(পর্ব-চার)
আনন্দ পাবলিশার্স থেকে ২০০৭ সালে প্রকাশিত ‘বাঙালনামা’র লেখক তপন রায় চৌধুরী ছিলেন জমিদার পরিবারের সন্তান। আদি বাড়ি বরিশালে, জন্মে ছিলেন নানাবাড়ি কুমিল্লায়, ১৯২৬ সালে। দেশভাগ এই জমিদার পরিবারটিকে স্থায়ী করে দেয় কলকাতায়।
‘বাঙালনামা’য় তপন রায় স্মৃতিচারণ করেছেন এভাবে—‘‘বরিশালের গ্রামগুলোতে তখন প্রায় প্রতিটি সম্পন্ন শিক্ষিত পরিবারে বইয়ের বিশাল সংগ্রহ ছিল। এসব পরিবার এবং গ্রামের স্কুলগুলোকে কেন্দ্র করে একটি সাংস্কৃতিক আবহ গড়ে উঠেছিল। উনিশ শতকে যে পশ্চিমি শিক্ষার শুরু হয়—বাঙালি জীবনে তার একটি মহৎ দান বিশ্ব সংস্কৃতি সম্বন্ধে কৌতূহল। ১৯১৭ সালে স্যাডলার কমিশন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন করে মন্তব্য করে যে, ‘শিক্ষিত বাঙালি যুবক শুধু নিজের দেশে কী হচ্ছে জেনে তুষ্ট না—লন্ডন, প্যারিস, নিউইয়র্কে জ্ঞানের জগতে কী হচ্ছে, সে খবর জানার জন্য দুরন্ত আগ্রহী।’ বরিশালের শিক্ষিত মহলে এই প্রবণতা স্পষ্টতই নজরে আসতো। বরিশালের স্থানীয় দোকানগুলোতে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসসহ বিদেশি ভাষার বই পাওযা যেত। ফরাসি ভাষার বই এবং ফরাসি জানা লোকও বরিশালে দুর্লভ ছিল না। বহু বিদ্যাব্রতী ব্যক্তি জাগতিক সব দুঃখ-কষ্ট মেনে নিয়ে কেবল জ্ঞানচর্চাকেই তাদের জীবনের লক্ষ্য বানিয়েছিলেন। সমাজ কাঠামোর মূলে এ ধরনের মানুষের অস্তিত্ব সমাজের ভিতকে মজবুত করেছিল—এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। উর্বর ভূমি বরিশালের মানুষের হাতে অবসর ছিল, আর সে অবসর কেবল গল্প-আড্ডায় কাটতো না। উচ্চাঙ্গের সাহিত্য-সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি—সবই ছিল আড্ডার আলোচ্য বিষয়।’’
লেখক তপন রায় চৌধুরীর এই বক্তব্যের সমর্থন পাওয়া যায় লেখক, রাজনীতিক, কূটনীতিক ও আইনজীবী কামরুদ্দীন আহমদের লেখায়। তার ‘বাংলার মধ্যবিত্তের আত্মবিকাশ’ গ্রন্থটির প্রথম খণ্ড লিখেছিলেন ১৯৭১ সালে কারাবন্দি অবস্থায়। শুনুন তার বয়ানে, ‘‘আমার আজ যার কথা বেশি মনে পড়ে, তিনি হচ্ছেন শায়েস্তাবাদের নবাবজাদা সৈয়দ মোহাম্মদ হুসেন সাহেব। তিনি ছিলেন এক অদ্ভুত চরিত্রের মানুষ। তিনি যখনই বিকালে সান্ধ্যভ্রমণে বেরোতেন, তখন তার পরনে থাকতো খাকি হাফ প্যান্ট, সাদা হাফ শার্ট, মাথায় সোলার হ্যাট, হাতে বেরানোর লাঠি, সঙ্গে একটি বিলাতি কুকুর। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও ডিগ্রি তার ছিল না—কিন্তু সে যুগে এমন কোনও ইংরেজি বই নাই যা তিনি পড়েননি, অবশ্যই ওল্ড ইংলিশ থেকে চসার ল্যাংল্যান্ড পর্যন্ত ইংরেজি সাহিত্যের যুগটা বাদ দিয়ে। প্রতিটি বইয়ের নানা ধরনের সংস্করণ তার পাঠাগারে পাওয়া যেত—বিশেষ করে, মরক্কো লেদারের কভার পাতলা ইংরেজি কাগজের সংস্করণ তিনি বেশি পছন্দ করতেন। বিকাল বেলা নদীর তীরে বেড়ানো ছাড়া প্রায় সমস্ত দিনই বইয়ের মধ্যে ডুবে থাকতেন। ডিকেন্স ও থ্যাকারের অনেক সুন্দর মরক্কো বাইডিং বই তিনি আমাকে পড়তে দিয়েছিলেন—সঙ্গে কেমব্রিজ হিস্টোরি অব ইংলিশ লিটারেচার। তার দেওয়া শেকসপিয়ারের পকেট এডিশন আজও অনেকগুলো আমার কাছে আছে।’’
‘নারী’ গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করার গুজব ছড়িয়ে পড়লে সাংবাদিকদের কাছ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য হুমায়ুন আজাদ ছুটে গিয়েছিলেন প্রেস ক্লাবে। সেখানে গিয়ে স্বভাবসুলভ তর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি।
কামরুদ্দীন আহমদ আরও লিখেছেন, ‘‘নবাবজাদা সম্বন্ধে অনেক কিংবদন্তি ছিল। আমার জানামতে, একটা ঘটনা তার মুখ থেকে শোনা, তা উল্লেখ না করে পারছি না। বিলেতের নাম করা সব পাবলিশারের কাছে তার চিঠি দেওয়া ছিল যে, ইংরেজি সাহিত্যের যেকোনো বই প্রকাশিত হওয়া মাত্র তাকে এক কপি ‘সারফেস মেইল’ এ পাঠাতে হবে। একদিন হঠাৎ স্টেটসম্যনস-এর পুস্তক সমালোচনা পাতায় একটি পুস্তকের সমালোচনা দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলেন যে, তার কাছে সে বই এসে পৌঁছায়নি। তিনি পরের দিন কলকাতায় গিয়ে ইম্পেরিয়াল লাইব্রেরিতে বইটির খোঁজ করেন— কিন্তু বইটা সেখানেও পৌঁছায়নি। তারা তাকে বললেন যে, শায়েস্তাবাদের নবাবজাদার ওখানে যেন খোঁজ নেন। নবাবজাদা খুব সহজভাবে বললেন, ‘অত্যন্ত দুঃখের বিষয় বইটি আমার লাইব্রেরিতেও এসে পৌঁছায়নি।’ লাইব্রেরির কর্মচারীরা একেবারে থ বনে গেলেন। নবাবজাদার নাম ও খ্যাতি যদিও তারা শুনেছেন, কিন্তু চাক্ষুষ তাকে দেখার সোভাগ্য তাদের হয়নি—তারা তাকে ঘরে এসে বসতে বললেন, কিন্তু তার যেন সময় নেই। বললেন, ‘দেখি, স্টেটসম্যান অফিসে তাদের কাছে কপিটা আছে কি না।’ এই বলে ট্যাক্সিতে উঠে চলে এলেন স্টেটসম্যান অফিসে। সেখানে সম্পাদক সাহেব তার খবর পেয়ে তাকে ঘরে নিয়ে গেলেন এবং জানালেন যে, রিভিউ তাদের কাছে লন্ডন থেকে এসেছিল, বইটি তাদের কাছে নেই। বরিশালে ফিরে এলেন। তার কিছুদিন পরে পাবলিশারের কাছ থেকে বইটা পেলেন। তৎকালীন মুসলিম সমাজের মধ্যে তিনিই ছিলেন সত্যিকার সাহিত্যানুরাগী।’’
প্রসঙ্গত, নবাবজাদা সৈয়দ মোহাম্মদ হুসেনের নিজের সংসার ছিল না। তাই তার ভাই সৈয়দ নেহাল হুসেনকে বিয়ে দিয়ে সংসার সৃষ্টি করেন। এই নেহাল হুসেনের স্ত্রী ছিলেন সুফিয়া বেগম, যিনি বিয়ের পর হলেন সুফিয়া নেহাল হুসেন। নেহাল হুসেন অল্প বয়সে মারা গেলে সুফিয়া আবার বিয়ে করেন কামাল উদ্দিনকে। এবার তার নাম হলো সুফিয়া কামাল, পরে যিনি কবি সুফিয়া কামাল নামে পরিচিতি পান।
এই লেখার গত পর্বে জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক এবং অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদকে উদ্ধৃত করেছিলাম। এই দুই গুণী ব্যক্তিকে পুনরায় উদ্ধৃত করছি। যদিও তাদের এই উদ্ধৃতি ভিন্ন। অধ্যাপক রাজ্জাক লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বাবধানে যে পিএইচডি শুরু করেছিলেন, তার বিষয় ছিল ‘অবিভক্ত ভারতের রাজনৈতিক দল’। তিনি অভিসন্দর্ভটি জমাও দিয়েছিলেন। কিন্তু ভুলবশত কিছু রেফারেন্স উল্লেখ করেননি। সেটি সম্পন্ন করে পুনরায় থিসিসটি জমা দিতে বলেছিলেন তার শিক্ষক। কিন্তু রাজ্জাক পিএইচডির মায়া তুচ্ছ করে দেশে চলে আসেন। এ তথ্য অনেকেরই জানা। তার এই আলসেমির কারণেই সেই অভিসন্দর্ভটি আজও বই আকারে প্রকাশিত হয়নি। তবে তার একটি নির্বাচিত অংশ মূল ইংরেজিতে ‘নিউ ভ্যালু’ সাময়িকীতে (বাংলা ১৩৮৪) প্রকাশ করেছিলেন খান সারওয়ার মুরশিদ। ২০১৫ সালে অধ্যাপক রাজ্জাকের শততম জন্মবার্ষিকীতে সেই নির্বাচিত অংশটি ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে প্রতিচিন্তা। রাজ্জাক থিসিসের এক জায়গায় উল্লেখ করেছেন—‘ভারত ভাগ হলো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস ও নিখিল ভারত মুসলিম লীগের আপসহীন বিরোধের পরিণাম।’
ভারতে আজও রণ-সংগীত হিসেবে ‘বন্দে মাতরম’ জনপ্রিয়তার মাপকাঠিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এই সংগীতের রচয়িতা বঙ্কিম চন্দ্র এবং ‘বন্দে মাতরম’ গানটি সম্পর্কে আব্দুর রাজ্জাকের গুরুত্বপূর্ণ মূল্যায়ন হচ্ছে, ‘ইতিহাসের স্মৃতি পাঠ্যবইয়ের চেয়ে আরও বেশি লালিত হয় কল্পনাশ্রয়ী রচনার দ্বারা। দুর্ভাগ্যক্রমে উনবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে শক্তিশালী বাঙালি লেখক বঙ্কিম চন্দ্র তার প্রায় সব লেখাতে ইচ্ছাকৃতভাবে হিন্দু-মুসলমানের উত্তেজনা উসকে দেওয়ার জন্য কলম ধরেছিলেন। ১৮৬৫ সালে তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশের পর থেকে আজ পর্যন্ত বঙ্কিম বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বেশি পঠিত লেখক। রামমোহন রায় থেকে বিবেকানন্দ পর্যন্ত ধর্মীয় চিন্তা ও আচারাদির সংস্কারে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদিত অন্য মনীষীদের মধ্যে বঙ্কিম উনবিংশ শতাব্দীর সৃষ্টিশীল কর্মক্রিয়ায় সবচেয়ে উজ্জ্বল।’
রাজ্জাকের মতে, ‘‘তার ‘বন্দে মাতরম’ গানটি এখন পর্যন্ত ভারতীয়দের চিন্তায় ও মননে তার যে স্থান তারই স্থায়ী স্মৃতিসৌধ। গানটি তার সবচেয়ে পঠিত উপন্যাস ‘আনন্দমঠে’ স্থিত। আনন্দমঠ একটি অত্যন্ত আবেগাশ্রিত উপন্যাস। যার বিষয়বস্তু একটি হিন্দু-মুসলিম বিবাদ। বাংলা ভাষায় এটি প্রথম রাজনৈতিক বিষয়বস্তুসংবলিত সাহিত্যকীর্তি। এই মাতৃ-বন্দনা (বন্দে মাতরম) অবিশ্বাসী মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে গমনোদ্যত হিন্দু ‘সন্তানদের’ সমর-সংগীত। উপন্যাসটি এমন একজন প্রভাবশালী লেখকের সৃষ্টি, যিনি তার সমস্ত শক্তি নিয়োগ করেছেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে একটি ঘৃণা-স্তোত্র রচনার জন্য। উপন্যাসটি ১৮৮২ সালে প্রকাশিত হয়, ভারতীয জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন বসার তিন বছর আগে।’’
‘নারী’ গ্রন্থটি নিষিদ্ধ করার গুজব ছড়িয়ে পড়লে সাংবাদিকদের কাছ থেকে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য হুমায়ুন আজাদ ছুটে গিয়েছিলেন প্রেস ক্লাবে। সেখানে গিয়ে স্বভাবসুলভ তর্কে জড়িয়ে পড়েন তিনি। ঘটনাটি শুনুন সাংবাদিক মারুফ কামাল খানের বয়ানে— ‘‘আমরা জাতীয় প্রেসক্লাবের বাইরের লাউঞ্জে বসে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছিলাম সন্ধ্যার পর। হঠাৎ করেই এসে হাজির হলেন হুমায়ুন আজাদ। বসেই বললেন, ‘সাংবাদিকদের কাছে জানতে এলাম আমার কোনো একটা বই নাকি নিষিদ্ধ করা হয়েছে?’ আমি মোজাম্মেল ভাইকে দেখিয়ে দিলাম। বললাম, ‘উনি বলতে পারবেন। উনি হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার প্রেসসচিব মোজাম্মেল হক।’ মোজাম্মেল ভাই আমার দিকে রাগ হয়ে তাকালেন, ‘আমি কি এসব খবর নিয়ে ঘুরি? ভাইরে, আমারে ধরাইয়া দিলেন? দিলেন তো আড্ডাটা মাটি করে। বই নিষিদ্ধ হলে তো সরকার নিজেই তথ্যবিবরণী দিয়ে জানাবে। রেডিও-টিভিতে খবর দেবে। এরজন্য প্রেসক্লাবে এসে খোঁজ নেওয়ার দরকার আছে?’’
মাহমুদ শফিক আরও কড়া করে কিছু একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলেন। আমরা কয়েকজন হুমায়ুন আজাদকে আর দাঁড়াতে না দিয়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিদায় জানালাম
মারুফ কামাল খানে আরও লিখছেন, ‘‘বিরক্ত হলেও মোজাম্মেল হক সেলফোনে দুই-তিন জায়গায় ফোন করে খবর নিলেন। তারপর বললেন, ‘না, আপনার কোনো বইটই নিষিদ্ধ হয়নি। তবে তসলিমা নাসরিন নামে এক মাতারি আছে না? সে কী একটা লিখেছে ‘লজ্জা’ নামে। যার নিজেরই কোনো লজ্জা নাই, সে আবার লিখেছে লজ্জা। ওইটা নিষিদ্ধ করেছে। একটু পর খবর হবে।’ হুমায়ুন আজাদ ‘ও আচ্ছা, ধন্যবাদ’ বলে উঠে পড়লেন। মোজাম্মেল ভাইয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বললেন, ‘‘আপনার ওই ‘মাতারি’ শব্দের ব্যবহারটা ভালো লাগলো না।’’ মোজাম্মেল ভাই বললেন, ‘কেন? অভিধান খুলে দেখেন, মাতারি শব্দের কোনো মন্দ অর্থ আছে কি না।’ হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘আমি এদেশের একমাত্র ভাষাবিজ্ঞানী। আপনি আমাকে শব্দের অর্থ অভিধান খুলে দেখতে বলছেন? আপনাকে জানতে হবে আভিধানিক অর্থের বাইরে শব্দের প্রায়োগিক অর্থও থাকে। মাতারি শব্দের প্রায়োগিক অর্থ ইতিবাচক নয়। এটা তুচ্ছার্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। আপনিও তুচ্ছার্থেই ব্যবহার করেছেন। এখন তর্কের খাতিরে আভিধানিক অর্থের কথা বলছেন।’ মোজাম্মেল ভাই হাঃ হাঃ করে হাসলেন। বললেন, ‘আপনি কি মনোবিজ্ঞানীও? আমি একটা শব্দ তুচ্ছার্থে নাকি উচ্চার্থে ব্যবহার করেছি, সেটাও আপনি জেনে ফেলেছেন? আর বলেন দেখি ভাষাবিজ্ঞানী জিনিসটা কী? সেন রাজাদের মতে, বাংলা হৈলো গিয়া পক্ষীকূলের একটা ভাষা। সেইটার আবার বিজ্ঞানী আপনি? আপনারে এই বিজ্ঞানী খেতাব কে দিছে? ভাষামিস্ত্রী বললেও মানতে পারতাম।’ ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের মাধ্যমে নিজেকে উন্নাসিক হিসেবে জাহির করতে সিদ্ধহস্ত অধ্যাপক কিন্তু ততক্ষণে বুঝে ফেলেছেন যে, আজ তারই মতোন আরেক উন্নাসিকের পাল্লায় পড়েছেন। তাই তিনি আর তর্ক না বাড়িয়ে ‘যে যেমন বুঝে’ বলে পা বাড়াতেই মাহমুদ শফিককে দেখে থামলেন। আসলে হুমায়ুন আজাদের মনে হয় সেদিন ‘জোড়া কপাল খারাপ’ ছিল।
মাহমুদ শফিক বিশিষ্ট কবি এবং সাংবাদিক সমাজে আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়েছেন তিনি। সেই সুবাদে হুমায়ুন আজাদ হয়তো তাকে ছাত্রই জ্ঞান করতেন। মাহমুদ শফিক অবশ্য হুমায়ুন আজাদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার আগেই পাস করে বেরিয়ে যান। তার আগে হুমায়ুন আজাদের নাম ছিল হুমায়ুন কবির। এফিডেবিট করে নাম বদলে হুমায়ুন কবির ‘আজাদ’ হয়েছিলেন। ‘স্যার, চা খান।’ সালাম দিয়ে বললেন মাহমুদ শফিক। ‘না, চা আমি খেয়েছি। তা আপনি কেমন আছেন শফিক? অনেক দিন পরে দেখা। জানতাম আপনি সাংবাদিকতার পাশাপাশি টুকটাক কবিতা-টবিতাও লেখেন। ইদানিং শুনতে পাচ্ছি আপনি নাকি গান-টানও লিখছেন?’ মাহমুদ শফিক বললেন, ‘জ্বি স্যার। আমি শতাধিক হিট গানের গীতিকার। দেশের সেরা শিল্পীরা আমার গান করেন। শ্রেষ্ঠ সব সুরকার সুর দিয়েছেন আমার লেখা গানে। রেডিও-টিভিতে কুড়ি বছর ধরে আমি ‘এ’-গ্রেড গীতিকার হিসেবে এনলিস্টেড।’ হুমায়ুন আজাদ তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ব্যঙ্গাত্মক হাসলেন। বিদ্রূপভরা কণ্ঠে বললেন, ‘কিন্তু এ দু’টোকে মেলান কী করে? কবিতা রচনা ও গান লেখা! কবিতা একটা অতি নান্দনিক, সুকুমার শিল্পের চর্চা। আর গান-টান লেখা মানে তো আমার কাছে ইট ভাঙার মতোন একটা ব্যাপার।’
মাহমুদ শফিক এবার সত্যিই চটলেন। বললেন, ‘আপনি যে এতটাই মূর্খ, তা তো আগে বুঝিনি। বাংলাভাষায় রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের মতোন কবিরা সবাই কালজয়ী গীতিকারও। গানের লিরিকও যে সেরা গীতিকবিতা হতে পারে, সেটাও আপনি জানেন না?’ হুমায়ুন আজাদ বললেন, ‘গীতিকবিতা ও লিরিক এই বিষয়গুলো তো আমি পড়াই। আপনি আমাকেই ওগুলো শেখাচ্ছেন? আর রবি ঠাকুর বা নজরুল গান লিখলেই সেগুলো খুব ভালো কিছু হয়েছে বলে মানতে হবে? ওগুলোর কথা-টথা ও বাণী আসলে কিচ্ছু হয়নি। বেশির ভাগই অতিশয় নিচুমানের। কেবল সুর-সংযোগের কারণে উৎরে গেছে।’
মাহমুদ শফিক আরও কড়া করে কিছু একটা জবাব দিতে যাচ্ছিলেন। আমরা কয়েকজন হুমায়ুন আজাদকে আর দাঁড়াতে না দিয়ে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে বিদায় জানালাম।’’
বি. দ্র: ‘বইয়ের সঙ্গে বন্দুত্ব’ লেখার দ্বিতীয় পর্বটি পড়ে সিডনি থেকে সাংবাদিক আতিকুর রহমান গত ১৬ জুলাই লিখেছেন, ‘আজীবন বই পড়তে চেয়েছি, এখনো চলছে। যখন হাতে টাকা ছিল না, তখনো টাকা পেলে প্রথম কাজই ছিল বই কেনা। সিডনিতেও গড়ে তুলেছি ‘প্রশান্তিকা বইঘর।’
চলবে…
বইয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব-৩॥ আনোয়ার পারভেজ হালিম