(পর্ব-২৬)
মিলি মাহজবীন থরথর কাঁপছে শিমুলের বুকের মধ্যে। দুহাতে বুকের মধ্যে ঝাপটে ধরে শিমুল ধীরে ধীরে বলে, ভয় পাওয়ার কিছু নেই মিলি। ওগুলো শিয়াল, খেক শিয়াল। রাত হলে ডাকে।
এত জোরে ডাকে? দেখো আমার শরীর কাঁপছে। ফিসফিসিয়ে বলে মিলি। চলো ঘরে যাই।
আচ্ছা, চলো।
বুকের ওপর থেকে সরিয়ে হাত ধরেছে মিলির, মিলির হাতও কাঁপছে। মিলির চিৎকারে ঘরের মধ্যে থেকে বের হয়ে এসেছে শ্বশুর শামসুদ্দিন, শ্বাশুড়ি পারুল বেগম, ননদ রূপালী আখতার। শিমুলের হাত থেকে মিলির হাত নিজের হাতে নেয় রূপালী। প্রায় জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে। অভয় দেওয়ার কণ্ঠে বলে, তুমি ভয় পাইচো ভাবী? ভয়ের কিচ্ছু নাই। এই দেহো, আমরা সব তোমার লগে।
পেছনে উৎকণ্ঠার সঙ্গে দাঁড়িয়ে দেখছে তমাল। খেকিয়ে ওঠে রূপালী, যা একটা চেয়ার লইয়া আয়। দেখোস না ভাবী ভয় পাইচে?
তমাল দৌড়ে ঘরের দিকে যায়। পারুল বেগম হাত ধরেন মিলি, ও মাইয়া ভয় পাইচো? পরিশ্রমের খটখটে হাত বুলায় মিলির মুখে, ভয়ের কিছু নাই। এই তো তোমার কাছে আমি, তোমার শ্বশুর, শিমুল, রুপালী আছি। মাথায় হাত বোলায় পারুল বেগম, আর কোনো দিন হিয়ালের ডাক হোনো নাই?
মাথা নাড়ায় মিলি, না মা।
কাছে এসে দাঁড়ায় শামসুদ্দিন, তুমি কি যে কও তমালের মা? বৌমা হইলো শহরের মাইয়া। শহরে কি বন জঙ্গল থাহে? তোমার মনে নাই, বঠর পাঁচেক আগে যে খুলনা গেছিলা, খুলনা শহরে কোনো বন জঙ্গল দেখছো? বন জঙ্গল থাকলে না শিয়াল থাকবে?
মিলি মাহজাবীনের ভয় অনেকটা কেটে গেছে। বাড়ির সবাই ছুটে এসেছে। ওকে অভয় দিচ্ছে, পাশে দাঁড়িয়েছে। শিমুলের বাবা শহরের বন জঙ্গলের তুলনা খুব ভালো লেগেছে মিলির। কঠিন বিষয় খুব সহজে বুঝিয়ে দিলেন। অদ্ভুত একটা ভালো লাগায় মনটা ভরে যায় মিলি মাহজাবীনের।
ভাবী? আপনের চেয়ার। ঘাড় থেকে চেয়ার নামিয়ে সামনে রাখে তমাল।
এই চেয়ারে বসো ভাবী, মিলির হাত ধরে বসিয়ে দেয় রূপালী।
রূপালী?
মা?
এক গ্লাম পানি আইনা দে মাইয়ারে। পানি খাইলে শরীরে বল পাইবে।
যাইতেছি মা, রুপালী দৌড়ে ঘরের দিকে যায়। তমাল ঘরের মধ্যে থেকে তিনটা জল চৌকি এনে দেয়, সঙ্গে সঙ্গে বসে শামসুদ্দিন, শিমুল আর পারুল বেগম। চাঁদটা মাথার ওপর উঠে এসেছে। কৃষ্ণপক্ষের ক্ষয়িষ্ণু চাঁদ মাথার ওপর উঠে এসেছে। বালু চিকচিক হালকা আলো ছড়িয়ে চারদিকে। সামনে চওড়া জায়গায় দুপুরের গোসলের পর পারুল বেগম কাপড় শুকাতে দিয়েছে আড়ার ওপর। হালকা হাওয়ায় সেই কাপড় দুলছে। কয়েক হাত দূরে পুকুরের টলমল পানি অদ্ভুত অপার্থিব সৌন্দর্য তৈরি করেছে।
মা, বৌমা?
জি আব্বা?
তোমার মা বাপরে তো বইলা আসো নাই। কিন্তু তুমি তো হেগো মাইয়া। হেরা কষ্ট পাইতেছে না? কালকে একটা চিঠি লিখবা। লিখবা চিঠিতে- তুমি আমাগো ধারে আছো। ভালো আছো। আমি তো বাবা। মাইয়া পোলা হইলো কইলজার টুকরা। হেই কইলজার টুকরা ধারে না থাকলে বাপ মায়ের ভালো লাগে না, মনে বড় কষ্ট পায়। তুমি টিঠি লেইখা আমারে দিও, আমি পোস্ট কইরা দিমু। আমার কতায় কষ্ট পাইলা মা?
দুহাতে মুখ ঢেকে হু হু কান্নায় ভেঙে পড়ে মিলি মাহজাবীন। মিলির হঠাৎ কান্নায় সবাই অপ্রস্তুত। শিমুল কী বলবে বুঝতে পারে না। মাথার ওপর হাত রাখে পারুল বেগম, কী হইচে মা?
অন্তত পিরোজপুরের সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে বিএ পাস করুক। কিন্তু বাসুদেব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় অষ্টম শ্রেণীতে খুব ভালোভাবে ফেল করার পর, মোর লেহাপড়া ভালো লাগে না।
সঙ্গে সঙ্গে দাঁড়িয়ে ঘুরে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে দুহাতে, মা!
কী মা? পারুল বেগমও জড়িয়ে ধরে ছেলের বউকে। কী হইচে তোমার? ওনার কতায় কষ্ট পাইচো?
না মা, কান্নার বেগ কিছুটা কমেছে মিলির।
তাইলে কানতেছো ক্যা?
আব্বার কথায় আমার ঢাকার বাবা-মাকে মনে পড়ে গেলো যে! ওরা তো আমাকে ভীষণ ভালোবাসে, নিশ্চয়ই মা চিন্তা করে এখন হাসপাতালে।
হাসপাতালে মানে? শিমুল প্রশ্ন করে, কিভাবে জানলে হাসপাতালে তোমার মা?
বাসায় ছেলে মেয়ে নিয়ে কোনো ঝামেলা হলেই মায়ের হাইপারটেনশন বেড়ে যায়। আর মা সেন্স হারায়। তখন তিন চারদিন হাসপাতালে থাকতে হয়, বাসার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে মিলি মাহজাবীন। নিশ্চয়ই আমার জন্য মা হাসপাতালে…আবার গলা জড়িয়ে আসে কান্নায়।
এটাই তো স্বাভাবিক মা, আরও নরম গলায় বলে শামসুদ্দিন। তোমার বাবা-মায়ে তোমার হাতের লেখা চিঠি পাইলে বোঝবে, তুমি ঠিক আছো।
জি, আমি কালকেই চিঠি লিখবো মা-বাবাকে।
ঠিকাছে, তাইলে এহন তোমারা ঘুমাও। মেলা রাইত অইচে। শিমুলের মা, ঘুমাইতে লও, দাঁড়ায় শামসুদ্দিন।
হয়, লন। শামসুদ্দিন, পারুল বেগম চলে গেলে পেছনে পেছনে যায় রূপালী আখতার আর তমাল। আবার দুজনে, কৃষ্ণপক্ষের আধো জোছনায় দাঁড়িয়ে থাকে। দরজা বন্ধের শব্দ পেলে শিমুল বুকের সঙ্গে ঝাপটে ধরে মিলিকে, মিলি মুখ তুলে তাকায়, শিমুল নিজের মুখ নামিয়ে আনে মিলির আলতো ভেজা লাল কামনামুখর ঠোঁটে।
প্রথম আদর নিয়ে মিলি ফিসফিসিয়ে বলে, চলো। ঘরের মধ্যে যাই।
চলো, বুকের সঙ্গে ঝাপটে ধরে মিলিকে নিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বিছনায় যায় শিমুল। মিলি শুয়ে পড়ে বিছানায়, শিমুল দুহাতে জড়িয়ে নেয় বুকের সঙ্গে নিবিড়ে গভীরে মিলিকে। মিলির মুখে সুখের নির্মল ঢেউ ভাঙিয়া ভাঙিয়া পড়ে।
সকালে ঘুম ভাঙে শিমুলের বন্ধুদের হাকডাকে।
গতকাল দুপুরের পর বাড়ি আসতে আসতে খেয়ে দেয়ে ঘুমিয়ে উঠতে উঠতে রাত। শিমুল বন্ধুদের কাছে যেতে না পারলেও বন্ধুরা ঠিকই জেনে যায়, ঢাকা শহরের মেয়েকে বৌ করে নিয়ে এসেছে বন্ধু শিমুল। সন্ধ্যার সময়ে উজানগাঁও বাজারে প্রথম খবরটা শোনে মুজাহার। মুজাহার উজানগাও হাইস্কুলে টেন পর্যন্ত একসঙ্গে পড়েছে। পিতা মারা যাওয়ায় পড়াশোনার খরচ আর চালাতে পারেনি, বাজারে মুদি মনোহরি একটা দোকান দিয়ে বসেছে। আর এক বন্ধু এনামুল হক মেট্রিক পরীক্ষা দিয়ে পাস করার পর পিরোজপুরের কলেজে এইএ পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে, পরীক্ষা আর দেওয়া হযনি, বাড়ির পাশের লাইলীর কারণে।
লায়লীর বিয়ের প্রস্তাব পাকা হলে এক সন্ধ্যায় লায়লী বাড়ি ছেড়ে পিরোজপুরে, কলেজের বোডিংয়ে হাজির। বন্ধুরা মিলে সেই রাতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেয় এনামূলকে। এনামুল দেখলো প্রেমিকা লাইলী বিয়ের পর স্ত্রীতে রূপান্তরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সংসারের টান বাড়ছে। আয় রোজগার করা দরকার। ঢুকে যায় গ্রামীণ চিকিৎসা প্রশিক্ষণে। সেই প্রশিক্ষণ নিয়ে উজারগাঁও বাজারে বিরাট পসরা সাজিয়ে বসেছে লাইলী মেডিকেল হল নামে দোকান খুলে।
মুজাহার দৌড়ে যায় লায়লী মেডিকেল হলে, খবর হুনচো?
ক্রেতাকে ওষুধ দিতে দিতে তাকায় এনামুল, কী হইচে?
শিমুলতো বাড়ি আইচে, গলার মধ্যে এক ধরনের আনন্দ উপচে পড়ছে।
হালায় কই? বাজারে আইচে? আইলে গলায় গামছা লাগাইয়া আমার দোকানে লইয়া আয়। আর গৌতম দার দোকান দিয়া গজা আন। ওতো গজা খাইতে খুব পছন্দ করে, মুজাহারের সঙ্গে কথা শেষ করে আর একজন ক্রেতার কাছ থেকে ওষুধের প্রেসক্রিপশন হাতে নেয় এনামুল হক।
আরে ঘটনা তো আছে আরও!
কী ঘটনা? এনামুলের চোখ প্রেসক্রিপশনের ওপর।
শিমুল তো বউ লইয়া আইচে।
ওষুধের প্রেসক্রিপশনের ওপর থেকে চোখ সরিয়ে তাকায় মুজাহারের দিকে, কস কী?
তোরে তো হেইডাই কইতে আইলাম। একটা কিছু করা দরকার না?
করা তো দরকারই, বৌ দেখছো? কেমন?
আমি কেমনে কমু? আমারে কইচে শিমুলদের বাড়ির গণি ভাই। দোকানে আইচিল ডাইল নিতে। তয় ঢাকা শহরের মাইয়া। দেখতে নাকি মেলা সুন্দর। ঢাকা ইনভারসিটির ছাত্র শিমুলের বৌ।
আমাগো শিমুলও তো ঢাকা ইনভারসিটির ছাত্র, হাসে এনামুল, হারামজাদা একটা কামের কাম করছে। হোন মুজহার, শিমুল আমাদের বন্ধু। এমন কিছু করা যাইবে না, যাতে ও ঢাকার মাইয়ার কাছে ছোড অয়।
তুই ঠিকই কইচো এনামুল।
এক কাম কর। সালাম, মনিক, হানিফ আর হরলালরে খবর দে। আমি আইতেছি তোর দোকানে।
আইচ্চা। আয়, মুজাহার হন হন করে চলে যায় নিজের দোকানের দিকে। যেতে যেতে দেখা হয়ে যায় বাসুদেবের সঙ্গে। বাসুদেব হালদার অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর আর পড়েনি। বাপ জগদীশ হালদারের অনেক টাকা, জমিজমা। একমাত্র ছেলে, যদিও তিনটি মেয়েও ছিল। কিন্তু বাপের সবকিছুতো পাবে বাসুদেব হালদার। বাপ জগদীশ হালদারের খুব ইচ্ছে ছিল একমাত্র ছেলেটা লেখাপড়া করুক। অন্তত পিরোজপুরের সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ থেকে বিএ পাস করুক। কিন্তু বাসুদেব স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় অষ্টম শ্রেণীতে খুব ভালোভাবে ফেল করার পর, মোর লেহাপড়া ভালো লাগে না।
ছেলের যখন লেখাপড়া ভালো লাগে না, তখন আর কি করা! বছর তিনেক পরে জগদীশ হালদার একমাত্র পুত্র বাসুদেব বাবুকে বিবাহ করাইয়া দিলেন। হ্যাঁ, উজানগাও গ্রামে একটা বিবাহ হয়েছিল বটে। উজানগাও গ্রামের ঠিক মাঝখান দিয়ে ডিস্ট্রিকবোর্ডের রাস্তা চলে গেছে উত্তর থেকে দক্ষিণ দিকে। ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তার পূর্ব দিকের প্রায় সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের। মাঝে মধ্যে দু এক গৃহস্ত মুসলমানও ছিল। গ্রামের হিন্দু মুসলমান প্রায় তিনশো মানুষকে রবযাত্রী করে খাইয়েছিলো জগদীশ হালদার। বিয়ে হয়েছিল প্রায় আট দশ বছর আগে কিন্তু এখনও বিয়ের প্রসঙ্গ এলে উজানগাওয়ের সবাই বলে জোর গলায়, বিয়ে একখান খাইছিলাম বাসুদেবের বিয়া। ওই বিয়া আর কেউ খাওয়াইতে পারবে না।
তো বন্ধু বাসুদেবের এখন তিন মেয়ে, দুই পুত্র। পিতার সহায় সম্পত্তি নিয়ে যে বড়াই ছিল, সেই বড়াই অনেকটা কমে গেছে। মাত্র ত্রিশ বছরের মধ্যে চোখে মুখে বয়সের ছাপ প্রকাশ পাচ্ছে। বাসুদেবের বড় গুন শত যন্ত্রনাদায়ক পরিস্থিতির মধ্যেও মুখে একটা হাসি থাকে। আর বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় বসলে, এখনও নিজেকে প্রথম প্রেমিকের দাপট দেখায়।
বাসু? ওই বাসু? বাসু উজানগাও বাজারে এসেছে ক্ষেতের বেগুন বিক্রি করতে। বেগুনের কাছে মেয়ে ইলাকে রেখে খালের পারে এসেছিল বিড়ি টানতে। মুজাহারের ডাকে ফিরে তাকায়, কিরে?
ঘটনা হুনচোস?
মাথা নাড়ে দুদিকে বাসুদেব, না রে। কি ঘটনা?
শিমুলতো ঢাকা দিয়া নতুন বৌ লইয়া বাড়ি আইচে।
ফিক করে হাসি ফোটে বাসুদেবের মুখে, হাচাই?
হয়। সন্ধ্যার পরে আমার দোকানে আসিস। সবাই বইয়া একটা সিদ্ধান্ত লইতে হইবে, শিমুলের বৌ দেখতে কি কি লইয়া যামু, হেই বিষয়ে।
আইচ্ছা, আমি আমুনে।
সঙ্গে সঙ্গে হানিফ, এনামূল, মুজাহার, হরলাল, বাসুদেব দাঁড়িয়ে যায়। অবাক চোখে তাকায় ওরা, সামনে দাঁড়ানো এক জলপরীর দিকে। এত সুন্দর হয় কোনো নারী? চোখের পাতা নড়ে না কারও।
সন্ধ্যার পর পরই মুজাহারের দোকানের সামনে হাজির হয় এনামুল, বাসুদেব, হরলাল,সালাম, হানিফ হাজির। সন্ধ্যার পর লোকজন চলে গেলে অবসরের মানুষজন, দোকানীরা খালের পারে ছোট্ট মাঠের ঘাসের উপর বসে গল্প করে। মাঠের পাশেই মুজাহারের দোকান। সবাই বসলে দোকান বন্ধ করে মুজাহারও আসে, আসার আগে ভবানী শংকরের চায়ের দোকান থেকে চা আর নিমকির অর্ডার দিয়ে আসতে ভুল করে না। কিছু না খাওয়ালে মুখের কথায় পিঠের ছাল তুলবে বন্ধুরা, অভিজ্ঞা আছে মুজাহারের।
অনেক আলাপ আলোচনার পর ঠিক হয়, প্রত্যেকে একশো টাকা চাঁদা দেবে। মানিককে পাওয়া যায় নাই, কারণ মানিকের নানী অসুস্থ। অসুস্থ নানীকে দেখতে গেছে আতরখালী। মোটা টাকা হলো সাতশো। সাতশো টাকা নিয়ে খুব ভোরে বাসুদেব আর সালাম যাবে পারেরহাট। পাড়েরহাটে সমুদ্র থেকে বা কচানদী থেকে জেলেদের ধরা বড় বড় মাছ আসে। সেই একটা বড় মাছ নিয়ে বন্ধু শিমুলের বৌকে দেখতে যাবে বন্ধুরা। সকাল আটটার দিকে বাকী বন্ধুরা অপেক্ষা করবে উজানগাও বাজারে। পাড়েরহাট দিয়ে বড় মাছ নিয়ে আসলে সবাই মিলে একসঙ্গে যাবে শিমুলের বাড়ি।
সেই পরিকল্পায় পাড়েরহাট থেকে বিরাট, সাড়ে পনেরো কেজির কোরাল মাছ নিয়ে এসেছে বন্ধুরা বাড়িতে। এসেই হাক ডাক। সকালে উঠে নামাজ পড়ে কেবল শুয়েছিল শামসুদ্দিন, বাইরে এসে ওদের দেখে, আর বড় মাছ দেভে বুঝে হাসে, আসো আসো ভিতরে আসো। উঠানে রৌদ।
সামনের বারান্দায় বিরাট মাছ লম্বা হয়ে পড়ে আছে। রূপালী, তমাল মাছ দেখে অবাক। তমাল বাপের হাতের পাশ দিয়ে শরীর গলিয়ে উঠোনে নেমে দৌড়, জগদীশ কে জানাতে হবে না বিরাট মাছের ঘটনা?
পারুল বেগম সহাস্য মুখে বলে, এতবড় মাছ কুটবে কেডায়?
চাচি, মাছ কোটা লইয়া আপনে চিন্তা কইরেন না। উজানগাও বাজারে মাছ বিক্রি করে হানিফ, আমি থাকতে আপনার ভরসা নাই!
সবাই হাসে। হাসির মধ্যে ডাক ছাড়ে মুজাহার, শিমুল কইরে?
রূপালী আখতার দরজায় ধাক্কা দিলে ঘুমঘুম চোখে বাইরে আসে শিমুল, কি হয়েছে রে বুড়ি? বাড়ির মধ্যে এতো হল্লা কিসের?
দেইখা যাও… হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে সামনের বারান্দায় বন্ধুদের সামনে উপস্থিত করে শিমুলকে। এই দ্যাখো তোমার বন্ধুরা কি করছে?
ওকে পেয়ে সবাই মিলে ধেই ধেই নাচতে শুরু করে। পারুল বেগম আর শামসুদ্দিন ভেতরের ঘরে গিয়ে পরামর্শ করে, পোলাদের মুড়ি আর পাটালি গুড় দাও। তমালকে কও জগ ভইরা পানি দিতে। ওরা খুব কষ্ট করছে, নিজের মনে বলে শামসুদ্দিন।
রূপালীকে ডেকে বলে পারুল বেগম, তোর ভাবীরে ওঠা। মুখ ধুইয়া জিগা কী খাইবে। আর হ্যাগগো সামনে যাইতে অইবে, বুঝাইয়া ক শিমুলরে।
বন্ধুকে নিয়ে নানা ধরনের হালকা ঠাট্টা মশকরা করার মধ্যে ঘরের ভেতর থেকে দুই গামলায় মুড়ি, এক গামলায় পাটালি গুড় আসে। মুজহার, হানিফ, এনামুল, হরলাল, বাসুদেব, সালাম মুড়ি আর বাটালি গুড় খেতে খেতে বলে, ভাবী কই? যারে দেখতে আইলাম, হেই রাঙা ভাবী কই?
তোরা মিনিট দশেক সমায় দে, আমি মিলিকে নিয়ে আসছি, বলে শিমুল।
ওরা হাসে।
শিমুল ঘরের ভেতরে যায়। ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে সামনের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে মিলি। ইতিমধ্যে আশপাশের বাড়ি থেকে অনেক মহিলা শিশু এসে পুকুরপারে, রান্নাঘারের সামনে জড়ো হয়েছে। চোখে মুখে অপার কৌতুহল, ঢাকার মাইয়া দেখতে কেমন? মিলিকে বন্ধুদের ঘটনা অনেকটা বুঝিয়ে বলেছে রূপালী। মিলি হাসে মিট মিট আর আশেপাশের মহিলাদের দিকে তাকাচ্ছে। বুঝতে পারছে মিলি, আমাকে ঘিরে গোটা বাড়িতে, গ্রামীণ নারী পুরুষ শিশুদের মধ্যে প্রবল কৌতুলহ তৈরী হয়েছে। উপভোগ করছে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে পারুল এক একজন মহিলাকে ডেকে পুত্রবধূর সঙ্গে খানিকটা গর্ব আর কৌতুকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়। মিলি হাসে, হাত তুলে অভিবাদন জানায়, কেমন আছেন আপনি?
বিস্ময়ের সঙ্গে অপরূপ সুন্দরী, হালকা পাতলা গড়নের মেয়ে, গায়ের রঙ সিঁদুরে লাল। হাসলে টোল পড়ে গালে সেই মেয়ে কি চমৎকার ঢংয়ে কথা বলছে, শিশুদের গাল টিপে আদর করছে! বসতে বলছে। শাশুড়ির কাছ থেকে বাটি ভরা মুড়ি আর পাটালির টুকরো এনে দিচ্ছে।
মিলি?
পাশের বাড়ির ছোবাহানের মা-পরাণ চাচির কোলে, ছোবাহানের ছেলে রিপনকে নিয়ে এসেছে নতুন বৌ দেখতে। রিপনের গাল টিপে জানতে চায় মিলি, কী নাম তোমার?
জবাবে দেড় বছরের রিপন এক হাতে মুড়ি নিয়ে মুখে দেয়, আর এক হাতে পাটালি গুড়ের অর্ধেক নিয়ে দাদির পেছনে মুখ লুকায়। হাসে দাদি, বোঝলেন হারাদিন আমারে জালায়। মার কাছে যায়, বাপের কাছে যায় না, হারাদিন আমার লগে থাহে।
মিলি? ডাকে শিমুল।
আবার আসবেন, রিপনের গাল টিপে আদর করে এসে দাঁড়ায় শিমুলের কাছে, কী?
চলো। আমার বন্ধুরা আসছে তোমাকে দেখতে বিরাট এক মাছ নিয়ে।
চলো, দুজনে হাত ধরে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে। সামনের বারান্দায় বন্ধুরা বসে বসে গল্প করছে। হানিফ বলে, ঢাকা শহরের মাইয়াতো , আমাগো সামনে আইতে পারে।
না না, আইবো। আইবো না ক্যান? আমরা হের সোয়ামীর বন্ধু না? ছোটকালে এক লগে কতো খেলছি, শিমুল না হয় ঢাকা গেছে, ইনভারসিট-এনামুল হকের মুখের শব্দ থেমে যায়। রুমে ঢুকেছে মিলি মাহজাবীন। মিলির হাত ধরা শিমুল।
সঙ্গে সঙ্গে হানিফ, এনামূল, মুজাহার, হরলাল, বাসুদেব দাঁড়িয়ে যায়। অবাক চোখে তাকায় ওরা, সামনে দাঁড়ানো এক জলপরীর দিকে। এত সুন্দর হয় কোনো নারী? চোখের পাতা নড়ে না কারও।
চলবে…
মোকাম সদরঘাট-২৫॥ মনি হায়দার