কবিতা কখন কবিতা হয়ে ওঠে? Symbolism, post-impressionism, expressionism, imagism এরূপ আরও কিছু ইজম বা ‘বাদ’-এর সমন্বয়ে নাকি ধারা অতিক্রম্য, গতিপথ পরিবর্তনীয়,স্বাতন্ত্র্যবোধ সৃষ্টির দুর্দমনীয় আকাঙ্ক্ষা উসকে দেবার শক্তিমত্তা জড়ো হলে। অবচেতনের ভাবনা যা মূলত লুকিয়ে থাকে দৃশ্য বা চিন্তার বাইরে তাকে ভাষা দেওয়াই তো কবিতার কাজ। কবি সেই ভাষা বোনেন নিজস্ব ধরনে, ধারনায়, চিন্তায় ও চারুতায়। এই নিজস্ব চলনে একজন কবি কতটা স্বতঃস্ফূর্ত, কতটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, কতটা স্বাধীন তা বুঝতে হলে তার কবিতায় দৃষ্টি দিতে হবে।
জাকির জাফরানের এই পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, সমুদ্রপৃষ্ঠা (২০০৭), নদী এক জন্মান্ধ আয়না (২০১৪), অপহৃত সূর্যাস্তমণ্ডলী (২০১৫), অন্ধের জানালা (২০২০), নির্বাচিত কবিতা(২০২০), পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম (২০২১) ও জ্যোৎস্নাসম্প্রদায় (২০২১)। এছাড়া অনুবাদগ্রন্থ রয়েছে একটি। পাওলো কোয়েলহোর আক্রায় পাওয়া পাণ্ডুলিপি (২০১৫)। কলমের পাশাপাশি তার কণ্ঠ ও চোখের প্রতিও সুবিচার করেছেন তার গায়কি ও ফটোগ্রাফির মাধ্যমে। তবে গায়ক বা চিত্রধারক জাকির জাফরানকে পাশে রেখে কবি জাকির জাফরানের কাব্যশৈলীই আজ আমার আলোচ্য বিষয়। আলোচনাটি সহজ হবে যদি আমরা কবির কবিতার শক্তিমত্তা চিহ্নিত করতে পারি, দুর্বলতার জায়গাগুলো ধরতে পারি। তার কবিতার স্বর ও সুরকে চিনতে পারি।
জাকির জাফরানের কবিতার ঋষি সত্তা, মরমি সুর আমাকে র্যাবোর সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। র্যাবোর কবিতায় সিম্বলিজমের যে উপস্থাপন, তার মাধ্যমে মূলত তিনি কবিতাকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন যাবতীয় যুক্তি, অনুশাসন ও শৃঙ্খল থেকে। ১৮৭১ সালে জর্জ ইসামবার্ডকে লেখা এক চিঠিতে তিনি লিখলেন, ‘আমি কবি হতে চাই, আর আমি নিজেকে তৈরি করছি ঋষি হওয়ার জন্য।(…) আমার ইন্দ্রিয় অনুভূতি সব পালটে দিয়ে, এ সেই অচেনার কাছে পৌঁছান। এতে কষ্ট খুব, কিন্তু কবি হয়ে জন্মালে তা সহ্য করতেই হবে, আর আমি জানি আমি কবি হয়েই জন্মেছি।’ (র্যাবো: সিলেক্টেড লেটারস, অনুবাদ: জাঁ নিকোলাস আর্থার)।
জাকির জাফরানের কবিতায় যেন সেই চিঠিরই অনুরণন,
নিজেকে সপেছি আমি
রয়ে গেছে বাউল জন্মের কিছু ঋণ,
শুধু মন নয়
আমার এ ঘুমও আজ তোমারই অধীন
(মায়া: পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম)
অথবা
…এখনো বাউল আমি
বিভূতির ঢেউ ভেঙে কত সুর ভেসে আসে আজো।
(জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়-২৭)
সরল পদবিন্যাস কবির কবিতার অনন্য শক্তি বলেই মানি। যেমনটা পাই এলুয়ারের কবিতায়। প্রেমের উচ্চারণে স্বতঃস্ফূর্ত, সুকুমার কিন্তু কী আশ্চর্য সহজি! এলুয়ারের কবিতা লিবার্টি’র দুটি লাইন পড়ে আসি চলুন,
পঠিত সব পৃষ্ঠায় আমি তোমার নাম লিখি,
না পড়া সব সাদা পৃষ্ঠায় আমি তোমার নাম লিখিএবার আসুন জাকির জাফরানের কবিতায় খুঁজি সেই সুর,
আর ধরো একটি বকুল গাছ যদি
উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে গন্ধ ছড়ায় চারিদিকে,
তবে আমি, এই আমি, তুমি বিনা, কোন দিকে যাব?
(নীলাভ স্নায়ু: অন্ধের জানালা)
অথবা
একদিন তুমি তরমুজ কেটে নিয়ে এলে
খেতে খেতে ভাবলাম
তরমুজ কাটলে দু’ভাগ হয়ে পড়ে থাকে তার লাল আকাশ।
কিন্তু হৃদয় দু’ভাগ হলে মাথার ওপরে কোনো আকাশ থাকে না।
আজ তুমি নেই
আমি আলো আঁধারির মধ্যে বসে কাঁদলাম
কেউ আর তরমুজ কেটে নিয়ে আসে না এখন
আজ সত্যি সত্যি মাথার ওপরে কোনো লাল আকাশও আর থাকলো না।
(লাল আকাশ: নদী এক জন্মান্ধ আয়না)
ছন্দ নিয়ে দ্বন্দ্ব তো আর কম নেই। নানা মুনির নানা মতের মতো ছন্দতত্ত্বের রয়েছে নানাবিধ পথ। দুই-একজন ছন্দ বিশেষজ্ঞের অভিমত জানার চেষ্টা করা যেতে পারে। তাতে আমার মতো পথহারাদের যদি কোনো দিশা মেলে। অমূল্যধন মুখোপাধ্যায় ‘যেভাবে পদবিন্যাস করিলে বাক্য শ্রুতিমধুর হয়’ তাকেই ‘ছন্দ’ বলতে চান। আবার পবিত্র সরকারের মতে ‘উচ্চারণ আর বিরামের সুশৃঙ্খল ও আবর্তনময় বিন্যাসই ছন্দ।’
সম্ভবত জাকির জাফরান এই সত্যকেই গ্রহণ করেছেন তার স্বরে ও সুধায়। ‘জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়’-এর আগ পর্যন্ত (এমনকি এই কাব্যগ্রন্থের কোনো কোনো পঙ্ক্তিতেও) ছন্দের ভাঙন তিনি রোধ করেননি। কারণ তাতে কবিতার আশ্চর্য ভাব উধাও হওয়ার সমূহ-আশঙ্কা ছিল।
কথা হলো, ছন্দ যতদিন বিজ্ঞান না হয়ে উঠবে, ততদিনে এই বিতর্ক ও বিভ্রান্তি চলতেই থাকবে। একথা অনস্বীকার্য যে, ছন্দে সিদ্ধিলাভ না ঘটিয়ে ছন্দ ভাঙার চেষ্টা অনেকটা ঢেঁকির তাল না বুঝে তার গর্তে রাখা শস্যে হাত ঢুকিয়ে দেওয়ার মতো। জাকির জাফরানের কিছু কবিতার দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক এবার৷
০১.
পাখি বরং উড়তে থাকুক
তুমি থাকো
তুমি তো আর পাখিটি নও
ফড়িঙও নও
তুমি এক ব্যর্থ মানুষ।
তারচে বরং রাস্তাটা ঠিক চলতে থাকুক
তুমি বসো
তুমি তো আর অসীম পানে
ছুটতে থাকা রাস্তাটি নও
তুমি তো এক ব্যর্থ মানুষ
করুণ সবুজ ব্যর্থ মানুষ।
(ব্যর্থ পাখির গান: অন্ধের জানালা)০২.
মায়ের জুতো পরে হাঁটছে শিশুটি
পায়ের নিচে দেখো যৌথ অবচেতন
পায়ের নিচে দেখো হাসছে মিটিমিটি
. পুরোটাই এক খেলনা-পৃথিবী
মায়ের জুতো পরে হাঁটছে শিশুটি।’
(যৌথ অবচেতন: অন্ধের জানালা)
‘অন্ধের জানালা’ থেকে একটি কবিতা ও একটি কবিতাংশ তুলে দিলাম। দু’টো কবিতাই অক্ষরবৃত্তে লেখা। প্রথম কবিতায় তিনি দ্বিতীয় ও সপ্তম লাইনে মাত্রা ভেঙে দিয়েছেন। আবার পঞ্চম লাইন ‘তুমি এক ব্যর্থ মানুষ’-এও এক মাত্রা কমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু কবিতা পড়তে গিয়ে যদি পড়তে হতো, ‘তুমি একটি ব্যর্থ মানুষ’ তাতে কবিতার দোলা হোচট খেতো।
এবার আসি দ্বিতীয় কবিতাংশে। পাঁচ মাত্রায় অক্ষরবৃত্তে লেখা এই কবিতাংশেও তৃতীয় লাইনে একমাত্রা কম ও চতুর্থ লাইনে এক মাত্রা বেশি। তাতে কবিতার নান্দনিক উপস্থাপনায় যেমন কোনো অসুবিধা হয়নি, তেমনি নিবিড় বহমান ধারাও কিছুমাত্র বিঘ্নিত হয়নি৷
এবার আরেকটি কবিতা পড়া যাক। যেটিও সাক্ষ্য দেবে তার মাত্রাজ্ঞানের যথার্থ প্রয়োগ ও ব্যবহারবিধি সম্পর্কে।
মনের ছবি দেহের গোপন বাঁকে
ভেসে ওঠে মেঘের মতো ওড়ে
পাখ-পাখিনী রঙ্গ করে বলে
ধর্মের কল অন্ধকারে নড়ে
(আগুন নিয়ে খেলা: নদী এক জন্মান্ধ আয়না)
স্বরবৃত্তের চমৎকার একটি কাজ। অতএব যে ভাঙচুর কবিতার শরীর মোহনীয় করে, পাঠকের হৃদয়তন্ত্রীতে সুরেলা ঝঙ্কার তোলে, তাকে কী ভাঙচুর বলা যায়? ‘আধুনিক কবিতার ইতিহাস’ শীর্ষক এক প্রবন্ধে অমিয় চক্রবর্তী বলেছেন, ‘ছন্দে আশ্চর্য হবার উপায় নেই, যদি তার মধ্য দিয়ে কাব্যের আশ্চর্য ভাব ছন্দিত না হয়ে থাকে।’ সম্ভবত জাকির জাফরান এই সত্যকেই গ্রহণ করেছেন তার স্বরে ও সুধায়। ‘জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়’-এর আগ পর্যন্ত (এমনকি এই কাব্যগ্রন্থের কোনো কোনো পঙ্ক্তিতেও) ছন্দের ভাঙন তিনি রোধ করেননি। কারণ তাতে কবিতার আশ্চর্য ভাব উধাও হওয়ার সমূহ-আশঙ্কা ছিল।
শুদ্ধ ও স্বয়ংক্রিয় কার্যক্রমে প্রতিভা ও উপভোগ্যতার প্রয়োগ যথাযথ না হয়ে পরস্পর বিরোধী হলে নিবিড় পাঠকের গতিভঙ্গ না হলেও কিছুটা মতিভ্রম তো হতেই পারে। আশা করি কবি বিষয়টি ভাববেন। এই যৎসামান্য শৃঙ্খল ভেঙেও বেরিয়ে আসবেন।
পদ ও পঙ্ক্তির অপরিপক্ব ব্যবহার আর জটিল, দুর্বোধ্য শব্দ বুনে যাওয়াকেই যদি উত্তরাধুনিক কবিতার ডেফিনেশন ভাবা হয়, তাহলে কবিতা যে পাঠক হারাবে, এ ব্যাপারটি বুঝতে যেমন জ্যোতিষশাস্ত্র অধ্যয়নের প্রয়োজন নেই, তেমনি অতি সরল পদবিন্যাসবিধিও একটি সার্থক বাক্যের সুনির্মিতিকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পারে। আমাদের এ কথা ভুললে চলবে না যে, কবিতায় স্বতঃস্ফূর্ত ও ঘরোয়া শব্দের আসক্তি বাঙালি পাঠকের নিকট থেকে দূর করার চেষ্টা কিছুটা কষ্টসাধ্য। একথার পরে এ প্রশ্ন আসাটাও স্বাভাবিক, কবিতা কি তবে সরল ভাষাতেই লিখতে হবে? না, এমন কথা কেউ দিব্যি দিয়ে বলেনি। তবে এটুকুও ভাবার প্রয়োজন রয়েছে সামাজিক সত্য ও সৌন্দর্য বোধ যা সৃষ্টি করে এক মায়াময় চিত্র ও রূপকল্প এবং যা সাধারণের দ্বারা আবৃত, তেমন সুধাময় শব্দরাজিই তো প্রকৃত কবিতা হয়ে ওঠে। চলুন শঙখ ঘোষের একটি কবিতা পড়া যাক:
অনেকদিন মেঘের সঙ্গে কথা বলোনি তাই এত শুকনো হয়ে আছো এসো তোমার মুখ মুছিয়ে দেই
সকলেই শিল্প খোঁজে রূপ খোঁজে আমাদের শিল্পরূপে কাজ নেই আমরা এখানে বসে দু-একটি মুহূর্তের শস্যফলনের কথা বলি
এখন কেমন আছো বহুদিন ছুঁয়ে তো দেখিনি শুধু জেনে গেছি ফাটলে ফাটলে নীল ভগ্নাবশেষ জমে আছে
দেখও এই বীজগুলি ভিখারির অধম ভিখারি তারা জল চায় বৃষ্টি চায় অতপ্রোত অন্ধকারও চায়
তুমিও চেয়েছো ট্রামে ফিরে আসবার আগে এবার তাহলে কোনো দীর্ঘতম শেষকথা হোক
অবশ্য, কাকেই-বা বলে শেষ কথা। শুধু
দৃষ্টি পেলে সমস্ত শরীর গলে ঝরে যায় মাটির উপরে, আর ভিখারিরও কাতরতা ফেটে যায় শস্যের দানায় দানায় এসো মেঘ ছুঁয়ে বসি আজ বহুদিন পর এই হলুদডোবানো সন্ধ্যাবেলা।
(তাই এত শুকনো হয়ে আছ: শঙ্খ ঘোষ)
এবার ফিরে যাই জাকির জাফরানের কিছু কবিতার অংশবিশেষে:
০১.
আমি মহিমল, আমি জলদাস, জলফসলের
দীপ্ত প্রজনন ছাড়া আর কোনো উপাসনা নাই।
(জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়: ৪২)০২.
মূলত ধানের মতো তুমি, মূলত বৃষ্টির মতো।
কার্পাস তুলার দেশে আমি বৃষ্টিনির্ভর প্রেমিক,
এসো তুমি, এক লক্ষ ছত্রিশ হাজার বৃষ্টিবিন্দু
তুমি এসো আজ। নীল নীল সুপারীর মতো চোখ,
তুমি এসো। জামদানি হৃদয় তোমার, তুমি এসো।
(জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়: ৪৫)
ভাব ও ব্যাঞ্জনার এই যে প্রাঞ্জলতাগুণ, এই যে শব্দকে নতুন করে দেখার দৃষ্টি, জীবনঘনিষ্ঠ ও সহজাত উপকরণের উর্বর উপস্থিতি, তা যেন আপন আলো ছড়ায় পাঠকের হৃদয়ে। জাকির জাফরানের কবিতায় সেই অন্তর আলো করা সহজিয়া অথচ রহস্যময় জীবনবোধের পরিচয় মেলে। অহেতুক ওজনদার শব্দে কবিতার অন্তর্নিহিত সৌন্দর্য ভঙ্গের ফলে কবিতা বিসর্জনের বেদনায় মুহ্যমান হতে হয় না পাঠককে। কল্পনাশ্রয়ী বা ব্যাঞ্জনাধর্মী শব্দের যুগোপযোগী প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজের অসঙ্গতি ও দেশকালের নৈতিক ভঙ্গুরতাকেও তিনি এক অসাধারণ প্রতীকী প্রকাশের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছেন।
০১.
কালো এ কৌতুকে আজ মজে গেছে মন।
গোস্তাখি মান করো প্রিয়। কম্পমান বাসনার মতো দুঃখিত যুবরাজ, দেখিনি কখনো। ভাল্লাগছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এ দেশ, এই ভেজা চুলের জঙ্গল। আর খেলাচ্ছলে ঘটে যাওয়া প্রথম এই মিরাকল। ভাল্লাগছে। নিচু আকাশের তলে তুমি এক এক কুহু-প্রায়। অত্যন্ত পাখি তুমি। প্রাণেরও কৈতর তুমি। মেঘ হয়ে ভাসো দেখি বিছানায়।
(প্রিয়ঝু সিরিজ-১৭: সমুদ্রপৃষ্ঠা)০২.
নদীও কূটনীতি জানে,
কথা দিয়ে কোনোদিও জল সে দেয় না,
কোনোদিনও সমুদ্রে মেশে না,
তৃষ্ণার্ত হোসেন হায়! নদী এক জন্মান্ধ আয়না।
(নদী এক জন্মান্ধ আয়না: নদী এক জন্মান্ধ আয়না)
চিত্রকল্প সেই আশ্চর্য দর্পণ, যা একজন কবির ভাব, আবেগ ও মেধার সঙ্গে এক ম্যাজিকাল মাত্রা যোগ করে। এ প্রসঙ্গের সমর্থনে সিসিল ডি লুইসের ‘দ্য পোয়েটিক ইমেজ’ গ্রন্থের ১৮তম পৃষ্ঠায় চোখ বোলানো যেতে পারে:
Every poetic image therefore is to some degree metaphorical. It looks out from a mirror in which life perceives not so much it’s face as some truth about its face.This, I know, is a controversial statement.So let us go back for a moment to the definition of an image as a picture made out of words.The commonest type of image is a visual one; and many more images,which may seem un-sensuous, have still in fact some faint visual association adhering to them.But obviously an image may derive from an appeal to other senses than that of sight.’
(Lewis, C. Day- The poetic image, Jonathon Cape, page- 18)
জাকির জাফরান সেই ম্যাজিকমাত্রা যোগ করতে সক্ষম হয়েছেন কবিতায়। বিদ্রূপ, বঞ্চনা, বিরহ; হোক তা সামাজিক, রাজনৈতিক বা আন্তর্জাতিক; পর্যবেক্ষণের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ক্ষমতা ও শব্দের কোমল ব্যবহারে কবিতাকে সমকালীন করে তোলায় তার নৈপুণ্য ও পারদর্শিতা চোখে পড়ার মতোই। তিনি যেন নিজেকেই নিজে উৎরে যেতে চেয়েছেন বারবার৷ শব্দে শান দিয়েছেন। বাক্যের প্রবাহমাত্রা ঠিক রাখতে প্রয়োজনে অসম পঙ্ক্তির আশ্রয় নিয়েছেন।
তার কয়েকটি কবিতা পড়ার পরে মনে হয়েছে, গলিত লাভা যতটা উদগীরণের অপেক্ষায় ছিল, তার কিছুটা তিনি নিজের ভেতরেই রেখে দিয়েছেন। ঠিক যতটা বিদ্রোহ একটি কবিতা দাবি করছে, অনেকটা এগিয়ে তিনি তার লাগাম টেনে ধরেছেন। ফলত কবিতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সুবিচার পায়নি। কিন্তু কেন এই অবগুণ্ঠন? কবিতার পদপাতে যে তরঙ্গোদ্বেল, অস্তিত্বের যে তীব্রতর আহ্বান, তাকে উপেক্ষা করলে বা গতিরোধ করলে, তার সেই উচ্ছ্বাস কোথাও যেন থমকে যায়। শুদ্ধ ও স্বয়ংক্রিয় কার্যক্রমে প্রতিভা ও উপভোগ্যতার প্রয়োগ যথাযথ না হয়ে পরস্পর বিরোধী হলে নিবিড় পাঠকের গতিভঙ্গ না হলেও কিছুটা মতিভ্রম তো হতেই পারে। আশা করি কবি বিষয়টি ভাববেন। এই যৎসামান্য শৃঙ্খল ভেঙেও বেরিয়ে আসবেন।
একটি কাব্যগ্রন্থ নিয়ে আলাদা করে কথা বলতে চাই। যে কাব্যগ্রন্থটি কবিকে আলাদা করে এবং অনেকটা নতুন করেই কবিকুল আর পাঠককুলের সামনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে। উপনিষদের ‘অন্তরতমহৃদয়মাত্মা’র প্রতিধ্বনি কবির বাউল মন যেন অনুভব করেছিল এক ভিন্নতর দৃষ্টিকোণ থেকে। বলতে চাই, কবির সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়’ নিয়ে। এই কাব্যের সমস্তের ব্যাখ্যা স্বল্পে অসম্ভব। ‘আমারই হাতে এত দিয়েছ সম্ভার’, কিন্তু কোথায় সে সম্ভার? কেন কবিতায় এতদিনেও মেলেনি এমন শব্দসঙ্গম? হাহাকার ছিল এ কারণেই। হঠাৎই ‘জোৎস্নাসম্প্রদায়’য়ের কবি যেন তার জোৎস্নার তীর হাতে দাঁড়ালেন কবিতার মণ্ডপে। ‘জীর্ণ করে ওকে কোথায় নেবে?’-এমন বীরত্বেই যেন কবিতার মোহনীয় আগুনে হাত বাড়িয়ে দিলেন। শুধু যে হাত বাড়ালেন, এমন নয়। এরকম হাত তো অনেকেই বাড়িয়েছেন; আগুন নিয়ে খেলেছেন, ডানা পুড়িয়েছেন। কিন্তু নিজেকে আগুনে উৎসর্গ করে কাব্যের সেই আগুনের সঙ্গেই আগুন সাক্ষী করে সাতপাঁকে সংসার বেঁধেছেন এই জোৎস্নাসম্প্রদায়ের কবি। আমরা পেলাম গোটা বাংলার সৌর্য, বীর্য, প্রেম, অহঙ্কার, ঐতিহ্য ও পরম্পরার এক অনির্বচনীয় চিত্রসুধা। আঙ্গিকে এক পৌরাণিক দেহবল্লরী, অনুপ্রাসে এক শ্যামার হৃদকম্পন, ভাব ও ভাষায় অরুণ্যের গভীরতা, চিত্রকল্পে এক মায়া হরিণী। এই তো জোৎস্নাসম্প্রদায়!
বাগানে হাজারো বৃক্ষের ছায়ার দিকে তাকালে ছেঁড়াছেঁড়া ছায়ায় বোঝা মুশকিল, কোনটি কোন বৃক্ষের ছায়া। শুধু সুপুরি গাছের ছায়াই দীর্ঘ, একক আর স্বকীয়। কবির এই যাত্রা জারি থাক।
বিনয় মজুমদারের আগেও ওমর খৈয়াম, এমিলি ডিকিনসন প্রমুখ কবিরা গণিতের সঙ্গে কবিতার যোগসূত্র ঘটিয়েছেন। কিন্তু এই মেলবন্ধন ও সার্থক নির্মিতি খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়। জাকির জাফরানের এই কবিতাটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে এমন মেলবন্ধনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে কাব্যজগতে প্রতিনিধিত্ব করবে বলেই আস্থা রাখি।
সুররিয়ালিস্ট সালভাদোর দালি (১৯০৪-১৯৮৯) কিউবিজম, ফিউচারিজম ও মেটাফিজিক্যাল পেইন্টিংয়ের অনবিচ্ছিন্নতায় সৃষ্টি করেন এমন এক স্যুরিয়ালিস্টিক আবহ, শিল্পকলার ইতিহাসে যা এখনো বিস্ময়কর। ‘দ্য পারসিসটেন্স অব মেমোরি’ দালির সবচেয়ে আলোচিত ছবি। এ ছবির প্রধান চরিত্র ঘড়ি। সাদা গলিত পনিরের দিকে চেয়ে জগৎশ্রেষ্ঠ দূরাভিসারী (ভিশনারি) দালির মনে হলো সময় এভাবেই চলছে, গলে পড়ছে, রূপান্তরিত হচ্ছে। ক্রমে গলিত পনিরের জায়গায় উপস্থিত হল ঘড়িগুলো। সময়ের অস্থিরতার স্মারক ঘড়িগুলোর কোনোটাই সদর্থকতার ইঙ্গিত দেয় না।
অনেকগুলো ঘড়ির অভিব্যক্তিতে যুক্তির অতীত এবং কালাতীত অবস্থাকেও দালি ধরতে চেয়েছেন। এখানে সময় প্রাগৈতিহাসিক কোনো প্রাণীর মতো। কোথাও সময় ঝুলে পড়েছে কাপড়ের মতো, কোথাও গলে পড়েছে মাখনের মতো।
ঘড়ির যে গোলাকার ডায়াল সময়ের ঘূর্ণমানতাকে প্রকাশ করে, সেই বৃত্তের বেড়ি ভেঙে পড়েছে এই ছবিতে। সালভাদর দালির সেই গলিত ঘড়ির মতো জাকির জাফরানের কবিতাও বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে পড়ছে। পাঠককে কল্পনাশক্তির দোরগোড়ায় পৌঁছে দিচ্ছে। জাকির জাফরানের প্রতিটি কাব্যগ্রন্থকে এক-একটি ঘড়ি মনে হয়েছে। কোনোটি থেকে ‘অপহৃত হচ্ছে সূর্যাস্তমণ্ডলী’, কোনোটি থেকে ‘সমুদ্রপৃষ্ঠা’র জল গড়িয়ে পড়ছে, কোনোটি অন্ধ হয়ে জানালার পাশে বসে ভাবছে ‘নদী এক জন্মান্ধ আয়না’। আর কোনো কোনোটি এক ‘জ্যোৎস্নাসম্প্রদায়’, যার ‘পায়ে বাঁধা দুটি সর্বনাম’।
শেষ করবো জাকির জাফরানের এমন একটি কবিতায় পরিভ্রমণের মধ্য দিয়ে, যেটি তাকে সমকালীন কবিদের থেকে বেশ কিছুটা আলাদা করেছে। শুধু আলাদা করাই নয়, কবিতায় তার আধুনিকতা ও অতীন্দ্রিয়তার সাক্ষ্য বহন করে তাকে নিয়ে গেছে এক ভিন্নতর জগতে। মালার্মে, যাকে আধুনিকতার পুরোহিত বলে জানেন ও মানেন, বিশ্ব তার কবিতার সংজ্ঞা অনুসারেই এই কবিতাকে সম্পূর্ণভাবে আধুনিক এবং বিনয় মজুমদার কবিতার সঙ্গে গণিতের যে মেলবন্ধন নির্মাণ করেছেন, সেই সূত্রে ফেললে এই কবিতাকেই জীবন ফর্মুলায় ফেলা যায় নিঃসন্দেহে। মালার্মের মতে, ‘অস্তিত্বের রহস্যের অর্থ মানবিক ভাষার ছন্দে প্রকাশই কবিতা,আর এভাবেই তা আমাদেরকে নির্ভরতা দেয়, আর সেই আমাদের একমাত্র আধ্যাত্মিক কাজ।
বিনয় মজুমদারের মতে, ‘রূপ থেকে অরূপে আসা আবার অরূপ থেকে রূপে ফিরে যাওয়া রূপের সহিত অরূপের পারস্পরিক সম্পর্ক; এসকল বিষয় অত্যন্ত মূল্যবান। গণিতশাস্ত্রেও ঠিক একই ব্যাপার ঘটে। কোন রূপের নির্যাস রূপে থিওরেম বা ফর্মুলা তৈরি করা হয়। অতঃপর সেই থিওরেম বা ফর্মুলা যত খুশি রূপ ফিরে পাওয়া যায়।’
বিনয় মজুমদারের আগেও ওমর খৈয়াম, এমিলি ডিকিনসন প্রমুখ কবিরা গণিতের সঙ্গে কবিতার যোগসূত্র ঘটিয়েছেন। কিন্তু এই মেলবন্ধন ও সার্থক নির্মিতি খুব কমই খুঁজে পাওয়া যায়। জাকির জাফরানের এই কবিতাটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে এমন মেলবন্ধনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে কাব্যজগতে প্রতিনিধিত্ব করবে বলেই আস্থা রাখি।
সাত পঙ্ক্তি আর দুই স্তবকের এই কবিতার পরে আর কিছু না বলাই ভালো। কবিতার রেশটুকু বাজতে থাকুক পাঠকের কর্ণকুহরে:
আজ বাবা অঙ্ক শেখাচ্ছিলেন
বললেন, ধরো, ডালে-বসা দুটি পাখি থেকে
শিকারির গুলিতে একটি পাখি মরে গেলো
তবে বেঁচে থাকলো কয়টি পাখি?অঙ্কের বদলে এই মন চলে গেলো
বেঁচে থাকা নিঃসঙ্গ সে-পাখিটির দিকে
আর মনে এলো তুমি আজ স্কুলেই আসোনি।
(চিঠি: সমুদ্রপৃষ্ঠা)
আরও পড়ুন:
মোহাম্মদ নূরুল হকের প্রবন্ধ: যুক্তির শৃঙ্খলা ও শিল্পের দায় ॥ আজিজ কাজল