বাংলা সাহিত্যে এই সময়কালে রকিবুল হাসান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লেখক। উপন্যাস, ছোটগল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, গবেষণা সাহিত্য—সব ক্ষেত্রেই তার সরব উপস্থিতি। তিনি প্রায় দুদশক প্রবহমান নদীর মতো সহিত্যে গতিশীল রয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ অনেক সৃষ্টিকর্ম তিনি সম্পন্ন করেছেন। বাংলা সাহিত্যে সেগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। গতানুগতিক ধারায় তিনি না এগিয়ে নিজের স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করে তিনি বিশিষ্টতা প্রমাণ করেছেন। তার সাহিত্য জীবনঘনিষ্ঠ ও নীরীক্ষাধর্মী। স্বতন্ত্রবীক্ষণ ও নিরলস সাহিত্যচর্চায় ইতোমধ্যে তিনি বাংলা সাহিত্যে নিজস্ব স্থান করে নিয়েছেন।
সাহিত্যের বিচিত্র শাখায় বিচরণ করলেও সর্বত্রই তার কবিত্বের আবহ-আবেশ ফুটে ওঠে। রবীন্দ্রনাথের গল্পের মতো সমালোচকের দৃষ্টিতে তার উপন্যাস ও গল্প কবিতারই পর্যায়ভুক্ত। যদিও তিনি স্বীকার করেন চান যে, তিনি কবিতা দিয়ে উপন্যাস লিখেছেন। কারণ গল্প-উপন্যাসের প্রকরণরীতি মেনেই তিনি শিল্পটিকে উপস্থাপন করেন। তবু সব তর্ক উৎরে আমরা তাকে বহুমাত্রিক লেখক হিসেবে জানতে চাই।
রকিবুল হাসান উপন্যাস শিল্পে বিশেষ পারমাঙ্গতা প্রদর্শণে সক্ষম হয়েছেন। তার উপন্যাস জীবনের গভীরদর্শনকে মূর্ত করে তুলেছেন। একদিকে জীবনের আবেগময় জীবনের আলেখ্য, অন্যদিকে রূঢ় বাস্তবতা নির্মোহ রূপায়ণ তার উপন্যাসকে করেছে বিশেষায়িত সাহিত্যের পদবাচ্য।
রকিবুল হাসানের উপন্যাসে রূঢ় বাস্তবতার চিত্র যেমন প্রতিভাত, তেমনি প্রকরণরীতি ও আঙ্গিকে স্বতন্ত্র। জীবনকে এমন পর্যবেক্ষণ খুব কম শিল্পীর লেখায় দেখা মেলে। সহজ ও স্বাভাবিক জীবনধারায় কত যে পঙ্কিলতা অন্তর্বাস্তবতার অক্টোপাশের মতোন গেঁথে থাকে সেটা রকিবুল হাসানের উপন্যাস না পড়লে বোঝা যায় না। তার উল্লেখ্যযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে জীবন দিয়ে ভালোবাসি (১৯৯৯), এ কী তৃষ্ণা এ কী দাহ(২০০০), নবীরন (২০০৩), ভাঙন (২০০৬) ছায়াবন্দি (২০১১), অহনাবউ (২০১৪) অন্যতম।
রকিবুল হাসানের প্রতিটি উপন্যাস বিষয় ও প্রকরণে ভিন্ন ভিন্ন রীতির পরিচায়ক। তিনি প্রথাগত রীতিকে যেমন পরিহার করেছেন, তেমনি চলমান জীবনকে রূপায়ণে শিল্পকলার রূপান্তরের বিষয়টিও ইঙ্গিত করেছেন।
প্রসঙ্গত, ছায়াবন্দি রকিবুল হাসানের জনপ্রিয় উপন্যাসের মধ্যে অন্যতম। পুরুষশাসিত সমাজবাবস্থায় বিরুদ্ধ পরিবেশ একজন নারী কত অসহায় হতে পারে, তারই করুণালেখ্য এই উপন্যাস। ঔপন্যাসিক এতে সমাজবিশ্লেষণে মানুষের অন্তর্গত জীবনের অনেক গহিনে অবগাহন করেছেন।
উপন্যাসশিল্পে এত নিখুঁত চিত্রায়ণ ঔপন্যাসিককে দায়বদ্ধ শিল্পীর ভূমিকায় অবতীর্ণ করে। গ্রিক ট্র্যাজেডিতে আক্রান্ত কেন্দ্রীয় চরিত্র সেবন্তি শুধু বিরূপনিয়তীর মুখোমুখি হয় না, প্রচলিত সমাজব্যবস্থা যেন তার ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়। সমাজ ও বাষ্ট্রীয় জীবনে ক্ষমতা ও দাপুটে ক্যাডারবাহিনীর দৌরাত্ম্যে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রাই শুধু ব্যাহত হয় না, নারীরা সম্ভ্রম ও সতীত্ব হারিয়ে অবৈধ সন্তানের দায়ও যেন তার নিজের হয়ে যায়। উপন্যাসটির আখ্যানবিন্যাস লেখকই প্রেক্ষাপট নির্বাচণ করেছেন। প্রথম স্বামী তুর্যের মৃত্যুর পর শ্বশুর পরিবারের স্নেহবন্ধনের বেড়াজাল ও সামাজিক নিয়মের ফ্রেমে আবদ্ধ হয়ে দেবর সূর্যকে বিয়ে করতে হয় সেবন্তিকে। বিয়ের পর বড় হওয়ার স্বপ্ন দেখে সেবন্তি। শ্বশুরের দেওয়া টাকা দিয়ে সুপারস্টোর দোকান করে সেবন্তি। সূর্য দোকান চালাতে থাকে। এরই মধ্যে সৎমায়ের ভাই সমীরের লালসার শিকার হয় সেবন্তিকে।
পুলিশ ও রাজনৈতিক দলের ক্যাডারদের চাঁদা দিয়ে শেষ পর্যন্ত লোকসানের খাতায় ওঠে ব্যবসা। নিরুপায় সেবন্তি ব্যবসা চালিয়ে নেবার জন্য কিছু টাকার জন্য শরণাপন্ন হয় আবু তাহেরের। তাহের সুযোগ বুঝে তার সঙ্গে দৈহিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। এরই মধ্যে আমজাদ কমিশনার সেবন্তির দোকান গুঁড়িয়ে দেয়। শেষ পর্যন্ত টাকা ও লোন করে তো দেয়ই না উপরন্ত আবু তাহের সেবন্তির পেটে তার সন্তানকেও নিতে সে অস্বীকার করে। অনাগত সন্তানকে নিয়ে আবু তাহেরের কাছে দিয়ে বাঁচতে চাইলেও আবু তাহের তাকে বেশ্যা বলে গালি দেয়। মনোলোকে ক্ষতবিক্ষত সেবন্তি নিজকে জীবনঝড়ে নিজকে শক্ত রাখে; একসময় প্রতিবাদের পন্থা হিসেবে সে থানা অভিযোগ যাত্রা করে।
উপন্যাসের প্লটবিন্যাসে লেখক সমকালীন জীবনবাস্তবতাকে রূপায়ণে বদ্ধপরিকর। একদিকে নিয়তি-নির্ধারিত ভাগ্যবিড়ম্বনার টানাপড়েন অন্যদিকে পুরুষশাসিত সমাজের দাপট ও দৌরাত্ম্য; এই দুয়ের দোলাচলে ক্ষত-বিক্ষত হয় সেবন্তি নামক নারীর হৃদয়। উপন্যাসের কাহিনি সম্মুখগতি অভিমুখী। ঘটনা বর্ণনায় স্মৃতিচারণ পশ্চাৎগতিশীলতা নেই।
ছায়াবন্দি উপন্যাসে মুখ্য ও গৌণ উভয় প্রকারের চরিত্রের চিত্রায়ণ আছে। চরিত্রগুলো লেখকের সামগ্রিক জীবনভাবনায় চিত্রিত। একটি সমাজ ও রাষ্ট্রে বসবাসকারী অধিবাসী সেই দেশের সংস্কৃতির ধারাকে বহমান করে চলে। সমাজ ও রাষ্ট্রে অন্যায় অনাচার ব্যাভিচার হতে থাকলে সেগুলো চরিত্রে অনায়াসেই আরোপিত হয়। এই উপন্যাসে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্যে জেঁকে বসা ক্ষমতালিপ্সুদের যে দৌরাত্ম্য, সেটা টের পাই সেবন্তির সোনার সংসার ভাঙার মধ্য দিয়ে। চরিত্রগুলো লেখকের শিল্প অভিপ্রায় নিয়েই আবির্ভূত। প্রথমেই কেন্দ্রীয় চরিত্র সেবন্তির লেখকের চিত্রায়ণকৌশল বিশ্লেষণ করা যায়।
‘ছায়াবন্দি’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র সেবন্তি। তার মাধ্যমেই ঔপন্যাসিক অনুপুঙ্খ সময় ও সমাজ বিশ্লেষণে অন্তর্বাস্তবতা ও বহির্বাস্তবতা চিত্রায়ণ করেছেন। উপন্যাসের কাহিনি ও অন্য চরিত্রগুলো সেবন্তির মধ্য দিয়ে অগ্রে ধাবমান। চরিত্রগুলোর আগমন ও প্রস্থান তার জীবন ও রূপলাবণ্যের গুণে। বিরুদ্ধ পরিবেশে একাধিক পুরুষের লালসার শিকার হলেও জীবনসমৃদ্ধির জন্য সে স্বপ্নে বিভোর। প্রথম স্বামীর মৃত্যুর পারিবারিক চাপে দেবর সূর্যকে বিয়ে করে সে চিন্তা করে এভাবে গ্রামে থেকে কিছু করা যাবে না। সে উন্নতর জীবনভাবনায় সূর্যকে নিয়ে বড় স্বপ্ন দেখে। অর্থনৈতিক মুক্তি ও অভিজাত জীবনাকাঙ্ক্ষায় সে শহরের ব্যবসায় নামে। সুপারস্টোর চালু করে শহরে।
প্রসঙ্গত উদ্ধৃত করা যায়, শহরে নিজেদের জন্য একটা ঠিকানা বানানো খুব প্রয়োজন মনে করে সেবন্তি। শহরে স্বপ্ন আছে, স্বপ্ন নিয়ে সেখানো দৌড়ানো যায়। কিন্তু এখানে এ বাড়িতে থেকে কিচ্ছু হবে না। এখানে মানুষ ঠকানো ব্যবসা। (ছায়াবন্দি ২০১১: ৩৫)
সেবন্তির এই যে উন্নতর জীবনভাবনা, সময় ও সমাজের জাঁতাকলে এই সময় চুরমার হয়ে যায়। সে বাঁচতে চেয়েছিল অতি সাধারণভাবে। গ্রামীণ নীরব নিস্তরঙ্গ জীবনে তুর্ষ নিয়ে সে বাঁচতে চেয়েছিল, কিন্তু তার অকাল মৃত্যুই তাকে যেন হায়েনা রূপী লালসাপ্রবণ মানুষের ভোজ্য করে দেয়। স্বামীর মৃত্যুর সে সন্তান কথাকে নিয়েই বাঁচতে চেয়েছিল। পারিবারিক চাপ ও সামাজিকতায় দেবর সূর্যকে বিয়ে করে ঘর করতে হয় তাকে। পরে বাবার দ্বিতীয়পক্ষের ঘরের মামা সমীরের লালসার শিকার হতে হয় তাকে। পরবর্তী পর্যায়ে অর্থের আশায় আবু তাহেরের শরণাপন্ন হলেও সে তাকে ভোগ করে, কিন্তু কোনো দায়িত্ব গ্রহণ করে না। প্রথমত প্রেমের ভান করলেও পরবর্তী পর্যায়ে লালসা চরিতার্থই যে তার মূল উদ্দেশ্য ছিল, তার দায়িত্বহীন আচরণ এবং সম্পর্ক না রাখার ভেতর দিয়ে তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শেষ পর্যন্ত সেবন্তি শক্ত করে ধরে রাখে নিজেকে। কারণ সে জানে জীবনে টিকে থাকাটাই যুদ্ধ। আমজাদ কমিশনার তার সুপারস্টোর ভেঙে দিলেও সে টলে না। তাহের কেটে পড়লেও সে দুঃখ করে না। প্রতিবাদে সোচ্চার হয়।
প্রাসঙ্গিক অংশ উদ্ধৃত করা যাক, মুষলধারে বৃষ্টির মতো কান্না পায় সেবন্তির। কিন্তু চোখে মুখে একটু কান্নাও ফুটে উঠতে দেয় না, বুকের মধ্যে যেন সমুদ্রের ভয়াবহ ঢেউ। তবু নিজকে শক্ত করে ধরে রাখে। নিজেই নিজকে প্রশ্ন করে, আমজাদ কমিশনারের খুনের সঙ্গে কি তাহলে ও জড়িত। না কি খুনের পেছনের আসল মানুষটি ও নিজেই! ও আমাকে সেটিই ইঙ্গিত করে ওর ক্ষমতা বুঝাতে চাইলো! তাহলে ও কি কোনো গোপন বাহিনীর কেউ! ওর ভদ্রবেশ! ওর চাকরি! ভালোবাসার নাটক। এসব ডশ তাহলে ওর ছায়া! ছায়ার আড়ালে ও কি কোনো ভয়ঙ্কর কীট! প্রেমের নিখুঁত অভিনেতা, কল্যাণকামী মানুষের বেশ; এসব ওর লেবাস! ওর প্রকৃত পরিচয় তাহলে এ-ই! ভেতরে ভেতরে কেঁপে ওঠে সেবন্তি। তারপর নিজের ভেতরে সাহসটাকে শক্ত করে ধরে। রিকশাওয়ালকে রিকশা ঘুরিয়ে থানায় যেতে বলে সে!
মূলত সেবন্তিই লেখকের আরাধ্য চরিত্র। এই চরিত্রটির মধ্য দিয়ে ঔপন্যাসিক সমাজে ক্লেদাক্ত ও বীভৎসতার রূপ রূপায়ণের প্রয়াস পেয়েছেন। শিক্ষিত মানুষগুলোর বাহিরের চেহারা রূপ পরিশীলিত মার্জিত হলেও ভেতরে তাদের রূপ অন্য। সমাজের অভ্যন্তরে ঘটে যাওয়া এইসব অন্তর্গত ঘটনা যে কত অমানবিক ও পাশরিবক সেটা অনুভব করতে পারে সেবন্তি নামক অসহায় নারীরা। তবু সেবন্তিরা হারিয়ে যায় না। বাঁচার জন্য হাল শক্ত করে ধরে। মূলত জীবনযুদ্ধে হেরে যাওয়া সেবন্তির বেঁচে থাকার নিরন্তর চিত্রই ছায়াবন্দি উপন্যাস। এই উপন্যাসে সেবন্তিই কেন্দ্রীয় ও প্রধান চরিত্র।
সূর্য সহজ সরল একটি চরিত্র। গ্রামীণ জীবনে প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা স্বাভাবিক ও ভাবনাহীন একটি চরিত্র। বড়ভাই মারা গেলে বাবার আদেশে সে ভাবি সেবন্তিকে বিয়ে করতে রাজি হয়ে যায়। বিয়ে করে স্বাভাবিক জীবনযাপনও করে। তার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। মনে কোনো কুটিলতা ও জটিলতাও নেই। সে শুধু ভালোবাসতে জানে। মানুষকে অত্যন্ত বিশ্বাস করে সে। আবু তাহের দিনের পর দিন তার বাড়িতে এসে সেবন্তির সঙ্গে মেলামেলা করলেও তাহেরের ওপর বিশ্বাস হারায় না। সে তাহেরকে অকপটে বিশ্বাস করে। সূর্যের সরলতা ও প্রকৃতির মতোন স্বাভাবিক উদারতা সেবন্তির সঙ্গে বিয়ের পর তার সঙ্গে কথোপকথনে অনুভূত হয়। যেমন, ‘সত্যি করে কচ্চি, তোমাকে আমি বড় মানি। তুমি যা কবা আমি সব মাহ্নি চলবো। একটা কথা কই তোমাক, আব্বা যখন তোমার সাত আমার বিয়ের কথা কোই্ত, আমি মনে মনে কতাম, আব্বা একটা পাগল! ভাবী কাম পাইল না আমাক বিয়ে করবি। পাগলে কামড়াইচে। আরেকটা কথা কই তোমাক, তুমি যেদিন এই বাড়ি থেকে চইলি গেইলে সেদিন মাঠের ভেতর য্যায়া একা একা অনেক কাঁদিছিলাম। (ছায়াবন্দি, ২০১১: ৩৬)
এখানে রুচিরার সঙ্গে শোভনের প্রেম, সুস্মিতার সঙ্গে মিজানের প্রেম ও বিবাহ কাহিনিই পল্লবিত হয়ে উপন্যাসের পটভূমি নির্মাণ করেছে। এ উপন্যাসে সমগ্রজীবনভাবনা প্রতিভাত হলেও নারীর বিশেষ রূপ ফুটে উঠেছে শিল্পসুষমায়।
সূর্য সহজ সরল হলেও অন্যায় অনাচারে সে চরম প্রতিবাদী। সত্য কথা বলতে বাধে না তার। আমজাদ কমিশনার তার দোকান ভাঙতে উদ্যত হলে রাগে তার চোখ লাল হয়ে ওঠে। ঔপন্যাসিক এই চরিত্রটির মধ্য দিয়ে সমাজের বাস্তবচিত্র রূপায়ণ করেছেন। অসহায়ের মতো সেবন্তিকে বললো সূর্য, ‘পুলিশ-মাস্তানদের চাঁদা দেই। আমজাদ কমিশনারের লোকজনদের চাঁদা দিই। অনেক ছাত্রনেতাও চাঁদা নিয়ে যায়। আরও কতজন কত উছিলা করে চাঁদা নেয়। তবু একরকম সুপারস্টোরটা চাচ্ছিলাম। কমিশনারের লোকজনদের ভাবভঙ্গি তো আরো খারাপ মনে হচ্ছে। যেকোনো সুমায় সুপারস্টোর ভাঙি দিতে পারে। কী যে করি! কিছু তো বুঝে উঠতে পারতেছিনি। চোখ দুটো লাল হয়ে ওঠে সূর্যের।’(ছায়াবন্দি ২০১১: ৭৫)।
আবু তাহের চরিত্রটি কদর্য, কদাকার, নীতিভ্রষ্ট, কামুক ও নিপুণ খল। ভালোবাসার অভিনয় করে সে সেবন্তির হৃদয়ের মণিকোঠায় স্থান করে দেয়। তার কথা, আচার ও ভালোবাসা প্রয়োগের নিপুণশৈলীরূপে সেবন্তি বুঝে উঠতে পারে না এ ভালোবাসা মিথ্যে হতে পারে। প্রথমত আবু তাহের হৃদয়জ প্রেমের অভিনয় করে। হৃদয়ের স্থান নেওয়ার পর কামনার লালসায় ভাসিয়ে দেয় সেবন্তিকে। সেবন্তি প্রথমত তাদের মধ্যকার সম্পর্কটা মনোগত মনে করে অগ্রসর হয়। শেষের দিকে সুপারস্টোর ভেঙে যাওয়ার মধ্যে দিয়ে সেবন্তি যখন তার কাছে অর্থের দ্বারস্থ হয়, তখন আবু তাহেরের প্রকৃত রূপ বুঝতে পারে। আবু তাহেরের ভালোবাসার অভিনয় বোঝাতে তার চোখে পানি এনেছেন ঔপন্যাসিক। যেমন, ‘খপ করে সেবন্তির হাত ধরে আবু তাহের বললো, যা চলে গেছে তা নিয়ে দুঃখ করতে চাইনে। স্বামী সংসারের হিসেব তুমি আমাকে দিও না। আমি তোমাকে ভালোবাসি, তুমি আমাকে ভালোবাসবে। বলো, ভালোবাসবে কি না? … নিজের চোখের কোণে জমা পানি মুছে আবু তাহের বললো, তোমার জন্য আমি শুধু ওর কাছে কেন, দুনিয়ার সবার কাছে ছোট হতে পারি, তুমি নিজেও তা জানো না। (ছায়াবন্দি ২০১১: ৬১-৬২)
এই মনোজ প্রেম, ভালোবাসা, হৃদয় দিয়ে ভালোবাসাকে অনুভব করা, সেই প্রেমিক আবু তাহেরই সময়ের পরিক্রমায় তাকে শারীরিকভাবে পাবার বাসনা পূর্ণ হওয়ার পরে একসময় সেবন্তিকে বলে, ‘বেশ্যার আবার দেমাগ! অবজ্ঞার স্বরে বলে সিগারেট ধরায় আবু তাহের। জোরে একটা টান দিয়ে পুরো ধোঁয়া সেবন্তির মুখের ওপর ছাড়ে।’ (ছায়াবন্দি, ২০১১: ৯৫) তখন আমরা আবু তাহেরের লাম্পট্য বুঝে নিতে পারি। মূলত আবু তাহের চরিত্রের মাধ্যমে লেখক সমাজের অন্তর্গত চিত্র তুলে ধরেছেন। সমাজের বিত্তশালী, ক্ষমতাধর মানুষরা নারীদের কিভাবে ভোগ ও লালসার বস্তুতে পরিণত করে, সেটি বোঝাতে ঔপন্যাসিক আবু তাহেরকে নিমার্ণ করেছেন। আবু তাহের মূলত সমাজে ক্লেদাক্ত, কদর্য, ভোগবাদী পুরুষদের প্রতিনিধি।
আবু তাহেরের দেহাশ্রিত কামনাবাসনাপ্রবণ চরিত্র সমীর। সেও ভদ্রবেশধারী চরিত্র। সামজিকরীতি রেওয়াজের তোয়াক্কা না করে ধর্মের অনুশাসন না মেনে সে শুধু দেহটাই বোঝে। রুনুর বিয়েতে সুযোগ বুঝে বিধবা সেবন্তিকে ভোগ করে সে। এই চরিত্রও কুৎসিত কদাকার। ঔপন্যাসিক এই চরিত্র নির্মাণে ফ্রয়েডিও মনোবিকলনতত্ত্ব প্রয়োগ করেছেন। এই চরিত্রের সাদৃশ্যে আমজাদ কমিশনার চরিত্রটি নির্মিত। তবে ঔপন্যাসিক এই আলো-আঁধারী ছায়ার নির্মাণ করেছেন। আমজাদ কমিশনারে বিস্তৃত পরিচয় উপন্যাসে নেই। তবে ক্ষমতাসীনদলের সার্থক প্রতিনিধি বলে আমরা আভাস পাই। সে খুন খারাবি, চাঁদা উত্তোলন, নারীহরণ প্রভৃতি নেতিবাচক কাজে জড়িত। সে একসময় খুন হয়। এই খুনের পেছনে আবু তাহেরকে সন্দেহের আভাসও ঔপন্যাসিক সেবন্তির স্বগত-উক্তিতে ব্যক্ত করেছেন। মূলত এই চরিত্রগুলো সমাজের বন্ধ্রে রন্ধ্রে বাস করে। ঔপন্যাসিক সমাজের রূঢ় বাস্তবতা রূপায়ণ করতে এদের আমদানি করেছেন।
এই উপন্যাসে আরও যেসব চরিত্রের সন্ধান পাইম, তার মধ্যে সূর্যের বাবা হোসেন আলী, মা আমিরুন্নেসা সেবন্তির বাবা আবদুর রশীদ, সূর্যের বন্ধু হেলাল, দেবু, রুনু প্রভৃতি অন্যতম। এসব চরিত্র উপন্যাসের ঘটনাগ্রন্থনে সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। সূর্যের বাবা চরিত্রটি স্নেহমমতার চেয়ে স্বার্থবাদী ও জীবনমুখী। আবদুর রশীদটি সহজ-সরল। ঔপন্যাসিক চরিত্রায়ণে বিষয়ানুসারী ঘটনাগ্রন্থনে সহায়কদের নির্বাচন করেছেন।
ছায়াবন্দি উপন্যাসের ভাষা প্রমিত বাংলা। তবে চরিত্রের সংলাপে স্থানিক ভাষার সংলাপ দেখা যায়। এটা লেখকের জন্মস্থান কুষ্টিয়ার স্থানিক ভাষা। বিশেষ করে সূর্যের সংলাপে ও কাজের বুয়ার উক্তিতে ভাষার স্থানিকতা প্রভাব আছে। অন্যসব স্থানে ও ঔপন্যাসিকের বর্ণনায় ভাষা প্রমিত চলিত রীতির। স্থানিকজীবনবোধ রূপায়ণের ঔপন্যাসিক এই স্থানিকতার আশ্রয় নিয়েছেন অন্যদিকে ভাষার লালিত্য ফোটাতে লেখক কাব্যিকতার আশ্রয় নিয়েছেন।
‘নবীরন’ গ্রামীণ জীবনচেতনাভিত্তিক উপন্যাস। এই উপন্যাসে লেখক প্রান্তিক জীবনালেখ্য রূপায়ণের সমান্তরালে নারীচরিত্রের রহস্যলোকের যেমন সন্ধান করেছেন, তেমনি সমাজের উঁচুশ্রেণির মানুষের চরিত্রাঙ্কন করেছেন নির্মোহ নিরাসক্ত দৃষ্টিতে। প্রকৃতির মতো অত্যন্ত সহজ সরল আকুমিয়া নবীরনকে পেয়ে কুঁড়েঘরে স্বর্গের সন্ধান পায়, কিন্তু কামুক লম্পটদের লোলুপতা ও নরীরনের উচ্চাশা সে স্বর্গঘরকে ধূলায় লুটায়। দেহ ব্যবসায়ী চক্রের হাতে পড়ে লাল জব্বারের মাধ্যমে ছাড়া পেয়ে গ্রামে স্বামীর ঘরে ফিরলেও আকুমিয়া মনোলোক হয় ক্ষতবিক্ষত। গ্রাম-মেম্বার জয়নাল তার বিচার করতে এলেও সে ঘরের খুঁটি শক্ত করে ধরে থাকে। ঔপন্যাসিক এই ঘরের খুঁটি শক্ত করে ধরার মধ্য দিয়ে নারীচেতনার জানান দিলেও নবীরন চরিত্রটি রহস্যাবৃত্তই থেকে যায়। এই দ্বৈতচেতনায় পর্যবেশিত। এই চরিত্রাঙ্কনে লেখকের সাংঘর্ষিক মনোভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়।
‘জীবন দিয়ে ভালোবাসি’ ও ‘এ কী তৃষ্ণা এ কী দাহ’ উপন্যাস দুটিতে লেখকের জীবনচেতনার গভীরতার ইঙ্গিত বহন করে।
প্রথম উপন্যাস হিসেবে প্রকরণরীতিতে ও কাহিনিবিন্যাসে যে দুর্বলতা স্বাভাবিক থাকার কথা সেটা এই উপন্যাসে ঘটেনি। ‘এ কী তৃষ্ণা এ কী দাহ’ উপন্যাসে লেখক জীবনতৃষ্ণাকেই ইঙ্গিত করেন। জীবনের দাহকেই তিনি রূপায়ণ করতে চান।
রকিবুল হাসানের ‘ভাঙন’ সামগ্রিক জীবনভাবনামূলক উপন্যাস। তিনি সমগ্রজীবনকেই উপন্যাসে ধরতে চান। আমরা জানি উপন্যাসে জীবনই প্রতিবিম্বিত হয়। তবু ঔপন্যাসিক বিশেষ কোনো দিক ফুটিয়ে তোলার দিকেই দৃষ্টি দেন। এখানে লেখকের বিশেষ কোনো দিক প্রতিভাত হয় না। তিনি সময় ও সমাজ বাস্তবতায় সমগ্রজীবনকেই অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করতে চান। সে বিশ্লেষণে ঔপন্যাসিক অনিবার্যভাবে জীবনবাদী শিল্পীর ভূমিকায় অবতীর্ণ। তাই দেখি তার সৃজ্য নরনারীর অনিবার্য মিলনে কোনো পাপবোধ নেই। তারা ফুটন্ত ফুলের মতোন কিংবা বহমান নদীর অনিবার্য এক আর্কষণে বহে চলে। আলোচ্য উপন্যাসে কয়েকটি প্রেমের ঘটনা আছে। প্রেমগুলো এক পক্ষীয় ও উভয়পক্ষীয়। ‘ভাঙন’-এ ত্রিভূজ প্রেমের কাহিনি থাকলেও লেখক চতুর্ভূজীয় পন্থা অবলম্বন করেছে। অধ্যাপক সৈকত চোধুরী সুস্মিতা ও রুচিরাকে ভালোবাসলেও ওটা আসলে প্রেম নয়, দেহাশ্রিত কামনাবাসনার লিবিডোজাত অনুষঙ্গ। এখানে রুচিরার সঙ্গে শোভনের প্রেম, সুস্মিতার সঙ্গে মিজানের প্রেম ও বিবাহ কাহিনিই পল্লবিত হয়ে উপন্যাসের পটভূমি নির্মাণ করেছে। এ উপন্যাসে সমগ্রজীবনভাবনা প্রতিভাত হলেও নারীর বিশেষ রূপ ফুটে উঠেছে শিল্পসুষমায়।
অতি-আধুনিকযুগের পাদমূলে এই উপন্যাসের নারীরা শুধু শিক্ষিতই নয়, তারা রীতিমত স্বাবলম্বী, দ্রোহী, চিরায়ত সমাজব্যবস্থার ঘোর বিরোধী। এখানে নারীর বিদুষিণী রূপের পাশাপাশি নান্দনিকরূপ ও রিরংসার অনুগামী রূপও প্রতিভাত হয়। ঔপন্যাসিক যুগপ্রভাবকে তিলমাত্র অস্বীকার করেননি। তাই দেখা যায় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈকত চৌধুরির লাম্পট্যচিত্র ঔপন্যাসিক অবলীলায় বর্ণনা করেছেন। অপরদিকে শোভনের মামী ঋতুর ভালোবাসার চিত্র প্রকাশ করে দিতেও যেমন তার বাধে না, তেমনি বাংলার লোকসংস্কৃতি রাধাকৃষ্ণের প্রেমের অনুষঙ্গে মামী ভাগ্নের প্রেমের বিষয়টিও প্রকাশ না করে ছাড়েন না। এ প্রসঙ্গে লেখক সমাজবাস্তবতার চিত্র আঁকতে অসম দাম্পত্য বিষয়টি তুলে ধরেন। ঋতুর উক্তিতে তা পরিষ্কার হয়, ‘আমার অনিচ্ছাসত্ত্বেও দ্বিগুণ বয়সী একটা লোকের সঙ্গে যে বিয়ে হলো; এটা পাপ নয়? বিয়ে করা স্ত্রীকে বছরের পর বছর ফেলে বিদেশ বিভূঁইয়ে পড়ে থাকা তা কি পাপ নয়? আমার সুন্দর ইচ্ছেগুলোর যে অপমৃত্যু হলো; তা পাপ নয়? এত পাপের ভেতর আমি যদি আমার কাঙ্ক্ষিত কোনো পুরুষের বুকের ভেতর নিজের মন শরীর সর্বস্ব সমর্পণ করি, তা কি খুব বেশি পাপ হবে? আমি এটুকু পাপ করলে কি খুব বেশি ক্ষতি হবে পৃথিবীর? (ভাঙন, ২০১৪: ৪৩)।
এখানে অসম দাম্পত্য-সংকটের পাশাপাশি নারীর চিরন্তন ভালোবাসার মধ্যে শাশ্বত নারীরূপের প্রকাশ ঘটেছে। আবার নারী পুরুষের সম্পর্কটা সামাজিক রীতিনীতি দিয়ে চালিয়ে নিতে চাইলেও ওটা পুরুষকর্তৃক সৃষ্ট নারীদের ওপর চাপিয়ে নিয়ম বলে সালেহার দ্রোহরূপও প্রণিধানযোগ্য, ‘এ সমাজ তো তোমাদের মতোন পুরুষরা তৈরি করেছে বলেই সালেহা খাতুন বিছানা থেকে উঠে শরীরের কাপড় ঠিক করতে করতে আবার বললেন, তোমরা তোমাদের সুবিধার্থে সমাজ তৈরি করো, সমাজের নিয়ম তৈরি করো। দ্যাখো, একদিন তোমাদের উদ্ভট নিয়ম গড়া সমাজ ভেঙেচুরে খান খান হয়ে যাবে।’ (ভাঙন, ২০১৪; ১২৯)।
সাম্প্রতিক সাহিত্য রচনায় যে সরলতা ও পাঠকরঞ্জনের সস্তা ধারা চলছে তা থেকে রকিবুল হাসান অনেক দূরে। তিনি গড়াই নদীর পলিমাখা সাহিত্যবালক; নদীর দুকূল উপচেপড়া আবেগ নিয়ে তিনি শুধু কাহিনিকথক নন, নদীর মতোন জীবনকূলের নানা রঙ ও সঙের সমন্বয়ে তিনি রূঢ়বাস্তবতারই রূপকার।
এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্র রুচিরা। তাকে ঘিরেই উপন্যাসের ঘটনা আবর্তিত হয়েছে। সপ্তম শ্রেণিতে পড়ার সময় বাবার মুত্যু হয় রুচিরার। তারপর বিরুদ্ধ ও প্রতিকূল পরিবেশে সে লেখাপড়া চালিয়ে নেয়। লেখাপড়ার পাঠ চুকিয়ে কলেজের অধ্যাপনার চাকরি নেয় রুচিরা। এখানে রুচিরা বিরুদ্ধ ও দুঃখ, দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে শুধু শিক্ষিতাই হয় না; চাকরি নিয়ে সে স্বাবলম্বীও হয়। এখানে আধুনিকা নারীর রূপ ও স্বরূপ প্রকাশিত হয়েছে। এ উপন্যাসে শুধু নারীর দ্রোহ ও শিক্ষিতা ও স্বাবলম্বী রূপের সমান্তরালে নান্দনিক রূপটিও কাব্যময় অনুষঙ্গে প্রকাশিত হয়েছে। ঔপন্যাসিকের কবিমন এখানে নারীর সৌন্দর্যরূপের অনুপুঙ্খ বর্ণনা প্রসঙ্গ উল্লেখ্য, ‘অদ্ভূত সুন্দর কণ্ঠ! এক সুন্দর চেহারা! যেন সদ্য প্রস্ফূটিত লাল টকটকে সুস্বাস্থ্যবতী একটি গোলাপ। অথচ কত ভদ্র, কত বিনয়; নদীর শান্ত স্রোতের মতো। এই মেয়েটির কাছে তমাকে দাঁড় করিয়ে দিলে তমার অহঙ্কার এক মুহূর্তে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে।’ (ভাঙন, ২০১৪: ১০)।
এখানে উপন্যাসে নারীকে আবার স্বৈরিণী হিসেবে অঙ্কন করা হয়েছে। সম্ভবত যুগপ্রভাবকে লেখক এড়াতে চাননি। তাই তমা চৌধুরির সঙ্গে সৈকত চৌধুরির দাম্পত্য-সংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। এই দাম্পত্যসংকটের পাশাপাশি আমরা উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তের মধ্যকার ভেদটাও অবলোকন করি। লেখক অবশ্য তমার আভিজাত্যবোধকে দাম্পত্যসংকটের কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছেন, সেই সঙ্গে পরপুরুষের সঙ্গটা অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা গেছে। মূলত অতিআধুনিক যুগে উচ্চবিত্তের উচ্ছৃঙ্খলতাকে ঔপন্যাসিক এখানে ইঙ্গিত করেছেন।
ভাঙন উপন্যাসটিতে সামগ্রিক জীবনভাবনা প্রকাশিত হলেও গ্রেনেড হামলায় শোভনের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে লেখক জাতিসত্তার গভীরে প্রোথিত চেতনার কথা বলতে চান। ভালোবাসার মানবীর ভেতর নিজের ঔরশজাত সন্তানকে উপহার দিয়ে শোভন যখন বিবাহপূর্ববর্তী সময়ে গ্রেনেড হামলায় মৃত্যুবরণ করে, তখন রুচিরার আসন্ন উত্তরাধিকার নিয়ে আমরা ভাবনায় পড়ে যাই। এই সন্তানের উত্তরাধিকার নিয়ে আমাদের ভাবনার সমাধান টানা হয় না। একটা অমিমাংসিত সূত্র মেনে উপন্যাসের রসনিষ্পত্তি করতে হয়। এখানে সন্তানসম্ভবা নারীর অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে রূপকের অন্তরালে মুক্তিযুদ্ধেল চেতনাহীন বাঙালির বাঙালিসত্তার বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে। এ উপন্যাসের সমান্তরালে শওকত আলীর দক্ষিণায়নের দিন রচিত। উপন্যাসের নায়িক রোকেয়া আহমেদ রাখি যেমন সেজানের সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে তাকে রক্তাক্ত রাজপথের গল্প শোনায়, তেমনি রুচিরা শোভনের সন্তান পেটে ধারণ করে তার ভালোবাসার মানুষটির স্বপ্ন দেখে। কখন আসবে শোভন সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে তাকে ঘরে তুলবে।
‘অহনা বউ’ রকিুবল হাসানের কাব্যধর্মী উপন্যাস। রবি ঠাকুরের শেষের কবিতা ও বুদ্ধদেব বসুর তিথিডোরের মতো এতে কাব্যময় ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রেম ও কামের সূত্র উল্লেখে এক অমিমাংসিত প্রশ্ন রেখে উপন্যাসের সমাপ্তি টানা হয়েছে। পুরো উপন্যাসে ত্রিভূজ প্রেমের গঠনে একে অপরের পাবার ও পাওয়ার আকাঙ্ক্ষার মধ্য দিয়ে শেষ করা হয়েছে। দাম্পত্য সুখ-বর্জিত শারমিন ও অহনা উভয়ে আবিরকে ভালোবাসে। ভালোবেসে অহনা আবিরকে পায়। শারমিন পাওয়ার জন্য নানা ফন্দি আঁকে। কিন্তু অবশেষে তার পাওয়া হয়ে ওঠে না। ফলে সে ক্ষোভে রাগে অহনা-আবিরের মিলনের গোপণ ভিডিও মালয়েশিয়া প্রবাসি অহনার স্বামী জাহিদের কাছে পাঠায়। জাহিদ দেশে এসে ঘটনা প্রত্যেক্ষণে ভালোবাসার শাশ্বত মানবী নগ্নতার চরমতম দৃশ্য প্রত্যেক্ষ করে ক্ষোভে দুঃখে ট্রেনে কাটা পড়ে আত্মহত্যা করে। লেখক উপন্যাসের প্রারম্ভ থেকে দেহাশ্রিত কামনা-বাসনার উল্লেখে হালকা চটুল ঘটনার অবতারণে শৃঙ্গার রসের আমদানী করলেও তার অভিপ্রায় ছিল সুদূর প্রসারী। ভালোবাসা ও প্রেমের জন্য দেহটাই মুখ্য না মনটা? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজেন তিনি সারা উপন্যাসজুড়ে। উপন্যাসের পুরোটা সময় দেহ ও দৈহিক সৌন্দর্যকে পরম জ্ঞান করে তার সৃজিত পাত্রপাত্রিদের অভিনয় প্রত্যেক্ষ করি। এই অভিনয় মূলত প্রযুক্তিযুগের সমাজবাস্তবতার বাস্তব অথচ নগ্নতার ছাপচিত্র। উপন্যাসের গভীর ও গভীরতর স্তরে প্রবেশ না করে আমরা যদি নদীর স্রোতের ভাসমান দৃশ্য অবলোকন করি তাহলে দেখতে পাই নারীর বাহ্যিক নান্দনিক রূপ। উল্লেখ্য, ‘অহনা যেন আবিরের এক পুরনো দুপুর। বিকেলের মেঘে লাল শাড়ি পরে ওড়ে। যেন নীল পরি। অষ্টাদশী। কাঁচা পানিতে উপচে ওঠা নবযৌবনা গড়াই নদী যেন। দুচোখে সুখ বুনে জেগে থাকা স্বর্ণআলো ছড়ানো ফসলের মাঠ।’ (অহনা বউ, ২০১৪ : ১০)।
আবার আধুনিকা শিক্ষিতা ও প্রথার প্রাচীর ভেঙ্গে বাইরে বেরিয়ে আসা নারীর রূপও অনায়াসে দেখা যায়। লেখকের যুগচেতনা প্রণিধানযোগ্য :
‘এখন তো মেয়েরা অনেক স্বাধীন। লেখাপড়া শিখছে। চাকরি করছে। নিজেদের ভালো-খারাপ বুঝতে পারছে। এখন তো স্বামীর কথায় উঠবস কিংবা তার খুশিতেই সব কর্ম নাও করতে পারে। অনেক মেয়েই তো এ বৃত্ত ভেঙ্গে বের হয়ে আসছে।’ (অহনা বউ, ২০১৪ : ২৪)
আবার কাব্যময় ভাষায় কামনাগন্ধি নারীর রূপ কবিতার সুঘ্রাণের মতোন সুবাস ছড়ায় হৃদয়ের ছত্রে ছত্রে। ঔপন্যাসিক সাবলীল গদ্যভাষায় অহনার দেহিক যে বর্ণনা দেন তা যেন কবিতারই বেলিফুল। প্রসঙ্গত, ‘বেলিফুলের মতো অহনার শুভ্র-সুগন্ধি শরীর আবির দুবাহুল মুগ্ধবেষ্টনীতে টেনে নেয়। ঢেউ নদীর ভরাট বুকের মতো আবিরের বুকে এক নদী সুখ হয়ে লেগে থাকে অহনা। রঙধনুসুখ আবিরের বুকের গহিনে রঙিন হয়ে ওঠে। আবির ওকে আরো গভীরভাবে বুকের ভেতর টেনে নেয়। তার সমস্ত শরীর সুঘ্রাণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে আবিরের শরীর। পাপড়ি খুলে পড়া সুবাসিত সুগ্ধগোলাপ রমণী হয়ে ওঠে অহনা। আবির মুগ্ধ হয়ে ভাবে অহনার কাঁচাহলুদী শরীরে এক রূপ! এতো লাবণ্য। এত সৌন্দর্য! (অহনা বউ, ২০১৪ : ৫১)
সন্দেহ নেই এখানে আবির ও অহনার যে রূপস আর ঘ্রাণের কথা বলা হয়েছে তা দৈহিক সৌন্দর্যের। প্রেম তো সুন্দরের প্রকাশ। সে প্রকাশ প্রকৃতির সর্বত্র। কী নারী, কী পুরুষ, কী স্বর্ণলতা কিন্তু এই সৌন্দর্যসন্ধান করতে দেহের আবেদন যেমন সত্য তেমনি সত্য মন। মনহীন সৌন্দর্য কত আরাধ্য তাও দেখার বিষয়। প্রসঙ্গত নিম্নোক্ত উদ্ধৃতি বিশ্লেষণ করলে এটাকে প্রেম না কাম বলা শ্রেয়?
‘না, তুমি যাবে না। বলেই আবিরের সামনে এসে দাঁড়ায় শারমিন। তারপর ফুঁসতে ফুঁসতে একটান দিয়ে নিজের গা থেকে ব্লাউজ ছিঁড়ে ফেলে সে। রুদ্রমূর্তিতে যেন সে বললো নিজের ভালো চাও তো আমি যা বলছি তা শোনো। তোমার জীবন আমি বরবাদ করে দেব। আবির সাহেব, তোমার জীবন কিন্তু আমার কাছে বাঁধা হয়ে গেছে।’ (অহনা বউ ২০১৪ : ৮৩)
উল্লিখিত উদ্ধৃতিতে আর যাই হোক প্রেমের নান্দনিক রূপ নেই। এখানে স্বভাবতই নারীর নগ্নরূপ প্রত্যেক্ষ করা যায। বলাবাহুল্য ঔপন্যাসিক প্রযুক্তিযুগের কথিত শিক্ষিত ও আভিজাত্য প্রদর্শনকারী নারীর রূপায়ণ করতে গিয়ে আলোচ্য অনুষঙ্গ টেনেছেন।
‘অহনা বউ’ উপন্যাসে নারীর রূপ শুধু রোমান্টিসিজমে নয়, লিবিডো ভাবনার সর্বশেষ স্তরে পৌঁছে গেছে এর কামনাবাসনার অনুষঙ্গগুলো। তাই দেখা যায়, যুগবাস্তবতার প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র শারমিন শুধু নিজ ব্লাউজটি খুলে ছুড়ে মারেনি, আবিরকে পাওয়ার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছে। এই অনুষঙ্গের প্রেক্ষাপটে দেখা যায় প্রযুক্তিযুগে দেহাশ্রিত কামনাবাসনার উলঙ্গ প্রকাশ ঘটেছে আলোচ্য উপন্যাসে। ফলে দেখা গেছে দাম্পত্যজীবনে প্রেমের গহীনে প্রবেশ না করে অহনা বাহ্যিক সুন্দরকেই আঁকড়ে ধরেছে। ত্রিভূজ প্রেমের আলেখ্যে আবিরকে অহনা পেলেও শারমিন তাকে পায় না। এই পাওয়ার আগুনে জ্বলেপুড়ে সে গোপন ভিডিও প্রকাশ করে দেয়। এখানে আবির, অহনা ও শারমিন প্রেমকে শাসন করতে চেয়েছে দেহ দিয়ে। পক্ষান্তরে জাহিদ প্রেমকে হৃদয় দিয়ে ধারণ করেছে। অহনার প্রতি অগাধ বিশ্বাস ছিল জাহিদের। তাই দেখি বিদেশ বিভূঁইয়ে সে অহনা প্রতি তুমুল বিশ্বাসী ছিল, শারমিন সেই গোপন ভিডিও তাকে অবিশ্বাসে পঙ্কিলে নিমজ্জিত করায়। ঔপন্যাসিক এখানে বলতে চান, দেহহীন প্রেম পানসে আবার দেহযুক্ত প্রেম পঙ্কিল। এখানে রবি ঠাকুরের ‘নিষ্ফল আবেদন’ কবিতার এক্সপেরিমেন্টের একটা অনুষঙ্গ প্রকট আকার ধারণ করেছে বলে প্রতিভাত হয়। অবশেষে ঔপন্যাসিক হৃদয়ের শাশ্বত নিবাসই প্রেমের আবাস বলে উপন্যাসের ইতি টানেন, এবং জাহিদের আত্মহত্যার মধ্য দিয়ে জানান দেন, প্রেম দেহে নয়, বাস করে হৃদয়ের গহীন থেকে গহীনতর স্তরে। উপন্যাসের শেষপাদে জীবনানন্দ দাশের কবিতার উদ্ধৃতি উল্লেখে দেখা যায়, এখানে তার ব্যক্তিজীবনের ঘটনার রেখাপাত আছে। জীবনানন্দ দাশ নিজেও ট্রামে কাটা পড়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। এবং তার স্ত্রী লাবণ্যদাশ গুপ্তও দেহাশ্রিত কামনাবাসনাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। মূলত অতিআধুনিক যুগে নারী শিক্ষায়, মেধায়, মননে, যোগ্যতায়, দ্রোহে, স্বাধিকার ও স্বাবলম্বী, স্বাধীনতাকামিনী রূপে আবির্ভূত হলেও কথিত শিক্ষিতারা পাশ্চাত্যদার্শের অনুষঙ্গে নগ্নরূপ নিয়ে অবতীর্ণ। ফলে বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় দাম্পত্যসংকটই শুধু নয় বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা হরহামেশা ঘটতে দেখা যাচ্ছে।
উপর্যুক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে দেখা যায়, রকিবুল হাসানের সাহিত্যক্ষেত্র বিশেষ ও স্বতন্ত্ররীতির। উপন্যাসে তিনি শুধু ঘটনা বর্ণনা করেন না, ঘটনার সঙ্গে একীভূত সমাজ ও জীবনকে যেভাবে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেন, তাতে জীবন নামক যে মহাসমূদ্র তার তল খুঁজে পাওয়া না গেলেও তিনি সেই অতল জীবনের রহস্য উন্মেচনে বদ্ধপরিকর। সাম্প্রতিক সাহিত্য রচনায় যে সরলতা ও পাঠকরঞ্জনের সস্তা ধারা চলছে তা থেকে রকিবুল হাসান অনেক দূরে। তিনি গড়াই নদীর পলিমাখা সাহিত্যবালক; নদীর দুকূল উপচেপড়া আবেগ নিয়ে তিনি শুধু কাহিনিকথক নন, নদীর মতোন জীবনকূলের নানা রঙ ও সঙের সমন্বয়ে তিনি রূঢ়বাস্তবতারই রূপকার।
আরও পড়ুন: ফারুক সুমনের প্রবন্ধ: কাব্যগন্ধী আনন্দফুল ॥ গোলাম সবুর