‘কথা বলার সময়-অসময়জ্ঞান’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু কিভাবে?
মানুষ কথা বলবে, প্রাণী হিসেবে এটা তার জন্মগত অধিকার। আবার রাষ্ট্রও তার নাগরিকদের বাক্-স্বাধীনতার অধিকার স্বীকার করেছে। আপাতত সরল সত্য, সভ্য রাষ্ট্রের নাগরিকরা ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবনযাপন সম্পর্কে নিজ-নিজ অভিমত প্রকাশ করবে স্বাধীনভাবে, নির্ভয়ে; সংশয়হীন চিত্তে। কিন্তু গভীরভাবে চিন্তা করলে সমাজে ভিন্নচিত্রও চোখে পড়বে। অর্থাৎ মানুষ কথা বলে বটে, কিন্তু সব শ্রেণীর মানুষ একই রকমভাবে কথা বলতে পারে না।
সমাজ-শ্রেণী-স্তরভেদে মানুষের কথা বলার ধরন, প্রকাশের ধরন, শব্দ ব্যবহারের ধরন ভিন্ন। অর্থাৎ সুনির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে একজন কৃষক যে ধরনের শব্দ ব্যবহার করে কথা বলেন, একজন শিক্ষক সেভাবে বলেন না। আবার একজন মোটরশ্রমিক যেভাবে বলেন, একজন রাজনীতিবিদ সেভাবে বলেন না।
শিল্পপ্রেমীরা নিজের রোমান্টিক মনোভাব প্রকাশে গান-কবিতার চরণ-পঙ্ক্তির ব্যবহার করলে একজন রাজনীতিবিদ নিশ্চয় সেভাবে করেন না। শিল্পস্রষ্টা রোমান্সকর মুহূর্তে তার সঙ্গীকে যখন বলেন, ‘গায়ে আমার পুলক লাগে, চোখে ঘনায় ঘোর’ ঠিক তখন শিল্পরসিক বলেন, ‘আমি ধন্য হয়েছি ওগো ধন্য/ তোমারই প্রেমেরই জন্য’। আবার একজন শ্রমজীবী মানুষ প্রেমের দুর্বল মুহূর্তে বলবেন, ‘তোমাকে না পেলে আমি মরে যাবো’, একজন রাজনীতিবিদ বলবেন, ‘তুমি আমার যোগ্য সঙ্গী। দলে তোমার জন্য বিশেষ পদ-পদবির ব্যবস্থা করবো’। আবার একজন সম্পন্ন কৃষক হয়তো তার নববধূকে বলবেন, ‘এবার ইউনিয়ন বোর্ড অফিসের পাশের জমিটা তোমার নামে লিখে দেবো।’ অর্থাৎ ব্যক্তি তার পুলকমুহূর্তে সঙ্গীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে গিয়ে প্রগলভ হয়ে ওঠে। কিন্তু সেই আবেগ প্রকাশে একেক শ্রেণীর মানুষ একেক ধরনের শব্দ-বাক্য ব্যবহার করেন। এরমধ্যে শিক্ষিত-শিল্পী-শিল্পপ্রেমীরা নিজের মনের কথা নিজের তৈরি বাক্যবন্ধে প্রকাশ করেন না, অন্যের বানানো কথায় প্রকাশ করেন। আবার কৃষিজীবী ও শ্রমজীবীরা প্রায় ‘সংস্কারহীনভাবেই’ প্রকাশ করেন। অর্থাৎ শিল্পী-শিল্পপ্রেমী-শিক্ষিত শিক্ষিত শ্রেণী ‘হৃদয়ের কথা বলিতে ব্যাকুল’, কিন্তু নিজের সাদামাটা আবেগসঞ্জাত ভাষায় নয়; অন্যের পরিশীলিত বাণীতে। আর কৃষিজীবী-শ্রমজীবীরা মনের ভাব প্রকাশের নিজের মনের কথা দিয়েই। এই দিক থেকে বিচার করলে প্রথম শ্রেণী অসততার আশ্রয় নেয়, কিন্তু দ্বিতীয়শ্রেণী হৃদয়ের কাছে, নিজের কাছে, অন্যের কাছে শতভাগ সততার সঙ্গে নিজেকে উপস্থাপন করে।
এ তো গেলো, প্রেম ও প্রেমালাপ সংক্রান্ত কথা বলার অনুষঙ্গ। কিন্তু জগতে কেবল প্রেমই একমাত্র বিষয় নয়, যার ওপর নির্ভর করে মানবজাতিকে টিকে থাকতে হয়। মানবাজাতির জন্য করার মতো আরও বহু কাজ রয়েছে। আরও দায়িত্বও রয়েছে। কারণ জীবন কাব্য নয়, গানও নয়। আবার জীবন তপ্ত-ঊষর মরুও নয়। জীবনের এসবের মিলিত রূপ। আবার একই মানুষেরও অনেক রূপ থাকে। যে মানুষ প্রেমিক, তিনি আবার সৈনিকও হতে পারেন, হতে পারেন কৃষক কিংবা আইনজীবী কিংবা ব্যবসায়ী কিংবা রাজনীতিবিদ অথবা শিক্ষক। আবার এমনও হতে পারে একজন মানুষেরই দু্ই বা তিন বা ততোধিক সত্তা রয়েছে। একইব্যক্তি একইসঙ্গে হতে পারেন কাজী নজরুল ইসলাম কথিত ‘মম একহাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরি, আর হাতে রণতূর্য’অলাও। তবে, তার যত পরিচয়ই থাকুক, একই আসনে সব সত্তার কাজ ও কথা একসঙ্গে চলে না। মানুষের স্থান-কাল-পাত্র অনুযায়ী কথা বলার মাত্রাজ্ঞান থাকতে হয়। তাকে কখন কোন প্রসঙ্গে কী কথা বলতে হবে, সে বিষয়ে তাকে বেহুঁশ হলে চলে না।
‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ বললে প্রচলিত শিক্ষিত মানুষ কিংবা অলঙ্কারশাস্ত্রের পণ্ডিতরা সেখানে উৎপ্রেক্ষার সন্ধান করলেও বাউলরা কিন্তু অন্য কিছু বোঝান। কিন্তু সেই অন্যকিছু কী—তার ব্যাখ্যা বাউলতত্ত্বে দীক্ষা না নিলে কখনোই জানা যাবে না।
যিনি কথা বলবেন, তাকে মনে রাখতে হবে, যে কথা বেডরুমে কারও কানে কানে ফিসফিস করে বলতে হয়, সে কথা ড্রয়িংরুমে বলা যায় না। আবার ড্রয়িংরুমের কনফিডেনশিয়াল আড্ডার কথা সেমিনারে বলা শোভা পায় না। তেমনি সেমিনারের তাত্ত্বিক কথাও জনসভায় বললে লোকে হয় বুঝবে না, নয় উল্টো বুঝবে। এই যে লোকে উল্টো বুঝবে, ক্ষোভে ফুঁসে উঠবে, তার জন্য তাদের দায়ী করা যাবে না। তার সমস্ত দায় বক্তাকেই নিতে হবে।
তাহলে পরিস্থিতি কী দাঁড়াচ্ছে? দাঁড়াচ্ছে এই যে, কথা বলার আগে বক্তাকে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় নিতে হবে। স্থান-কাল-পাত্রের ধারণক্ষমতার ওপর নির্ভর করেই বক্তা তার শব্দ নির্বাচন-প্রয়োগ করবেন। না হলে যে উদ্দেশ্যে তিনি কথা বলবেন, সেই উদ্দেশ্য সফল হবে না। পরন্তু সেসব কথা বিপজ্জনক ফলও বয়ে নিয়ে আসতে পারে। আলোচনার এই পর্যায়ে এসে আমরা বুঝতে পারলাম, কথা বলার জন্য মানুষের বাগযন্ত্র থাকলেও, চাইলেই মানুষ যা খুশি তা বলতে পারে না। এমনকি সমাজের উপকারে আসবে যেসব কথা, সেগুলোও যেখানে-সেখানে বলতে পারবে না।
বিষয়টি কয়েকটি উদাহরণের মাধ্যমে পরিষ্কার করা যাক। পৃথিবীতে কোন্ ধর্ম শ্রেষ্ঠ—ইসলাম, খ্রিষ্ট, বৌদ্ধ না সনাতন? এমন একটি সেমিনার কিংবা বিকর্তসভায় সাধারণত প্রতিটি ধর্মের দোষগুণ নিয়ে আলোচনা হবে। সেই বিতর্কে যারা অংশ নেবেন, তাদের উচিত হবে না উন্মু্ক্ত প্রান্তরে হাজার হাজার শ্রোতার সামনে যুক্তিতর্ক পেশ করা। কারণ হাজার হাজার জনতার মধ্যে উগ্র কিংবা ধর্মান্ধ কিংবা নিছক ধার্মিক থাকলেও ধর্মতত্ত্ব বোঝার মতো কেউই নাও থাকতে পারে। ফলে যখন কোনো ধর্মের গুণ আলোচনা চলবে, তখন সেই ধর্মের লোকজন খুশিতে আহ্লাদিত হলেও দোষ নিয়ে আলোচনার সময় তেড়েও আসতে পারে। তারা তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে বক্তাকে হত্যাও করতে পারে।
ধর্মতত্ত্ব নিয়ে তুলনামূলক আলোচনার প্রসঙ্গ দীর্ঘায়িত না করে প্রচলিত একটি বিষয়ে বরং আসা যাক। নবম শ্রেণীতে পৌরনীতি পড়ানো হয় ছাত্রদের। পৌরনীতি কিংবা পরবর্তীসময়ে উচ্চতর বিদ্যার্জনের ক্ষেত্রে পড়ানো হয় রাজনীতিবিষয়ক বিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান। এখন পৌরনীতি বলি, রাজনীতিবিজ্ঞান বলি আর রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলি, শাস্ত্রটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলো গণতন্ত্র-রাজতন্ত্র-একনায়কতন্ত্রের দোষগুণ নিয়ে আলোচনা করা। পৌরনীতি-রাষ্ট্রবিজ্ঞান অনুযায়ী প্রতিটি তন্ত্রেরই ভালো ও মন্দ উভয় দিক আছে। সমাজ-রাষ্ট্র-কাল ও সরকার প্রধানের রুচি-ব্যক্তিত্ব অনুযায়ী এসব তন্ত্রের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের দেওয়া তত্ত্ব বিশ্লেষণের সমং শ্রেণীকক্ষের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গণতন্ত্রের গুণের কথা যেমন বলেন, তেমনি একনায়কতন্ত্রেরও বেশকিছু ইতিবাচক দিকও তুলে ধরেন। আবার একনায়কতন্ত্র কিংবা রাজতন্ত্রের দোষের কথা যেমন বলেন, তেমনি গণতন্ত্রের ত্রুটি নিয়েও কথা বলতে ছাড়েন না। এসবই চলে শ্রেণীকক্ষে কিংবা থিসিসপত্রে। ভুলে আমজনতার সামনে এমন গুরুগম্ভীর তাত্ত্বিক বিষয়ে কেউ আলোচনা করেন না। কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের রাজপথে আয়োজিত কোনো রাজনৈতিক জনসভায় কেউ যদি গণতন্ত্রের ত্রুটি তুলে ধরে একনায়কতন্ত্রের গুণাবলির ব্যাখ্যা করতে গেলে সেখানে তার নিজের দলের লোকরা তো তাকে আক্রমণ করবেই, পরন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ তুলে তাকে আটক করতে পারে। একই পরিণতি ঘটবে একনায়কতন্ত্রের কোনো রাষ্ট্রেও বিপরীত বক্তব্য রাখতে গেলেও।
আরও একটি সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। পদার্থবিজ্ঞানীরা গবেষণাগারে বোমা কিংবা মিশাইলসহ যুদ্ধের সময় ব্যবহারে জন্য মারণাস্ত্রের উপকরণ ও প্রস্তুত প্রণালী নিয়ে নিজেদের মধ্যে যে আলোচনা করেন, সেই আলোচনা যদি জনসভায় করেন, ফল কী দাঁড়াবে? উপস্থিত জনতার বেশিরভাগই সেখান থেকে বের হয়ে সেই সব মারণাস্ত্র তৈরির কাজে আত্মনিয়োগ করবে। আর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবহারের উছিলা খুঁজবে। বিজ্ঞানীরা নিশ্চয় আমজনতার সামনে তাদের বৈজ্ঞানিক গবেষণার সূত্র ও কোনো মারণাস্ত্রের প্রস্তুতপ্রণালী ব্যাখ্যা করবেন না।
সবশেষ উদাহরণটি দেওয়া যাক, বাউলদের নিয়ে। বাউলরা যে তত্ত্বকথা প্রচার করে এবং নিজেরা জীবনাচারে অভ্যস্ত, তার আলোচনা তারা সাধারণ্যে করে না। তারা বিশেষ শব্দে, বিশেষ ভাষায় নিজেদের মনের ভাব প্রকাশ করে। যেমন, ‘চাঁদের গায়ে চাঁদ লেগেছে’ বললে প্রচলিত শিক্ষিত মানুষ কিংবা অলঙ্কারশাস্ত্রের পণ্ডিতরা সেখানে উৎপ্রেক্ষার সন্ধান করলেও বাউলরা কিন্তু অন্য কিছু বোঝান। কিন্তু সেই অন্যকিছু কী—তার ব্যাখ্যা বাউলতত্ত্বে দীক্ষা না নিলে কখনোই জানা যাবে না।
একথা ভুলে গেলে চলবে না—পোশাকে-আশাকে, চলনে-বলনে চাকচিক্য যতই বাড়ুক, জ্ঞানচর্চার দিক থেকে বেশিরভাগ মানুষ আজো প্রাগৈতেহাসিক মানসিকতার ধারক।
উল্লিখিত ধর্মতত্ত্বের আলোচক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র-শিক্ষক, পদার্থবিজ্ঞানী ও বাউলদের মতো সমাজচিন্তক কবি, কথাকার প্রাবন্ধিককেও মনে রাখতে হবে, সব কথা সবসময় সব জায়গায় সবার সামনে বলা যায় না। তত্ত্বকথার আলোচনা চলবে একান্তে কেবর দুই বা ততোধিক তাত্ত্বিকের মধ্যেই। মনে রাখতে হবে—একই বক্তব্য তিনি যেভাবে লিখে প্রকাশ করবেন, মৌখিকভাবে সেভাবে করবেন না। কারণ, মৌখিক বক্তব্যের শ্রোতা থাকে নির্বাচিত; একইসঙ্গে উপস্থিতও। আর লিখিত বক্তব্যের পাঠক থাকে অনুপস্থিত। একইসঙ্গে বর্তমানে যেমন উপস্থিত-অনুপস্থিত দুই ধরনের পাঠক থাকতে পারে, তেমনি থাকতে পারে অনাগতকালের মানুষও। তাই মৌখিক বক্তব্যে বক্তার শব্দচয়নে শুদ্ধতা-অশুদ্ধতার চেয়ে তার শারীরিক ভঙ্গি ও শ্রোতার মনোযোগ আকর্ষণের প্রতিই আগ্রহ দেখাতে হয় বেশি। অন্যদিকে লিখিত বক্তব্যে ব্যাকরণিক রীতি-নীতি মেনে চলার পাশাপাশি সমকালীন সমাজব্যবস্থাপন, ধর্মীয় রীতি, নীতি-নৈতিকতার প্রতিও লেখককে সচেতন থাকতে হয়। ব্যক্তি যখন লিখিত প্রবন্ধে কথা বলেন, তখন যতটা পরিশীলিত ভাষায় বলেন, সভা-সেমিনারে ততটা নয়। জনসভায় আরও বেশি ‘অপরিশীলিত’ ও ‘অ-সংস্কৃত’ ভাষায় কথা বলেন।
মৌখিক বক্তব্যে সমকালীন কোনো প্রাজ্ঞ যখন অতীতের কোনো মনীষীকে সমালোচনা করেন, তখন সেই কথার সঙ্গে সবাই একমত না-ও হতে পারে। মনীষী ও আমজনতার বোধে-চিন্তায় যেমন পার্থক্য আছে, তেমনি মনীষীতে-মনীষীতেও চিরকাল মতানৈক্য ছিল। এখনো আছে। এই মতানৈক্যের ফলে নতুন চিন্তা, নতুন জ্ঞানের, নতুন দর্শনের জন্ম হয়েছে। হচ্ছেও। এই নতুন চিন্তা, নতুন যুক্তির শক্তিতেই পূর্ববর্তীদের কাজে কোনো ভুল থাকলে কিংবা তার কাজের সঙ্গে উপস্থিতকালের ভিন্নমত থাকলে যৌক্তিক ব্যাখ্যার আলোকে তুলে ধরবেন বর্তমানকালের মনীষী। কোনোভাবেই সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রচুর জ্ঞান যার অর্জিত হয়নি, তিনি প্রাচীনকাল কিংবা বর্তমান কালের কোনো মনীষীর বক্তব্যকে ‘কালাপাহাড়ি’ মন্তব্যের মাধ্যমে খারিজ করে দিতে পারেন না। কোনো পণ্ডিত ব্যক্তির জ্ঞানের বিচার করার জন্য সমকক্ষ আরেকজন পণ্ডিতেরই প্রয়োজন। ষোলআনার জ্ঞানীর বিচার করার আধুলি কিংবা সিকিজ্ঞানীর পক্ষে অসমীচীন।
এখন প্রশ্ন উঠছে—এত কথা বলার কারণ কী? কারণ একটিই মনীষীদের নানা মত-বক্তব্য নিয়ে সাধারণ মানুষের বিরূপ সমালোচনা-কটূক্তি সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে সন্ত্রস্ত করে তুলেছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান-দর্শন-ভাষাবিজ্ঞান-ইতিহাস-রাজনীতিসহ জ্ঞানকাণ্ডের বিভিন্ন প্রপঞ্চ নিয়ে সেমিনারে-শ্রেণীকক্ষে দেওয়া মনীষীদের বিভিন্ন বক্তব্যের ফুটেজ ছড়িয়ে পড়েছে ইউটিউব-ফেসবুকে। এসব খণ্ডিত ও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্ববিশ্লেষণাত্মক বক্তব্যরাজি শুনে ‘অল্পবিদ্যা’ধারীরা রোষে ফুঁসে উঠছেন। করছেন নানা রকম অশালীন মন্তব্য। তাদের সেসব মন্তব্যে কোনো যুক্তি নেই, কোনো শৃঙ্খলাও না। দেখেশুনে মনে হচ্ছে—এই যুগের বক্তাকে যদি বক্তব্য দিতেই হয়, তাহলে আগের মতো সীমিত জ্ঞানী-সমঝদার শ্রোতার কথা মনে রাখলেই হবে না, অল্পবিদ্যাধারী, অক্ষরজ্ঞানহীন, অ-জ্ঞান ও অর্বাচীনদের কথাও তাদের মনে রাখতে হবে।
বক্তাকে মনে রাখতে হবে, তিনি অবচেতন মনে কিছু বললে, যাদের উদ্দেশে বক্তব্য নয়, তারাও কিন্তু তার শ্রোতা। তিনি না চাইলেও তারা তার শ্রোতা, যদি তার বক্তব্য ইউটিউব-ফেসবুক-ফেসবুক পেজে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। সুতরাং সেমিনার-ক্লাস রুম-কর্মশালার বক্তব্য রেকর্ড করে আম-শ্রোতার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে, নয় ওই বক্তব্য লিখিত প্রবন্ধের মতোই সুনির্বাচিত শব্দসহযোগেই হতে হবে। তাতে বক্তৃতার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে, সন্দেহ নয়। তবু তা-ই করতে হবে। না হয় সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। লোকে প্রাজ্ঞজনকে হেনস্ত করবেই। একথা ভুলে গেলে চলবে না—পোশাকে-আশাকে, চলনে-বলনে চাকচিক্য যতই বাড়ুক, জ্ঞানচর্চার দিক থেকে বেশিরভাগ মানুষ আজো প্রাগৈতেহাসিক মানসিকতার ধারক।
আরও পড়ুন: