(পর্ব-২৮)
-মিলি, আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এখান থেকে আরও আধা কিলোমিটার দূরে, কচা নদীর বুকে আমাদের উজানগাঁওয়ের হাই স্কুল আর প্রাইমারি স্কুলটা ছিল, এখন অথৈ পানি। শিমুলের নাক চিরে বিশাল একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়।
নদীর স্রোত থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে মিলি মাহজাবীন, স্কুলটা কোথায় গেলো?
হাসে পাশে দাঁড়ানো হরলাল, ভাবি নদীটায় খাইয়া হালাইচে মোগো স্কুলডারে। তয় এহন স্কুলডারে দূরে সরাইয়া বোথলা বাজারের কাছে লইয়া গেচে।
-নদীটায় খেয়েছে মানে কী?
-মিলি তুমি আমি আমরা দাঁড়িয়ে আছি কচা নদীর একেবারে পাড়ে, যদিও পানি এখন নিচের দিকে, ভাটার টানে। আমাদের এখান থেকে বঙ্গোপসাগর বেশি দূরে না, ধরো ষাট থেকে সত্তুর কিলোমিটার। এই নদীটি বঙ্গোপসাগরে নেমে গেছে। ফলে তীব্র সোতে আষাঢ শ্রাবণ মাসের অকূল স্রোতের টানে পাড়ের পর পাড়, বাড়ির পর বাড়ি ভাঙতে থাকে। কত মানুষ নদীর গর্ভে সব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে যায়। নদীর পারের ভাঙনকবলিত মানুষের কান্না তো দেখোনি। দেখলে বুঝতে পারতে সর্বহারা মানুষ কাকে বলে! ঠিক সেভাবে ভাঙতে ভাঙতে একদিন অনেক বাড়িঘর গাছপালা জায় জঙ্গলের সঙ্গে আমাদের শৈশবের অনন্য সুন্দর উজানগাঁও বহুমুখী স্কুলটাকেও খেয়ে ফেলে প্রিয় কচানদী। ওই যে ভেসে যাচ্ছে ঘন সবুজ পত্রালি, সাগরের কারণে স্রোত অনেক বেশি, দেখতে পাচ্ছ ভাটার টানে কিভাবে কচুরিপানা ভেসে যাচ্ছে!
-কচুরিপানা কী?
-ওই যে ভাবি, গাঙ দিয়া ছোট ছোট লতানো গাছ ভাইসা যায়…দল বাইন্ধা, হাত উঁচু করে দেখায় মুজাহার আলী। পাশে দাঁড়ানো বাসুদেব দৌড়ে নদীর পাড়ে পড়ে থাকা কয়েকটা বিচ্ছিন্ন কচুরিপানা এনে ধরে মিলির সামনে, ভাবি এইগুলারে কয় কচুরিপানা। আবার কেউ কেউ কয় টগর।
মিলি হাতে ধরা টগর আর নদীতে ঝাড়ে ঝাড়ে ভেসে যাওয়া টগর দেখতে দেখতে প্রশ্ন করে, নদী থেকে কিভাবে উঠে এলো এখানে?
হাসে সবাই।
মিলি—কাছে দাঁড়িয়ে বলে শিমুল, তুমি আমি আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, কচানদীর পাড়ে, এই জাযগাটা নদীর জোয়ারের সময়ে পানিতে ভরে যায়। পানির স্রোতে বা তোড়ে অনেক কুচরিপানা ভেসে এসে আটকে যায় তীরের মাটির সঙ্গে। ভাটার সময়ে পানি শুকিয়ে গেলে আর যেতে পারে না-আটকে যায় মাটির সঙ্গে, বুঝলে?
ঘাড় নাড়ে, বুঝেছি। এ এক অদ্ভুত জীবন, না দেখলে শহরের আলো হাওযায় বোঝা যায় না এই জীবনের গল্প।
-তুমি ঠিকই বলেছ মিলি, সমর্থন করে শিমুল। জীবনের দুটি অংশ, তুমি জন্ম নিয়েছ শহরে, ঢাকায়। সেখান থেকে গ্রামে যাওয়া আর হয়নি তোমার। ফলে তোমার জীবনের একটা দিক, বিশাল বাংলার গ্রামীণ জনপথের জীবন আর জীবনের বিচিত্র গল্প দেখার বা অনুভব করার সুযোগ হয়নি। অন্যদিকে আমি এবং আমার মতো যারা গ্রামে জন্ম নিয়েই শহরের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করেছি, জীবনের দুটি দিক আমাদের জানা। যদিও শহরের বা ঢাকা শহরের বনেদি বলতে পারো ধনবান পরিবারের জীবনের চাকচিক্য আমি তেমন দেখতে পাইনি কিন্তু গ্রাম আর শহরের পাদটিকা কিছুটা হলেও জানি।
-এখন থেকে তোমার সঙ্গে আমিও জানলাম।
-না, তুমি গ্রামের জীবনযাত্রা মাত্র জানতে শুরু করছ। আর একটু সময় লাগবে গ্রামীণ জীবনের লৌকিক সত্তায় প্রবেশ করতে। কিন্তু আমি বুঝতে পেরেছি গত দুদিনের অভিজ্ঞতায়, তুমি শিগগিরিই গ্রাম জীবনকেও তোমার অস্তিত্বের মধ্যে ধারণ করতে পারবে, তোমার সেই কৌতূহল আছে, আছে আগ্রহ। অনেকের মতো নাক সিটকানো স্বভাব তোমার নেই। এই জন্যই তুমি অনন্য।
-ভাবি দেহেন দেহেন, গাঙের মধ্যে সূর্যডা ডুইবা যাইতেছে…দেখায় এনামুল হক। কেমন সুন্দর লাগতেছে না?
দরজায় এসে দাঁড়ায় শিমুল, কই আসো। ওরা না খেয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে মিলি।
কচানদীর পারের গোটা পরিবেশটা অন্যরকম লাগে মিলি মাহজাবীনের কাছে। অদ্ভুত, সুন্দর। প্রকৃতির দুরন্ত বিস্তার। নদী, নদীর পারের মানুষ, নদীর স্রোত, নদীর নৌকা—চলে যাওয়া লঞ্চ, স্টিমার, কারগো—কাজ অনুসারে এক একটা জল বাহনের এক একটা নাম। কচানদীর এপার থেকে ওপারে কিছুই দেখা যায় না, চোখের দৃষ্টিতে ঝপসা লাগে-কত কিলোমিটার চওড়া?
সাড়ে তিন কিলোমিটার হবে, জবাব দেয় শিমুল।
আরে না, পাঁচ মাইলের কম না, শিমুলের প্রতিকথায় উত্তর দেয় মুজাহার আলী।
-পাঁচ মাইল চেন? হালকা ধমক দেয় শিমুল । কচা নদী চওড়া, কিন্তু পাঁচ মাইল না। তিন থেকে সাড়ে তিন কিলোমিটার হবে।
মিলি অবাক হয়ে কচানদীর পারের সন্ধ্যার অপরূপ দৃশ্য দেখে। দূরের নদীর মাঝ দিয়ে চলে যাচ্ছে ছোট্ট একটা নৌকা। নৌকার পিছনে একমাত্র মাঝি—খালি গা, নিজের মনে নৌকা বাইছে আর গান গাইছে…ও আমার জীবন বেদনার দিন… কেমনে সুধিবো তোমার ঋণ।
-ও মাঝি কোথায় যাবে? জিজ্ঞেস করে মিলি পাশে দাঁড়ানো হরলাল গাইনকে।
-ভাবি, কই যে যাইবে ঠিক নাই। এই যে আমাগো গেরাম উজানগাও, এই গেরামের নিচে আছে তেলিখালি, জুনিয়া। তয় সন্ধ্যা অইচে তো, অত দূরে যাইবে নানে। ধরেন বোতলার বাওনের খালে, নয়তো তেলিখালির আগে ছোট তেলিখালির খালে ঢুইকা যাইবে।
-ওর ভয় লাগছে না?
-কেন ভয় লাগবে ভাবি? পাল্টা প্রশ্ন করে হানিফ, জন্মের পর থেইকা আমাগো নদীর লগে পরিচয়, দেহজা সাক্ষাৎ। নদী মোগো জীবনে মায়ের নাহান—মিইশা রইচে। ওই পোলাতো অনেক দূর দিয়া যাইতেছে, কাছ দিয়া গেলে জিগাইতাম, কই যাইবা, কইতো। হের লাইগা আমাগো নদীর ভয় ডর নাই—যেমন নদী খাল বিল আমাগো মাছ দেয়। হললাল গাইন তো মাছ ধইরা বেচে সংসার চালায়। নদী ভাদ্র আশ্বিন মাসে ধান চাষের সোমায় জোয়ারের পানি দেয়। নদীতে নৌকা বাইয়া মোরা দূরে হাট বাজারে যাই। নদী ছাড়া মোগো কোনো উপায় নাই ভাবি, কইচি না আপনারে, নদী মোগো মা।
-নদী আপনাদের মা?
-গোল হয়ে দাঁড়িয়ে সবাই কচানদীর পারে। সূর্যের লাল রঙ পশ্চিমের আকাশে আবির মেখে ছড়িয়ে পরেছে। কচা নদীর প্রবল স্রোতের মধ্যে গনগনে সূর্যটা ডুবে যাচ্ছে, একটু একটু করে। অপরূপ লাগছে মিলি মাহজাবীনের চোখে।
মাথানাড়ায় শিমুল, হাসে হানিফের দিকে তাকিয়ে-তুই তো দারুণ বলেছিস রে হানিফ। নদী মোগো মা! মিলি, দেখো—আমার বন্ধুদের দেখো, এনামুল ছাড়া ওরা কেউ লেখাপড়া করেনি তেমন। কিন্তু জীবনের পাঠ কী গভীর—কোনো শিক্ষিত মানুষ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এমন করে বলতে পারবে, নদী মোগো বা আমাদের মা?
-হানিফ কিন্তু রাইতে বাঁশিও বাজায়, বলে বাসুদেব রায়।
-তাই না কি? আজ আপনার বাঁশি শুনবো, মিলি ওর দিকে তাকিয়ে বলে।
লজ্জা পায় হানিফ মৃধা, না ভাবি মুই বাঁশি শেকতেছি। ভালো কইরা বাঁশি বাজাইতে পারি না। অগো মাঝে মাঝে হোনাই আর কী!
-বন্ধুদের যা শোনান, সেটাই আমাকে শোনাবেন।
-বাঁশি তো লগে নাই ভাবি। কেমনে হোনামু?
-ঠিক আছে, আগামী দুই একদিনের মধ্যে হানিফ মৃধা আমাদের বাঁশি শোনাবে। ঘোষণা দেয় শিমুল।
সঙ্গে সঙ্গে মেনে নেয় হানিফ মৃধা, আইচ্চা।
দুপুরের খাবারের পর বিরাট চৌকির ওপর শুয়ে পড়েছে মুহাজার আলী, হরলাল গাইন, হানিফ মৃধা, বাসুদেব রায়, এনামুল হক । খাওয়ার সময়ে খেতে খেতে শিমুল বলে, বিকেলে কী করবি তোরা?
-কী করুম? পাতে ডাল নিতে নিতে তাকায় বাসুদেব রায়, খাইতে খাইতে তো পেটের অবস্থা কাহিল। খাইয়া তোগো এই খাটের ওপর একটা টানা ঘুম দিমু। ঘুম না দিলে পেডের খাওন হজম অইবে না।
হয়, বাসুদেব ঠিকই কইচে, সমর্থন করে হানিফ মৃধা। হানিফ মৃধা খাচ্ছে আর ঘামছে। ঘরের মধ্যে কোনো পাখা নেই। জানালা খোলা। খোলা জানালা দিয়ে হঠাৎ করে এক ঝলক বাতাস এসে আবার নিমিষে হারিয়ে যায়। মুরগীর মাংস, আইড় মাছ, গোল আলু ভর্তা, আর পাতলা ডালের সঙ্গে আমন মোটা চালের ভাত; খাচ্ছে মনের সুখ মিটিয়ে।
সকালে নাস্তা করে শিমুলের বন্ধুরা বাড়ি চলে যায়। বাড়ির কাজ শেষ করে, গোসল সেরে দুপুরের পর, দেড়টার দিকে সবাই হাজির হয়। সকালের চেয়ে এখন প্রত্যেকে আরও পরিপাটি। ঘরে রাখা পুরনো হলেও সব চেয়ে ভালো জামাটা পরেছে। সকালে কারও পায়ে জুতো না থাকলেও দুপুরে প্রত্যেকে জুতো পায়ে দিয়েই এসেছে। খাবার বসার আগে মুজাহার আলী ডাকে মিলিকে। মিলি প্রথম গ্রামের বাড়িতে, পুকুরে গোসল করেছে। খেজুর গাছের ঘাটলায় নেমে, মগ বা বাদনা দিয়ে শরীরে পানি ঢেলেছে। মিলির গোসলের সময় দাঁড়িয়েছিল পারুল বেগম আর রূপালী আখতার, যেন কেউ না এসে পড়ে। তারও আগে পারুল বেগম নিজে গোসল করে দেখিয়েছে মিলিকে। মিলি পুকুরপারে দাঁড়িয়ে শাশুড়ির গোসল দেখেছে। দেখেছে আর গ্রাম শহরের বিশাল ব্যবধানের প্রক্রিয়া ভেবেছে।
গোসল সেরে আসার পর ঘরের মধ্যে এসে শাড়ি পরেছে। সকালে শিমুল আর শামসুদ্দিন রূপালী ভানডারিয়া গিয়েছিল মিলির জন্য নতুন শাড়ি জামা কাপড় আনার জন্য। শাড়ির পাশাপাশি বেশ কয়েক গজ কাপড় এনেছে শিমুল থ্রিপিস বানিয়ে দেওয়ার জন্য। উজানগাঁও বাজারে কয়েকটা টেইলার্স হয়েছে। রূপালী স্যালোয়ার কামিজ ওখান থেকেই বানায়। কিন্তু ঢাকা শহরের মেয়ে মিলি মাহজাবীনের কি পছন্দ হবে, মনে মনে ভেবেছে শিমুল কেনার সময়ে। কিন্তু পছন্দ না হলেও আপতত কিছু করার নেই। শাড়ির সঙ্গে সাবান, মাথার চুলের ক্লিপ, পায়ের স্যান্ডেল… আরও অনেক সামগ্রী। শাড়ি ঢাকায় থাকার সময়ে কয়েকবার পরেছে কোনো অনুষ্ঠান উপলক্ষে, আজকে আবার পড়লো মিলি বউ হিসেবে। শাড়ি ব্লাউজ পরার ব্যাপারে রূপালী আখতারের সাহায্য ছিল প্রচুর। মেয়েটা যেমন হাসিখুশি তেমনি সরল। খুব ভালো লাগে রূপালীকে। শাড়ি পরে কেবল বসেছে, সামনের বারান্দায় এসে জটলা করা শিমুলের হেড়ে গলায় বন্ধুরা ডাকে, ভাবি? ভাবি কই আপনে?
পারুল বেগম এসে সামনে দাঁড়ায় শিমুলের, তোর বন্ধুরা এসব কি শুরু হরচে হুনি? বউমা কি একটু জিরাইবে না? সকালে কত কষ্ট কইরা খাওয়াইলো; এহন আবার ডাহে ক্যা?
-মা, বন্ধুরা তো একটু উলটা পালটা করবেই, আজকের দিনটা তো, ওরা বড় আশা করে এসেছে।
-কর তোর যা খুশি! পারুল বেগম রাগ করে চলে যায়।
মিলি মাহজাবীনের খুব ভালোলাগে, শাশুড়ির এই মমতাটুকু। কত ব্যস্ত থেকে সারা দিন সংসার সামলাচ্ছেন; ছেলে মেয়ে স্বামী আত্মীয় স্বজনের কতো আবদার রাখেন, রান্না করেছেন, তরকারি কুটেছেন, মাছ কুটেছেন; গোসল সেরে সবাইকে খাবার দিচ্ছেন। এতসব ঘটনার মধ্যে পুত্রবধূর সুখ দুঃখের দিকেও খেয়াল রেখেছেন তিনি। মিলি ভাবে, আমার মা কি এতসব মেনে সংসার করতেন? আপন মনে হাসে, দূর সেই জীবন আর এই জীবন কত আলাদা, রহস্যময় আর দূরের।
-ভাবি আপনারে ডাকতাছে, রুমের দরজায় দাঁড়ায় তমাল। গোসল সেরেছে ও, পরনে লুঙ্গি। মাথায় সরিষার তেল, পরিপাটি আচড়ানো।
-তুমি কাছে আসো; মিলি ডাকে তমালকে।
বিছনা থেকে নামে শিমুল, ওরা ডাকছে যখন চলো মিলি।
-তুমি যাও, আমি আসছি।
কাছে এসে দাঁড়ায় তমাল। হাত ধরে মিলি, সারা দিন কই ছিলে? আমার তো কোনো খবর নিলে না?
-ইস্কুলে গেছিলাম ভাবি।
-তাই তো, তুমি তো আবার ছাত্র। কোন ক্লাসে পড়ো?
-ক্লাস ফাইভে পড়ি ভাবি।
-আমাকে কেমন লাগলো, কিচ্ছু বললে না তো তুমি?
-ফিক করে হাসে তমাল।
-হাসছ কেন?
-আমি যাই ভাবি, চট করে হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে উপচেপড়া হাসি নিয়ে দ্রুত চলে যায় তমাল। ওর চলে যাওয়া দেখতে দেখতে হাসে মিলি, খুব মিষ্টি একটা ছেলে!
দরজায় এসে দাঁড়ায় শিমুল, কই আসো। ওরা না খেয়ে তোমার জন্য অপেক্ষা করছে মিলি।
-চলো।
-সদরঘাটে। আপন মনে আকাশের দিকে চোখ রেখে উত্তর দেয় শিমুল। সদঘাট হচ্ছে ঢাকাকেন্দ্রিক এই অঞ্চলের মানুষের মোকাম।
দ্রুত রুম থেকে বের হয়ে হত ধরে শিমুলের। দুজনে এসে দাঁড়ায় সামনের ঘরের দরজার সামনে। তাকায় মিলি, শিমুলের বন্ধুরা খাটের ওপর আসন গেড়ে বসে আছে। সামনে বড় গামলায় ভরা ভাত। ভাত থেকে ধোঁয়া উড়ছে। আরও আছে মাংস, মাছ আর ডালের বড় বড় বাটি। মিলিকে দেখে মুজাহার আলী বলে, ভাবি আপনে আমাগো লগে বইয়া খাইবেন। আপনে মোগো লগে না খাইলে মোরাও খামু না।
-হয়, মুজাহার আলীর সঙ্গে তাল দেয় হরলাল গাইন, হানিফ মৃধা আর এনামুল হক।
আসলে কোথায় খাবে, কিছুই জানে না মিলি। খাওয়া রেডি, দুপুর। সবাই যেখানে খাবে, মিলিকে ডাকলে খাবে। তাকায় শিমুলের দিকে। শিমুল মাথা নাড়ায়, আসো, সবাই মিলে আমরা একসঙ্গে খাই। তাকায় বন্ধুদের দিকে, তোদের জানাই, মিলি তো শহরের মেয়ে। ওরা খায় চেয়ারে টেবিলে বসে। এভাবে সোজা বসে খাওয়ার অভ্যাস নাই। আমরা দুজনে তোদের সঙ্গে এই টেবিল চেয়ারে বসে খাই।
-খাও, কোনো আপত্তি নাই, আমা গো সুখ ভাবি আমা গো লগে খাইচে, হাসে আর গামলা থেকে থালায় চামচ দিয়ে ভাত দিতে দিতে বলে এনামুল হক।
সবাই খেতে বসে। কিন্তু মিলির খুব কষ্ট হচ্ছে, খাওয়ার সময়ে প্রচন্ড ঘামছে। রূপালী তরকারি দিতে এসে মিলির ঘামানো দেখে ঘরের ভেতর থেকে তালপাখা নিয়ে এসে বাতাস করতে থাকে। মিলির শরীরটা জুড়িয়ে যায়। খাওয়া দাওয়া সেরে শিমুলের বন্ধুরা খাটের ওপর শুয়ে পড়ে। মিলি ওদের সঙ্গে খাচ্ছে, আনন্দে উচ্ছ্বাসে শিমুলের বন্ধুরা জোশে অনেক ভাত তরকারি খেয়ে বিছনায় শুয়ে হাঁসফাঁস করতে করতে ঘুমিয়ে যায়। বিকেলে ঘুম থেকে উঠলে চা খেয়ে সবাই মিলে কচানদীর পারে আসে।
-ভাবি? সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারের আগে নদীর পারে চলে এসেছে তমাল আর তমালের বন্ধু জগদীশ।
-কী রে তোরা এখানে কেন?
দুজনে হাঁপাচ্ছে, দৌড়ে এসেছে বাড়ি থেকে। হাঁপানো একটু থামলে জগদীশ বলে, ভাবিরে লইয়া সন্ধ্যার সমায় নদীর পারে থাকতে মানা করছে কাকি। এহনই লইয়া বাড়ি যাইতে কইচে।
ঠিক আছে, যাচ্ছি। মিলির দিকে তাকায় শিমুল, চল মা রাগ করছে।
-কেন? নদীর পারে আসলে মা রাগ করবে কেন?
গ্রামে অনেক ধরনের প্রচলিত রিচুয়াল আছে নতুন বউ ঘরের মধ্যে থাকবে। বাইরে বের হবে কম, নদীর পারে অনেক অপশক্তি থাকতে পারে, নতুন বউয়ের কোনো ক্ষতি করতে পারে সেই অপশক্তি, বুঝেছ?
মাথা নাড়ে মিলি, শাশুড়ি কল্যাণ কামনা করেই খুঁজতে মানুষ পাঠিয়েছেন। শাশুড়ি কত দিকে খেয়াল রাখেন, একটু অবাকই হয় মিলি।
বাড়ির দিকে ফেরার জন্য যখন ফিরছে ঠিক তখনই কচানদীর মাঝ দিয়ে উজানে যাচ্ছে ঢাকাগামী লঞ্চ এমভি নাবিক। চোখে পড়ে মিলির, শিমুল দ্যাখো দ্যাখো।
শিমুলের সঙ্গে সবাই থাকায়, কচানদীর মাঝ দিয়ে ভাটার বিপরীতে স্রোত ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছে এমভি নাবিক পাড়েরহাটের দিকে।
-কী মিলি? বুঝতে পারে না শিমুল, মিলি কী দেখাতে চাচ্ছে?
-এই সেই লঞ্চ না, আমরা যেটায় এসেছি?
হাসে শিমুল, তুমি ঠিক ধরেছো মিলি। এই লঞ্চে চড়ে এই অঞ্চলের অনেক মানুষ ঢাকায় যাচ্ছে। ঢাকার সঙ্গে দেশের দক্ষিলাঞ্চলের মানুষের যাতায়াতের একমাত্র পথ এই লঞ্চ। লঞ্চের পেটের মধ্যে কত ধরনের মাল জিনিস যায়, ইয়াত্তা নেই। যেমন ধর ডাব, কাচাকলা, পাকা কলা, চালতা, পানিতালা, আমড়া আরও কত কী যায়! আর মানুষের তো শেষ নেই। মানুষ কত আশা নিয়ে ঢাকা যায় বলতে পারো? আমাদের এই অঞ্চলের মানুষেরা, যারা মেট্রিক বা ইন্টারমিডিয়েট পাস করেই কোনো না কেনো সূত্র ধরে চলে যায় ঢাকায়, এই লঞ্চে চড়েই। কত বিচিত্র ধরনের স্বপ্ন আশা আর আকাঙ্ক্ষায় ভরা যাত্রীরা ঢাকায় প্রথম পা রাখে কোথায়?
-কোথায়? অবাক প্রশ্ন মিলির।
-সদরঘাটে। আপন মনে আকাশের দিকে চোখ রেখে উত্তর দেয় শিমুল। সদঘাট হচ্ছে ঢাকাকেন্দ্রিক এই অঞ্চলের মানুষের মোকাম।
চলবে...