এক.
বিকেলের বিষণ্ন হলুদ আলোয় বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চা খেতে খেতে সামনের চিলতে জমিতে লাগানো গাছগুলো তাকিয়ে দেখেন মফিজ সাহেব। অযত্ন, অবহেলায় গাছগুলো মৃতপ্রায় ধূলি-ধূসর মলিন। আগাছাও জন্মেছে বেশ।
ছোট্ট একটু জমি। ওতেই কায়দা করে জবা, কাঠগোলাপ, কামিনী, মাইক ফুল গাছের পাশে গন্ধরাজ, লেবু, করমচা, দেশি পেয়ারা, কুমড়ো, ঢেঁড়শ, বেগুন আরও কী কী সব গাছ ঠাসাঠাসি করে বুনেছে তাহমিনা। তার বরাবরই বাগান করার নেশা। সরকারি কোয়ার্টারে থাকার সময়ও বাড়ির বারান্দায়, রান্না ঘরের জানলার পাশের চওড়া জায়গাটিতে লেটুস, পুদিনা, কাচালঙ্কার গাছ লাগাতো পুরনো শিশি, বোতল, ভাঙা মগ বা কৌটোয়।
তাহমিনার বারান্দার বাগানে ফলানো কুমড়ো, পুঁইশাক আরও কত সবজি তো খেয়েছে পড়শীরাও।
বাগান করার এমন নেশা দেখে মফিজ সাহেব তাহমিনাকে কথা দিয়েছিলেন তিনি কোনোদিন ফ্ল্যাট বাড়ি কিনবেন না। একটুকরো জমি কিনে বাড়ি করে দেবেন। বলেছিলেন বটে কিন্তু হিসাবের টাকায় সংসার সামলে, সন্তানদের মানুষ করতে গিয়ে সঞ্চয় কিছু ছিল না বললেই চলে।
প্রথম শ্রেণীর সরকারি চাকরিজীবী ছিলেন। সৎ, ন্যায়পরায়ণ, ভালো মানুষ। রিটায়ার্ড করেছেন বছর দশেক হলো। রিটায়ারমেন্টের পর পাওয়া টাকার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ দিয়ে এই বাড়িটা কিনে তাহমিনাকে দেওয়া কথা রেখেছেন।
বাড়ি মানে জমিটুকুই যা। একতলা ইট-সিমেন্টের গাঁথুনিতে কিছু ঘর তুলেছেন থাকার মতো। ছেলেমেয়েরা অবশ্য বলেছিল আর্কিটেক্ট দিয়ে প্ল্যান করে মাল্টিস্টোরেড বাড়ি করতে। তাতে নিজেদেরও সন্মান বাড়বে আর ভাড়া দিয়ে পয়সাও আসবে। তাহমিনারও তেমন ইচ্ছে ছিল। তার ভাই-বোনেরা সব বিশাল বিশাল অট্টালিকায় থাকে। কিন্তু মফিজ সাহেব কারও কথা শোনেননি। জীবনের এতটা সময় পৃথবীতে কাটিয়ে কম অভিজ্ঞতা তো সঞ্চয় করেননি। তিনি ভালোমতোই জানেন, টাকা না থাকলে সন্তানদেরও পর হতে বেশি সময় লাগে না। যদিও নিজের সন্তানদের সত্যিকার মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পেরেছেন বলেই তার ধারণা। আর তাহমিনার কাছে তো ছেলেমেয়েরা স্বর্ণের টুকরো একেকজন। কিন্তু তবু নিজের হাত সম্পূর্ণ শূন্য করে ফেলতে মন সায় দেয়নি। যদিও শেষপর্যন্ত শূন্য করতে হলোই!
ছোটছেলেটা বিদেশ যাওয়ার জন্য বড্ড ঘ্যান ঘ্যান করছিল। মাস দুই আগে সঞ্চয়ের যেটুকু ছিল ছেলের হাতে তুলে দিয়েছেন। ছেলে এখন অস্ট্রেলিয়া না জার্মানে আছে!
দুই.
বয়স হলেও বুড়িয়ে যাননি মফিজ সাহেব। এখনো নিজে বাজার করেন। সকালে হাঁটতে যান। জমি কিনেছেন শহরতলী এলাকায়। সরকারি পেনশনের টাকায় মূল শহরে জমি কেনা সম্ভব নয়। এলাকাটা এখনো শহর হয়ে ওঠেনি। বিস্তর গাছপালা আছে। ফাঁকা জমি আছে। এঁদো ডোবা আছে কয়েকটা। ওখানে ছনের বন আছে, চোরাকাটার ঝোঁপ আছে। তেলকুচা লতার সাদা সাদা ফুল ফুটে থাকে আগাছার জঙ্গলে। মফিজ সাহেব কখনো সখনো মন চাইলে ওখানে যান। আশেপাশের দরিদ্র পরিবারের কিংবা দূরন্ত ছেলেপেলেদের ডোবা হাতড়ে মাছ ধরা দেখেন। ঘুড়ি ওড়ানো দেখেন। সেই কোনকালে গ্রামের বাড়ির পাট চুকিয়ে এসেছিলেন, মনেও নেই। বাচ্চা ছেলেগুলোর নানাবিধ দুরন্ত কাজ-কারবার তাকে শৈশবে ফিরিয়ে নেয়।
অ্যাম্বুলেন্সে করে তাহমিনাকে হসপিটাল নেওয়া হয়। মফিজ সাহেব বয়স্ক মানুষ বলে, ছেলে তাকে সঙ্গে যেতে নিষেধ করে। মফিজ সাহেব যাননি। তাহমিনাও আর আসেনি।
মেয়েরা সবাই বিবাহিত এবং দেশের বাইরে থাকে। মাঝে মধ্যে দেশে এলে বাপের বাড়িতে বেড়ায়। সে সময়গুলো বড্ড ভালো লাগে মফিজ সাহেবের। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে গল্প, আড্ডা, বেড়ানোয় কিভাবে যে সময় চলে যায়, বুঝতেই পারেন না।
মেয়েরা বাবার বাড়ির প্রশংসা করে। বলে, বাবা, এখানে এলে মনে হয় সত্যি বুঝি গ্রামে এসেছি। তুমি মাল্টিস্টোরেড বাড়ি না করে খুব ভালো করেছ। এই যে কেবল আমরা, আমরা সবাই; কী যে ভালো লাগে। ওই সব ফ্ল্যাট বাড়ি অসহ্য। আর ভাড়াটে নিয়ে থাকা যে কত গ্যাঞ্জাম।
শুনে তাহমিনা বলে, সব ঠিক আছে। কিন্তু হাতে নগদ টাকার অত দরকার হয় মা। রোগ বালাই আছে, ওষুধপত্র আছে। দুখান ঘর বাড়তি থাকলে ভাড়া দিলে ওই ক্যাশটুকু তো হাতে থাকতো। প্রয়োজনে কাজে লাগতো। তোমাদের বাবার পেনশন আর কয়টাকা?
শুনে মেয়েরা হৈ হৈ করে ওঠে। এটা কোন কথা বললা মা, টাকার প্রয়োজন হলে ফোন দিবা। এখন তো টাকা পাঠানো অনেক সহজ। তোমাদের ছেলেমেয়েরা সব ওয়েল স্টাবলিশড্। বললেই টাকা পাঠিয়ে দেব।
কথাটা মিথ্যে নয় কর্তা-গিন্নী দুজনেই জানেন। তবে টাকা যে চাওয়া হবে না, মানে চাইতে পারবেন না, সেটাও ভালোমতোই জানেন তারা। ছেলেরা দুজনেই অবশ্য বাবার এমন একতলা সাধারণ বাড়ি পছন্দ করেনি। বরং অন্তত তিনতলা বাড়ি না করায় বাবার সঙ্গে তাদের একটু মনোমালিন্যও হয়েছে। বড় ছেলে বেসরকারি ব্যাংকে কাজ করে। তার স্ত্রীও ব্যাংকার। তাদের দুই সন্তান নামকরা ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্র। বাবার টাকা সে চায় না। তার কথা বাড়িটা যদি তিনতলা হতো তাহলে ভাড়া বাবদ কিছু টাকা পাওয়া যেতো। আজকালকার দিনে একতলা বাড়ির বিলাসিতা মানায় না।
তিন.
চারিদিকে পাঁচ ফিট উচ্চতার পাঁচিল ঘেরা বাড়িটায় জৌলুস নেই বটে কিন্তু অপরিসীম শান্তি আছে। সৎ জীবন যাপন করার প্রাপ্তি এই শান্তি। তাহমিনা তো রান্না-বান্না, ঘর-সংসার সামলে দিনমান তার ওই বাগান নিয়েই পড়ে থাকতো। টুকটাক মৌসুমি ফল বা সবজি রোজই বাগান থেকে এক আধটা তুলে এনে মফিজ সাহেবের সামনে এনে বলতো, দেখেছো পেঁপে টা কী সুন্দর হয়েছে। এই দ্যাখো আজ আমার গাছের এই বেগুনটা ভাজি করব। তাহমিনার চোখ উজ্জ্বল। সুখ চকচক করে সেই চোখে। মফিজ সাহেবের মনেও তৃপ্তি জাগত সারাজীবনে স্ত্রীর একটা সখ অন্তত পূরণ করতে পেরেছেন ভেবে।
সেই বাগান এখন অবহেলা, অযত্নে পড়ে আছে। গাছগুলোয় পানি দেওয়া হয়নি আজ কতদিন। মফিজ সাহেব হাতের আঙুলে তারিখ গোনেন, সাত, আট, নয়। আজ উনত্রিশ! তেইশ দিন হয়ে গেছে তাহমিনা যাওয়ার। অথচ যাওয়ার দিনও বোঝা যায়নি চলে যাবে। দুই তিন দিন জ্বর ছিল। করোনার কারণে বাড়ির কাজের লোকদের বিদায় করে দিয়েছিল। বাইরের কোনো লোককে বাসায়ও ঢুকতে দিতো না। নিজ হাতে সংসারের সব সামলাতো।
মফিজ সাহেব এটা পছন্দ করতেন না। স্ত্রীর নিষেধ সত্ত্বেও দুই দিন বাজারে গিয়ে মাছ মাংস কিনে এনেছিলেন। এই নিয়ে তাহমিনার কত রাগ, কিছু একটা হয়ে গেলে কী হবে?
মফিজ সাহেব হেসে বলেছেন, দেখো, কিচ্ছু হবে না আমার। সত্যি, মফিজ সাহেবের কিছু হয়নি। তাহমিনার জ্বর এসেছিল। সংসারের সব কাজ একা সামলাচ্ছে, বেশি পানি টানি ধরা হচ্ছে, তাই হয়তো জ্বর এসেছে ভেবেছিলেন স্বামী-স্ত্রী দুজনেই। অথচ জ্বরের চারদিনের মাথায় রাতে শ্বাসকষ্ট শুরু হলে বড় ছেলেকে জানান। অ্যাম্বুলেন্সে করে তাহমিনাকে হসপিটাল নেওয়া হয়। মফিজ সাহেব বয়স্ক মানুষ বলে, ছেলে তাকে সঙ্গে যেতে নিষেধ করে। মফিজ সাহেব যাননি। তাহমিনাও আর আসেনি।
নিজেরা ঘুরবে, আউটিং এই যাবে-সব ব্যাপারেই আমার বাসায় থাকাটা একটা ইস্যু হয়ে উঠবে। না তখন তোমরা ভালো থাকবে, না আমি!
কোভিড আক্রান্ত মৃত কে হাসপাতাল থেকেই সোজা কবরস্থানে রেখে এসেছে ছেলে। এভাবে হুট করে তাহমিনা চলে যাবে ভাবতেও পারেননি মফিজ সাহেব। নিজেকে সেবা করার কোনো সুযোগই দিলো না তাহমিনা। আজকাল চিকিৎসা ব্যয়বহুল। সঞ্চিত যা সামান্য ছিল, তা দিয়ে ছোট ছেলের বিদেশ যাওয়ার সখ পূরণ করায় তাহমিনা খুব রাগ করেছিল, কেঁদেওছিল। তোমার বা আমার কোনো অসুখ হলে বিনা চিকিৎসায় মরবো। দেখো। কেঁদে কেঁদে বলেছিল, আমার জন্য ভাবি না। কিন্তু তোমার বিনা চিকিৎসায় রোগভোগে মরা আমার সহ্য হবে না।
তাহমিনার কথা মনে করে মফিজ সাহেব হেসে ফেলেন। তাহমিনা তো চিকিৎসা করার সুযোগই দিলো না। অবশ্য সুযোগ দিলেও কি মফিজ সাহেব ঠিকঠাক চিকিৎসা করাতে পারতেন? হাতে তো মাসিক পেনশনের টাকা ছাড়া একটা বাড়তি টাকাও নেই। হয়তো ছেলে চিকিৎসা করাতো। বাবা-মায়ের প্রতি কর্তব্য পালন করত ঠিকই। এভাবেই তো শিক্ষা দিয়েছেন সন্তানদের।
চার.
শরীরটা আজকাল ভালো যাচ্ছে না। একটা মহিলা এসে রান্নাবান্না সহ প্রয়োজনীয় কাজ করে দিয়ে যায়। তাহমিনার আমল থেকেই তার এ বাড়িতে আসা যাওয়া। বাজার সদাই ও তাকে দিয়েই করান মফিজ সাহেব। আসলে শরীর যতটা না দুর্বল। মনটা তারচে বেশি ভেঙে পড়েছে তার। তাহমিনার চলে যাওয়াটা তাকে একদম একা আর নিঃসঙ্গ করে দিয়ে গেছে।
পড়শী কারও কারও সঙ্গে আগে এলাকায় নতুন খোলা মার্কেটের নিচে চা-দোকানে বসে গল্পটল্প করতেন। সেটায়ও আজকাল যান না। মানে যেতে ভালো লাগে না। বিছানায় শুয়ে থাকেন। একা একা স্মৃতিচারণ করেন। মাঝে মাঝে বাগানের মলিন শীর্ণ গাছগুলোর গায়ে হাত বুলিয়ে তাহমিনার স্পর্শ অনুভব করেন। কখনো মন চাইলে গাছগুলোয় পানি দিয়ে আসেন। শেষ কবে যে খবর দেখার জন্য টিভি অন করেছিলেন, মনেও পড়ে না।
মেয়েরা ফোন করে, খবর নেয়। আগের মতোই। কিন্তু মফিজ সাহেবের মনে হয় তারা আগে আরো ঘন ঘন ফোন দিতো! ছোট ছেলে বলেছে একটু গুছিয়ে উঠলেই সে বাবাকে তার কাছে নিয়ে যাবে। বাবাকে একা পড়ে থাকতে দেবে না! বড় ছেলে মাঝে মাঝেই সপরিবারে চলে আসে বাবাকে তার বাসায় নিয়ে যেতে নাতিদের দিয়ে জোরাজুরি করে। মফিজ সাহেব মন খারাপ করে বলেন, জীবনের প্রায় সবটাই তো ফ্ল্যাট বাড়িতে, একশ’ একটা নিয়ম কানুন মেনে কাটিয়েছি। জীবনের শেষটুকু থাকি না একটু নিজের মতো, স্বাধীন।
বাবার কথা শুনে ছেলে বিরক্ত হয়। তুমি জানো বাবা, তোমাকে এখানে রেখে আমাদের কত টেনশন হয়? সব সময় একটা দুর্ভাবনা মাথায় ঘোরে। তারচে তুমি আমাদের সাথে চলো। আমরা এক সাথে থাকব। তোমার কোনো অসুবিধা হবে না।
এ বাড়িটা এভাবে রেখে গেলে বেদখল হয়ে যাবে।
এভাবে ফেলে রাখবা কেন? ডেভেলপারকে দিয়ে দাও। ফ্ল্যাট পাবে সাথে নগদ টাকাও। পাঁচ কাঠা জায়গা। চার ইউনিটের ফ্ল্যাট হয়েও সামনে বাগান করার জায়গা থাকবে। তুমি চাইলে ডেভেলপারের সাথে কথা বলতে পারি।
যতদিন বেঁচে আছি এ বাড়ি হাতছাড়া করব না। মনে মনে ভাবেন মফিজ সাহেব। সন্তানদের সব সম্পত্তি লিখে দিয়ে শেষ বয়সে অন্যের কাছে হাত পাততে অনেককেই দেখেছেন। অনেককে দেখেছেন সব দিয়ে দেওয়ার পর সন্তানদের কাছে বোঝা হয়ে উঠতে। বাড়ি ডেভলপারের হাতে দিলে সেটা তৈরি হতে যে সময় লাগবে, যদি মরে না যান ততদিন কোথায় থাকবেন? যদিও জানেন, তার ছেলেরা কখনোই তার সঙ্গে অন্যায় করবে না। কিন্তু মানুষের বদলে যেতে কতক্ষণ?
শেষ বয়সে আশ্রয়হীন হয়ে পথে পথে ঘুরতে পারবেন না তিনি! তাছাড়া, তাহমিনাকে তিনি কথা দিয়েছেন, যত প্রয়োজনই হোক এই বাড়ি কোনোদিন বিক্রি করবেন না।
ছেলের কথায় মফিজ সাহেব রাজি হন না। ছেলের বউয়ের কথাও সুকৌশলে এড়িয়ে যান। অগত্যা ছেলে তার বোনদের শরণাপন্ন হয়। বোনেরাও বাবাকে ভাইয়ের বাসায় গিয়ে থাকতে বলে। বাড়ি বাড়ির জায়গায় যেমন আছে তেমনি থাকবে। ডেভেলপারকে দেওয়া হবে না। মাঝে মাঝে তিনি ছেলের সঙ্গে এসে সব কিছু দেখে যাবেন।
মফিজ সাহেব তবু রাজি হন না। বলেন দেখো বাবা খুব বেশি অসুস্থ হলে তো তোমার বাসায় গিয়ে আমাকে উঠতে হবেই। তোমাদের সাজানো সংসারে আমি বুড়ো মানুষটা গিয়ে উঠলে তোমাদের মেলা সমস্যা হবে। হয়ত ট্যুরে যাবে, আমি বাসায় একা থাকব ভেবে যেতে পারবে না। নিজেরা ঘুরবে, আউটিং এই যাবে-সব ব্যাপারেই আমার বাসায় থাকাটা একটা ইস্যু হয়ে উঠবে। না তখন তোমরা ভালো থাকবে, না আমি!
শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় গাড়ির জানলা দিয়ে নিজের বাড়ির গাছপালা ক্রমশ সরে গিয়ে ধূসর আকাশটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আর খোলা দরজা দিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার শূন্য ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে শুরু করলো।
মফিজ সাহেব বিচক্ষণ মানুষ। তার কথা শুনে ছেলে চুপ করে থাকে। বাবাকে ভালোবাসার আবেগের পাশে কঠিন একটা বাস্তবতা চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে ওঠে। তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরি করে, ভালো গৃহকর্মী পাওয়া আজকাল খুবই কঠিন। তার স্ত্রী যত ভালোই হোক চাকরি করে সংসার সামলে বাবার দেখাশোনা সে কিভাবে করবে! বাবার কথাই ঠিক, খুব অসুস্থ হলে বাবা তখন ছেলের বাসায় চলে যাবেন। নিজের যেতেও হবে না। জাস্ট একটা ফোন দিলেই চলবে। ছেলে নিজে চলে আসবে বাবাকে নিতে!
পাঁচ.
প্রায় বছর ঘুরে আসতে চললো তাহমিনার মৃত্যুর। অতীত আর স্ত্রীর স্মৃতিচারণ, সন্তানদের দীর্ঘ ফোনে কথোপকথন; বিকেলটা বারান্দায় বসে আমির আলীর (বাগানে কাজ করার জন্য একটা লোক রেখেছেন মফিজ সাহেব) মাটি কোপানো, সার পানি দেওয়া, আগাছা সাফ দেখে আর তার সঙ্গে কিছু কথা বলে ভালোই কাটছে মফিজ সাহেবের দিন। তবে বিশ্বের অন্য সব দেশের মতো দেশেও করোনা পরিস্থিতি ভয়াবহ। বড় ছেলে তাই দীর্ঘদিন আসতে পারছে না। মোবাইলে কথা হয় অবশ্য।
লোকজন সবাই মুখে মাস্ক পরে থাকে। কাউকে দেখে সহজে চেনা যায় না। মফিজ সাহেব ভাবেন কী যুগ এলো। এমন ভয়াবহ দুর্যোগের মুখোমুখি হতে পারে এ পৃথিবী এমন কথা কি ভেবেছিলেন কোনোদিন?
ছেলে-মেয়েরা ফোনে বারবার সাবধান করে। নিয়ম মানার কথা বলে। বাইরে যেতে নিষেধ করে। বাইরের লোক বাড়িতে প্রবেশ করাতে নিষেধ করে। বাইরে তো যানই না। তবে বুয়া, মালি না এলে কিভাবে চলে?
প্রতি রাতের নামাজে দীর্ঘসময় মোনাজাত করেন মফিজ সাহেব। কিন্তু আজ শরীরটা বড্ড ক্লান্ত লাগছে। কোনোমতে নামাজ শেষ করে একগ্লাস পানি খেয়ে শুয়ে পড়লেন। টেবিলে রাখা খাবার গুলোর দিকে ফিরেও দেখলেন না। রাতে প্রচণ্ড জ্বর এলো। বিছানা থেকে উঠতে পারছেন না এমন। পরদিন সকালে কাজের বুয়া এসে মফিজ সাহেবের অবস্থা দেখে ভয় পেয়ে পাড়ার লোকদের খবর দিলে প্রায় আট দশ বছর এলাকায় থাকায় পরিচিত জনেরা এগিয়ে এলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে। বোধহীন মফিজ সাহেবকে নিয়ে কী করবে, তা নিয়ে আলোচনা চললো কিছুক্ষণ। খাবার ঘরে চেয়ারের ওপর চার্জহীন মোবাইলটা কারও চোখে পড়লো না। তাই ছেলেকে তৎক্ষণাৎ জানানোও গেলো না।
অবশেষে পাড়ার কয়েকজন যুবক স্থানীয় হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে চেতন-অবচেতনের মাঝামাঝি মফিজ সাহেবকে অ্যাম্বুলেন্সে তুলে দিলো। মুখে অক্সিজেন-মাস্ক পরিয়ে দিতে মফিজ সাহেব ঘোর লাগা চোখ মেলে চাইলেন।
সাইরেন বাজিয়ে অ্যাম্বুলেন্স ছুটতে শুরু করেছে। শেষ বিকেলের ম্লান আলোয় গাড়ির জানলা দিয়ে নিজের বাড়ির গাছপালা ক্রমশ সরে গিয়ে ধূসর আকাশটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আর খোলা দরজা দিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার শূন্য ঘরের ভেতর প্রবেশ করতে শুরু করলো।