পর্ব-১৫
ফোনটা এলো ঠিক দুপুরে। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য তখন নিজের অফিস রুমে পরীক্ষার খাতা দেখছিলেন। তিন-চার দিনের ভেতর পরীক্ষার ফল প্রকাশ করতে হবে। আজকের ভেতরই খাতা দেখা শেষ করতে হবে। তারপর রেজাল্ট তৈরি করে বিভাগের প্রধানের কাছে জমা দিতে হবে। এ সময়টা বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে ব্যস্ত সময় যায়। বিশেষ করে সেমিস্টার শেষের দিকে। মোবাইলের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, অপরিচিত নম্বর। ব্যস্ততার কারণে ধরলেন না। কিছুক্ষণ পরে একই নম্বর থেকে ফোনটা আবার এলো। টিঅ্যান্ডটির নম্বর। ভাবলেন, নিশ্চয় কোনো অফিসের নম্বর। ফোনটা রিসিভ করলেন।
-হ্যালো বলতেই ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে ভেসে এলো নারীকণ্ঠ, ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য স্যার বলছেন?
-জি, বলছি।
-স্যার, আমি বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের এইচ আর ডিপার্টমেন্ট থেকে মেহেরিন মুস্তারি বলছি।
-বলুন।
-স্যার, আপনি আমাদের এখানে বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান পদে আবেদন করেছেন। আগামীকাল সকাল এগারটায় নিয়োগ বোর্ড বসবে। আপনাকে নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ করছি।
-কিন্তু ম্যাডাম, আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি, আমি তো আগামীকাল উপস্থিত থাকতে পারবো না।
-ওকে স্যার, আমি এখুনি ম্যানেজমেন্টকে রিপোর্টটা জানিয়ে দেবো।
মেহেরিন মুস্তারি আবেদনকারীদৈর একটা পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করে ভিসি স্যারের কাছে নিয়ে গেলেন। ড. সাদিক আহসান কাজ করতে করতেই মেহেরিন মুস্তারির দিকে না তাকিয়েই বললেন, কতজন আবেদন করেছেন?
-স্যার, ছয় জন।
-সবার সঙ্গে কথা বলেছেন? আগামীকালের বোর্ড ঠিক আছে তো?
-স্যার, সবার সঙ্গেই কথা বলেছি। শুধু একজন বাদে সবাই কনফার্ম করেছেন। এখন পর্যন্ত বোর্ড ঠিক আছে। বোর্ডে যারা থাকবেন, তাদের সাথেও কথা বলেছি। তারাও কনফার্ম করেছেন।
-বাইরে থেকে যে দুজন এক্সপার্ট আসবেন, তারা কনফার্ম করেছেন?
-জি স্যার।
-ড. সাদিক আহসান কী যেন চিন্তা করলেন। তারপর মেহেরিন মুস্তারির দিকে তাকালেন, বললেন, যিনি আসতে পারবেন না বলে জানিয়েছেন, কী নাম যেন বললেন?
-ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য।
-তিনি আবেদন করেছেন। কিন্তু পরীক্ষা দিতে আসবেন না! কেন আসবেন না জানতে চেয়েছেন? আচ্ছা তার সিভিটা দেন তো।
-মেহেরিন মুস্তারি ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যরে সিভিটা উপাচার্যকে দিলেন। তিনি খুব মনোযোগ সহকারে সিভিটা আদ্যপান্ত দেখলেন। ভাবলেন, রেজাল্ট ভালো। লেখালেখি ভালো। জার্নালে অনেক প্রবন্ধ বের হয়েছে। মননশীল সৃজনশীলÑসব শাখাতেই লেখালেখি করেন। বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। চল্লিশের বেশি গ্রন্থ বের হয়েছে। বয়সও বেশি নয়Ñআটত্রিশ উনচল্লিশ বছর। বাঘা যতীনের মতো বিখ্যাত বিপ্লবীকে নিয়ে কাজ করেছেন। এদেশে তো বাঘা যতীনকে নিয়ে কেউ কাজই করেননি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নামটাও বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়। এখানকারই তো অনেকে বাঘা যতীন সম্পর্কে বলতে পারবে না। তার চিন্তাচেতনা আদর্শ অবশ্যই একটু আলাদা হবে। এই ছেলেটাকে বোর্ডে ডাকা জরুরি। তিনিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রার্থী হতে পারেন!
উপাচার্য সিভিটা আবারও একটু দেখলেন। তারপর বললেন, মেহেরিন আপনি ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে ফোন দিয়ে তার না আসতে পারার কারণটা জানতে চান। আর শুনুন, লাউড স্পিকারে রাখেন। কনভারসেশনটা আমি শুনতে চাই।
-ওকে স্যার। মেহেরিন মুস্তারি নিজের মোবাইল থেকেই ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে ফোন করলেন।
ফোনটা সঙ্গে সঙ্গেই ধরলেন ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য।
-স্যার, আমি বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এইচ আর ডিপার্টমেন্টের মেহেরিন মুস্তারি বলছি। গতকাল আপনার সাথে আমি কথা বলেছিলাম। বাংলা বিভাগের চেয়ারম্যান নিয়োগের পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে। ম্যানেজমেন্ট জানতে চেয়েছেন, আপনি কী কারণে, আগামীকাল ভাইভা বোর্ডে উপস্থিত থাকতে পারছেন না!
-দেখুন, আগামীকাল সারাদিন আমার এখানে এমএ ক্লাসের শিক্ষার্থীদের ফাইনাল পরীক্ষার ভাইভা। এটা আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা রয়েছে। অনেক দূর-দুরান্ত থেকে পরীক্ষার্থীরা ভাইভা দিতে আসবেন। আমি এখানকার কো-অর্ডিনেটর। আমি না থাকলে পরীক্ষাটা পিছিয়ে দিতে হবে। আমি নীতিগত ও দায়িত্বগতভাবে তা করতে পারি না। যে কারণে আমার চাকরির পরীক্ষার থেকে ছেলেমেয়েদের পরীক্ষাটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সরি, আমাকে ক্ষমা করবেন—আমি আগামীকাল উপস্থিত থাকতে পারছি নে। ম্যানেজমেন্টকে আমার অপারগতার কথা জানাবেন। আমি দুঃখ প্রকাশ করেছি।
ড. সাদিক আহসান মুহূর্তের ভেতর বুঝে নিলেন, তিনি দায়িত্বশীল একজন শিক্ষক। তার নীতি আদর্শ ও দায়িত্বজ্ঞান আছে। একটা চিরকুট লিখে মেহেরিন মুস্তারিকে দিলেন, জানতে চান, তিনি কবে আসতে পারবেন?
মেহেরিন মুস্তারি আবার বললেন, স্যার, ম্যানেজমেন্ট জানতে চেয়েছেন, আপনি কবে আসতে পারবেন? কবে কখন বোর্ড বসালে আপনার সুবিধা হবে?
দেখুন, আমার সাপ্তাহিক ছুটি রবিবারে। এই একটা দিন ছাড়া আমি কোনোদিনই কখনোই চাকরির পরীক্ষা দিতে যেতে পারবো না। এটা আমার নীতি ও আদর্শ। বলতে পারেন দায়িত্ব।
-ওকে স্যার, আপনাকে আমি একটু পরে আবার ফোন দেবো।
-আপনাকে ধন্যবাদ।
ড. সাদিক আহসান নিজেও অবাক হলেন, কত ট্যালেন্ট দেখেছি অফিসে মিথ্যে বলে চাকরির পরীক্ষা দিতে যায়। তথ্য গোপন করে ফুলটাইমার শিক্ষক অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইমার হয়ে জোড়াতালি দিয়ে শিক্ষকতা করেন। অফিসে থেকেই অফিসের কাজ ফাঁকি দিয়ে নিজের ব্যক্তিগত কাজ করেন। মিথ্যে অসুখের কথা বলে বাসায় আরাম করেন। এই ছেলেটি নিশ্চয় আলাদা হবে। তার ভেতর নির্লোভ ও নিষ্ঠাগত যে পেশাদারিত্ব ও আদর্শ আছে, এ সময়কালে তা বিরল। দায়িত্বের প্রতি শতভাগ আন্তরিক। তাকে বোর্ডের সামনে উপস্থিত করা প্রয়োজন। মেহেরিন মুস্তারিকে বললেন, দুদিন পর তো রবিবার, এই রবিবার বাদ দিয়ে পরের রবিবার সকাল এগারটায় বোর্ড বসান। আর তাকেও এটা জানিয়ে দেন। অন্যদের আজই নোটিশ করে আগামীকালের নিয়োগ বোডকেও তা বলে দেন। বলে দেন বিশেষ কারণে নিয়োগ বোর্ডের সময় পরিবর্তন করা হয়েছে।
প্রকৃত ভালো মানুষ হওয়া যায়; বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়; এসব বিষয়ে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে এবং তা পরিকল্পনামাফিক।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য পরীক্ষার নির্দিষ্ট সময়ের একটু আগেই বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের অতিথি রুমে ঢুকেই দেখলেন আরো অন্যসব প্রার্থী চা কফি খাচ্ছেন। ভাইভা এখনো শুরু হয়নি; হবে হবে ভাব। সবাই স্যুটকোর্ট টাই স্মার্ট; নায়কের মতো হয়ে এসেছেন। নিজের লেখা গ্রন্থ, প্রকাশিত আর্টিকেল নিয়ে এসেছেন। দেখেই বুঝলেন; এখানে আমার আসাটাই ঠিক হয়নি। সিএনজি ভাড়ার তিনশ টাকাই মাটি। বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত কয়েকজন প্রফেসর স্বয়ং প্রার্থী। আবার কেউ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরিতে আছেন দু বছরের অবৈতনিক ছুটির অনুমতি নিয়ে আবেদন করেছেন। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাত্র দুজন দরখাস্ত করেছেন। তার মধ্যে ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য একজন। সাধারণ মার্জিত প্যান্ট শার্ট পরেছেন। টাইও পরেননি। দুটো গবেষণা গ্রন্থ হাতে করে এনেছেন। কেউ তার দিকে ভালো করে তাকালেনও না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বলে কেমন যেন একটু তাচ্ছিল্যভঙ্গিতে না দেখার মতো করে দেখলেন। পরিচিত হওয়ার আগ্রহও দেখালেন না। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যও বাড়তি কোন আগ্রহ দেখালেন না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যজন একটু কাছে এগিয়ে এসে বললেন, ভাই, আপনি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আবেদন করেছেন?
-জি।
-আমিও তো। দেখছেন সবাই পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বলে আমাদের কীভাবে অবজ্ঞার চোখে দেখছেন! বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ই মনে করেন না।
-তা ঠিক। কিন্তু তারা তো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরির জন্যই পরীক্ষা দিতে এসেছেন। বাদ দেন এসব। নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস রাখবেন। আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন?
-কেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানকার যে ভাব, তাতে তো ভাই, আবেদন করাই ভুল হয়ে গেছে। এসব জাদরেল শিক্ষক থাকতে আমাদের নেবে না। দেখছেন না, আমাদের সিরিয়াল সবার শেষে।
-এসব নিয়ে চিন্তা করেন কেন? এসেছি। পরীক্ষা দেবো। নিজের সর্বোচ্চটা বোর্ডের সামনে উপস্থাপন করার চেষ্টা করবো। হলে ভালো, না হলে আরো ভালো। আপনিও বুঝিয়ে দেবেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলেও আমরা পড়ালেখা করি। আমরাও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পড়ালেখা করে ভালো রেজাল্ট নিয়ে বের হয়েছি। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও ঢোকা অতো সহজ নয়। পাবলিকে তো অধিকাংশ নিয়োগ হয় পলিটিক্যালি। আর নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ে পত্রিকায় রিপোর্ট পড়েন না! বাইরে সব বড় বড় কথা! কতোজনকে তো দেখলাম ভিসির চেয়ারে বসার সাথে নিজের পেট ফুলে ঢোল হয়ে যায়, মুখ ফুলে আষাঢ়ে ব্যাঙের মতো হয়ে যায়। রাতারাতি অর্থবিত্ত গাড়ি বাড়ির মালিক হয়ে যান। কিভাবে এসব হয় ভাই! কিছুদিন যেতে না যেতেই আবার দেখি ছাত্ররা তার রুমে তালাবন্দি করে রাখে। দুর্নীতিবাজ; আত্মীয়করণ কতো অভিযোগে তার পদত্যাগের দাবিতে আন্দোলনে আগুন জ্বলে। রাজনীতির দড়িতে বাঁধা মেরুদণ্ডহীন ভিসিও তো আছে। আবার অনেক নীতিবান ও আদর্শিক সৎ ভিসিও আছেন। তারা দেশের মহাসম্পদ। কী বলবেন সবকিছু মিলিয়েই তো দেশটা এভাবেই চলছে। যা হোক আমাদের মতো চুনোপুঁটিদের মুখে এসব মহাভারতীয় মার্কা কথা মানায় না। আচ্ছা, আপনি এখানকার নিয়োগ নিয়ে কিছু শুনেছেন নাকি!
যেমন?
-শুনলাম যাকেই নিয়োগ দিক, পাবলিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকেই দেবে! এর বাইরে নাকি তারা ভাবছে না।
-তাই নাকি! বিজ্ঞাপনে কী তা উল্লেখ ছিল? ছিল না। বাদ দেন ওসব। এসেছি যখন, এসব চিন্তা করে লাভ নেই। বোর্ড ফেস করি। যা হয় হবে। এমন তো নই যে, বেকার হয়ে বসে আছি। চাকরি তো একটা করছি।
মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয়েছে আরো ঘণ্টা দুয়েক আগেই। তিনজনের পরীক্ষা হয়েও গেছে। সবাই হাসিমুখে বেরুচ্ছেন, যিনি বেরুচ্ছেন, তাকে দেখেই মনে হচ্ছে চাকরিটা তার হয়েই গেছে। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যর যখন ডাক পড়লো, তখন রাত সাড়ে আটটা পার হয়ে গেছে। তিনিই শেষ প্রার্থী।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবে রুমে ঢুকেই সালাম দিয়ে, প্রার্থীর জন্য নির্দিষ্ট করে রাখা চেয়ারের কাছে দাঁড়ালেন।
ড. সাদিক আহসান, বললেন, ড. অনিন্দ অর্ঘ্য, বসুন।
-ধন্যবাদ স্যার, বলেই চেয়ারে বসলেন।
-বোর্ডের মেম্বার সেক্রেটারি আজিজুল হক চোখের পলকে ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে ভিসিকে কানে কানে বললেন, খুবই সাধারণমানের একটা ছেলে। ড্রেসও সাধারণ। স্মার্টনেস বলে কিছু নেই। অন্যরা কিভাবে বোর্ডে এসেছেন, আর এ কিভাবে এসেছে! ভাইভা বোর্ড সম্পর্কেই তো কোন ধারণাই নেই। বাদ দেন। নাম-টাম কিছু একটা জিজ্ঞেস করে ছেড়ে দেন। রাতও অনেক হয়ে গেছে। পাবলিক বিশ্ববিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব জিনিয়াস প্রফেসর পেয়েছি, এদের ভেতর থেকে একজনকে নিয়োগ দিয়ে দেন।
ড. সাদিক আহসান বললেন ছেলেটা যেহেতু এসেছে, একটু দেখি না! ওর তো বেশ কাজও আছে।
-ঠিক আছে, দেখেন। বিরক্ত হয়েই বললেন মেম্বার সেক্রেটারি আজিজুল হক।
ড. সাদিক আহসান বললেন, ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য, এমএ পরীক্ষার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা একটা দিন পিছিয়ে, যদি ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে চেয়ারম্যান পদে পরীক্ষা দিয়ে, চাকরিটা হয়ে যায়, নিজের জীবনের জন্য এ দুটোর মধ্যে আপনার কাছে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ?
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য স্ফীত হেসে বললেন, ধন্যবাদ স্যার। আমি উত্তরটা একটু অন্যভাবে দিতে চাই।
বলুন। ড. সাদিক আহসান বললেন।
আপনাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বাঘা যতীন। তাকে দিয়েই উত্তর দিতে চাই। বাঘা যতীন ১৯১৫ সালে ৯ সেপ্টেম্বর বালেশ্বরের বুড়িবালাম নদীর তীরে চারজন সৈন্য নিয়ে সাড়ে চার হাজার ব্রিটিশ সৈন্যের সাথে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি জানতেন আজ তার মৃত্যু অবধারিত। কিন্তু ইচ্ছে করলে তিনি পালিয়ে নিজের জীবন রক্ষা করতে পারতেন। তার সহযোদ্ধারা তাকে তা অনুরোধও করেছিল। তিনি তা শোনেন নি। ব্রিটিশদের বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, এখন থেকে এভাবেই আমরা তোমাদের সাথে লড়বো। ভারতামাতাকে স্বাধীন করবো। তিনি মৃত্যুকে গ্রহণ করে বলেছিলেন, বৃহৎ স্বার্থে ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করতে হয়। স্যার, এখানে বাঘা যতীন নিজের জীবনের কথা একবারও ভাবেননি। দেশের স্বাধীনতার কথা ভেবেছেন। আমিও আমার শিক্ষার্থীদের ক্ষতি করে বা মিথ্যে অজুহাতে ছুটি নিয়ে চাকরির পরীক্ষা দেয়াকে অপছন্দই শুধু মনে করি না, ঘৃণ্য কাজও মনে করি। আমার ছাত্ররা আমার কাছে দেশের সম্পদ; তাদের সাথে আমার জীবন হবে সততা আদর্শ নীতি ন্যায়বোধ ও দেশপ্রেমের। আমার কাছে আমার চাকরিটা বড় নয়। আমি যে প্রতিষ্ঠানে আছি, সেটাকে নিজের প্রতিষ্ঠান মনে করি।এখানে যদি আমার চাকরি হয়, আমি যে প্রতিষ্ঠানে এখন আছি, সেখানকার সমস্ত নিয়মকানুন মেনে দায়িত্ব বুঝে দিয়ে, তারপর আসবো।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যরে উত্তরে পুরো বোর্ড যেন নড়ে বসে। বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো প্রতিষ্ঠানের চাকরির থেকে তার শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা বেশি গুরুত্বপূর্ণ; নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে একটুও ভাবে না এই ছেলেটি! বাঘা যতীনের জীবনাদর্শ দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন! বিস্ময়।
ড. অনিন্দ্য, বাঘা যতীন সম্পর্কে আপনার আগ্রহ আমাকে মুগ্ধ করেছে। এককথায় আমাদের বলতে পারবেন বাঘা যতীন অগ্নিকালে কোন মাপের নেতা ছিলেন?
ব্রিটিশেিবারধী আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা ও নব-মানবতাবাদ দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা এমএন রায় বাঘা যতীন সম্পর্কে বলেছেন, ‘যতীনদা ছিলেন মানবতাবাদী; সম্ভবত আধুনিক ভারতের প্রথম মানবতাবাদী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে তিনি ছিলেন আমাদের সর্বাধিনায়ক।’ স্যার, এমএন রায় কিন্তু লেনিন, ট্রটস্কি, সুন-ইয়াৎ-সেন, কারাঞ্জা; তখনকার দিনের এসব মহাপুরুষদের সাথে রাজনীতি করেছেন। আর এম এন রায়ের মতো বিখ্যাত তাত্ত্বিক নেতার নেতা ছিলেন বাঘা যতীন। তিনি পরিষ্কারভাবে বলেছেন, দাদা অর্থাৎ বাঘা যতীন ছিলেন ভালো মানুষ। অন্যরা সব মহাপুরুষ। মহাপুরুষদের চাঁদের হাটে ভালো মানুষের নাম পাওয়া যায় না, এইভাবেই চলতে থাকবে সব কিছু; যতদিন না ভালোমানুষ হওয়াটা মহাপুরুষ হবার প্রধান লক্ষণ বলে আমরা মানতে শিখছি। তাঁর এ কথাতে বোঝা যায় তিনি লেনিন, ট্রটস্কি, সুন-ইয়াৎ-সেন, কারাঞ্জা; এসব মহাপুরুষদের চেয়েও বাঘা যতীনকে তিনি বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। কাজী নজরুল ইসলামও বাঘা যতীনকে নিয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। ধূমকেতু পত্রিকায় পৃষ্ঠাজুড়ে তার ছবি ছেপেছেন, কবিতা লিখেছেন, কুহেলিকা উপন্যাসেও বাঘা যতীনের ছায়া আছে।
রেজিস্ট্রার শামস জিজ্ঞেস করলেন, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু এবং বাঘা যতীনের রাজনৈতিক দর্শন কি এক না ভিন্ন?
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য মৃদু হাসলেন। বললেন, দর্শন তো অবশ্যই আলাদা ছিল। তবে তাদের মূল লক্ষ্য ছিল একই। ভারতমাতাকে স্বাধীন করা। তবে একথাও ঠিক নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু বাঘা যতীনের তৈরি সশস্ত্র বিপ্লবী আন্দোলনের অবকাঠামোকে ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছিলেন। তিনি পরবর্তীতে আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠনের মাধ্যমে বাঘা যতীনৈর কর্মসূচিকে ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত করেছিলেন।
রেজিস্ট্রার খুশি হয়ে মাথা নাড়লেন। বললেন, ইতিহাস সম্পর্কে আপনার আগ্রহটা আমার ভালো লেগেছে। তিনি আবার প্রশ্ন করলেন, আপনি তো ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে আছেন, গগন হরকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যথেষ্ট সুনাম আছে। সেখান থেকে আসতে চান কেন?
স্যার, গগন হরকরা নিঃসন্দেহে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানে আমি নিজেও অনেক ভালো অবস্থানে আছি। কিন্তু বর্তমানে বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয় অনেক ভালো করছে। বিশেষ করে গত এক বছরে এই বিশ্ববিদ্যালয়টি অবিশ্বাস্যরকম সুনাম অর্জন করেছে। আমি এখানে নিজেকে প্রমাণ করতে চাই। বাংলা বিভাগকে বহুমাত্রিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত একটি বিভাগ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। আপনারা আমাকে সুযোগ দিলে, আমি বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নের স্রোতে নিজে একজন সাহসী সৈনিক হতে চাই।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যরে উত্তর শুনে মেম্বার সেক্রেটারি আজিজুল হকের বিরক্তভাব কখন যে উড়ে গেছে, তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন তার কথাগুলো। এবার তিনি নিজেই বললেন, আচ্ছা গগন হরকরার নামে বিশ্ববিদ্যালয়; এটা কেন? যারা চিঠিপত্র বিলি করে বেড়ান, তাদের তো ডাক হরকরা বা পোস্ট অফিসের পিয়ন এরকম কিছু বলা হয় জানি। তার নামে আবার বিশ্ববিদ্যালয়! যারা চিঠি বিলি করে বেড়ায়, তারা আবার কেউ বিখ্যাত হয় নাকি! তাদের নামেও বিশ্ববিদ্যালয় হয়! বিস্ময়ের সাথে বললেন তিনি।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য ঠিক বুঝতে পারছিলেন না এটা প্রশ্ন করা হলো, নাকি নিজেরা আলোচনা করছেন! এ সময় ড. সাদিক আহসান বললেন, ড. অনিন্দ্য, আপনি এ বিষয়ে কিছু বলতে পারবেন?
জি স্যার। গগন হরকরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকরের শিলাইদহ কুঠিবাড়ির পোস্ট অফিসের পিয়ন ছিলেন। তিনি চিঠি বিলি করে বেড়াতেন। তার পুরো নাম গগন চন্দ্র দাস। তিনি বাউল গীতিকার ছিলেন। তার জন্ম শিলাইদহের পাশ।র্ববর্তী আড়পাড়া গ্রামে, আনুমানিক ১৮৪৫ সালে। অনুমান করা হয় ১৯১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন। গগন হরকরা মনে মনে গান তৈরি করে, সেই গানে নিজেই সুর দিয়ে গাইতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গানে মুগ্ধ ছিলেন। রবীন্দ্রনাথে সাথে তার বিশেষ অন্তরঙ্গতা ছিল এবং প্রায়ই দুজনে রসালাপ ও সঙ্গীতচর্চা করতেন। আমাদের যে জাতীয় সংগীত; আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি, এই গানটির সুর কিন্তু গগন হরকরার ‘আমি কোথায় পাবো তারে / আমার মনে মানুষ যে রে’ গানের সুর থেকে নেয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও গানের কথাতেও মিল আছে। যে কারণে গগন গরকরা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। রবীন্দ্রনাথের আর একিট গান আছে ‘যে তোমায় ছাড়ে ছাড়–ক’ এ গানটিও গগন হরকরার ‘ও মন অসাড় মায়ায় ভুলে রবে’ গানের সুরের অনুকরণে রচিত।
তিনি তো লালন সাঁইজির ভাবশিষ্য ছিলেন। বললেন মেম্বার সেক্রেটারি আজিজুল হক।।
জি স্যার । হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলেন ড. অনিন্দ অর্ঘ্য।
আপনি গান জানেন? গগন হরকরার যে গানটার কথা বললেন, তা গেয়ে শোনাতে পারবেন? মেম্বার সেক্রেটারি বললেন।
বোর্ডের অন্য সদস্যরা মুখ চাওয়াচায়ি করলেন, ভাবলেন, সেক্রেটারি সাহেবের এবারের প্রশ্নে ড. অনিন্দ্য নিশ্চিতভাবে আটকে যাবে। সেক্রেটারি সাহেব হয়তো তাকে পছন্দ করছেন না বলে বিভিন্নভাবে আটকাতে চাচ্ছেন। ড. সাদিক আহসানও একটু ভাবলেন। আবার ভাবলেন, গান জানলেও জানতে পারে। কারণে ছেলেটা তো সবদিকেই ট্যালেন্ট বলে মনে হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে এসেছেন প্রখ্যাত প্রফেসর ও কবি এ. গণি মাহমুদ। তিনি বললেন, অনিন্দ্য, তুমি তো কুষ্টিয়ার ছেলে। তোমার তো এ গান জানা থাকার কথা।
স্যার, আমি গানটা জানি। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়েও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গানটা আমি করেছি।
ড. সাদিক আহসান খুব খুশি হলেন। কিন্তু গম্ভীরকণ্ঠে বললেন, এখন শোনাতে পারবেন?
জি স্যার।
ঠিক আছো শোনাও তো।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য একটু সময় নিলেন। গানটা তিনি পারিবারিকভাবেই পেয়েছেন। বাবা যখন একতারা হাতে এই গানটা গান করতেন, ছোট্ট অনিন্দ্য অর্ঘ্য তখন একতারার সুরে বাবার গানের তালে তালে নাচতেন। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য যখুনি কোন গান করেন, বাবার ছবিটা বুকের ভেতর অনুভব করেন, যেন বাবা তার গান শুনছেন। এখনো ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য বাবার একতারা আর বাবার গান; বাবার মুখটা সামনে ধরে, দুচোখ বন্ধ করে গাইলেন:
আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে॥
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে, আমি দেশ
বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
আমি কোথায় পাবো তারে, আমার মনের মানুষ যে রে।
লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী,
পেলে মন হত খুশী, দিবা নিশি দেখিতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে, নিভাই কেমন করে,
মরি হায়, হায় রে-
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে, নিভাই কেমন করে,
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে, বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
দেখ না তোরা হৃদয়ে সে, দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যেরে।
দিব তার তুলনা কি যার প্রেমে জগত্ সুখী,
হেরিলে জুড়ায় আঁখি, সামান্যে কি দেখিতে পারে তারে।
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে,
মরি হায়, হায় রে-
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে,
ও সে না জানি কি কুহক জানে, না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষে মন চুরি করে, কটাক্ষে মন চুরি করে।
কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যেরে।
কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে-
তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না জেনে তায় গগন ভেবে মরে
মরি হায়, হায় রে-
ও তার বসত কোথায় না জেনে তায় গগন ভেবে মরে।
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানিস, মানুষের উদ্দিশ যদি
জানিস
কৃপা করি বলে দে রে, আমার সুহৃদ হয়ে বলে দে রে,
ব্যথার ব্যথিত হয়ে বলে দে রে,
কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যেরে।
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ বিদেশে, আমি দেশ
বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যেরে।
আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রে।
পুরো বোর্ডের সব সদস্য মন্ত্রমুগ্ধের মতো ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যরে গান শুনলেন। প্রফেসর ড. এ. গণি মাহমুদ বিস্ময়কণ্ঠে বললেন, তুমি তো জাত শিল্পীরে বাবা! তোমার পরিবারে আর কেউ -গান করেন?
-জি, স্যার। আমার বাবা গান করেন।
ড. সাদিক আহসান মনে মনে ভাবলেন, এমন ছেলেকেই আমার দরকার। কিন্তু বাইরে তা বিন্দুমাত্র কাউকে বুঝতে দিলেন না। বললেন, ড. অনিন্দ্য, আমাদের কাছে একটা কথা প্রায়ই আসে, বাংলায় কেউ পড়তে চায় না। এ বিষয়টা আপনার কাছে কেমন মনে হয়?
এটার সাথে আমি একমত নই স্যার। গগন হরকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে সাড়ে তিনশ ছাত্র বাংলায় পড়ছে। যা তিন বছর আগে ত্রিশ পঁয়ত্রিশজন ছিল। আমি মনে করি এটাকে নিজে দায়িত্ব হিসেবে গ্রহণ করতে হবে; বাংলা যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তা আগে বোঝাতে হবে। এখানে পড়ে যে অনেক ভালো চাকরি পাওয়া যায়। প্রকৃত ভালো মানুষ হওয়া যায়; বিখ্যাত ব্যক্তি হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা যায়; এসব বিষয়ে আমাদের অনেক কাজ করতে হবে এবং তা পরিকল্পনামাফিক। বাংলা ভাষা ও মুক্তিযুদ্ধ এ ব্যাপারগুলো আছেই; দেশপ্রেম ও মূল্যবোধের জায়গাটা শিক্ষার্থীদের ধরিয়ে দিতে হবে।
ড. সাদিক আহসান মেম্বার সেক্রেটারি আজিজুল হকের কথায় একটুও গদগদ হলেন না। কারণ তিনি নিজেকে জানেন; তিনি এখানকার উপাচার্য; এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক; তার ব্যক্তিত্ব; সততা-আদর্শ-ন্যায়বোধ প্রখর রোদ্রের মতো উজ্জ্বল থাকতে হবে। সত্যসাধক হয়েই তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে; এই দৃঢ়তাই তার জীবনের মূল শক্তি।
প্রফেসর ড. এ. গণি মহমুদ বললেন. ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য, তোমার জানাশোনা ভালো। আচ্ছা বলো তো, বাবা, একটা দেশকে কেউ যদি ক্ষতিগ্রস্ত করতে চায়, তাহলে সে দেশের কোন জিনিসটাকে প্রথমে ধ্বংস করা সবচেয়ে বেশি দরকার?
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য একটু ভাবলেন। প্রশ্নটা বেশ শক্ত। ড. সাদিক আহসানের কপালে এবারও খানিকট ভাঁজ পড়লো। কারণ বোর্ড সবসময় চায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্যাকাল্টি নিতে! এটা তাদের মানসিক একটা রোগ! ফলে ড. অনিন্দ্যকে এখানে নিজের ষোল আনা প্রমাণ করতে হবে। রেজিস্ট্রার নিজেও ভাবছেন প্রশ্নটা ভারি জটিল। কী উত্তর হবে নিজেও বুঝতে পারছেন না! মেম্বার সেক্রেটারির মাথার ভেতর প্রশ্নটাই ঢুকলো না।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য বললেন, স্যার, আপনি যদি অনুমতি দেন, তাহলে ব্যাপারটি আমি যেভাবে বুঝি, সেভাবে বলি।
ড. সাদিক আহসান খুশি হলেন। কিন্তু একটুও বুঝতে না দিয়ে গম্ভীরভাবে বললেন, বলেন, অনিন্দ্য আপনার মতো করেই বলেন।
-স্যার, আমি মনে করি যে কোন দেশের প্রধান শক্তি অর্থনীতি। অর্থনীতি শক্তিশালী না হলে সে দেশ কখনো উন্নয়নের সিঁড়ি ধরে এগুতে পারবে না। ফলে সে দেশের উন্নয়ন ব্যহত বা ক্ষতিগ্রস্ত করতে হলে, অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে হবে। কিন্তু অর্থনীতিকে সরাসরি ধ্বংস করা সম্ভব নয় অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে হলে সে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট করে দিতে হবে। আর শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে হলে সে দেশের ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে হবে। সুতরাং প্রথমেই আঘাত করতে হবে একটি দেশের ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের ওপর। এটাকে ধ্বংস করতে পারলেই শিক্ষা ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। শিক্ষা ব্যবস্থা না থাকলে অর্থনৈতিকভাবে একটি দেশ মেরুদণ্ড শক্ত করে কখনোই দাঁড়াতে পারবে না।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য যখন কথাগুলো বলছিলেন, বোর্ডের সবাই যেন ছাত্রের মতো মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন। ড. এ. গণি মাহমুদ মুগ্ধ হয়ে বললেন, অসাধারণ বলেছ, অনিন্দ্য।
এর পরও অন্য সদস্যরা আরো কিছু প্রশ্ন করলেন। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য সাবলীল ও প্রাণবন্তভাবে সেসবের উত্তর দিলেন। ড. সাদিক আহসান বললেন, ড. অনিন্দ্য এবার প্রশ্ন নয়, আমি একটা বিষয় জানতে চাই, তাহলো এই যে আমরা বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, মানিক-বিভূতি-তারাশঙ্কর থেকে শুরু করে বিভিন্ন লেখকের উপন্যাস পড়ি। ক্লাসেও তো আপনারা পড়ান। আপনি নিজেও তো উপন্যাস নিয়ে গবেষণা করেছেন। নিজে উপন্যাস লিখেছেনও। একটা উপন্যাস সার্থক হতে হলে কী কী গুণ থাকা আবশ্যক বলে মনে করেন, বলতে পারবেন?
ড. অনিন্দ্য বললেন, স্যার, যদি অনুমতি দেন আমি এ বিষয়ে এখন একটা ক্লাস নিতে চাই। চার পাঁচ মিনিট সময় দেবেন স্যার।
ওকে।
বোর্ডরুমে একটা সাদা বোর্ড ও মার্কার রাখা ছিল। ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য সেখানে দাঁড়িয়ে চমৎকারভাবে বিষয়টা উপস্থাপন করলেন এবং বোর্ডে ছক করে করে কাহিনি চরিত্র সংলাপ আর্থ-সামাজিক অবস্থা; সমকাল, শিল্প, লেখকের দর্শন; বিভিন্ন বিষয় এমনভাবে তুলে ধরলেন, পিনপতন শব্দ নেই। মুগ্ধ ছাত্রের মতোই যেন শুনছেন সবাই।
প্রোভিসি নাজমুল সৈকত বললেন, ড. অনিন্দ্য, আপনি এখানে স্যালারি কতো চান? আপনি এতে বিব্রত বোধ করবেন না। আমরা প্রত্যেকের নিকট থেকেই তাদের প্রত্যাশিত স্যালারিটা জানতে চাইছি।
ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য একটু ভাবলেন, প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়েই তো নির্দিষ্ট একটা বেতনকাঠামো আছে। নিশ্চয় এখানেও আছে। এটা ভেবেই বললেন, স্যার, আপনাদের যে বেতনকাঠামো আছে, তার প্রতি আমার সম্মান আছে। বেতন নিয়ে এর বেশি আমি বলাটা সমীচীন মনে করি না।
সবাই বুঝলেন ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যরে ব্যক্তিত্ব দৃঢ়। তার নীতিবোধও আদর্শ প্রখর।
ড. সাদিক আহসান বললেন, ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য, আপনার উপস্থাপন আমাদের পছন্দ হয়েছে। অন্যদের উপস্থাপনও আমাদের ভালো লেগেছে। আমরা তো মাত্র একজনকে চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেবো। বোর্ড সামগ্রিক বিচার বিবেচনা মূল্যায়ন করে, যাকে অধিকতর যোগ্য মনে করবেন, এইচ আর ডিপার্টমেন্ট থেকে তাকে ফোন করে জানিয়ে দেবে।
-ড. সাদিক আহসান আবার বললেন, আপনাকে যদি বোর্ড মনোনীত করেন, তাহলে আপনি কবে জয়েন করতে পারবেন?
-যখুনি আমাকে কনফার্মেশন দিবেন, তখন থেকে ন্যূনতম এক মাস সময় আমার প্রয়োজন হবে। কারণ যেখানে আমি আছি, সেখানে এক মাসে আগে নোটিশ করতে হয়।
-ঠিক আছে আপনি আসুন।
-ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্য ধন্যবাদ জানিয়ে বের হয়ে যাবার পরে, রেজিস্ট্রার বললেন, দেখলেন স্যার, সবাই কিন্তু বের হবার সময় নিজের থেকে জানতে চেয়েছেন, কতোদিনের ভেতর রেজাল্টটা জানানো হবে! ড. অনিন্দ্য এ বিষয়ে একটুও আগ্রহ দেখালো না। ছেলেটা আসলেই ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন।
ড. সাদিক আহসান বোর্ডেও সবার কাছে জানতে চাইলেন, ছয়জনকেই তো দেখলেন; ডিপার্টমেন্টের জন্য কাকে বেশি যোগ্য মনে করেন?
বোর্ডের সবাই বললেন, ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যকেই মনে হয় বিবেচনা করা ঠিক হবে। এ সময় ট্রাস্টিবোর্ডের জেনারেল সেক্রেটারি আজিজুল হক বললেন, আপনারা আজ অনেক কষ্ট করেছেন, আর একটু কষ্ট করেন। যেহেতু একটা বিভাগের চেয়ারম্যান নিয়োগের বিষয়; আপনারা নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে বিবেকের কাছে পরিষ্কার থেকে আলাদা আলাদা রিপোর্ট দেন। দশ পনের মিনিটের ভেতর। আমি আন্তরিকভাবে অনুরোধ করবো, আপনাদের কারো কাছে কোন তদবির যদি থেকে থাকে, তা নেবেন না। আমরা সত্যিকারের একজন যোগ্য চেয়ারম্যান চাই। বোর্ডে যে নয়জন আছেন। সবাই লিখিত মতামত দেন। সেই মতামতের ভিত্তিতে আমরা এখুনি এটা চূড়ান্ত করে যাবো।
ড. সাদিক আহসান বোর্ডের সবার রিপোর্ট এক সঙ্গে করে দেখেন, নয়জনই মত দিয়েছেন ড. অনিন্দ্য অর্ঘ্যরে পক্ষে। তিনি রিপোর্টটা ট্রাস্টি বোর্ডের মেম্বার সেক্রেটারি আজিজুল হকের হাতে দিলেন। তিনি দেখে বললেন, ছেলেটা রিয়েলি সুপার ট্যালেন্ট। মেম্বার সেক্রেটারি হাসতে হাসতে বললেন, আমি তো প্রথমে ছেলেটাকে দেখেই ভিসি সাহেবকে কানে কানে বাদ দেয়ার কথা বলেছিলাম। ভাগ্যিস, ভিসি সাহেব আমার কথা শোনেননি।
ড. সাদিক আহসান বললেন, ছেলেটা এখানে ভালো করবে।
সবাই একবাক্যে তাতে সম্মতি জানালেন।
মেম্বার সেক্রেটারি বোর্ডের চেয়ারম্যানকে তৌফিক চৌধুরীকে ফেইসটাইমে ফোন করলেন, তখন তিনি আমেরিকায় অবস্থান করছিলেন। চেয়ারম্যান তৌফিক চৌধুরী নিজেই সবাইকে আগে সালাম জানালেন। বললেন, আপনারা এত বড় বড় মানুষ, এতো রাত পর্যন্ত আছেন! কী বলে কৃতজ্ঞতা জানাবো! আমি তো নিজেই বিব্রতবোধ করছি।
মেম্বার সেক্রেটারি বললেন, তৌফিক ভাই, আমরা বাংলা বিভাগের জন্য ভালো একটা ছেলে পেয়েছি, বোর্ডের সবাই পছন্দ করেছেন। আপনি অনুমতি দিলে, তাকে নিয়োগ দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি।
আজিজ ভাই, ভিসি মহোদয় যে সিদ্ধান্ত দেবেন, যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন, সেটাই চূড়ান্ত। আমার অনুমতির প্রয়োজন নেই। সবাই ভালো থাকুন। শুভ রাত।
মেম্বার সেক্রেটারি বললেন, ভিসি স্যার, আপনাকে অনেক অভিনন্দন, আপনি যেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, প্রত্যেকটা নিয়োগ প্রক্রিয়া এতো চমৎকার আর এতো স্বচ্ছভাবে করছেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে সবসময় আপনাকে স্যালুট করি। যেটা আপনার আগে এখানে কখনোই ছিল না। নিয়োগ বোর্ড যে এতো সুন্দর করে নিরপেক্ষ ও নির্মোহভাবে সেরা ট্যালেন্ট বের করে আনা যায়, এই ধারণই তো আমাদের ছিল না।
ড. সাদিক আহসান মেম্বার সেক্রেটারি আজিজুল হকের কথায় একটুও গদগদ হলেন না। কারণ তিনি নিজেকে জানেন; তিনি এখানকার উপাচার্য; এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক; তার ব্যক্তিত্ব; সততা-আদর্শ-ন্যায়বোধ প্রখর রোদ্রের মতো উজ্জ্বল থাকতে হবে। সত্যসাধক হয়েই তাকে নেতৃত্ব দিতে হবে; এই দৃঢ়তাই তার জীবনের মূল শক্তি।
চলবে…
আরও পড়ুন: ঈশ্বর ও শয়তান-১৪॥ রকিবুল হাসান