পর্ব-৪
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র ও অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
সবেমাত্র এমএ পরীক্ষা দিয়েছি। ফল প্রকাশের অপেক্ষা। এমতাবস্থায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হল ছেড়ে দেই। একটা প্রকাশনীতে মাসদেড়েক খণ্ডকালীন চাকরি করার পর হঠাৎ একদিন সিইও স্যার আমাকে ডেকে বললেন, কাল থেকে আপনাকে আর অফিসে আসতে হবে না।
জীবনের প্রথম চাকরি এভাবে আচমকা চলে যাওয়ায় খুব কষ্ট পেয়েছি। যে অপরাধে আমার চাকরি চলে যায় তা হলো, লাঞ্চ করার পর অফিসের ডেস্কে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়া। এটা নাকি সিসি ক্যামেরায় সিইও দেখেছেন। আসলে এই তথ্য এইচআর সেকশনের দায়িত্বে থাকা ম্যাডাম গোপনে আমাকে বলেছেন। সত্য-মিথ্যা জানি না। সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা তরুণের দুপুরে খাওয়ার পর একটু ভাতঘুম দেওয়া লাগে, এটা অফিস বুঝবে কেন? ফলে চাকরিটা আর রক্ষা করা গেলো না।
চাকরি হারিয়ে যখন আমি নিজেকে নিঃস্ব ভাবছিলাম, তখন মেসে থাকা সাঈদ ভাই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে চাকরির আবেদন করতে বললেন। আবেদন করলাম। ডাকযোগে ইন্টারভিউ কার্ড হাতে এলো। জীবনে প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ কার্ড হাতে পেয়ে খুব রোমাঞ্চিত হলাম। বলা যায়, এটাই প্রথম চাকরি। কারণ চলে যাওয়া চাকরিটা শ্যামল ভাইয়ের রেফারেন্সে হয়েছিল। সেখানে চাকরি পাওয়ার গতানুগতিক প্রক্রিয়ার মুখোমুখি আমাকে হতে হয়নি।
যাই হোক, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ইন্টারভিউ কার্ড সঙ্গে নিয়ে ভাইবা পরীক্ষা দিতে গেলাম। নির্দিষ্ট সময়ে গিয়ে হাজির হলাম বাংলামোটরে কেন্দ্রের অফিসে। ভেতরে ভেতরে রাজ্যের ভয় জমা। ভাইবা কক্ষে ঢুকে দেখি স্বয়ং আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বসে আছেন। মনের মধ্যে যে ভয় এবং উৎকণ্ঠা ছিল সেটা চেয়ারে বসার খানিক সময় পরেই উধাও হয়ে গেলো। কারণ তিনি যখন বললেন, বসো ফারুক, চাকরি হোক বা না হোক, তুমি-আমি মুখোমুখি বসে কথা বলছি, এটাই বা কম কিসে। তুমি কেমন আছ?
তার কথায় বরাবরের মতো তখনো আপ্লুত হলাম। রুমে তিনি ছাড়াও সম্ভবত প্রজেক্টের সমন্বয়কারী কামাল ছিলেন। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের স্বভাবসুলভ জাদুকরি বাকচাতুর্যে আমি ভীষণ প্রণোদিত হলাম। সবশেষে তিনি বললেন, লেখালেখি যেহেতু করো, বেশি করে বই পড়বে। বই, বই এবং বই। আচ্ছা বলো তো, এই যে চাকরির সাক্ষাৎকার পরীক্ষা দিয়ে গেলে, ধরো তোমার চাকরিটা হলো না, তবু মনকে তুমি কী বলে সান্ত্বনা দেবে?
বললাম, স্যার, আপনার সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলার সুযোগ হয়েছে। এটাই বা কম কিসে! এই সময়টুকু আমার জীবনে স্মরণীয় স্মৃতিসঞ্চয়। তিনি মুচকি হেসে বললেন, আচ্ছা তুমি এবার বাইরে অপেক্ষা করো।
বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মোবাইল লাইব্রেরি প্রজেক্টে চাকরি পেলাম। ২০০৮ সালের ২৯ মে কাজে যোগ দিলাম। পোস্টিং ময়মনসিংহ। প্রথমেই মন দমে গেলো। যাবো? শেষমেশ স্থির করলাম, যাবো। সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতা; কিছুই চেনাজানা নেই। নতুন অফিসের নতুন সহকর্মী সাঈদ ফরাজি ভীষণ ভালো মনের মানুষ। তার বাড়ি আবার ময়মনসিংহে। আশ্বস্ত হলাম। বাসা জোগাড়, টাউন হল মোড় থেকে ১২০০ টাকা দামের কদম কাঠের চৌকি, চেয়ার, টেবিল ইত্যাদি কাজগুলো ঢাকায় বসে করে দিলেন তার বন্ধু রবিনকে দিয়ে। ব্যাগ বোচকা নিয়ে রওনা দিলাম।
মহাখালী-টাঙ্গাইল বাস টার্মিনালে গিয়ে ময়মনসিংহগামী সৌখিন পরিবহনে আরামসে সিট নিলাম। চলতিপথে টঙ্গী, গাজীপুর, ভালুকা ও কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিবিজড়িত ত্রিশাল দেখলাম। খুব ছোটবেলায় স্কুলের বাংলা বইয়ে দুখু মিয়া নামের কবি নজরুলকে নিয়ে যে গল্প পড়েছিলাম, সেখানে ত্রিশালের দরিরামপুর হাই স্কুলের কথা পড়েছিলাম। তাই ত্রিশাল পেরিয়ে যাওয়ার সময় কিছুটা নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত হলাম।
মাসকান্দা বাসস্ট্যান্ডে নেমে রিকশা নিলাম। পথিকের উৎসুক চোখে দেখছি মফস্বল শহরের বাড়িঘর, জমিজমা। নয়াপাড়া, চরপাড়া, ময়মনসিংহ সরকারি মেডিক্যাল পার হয়ে ঢুকে যাচ্ছি, ক্রমশ ঢুকে যাচ্ছি শহরের পেটে। এদিকে বাড়ি থেকে মায়ের আতঙ্কিত বার্তা, তুই মমিনসিং গেলি ক্যা? হিয়ানো মাইনসে নাকি জোর করি বিয়া হড়াই দেয়। আমি মনে মনে হাসি। রিকশা গাঙিনাপাড় পার হলো। মায়ের ফোন রেখে রিকশাচালককে জিজ্ঞেস করলাম, মামা, কথা কি সত্য?
-কী মামা? সে জানতে চায়।
বললাম, ময়মনসিংহে নাকি জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়?
সেও হাসে, কে কইছে? আমারে জিগায়।
আমি বললাম, আমার মা বলেছেন।
মামা, সাবধানে থাউন যে!
সত্য মিথ্যা জানি না। সেই মুহূর্তে ভেতরে ভেতরে সাবধান হয়ে শার্টের বোতাম লাগিয়ে নিলাম।
নির্দেশনা অনুযায়ী রিকশা যাচ্ছে। সানকিপাড়া শেষমোড় এসে থামলো।
এভাবেই বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের আলোর ফেরিঅলার দায়িত্বে আমিও নিয়োজিত হয়ে গেলাম। টানা দুই বছর কেন্দ্রের নানা কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত থেকেছি। বইপড়ার পাশাপাশি ময়মনসিংহ-নেত্রকোনা ইউনিটের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নানা ধরনের শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ক অনুষ্ঠান করেছি। শিখেছি অনেক কিছু। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সান্নিধ্য পেতাম মূলত ষান্মাসিক কর্মী সম্মেলনে। তার স্বভাবসুলভ বৈদগ্ধ্যপূর্ণ অথচ হাস্যরসসমৃদ্ধ কথাগুলো জীবন ও শিল্পপথের পাথেয় হয়ে রইলো। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রর সংস্পর্শে থেকে শিল্প-সাহিত্যের সৌরভ পেয়েছি। জন্মদিনে অশেষ শুভকামনা স্যার। আপনি দীর্ঘায়ু হোন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের জন্য ভালোবাসা।
রবীন্দ্রগবেষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আকরম হোসেনের সঙ্গে মহত্তম স্মৃতি-সঞ্চয়
সময়: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১০। এই দিনটি আমার মতো এই সামান্য লেখকের জন্য একটি অসামান্য ঘটনা বটে। কারণ, সেদিন আমি এমন একজন বরেণ্য ব্যক্তির সামনে প্রবন্ধ পাঠ করার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছি, যা আমার জীবনে মহত্তম স্মৃতি-সঞ্চয় হিসেবে সযত্নে থাকবে। তিনি হলেন সর্বজন শ্রদ্ধেয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. সৈয়দ আকরম হোসেন। আমি তার সরাসরি ছাত্র নই। কিন্তু সেদিনের অনুষ্ঠানে তার অসাধারণ বয়ানভঙ্গি দেখে-শুনে মুগ্ধ হয়েছি। তার মতো নিরহঙ্কার ও আন্তরিক শিক্ষক সত্যিই বিরল।
তখন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে চাকরির সুবাদে ময়মনসিংহে ছিলাম। ‘রবীন্দ্র-মেলা উদযাপন পর্ষদ, ময়মনসিংহ’ আয়োজিত তিন দিনব্যাপী রবীন্দ্র-মেলা-১৪১৬ অনুষ্ঠানের প্রথম দিনে আমার ‘রবীন্দ্রনাথ: সমগ্রতাস্পর্শী শিল্পপ্রতিভা’ প্রবন্ধ পাঠ করি। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। মঞ্চে বসে ছিলেন অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি অধ্যাপক ড. সৈয়দ আকরম হোসেন। আলোচক হিসেবে ছিলেন অধ্যাপক সুমিতা হোম রায় ও অধ্যাপক নজরুল হায়াত।
আকরম হোসেন তার বক্তব্যে আমার প্রবন্ধের প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলেছেন। প্রশংসা করেছেন। অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার আগেই তার অনুমতি নিয়ে ঢাকায় ফিরতে চাইলাম। কারণ পরের দিন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে আমার চাকরির ভাইবা আছে। প্রথম পরিচয়ে আমাকে অবাক করে দিয়ে তিনি বললেন, ‘অনুষ্ঠান শেষে আমিও ঢাকা যাবো। তাড়া না থাকলে আমার গাড়িতে যেতে পারো।’ নিজে থেকে ডেকে তার ব্যক্তিগত গাড়িতে করে ঢাকায় নিয়ে এলেন। তিন ঘণ্টার জার্নিতে জানলাম, শিখলাম অনেক কিছু। এই ঘটনা আমার জীবনে মহত্তম স্মৃতিসঞ্চয় হয়ে রইলো।
চলবে…
করাতের কথা-৩॥ ফারুক সুমন