সমাজের প্রভাব আর দশটি সাধারণ মানুষের মতো কবি-শিল্পীর ওপরও পড়ে। তবে, সাধারণ মানুষ সমাজের প্রভাবে প্রভাবিত হন, কবি-শিল্পীরা সে প্রভাব কাটিয়ে উঠে সমাজকেই প্রভাবিত করেন। অন্তত প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন। অন্য আর দশজনের সঙ্গে কবির পার্থক্য এখানে। একুশ শতকের শুরুতে যারা কবিতাকে সাধনার বস্তু করে তুলতে চেয়েছেন, তাদের একজন কবি মামুন রশীদ। দেশ-কালের বৃত্তে বসবাস করেও মামুন রশীদ এই দুইয়ের সীমারেখা অতিক্রমণের চেষ্টা করেছেন।
মামুন রশীদ সমাজের নানা অসঙ্গতিকে ব্যঙ্গ করেছেন সত্য, কিন্তু স্বসমাজকে কখনো ভিন্নসমাজের কাছে খাটো করে দেখাননি। তবে মাঝেমাঝে কবি যে সময়ের মধ্যে বাস করছে, সে উপস্থিতকালকেই অস্বীকার করেছেন। ‘সময়’ কবিতায় কবি স্পষ্ট উচ্চারণ করেছেন, ‘সময় বলে কিছু নেই। বন্ধ খামের ভেতরে বয়ে বেড়ানো শূন্যতা শুধু।/এ এক শরীরী ভ্রমণ। দেহ থেকে দেহান্তরে, চক্রাকারে।/ শূন্যতায় কোলাহল–বোবা অনুভূতি–দিনমান অস্থিরতা/ শূন্যতায় ফিসফিস–কলকল ছলছল–স্বপ্নময় স্পর্শ।’
কবির মতে সময় একটি ধারণা মাত্র। এটা মূলত মানুষের শরীরী ভ্রমণ, যা মানুষ অবচেতন মনে পার করে। সমাজের শৃঙ্খলার মধ্যে বসবাস করতে গেলে কিছু নিয়ম মেনে চলতে হয়, মানুষও মেনে চলে। সময়ের অস্তিত্বকে অস্বীকার করার ভেতর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সত্যের প্রতি কবি প্রশ্ন ছুড়ে দেন। আর এর মাধ্যমেই তিনি সময়-মানুষ-বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে একটি বিতর্কিত ধারণা উপস্থাপন করেন। তবে, সে ধারণার পেছনে কোনো বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব-সত্য হাজির করেন না। হয়তো একারণেই ‘দর্শক’ কবিতায় তার উপলব্ধি হয়, ‘শহর আর আয়নার মাঝামাঝি’ তাকে রেখে পৃথিবীর লুকোচুরি খেলে।
কবি যতই স্বপ্নপ্রবণ হন, বাস্তবতাকে অস্বীকার করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। তাকেও স্বীকার করে নিতে হয়–মানুষের সীমাবদ্ধতা আছে, পথেরও। ফলে মানুষ চাইলেই অনন্ত পথের পথিক হতে পারে না। কেবল কোনো একটি নির্দষ্টি স্থান থেকে সে পালায় মাত্র। এরপরই সে মুখোমুখি হয় আরও একটি অচেনা কিংবা চেনা জগতের। এমনই চিত্র ফুটে উঠেছে ‘তুমি যেখানেই যাও’ কবিতায়। ‘টেলিগ্রাফ’ কবিতায় সময় ও সমাজ নিয়ে কবিকে গভীর দুর্ভাবনায় নিমজ্জিত হতে দেখি। সময়জ্ঞান এই কবিকে করেছে জীবনানন্দগোত্রীয়। তার তিনি ‘অশ্লীল সময়ের মধ্যে’ দেখেন ‘দাঁতে দাঁত চেপে সয়ে যাওয়া লাঙ্গলের কর্ষণ।’
মানবজীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই গুরুত্বপূর্ণ। সুখ কিংবা দুঃখের স্মৃতি বলে আলাদা তাৎপর্য নেই। প্রতিটি ঘটনাই স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল।
আস্থা-ভালোবাসা কখনো কখনো আপেক্ষিক। তাই কারও কারও চলে যাওয়া কিংবা হারিয়ে যাওয়ার ভেতর দুঃখ যেমন থাকে, তেমনি থাকেও ঔদাসীন্যও। মামুন ‘তুমি চলে গেলে’কবিতায় খুব সহজেই বলতে পারেন, ‘উল্টে হঠাৎ বেরিয়ে পড়বে আকবর বাদশহার মোহার?’ আদৌ কারও কাছে কিছু কি জানতে চান এই কবি? না কি নিজেকেই এমন প্রশ্ন করেন? পাঠক এমন একটি সংশয়াকুল প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড়াতেই পারেন।
চিরায়ত বিষয়কে কবিতার অনুষঙ্গ করে তোলার প্রবণতা প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে। এছাড়া প্রবণতাটি শক্তিমান কবির স্বভাবও। তবে, বিষয়কে মামুন দার্শনিকের মতো ব্যবহার করেন না। তাঁর শব্দ ব্যবহারের সময় বক্রোক্তির প্রতি ঝোঁক থাকেই। এ কারণেই একটি সাধারণ কথাও স্মরণীয় করে তুলতে পারেন তিনি। ‘ছেড়ে যাবার পর’ কবিতায় এমন উক্তিু ‘মূর্খরা কি হ্রস্ব-উকার ও দীর্ঘ-ঊকারের ব্যবহার জানে?’ এখানে এসে ‘তুমি চলে গেলে’ ও ‘ছেড়ে যাবার পর’ কবিতা দুটির অন্তর্গত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে বলতে গেলে বলতে হয়–কবি ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতে নানা রকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হলেও, তার ভেতরের কবিসত্তা একই ধরনের অনুভূতি ধারণ করে। তাই সমাজ থেকে পাওয়া কষ্ট, বেদনা, আনন্দ–সবকিছুকেই একই সমান্তরালে বিবেচনায় নেন।
আবার তিনি এও মনে করেন, প্রতিটি মানুষের একটি নির্দিষ্ট ভূমি থাকবে। যেখানে সে সমস্ত ক্লান্তি শেষে ফিরে আসবে। অন্তত ফিরে আসার আকুলতা প্রকাশ করবে। কারণ মানুষ মাত্রই একটি আশ্রয় খুঁজে বেড়ায়। যতই সে বিচরণশীল হোক না কেন। তার বিশ্রামের জন্য প্রয়োজন হয় একটি নির্ভার আশ্রয়স্থলের। তাই ‘সকল ভ্রমণ শেষে বগুড়ায় ফিরে যেতে সাধ হয়।’
মামুন রশীদ সমাজ-রাজনীতি সচেতন। তাই সমাজের নৈরাশ্যবাদী ঘটনাবলি প্রত্যক্ষ করেও তিনি আশাবাদী হতে চান। বিরুদ্ধ সময়ে বাস করেও কখনো কখনো খুব সহজেই উচ্চারণ করতে পারেন কিংবা মনে করতে পারেন–‘অজানা খবরের মতো তোমার চোখের দীপ্তিতে আজো জাগিয়ে রাখে মঙ্গলকাব্যের আমেজ।’
মানুষের অর্জিত জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও প্রথাগত বিশ্বাসের সম্পর্ক অনেক সময় সাংঘর্ষিক হয় পড়ে। তবু মানুষ বহুকাল ধরে চলে আসা প্রচল নিয়মকেই বিশ্বাস করতে চায়। অথচ সে জানে, এই প্রথা সত্যনিষ্ঠ নয়। এমনকি মিথ্যাকেও মানুষ বৈজ্ঞানিক সত্যের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিশ্বাস করতে শেখে। বিষয়টি মামুন ফুটিয়ে তুলেছেন ‘প্রবাস’ কবিতার দুই পঙ্ক্তিতে। বলেছেন, ‘মুকুরে প্রতিফলিত মুখ কখনো সত্য বলে না/ তবু সেই সত্যে আস্থা রাখি বারবার।’ আবার এই বিশ্বাসের ধারাবাহিকতায় মানুষ অন্য সত্যকেও হাজির করতে পারে। বলতে পারে– বিশ্ব চরাচরের প্রতিটি লতাগুল্মই গুরুত্বপুর্ণ। কবিরও মনে হয়, ‘কিছুই ফেলনা নয়। কিছুই যায় না ফেলা’। অর্থাৎ মানবজীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই গুরুত্বপূর্ণ। সুখ কিংবা দুঃখের স্মৃতি বলে আলাদা তাৎপর্য নেই। প্রতিটি ঘটনাই স্বমহিমায় প্রোজ্জ্বল।
ব্যক্তিই নিজের মর্জিমতো সাজায় এসবের ঘূর্ণন চক্র। তিনি এসব বিষয়কে আঁকতে গিয়ে প্রায় চিত্রকল্প ও প্রবাবধর্মী পঙ্ক্তি সৃষ্টি করেন।
তবে মানুষের চাওয়া-পাওয়ার সঙ্গে সবসময় সঙ্গতি রক্ষা করা চলে না। প্রায় দেখা যায় প্রত্যাশা একপাক্ষিক। প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তিযোগের সম্পর্ক প্রায়ই ক্ষীণ। হৃদয়বান মানুষ সবকিছু নিয়ে সুখ পেতে চায়, কিন্তু সব কিছু তাকে ঘিরে সব সময় আবর্তিত হয় না। তাই কবি বেদনাতুর কণ্ঠে বলেন–‘আমাকেই ছেড়ে যায় সবাই, আমি নাই।’ এরপর অভ্যাস ও প্রত্যাশা-প্রাপ্তির যোগফল মেলান। সবশেষে উচ্চারণ করেন–‘বসন্তের চেয়ে ঝরাপাতার স্পর্শ অনেক বেশি সঙ্গীতমুখর।’ এমন অভিব্যক্তি জেনে পাঠকের মনে হতে পারে, কবি নৈরাশ্যবাদী। কিন্তু সামগ্রিক দিক বিবেচনায় নিলে তাকে বরং সংশয়বাদীই মনে হতে পারে। কবি এখানে বসন্ত বলতে কলে সবুজ যৌবনকান্তিকে বুঝেছেন। পাতা ঝরা কিংবা বিলয়ও বসন্তের আরেকটি স্বভাব, বিষয়টি কবি মানতে পারেননি।
মামুনের কবিতার গুরুত্বপূর্ণ একটি বৈশিষ্ট্য হলো–প্রবাদপ্রবণতা। পঙ্ক্তিকে সমকালের প্রেক্ষাপটে স্থাপন করে, চিরকালীন ব্যঞ্জনা দেওয়ার প্রতি তার আগ্রহ সহজাত। তাই ‘দূরত্ব ঘোচে না কখনো’য় খুব সহজেই উচ্চারণ করতে পারেন–‘দূরত্ব ঘোচে না কখনো, দূরের ওই চাঁদটার মতো/ এত স্পষ্ট, তীব্র আলিঙ্গনে কেঁপে উঠছে/শিহরণে থরথর।’
মামুন রশীদের কবিতায় প্রেম, প্রকৃতি, ইতিহাস, ভূগোল একইসূত্রে গাঁথা। রাজনৈতিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক বিষয়গুলোকে তিনি অভিন্নসূত্রে বিবেচনা করেন। অর্থাৎ তার বিবেচনায় এসবই ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট। ফলে এসবই আবর্তিত হবে ব্যক্তির সুখভোগের উপকরণ হিসেবে। ব্যক্তিই নিজের মর্জিমতো সাজায় এসবের ঘূর্ণন চক্র। তিনি এসব বিষয়কে আঁকতে গিয়ে প্রায় চিত্রকল্প ও প্রবাবধর্মী পঙ্ক্তি সৃষ্টি করেন। এটিই তার কবিতার প্রধান বৈশিষ্ট্য। প্রবাদপ্রবণ পঙ্ক্তি সৃষ্টির ক্ষেত্রে তার মুন্সিয়ানা রয়েছে।
যেমন :
১। সমুদ্র রাখে না কোনো স্মৃতি (সমুদ্র রাখে না কিছুই)
২। স্মৃতির মন্দিরে কিছুই ফেলনা নয় (কিছুই ফেলনা নয়)
৩। পুরনো জুতোর মতো পুরনো বেদনা/ যত পুরনো হয়, তত বেশি স্বস্তি। (দুঃখ)
৪। প্রথম স্মৃতি সবসময়ই রঙিন (ফাল্গুনের আগে)
৫। চাবিতে ঠিকানা থাকে না ( চাবিতে ঠিকানা থাকে না)
৬। প্রতিটি ফুলের রয়েছে নিজস্ব সৌরভ (প্রতিটি ফুলের রয়েছে নিজস্ব সৌরভ)
৭। স্বাক্ষরে অক্ষর শুধু বেঁচে আছে (অক্ষর শুধু বেঁচে থাক)
৮। প্রকৃতি নিয়ম বোঝে, মানুষ বোঝে দৃশ্য (প্রকৃতি নিয়ম বোঝে, মানুষ বোঝে দৃশ্য)
৯। সময় বলে কিছু নেই। বন্ধ খামের ভেতরে বয়ে বেড়ানোর শূন্যতা শুধু (সময়)
উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলোয় মূলত চিরকালীন ব্যঞ্জনা সৃষ্টির ইঙ্গিত রয়েছে। মামুন, যা বলতে চেয়েছেন, তার চুম্বক অংশকে তিনি করে তুলতে চেয়েছেন ‘মেমোরেবল স্পিস’। কারণ, মামুন জানেন, কবিতার মূল শক্তিই হলো ‘মেমোরেবল স্পিস’ সৃষ্টি করা। না হলে তা, চিরকালের পাঠকের টেবিলে পৌঁছতে পারে না।
তবে, ছন্দের প্রয়োগে তার ঔদাসীন্য নিবিড় পাঠককে পীড়া দেয় কিঞ্চিত। কিন্তু কবিতার সামগ্রিক চিত্র সে মর্মযাতনাকে প্রশমিত করে অনেকটা। এখানেই মামুনের মৌলিকত্ব, এখানেই তার সাফল্য।
আরও পড়ুন: সাম্প্রতিক সাহিত্য