পর্ব-১.
ক.
করাতের কথা
করাত। শব্দটি লেখা কিংবা দেখামাত্র আমাদের চোখে কাঠচেরাইয়ের একটা হাতিয়ারের ছবি ভেসে ওঠে। খাঁজকাটা এই হাতিয়ার দিয়ে কাঠচেরাইয়ের সময় অদ্ভুত শব্দ হয়। এই শব্দ শ্রবণে আমি যেন বেদনাহত হই। করাত আস্ত গাছের বুক বিদীর্ণ করে। চেরাইয়ের পর নতুন নাম হয় কাঠ। যা দিয়ে বিচিত্র সব আসবাবপত্র। ভাবতে অবাক লাগে, গাছ নিজেকে উৎসর্গ করে মানুষের প্রয়োজনে। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব বলে এসব স্বাধীনতা ভোগ করে।
একদিন গ্রীষ্মের দুপুরে রমনাপার্কের মাঝখান দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম। আমাদের আঞ্চলিক ভাষায় যাকে বলে ‘কোনাইচ্ছা পথ’। হঠাৎ কাঠচেরাইয়ের শব্দ কানে আসে। কাছে গিয়ে দেখি বড় একটি গাছের গোড়ায় দুজন মানুষ দুদিক থেকে বিরামহীনভাবে করাত টেনে যাচ্ছে। চোখের সামনে ধীরে ধীরে একটি জীবন্ত গাছ মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। জীবন্ত বৃক্ষের এমন লুটিয়ে পড়ার দৃশ্য দেখে মন খারাপ হয়। কাঁটাযুক্ত করাতের দিকে চোখ পড়ে। অবশ্য কাঁটা না বলে ‘করাতের দাঁত’ বলা ভালো। কারণ এই নামটি বেশি প্রচলিত। তাকিয়ে দেখি দাঁতগুলো কেমন চকচক করছে। যেন দন্তবিকশিত নিষ্ঠুর হাসি। অন্যকে বিদীর্ণ করার হাসি।
সেদিন বাড়ি ফিরে ‘করাতের কথা’ লিখতে শুরু করি। না, এটা ফিকশনধর্মী কোনো গদ্য নয়। প্রবন্ধ-নিবন্ধের ক্যাটাগরিতেও ফেলা যাবে না। কলাম? না তাও নয়। এই গদ্য ‘ব্যক্তিগত গদ্য’। কেউ কেউ এ ধরনের গদ্যকে ‘মুক্তগদ্য’ বলে আরাম বোধ করেন। যে নামেই ডাকি না কেন ক্ষতি নেই। আরাম বোধ হলেই ভালো।
করাত সম্পর্কিত যৎসামান্য ভূমিকা একারণেই দিলাম। উপমা, রূপক কিংবা প্রতীকের দ্যোতনায় করাত আসলেই অন্যরকম ভাবনা জোগায়।
করাতের কথা একজন কবির মনোবেদনার উদ্ভাস। স্মৃতি-অভিজ্ঞতা-উপলব্ধি-আনন্দ-বেদনা কিংবা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। সমকালীন নানা ঘটনার নির্যাস। কখনওবা দিনলিপির আঙ্গিকে উপস্থাপিত হয়েছে। আছে তথ্য, যুক্তি ও বিশ্লেষণ। ‘করাত’ যেহেতু একা একা কাটতে পারে না। অন্য কেউ তাকে দিয়ে কেটে বিদীর্ণ করে বৃক্ষের বুক। ফলে এই বিবেচনায় ‘করাত’ মূলত বোবা এবং প্রতিবাদে অপারগ। ‘করাতের কথা’ শিরোনামের লেখাগুলো এই বোবা ও অপারগতার ভাষাপ্রকাশ। ব্যক্তি-করাতের আর্তনাদ।
যেহেতু ‘করাতের কথা’ ব্যক্তিগত গদ্য। সেহেতু ‘করাত’ সম্পর্কে আরও দুচার কথা বলা বোধহয় বেঠিক হবে না। ছোটবেলায় বাবার মুখে ‘করাত-মাছ’-এর নাম শুনে বিস্মিত হয়েছি। কিন্তু বড়বেলায় উপনীত হলেও এই মাছ এখনো সরাসরি দেখার সুযোগ হয়নি। ‘করাত-মাছ’ ইংরেজিতে ‘কারপেন্টার হাঙর’ নামে পরিচিত। বৈজ্ঞানিক নাম প্রিসটিস পেকটিন্যাটা (Pristis pectinata)। ছবিতে দেখেছি, করাত মাছের নাক কিছুটা লম্বা আর চ্যাপ্টা। নাকের দুই পাশে করাতের মতো অনেকগুলো ধারালো দাঁত আছে। মূলত এগুলো দিয়ে সে ছোট প্রজাতির মাছকে ভয় দেখায়। করাতের মতো লম্বা দাঁত থাকলেও এই মাছ নাকি ভীষণ ভদ্র। আক্রমণের শিকার না হলে এরা কাউকে বিরক্ত করে না। অবশ্য সমুদ্রের হাঙর এবং ডলপিন দেখলে করাত-মাছ আত্মরক্ষার্থে পালিয়ে যায়। পালাতেই পারে। প্রাণ হারানোর ভয় কার না আছে?
অবশ্য ‘শাঁখের করাত’ কিন্তু ভয়ংকর। দুই দিক দিয়েই কাটে। এই কারণে লোকসমাজে ‘শাঁখের করাত’ নামে একটি বাগধারা প্রচলন আছে। এই করাতের দুই দিকে ধার বিদ্যমান। উভয় সংকটের অবস্থা প্রকাশে ‘শাঁখের করাত’ দারুণ অর্থবহ। যেমন ‘জলে কুমির, ডাঙায় বাঘ’। শঙ্খবণিক বা শাঁখারিরা শাঁখ থেকে চুড়ি, অলঙ্কার, বালা ও বোতাম তৈরি করে। মূলত এগুলো তৈরির নিমিত্তে প্রয়োজন শাঁখের করাত। বৈষ্ণব পদাবলির কবি চণ্ডীদাস রাধিকার অসহায়তা প্রকাশ করার জন্যে অনুরূপ একটি পদও লিখেছেন-
সুজনের সাথে আনের পিরিতি
কহিতে পরাণ ফাটে।
শঙ্খ বণিকের করাত যেমন
আসিতে যাইতে কাটে।
শাঁখের করাতের ফেরে পড়ে ত্রাহিত্রাহি অবস্থার শিকার হয়নি এমন মানুষ কমই আছে। তবে ‘করাত-মাছি’ নামে একপ্রকার পোকাও কিন্তু গাছের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। জীববিজ্ঞানের এক সহকর্মী আমাকে জানালেন, এই পোকা পাতার শিরা ছাড়া পুরো পাতাই খেয়ে ফেলে। ফলে পাতা কঙ্কালসার হয়ে একসময় পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। করাত সম্পর্কিত যৎসামান্য ভূমিকা একারণেই দিলাম। উপমা, রূপক কিংবা প্রতীকের দ্যোতনায় করাত আসলেই অন্যরকম ভাবনা জোগায়।
খ.
ভালোবাসা, বুঝ-অবুঝের ঘরবসতি
অন্য সবার মতো ভালোবাসা নিয়েও করাতের তুমুল আগ্রহ। প্রিয়জন কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে করাতের করুণ দিন যাচ্ছিল। বেদনাহত করাত ঘরের এককোণে বসে একা-একা সান্ত্বনা খোঁজে। যুক্তিতর্ক কিংবা বিশ্লেষণ করে ভালোবাসার তল খুঁজে পাওয়া কঠিন। রুচি কিংবা অভিরুচি অনুযায়ী ভালোবাসার উপলব্ধিও জনে জনে আলাদা। বলি কী, ভালোবাসা হলো সুবিশাল আকাশে চাঁদ দেখার মতো। যিনি যখন যে পরিস্থিতিতে চাঁদ দেখেছেন, তিনি সেই অনুযায়ী চাঁদ দেখার অভিজ্ঞতা ও অনুভূতি প্রকাশ করবেন এটাই স্বাভাবিক। কেউ যদি বাড়ির ছাদ, সমুদ্রপাড়, পাহাড়চূড়া কিংবা পুষ্পবিতানে বসে বিপুল রোমান্স নিয়ে চন্দ্রযাপন করেন। তার দেখা অনুভূতি নিশ্চয় অ-রোমান্টিক, পোড়খাওয়া, বিপদগ্রস্ত, ক্ষুধার্ত কিংবা ব্যক্তিগত হতাশায় চাঁদদেখা ব্যক্তির অনুভূতির সঙ্গে মিলবে না। তবে এই কাতারে সৃজনশীল ও অপার্থিব ভাবাদর্শে উদ্বোধিত মানুষকে রাখা যাবে না। কারণ তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণ সক্ষমতা গতানুগতিক মানুষের ঊর্ধ্বে।
গোলাপের নামে একটা বিষবৃক্ষ আমারর পরিচর্যায় বেড়ে উঠেছে মাত্র।
ফলে, ভালোবাসা হচ্ছে বুঝ-অবুঝের ঘরবসতি। কম্প্রোমাইজ। নিঃস্ব হয়ে হাওয়ায় ভেসে থাকার নাম ভালোবাসা। না পাওয়ার মাঝেও পাওয়ার আনন্দ মেনে নিয়ে প্রেমের বিষবাণে জর্জরিত হওয়ার নাম ভালোবাসা। লবণ ছাড়া তরকারি রান্না করে পাতে দিলেও বলতে হবে ‘আহ অমৃত খেলাম।’ বাজার থেকে পচা মাছে কিনে আনলেও বলতে হবে ‘এমন টাটকা মাছ কোথায় পেলে সোনা? জীবনে এমন মাছ কমই দেখেছি।’ এসব কারণে যারা ভালোবাসে তারা মিথ্যুকও বটে। প্রেমাস্পদকে খুশি করার জন্যে এই ধরনের মিথ্যা বলা জায়েজ আছে।
যেই মুহূর্তে প্রথম দুজন মানুষ পরস্পরকে ভালোবাসার স্বীকৃতি দেয়। সেই মুহূর্তটাই ভালোবাসার পরিপূর্ণ শীর্ষাসন। তারপর তারা যতই কাছাকাছি হয় ততই পরিপূর্ণ শীর্ষাসন থেকে শুরু হয় পতন। পাওয়া-না পাওয়ার হিসাবে ভালোবাসা বিবর্ণ হতে থাকে। তুমুল ভালোবাসা সত্ত্বেও পরিবেশ-পরিস্থিতির চাপে দুজনের মনে প্রশ্নবাচক (?) চিহ্নের জন্ম হয়। প্রশ্নবাচক চিহ্ন দেখতে অনেকটা সাপের ফণার মতো। ছোবল দেওয়ার ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকে। ‘তোমাকে ভালোবেসে কি পেয়েছি?’ এমন প্রশ্ন সারাক্ষণ মনে গুঞ্জরিত হয়। পরস্পরের তনুমন ছুঁয়ে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি হয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। একারণে করাত মনে করে, অধরা ভালোবাসাই উত্তম। ‘ভালোবাসা মিলনে মধুর হয়, বিচ্ছেদে উজ্জ্বল’।
সবসময় প্রাপ্তির হিসাব ভালোবাসায় না-ও থাকতে পারে। এমনও তো হতে পারে, আমি ভুল মানুষকে ভালোবেসেছি। গোলাপের চারা ভেবে যাকে দীর্ঘদিন পরিচর্যা করেছি। একদিন হঠাৎ আবিষ্কার করি এটা গোলাপ গাছ নয়। গোলাপের নামে একটা বিষবৃক্ষ আমারর পরিচর্যায় বেড়ে উঠেছে মাত্র।
প্রেম-ভালোবাসা বিষয়ে করাতের শেষ কথা- প্রেমে প্রাপ্তি নয়। ত্যাগেই নিহিত আছে প্রেমতীর্থ।
(চলবে)