পরিপাটি করে রান্না ঘরের পাশাপাশি উঠান আর ভাঁড়ার ঘরটাও লেপে ফেললো নুপুর। গতকালই নদী থেকে মাটি তুলে এনেছিল। এঁটেল মাটি। কালো, ঘন, আঠালো। এই দিয়েই কুমোরেরা মাটির তৈজসপত্র, পুতুল, খেলনা বানায়। মূর্তি গড়ে। পাশের বাড়ির অরুণামাসি মাটি তুলছিল। তাই দেখে নুপুরেরও মাথায় এলো, ঘরবাড়ি একবার লেপে দিলে বেশ হয়। সে-ও মাটি নিয়ে এলো।
লেপা সবে শেষ করেছে, কোমরে গোঁজা ছোট্ট কালো ফোনটায় কল বেজে উঠল। ‘পয়লা নেশা পয়লা পেয়ার’… নুপুরের স্বামী আজমত এই গানটা রিংটোন হিসেবে সেভ করে দিয়েছে। ছোটখাটো, হালকাপলকা, কালো চেহারার হলেও বেচারা খুব রোমান্টিক। প্রায় দুইবছর হতে চলল বিয়ের, কিন্তু সে এখনো প্রথম দিনের মতোই রোমান্টিক! ঢাকায় থাকে। রিকশা চালায়। প্রতিমাসে সংসার খরচ পাঠায়। মোবাইলফোনে কল দিয়ে ভালোবাসার কথা বলে! তবে এইটা তার ফোন না।
উঠানের কোণে রাখা মটকা থেকে পানি দিয়ে দ্রুত হাত ধুয়ে আধভেজা হাতেই ফোন রিসিভ করে নুপুর। ওই পাশ থেকে মন্তাজের কণ্ঠ ভেসে এলো, আমার জানপাখিটা কী করে?
-ফোন দিছ ক্যান? ফোন রাখো।
-তোমার জইন্যে পরান পুড়ে, তুমি জানো না।
-জানি। জানি বইল্যাই তো…অখন রাখো। রাখতাছি। কিন্তু…
-দুইটা দিন যাইতে দেও।
মন্তাজ কী একটা বলতে যায়, তার আগেই নুপুর লাইন কেটে দেয়। এখন কথা বলার সময় নয়!
বড় ঘর থেকে শ্বাশুড়ির কণ্ঠ ভেসে আসে, বউরে ভাত রানছোস?
-রানছি মা। শিমুল তুলার মতো নরম স্বরে জবাব দেয় নুপুর। আমি গা ধুইয়া আইসা ভাত দিতাছি।
ফোনটা কোমরে রেখে দ্রুত সরকার বাড়ির পুকুরে চলে আসে। আরও বাড়ির বউ ঝিরা গা ধোয়া, কাপড় কাচা, ঘষামাজা করতে ঘাটলায় ভিড় করেছিল। তাদের পাশ কাটিয়ে দ্রুত জলের কাছে নেমে যায়। পাশ থেকে তানিয়া বলে, কী গো ভাবি। চুপ কেন?
মেয়েটারে নুপুর দুই চোখে দেখতে পারে না। ঢাকায় কিছুদিন গার্মেন্টসে কাজ করে এসেছে। চাল-চলনে সেই ভাব। দেখতে শুনতে বেশ। একটা বিয়েও নাকি করেছিল। টেকেনি। মদ্যপ স্বামীর অত্যাচার থেকে বাঁচতে ঢাকা ছেড়ে এসেছে। ওরে দেখলেই নুপুরের গা জ্বলে। তামাম পুরুষ ওর দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে। এ সহ্য হয় না। তবু হেসে বলে, ঘরবাড়ি লেপছি তো। তাই ক্লান্তি লাগতেছে।
আজমত বাড়ি এলে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘুমায়। একসঙ্গে ঘুমানো ছাড়া আর কোনো আশাই পূর্ণ হয় না নুপুরের। তাই তো অফুরন্ত সময় দিতে পারা মন্তাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে নির্দ্বিধায়।
এই বৃষ্টি বাদলার দিনে ঘর লেপতে গেছ কেন? ঘর-বাড়ি লেপতে হয় ভাদ্র আশ্বিন মাসে। তাড়াতাড়ি শুকায়। ধবধব করে ঘরের ভিটা-পাশ থেকে কে একজন বলে। দ্রুত দুটো ডুব মেরে উঠে আসে নুপুর। ভাদ্র-আশ্বিনে যে ঘর লেপতে হয়, এটা নুপুরও জানে। কিন্তু এখন ঘর লেপাটা দরকার ছিল বড়! মুখে বলে ইন্দুরের গর্তে আর থাকা যাইতেছিল না! ইঁদুরের নাম শুনেই মেয়েরা সেই টপিকে আলাপ শুরু করে।
নুপুরের এখন গালগল্প করার সময় নেই। ভাত খেয়ে একটু ঘুমাতে হবে। গত দুই রাত ঘুমায় নাই। ঘুমাবে কিভাবে। রাতে বাতি নিভাইলেই মনে হয় ঘরের ভিটা দুই হাতে সরিয়ে আজমত উঠে আসছে! ভয়ে ঘুমাতে পারে না নুপুর। চোখ বুজলেই আজমতের মুখটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বিস্ময়ে বিস্ফারিত চোখ। বেচারা কোনোদিন কল্পনাও করেনি এমন ঘটনা ঘটতে পারে।
আসলে ঘটনা তো ঘটতোও না। আজমত ঢাকায় থাকে, তিনচার মাস বাদে বাদে আসে। নুপুরের একলা লাগে। আর একবার যে মধু খায়, সে কি মধু না খেয়ে থাকতে পারে? আজমতের অনুপস্থিতি, নুপুরের সদ্যযৌবন আর এরইসঙ্গে আজমতের চাচাতো ভাই মন্তাজের সঙ্গে পরিচয় যেন আগুনে ঘি পড়ার মতো। মন্তাজ সুপুরুষ। সুঠাম দেহী। আজমতের সঙ্গে তার তুলনা চলে না। নুপুরের মতো ষোড়শীর এমন পুরুষই দরকার। মন্তাজ এখনো বিয়ে করেনি। মেয়েরা যেমন চোখ দেখে বুঝতে পারে পুরুষ কী চায়, পুরুষেরাও তেমন পারে। আর পারে বলেই আজমতের অনুপস্থিতির সুযোগে পরস্পরের চোখের ভাষা বুঝতে কষ্ট হয় না। খুব স্বাভাবিকভাবেই কাছে টেনে নেয় দুজন দুজনকে! ক্রমশ ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়ে ওঠে। নুপুরের অন্ধ শাশুড়ি এসব কিছু বুঝতে পারে না। আর বুদ্ধিমতি নুপুরও শাশুড়ির সেবা করে নিজের প্রতি সন্দেহ দূরে রাখে!
মন্তাজ আর নুপুর স্বপ্ন দেখে ঘর বাঁধার। আজমতের কাছে তালাক চাইলে সে তালাক দেবে না, নুপুর জানে। আর কী বলেই বা তালাক চাইবে। নুপুরের প্রতি তার তো কোনো অবিচার নেই। শুধু কয়েক মাস বাদে বাদে বাড়ি আসে। এটা তালাক নেওয়ার জন্য কোনো জোরালো যুক্তি নয়। আর হালকা পলকা ছোটখাটো হইলেও সে তো নপুংসক না। কাজেই মন্তাজের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়াটাই সঠিক হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয় নুপুর।
দুই দিন আগে রাতে মন্তাজ এসেছিল। পূর্ব পরিকল্পনা মতো সেই রাতে তাদের পালিয়ে যাওয়ার কথা। অমাবস্যার রাত। ঘন অন্ধকার। রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলেও কেউ দেখতে পাবে না। নুপুর তার শাশুড়িকে খাইয়ে দাইয়ে ঘরে আসে। শাশুড়িটার জন্য তার মায়া লাগে। নুপুর চলে গেলে কে তাকে দেখাশোনা করবে। ভেবে, একটু জলও জমে চোখের কোণে। কিন্তু নিজের সুখ আনন্দের কথা ভেবে এই মায়াটুকু মন থেকে সরিয়েও দেয়।
জীবন একটাই। এই দুই বছরে আজমতকে সে কয়দিন পেয়েছে? আর মন্তাজের মতো সুখ কি দিতে পেরেছে কোনোদিন? পারেনি। তাছাড়া নুপুরেরও তো ইচ্ছে করে স্বামীর হাত ধরে সিনেমা দেখতে যেতে। নতুন শাড়ি গয়না পরে স্বামীর মুখে প্রশংসা শুনতে। গ্রামে কত মেলা হয়, বৈশাখী মেলা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা আরও কত কী। সমস্ত উৎসব পার্বণে নুপুরের সইয়েরা যখন স্বামী সন্তান নিয়ে আনন্দ করে, সে সময়গুলোয় আজমত বাড়িতেই আসে না।
সে বলে উৎসব পার্বণে আয় রোজগার ভালো হয়। তখন গাঁয়ে গিয়ে বসে থাকলে চলবে?
নুপুর এত কিছু বোঝে না। সে শুধু চায় স্বামীর সঙ্গে থাকতে। দিনশেষে স্বামীর সঙ্গে বসে সুখ দুঃখের কথা বলতে। হুটহাট ঝগড়া করে আদর সোহাগ পাইতে!
কিন্তু আজমতের সঙ্গে তেমন হওয়ার নয়, বুঝে গেছে নুপুর। আজমত বাড়ি এলে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে ঘুমায়। একসঙ্গে ঘুমানো ছাড়া আর কোনো আশাই পূর্ণ হয় না নুপুরের। তাই তো অফুরন্ত সময় দিতে পারা মন্তাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে নির্দ্বিধায়।
বারোটায় বের হওয়ার কথা, এ বাড়ি ছেড়ে চিরতরে। এমনই যখন সব ঠিকঠাক, কথা নাই বার্তা নাই হঠাৎ আধ ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢোকে আজমত, নুপুর আর মন্তাজ তখন শরীরী খেলায় মগ্ন।
আর তখনই খুব মৃদু স্বরে মোবাইল ফোন বেজে ওঠার শব্দ ভেসে আসে ঘরের সদ্য লেপা মেঝের নিচ থেকে, যেখানে আজমতকে পুঁতে রেখেছে নুপুর।
আজমতের ঘরে ঢুকে স্তম্ভিত। নুপুর আর মন্তাজও ধরা পড়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়।
আজমতের চোখে আগুন জ্বলে ওঠে, নষ্টা মাইয়ামানুষ! বলতে বলতে সে লাফিয়ে গিয়ে নুপুরের চুলের মুঠি খামচে ধরে।
মন্তাজ বুদ্ধিমান পুরুষ। সে বুঝে এখনই কণ্ঠ রোধ না হলে বিপর্যয় সুনিশ্চিত। মুহূর্ত মাত্র, হালকা পাতলা, ছোটখাটো আজমতকে একলাফে গলাচেপে ধরতে তার বেগ পেতে হয় না। আজমত ছাড়া পেতে ছটফট করে। হাতের মুঠো থেকে নুপুরের চুল খুলে পড়ে। নুপুর দ্রুত আজমতের পা দুটো চেপে ধরে। আর কোনো ঝামেলা না করেই আজমত শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।
ঘরের মেঝেয় গর্ত করে আজমতকে পুঁতে দিয়ে মন্তাজ বেরিয়ে যাওয়ার আগে বলে, কয়দিন চুপচাপ থাকো। আমি দুয়েক সপ্তাহ পর তোমারে নিয়া যাব।
আজমতকে গ্রামে ফিরতে দেখেছিল বাজারের পাহারাদার ফিরোজালী। বাস থেকে একাই নেমেছিল আজমত। ফিরোজালীকে দেখে নিজেই কুশলাদি জিজ্ঞেস করেছিল। ছোটবেলা থেকে একসঙ্গে বেড়ে উঠেছে। দেখা হলে তাই কথা ফুরাতে চায় না। তবু পরদিন বিকালে বাজারে দেখা হবে বলে আজমত বিদায় নিয়েছিল। দুদিনেও তাকে বাজারে না পেয়ে ফিরোজালী নিজেই আজমতের বাড়ি চলে এলো। সঙ্গে দুই বাজারি।
দুইরাত জাগা তার ওপর বাড়ি ঘর লেপেমুছে ক্লান্ত নুপুর তখন দাওয়ায় মাদুর পেতে ঘুমোচ্ছিল। ফিরোজালী এসে ডাকাডাকি শুরু করলে ধড়মড় করে জেগে ওঠে নুপুর।
-ভাবি, আজমত কই?
ফিরোজালীর প্রশ্নে থতমত খেয়ে যায় সদ্য ঘুম ভাঙা নুপুর। হে, হে তো ঢাহা।
-ঢাহা? কন কী? তিন দিন আগে তার লগে বাসস্ট্যান্ডে আমার দেখা হইছে, রাইতের কালে।
-কী কন! আকাশ থেকে পড়ার ভান করে নুপুর। হে তো চাইর মাস ধইরা গেরামেই আহে নাই।
-ফিরোজালী আরও বিস্মিত হয়, আমার লগে কথা হইছে হেইদিন।
-আপনের লগে কথা হইলে হে বাড়িত আইব না?
-তাই তো। ফিরোজালী সঙ্গীদের দিকে তাকায়। তোমগোরে কইছিলাম না আজমত আইছে?
-হ। তারা সায় দেয়।
-গেরামে আইলে তো বাড়িত আইতোই। আফনে মনে হয় ভুল দেখছেন। বলে নুপুর তাদের ঘরে বসতে অনুরোধ করে, ভেতরে আইসা বসেন। নিজেকে সন্দেহের উর্ধ্বে রাখতে চেষ্টা করে।
নিতান্তই সৌজন্যতা। ভেবেছিল বসবে না। কিন্তু ফিরোজালী ও সঙ্গী দুজন ঘরে ঢুকে চেয়ারে বসে। আইচ্ছা হের ফোন নম্বরটা দেন তো দেহি।
ফিরোজালীকে আজমতের ফোন নম্বরটা দেয় নুপুর।
ফিরোজালী সঙ্গীদের দিকে ফেরে, পাহারা দিতে বাজারে ছিলাম তখন, বলতে বলতে মোবাইলে নম্বর টেপে।
আর তখনই খুব মৃদু স্বরে মোবাইল ফোন বেজে ওঠার শব্দ ভেসে আসে ঘরের সদ্য লেপা মেঝের নিচ থেকে, যেখানে আজমতকে পুঁতে রেখেছে নুপুর।
এই লেখকের আরও গল্প: মফিজ সাহেবের বাড়ি ॥ নুসরাত রীপা