক্ষীতিশকে ঝাউগ্রাম নিতে হবে। শিবের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। না হলে এই পাপমোচন হবে না। গোপনে তপতী বার দুয়েক ঝাউগ্রাম গিয়ে শিবলিঙ্গের মাথায় দুধ ঢেলে এসেছে। পাংশার ঝাউগ্রামে অনেক পুরনো একটি শিবলিঙ্গ আছে। কষ্টি পাথরে নির্মিত। লোকেশনটিও খুব সুন্দর। গাছগাছালিতে ছায়া সুনিবিড়, ছিমছাম পরিবেশ। সেখানে প্রতিবছর শিবমেলা বসে। দূর-দুরান্ত থেকে লোকজন আসে। শিবের মাথায় দুধ ঢালে আর নিচে বড় থালাকৃতির এক কোণা, যেখানে একটু ঢালু করে গাইড ওয়াল দেয়া, সেখান দিয়ে গড়িয়ে পড়ে। মণ মণ দুধ ঢালা হয়। বিশ্বাস না থাকলে মানুষ এ পূজা করতো কি? তাই তপতীও গিয়ে দুধ ঢেলে এসেছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। তপতী পূজা-অর্চনার কমতি করেনি, তারপরও তৃতীয় সন্তান খোজা হওয়ায় সে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছে।
একদিন তপতী তার বড় ছেলেকে পাঠালো আমার কাছে। আমি যেন আজই দেখা করি। হেঁটে যেতে মিনিট দশেক সময় লাগবে। তবু বিকালে যাব বলে জানিয়ে দিলাম। আমি তখন কলেজে পড়ি। শহরে লজিং থাকি। বাড়ি এসেছি জেনেই তপতী আমাকে ডেকে পাঠিয়েছে। আমার থেকে সে চার-পাঁচ বছরের বড় হবে। কিন্তু গ্রামের সম্পর্কে সে আমার কাকিমা। ক্ষীতিশ, মানে যাকে সবাই খাটাশ বলে ভাবে, সে আমার কাকা হয়। তপতী সোজা নিয়ে গেল ঘরে। চকিতে বসতে দিয়ে বলল, বাবা তাপস, তুই তোর কাহারে এট্টু বোজা দিনি। তুই লিহাপড়া জানিস, শহরে থাহিস, তোর কতা সে ফেলতি পারবিন নে।
পাশ থেকে ফোঁসফোঁস করতে থাকলো ক্ষীতিশ, মানে আমার খাটাশ কাহা। বললাম, কাহা, আপনি না যাতি চাইলি, না যান। শিবলিঙ্গের মাতায় দুদ ঢালতি অবি এমুন কোনু কতা নাই। খালি আমার কতাডা এট্টু মন দিয়া শোনেন।
আমি শিবলিঙ্গ সম্পর্কে যতটুকু জানি, বোঝানোর চেষ্টা করলাম। আমরা যে অর্থে এটাকে দেখি, অর্থাৎ শিবের শান্তমূর্তি, যাকে বলা যায় ধ্যানমগ্ন মূর্তি। ধ্যানমগ্ন শিবকে প্রতীকের সাহায্যে প্রকাশ করা হয়। আরেকটা হলো রুদ্রমূর্তি, যে মূর্তিকে যুদ্ধে যাওয়ার সময় পূজা করাই শ্রেয়। শিবলিঙ্গ মূলত পরমেশ্বর শিবের নির্গুণ বস্তু সত্তার একটা প্রতীকচিহ্ন। একারণে শিবরাত্রিতে বা অন্য সময়ে অনেকে শিবলিঙ্গ পূজা করে। অবিবাহিত মেয়েরা শিবের মতো বর চেয়ে এবং বিবাহিত মেয়েরা সন্তান চেয়ে পূজা করে। পুরুষেরাও তাদের মনের আশা পূরণের জন্য শিবলিঙ্গ পূজা করে। ভগবানকে তুষ্ট করার জন্য সবধরনের পূজাই করা যেতে পারে। সেই অর্থে শিবলিঙ্গ পূজাও খুব গুরুত্বপূর্ণ। এই লিঙ্গ, মানে মূর্তিরও ইতিহাস আছে। সংস্কৃত ভাষায় লিঙ্গ অর্থ প্রতীক। স্বামী বিবেকানন্দও একই কথা বলেছেন। শিব আত্মধ্যানে স্বরূপে লীন থাকেন এবং সব মানুষকেও আত্মনিমগ্ন তথা ধ্যানমগ্ন হতে উপদেশ দেন। শিবলিঙ্গের ওপরে অর্থাৎ শিবের কপালে তিনটি সাদা দাগ থাকে, যাকে বলে ত্রিপুণ্ড্র। এটা থেকেও প্রমাণিত হয় ওটা শিবের লিঙ্গ নয়, ধ্যানমগ্ন শিব।
ক্ষীতিশ লাফ দিয়ে উঠে পড়ে বললো, থাহো তোমরা শিবের ধোন নিয়ে। আমি যাই, আমার কাম আচে।
সে আর এক মুহূর্ত বিলম্ব করে না। ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তপতী খপ করে আমার হাত ধরে বলে, দ্যাকচো, দ্যাকচো তোমার কাহার কারবার? এই মানুষডারে নিয়ে ছয়ডা বচ্ছর আমি জ্বলতেছি। জল দিবার মানুষও খুঁইজে পাইতিছি নে। গলায় দড়ি দেব না গাঙে ডুবে মরব বুঝতি পারতিছি নে।
আমি কী বলব ভাষা খুঁজে পাইনে। কারণ আমিও ধর্মে-কর্মে অতটা মনোযোগী নই। যেমন আমার মা সারাক্ষণ যেন ধর্মেই ডুবে থাকে। সংসার-ধর্মও একটা ধর্ম যদি হয় তবে মা ধর্ম নিয়েই আছে। নিয়মিত আহ্নিক পর্যন্ত বাদ দেয় না, মানে পূজাহ্নিকও করে। যদিও সংসারে অভাব নিত্যসঙ্গী। কিন্তু মাকে কখনো হতাশ হতে দেখিনি। ভগবানকে মনে মনে স্মরণ করা ছাড়া সে আর কিছু শেখেনি। বাবা সবসময় চাইতো আমি তার সঙ্গে পালকি টানতে যাই। কিন্তু আমার লেখাপড়ার প্রতি প্রবল ঝোঁক। যে কারণে মা তার মায়ের দেওয়া বালাজোড়া পর্যন্ত বিক্রি করেছে। সুতরাং আমাকে পড়ালেখার দিকে আরও ঝুঁকতে হয়েছে।
এখন আমি ঢাকায় সেটেল্ড। কলাবাগানে নিজস্ব একটি ফ্ল্যাট আছে। নীলাক্ষির মতো অসম্ভব সুন্দর ও চমৎকার মনের একজন স্ত্রী পেয়েছি। ছেলেমেয়ে দুজনেরই বিয়ে দিয়েছি। ছেলের বউ আমাদের সঙ্গে থাকে। কী মিষ্টি ব্যবহার। ফুটফুটে একটি নাতিও হয়েছে। ওদিকে, মেয়েটাও তার স্বামীর সঙ্গে সুখের সংসার করছে। তাদের দুটো ছেলেমেয়ে এখন স্কুলে পড়ছে। মেয়েটা ও লেভেল দেবে। তিনটা নাতিই আমার ভীষণ ভক্ত। আমার একটু শরীর খারাপের খবর পেলে সবাই ছুটে আসে। এসব দিক বিবেচনায় আমি বরাবরই একজন সুখী মানুষ। যদিও আমার জন্ম হয়েছিল নিম্ন বংশে। আমরা ছিলাম কাহার অর্থাৎ বেহারা। আমার বাবা ছিল পালকি টানা একজন বেহারা। কত কষ্টের ছিল সেই দিনগুলো। মনে পড়লে শিউরে উঠি। আমার জন্মের পর থেকেই দেখেছি বাবা আর জ্যাঠার পৃথক সংসার। আমি শহরে যাওয়ার কিছু আগেই আমার জ্যাঠাতো ভাই নরেশ আর পরেশ পালকি টানার কাজে লেগেছিল। প্রাইমারি শেষ না করেই তারা অবশ্য ক্ষেতের কাজে লেগেছিল আগেই। ফলে জ্যাঠার সংসারে কিছুটা উন্নতি দেখা গেলেও আমরা ছিলাম নিতান্ত গরিব। মা-বাবাকে কোনো কোনোদিন উপোস থাকতে হতো। আমি লজিং থাকতাম বলে সে-সময় আমাকে উপোস করতে হয়নি।
কিন্তু আমি অসহায়ের মতো তপতী কাকির প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে লাগলাম। এজন্যেই বোধ হয় ভারতীকে দেখে আমার গা ঘিনঘিন করেছিল। এক হিসেবে সে আমার বোন, অন্য হিসাব মানে খুব জটিল একটি অঙ্ক।
এমনই একটি সময় শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। বাড়িতে এসে অভাবটা খুব চোখে পড়ল এবং কান্না পেল। এর মধ্যেই খবর এলো গ্রামে মিলিটারি ঢুকবে। হিন্দুদের পেলে নাকি রক্ষা নেই। কোথাও কোথাও নাকি অনেককে মুসলমানি দিয়ে ছেড়েছে। অগত্যা গ্রাম ছাড়তে হবে। ইতোমধ্যে অনেকে গ্রাম ছেড়ে চলেও গেছে। তাই ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা হতে হলো। একসাথে অনেকগুলো পরিবার। তার মধ্যে শৈলেনের পরিবার অর্থাৎ ক্ষীতিশ ও তার বউ তপতীও আছে, তিন তিনটি বাচ্চা নিয়ে, যে বাচ্চাগুলো খোজা। তপতীর পেট দেখে বুঝতে পারলাম আবার হবে। সে এই অবস্থায় বাড়ি ছেড়ে যেতে চায়নি, কিন্তু উপায় নেই। তপতী হাঁটতে পারছে না অথচ ক্ষীতিশ এক একবার ঝামটা মেরে বলছে, কী অইলো? নটীর পাও চলে না? তপতী কোনো উত্তর করে না। যতটা সম্ভব দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করে। এর মধ্যেই তার ব্যথা ওঠে। আমরা সবাই সাহায্যের হাত বাড়াই। পথের মধ্যে একটি পাকুড় গাছের নিচে তপতী একটি কন্যাসন্তান প্রসব করে। আমার মা খুব পরিশ্রম করে এই কন্যাটিকে পৃথিবীতে আনতে। সব দেখেশুনে আমার গা ঘিনঘিন করে। কিন্তু এখানে বসে থাকলে চলবে না। পথ চলতে হবে। ক্ষীতিশের মাথায় বোঝা, হাতে পোটলা। আমি কিছুটা মুক্ত, অত ভারী কিছু নেই। একসময় দেখা গেল, আমার কোলে চাপল তপতীর সদ্যজাত কন্যাটি। আবার গা ঘিনঘিন করে। মা-বাবাকে ফেলে মুক্তিযুদ্ধে যাবার কথাও ভাবিনি। উনিশের কাছাকাছি বয়সটা মুক্তিযুদ্ধে যাবার জন্য একেবারে অনুপোযুক্ত ছিল না। এই আক্ষেপটা অবশ্য সারাজীবনের।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এলাম। তপতী এলো বাড়তি একজনকে অর্থাৎ ভারতীকে সঙ্গে নিয়ে। সীমান্তের কাছে জন্ম নেয়ায় কন্যার নাম রাখা হয়েছে ভারতী। কিন্তু এবারও খুশি হতে পারল না শৈলেন। তার বংশে প্রদীপ জ্বালানোর লোক চাই। মেয়ে বিয়ে দিলে, সে এসে প্রদীপ জ্বালাতে পারবে না। ক্ষীতিশ স্বভাবসুলভ মুখে খামটি ঝাড়ে, প্রদীপ কি পাছায় জ্বালায়া রাখবা? হাগার সময় দেহা লাগবি পাতলা না শক্ত?
শৈলেনও কম যায় না। বলে, এমুন আচুদা ছাওয়াল জন্ম দিচি, যে শিবরাত্রির সলতে চেনে না।
এসব কথা বাতাসে ভেসে বেড়ায়। অনেকে বলে, তপতীর মতো একটা লক্ষ্মী বউ পেয়েছিল বলে এই সংসার করে গেল। ক্ষীতিশের মা অবশ্য মেয়ে পেয়েই খুশি। স্বাধীন দেশে আসার এক বছর পূর্তিও হলো না। তার আগেই আবার ক্ষীতিশের আরেকটা সন্তান হলো। এবারও খোজা। মেয়ে হওয়াতে সবাই একটা আশার আলো দেখতে পেয়েছিল। এমনকি তপতীও ভেবেছিল এবার একটি ছেলে নিশ্চয়ই হবে। কিন্তু সকলের সব আশা ভেঙে চূরমার করে দিয়ে পুনরায় ক্লীবলিঙ্গের উদয় হলো।
তখন আমি বাড়িতে নেই। ঢাকায়। মা-বাবাকে দেখতে মাঝে মাঝে বাড়ি যাই। কখনো দূর্গাপূজার ছুটিতে যাই। গ্রামের সাথে সম্পর্কের দূরত্ব বেড়ে গেল। ভালোবাসার জায়গাগুলি স্যাঁতসেতে হতে থাকল। প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজন অনেকেই ভারতে গিয়ে থিতু হতে থাকল। এমনকি জ্যাঠাও তার পরিবার নিয়ে চলে গেল। ভিটের অর্ধেক অংশ আমাকে কিনতে হলো। বাড়িতে সেমিপাকা একটি ঘরও তুললাম। মা-বাবা একটু সুখের মুখ দেখল। একদিন শুনলাম ক্ষীতিশ-তপতীরাও বাড়িঘর জমিজমা বিক্রি করে চলে গেছে। হয়ত সেখানে তারা সুখেই আছে। ইতোমধ্যে আমার মা-বাবাও পরলোকে। শেষ বয়সে আমার কাছে এনেছিলাম। বহুদিন পর আজ সবার কথা মনে পড়ছে। সব কথা মনে পড়ছে। একটি ভয়ঙ্কর পাপের কথা মনে পড়ছে। আমার বয়স এখন সত্তর পার হয়েছে। অনেক কিছুই ভুলে যাবার কথা। হয়ত ভুলেও ছিলাম। বাথরুমে পড়ে গিয়ে সমস্যাটা তৈরি হলো। আমি গরম জলে স্নান করি। বাথরুমে একটি কাঠের পিঁড়ি রাখি, সেটার উপর দাঁড়িয়ে স্নান করা অভ্যাস। কিন্তু এমনভাবে পিছলে পড়ে গেলাম, আমার লিঙ্গটা গিয়ে ছেঁচা খেলো পিঁড়ির সাথে। ওটাকে শক্ত করে ধরে চিৎকার দিলাম। ছুটে এলো নীলাক্ষি। ধরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। আমি ব্যথায় কাৎরাচ্ছি আর ভাবছি সেই প্রাপ্তবয়স্ক পাপটির কথা।
তপতী খপ করে আমার হাত ধরে কথাগুলো বলতে বলতে কেঁদে ফেললো। আমাকে সে বুকের সঙ্গে টেনে নিলো। আসলেই সে জ্বলন্ত মানুষ এবং জল দেওয়ার মানুষ খুঁজছিল। আমি ভয় পেলাম। সে জানালো, ভয়ের কিছু নেই, তার শাশুড়ি ৩ নম্বর খোজা ছেলেটাকে কোলে নিয়ে মাঠের দিকে গেছে। বাড়িতে তপতী ছাড়া কেউ নেই। আমি আরও ভয় পেলাম। সে বললো, বাবা তাপস, তুই ছাড়া আমারে কেউ বাঁচাতি পারবিন নে। আয় বাবা, কাছে আয়।
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, কাকি তুমি এইডা কী করতেছো? কিন্তু সে আমার মুখ চেপে ধরল। বাবা-বাবা বলে আমার মুখে মুখ ঘষতে লাগল। খুব সহজেই আমার লুঙ্গিটা খুলে ফেললো। তখন বুঝতে পারলাম শিবলিঙ্গের সঙ্গে এই লিঙ্গের কোনো মিল নেই। যে বিষয়টা আমি কোনোদিন ভাবিনি এখন সেটা করতে হচ্ছে। একটি আদর্শ ছেলে হিসাবে আমার সুনাম আছে। কিন্তু আমি অসহায়ের মতো তপতী কাকির প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে লাগলাম। এজন্যেই বোধ হয় ভারতীকে দেখে আমার গা ঘিনঘিন করেছিল। এক হিসেবে সে আমার বোন, অন্য হিসাব মানে খুব জটিল একটি অঙ্ক।
আরও পড়ুন: সাম্প্রতিক সাহিত্য