সমাজের প্রচল ধারায় কিছু পথ ও মত ভিন্ন হয়। কঠিন এই পথ। এই কঠিন পথের মাঝেই বিবেকবোধের সম্পূর্ণ-দায় নিয়ে, হাতেগোনা কয়েকজন শিল্পী ও চিন্তক সম্প্রদায় তৈরি হয়। যাদের দৃষ্টি—নিছক কোনো শিল্পের ভাঁড়ামো করা নয়। দায়বোধের আরও বেশি কিছু। তারা কাল-গভীরতার ভেতরে ডুব দিয়ে ছেনে আনার চেষ্টা করেন মণি মুক্তাসম সম্ভাবনার আকর সম্ভার। ‘আর্টস ফর আর্টস শেক’- এর নিছক দায়কে তারা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান।আর দেখিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন, মুদ্রার শুধু একটি তরল পিঠের—ঝলক মারা শিল্প কখনো শেষ পর্যন্ত কালের সীমাকে অতিক্রম করতে পারে না। দায়বদ্ধতায় সমর্পিত এমন শিল্পী, বিবেকের কাছে নিজেকে বন্ধক রাখেন—উঁচুতর শিল্পের ফসল যেমন ঘরে তোলেন; তেমনি সমসাময়িক বিষয়ের কোনো চন্দ্রবিন্দুও তাদের চোখ এড়িয়ে যায় না—সময়কে ছেনে-ভেঙে, তারা হয়ে ওঠেন কালের কথক—কবি। মোহাম্মদ নূরুল হক সেই দায়বোধ মাথায় নিয়ে নিজেকে সম্প্রদানে সচল ও সক্রিয় রাখছেন।
মোহাম্মদ নূরুল হক সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কবি ও চিন্তক। যিনি কবিতা ও কলামের পাশাপাশি প্রবন্ধ রচনার জায়গাকে সমৃদ্ধ করছেন। চিন্তার প্রতি ছত্রে, অনিয়ম ও অনৈতিকতার বিরুদ্ধে যৌক্তিকভাবে আঙুল যেমন তুলছেন, তেমনি সাহিত্যসহ সমাজের বিবিধ শাখার শিল্প ও শিল্পীর নানা সৃজন প্রক্রিয়াকে গদ্যে-প্রবন্ধে (সারমর্মসহ তার ইতিবাচক স্বকীয় মতাদর্শ ও সীমাবদ্ধতাও) তুলে ধরার প্রয়াস পেয়েছেন। চিন্তায় তিনি নতুন কিছু ভাবনা-জিজ্ঞাসাকে উসকে দিয়েছেন, যা প্রবন্ধ সাহিত্যকে অনেক ঋদ্ধ ও দূরদর্শী (চলমান) করেছে।
এই প্রবন্ধে মোহাম্মদ নূরুল হকের লেখালেখির বৈচিত্র্য, তার লেখক-মানসের সম্ভাবনা ও সাহসী প্রবণতার ৩টি দিক উন্মোচনের চেষ্টা হয়েছে। এগুলো হলো—এক. ‘শিল্পী ও শিল্পযোগ’। দুই. ‘শিল্প: যুক্তির শৃঙ্খলা ও দায়বোধ’। তিন. ‘সমকাল ও সচেতনার দায়’। এই তিন প্রতীতিতে তার প্রবন্ধবিচারের চেষ্টা করবো।
শিল্পী ও শিল্পযোগ
ইউরোপীয় সাহিত্যের কাঠামোর ভেতর থেকে যে শিল্পীরা বাংলা সাহিত্যে মহান হয়ে আছেন, তার মধ্যে পঞ্চপাণ্ডবের দুই জন—সুধীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ উল্লেখযোগ্য বড় আসন ধরে রেখেছেন; পঞ্চাশের শামসুর রাহমান, আল মাহমুদসহ ইউরোপীয় সাহিত্যের কাঠামোর ভেতরে থেকেই শিল্পপ্রকাশে অনেকে নিজস্বতা এনেছেন। কেউ কাঠামোগত ও প্রকরণে, তারই অনুগামী হয়েও হেঁটেছেন অনেকটা স্বতন্ত্রভাবে। কেউ দেশ ভাবনায় হয়েছেন রাষ্ট্রের নানা অনাচারের শিল্পীত সাক্ষী; কেউ নিজের ভূমিলগ্ন বিষয় আশয়ে, প্রকাশের স্বতন্ত্র দৃষ্টিভঙ্গিকে আশ্রয় করেছেন।
মোহাম্মদ নূরুল হক স্বকীয় দৃষ্টিভঙ্গির আলোকে—বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদী লেখক শিল্পীসহ সময়ের অন্যতম প্রতিনিধিত্বকারী শিল্পীদের নিয়ে যেমন কাজ করেছেন; তেমনি দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্রের মৌলিক (সমূহ) বিষয়ের প্রতিনিধিত্বকারী প্রজ্ঞাবান শিল্পী-মনীষী নিয়েও ভেবেছেন। এক্ষেত্রে কবি, লেখক ও শিল্পী-মনীষা নিয়ে তার প্রবন্ধ থেকে কিছু উল্লেখযোগ্য অংশের উদ্ধৃতি দিয়ে বাকি প্রবন্ধ-সম্পর্কের পরিচয়-সংক্ষেপ তুলে ধরার চেষ্টা করবো।
জীবনানন্দ। বাংলা সাহিত্যে জীবনানন্দ মানে একটি ঘোর। একটি বিশাল ক্যানভাস। একটি বৃহৎ স্পেস। যে ঘোর ও স্পেসের ভেতরেই মজ্জমান, কবিতা নামক উঁচুবোধের বড় একটি শিল্পপ্রত্যয়। যেখান থেকে আমাদের কাছে এসে পৌঁছানো খুব একটা সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে সেই শূন্যতা পূরণ হবে। জীবনানন্দ নিয়ে মোহাম্মদ নূরুল হক অর্থবহ কিছু মৌলিক বিষয় ও জিজ্ঞাসা উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলছেন—‘অভিজ্ঞতার চেয়ে কল্পনা, প্রজ্ঞার চেয়ে আবেগের তীব্রতা-ই জীবনানন্দ-কাব্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য। দাশকাব্যে বাঙালি স্বভাবের মৌল প্রবণতা—আবেগই বেশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সীমাহীন কল্পনা ও কল্পনার নানামুখী প্রকাশ […] জীবনানন্দ দাশের প্রধান কবিতাগুলো মূলত আবেগ-স্বপ্ন আর অচরিতার্থ জীবনের হাহাকারময়। এসব কবিতায় যতটা প্রাপ্তি, তারও চেয়ে হারানোর চিত্র বেশি। তারও চেয়ে বেশি বিরহগাথা; স্মৃতিচারণাও। বাঙালি স্মৃতিচারণপ্রিয়, আবেগপ্রবণ। এই অর্থে জীবনানন্দ দাশ বাঙালির ভাবালুতার সমব্যথী […] সমাজ থেকে যখন ন্যায়বোধ, সততা, নিষ্ঠা ও প্রতিভার মূল্য উঠে যায়, তখন প্রতিভাবানেরা স্বভাবতই ক্ষেপে ওঠেন। কিন্তু সে ক্ষোভ প্রকাশেও একেক শ্রেণীর মানুষের একেক কৌশল থাকে। কিন্তু যিনি কবি, তিনি কেবল শব্দে-বাক্যে-চিত্রকল্পে-উপমায়ই তা প্রকাশ করেন। কখনো তীব্র শ্লেষে, কখনো স্লোগানে কখনো বা প্রবাদপ্রতিম পঙ্ক্তিতে। জীবনানন্দ শেষ ধারায়। তাই তার কবিতায় তীব্র ব্যঙ্গ, শ্লেষোক্তি রয়েছে। কিন্তু তা প্রকাশে পরিমিত, সংযমী […]।’
ছন্দ না বুঝে কবিতা লেখা। গল্প বা উপন্যাস বা প্রবন্ধ যাই বলি, দেশ প্রেক্ষাপট ও পশ্চাৎ ইতিহাস না দেখে এই যুগে এসেও সেই ধারার—সেই ভাষা ও প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়ে, গল্প বা উপন্যাস রচনার প্রবণতা বিরাজমান। মোহাম্মদ নূরুল হক সচেতন প্রয়াসে শিল্প সাহিত্যের এই বিষয়গুলো বিজ্ঞানসম্মতভাবে আলোচনা করেছেন।
এছাড়া, জীবনানন্দের বিখ্যাত সৃষ্টি ‘বনলতা সেন’সহ আরও কিছু বিষয়ে মোহাম্মদ নূরুল হকের ভাবনায় উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন—‘‘ইতিহাস চেতনার সঙ্গে কালচেতনা এবং প্রকৃতির সঙ্গে নারীর সম্পর্কের যুগল চিত্র ‘বনলতা সেন’। একইসঙ্গে ‘বনলতা সেন’কে তুলে ধরা হয়েছে ক্লান্তিনাশা আশ্রয় হিসেবে। নিঃসঙ্গ, অনেক পথ পাড়ি দিয়ে আসা ক্লান্ত-শ্রান্ত পথিকের শেষ আশ্রয়স্থল ‘বনলতা সেন’[…] জীবনানন্দ-উত্তর বাংলাকাব্যে এমন কবি খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি প্রথমে এই কবির প্রভাবে কবিতা রচনা করেননি। কারও কারও সমগ্র কাব্যপ্রচেষ্টা-ই জীবনানন্দীয়। এ কথা বলা অসঙ্গত হবে না—উত্তররৈবিক বাংলাকাব্যে জীবনানন্দের প্রভাব দিগন্তবিস্তারী, অতলস্পর্শী ও সর্বগ্রাসী। তার প্রভাব এড়িয়ে কবিতা রচনা শুধু কঠিনই নয়, অনেকক্ষেত্রেই অকল্পনীয়। বিশেষত আবেগ, কল্পনা, প্রকৃতির সঙ্গে নারীর অভিন্ন রূপ চিত্রায়ণ ও ইতিহাসচেতনার সঙ্গে সমকাল চেতনার মেলবন্ধন ঘটানোর ক্ষেত্রে। (জীবনানন্দ দাশ: কবিতার সময় ও মনীষার দান)।
সুধীন্দ্রনাথ। মোহাম্মদ নূরুল হকের সুধীন্দ্রভাবনায় দেখি আরেকপ্রস্থে ভিন্ন করে—‘আধুনিক বাংলা কবিতার প্রথম আধুনিকদের একজন সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। তার কবিতায় আবেগের চেয়ে প্রজ্ঞা, কল্পনার চেয়ে অভিজ্ঞতা এবং ভাবালুতার চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তির পরিচয় বহুল পরিমাণে বিধৃত। ফলে তার কবিতা সহজবোধ্য হয়ে ওঠেনি। এর কারণ কবিতা নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে ধ্যানস্থ হওয়া এবং কবিতাকে অভিজ্ঞতা ও ভাবনা প্রকাশের বাহন করে তোলা […] সুধীনদত্ত কবিতাকে অভিজ্ঞতা ও কল্পনার সমন্বয়ে প্রজ্ঞার স্মারক করে তুলেছেন। চিন্তাশূন্য কল্পনাবিলাসিতার বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে তার কবিতা। সঙ্গত কারণে অপ্রস্তুত পাঠকের পক্ষে তার কবিতার রস আস্বাদন অনায়াস-সাধ্য নয়। এ কথা অস্বীকার যায় না—তার কবিতায় তৎসম শব্দের বাহুল্য রয়েছে, সেই সঙ্গে রয়েছে মিথ ও পাণ্ডিত্যের সংশ্লেষ। এর অন্য কারণও রয়েছে। সুধীনদত্ত যুক্তিনিষ্ঠ এবং বিজ্ঞানমনস্ক। প্রমাণ ছাড়া অন্তঃসারশূন্য বিষয়ের প্রতি কোনো মোহ ছিল না। বস্তুসত্যের ওপর কল্পনার প্রলেপে কবিতা সৃষ্টিই একমাত্র লক্ষ্য ছিল। কেবল ভাবের জগতে বিচরণ করে, যুক্তিহীন স্বপ্নচারিতায় প্রতিভার অপচয় সময়ের অপব্যবহারে ছিলেন অনীহ।’ (সুধীন্দ্রনাখ দত্ত: কবিতার সময় ও মনীষার দান)। এখানে সুধীন্দ্রনাথের শিল্পমানস, প্রজ্ঞা ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতা—লেখকের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ ও যথার্থ বলে মনে হয়েছে।
আল মাহমুদ। বাংলা সাহিত্যের বিরলপ্রজ প্রতিভা আল মাহমুদ। তার ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের কলস’, বিশেষ করে ‘সোনালি কাবিন’ বাংলা সাহিত্যের অমর সৃষ্টি। ফলে পরবর্তী অনেক কাব্যগাথায় তার দর্শন ও আইডেনটিটি প্রশ্নবিদ্ধ হলেও কিছু সূচকে তার অবস্থান এতই শক্তিসম্পন্ন যে, তাকে অস্বীকার করার কোনো সুযোগ থাকে না। আল মাহমুদ বিষয়ে মোহাম্মদ নূরুল হকের ভাষ্যে মূলত সেই বিষয়গুলো ভিন্ন অথচ অর্থবহ উপস্থাপনায় উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। তিনি বলছেন—‘স্বাদেশিকতা ও আন্তর্জাতিকতা বোধের যুগ্ম-স্বাক্ষর রয়েছে তার কবিতায়। রাজনৈতিক চেতনা তাকে করে তুলেছে জনবান্ধব। ধর্মীয় চেতনায় আক্রান্ত হলেও তা মানবতাকে অস্বীকারের ভেতর দিয়ে নয়।’ […] আধুনিক বাংলা কবিতা গভীরতর অর্থে ঐতিহ্যের পরম্পরা এবং সংস্কৃতির রূপায়ণের ফল। বাংলা কবিতার আধুনিকতা কোনোভাবেই উল্লম্ফনের বিপরীতে ঐতিহ্যিক পরম্পরাকে মান্য করে। এ দৃষ্টিকোণ থেকে আল মাহমুদের শুরুর দিকের কবিতায় কোথাও কোথাও জীবনানন্দীয় সুর লক্ষ করা যায়। […] আল মাহমুদ কেবল গ্রামীণ পটভূমিকে কবিতায় অঙ্গীভূত করেননি, নগরও চিত্রায়িত করেছেন। তার কবিতায় নগর এসেছে, যান্ত্রিক সভ্যতার রূঢ় রূপ নিয়ে। গ্রামীণ বিষয়-আশয়কে তিনি যেভাবে ‘আন্তরিক রতির দরদ’সহ দেখেছেন, নগরকে সেভাবে দেখেননি।’’
এছাড়া আল মাহমুদ বিষয়ে মোহাম্মদ নুরুল হকের চূড়ান্ত প্রজ্ঞাভাষ্য হলো—‘‘কালই শেষ পর্যন্ত কবিতার শ্রেষ্ঠ পাঠক ও বিচারক। বাংলা কবিতার ইতিহাসে ‘সোনালি কাবিন’ একাধারে বুর্জোয়া, ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ‘সোনালি কাবিন’ নিখিল নাস্তির দলিল নয়; নয় প্রবল বিশ্বাসের খতিয়ানও। আল মাহমুদ কবি—সমাজ ও শিল্পে সমন্বয়বাদী; বলার ভঙ্গি এবং অন্তর্জগত চেতনায় ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে প্রোজ্জ্বল। নিজের কণ্ঠস্বাতন্ত্র্য স্পষ্ট করার লক্ষ্যে একই বিষয়ে যেমন বারবার ভিন্ন ভিন্ন কবিতায় উচ্চারণ করেছেন, তেমনি পরম্পরা রক্ষা করে রচনা করেছেন একের পর এক কবিতা।” (আল মাহমুদ: কবিতার সময় মনীষার দান)।
মোহাম্মদ নূরুল হক বুর্জোয়া, পুঁজিবাদ ও ধনতন্ত্রের বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিতে আল মাহমুদ নিয়ে দূরদর্শী বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। তাকে নিয়ে অভিনিবেশী এবং ধীর পাঠ না থাকলে আল মাহমুদ নিয়ে মোহাম্মদ নূরুল হকের যুক্তিনিষ্ট মূল্যায়নের ভাষা বোঝা কিছুটা কঠিন বৈকি।
নজরুল। বাংলা সাহিত্যে নজরুল একটি সম্পূর্ণ-ব্যতিক্রমী প্রতিভা। যার আপাত ‘পাগলামি’ একটি অসাম্প্রদায়িক বাংলার স্বপ্ন দেখার পক্ষে থাকে। বাংলার বিদ্রোহী সত্তার জাগরণসহ ললিতকলার অনেকগুলো অনুষঙ্গে যিনি দিয়েছেন ধ্রুপদি প্রাণ ও নন্দন। তাকে নিয়ে মোহাম্মদ নূরুল হকের বিশেষ করে নজরুলের কবিতার ব্যাকরণ নিয়ে—কবিতায় পঙ্ক্তিবিন্যাস ও মাত্রাচেতনা নিয়ে আছে বিজ্ঞানসম্মত আলোচনা; এখানে নজরুলের আরেকটি দিককে তিনি উন্মোচন করলেন। তিনি বলছেন—‘নজরুল তার কবিতায় পঙ্ক্তিবিন্যাস ও মাত্রাচেতনায় একটি বিশেষ ধারা তৈরি করেছেন। যে ধারা নজরুলের সাহিত্যিক স্বকীয়তাকে প্রোজ্জ্বল করে তুলেছে। ছন্দবিষয়ে গভীরতর অভিনিবেশ না থাকলে মাত্রাচেতনায় সাফল্য অর্জন অসম্ভব। নজরুল বাংলা ছন্দের প্রতিটি প্রকরণ সম্পর্কে ছিলেন পূর্ণ সচেতন। ফলে ছন্দের ভাঙাগড়ায় তার নিরীক্ষাও ছিল, প্রতিকৃতের। এদিক থেকে কাজী নজরুল ইসলাম নিরীক্ষাপ্রবণ কবিদের জন্য নমস্য।’ (নজরুলের কবিতায় পঙ্ক্তিবিন্যাস ও মাত্রাচেতনা: সমালোচকের দায়)।
আরজ আলী মাতুব্বর। বহির্গঠনে আপাত দৃষ্টিতে তাকে অনেকটা গ্রাম্য ও মলিন মনে হলেও, তার প্রতিভার ধ্রুপদি চিন্তা তাকে একজন যুক্তিনিষ্ঠ বাঙালি মনীষার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে। অনেক মৌলিক প্রশ্নের জন্ম দেওয়া এই মনীষীকে নিয়ে মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রবন্ধে উঠে এসেছে সার কথা—‘ঝরনার মুখে বাধা দিলে তার গতি থামে না, বরং দ্বিগুণ গতিতে লাফিয়ে চলে। সত্য সন্ধানীকে কোনো প্রলোভন কিংবা ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করা যায় না, তাতে তার সংশয় বাড়ে, বাড়ে অন্বেষণ ক্ষমতাও। সমাজে যখন একজন প্রথাবিরোধী মানুষের আবির্ভাব ঘটে, তখন সমাজপতিরা সামাজিক শৃঙ্খলা, প্রথা, আইন ও ধর্মের অজুহাতে তার বিরোধিতা করে। তবে, এই ধর্মান্ধ ও সুবিধাবাদী সমাজপতিতের রক্তচক্ষুর ভয়ে সত্যসন্ধানী কখনো থেমে যান না […] আরজ আলীর কৃতিত্ব এখানে যে কুসংস্কারচ্ছন্ন, ধর্মান্ধ সমাজে বসেই বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশ্ন তুলেছেন সমাজের কাছে। বিরূপ সমাজে মনীষার কাজ দ্রোহ করা, সে দ্রোহ শান্ত-স্থির ও নিরুত্তেজ। আরজ আলী মাতুব্বর সে-ই দ্রোহী মনীষী, যিনি কোনো খ্যাতি-মোহের প্রতি আকৃষ্ট নন, শান্ত অথচ নির্ভীক নিজের অভিমত প্রকাশের।’ (আরজ আলী মাতুব্বর: মনীষার দ্রোহ: সাহিত্যের রাজনীতি)।
আহমদ ছফা। বাংলা মূলুকে জন্ম নেওয়া, নিঃসন্দেহে একজন খাঁটি সত্যসন্ধানী মনীষী। সাত চল্লিশের দেশভাগ। বাংলার নানা ঘটনা পরম্পরায়, করুণ-মহাকাব্যিক-মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া নানাবিধ নৈরাজ্য, লুটপাট; স্বভাবে বৈপিরীত্যের দ্বিচারী-বুদ্ধিজীবীর খামারে পরিণত হওয়া বাঙালির মুখোশ উন্মোচক—একেবারে বস্তুনিষ্ঠ ও সত্য উন্মোচনকারী এই আহমদ ছফা। তাকে নিয়ে নূরুল হকের বক্তব্যে উঠে এসেছে—‘‘ছফা বাঙালির মানস-সংকট, আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় পরিচয়ের ভেতর জাতীয় পরিচয়ের উৎস সন্ধান করেছেন। কিন্তু এ সন্ধান প্রাতিষ্ঠানিক অভিসন্ধর্ভের ধাঁচে নয়। করেছেন একান্ত বেদরকারি-গদ্যলেখকের মতোই—আপন মনের খেয়ালে, নিজের মতো করে। এ ক্ষেত্রে ছফা গবেষক নন, পর্যবেক্ষক। পর্যবেক্ষণদৃষ্টি তীক্ষ্ণ, উপলব্ধি স্বচ্ছ। তার প্রবন্ধ-নিবন্ধ-গদ্যের বিষয় যেমন সমকালীন অন্য লেখকদের চেয়ে ভিন্ন, তেমনি উপস্থাপনকৌশলও। ছফা বাঙালির চরিত্র-বৈশিষ্ট্য-স্বভাব শনাক্তিসহ সবিস্তারে আলোচনা করেছেন ‘বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস’, ও ‘বাঙালি মুসলমানের মন’ শীর্ষক দুটি বইয়ে।’’
এছাড়া আহমদ ছফা নিয়ে মোহাম্মদ নূরুল হক যে গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য কোট করতে ভোলেননি, তা হলো—‘বুদ্ধিজীবীরা যা বলতেন, শুনলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। এখন যা বলছেন, শুনলে বাংলাদেশের সমাজ-কাঠামো আমূল পরিবর্তন হবে না।’[…] ‘আগে বুদ্ধিজীবীরা পাকিস্তানি ছিলেন, বিশ্বাসের কারণে নয়—প্রয়োজনে। এখন অধিকাংশ বাঙালি হয়েছেন—সেও ঠেলায় পড়ে।’এই প্রসঙ্গে মোহাম্মদ নূরুল হক বলছেন, ‘বাঙালি মুসলমানেরও মূল সমস্যা এখানে। তারা নিম্নবর্ণের নিন্দুদের সঙ্গে মিশতে পারেনি, উচ্চবর্ণ তাদের গ্রহণ করেনি কোনো কালেই। সঙ্গতকারণে পুরো সম্প্রদায়ের মধ্যে কোনো জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠেনি। বাঙালির এই চরিত্র গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছেন ছফা। প্রকাশও করেছেন সরাসরি, কোনো ভনিতা ছাড়াই […] সবচেয়ে বিস্ময়ে ব্যাপার হলো—আহমদ ছফা মেরুদণ্ডসম্পন্ন বাঙালি বলতে মূলত বুঝেছেন, চাষাভূষাকেই, আর বাঙালি মুসলমান বলতে চিনেছেন, নিম্নবর্ণের হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিতদের। যারা উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।’[আহমদ ছফার বাঙালিদর্শন: আহমদ ছফার বাঙালিদর্শন ও অন্যান্য]।
‘কবিতার সময় ও মনীষার দান’, ‘জ্যোতি প্রকাশ দত্তের কয়েকটি গল্প’, ‘জাকির জাফরানের কবিতা: বিষয়-প্রকরণে’, ‘গবেষক প্রাবন্ধিক তপন বাগচি’, ` নাজিব ওয়াদুদের গল্প: সমাজ-সচেতনতার চিত্র’, `রহমান হেনরীর কবিতায় চিন্তার দ্যুতি’, `সেলিনা শেলির কবিতা: বোধের গহনে’, ‘নোয়াখালীর আঞ্চলিক গান ও মোহাম্মদ হাশেম’, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস: জীবন ও শিল্পের যৌথপাঠ’, ‘হুমায়ুন আহমেদের গল্প: জটিল জীবনের সহজ গাথা’, ‘আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতা: সার্বভৌম উচ্চারণ- এর মতো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন মোহাম্মদ নূরুল হক। এখানে উল্লেখ্য, আবদুল মান্নান সৈয়দকে নিয়ে লেখা প্রবন্ধের সারসত্যটি উল্লেখ করার মতো। লেখক বলছেন, ‘বাংলা মূলুকের মননে, আবদুল মান্নান সৈয়দ একজন তাত্ত্বিক ও পরাবাস্তব কবি হিসেবে পরিচিত।’ আবদুল মান্নান সৈয়দ নিয়ে আমাদের সরল ও সহজ ধারণা-অনুধ্যানের বিপরীতে মোহাম্মদ নূরুল হক একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন লাগিয়ে দিয়েছেন। লেখার শুরুতেই তিনি বলেছেন,‘‘কোনো তত্ত্বের ছাঁচে ফেলে আবদুল মান্নান সৈয়দের কবিতার বিশ্লেষণ করা অবিচারের সমান। কারণ, মান্নান সৈয়দ তাত্ত্বিক নন; মতবাদীদের তত্ত্বের শিকার। এ কারণে তিনি ‘পরাবাস্তববাদী’ উপকবির খণ্ডিত অভিধায়ও অভিষিক্ত (…) কবিকে সময়ের কাছে তার জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে যেতে হয়। না হলে মহাকাল কবিকে বরণ করে নিতে অনীহ থাকে।’’
শিল্প: যুক্তির শৃঙ্খলা ও দায়বোধ
বাংলাদেশের শিল্প সাহিত্যে যতটুকু কাজ হচ্ছে, তার বেশিরভাগই অযাচিত, নিছক ‘আর্টস ফর আর্টস শেক- এ সমর্পিত। সাহিত্যের জন্যও ইতিহাস জানাটা খুবই জরুরি। সেইসঙ্গে একটি দেশের ঐতিহ্য, কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ বিবর্জিত সাহিত্য কখনো শিল্প সাহিত্যে জায়গা পেতে পারে না। শিল্প সাহিত্যে কবিতা, গল্প, উপন্যাস প্রবন্ধসহ বিবিধ শাখা বিরাজমান। যুগ বিবেচনায় প্রত্যেক শাখা, ভাষাকাঠামো, প্রকরণ ও কৌশলগত জায়গায় নতুন অনেক কিছুই সে দাবি করে। অথচ আমাদের বাংলা সাহিত্যে বেশিরভাগই চর্বিতচর্বণের খেলা। ছন্দ না বুঝে কবিতা লেখা। গল্প বা উপন্যাস বা প্রবন্ধ যাই বলি, দেশ প্রেক্ষাপট ও পশ্চাৎ ইতিহাস না দেখে এই যুগে এসেও সেই ধারার—সেই ভাষা ও প্রেক্ষাপটের ওপর দাঁড়িয়ে, গল্প বা উপন্যাস রচনার প্রবণতা বিরাজমান। মোহাম্মদ নূরুল হক সচেতন প্রয়াসে শিল্প সাহিত্যের এই বিষয়গুলো বিজ্ঞানসম্মতভাবে আলোচনা করেছেন।
যুগ বিচারে যারা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মৌলিক বিষয়সহ ভাবনায় দারুণভাবে আঘাত করেছেন, সে বাস্তবতাও উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এতে করে ফ্রয়েডের কালজয়ী ভাবনা-তরঙ্গের সমূহ বাস্তবতাও সামনে চলে আসে। যেখানে মোহাম্মদ নূরুল হক, সর্বোপরী প্রথাগত ধর্মপালন ও স্বভাবের বিপরীতে গুরুত্বপূর্ণ মানবধর্মকে স্থান দিয়েছেন। লেখক বলছেন—‘‘প্রতিক্রিয়াশীল প্রগতিবাদীরা মূলত প্রগতিবাদী তত্ত্বের দোহায় দিয়ে বিকৃত ও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার সারাংশ দিয়েই বাংলার মানবতাবাদী ও সর্বপ্রাণবাদী চিন্তার ভরকেন্দ্রে আধিপত্য বিস্তার করতে চায়। এ মতবাদীদের ভাষ্যমতে সর্বপ্রাণবাদ কথাটিও নাকি পশ্চিমের আবিষ্কার। গৌতম বুদ্ধের ‘জীব হত্যা মহাপাপ’ ও স্বামী বিবেকানন্দের ‘জীবে দয়া করে যে জন, সে জন সেবিছে ঈশ্বর’-এর মতো সর্বপ্রাণবাদী অমোঘ উচ্চারণও নাকি তারা কোনোকালেও শোনেনি। তারা লালনের আরশিনগর না চিনলেও দেরিদার ‘বিনির্মাণবাদ’ ঠিকই চেনে। এ ধরণের মতাদর্শবাদীরা মূলত সাহিত্যের গুণবিচারবিরোধী’(…) রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মতাদর্শকেন্দ্রিক সাহিত্য-সমালোচনার ধারা থেকে গুণবিচারী সমালোচকদের বের হয়ে আসতে হবে। মুক্তচিন্তার ধারাকে বিকশিত করার লক্ষ্যে সবধরনের সংকীর্ণতা ত্যাগ করতে না পারলে, প্রথাগত ধর্মের ওপরে মানবধর্মকে স্থান দিতে না পারলে মানুষে মানুষে বিভাজন বিলোপ হবে না (…) বাঙালি প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষালাভের সময় বিশ্বাস করতে বাধ্য হয় তার মৌলিক চাহিদা পাঁচটি—অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। তাবৎ জ্ঞানী-গুণী সে মিথ্যাচারকেই সত্য গণ্যে অনুমোদন দিয়েছেন কোনো রকম প্রশ্ন না তুলেই। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে যে সত্য রৌদ্রকরোজ্জ্বল দুপুরের সূর্যের মতো অস্তিত্বময়, তা হলো মানুষের পেটের ক্ষুধা নিবারণের পরপরই যৌনক্ষুধা জাগে। সঙ্গত কারণে মৌলিক চাহিদা হওয়া উচিত ছিল—অন্ন, যৌনতা, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা ও শিক্ষা। অবদমিত মন সবসময় নৈতিকতা-অনৈতিকতার প্রশ্নে দ্বান্দ্বিক। তার কাছে যে কোনো সত্য আপেক্ষিক। সে যা বলে তা বিশ্বাস করে না, যা বিশ্বাস করে, তা করার সাহস তার থাকে না। বাঙালির এ মানবিক সংকটের কারণে প্রচুর পরিমাণে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য রচনা সম্ভব হয় না।’’[প্রবন্ধ; বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব]। উল্লিখিত বক্তব্যে লেখক রাষ্ট্রের মৌলিক ভিত্তির পাটাতনে আঘাত করে, প্রাণির জৈব-সত্যকেও নানা অসংলগ্নতায় অনবদ্য করে তুলেছেন।
একটি চলমান সমাজ বাস্তবতাকে কিছু নির্দিষ্ট আচরণ ও বোধের কাছে সমর্পণ হতেই হয়; অন্যথায় তার নিজের বলতে কিছুই থাকে না। মূল্যবোধ এমন একটি বিষয়, যা সমাজের প্রত্যেকটি শাখায় অবচেতনে মানুষের নিত্য-আচরিত কাঠামোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।
এই মূল্যবোধ বিষয়ে, লেখক বাঙালির নানা বৈপরীত্য এবং অসচ্ছতাকে সামনে এনেছেন। লেখক বলছেন—‘কথাগুলো বলছিলাম, মূল্যবোধের অবক্ষয় প্রসঙ্গে। আমাদের সমাজবেত্তাদের কারও কারও অভিযোগ, মূল্যবোধের অবক্ষয়ের জন্য আকাশ সংস্কৃতি দায়ী। অভিযোগের ভিত্তি খুব দৃঢ় না হলেও সত্য। কিন্তু ওই সত্যটুকু আপেক্ষিক। প্রতিটি বিষয় বা প্রপঞ্চেরই যেমন ইতিবাচক দিক থাকে, তেমনি থাকে নেতিবাচক দিকও। ওই প্রপঞ্চের উপকারিতা বিচার করতে হবে এই গ্রহণ-বর্জনের কৌশলের ওপর (…) বর্তমানও বাঙালির স্বচ্ছ নয়। আজকের যুগে বিনয়ের স্থান ভাঁড়ামি আর প্রশংসার স্থান দখল করে নিয়েছে স্তূতি। বিনয়ীকে এখন আনস্মার্ট এবং দৃঢ়চিত্তের সত্যবাদীকে গোঁয়ার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, (…) মূল্যবোধের অবক্ষয় ঠেকাতে চাইলে, প্রথমে সমাজ থেকে মিথ্যাচার দূর করতে হবে, আর এজন্য সবার আগে প্রয়োজন শিক্ষাক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন। কিন্তু সে পরিবর্তনটা করবে কে?’ [প্রবন্ধ: মূল্যবোধের অবক্ষয়]।
‘যার হৃদয় কবির, যিনি কবিতাকে জীবনের ব্রত করেছেন, তিনি ছন্দেই সিদ্ধি খোঁজেন, মাত্রা-পর্ব-পঙ্ক্তির বৈচিত্র্য সৃষ্টিতেই তার আনন্দ। তিনি জানেন, ছন্দহীন রচনা কখনোই কবিতা নয়, কবিতার ছদ্মবেশে শিল্পের শত্রু মাত্র। ছবি আঁকার জন্য শিল্পীকে যেমন রঙ-জ্যামিতিক পরিমিতি বোধ, আলোছায়ার ব্যবহার জানতে হয়, তেমনি কবিকেও জানতে হয়, ছন্দের ব্যবহার। না হলে সবই আবর্জনায় পর্যবসিত হয়। শেষপর্যন্ত কবিতা ও অকবিতার পার্থক্য নির্ণয়ের জন্যও ছন্দ জরুরি।’
বাঙালি নিজের মেধা ও মনীষার গুরুত্বকে অস্বীকার করে, বাইরের মেধা-মনীষার জ্ঞান ও প্রজ্ঞাকে বেশি গুরুত্ব দিতে শিখেছে। এটি একটি জাতির বড় দৈন্যকেও প্রকাশ করে। এখানেই লেখক একটি বড় কোটরাঘাত করেছেন। এবং তুলনামূলক বিচারে বাঙালির মননশীলতা ও কল্পনাশক্তিও যে স্বীয় সমাজের নানা পারস্পেক্টিভে নানাভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তা প্রবল সমর্থনে স্বীকার করেছেন। লেখক বলছেন—‘সৎ-সাহিত্যিক কখনো আপন সমাজকে অস্বীকার করে ভিন্ন সমাজের দাসত্ব বরণ করতে পারেন না। স্ব-সমাজের নিন্দাভাষ্যসহ অন্যসমাজের স্তুতি করে করুণা ভিক্ষা তার স্বভাববিরুদ্ধ। পরচিন্তক যখন প্রচল ধারণার শ্রেষ্ঠ সমাজের-শিল্পের-রাজনীতির প্রশংসায় আত্মোৎসর্গ করেন, তখন বিশুদ্ধচিন্তক আপন সমাজের ইতিহাস-ঐতিহ্যের সঙ্গে ভিন্ন সমাজব্যবস্থার পরম্পরা তুলনা-প্রতিতুলনা করার প্রয়াস পান। নিজেকে গড়ে তোলেন শ্রেষ্ঠ সমাজচিন্তকের প্রমূর্তিরূপে। এ শ্রেণীর সমাজসচেতন সাহিত্যিকের চোখে মার্কস-সার্ত্র-রুশো-ভলতেয়ার-ফুকো-দেরিদার মতবাদ যেমন মর্যাদা পায়, তেমনি মান্যতা পায় চণ্ডীদাস-অতীশ দীপঙ্কর-লালন-গান্ধী-বিদ্যাসাগর-রামমোহন-বিবেকানন্দ-বঙ্কিম-রবীন্দ্র দর্শনও। তার চিন্তারাজ্যে চিন্তা-মনীষা ও মৌলিকত্বের প্রশ্নে পশ্চিম কখনোই একতরফাভাবে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি পায় না (…) বিদ্যাসাগর-রামমোহন রায়দের বিধবাবিবাহ প্রথা প্রবর্তন এবং সতীদাহ প্রথার উচ্ছেদকে বাদ দিলে বাঙালি চিন্তকের কোনো মৌলিক চিন্তার প্রমাণ নেই।’[প্রবন্ধ: বাঙালির মননশীলতা ও কল্পনাশক্তি]।
অন্যদিকে সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ শাখা কবিতা নিয়ে ‘কবিতার সংকট’ ও ‘কেন ছন্দ অনিবার্য’ প্রবন্ধে মোহাম্মদ নূরুল হক কিছু গুরুত্বপূর্ণ সত্য তুলে ধরেছেন। কবিতা লিখতে আসা নতুন লিখিয়ে অথবা ছন্দ না জেনে কবিতা করার ব্যর্থ প্রচেষ্টাধারীর জন্য উল্লেখিত দু’টি গদ্য, নানা-পারস্পেক্টিভে হতে পারে একটি অমোঘ পথ্য। কবি বলছেন— ’কবিতায় কবি দুই ধরনের সংকটে পড়েন। একটি নিজে বোঝার, অন্যটি অন্যকে বোঝানোর। যারা লেখেন, তাদের দাবি, কবিতা বোঝার বিষয় নয়, অনুভবের। যারা এর রসপিপাসু, তাদের অভিযোগ—যা বোঝার নয়, তা অনুভবেরও যোগ্য নয়। উভয়পক্ষের কথায় যুক্তি আছে। প্রথম পক্ষের যুক্তি অনেকটা আপেক্ষিক, তাতে বাস্তবতার চেয়ে স্বার্থপরতার পরিমাণ কিঞ্চিত বেশি। দ্বিতীয়পক্ষের যুক্তির ভেতর রয়েছে রূঢ় বাস্তবতা। স্বার্থপরতা এই অর্থে যে, এই শ্রেণির কবিরা কারও অভিরুচির প্রতি সম্মান দেখাতে চান না। কেবল নিজেদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে চান। আর বাস্তবতা এই অর্থে যে, মনের ভাব প্রকাশের জন্য রয়েছে প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা-সংকেত…কবিতার সংকট বোঝাতে গেলে, এর পারিপার্শ্ব, স্রষ্টা, রসপিপাসু, সমালোচকের চারিত্র্য সম্পর্কেও কিছুটা আলোকপাত প্রয়োজন। কবিতার সংকট বলতে আসলে কী বোঝাতে চাই, এমন প্রশ্নের সোজাসুজি কোনও উত্তর আপাতত নেই। তবে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে যা বলা হবে, তার সারাংশ মোটামুটি এ রকম—কবির প্রস্তুতি, খ্যাতির মোহ; ছন্দ-অনুপ্রাস-অন্ত্যমিল; চিত্রকল্প, ভাষা-সংকেত; আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট; রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পটভূমি, ভৌগলিক-কালিক সীমা রেখার আন্তঃসম্পর্ক যত সুনিবিড় হবে, কবিতাও হবে তত হৃদয়গ্রাহী, বিশ্বস্ত। কিন্তু এ সবের সঙ্গে যদি সাংঘর্ষিক সম্পর্ক সৃষ্টি হয়, তবে কবিতার অপমৃত্যু অনিবার্য।’ সমাপ্তিতে মোহাম্মদ নূরুল হক কবিতা নিয়ে বিশেষ গদ্যটিতে সামসময়িক বাস্তবতার নৈরাজ্য ও আক্ষেপকে যৌক্তিক উপায়ে বিশ্লেষণের প্রয়াস পেয়েছেন। [ কবিতার সংকট]।
অন্যদিকে কবিতার জন্য ‘ছন্দ কেন অনিবার্য’, তা নিয়ে কবির যে গুরুত্বপূর্ণ অভিনিবেশ—‘যার হৃদয় কবির, যিনি কবিতাকে জীবনের ব্রত করেছেন, তিনি ছন্দেই সিদ্ধি খোঁজেন, মাত্রা-পর্ব-পঙ্ক্তির বৈচিত্র্য সৃষ্টিতেই তার আনন্দ। তিনি জানেন, ছন্দহীন রচনা কখনোই কবিতা নয়, কবিতার ছদ্মবেশে শিল্পের শত্রু মাত্র। ছবি আঁকার জন্য শিল্পীকে যেমন রঙ-জ্যামিতিক পরিমিতি বোধ, আলোছায়ার ব্যবহার জানতে হয়, তেমনি কবিকেও জানতে হয়, ছন্দের ব্যবহার। না হলে সবই আবর্জনায় পর্যবসিত হয়। শেষপর্যন্ত কবিতা ও অকবিতার পার্থক্য নির্ণয়ের জন্যও ছন্দ জরুরি।’ [কেন ছন্দ অনিবার্য]।
‘বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব’ গদ্যে লেখক আমাদের অবদমন ও সমাজচিন্তার সস্তা চিন্তাকার্যক্রমের বিপরীতে একটি গভীর প্রজ্ঞাময় ধ্যান ও বড়ো সত্য নির্দ্বিধায় স্বীকার করেছেন। লেখক বলছেন—‘অবদমিত মন সবসময় নৈতিকতা-অনৈতিকতার প্রশ্নে দ্বান্দ্বিক। তার কাছে যে কোনো সত্য আপেক্ষিক। সে যা বলে তা বিশ্বাস করে না, যা বিশ্বাস করে, তা করার সাহস তার থাকে না। বাঙালির এ মানবিক সংকটের কারণে প্রচুর পরিমাণে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য রচনা সম্ভব হয় না।’
মোহাম্মদ নূরুল হকের ’মূল্যবোধের অবক্ষয়’, ’বাঙালির মননশীলতা ও কল্পনাশক্তি’সহ কিছু গদ্যে তিনি সৃজনের পাশাপাশি মননশীল চর্চার জায়গাকে সমৃদ্ধ করছেন। বিশেষ করে এই সব গদ্যে তিনি নতুন কিছু ভাবনা ও জিজ্ঞাসাকে উস্কে দিয়েছেন, যা প্রবন্ধ সাহিত্যকে অনেক ঋদ্ধ ও দূরদর্শী করেছে। মোটাদাগে যেমন, ’বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব’ গদ্যে লেখক আমাদের অবদমন ও সমাজচিন্তার সস্তা চিন্তাকার্যক্রমের বিপরীতে একটি গভীর প্রজ্ঞাময় ধ্যান ও বড়ো সত্য নির্দ্ধিধায় স্বীকার করেছেন। লেখক বলছেন, অবদমিত মন সবসময় নৈতিকতা-অনৈতিকতার প্রশ্নে দ্বান্দ্বিক। তার কাছে যে কোনো সত্য আপেক্ষিক। সে যা বলে তা বিশ্বাস করে না, যা বিশ্বাস করে, তা করার সাহস তার থাকে না। বাঙালির এ মানবিক সংকটের কারণে প্রচুর পরিমাণে কালোত্তীর্ণ সাহিত্য রচনা সম্ভব হয় না।’ [ বৃত্তাবদ্ধের স্বার্থচিন্তা ও মতাদর্শের দ্বন্দ্ব]।
সমকাল ও সচেতনার দায়
আমাদের অসংলগ্ন গণতন্ত্র ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থাপনা, বর্তমান সমাজে নৈরাজ্য ও বৈপরীত্যকে চলমান রেখেছে। উভয়ের কোনটাই এখনো সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠেনি—এর মধ্যে একটা পক্ষ সমাজের প্রচল ধারার বিপরীতে, অনেকটা এক রোখা স্বভাবে, কিছু গড়পড়তা নিজস্ব মত ও বিরুদ্ধাচরণ করেন। আরেকটি পক্ষ গড়পড়তা-সমাজের প্রচল ধারার বিপরীতে, বস্তুনিষ্ঠ নিজস্ব মত প্রকাশ করেন ও বিরুদ্ধাচরণ করেন। দ্বিতীয় পক্ষটি হাতে গোনা; শেষপর্যন্ত গণমানুষের কথাই বলতে চেষ্টা করেন। লেখক মোহাম্মদ নূরুল হক দ্বিতীয় পক্ষের। যিনি সমসাময়িক সমাজের নানা অন্ধতাসহ গোঁড়ামিরও বিরুদ্ধাচরণ করেন। ‘সমকাল ও সচেতনার দায়’এই প্রতীতিবন্ধের লেখক সত্তায় তিনি দ্বিতীয় শিল্পের পথে হাঁটছেন; তার লেখক সত্তার বৈশিষ্ট্য হলো তিনি রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ, বাক্ স্বাধীনতা, গণমানুষের অধিকার আদায়সহ (হঠাৎ ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা ও রটে যাওয়া কোনো মিথ্যাচারসহ) সমাজে নিগৃহিত, নিপীড়িত ও বিবেকবান মানুষের পক্ষে কলম ধরছেন এবং তা শিল্পীত; যেখানে সহি-বক্তব্য লক্ষণীয়। খুব সম্প্রতি ব্লগার লেখক প্রকাশক খুন, বাক-স্বাধীনতাহরণ, রাষ্ট্রভাষা বাংলা বানানের বিশৃঙ্খলা, জাতীয় সংগীত বিতর্কসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক তাৎপর্যপূর্ণ বিশ্লেষণ এখনো পর্যন্ত সত্য ও অনবদ্য প্রমাণিত হয়েছে। এখানে তারই কিছু সারাৎসার বা মূল অংশটুকু তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে।
শব্দ ও বাক্যের যুগল সম্মিলনে গতিময় তার ভাষা, চলিত ও তৎসম শব্দাশ্রয়ী। মাঝেমধ্যে তৎসম শব্দ ও যুক্তবর্ণের বিশেষ ব্যবহার তার ভাষাকে করে তোলে ভাবগম্ভীর।
সম্প্রতি লেখক বুদ্ধিজীবীসহ মুক্তমনাদের ওপর নির্মমতার বিপরীতে তার বিবেকবান-অবস্থান যেভাবে তিনি পরিষ্কার করেছেন। তিনি বলছেন—“বুদ্ধিজীবী ও লেখকদের হত্যা করার পেছনে অর্থনৈতিক কিংবা আদিপত্য বিস্তারের দূরতম কোনো সম্পর্ক নেই। দেশের বেশির ভাগ লেখক-বুদ্ধিজীবী-সমাজচিন্তকই স্রেফ নিজের বিবেকের তাড়নায় ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ান (…) কারণ, মুক্তমনা লেখক, বুদ্ধিজীবী, সমাজচিন্তককে খুন করার মাধ্যমে ভিন্নমত দমন করে জঙ্গিদের তথাকথিত আদর্শ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখাও এক ধরনের মানসিক রোগ। মানসিক বিকারগ্রস্ত না হলে, মানুষকে হত্যা করে, মানুষের আদর্শকে নিশ্চিহ্ন করার স্বপ্ন দেখা কোনো সুস্থ-বিবেকবান মানুষের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়। এ বিষয়ে নিশ্চয় মনোবিজ্ঞানী-মনোচিকিৎসক-সংশোধনবাদী অপরাধ বিজ্ঞানীরাও একমত পোষণ করবেন।’[ ব্লগার লেখক প্রকাশক খুন: একটি অশনি সংকেত]।
জাতীয় সংগীত বিতর্ক নিয়ে খুব সম্প্রতি তরুণ শিল্পী নোবেলের অজ্ঞতাপ্রসূত মন্তব্য, কাদা ছোড়াছুড়ি, নানা প্রশ্ন, বিরোধ গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসাসহ অনেক সত্যও যেমন সামনে এসেছে; তেমনি জাতীয় সংগীত বিতর্কে নোবেলের শিশুপনাসহ জাতিসত্তা ও রাষ্ট্রবিরোধী নানা পরম্পরা—পেছনের আরও কিছু বড় সত্য উন্মোচিত হয়েছে। মোহাম্মদ নূরুল হকের সত্যভাষ্যে যে বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে ওঠে উসেছে, তা হলো—“নোবেল যখন তার মন্তব্যে দেশকে ‘এক্সপ্লেইন’ প্রশ্নে রবীন্দ্ররচিত জাতীয় সংগীতের চেয়ে প্রিন্স মাহমুদ রচিত তালিকাপ্রধান রচনাটিকে কয়েক হাজার গুণ উঁচুতে বলে দাবি করলেন, তখনই ছদ্মবেশী প্রগতিশীল, সুবিধাভোগী সরকারি চাকরিজীবী ও রবীন্দ্রবিদ্বেষীদের মুখোশটা আস্তে করেই খসে পড়লো। আর বেরিয়ে এলো প্রকৃত ভোল। প্রকাশিত হলো মৌলিক বোলও (…) দেশপ্রেমিক, রুচিশীল ও সচেতন লেখক-চিন্তক-সাংবাদিক-সংস্কৃতিকর্মীরা যখন নোবেলের মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাতে শুরু করলেন, তখনই হঠাৎ করে হাওয়া ঘুরতে শুরু করলো। এতদিন যারা নোবেলকে সমর্থন দিয়ে আসছিলেন, তারাও এখন নোবেল প্রসঙ্গ কৌশলে এড়িয়ে যাচ্ছেন।’এছাড়া পেছনের বড় সত্যসহ জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ের যে কথাটি কবি কোট করতে ভোলেননি। দ্ব্যর্থ বচনে আরও তিনি বলছেন—‘পাশাপাশি কবে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ ও পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হয়েছে, সেখানে কে কে ছিলেন, কার কী ভূমিকা ছিল এসব ফিরিস্তি দিচ্ছেন। কবে রবীন্দ্রবর্জনের পক্ষে কতজন বুদ্ধিজীবী বিবৃতি দিয়েছেন, সেসব তুলে ধরছেন। এসব তথ্য তুলে ধরার সঙ্গে সঙ্গে তারা বলছেন, পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রবিরোধী হিসেবে যারা পরিচিত ছিলেন, বাংলাদেশ পর্বে এসে তাদের কেউ কেউ বোল-ভোল দুটিই পাল্টে নিয়েছেন। কেউ কেউ বলেছেন, তাদের ব্যবহার করা হয়েছিল।’[জাতীয় সংগীত বিতর্ক: মুখোশ যখন খসে পড়ে]।
অন্যদিকে মোহাম্মদ নূরুল হক বাংলা ব্যাকরণের ব্যাকরণগত কিছু প্রমাদ চিহ্নিতকরণসহ বর্তমান সমাজ বাস্তবতার সরাসরি কিছু চিত্র তুলে ধরেছেন—দেশের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে সমাজের সর্বত্র যে হারে ভুল বানান ভুল বাক্যে ছেয়ে আছে; যা অবর্ণনীয়। উল্লিখিত বিষয়গুলো লেখক খুব গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপন করেছেন। লেখক বলছেন, ‘ভাষা শেখার প্রথম জায়গা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অধিকাংশ শিক্ষকই নির্ভুল বানানে বাক্যগঠনে মনোযোগী নন। কোমলমতি শিশুদের প্রতিটি বর্ণের নির্ভুল উচ্চারণ শেখানোর ব্যাপারে শিক্ষকরা যত্নশীল হন না। ফলে শৈশব থেকেই শিক্ষার্থী কোনো কোনো বর্ণের ভুল উচ্চারণে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। এভাবে অভ্যস্ত হয়ে পড়ায় পরিণত বয়সেও তারা আর নির্ভুল উচ্চারণ আয়ত্ত করতে পারে না। ফলে সারাজীবনই ভুল উচ্চারণেই কথা বলে। এছাড়া, লেখ্যরূপের ক্ষেত্রেও একই পরিণতি ঘটে। সর্বনাম-ক্রিয়াপদের সাধুরীতি, চলিতরীতি, ণ-ত্ববিধি কিংবা ষত্ববিধি, উৎপত্তিগত দিক থেকে শব্দের শ্রেণীবিভাগ, সমাজ-কারক-প্রত্যয়ের যথাযথ ব্যবহার সম্পর্কে প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক স্তরে পড়ানো হলেও ব্যবহারিক জীবনে শিক্ষক-শিক্ষার্থী—কেউই চর্চা করেন না। এর ফলে কিভাবে ভাষায় দূষণ ঘটছে, কিভাবে গুরুচণ্ডালী ভুল হচ্ছে, সে বিষয়ে কেউ সতর্ক থাকছে না।’
এছাড়া ব্যাকরণগত এইসব জাতীয় (বিবিধ) প্রমাদ ও ভুলের জন্য তিনি বাংলা একাডেমিকে দায়ী করছেন। তিনি বলছেন—‘এই স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানটি প্রমিত বানানরীতির যে নিয়ম তৈরি করেছে, সেখানেই রয়ে গেছে আসল গলদ। একই শব্দের দ্বৈতরীতি যেমন রেখেছে, তেমনি রেখেছে বেশকিছু বানান ও সমাসবদ্ধ শব্দগঠনের ক্ষেত্রে অস্পষ্টতাও। [বাংলা বানানে বিশৃঙ্খলার জন্য দায়ী কে?]
সমকাল ও সচেতনার দায়—এ ধারার শিল্পে লেখককে সমাজের সমসাময়িক নানাবিধ সমস্যা, অসংলগ্নতা ও সম্ভাবনাকে নিজস্ব যুক্তিতে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। প্রথমত তিনি সমস্যাগুলো তুলে ধরেন, এরপর বিশ্লেষণ করেন। পরে অর্থবহ যুক্তি, তথ্য ও মতের সমাহারে তুলনামূলক একটা পার্থক্য দাঁড় করিয়ে দেন। এই তুলনামূলক পার্থক্য তার বক্তব্যকে আরও শানিত ও বিশেষ সম্ভাবনায় প্রকাশ করে—একটি যৌক্তিক সমাধানের আলাদা প্রচেষ্টা তার লেখাকে অনেকবেশি যুক্তিগ্রাহ্য করে উপস্থাপন করে।
উল্লিখিত এই সব সমসাময়িক প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি লিখে চলেছেন আরও অনেক ধারার প্রবন্ধ, পাশাপাশি গদ্যও। একজন শিল্পীর বহুমুখী শিল্পবৈশিষ্ট্য, ক্ষমতা ও যোগ্যতাকে খাটো করে দেখার যে প্রবণতা আমাদের সমাজের প্রচলিত, তার বিপরীতে মোহাম্মদ নূরুল হকের স্বচ্ছ জবাবও চোখ এড়িয়ে যাওয়ার নয়। তিনি নিজেই বলছেন—‘আমাদের সমাজের একটি কমন স্বভাব হলো, একই ব্যক্তির একাধিক পরিচয় মেনে নিতে পারে না। বহুমুখী প্রতিভাবানকে সহজে গ্রহণ করতে পারে না। তবে, আমি কবিতা-প্রবন্ধ দুটোই মনের আনন্দে লিখি। কোনো পরিচয়েই বিব্রতবোধ করি না। [কবি-প্রাবন্ধিক কোনো পরিচয়ের বিব্রত করি না: সাক্ষাৎকার: যোগসূত্র]।
মোহাম্মদ নূরুল হক মূলত কবি। এরপরও তার গদ্যের ভাষা ও ভাবে তিনি সৃজন, মনন ও প্রজ্ঞাবান্ধব। ফলে শিল্পের যেকোনো মাধ্যমের তুলনামূলক আলোচনায়—পাঠকের প্রশ্ন, ভাবনা বা উপলব্ধির জায়গাকে তিনি সহজেই উসকে দেন। শব্দ ও বাক্যের যুগল সম্মিলনে গতিময় তার ভাষা, চলিত ও তৎসম শব্দাশ্রয়ী। মাঝেমধ্যে তৎসম শব্দ ও যুক্তবর্ণের বিশেষ ব্যবহার তার ভাষাকে করে তোলে ভাবগম্ভীর।
আরও পড়ুন: সাম্প্রতিক সাহিত্য