(পর্ব-১৪)
সদিচ্ছা আন্তরিকতা সততা কর্মস্পৃহা থাকলে মরতে বসা দুর্গন্ধভরা প্রতিষ্ঠানকেও যে আদর্শিক ও স্বচ্ছ সুন্দর কর্মমুখর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা যায়, নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থ ত্যাগ করে বৃহৎ স্বার্থে নিজেকে উৎসর্গ করার ভেতর যে মহত্ব, তা খুব স্বল্প সময়ে ড. সাদিক আহসান তা প্রমাণ করে দিলেন। বছর যেতে না যেতেই বাঘা যতীন বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো পরিবেশ পরিবর্তন হয়ে গেলো। দূষিত পরিবেশ থেকে মুক্ত শুদ্ধ পরিবেশে গেলে যেরকম প্রাণ ভরে নিঃশ্বাস গ্রহণ করা যায়, এ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশও যেন ঠিক তাই হয়ে উঠলো। শিক্ষক কর্মচারীদের মধ্যে প্রাণবন্ত মনোমুগ্ধকর পরিবেশ তৈরি হয়। যাদের প্রমোশন বাকি ছিল, অধিকাংশেরই প্রমোশন হয়ে গেছে। যাদের দুতিন বছর বেতন বৃদ্ধি হয়নি, তাদেরও বেতন বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষকরা আন্তরিকভাবে ক্লাস নিচ্ছেন। পড়াচ্ছেন। বিভিন্ন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সহশিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। বিভিন্ন সেমিনার নিয়মিত হচ্ছে। সাহিত্য সংস্কৃতিবিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠান হচ্ছে। গবেষণামূলক কর্মকাণ্ড হচ্ছে। রিসার্চ সেন্টার চালু হয়েছে। লাইব্রেরিতে লাখ লাখ টাকার বই ক্রয় করা হয়েছে। দেশের নামিদামি শিক্ষাবিদদের আমন্ত্রণ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আনা হচ্ছে। ভিসি ড. সাদিক আহসান সকলকে একসঙ্গে নিয়ে আলোচনা করে কর্মপন্থা ঠিক করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে বিশ্বদ্যিালয়কে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। নিজে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন বিভাগে যাচ্ছেন, আলোচনা করছেন, পরামর্শ দিচ্ছেন। যারা প্রথমে প্রথমে ভেতরে ভেতরে ভিসির প্রতি অসন্তুষ্ট ছিলেন, তারাও তার সততা আদর্শ আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে একসঙ্গে সহযোগী হয়ে কাজ করছেন। এ যেন জাদুর কাঠির মতো পরিবর্তন। যে বিশ্ববিদ্যালয়ে দুর্নাম বদনামে ভরা ছিল, সেই বিশ্বববিদ্যালয় মাত্র বছর না পেরেুতেই সারা দেশে আলোড়নের বাতাস ছড়িয়ে দিয়েছে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছে, বিজয় ছিনিয়ে আনছে। কখনো কখনো জিততে না পারলেও নিজেদের আগামীর সাফল্যের ভিত্তি ঠিকই প্রমাণ করে দিচ্ছেন। এ যেন এক অভিনব ঘটনা।
কিন্তু দু-তিনটি বিভাগে আশানুরূপ সাফল্য আসেনি। বিশেষ করে বাংলা বিভাগ পরিবর্তনের এই স্রোতে এগুনো তো দূরে থাক, পিছিয়ে গেছে আরও। স্বাধীনতা দিবস-বিজয় দিবস-একুশে ফেব্রুয়ারিসহ এসব জাতীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করে অন্যান্য বিভাগ। সাংস্কৃতিক ক্লাব সহযোগিতা করে। সেখানে বাংলার কোন অংশগ্রহণ নেই। বাংলার চেয়ারপারশন ড. ফারজানার কোন ভূমিকা নেই। বিভাগের বয়স দশ বছর পেরিয়ে গেলেও একটা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করতে পারেনি। বিভাগে কোনো কবিতা বা সাহিত্যপাঠেরও ব্যবস্থা করতে পারেনি। এক বছর আগে জার্নাল বের করার কথা বলা হলেও কোন কাজই হয়নি। ছাত্র সংখ্যা আগে যা ছিল দিন দিন তা আরও কমে যাচ্ছে।
ড. সাদিক আহসান বাংলা বিভাগের প্রধান ড. ফারজানাকে ডাকলেন। সঙ্গে প্রোভিসি ড. নাজমুল সৈকত, রেজিস্ট্রার শামস, সিসি এবং কলা অনুষদের ডিনকে ডেকে জরুরি মিটিং দিলেন।
সাদিক স্যার তো তাই। কিন্তু তাতে আমার ক্ষতিই হবে। আমার তো একজন শাহেদমার্কা ভিসি স্যার দরকার ছিল।
ড. সাদিক আহসান বললেন, ড. ফারজানা, আমি এখানে এসেছি এক বছরের বেশি। আপনাকে কিছু কাজ দিয়েছিলাম। ডিন আব্দুল হামিদকেও আমি বলেছি আপনাকে সহযোগিতা করার কথা। উনি অনেকবার আপনাদের সাথে বসেছেন। প্রোভিসি, সিসি সাহেবরাও আপনাকে, আপনার টিচারদের ডেকে অনেকবার মিটিং করেছেন। এমনকি আপনি নিজে যে পরিকল্পনা দিয়েছেন, তার একটাও কার্যকরি করতে পারেননি। বলুন তো মূল সমস্যা কোথায়?
-ড. ফারজানা একটু রূঢ়তার সঙ্গেই বললেন, স্যার, ছাত্র সংগ্রহ করা কি টিচারের কাজ?
-না। টিচারের কাজ কোয়ালিটি শিক্ষা প্রদান নিশ্চিতকরণ করা। বিভাগের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করা। আপনার বিভাগে তো নিয়মিত ক্লাসই হয় না। ছাত্ররা ক্লাসে আসে না। আপনি নিজে কোর্স পর্যন্ত অফার করেন না। কোর্স কিভাবে অফার করতে হয় তাও আপনি জানেন না। সবকিছু চলে আপনার প্রোগ্রাম অফিসারের ওপর দিয়ে। সেই তো সব করে। সে কি টিচার? কোর্স অফারের কী বুঝবে? কোন টিচার কী বিষয়ে পড়াবেন, তাও নির্ধারণ করে দেয় সে। শিক্ষকরা সবসময় তার টেবিলের সামনে বসে থাকেন; অথবা তিনি নিজেই শিক্ষকরুমে গিয়ে আড্ডা দেন। তিনিই তো বাংলা বিভাগের অঘোষিত চেয়ারপারশন! শিক্ষকরা পর্যন্ত তাকে খাতির করে চলেন। কেন?
স্যার, খণ্ডকালীন শিক্ষকরা এসে প্রোগ্রাম অফিসারের রুমে বসে চা বিস্কুট খান; তার নির্দেশনা মোতাবেক সব কিছু চলে এটা সত্য। বিভাগে তো কিছুটা রুম সংকট আছে।
আপনার রুম ভেতর থেকে বন্ধ থাকে কেন? ঘণ্টার পর ঘণ্টা আপনি রুম বন্ধ করে হয় ফোনে কথা বলেন না-হলে কোন খণ্ডকালীন টিচারের সঙ্গে থাকেন। এগুলো কি অসত্য?
ড. ফারজানা কী বলবেন! কিছুই বুঝতে পারেন না। অনুতপ্ত স্বরে বললেন স্যার, এরপর থেকে এমনটি আর হবে না। আমি ক্ষমা চাইছি। বলেই মাথা নিচু করে। নিজের কাছে তার ভীষণ অপমান লাগে। অন্যরাও চুপ করে থাকেন। তারা জানেন, এই ভিসি স্যারের কাছে দায়সারা কোনো কথা বলে লাভ হবে না। তিনি আবার বললেন, আমি নিজে আপনাকে জার্নাল প্রকাশ করতে বলেছি। বের তো করেনইনি বুঝলাম। কয়টা আর্টিকেল সংগ্রহ করেছেন?
স্যার, আমি কয়েকজনকে ফোন করেছি, তারা বলেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ আবার কি জার্নাল বের করবে! তাচ্ছিল্য করে কথা বলেন।
জার্নাল করে তাদের কড়া জবাব দিতে পারাটাই ছিল আপনার যোগ্যতা। আপনি তা পারেননি। আপনার টিচাররা সারাদিন অফিসে কী করেন? জার্নালে আপনার এ পর্যন্ত কয়টা আর্টিকেল প্রকাশিত হয়েছে?
আমি শুধু পিএইচডি করেছি, স্যার। আমার কোন আর্টিকেল জার্নালে প্রকাশ হয়নি।
তাহলে কোন নিয়মে আপনি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হয়েছেন? আপনি তো নিজেই অনিয়মের ভেতরে আছেন। আগামীকাল তিনটায় আপনি আপনার টিচারদের নিয়ে আমার কনফারেন্স রুমে আসবেন। মিটিং। উপস্থিত অন্যদের বললেন, আপনারাও সবাই বাংলার মিটিংয়ে থাকবেন।
সবাই চলে গেলেন। শুধু আব্দুল করিম বললেন, স্যার, আপনার সাথে আমি একা দুমিনিট কথা বলতে পারি?
আব্দুল করিম এদিক ওদিক তাকিয়ে কেউ আছে কি না দেখে নিয়ে বললেন, স্যার, বাংলা বিভাগের অবস্থা খুবই খারাপ। ট্রাস্টি বোর্ড আমার কাছে এক বছরের রিপোর্ট চেয়েছে। কত টাকা এই বিভাগের পেছনে লোকসান যাচ্ছে! স্টুডেন্ট ভর্তির কী অবস্থা! আমি রিপোর্টটা তৈরি করেছি। আপনাকে দেখাতে পারিনি বলে, বোর্ডে সাবমিট করিনি। আপনি আসার পরে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টা এখন একটা নিয়মের ভেতরে এসেছে। প্রতি সেমিস্টারে যেখানে সাত-আটশ ছাত্র ভর্তি হতো না, সেখানে গত সেমিস্টারে সতের শ স্টুডেন্ট ভর্তি হয়েছে। এবার তো এটাও ছাড়িয়ে যাবে। বোর্ড আপনার ওপরে যারপরনাই খুশি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অতীতে আর কোনো সময়ে এমন সাফল্য কেউ দেখাতে পারেনি। এত ছাত্র কখনো ভর্তি হয়নি। কিন্তু একটা দুঃসংবাদ আছে স্যার।
-কী দুঃসংবাদ? বলেন তো।
-বোর্ড বাংলা বিভাগ বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছে।
-এ কথা আমার সাথেও আলোচনা হয়েছে। আমি তো বলেই দিয়েছি এটা করা যাবে না। বাংলা বিভাগ থাকবে। বাংলা না থাকলে আমি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্ববিদ্যালয়ই মনে করি না। এই বাংলার জন্য আমাদের সোনার ছেলেরা বুকের তাজা রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে। ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই স্বাধীনতা আন্দোলণের পথ তৈরি হয়েছিল, রাজনৈতিক সব বিভাজন দূর হয়ে একটা প্লাটফরম তৈরি হয়েছিল। সেখান থেকেই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছিল। স্বাধীনতা লাভের জন্য দলমতনির্বিশেষে সমস্ত মানুষ এক মন্ত্রে সমবেত হয়েছিল। এই বাংলাকে বঙ্গবন্ধু প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতেন। তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলন করেছেন। জনমত তৈরির জন্য বিভিন্ন জেলায় ছুটে গিয়েছেন, সভা করেছেন, বক্তৃতা করেছেন, কারাবন্দি হয়েছেন। তার নেতৃত্বে দেশের স্বাধীনতা এসেছে। আপনি তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়েছেন? না পড়লে পড়ে দেখেন। এই দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলা বিভাগ থাকবে না, বাংলা পড়ানো হবে না, তা কখনো হতে পারে না। বাংলা বিভাগ অবশ্যই থাকবে। আমাদের কাজ হবে এটাকে প্রতিষ্ঠিত করা। ভাই, এটা মাথায় রাখবেন, এই বিভাগটা কোনোভাবেই বন্ধ করা যাবে না।
-তাহলে উপায় কী স্যার?
-সবাই মিলে চেষ্টা করে বাংলাকে বাঁচাতে হবে। প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। লাভ না হোক, অন্তত লোকসান যেন না হয়, আমরা সেই চেষ্টা তো করতে পারি। তারপরও যদি না হয়, তবু বাংলা বিভাগ বন্ধ করতে দেওয়া যাবে না। ট্রাস্টি বোর্ডকে বুঝিয়ে বলতে হবে। তবে তা আরও পরে। আমরা আগে চেষ্টাটা করে দেখি।
-একটা কথা বলি স্যার, ড. ফারজানাকে দিয়ে এই বিভাগের কোনো উন্নতি হবে বলে আমার মনে হয় না। তিনি আড়াই বছরে কিছুই করতে পারেননি। বাংলা বিভাগ থেকে একটা অনুষ্ঠান পর্যন্ত করতে পারেননি। একটা সাধারণ পত্রিকা বের করতে পারেননি। জার্নাল কিভাবে করবেন, তা তিনি নিজেই জানেন না। ছাত্রসংখ্যা যেভাবে কমছে, আর একবছর পরে তো বিশ পঁচিশজনে নেমে আসবে। বন্ধ করতে হবে না স্যার, এমনিই বন্ধ হয়ে যাবে।
-আমিও তা অনুধাবন করেছি। কিন্তু বাংলা বিভাগকে এভাবে নিঃশেষ হতে দিতে চাই না। এটাকে যেভাবেই হোক প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
-স্যার, ড. ফারজানাকে বাদ দিয়ে নতুন চেয়ারম্যান নিলে কেমন হয়?
-প্রয়োজন হলে তাই করেন! আগামীকাল আপনি, প্রোভিসি, কলা অনুষদের ডিন আর রেজিস্ট্রার সাহেব বসে; এ বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে ভালো হয়। বোর্ডের অবজারভেশনের বিষয়টিও তাদের অবগত করা প্রয়োজন। এতে যদি সবাই মনে করেন, ডিপার্টমেন্টের প্রয়োজনে নতুন চেয়ারম্যান প্রয়োজন। আমরা তা করবো।
-স্যার, রেজিস্ট্রার সাহেব তো মনে হয় না এতে রাজি হবেন?
-কে রাজি হবেন, না হবেন; তা বড় কথা নয়। আপনি ড. ফারজানার পুরো পারফরমেন্সের হিসাব মিটিংয়ে উপস্থাপন করবেন। প্রত্যেক সেমিস্টারে আমরা কত টাকা লোকসান দিচ্ছি। ড. ফারজানা এ যাবৎ কতগুলো পরিকল্পনা সাবমিট করেছে, তার কত শতাংশ বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন; ছাত্র ভর্তি কী হারে কমেছে; এসব উপস্থাপন করার পর নতুন চেয়ারম্যান আনার প্রয়োজন আছে কী নেই; তাদের আলোচনা বা মন্তব্য নেবেন। সেগুলো নিয়ে একটা প্রতিবেদন তৈরি করে আমাকে দেবেন। আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে বোর্ডকে জানিয়ে দেবো। তারপর চেয়ারম্যান নিয়োগের বিজ্ঞাপন পেপারে যাবে।
-ধরুন, নতুন চেয়ারম্যান নেওয়া হলো, তখন কি ড. ফারজানা শিক্ষক হিসেবে এখানে থাকবেন?
-ওটা এখন আলোচনার বিষয় নয়। আর কিছু বলবেন?
-না, স্যার ।
সিসি উঠে নিজের রুমে গিয়ে ভাবেন, বাপরে বাপ! ভিসিতে ভিসিতে কত পার্থক্য! আগের ভিসিকেও দেখলাম, এখনকার ভিসিকেও দেখতেছি। সত্যিকারের ভিসি বলতে যা বোঝায়, তিনি তাই। স্যালুট করার মতো। এরকম ভিসি থাকলে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নতি হতে বাধ্য। এক বছরেই বিশ্ববিদ্যালয়টাকে কোথায় নিয়ে গেলেন! এককথায় অবিশ্বাস্য। আবার ভাবে, আমার তো ক্ষতিই করে দিলেন স্যার, রুমে মেয়েদের নিয়ে একআধটু ফুর্তিফার্তা যা করতাম! তা তো কর্পূরের গন্ধের মতো বাতাসে উড়ে গেলো!
এ সময় ড. ফারজানা ফোন করেন সিসিকে। ফোনটা ধরে শান্তকণ্ঠে বললেন, বলুন ড. ফারজানা।
-আপনি আমাকে এভাবে সরিয়ে দিলেন? আপনাকে চিনতে আমি ভুল করেছিলাম। আমার সাথে আপনি যা করেছেন তা খুব অন্যায় করেছেন। যা হোক, অফিসের কাজে আপনার কাছে একটু আসা প্রয়োজন। অনুমতি দিলে আসতে চাই।
-আমি এখন খুব ব্যস্ত। পরশু জরুরি মিটিং। কাগজপত্র তৈরি করতে হবে। আপনি পরশুর পরে ফোন করে আসেন। কাগজপত্রে সিগনেচারের বিষয় থাকলে ফারিয়াকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবেন। সিসি লাইন কেটে দেন।
মানুষের কত রূপ! মানুষ পারেও বটে! ড. ফারজানা বুকের ভেতর ব্যথা অনুভব করেন। ভাবতে থাকেন, যে মানুষটার সঙ্গে আমার এতদিনের এত গভীর সম্পর্ক, সেই মানুষটা এখন আমাকে দেখা তো দূরের কথা, নামই শুনতে পারে না! ভিসি স্যারের রুমে আমাকে নিয়ে যখন দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার এত কথা হচ্ছে, তখন তিনি আমার হয়ে একটা কথাও বলতে পারেন না! অথচ এই তিনিই আমার জন্য স্বয়ং বোর্ডের চেয়ারম্যানের সঙ্গে কত কায়দাকানুন করে একগাদা টাকা বেতন বাড়িয়েছেন। কোনো নিয়মের ধার ধারেননি। সেই তিনিই আজ আমার চাকরিটাও হয়তো খাওয়ার জন্য কত রকমের ফাঁদ তৈরি করছেন। অথচ কয়দিন আগেও যার রুমে আমার সারাদিনের নিঃশ্বাস পড়ে থাকতো, আমার জন্য যার সুতীব্র অপেক্ষা থাকতো, সেই রুম এখন এত দূরের হয়ে গেলো! রুমে আমার ঢোকার কোনো অনুমতি নেই। রেজিস্ট্রার অফিস থেকে একটার পর একটা অভিযোগ আমার নামে আসছে। কৈফিয়ত তলব হচ্ছে। কোনো হিসাব মেলাতে পারছি না! সবই কি এলিনার কাজ! তার এত ক্ষমতা হয়ে গেলো! ভাবেন, চাকরিটা দাপটের সঙ্গে করবো বলে নিজের থেকেই নিজেকে অতদূর পর্যন্ত নিচে নামিয়েছি। তুষার পারভেজের মতো ধনাঢ্য প্রেমিক থাকতেও, নিজেকে এদের বাহুর ভেতর ডুবিয়েছি। শাহেদ স্যারের সঙ্গে যা করার নয়, তার থেকে কত বেশি কিছু করেছি, তিনিও তো বিদায় হয়ে গেলেন। আর সিসি তো এখন গণেশ উল্টে যাবার মতো, পুরো মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। আমি তো এখন একা। ঝরাপাতার মতো উড়ছি। সামাজিক সম্মানের জন্য ভেতরে ভেতরে এর ওর কাছে নিজেকে পচিয়ে দুর্গন্ধ করে দিয়েছি। সবই তো এখন ভেসে যাচ্ছে! দুর্গন্ধটাই তো থেকে যাচ্ছে! নতুন ভিসি স্যার, নিয়মের বাইরে একবিন্দু বোঝেন না। নারীমোহ নারীপ্রীতি তো দূরে থাক, তার ত্রি-সীমানায় এরকম কোনো গন্ধ পেলে, কোনো অনিয়ম দেখলে, সঙ্গে সঙ্গে তার চাকরি শেষ। আসলে তো ভিসি স্যার এরকমই হওয়া উচিত। সততা আদর্শে ব্যক্তিত্বে ন্যায়বোধে মাথা উঁচু করে থাকবেন! সত্যিকারের অভিভাবক হয়ে থাকবেন। হিরকদ্যুতির মতো ব্যক্তিত্বের আলোকছটা ছড়িয়ে থাকবেন। সাদিক স্যার তো তাই। কিন্তু তাতে আমার ক্ষতিই হবে। আমার তো একজন শাহেদমার্কা ভিসি স্যার দরকার ছিল।
হতাশ কণ্ঠে ড. ফারজানা বললেন, কঠিনের থেকেও কঠিন। আমার পাপের ফাইলটা অনেক বেশি ভারী হয়ে গেছে।
ড. ফারজানা ভারাক্রান্ত মনে আবার ভাবে, নিজেকে নষ্টের স্রোতে ভাসিয়ে না বুঝলাম ডিপার্টমেন্ট, না করলাম শান্তি করে নিজের ঘর-সংসার। আদিত্য রায়হানকে স্বামী হিসেবে তার যে গুরুত্ব, তা কোনোদিন বিন্দুমাত্রও দেইনি। সবই তো আমার বন্যার স্রোতে ভেসে যাওয়ার মতো ভেসে গেলো। রুমে প্রোগ্রাম অফিসার ফারিয়াকে ডাকলেন। আচ্ছা ফারিয়া, চিফ কোঅর্ডিনেটর মানুষটা কেমন? তুমি জানো কিছু?
-শুনি তো অনেক কথা। কোনো সমস্যা হয়েছে ম্যাডাম?
-সমস্যা তো হয়েছেই। এখন তো চাকরি বাঁচানোই কঠিন মনে হচ্ছে। উনি তো আমার সাথে দেখাই করেন না।
-এলিনা ম্যাডামের সাথে ক্লাস দেওয়া নিয়ে আপনার সাথে সিসি স্যারের কোনো সমস্যা হয়েছে?
-আমাকে সিসি স্যার তাকে ক্লাস দিতে বলেছিলেন। ইংরেজিতে তো জিইডি কোর্স দিয়েছি। ওখানে তো তিনি ক্লাস নিচ্ছেন। এখানে ক্লাস দেবো না তাও তো বলিনি। সেমিস্টারের মাঝে কিভাবে ক্লাস দিই! আর এটা তো তুমিই সবচেয়ে ভালো জানো। কোর্স অফার তো তুমিই করো। আমি তো অত জটিল হিসাব বুঝিই না।
-এখানে সবকিছুতেই স্বেচ্ছাচারিতা। ভিসি স্যার চেষ্টা করছেন। খুব বেশিদিন হয়তো এসব স্বেচ্ছাচারিতা থাকবে না। সব ঠিক হয়ে যাবে।
-এলিনা ম্যাডামের সাথে আপনার ঝামেলায় যাওয়া ঠিক হয়নি। ক্লাস দিলেই ভালো করতেন। তিনি তো আপনার নামে সিসিকে যা তা বলেছেন। ভিসি বিল্ডিংয়ের তো সবাই জানে। আপনি কেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে ওখানে এক ডিন ম্যাডামের সাথে আপনার না কি কী সব হয়েছিল! ডিন ম্যাডাম আর আপনি; দুজনেই নাকি একজন বড় বিজনেসম্যানকে ভালোবাসতেন। তিনি নাকি সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য! গাজীপুরে কী এক রিসোর্টে ডিন ম্যাডাম আপনাকে আর ওই লোককে নাকি একরুমে হাতেনাতে ধরে ফেলেছিলেন! সে কারণেই নাকি আপনাকে তার পরদিনই কেয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল।
-তুমি এসব শুনলে কার কাছে?
-এইটা জানতে চায়েন না, ম্যাডাম। আমি বলতে পারবো না। আমাকে একজন ওয়াদা করিয়ে নিয়ে তারপর বলেছে। ভিসি বিল্ডিংয়ের সবাই এখন জানে এসব কথা। আপনাকে নিয়ে যা-তা কথা হচ্ছে। পারলে ও বিল্ডিংয়ে আপনি আপাতত আর যায়েন না।
অনেকক্ষণ চুপ করে থেকে ফারিয়ার দিকে তাকায় ড. ফারজানা। সে চোখে কেমন যেন এক অসহায়ত্ব, বাঘের মুখে পড়লে হরিণীর চোখে-মুখে যে অসহায় দশা ফুটে ওঠে, ড. ফারজানাকে যেন ঠিক সেরকমই মনে হয়। ফারিয়া নিজের চোখ দুটো নিচু করে রাখে। ভাবে, এ বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভিসি স্যার আসার আগে কতজন তো কত কিছুই করেছে। কারও কিছুই হয়নি। সাইফ স্যার আমার সাথে কী করলো! এখন আবার বিলকিস ম্যাডামকে নিয়ে যা করছে! এখন তো সাইফ স্যারের চালচলন কথাবার্তা দেখে মনেই হয় না আমাদের মধ্যে কোনোদিন কোনো বিশেষ সম্পর্ক ছিল! ফাবজানা ম্যাডামের অবস্থাও এখন তাই। সিসি স্যার এলিনা ম্যাডামকে পাওয়াতেই তো ফারজানা ম্যাডামের কপাল পুড়লো!
ড. ফারজানা ভেজাকণ্ঠে বললো, ফারিয়া, তুমি যা শুনেছ, তার সব যে মিথ্যে, তা আমি বলছিনে। ঘটনা তো কিছু ছিলই। কিন্তু এখানে সিসি স্যারের সাথে আমার যে সম্পর্ক তাও তো সবাই জানে। এলিনাকে নিয়ে উনি যা করছেন, তাও তো সবাই জানে।
-ম্যাডাম, সিসি স্যার খুব ধূর্ত। এখন রুমে কোনো ফিমেল ফ্যাকাল্টিকে এলাও করেন না। বহু দূরত্ব মেপে চলে। একেবারে করোনা ভাইরাসের ভয়ের মতো। খুব সাবধানে, নিরাপদে থাকে। যেন কোনোভাবে অক্রান্ত না হোন। বলতে পারেন, সিসি স্যার, অফিসে থেকে নিজের রুমে হোমকোয়ারেন্টাইনে আছেন।
-ঠিকই বলেছ। আমিই তাকে চিনতে ভুল করেছি। নিজের চাকরিটাকে নিরাপদে রাখার জন্য ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে চেয়েছিলাম, ভুলটা ওখানেই হয়েছে। এখনকার মতো ভিসি স্যার তখন থাকলে, সবকিছুই সুন্দরভাবে থাকতো।
-ম্যাডাম, সমস্যা হয়েছে আপনি ডিপার্টমেন্টে একদমই তো থাকতেন না। আমিই সব করতাম। আপনি ভিসি আর সিসি স্যারের সাথেই সারাদিন কাটাতেন। আবার তপোবন স্যারের সাথে রুম বন্ধ করে সন্ধ্যা পর্যন্ত থাকেন, সব কথাই তো বাতাসে উড়ে বেড়ায়। ড. সেলিনা খাতুন বোর্ডের স্পাই, আপনি জানেন না! তাকে তো বোর্ড এখানে সরাসরি ক্লাস দিয়েছে। তিনি তো এখানকার সব কথা বানিয়ে বেলুনের মতো ফুলিয়ে সিসিকে ফোনে বলে, আপনি জানেন এসব? আমি নিজের কানে অনেকবার শুনেছি। অন্য খণ্ডকালীন যে সব শিক্ষক আছেন, তারা তো ক্লাস গুনে টাকা নিতে আসেন। তারা তো ঠিকমতো ক্লাসই নেন না। আসেন, চা খান। গল্পগুজব করেন। ছেলেমেয়েদের সাথে একআধটু আলোচনা করেন। এই তো! ডিপার্টমেন্টের কোনো বিষয় নিয়েই কেউ মাথা ঘামায় না। একজন ছাত্র থাকুক না একশজন থাকুক; তাতে এদের কিছু আসে যায় না। তদের ক্লাস পেলেই হলো! আমি আপনাকে এসব বলবো অনেকবার ভেবেছি, একদমও যে বলিনি, তাও নয়। আপনি কানে তোলেননি। ডিপার্টমেন্টে তো কোনো নিয়ম কানুন কিছুই নেই। আরিফুল আর আমি দুজনে কিভাবে কী করবো! আমাদের কথা কে শোনে! কে মানে! প্রোগ্রাম অফিসার আর পিয়নের কথায় কি একটা ডিপার্টমেন্ট চলে! এখানে আরও অনেক বাজে ঘটনা ঘটে। সবার সামনে ছেলেমেয়েরা একে অপরকে লাভ কিস পর্যন্ত করে। জড়িয়ে ধরে। বিশ্রি অবস্থা!
-ক্লাস শেষে যখন কেউ থাকে না, তখন কোনো কোনো ছেলেমেয়ে রুমের ভেতর ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশা করে। আমি নিজে হাতে ধরেছি। উল্টো আমাকেই ধমকায়। আমার কথা কেউ শোনে না। আপনাকে একবার বললাম, আপনি বললেন, এ বয়সে ছেলেমেয়েরা ওসব একআধটু করেই থাকে! বয়সের দোষ! সবকিছুই দেখতে যাও কেন! আমাকেই দোষারোপ করা হলো আমি নাকি সারদিন রুম বন্ধ করে ব্লুফ্লিম দেখি! আরিফুলের সাথেও সম্পর্ক, আপনিও বললেন সেদিন। আরও কত কী!
-তুমি যে এটা দেখো, তা কিন্তু সত্য। রুম বন্ধ করে হেডফোন কানে লাগিয়ে ওসব দেখো। এর কিন্তু সত্যতা আছে। আমি নিজে এটাকে অন্যভাবে ধামাচাপা দিয়েছি। আরিফুলের ব্যাপারটা আমি জানি না। আমি শুনেছি। তোমাকে বলেছি। সত্য-মিথ্যা তুমিই ভালো জানো।
ফারিয়া ভাবে, এখানে তো কিছুই গোপন থাকে না! ভাবতাম, আমি যা করি কেউ তা জানে না! তাহলে কি এসব আরিফুলের কাজ! বেশ শয়তান আছে! বউ তো কাছে থাকে না! গ্রামে ফেলে রেখে এখানে চাকরি করে তো। ভালোই সুড়সুড়ি আছে! এই সুড়সুড়িটা কাজে লাগিয়ে ওর সাথে এমন ভাব করে চলতে হবে, যাতে পায়ের কাছে নেড়ি কুত্তার মতো বসে থাকে। আর স্বপ্ন দেখবে প্রোগ্রাম অফিসার ফারিয়া ওর প্রেমে দেওয়ানি! এটা না করে চললে বিপদ। আর ওর সাথে আমার বদনাম তো কিছু হলেও রটেছে। কিন্তু এখন ওরকম কোনো বাজে কথা ছড়ালে সাথে সাথে চাকরি নাই হয়ে যাবে। ফারিয়া নিজের মস্তিষ্কের কোষে চতুরতার বুদ্ধি একপাশে চেপে রেখে, ড. ফারজানাকে বললো, আপনি নিজে ডিপার্টমেন্টে না থাকলে কি টিচাররা থাকেন! থাকেন না। কখনো থাকলেও নিজের রুমেই বসে সারাক্ষণ ফেসবুকিং করেন। ফোনে কথা বলেন। আমি তো আর তাদের এসব নিয়ে কথা বলতে পারি না। তারা আমার স্যার, বস।
-এত সমস্যা! তুমি আগে বলোনি কেন? এখন এতকিছু বেরুচ্ছে! এ তো কেঁচোর গর্ত থেকে গোখরা সাপ বেরুচ্ছে। আসলে এর পেছনে ড. এলিনার একটা বড় হাত আছে। তুমি জানো তার সম্পর্কে কিছু?
-না, ম্যাডাম। আমার রুমে উনি দু একদিন এসেছেন। নাক উঁচু ভাব নিয়ে কথা বলেন। আমার ভালো লাগেনি।
-ও একসময় শান্তিপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন পার্টটাইমার হিসাবে পড়াতো। সেখানে ভিসি ছিলেন প্রফেসর দেলোয়ার হাসনাত। বাংলা বিভাগের প্রধান ছিলেন ড. মোমেনা খাতুন। সম্ভবত এখনো আছেন। আমি তাকে চিনি। তার স্বামী নেই। স্বামী মারা গেছে না ডিভোর্স দিয়েছে; অতটা জানি না। এই মহিলা একা থাকেন। তার সম্পর্কে কেউ কিছু বলতেও পারে না। একটা রহস্যময় টাইপের মহিলা। এই মোমেনা খাতুন ওখানে নামেই বাংলা বিভাগের প্রধান। আসলে সে হলো প্রফেসর দেলোয়ার হাসনাতের রক্ষিতা। দেলোয়ার হাসনাতের ওয়াইফও তা জানেন। ওখানে ড. এলিনা রহমান ঢোকার পর প্রফেসর দেলোয়ার হাসনাত যখন এলিনার রূপে মুগ্ধ হয়ে তার দিকে বেশি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন, তখন এসব নিয়ে মোমেনা খাতুনের সঙ্গে প্রফেসর দেলোয়ার হাসনাতের তুমুল দ্বন্দ্ব হয়। একসময় সিদ্ধান্ত হয় মোমেনাকে বাদ দিয়ে ড. এলিনাকে বিভাগের প্রধান করবেন। মোমেনা যখন দেখলেন প্রফেসর দেলোয়ার হাসনাত ও ড. এলিনার মধ্যে অবাধ শারীরিক সম্পর্ক হয়ে গেছে, তখন মোমেনা খাতুন ভিসিকে স্পষ্ট জানিয়ে দেন, এখানে আমি থাকবো, না হলে এলিনা থাকবে, দুজন এক সাথে থাকবো না। যদি আপনি এলিনাকে নিয়ে থাকতে চান, থাকেন। আপনার সাথে আমার যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, বছরের পর বছর আপনি আমাকে যেভাবে ভোগ করেছেন, আমাকে ঘর সংসার পর্যন্ত করতে দেননি, বাইরের জগতের কারও সাথে মিশতে দেননি; তার সব প্রমাণ আমার কাছে আছে। আর আপনি তো বিদেশ থেকে এসে এখানে বিশ্ববিদ্যালয় বানিয়ে ভিসি হয়েছেন, প্রফেসর হয়েছেন, নামের সাথে ডক্টর লাগিয়েছেন, আপনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ছিলেন? কান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করেছেন? এসব প্রশ্ন ছুড়ে দেয় মোমেনা। তিনি প্রেস কনফারেন্স করে তার মুখোস খুলে দেওয়ার হুমকি দেন। সবাই আপনার আসল চেহারাটা দেখতে পাবে। আর আমার! আমার তো সবই গেছে। আগামীকালের ভেতর যদি আপনি এলিনাকে এখান থেকে বের না করেন, পরশু দিন প্রেস ক্লাবে আপনার বিরুদ্ধে কনফারেন্স হবে। এখন সিদ্ধান্ত আপনার, কী করবেন, ভাবেন!
নিজের চরম বিপদ অনুধাবন করে প্রফেসর দেলোয়ার হাসনাত ড. এলিনাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরের দিন নয়, সেদিনই বের করে দেন।
-ম্যাডাম, এ তো দেখি ভয়ঙ্কর মহিলা! আপনি তার সম্পর্কে এত কিছু জানেন তো ম্যানেজমেন্টকে বলেননি কেন?
-বললে বিশ্বাস করবে কে! আমার কাছে কি এসবের দলিল আছে, কোনো প্রমাণ আছে! কিছুই নেই। কিন্তু ঘটনা সত্য, সবাই জানে। মোমেনা তো আমার ক্লাসমেট। আমার বন্ধু। আমি এখানে চাকরি হওয়ার আগে ওর কাছে পার্টটাইম ক্লাসের জন্য গিয়েছিলাম। আমাকে তখন ও এসব বলেছে। বলেছে, এখানে তুমি টিকতে পারবে না। তখন ভিসির সাথে ওর নিজের কী রকম সম্পর্ক সেসব ছবিও কিছু কিছু আমাকে দেখিয়ে গর্ব করেছে। আর এসব তো ওখানেও সবাই জানে। এলিনা তো খারাপ মেয়ে হিসেবে ওখানে পরিচিত। মোমেনাকেও তো ভিসির রক্ষিতা হিসেবেই সবাই জানে। মোমেনা তা নিজেও জানে এবং তা নিয়ে সে রীতিমতো গর্ব করে। আমাকেই কতবার গর্বের সাথে বলেছে। ওর সুবিধা হলো, ভিসি নিজেই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক। ধরো, এখানে যদি ড. শাহেদ জাহান বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক হতেন, আজ আমার এই করুণ অবস্থা হতো না। দুর্নাম বদনাম হতো ঠিকই। সামনে কেউ কিছু বলে সাহস করতো না।
-ম্যাডাম, এসব বাজে লোক ভিসি হয় কী করে?
-এসব ভিসি ভারপ্রাপ্ত ভিসি হয়ে বছরের পর বছর বিশ্ববিদ্যালয় চালায়। আবার কেউ আছে রাজনীতির ক্ষমতা খাটিয়ে অনুমোদন নিয়েও আসে। সমস্যা হলো তোমার আমার মতো চুনোপুটিদের!
-আপনি অত চিন্তা কইরেন না ম্যাডাম। একসময় সব ঠিক হয়ে যাবে।
-হবে না ফারিয়া, হবে না। বিভাগে নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে, দেখোনি?
-না তো। তবে শুনেছি ড. এলিনা রহমান নতুন চেয়ারপারসন হয়ে এখানে আসবেন। -সেদিন আমার এখানে তিনি নিজেও ওরকমই একটা ইঙ্গিত বোঝাতে চাচ্ছিলেন। আমার খুব খারাপ লাগছিল। ফারিয়ার গলা ধরে আসে। চোখ ভিজে আসে। বললো, আপনি না থাকলে এখানে আমি চাকরিটা করতে পারবো কি না সন্দেহ আছে! এলিনা ম্যাডাম খুব বাজে প্রকৃতির মহিলা।
ড. ফারজানা কোনো কথা না বলে উদাস চোখে কিছু একটা দেখলেন। হতাশকণ্ঠে শুধু বললেন, ভিসি আর সিসির পেছনে না দৌড়ে নিজেকে এভাবে দিনের পর দিন নিঃশেষ না করে, যদি ডিপার্টমেন্টটাকে যত্ন করে গড়ে তুলতাম, তাহলে হয়তো আজ নিজের জীবনে সর্বনাশের এত বড় মেঘ জমতো না। জানো ফারিয়া, বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি এখন খুব একা! ছেঁড়া নোংরা কাগজের মতো উড়ছি। কেউ ফিরেও দেখে না। দেখেও না দেখার ভান করে পাশ দিয়ে চলে যায়। আর আগে দূর থেকে ছুটে এসে সালাম দিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতো। আসলে পাপ করলে তার প্রায়শ্চিত্ত হয়ই।
-ম্যাডাম, মৃত্যুর কিনার থেকেও তো কোনো কোনো মানুষ বেঁচে ওঠে, নতুন জীবন ফিরে পায়। আপনিও একবার না হয় ওরকম করে চেষ্টা করুন, জিততেও তো পারেন। বর্তমান ভিসি স্যার তো সত্যিকারের একজন ভালো মানুষ। কাজ দেখিয়ে ডিপার্টমেন্টকে ডেভেলপ করে নিজেকে প্রমাণ করে দেন। সবাই তো বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় সত্যিকারের একজন ভগবান পেয়েছে।
হতাশ কণ্ঠে ড. ফারজানা বললেন, কঠিনের থেকেও কঠিন। আমার পাপের ফাইলটা অনেক বেশি ভারী হয়ে গেছে। লালনের গানটা শোনোনি, সময় গেলে সাধন হবে না…।
চলবে…
ঈশ্বর ও শয়তান-১৩॥ রকিবুল হাসান